মারওয়ান্ সৈন্যসহ মদিনায় আসিলেন। অলীদের মুখে সবিস্তারে সমস্ত শুনিলেন। হাসানের মৃত্যুর পর হোসেন অহোরাত্র ‘রওজা শরিফে’ বাস করিতেছেন, এ কথায় মারওয়ান্ অত্যন্ত চিন্তিত হইলেন। পবিত্র রওজায় যুদ্ধ করা নিতান্তই দুর্বুদ্ধিতার কার্য; সে ক্ষেত্রে যুদ্ধ করিতে সাহসও হয় না! যুদ্ধে আহ্বান করিলেও হোসেন কখনোই তাঁহার মাতামহের সমাধিস্থান পরিত্যাগ করিয়া অগ্রসর হইবেন না। মারওয়ান্, বিশেষরূপে এই সকল কথার আন্দোলন করিয়া অলীদকে জিজ্ঞাসা করিরেন, “ভাই! ইহার উপায় কী? আমার প্রথম কার্য হোসেনের মুণ্ড লাভ, শেষ কার্য তাহার পরিবারকে বন্দি করিয়া দামেস্কনগরে প্রেরণ। হোসেনের মস্তক হস্তগত না হইলে শেষ কার্যটি সম্পন্ন হওয়া অসম্ভব।” কী উপায়ে হোসেনকে মোহাম্মদের সমাধিক্ষেত্র হইতে স্থানান্তরিত করিবেন, এই চিন্তাই এখন তাহাদের প্রবল হইয়া উঠিল। অনেক চেষ্টা-অনেক কৌশল করিয়াও কিছুতেই কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। একদিন মারওয়ান্ ওত্বে অলীদের সহিত পরামর্শ করিয়া উভয়েই ছদ্মবেশে নিশীথ সময়ে পবিত্র রওজায় উপস্থিত হইলেন। রওজামধ্যে প্রবেশের পথ নাই, বিশেষ অনুমতিও নাই। রওজার চতুষ্পার্শ্বস্থ সীমানির্দিষ্ট রেল ধরিয়া হোসেনের তত্ত্ব ও সন্ধান জানিতে লাগিলেন। হোসেন ঈশ্বরের উপাসনায় মনোনিবেশ করিয়াছেন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত উভয়ে ঐ অবস্থাতেই রেল ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। উপাসনা সমাধা হইবামাত্রই ছদ্মবেশী মারওয়ান বলিলেন, “হজরত! আমরা কোন বিশেষ গোপনীয় তত্ত্ব জানাইতে এই নিশীথ সময়ে আপনার নিকট আসিয়াছি।”
হোসেন বলিলেন, “হে হিতার্থী ভ্রাতৃদ্বয়! কী গোপনীয় তত্ত্ব দিতে আসিয়াছেন? জগতে ঈশ্বরের উপাসনা ভিন্ন আমার আর কোন আশা নাই! গোপন তত্ত্বে আমার কী ফল হইবে?-আমি কোন গোপনীয় তত্ত্ব জানিতে চাহি না।”
ছদ্মবেশী মারওয়ান্ বলিলেন, “আপনি সেই তত্ত্বের সমুদয় বৃত্তান্ত শুনিলে অবশ্যই বুঝিতে পারিবেন যে, তাহাতে আপনার কোনরূপ ফল আছে কি না।”
হোসেন আগন্তুকের কিঞ্চিৎ নিকটে যাইয়া বলিলেন, “ভ্রাতৃগণ! নিশীথ সময়ে অপরিচিত আগন্তুকের রওজার মধ্যে আসিবার নিয়ম নাই। আপনারা বাহিরে থাকিয়াই যাহা বলিতে ইচ্ছা হয় বলুন।”
ছদ্মবেশী মারওয়ান্ বলিলেন, “আপনি আমাদের কথায় যদি প্রত্যয় করেন, তবে মনের কথা অকপটে বলি। আপনার দুঃখে দুঃখিত হইয়াই আমরা ছদ্মবেশে নিশীথ সময়ে আপনার নিকট আসিয়াছি। এজিদের চক্রান্তে জায়েদা যে কৌশলে ইমাম হাসানকে বিষপান করাইয়াছে, তাহার কোন অংশই আমাদের অজানা নাই! কি করি-কর্ণে শুনি, মনের দুঃখ মনেই রাখি, গোপনে চক্ষের জল অতি কষ্টে সম্বরণ করি। হাসানের বিষপানের বিষয় মনে হইলে হৃদয় ফাটিয়া যায়; চতুর্দিকে অন্ধকার বোধ হয়! এজিদের হৃদয় লৌহনির্মিত, দেহ পাষাণে গঠিত; তাহার দুঃখ কি! আমরা তাহার চাকর; কিন্তু নূরনবী মোহাম্মদের শিষ্য, আপনার ভক্ত। এই যে নিশীথ সময়ে শিবির হইতে বাহির হইয়া এত দূরে আসিয়াছি, কোন স্বার্থ নাই, কোন প্রকার লাভের আশা করিয়াও আসি নাই,-এজিদ্ কৌশলে আপনার প্রাণ লইবে,-ইহা আমাদের নিতান্তই অসহ্য। আমাদের অন্তরে ব্যথা লাগিয়াছে বলিয়াই আসিয়াছি।”
হোসেন বলিলেন, “প্রাণের একাংশ,-বিশেষ অগ্রগণ্য অংশ-সেই ভ্রাতাকে তাঁহার স্ত্রীর সহায়তায় এজিদ্ বিষপান করাইয়া কৌশলে মারিয়াছে, ইহার উপরে আর কী কষ্ট আছে? আমার প্রাণের জন্য আমি ভয় করি না।”
মারওয়ান্ বলিলেন, “প্রাণের জন্য আপনার যে কিছুমাত্র ভয় নাই তাহা স্বীকার করি। কিন্তু আপনার প্রাণ গেলে আপনার পুত্র-কন্যা-পরিবার, হাসানের পরিবার, ইহাদের কি অবস্থা ঘটিবে, ভাবুন দেখি। দুরন্ত জালেম এজিদ্! সে যে কি করিবে, তাহার মনই তাহা জানে; আর বেশি বিলম্ব করিতে পারি না। আমরা যে গুপ্তভাবে এখানে আসিয়াছি, এ কথার অণুমাত্র প্রকাশ হইলে আমাদের দেহ ও মস্তক কখনোই একত্র থাকিবে না। আজ ওত্বে অলীদ্ ও মারওয়ান্ এজিদের আদেশ মত এই স্থির করিয়াছে যে, এই রাত্রেই রওজা মোবারক ঘেরাও করিয়া আপনাকে আক্রমণ করিবে। পরিশেষে হাসনেবানু, জয়নাব এবং আপনার পরিবারস্থ যাবতীয় স্ত্রীলোককে বদ্ধ করিয়া বিশেষ অপমানের সহিত এজিদ্ সমীপে লইয়া যাইবে।”
হোসেন একটু রোষপরবশ হইয়া বলিতে লাগিলেন, “প্রকাশ্যভাবে যদি আমার মস্তক লইতে আসে, আমি তাহাতে দুঃখিত নই। আর ভাই, ইহাও নিশ্চয় জানিয়ো, আমি বাঁচিয়া থাকিতে ঈশ্বর কৃপায় আমার পরিবারের প্রতি-মদিনার কোন-একটি স্ত্রীলোকের প্রতি, কোন নরাধম নারকী জবারণে হস্তপে করিতে পারিবে না।”
মারওয়ান্ বলিলেন, “সেই জন্যই তো আপনার শিরচ্ছেদন অগ্রে করাই এজিদের একান্ত ইচ্ছা। এজিদ্ও জানিয়াছেন যে, হোসেন বাঁচিয়া থাকিতে আর কিছুই হইবে না। আপনি আজ রাত্রিতে এখানে কখনোই থাকিবেন না। হাজার বলবান্ ও হাজার ক্ষমতাবান হইলেও পাঁচ হাজার যোদ্ধার মধ্যে একা এক প্রাণী কি করিবেন? আপনি এখনই এ স্থান হইতে পলায়ন করুন। মারওয়ান গুপ্ত সন্ধানে জানিয়াছে যে, আপনি এই রওজা ছাড়িয়া কোনখানেই গমন করেন না; রাত্রিও শেষ হইয়া আসিল, আর অধিক বিলম্ব নাই। বোধ হয়, এখনই তাহার আক্রমণ করিবে। দেখুন! আপনার পরিবারগণের কুল, মান, মর্যাদা, শেষে প্রাণ পর্যন্ত এক আপনার প্রাণের প্রতি নির্ভর করিতেছে; আর বিলম্ব করিবেন না, আমরাও শিবিরাভিমুখে যাই; আপনি অন্য কোন স্থানে যাইয়া আজিকার যামিনীর মত প্রাণ রক্ষা করুন।”
হাস্য করিয়া হোসেন বলিলেন, “ভাই রে, ব্যস্ত হইও না। তোমাদের এই ব্যবহারে আমি বিশেষ সন্তুষ্ট হইলাম। তোমরা এজিদের পক্ষীয় লোক হইয়া গোপনে আমাকে এমন গুপ্ত সন্ধান জানাইলে-আশীর্বাদ করি, পরকালে ঈশ্বর তোমাদিগকে জান্নাতবাসী করিবেন। ভাই রে! আমার মরণের জন্য তোমরা ব্যাকুল হইও না, কোন চিন্তা করিয়ো না। আমি মাতামহের নিকট শুনিয়াছি, দামেস্ক কিংবা মদিনায় কখনোই কাহারো হস্তে আমার মৃত্যু হইবে না। আমার মৃত্যুর নির্দিষ্ট স্থান ‘দাস্ত কার্বালা’ নামক মহাপ্রান্তর। যতদিন পর্যন্ত সর্বপ্রলয়কর্তা, সর্বেশ্বর আমাকে কারবালা প্রান্তরে না লইয়া যাইবেন, ততদিন পর্যন্ত কিছুতেই কোন প্রকারে আমার মরণ নাই।”
মারওয়ান্ বলিলেন, “দেখুন! আপনার সৈন্যবল, অর্থবল কিছুই নাই; এজিদের সৈন্যগণ আজ নিশ্চয়ই আপনাকে আক্রমণ করিবে। আপনি প্রাণে মারা না যাইতে পারেন, কিন্তু বন্দিভূত হইতেই হইবে, তাহাতে আর কথাটি নাই। দাস্ত কার্বালা না হইলে আপনার প্রাণবিয়োগ হইবে না, এ কথা সত্য-কিন্তু এজিদের আক্রমণ হইতে রক্ষা পাইবেন কিসে? আপনার জন্যই মদিনা আক্রান্ত হইবে;-মদিনাবাসীরা নানাপ্রকার ক্লেশ পাইবে। যদিও তাহারা এজিদের সৈন্যগণকে একবার শেষ করিয়াছে, কিন্তু মারওয়ান্ এবারে চতুর্গুণ সৈন্য সংগ্রহ করিয়া দামেস্ক হইতে আসিয়াছে। আপনি যদি শত্রুহস্তে বন্দি হন, তাহা হইলে জীয়ন্তে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করিতে হইবে। আর বেশি বিলম্ব করিতে পারি না, প্রণাম করি। আমরা চলিলাম। যাহা ভাল বিবেচনা হয় করিবেন।”
লোকেরা চলিয়া গেল। হোসেন ভাবিতে লাগিল, “হায়! আজ পর্যন্ত এজিদের ক্রোধের উপশম হয় নাই। সকলই ঈশ্বরের লীলা! ঐ লোকটি যথার্থই ‘মোমেন’। এই নিশীথ সময়ে প্রাণের মায়া বিসর্জন করিয়া পরহিতসাধনে নিঃস্বার্থভাবে এতদূর আসিয়াছে! কি আশ্চর্য! বাস্তবিক ইহারাই যথার্থ পরহিতৈষী। মারওয়ান্ পুনরায় সৈন্য সংগ্রহ করিয়া মদিনায় আসিয়াছে। কি করি,-আমি যুদ্ধসজ্জা করিয়া শত্রুর সম্মুখীন হইলে মদিনাবাসীরা কখনোই নিরস্ত্র-নিশ্চেষ্ট হইয়া বসিয়া থাকিবে না, নিশ্চয়ই প্রাণ পর্যন্ত পণ করিয়া আমার পশ্চাদ্বর্তী হইবে। এখনও তাহারা শোকবস্ত্র পরিত্যাগ করে নাই; দিবারাত্র হাসানবিরহে দুঃখিত মনে-হা-হুতাশে সময় অতিবাহিত করিতেছে। এ সময় তাহাদের হৃদয় পূর্ববৎ সমুৎসাহিত, জন্মভূমি রক্ষার সুদৃঢ়পণে শত্রুনিধনে সমুৎসুখ ও সমুত্তেজিত হইবে কি না, সন্দেহ হইতেছে। কারণ দুঃখিত মনে, দগ্ধীভূত হৃদয়ে কোন প্রকার আশাই স্থায়িরূপে বদ্ধমূল হয় না। যতদিন তাহারা জীবিত থাকিবে, ততদিন ইমামের শোক ভুলিতে পারিবে না। এই শোকসন্তপ্ত হৃদয়ে সেই স্নেহকাতর ভ্রাতৃগণকে কী বলিয়া আমি আবার এই মহাযুদ্ধে প্রবৃত্ত করাইব। কিছুদিন যুদ্ধে প্রবৃত্ত না হওয়াই আমার উচিত। আমি যদি কিছুদিনের জন্য মদিনা পরিত্যাগ করি, তাহাতে তি কি? এজিদের সৈন্য আজ রাত্রিতেই রওজা আক্রমণ করিয়া আমার প্রাণবধ করিবে, ইহা বিশ্বাস্যই নহে। এখানে কাহারো দৌরাত্ম্য করিবার মতা নাই। শুধু এজিদের সৈন্য কেন, জগতের সমস্ত সৈন্য একত্রিত হইয়া আক্রমণ করিলেও এই পবিত্র রওজায় আমার ভয়ের কোন কারণ নাই, তথাপি কিছুদিনের জন্য স্থান পরিত্যাগ করাই সুপরামর্শ। আপাততঃ কুফা নগরে যাইয়া আবদুল্লাহ্ জেয়াদের নিকট কিছুদিন অবস্থিতি করি। জেয়াদ আমার পরম বন্ধু। আরব দেশে যদি প্রকৃত বন্ধু কেহ থাকে, তবে সেই কুফার অধীশ্বর প্রিয়তম বন্ধুবৎসল জেয়াদ্। যদি মদিনা পরিত্যাগ করিয়া যাওয়া উচিত বিবেচনা হয়, তবে সপরিবারে কিছু দিনের জন্য কুফা নগরে গমন করাই যুক্তিসিদ্ধ। আজ রাত্রির ও-কথা কিছুই নহে। এইরূপ ভাবিয়া হোসেন পুনরায় ঈশ্বরোপাসনায় মনোনিবেশ করিলেন।
ওত্বে অলীদ ও মারওয়ান্ উভয়ে শিবিরে গিয়া বেশ পরিত্যাগপূর্বক নির্জন স্থানে বসিয়া পরামর্শ করিতেছেন। অনেক কথার পর মারওয়ান বলিলেন, “মোহাম্মদের রওজায় হোসেনের মৃত্যু নাই! আমরা এমন কোন উপায় নির্ণয় করিতে পারি নাই যে, তাহাতে নিশ্চয়ই হোসেন রওজা হইতে বহির্গত হইয়া মদিনা পরিত্যাগ করেন। এইটি যাহা হইল ইহাও মন্দ নহে। ইহার উপরে আরো একটি ছিল, কিন্তু সে আমাদের ক্ষমতার অতীত। তৎবিস্তারিত কাসেদ গিয়া মুখে প্রকাশ করিবে, তাহার উপায়-কৌশল, সমুদয়ই কাসেদকে বিশেষরূপে বলিয়া দিলাম।”
ওত্বে অলীদ বলিলেন, “আর বেশি বিস্তারের আবশ্যক নাই, শীঘ্র পত্র লিখিয়া কাসেদকে প্রেরণ করা কর্তব্য।”
লিখিবার উপকরণ লইয়া মারওয়ান্ লিখিতে বসিলেন। কিছুণ পরেই ওত্বে অলীদ আবার বলিলেন, “একটি কথাও যেন ভুল না হয়, অথচ গোপন থাকে এইভাবে পত্র লেখা উচিত।” মারওয়ান পত্র লিখিতে লাগিলেন। একজন সৈনিক পুরুষের সহিত একজন কাসেদ্ আসিয়া যথারীতি নমস্কার করিয়া করজোড়ে দণ্ডায়মান হইল। মারওয়ান পত্র রাখিয়া কাসেদ্কে লইয়া গোপনে তাহাকে সমস্ত কথা বলিলেন। অনন্তর মারওয়ান পত্রখানি শেষ করিতে বসিলেন। কাসেদ্ করজোড়ে বলিতে লাগিল, “ঈশ্বরপ্রসাদে এই কার্য করিতে করিতেই আমি বৃদ্ধ হইয়াছি, যাহা বলিবেন অবিকল তাহাই বলিব। কেবল শহরের নামটি আর একবার ভাল করিয়া বলুন, কুফার কী কুফা।”
মারওয়ান রীতিমত পত্র লেখা শেষ করিয়া কাসেদের হস্তে দিয়া বলিলেন, “কুফা।” কাসেদ্ বিদায় হইল। মারওয়ান এবং অলীদ উভয়ে নির্দিষ্ট স্থানে গমন করিলেন।