মদিনাবাসীরা হাসানের শোকে বড়ই কাতর হইলেন। পরিজনেরা দশ দিবস পর্যন্ত কে কোথায় রহিল, কে কোথায় পড়িয়া কাঁদিল, কে কোথায় চলিয়া গেল, কেহই তাহার সন্ধান লইলেন না; সকলেই হাসানের শোকে দিবারাত্রি অজ্ঞান। পবিত্রদেহ মৃত্তিকায় প্রোথিত হইতে-না-হইতেই নৃশংস মন্ত্রী মারওয়ান দামেস্ক নগরে এজিদের নিকট সংবাদ পাঠাইয়াছিলেন। তাঁহার সমুদয় কার্য শেষ হয় নাই, সেইজন্য স্বয়ং দামেস্ক যাত্রা করিতে পারিলেন না। ইমামবংশ একেবারে ধ্বংস করিবার মানসে ছদ্মবেশে মদিনায় রহিয়াছেন। দামেস্ক হইতে ক্রমে ক্রমে সৈন্য আসিয়া পূর্বোক্ত পর্বতপ্রান্ত গুপ্তস্থানে জুটিতেছে। হাসানের প্রাণবিয়োগের পর পরিজনেরা,-হাসনেবানু, জয়নাব, সাহরেবানু (হোসেনের স্ত্রী) ও সখিনা (হোসেনের কন্যা) প্রভৃতি শোকে এবং দুঃখে অবসন্ন হইয়া মৃতবৎ হইয়া আছেন। হোসেন এবং আবুল কাসেম ঈশ্বরের আরাধনায় মনোনিবেশ করিয়া উপস্থিত শোকতাপ হইতে আত্মরক্ষার উপায় নির্ধারণ করিতেছেন। জায়েদা নিজ চিন্তায় চিন্তিত ও মহাব্যতিব্যস্ত। কি করিবেন, হঠাৎ গৃহত্যাগ করিবেন কি-না, ভাবিয়া স্থির করিতে পারিতেছেন না। মায়মুনার উপদেশে এতদূর পর্যন্ত আসিয়াছেন, এক্ষণে তাহার কথাই বেশি মূল্যবান বলিয়া মনে ধারণা হইল, আবার মায়মুনার শেষ কথা কয়েকটি এক্ষণে আরো ভাল লাগিল। কারণ জায়েদা এখন বিধবা।
পূর্বে গড়াপেটা সকলই হইয়া রহিয়াছিল, কেবল উত্তেজনা-রসানের সংযোগটি অপেক্ষা মাত্র। মায়মুনা পূর্বেই মারওয়ানের সহিত সমুদয় কথাবার্তা সুস্থির করিয়াছে, মারওয়ানও সমুদয় সাব্যস্ত করিয়া রাখিয়াছেন, কেবল জায়েদার অভিমতের অপেক্ষা। জায়েদা আজ-কাল করিয়া তিন দিবস কাটাইয়াছেন; আজ আবার কী বলিবেন, কী করিবেন, নির্জনে বসিয়া তাহাই ভাবিতেছেন! আপন কৃতকার্যের ফলাফল চিন্তা করিতেছেন; অদৃষ্টফলকের লিখিত লিপির প্রতি নির্ভর করিয়া সমুদয় চিন্তা দূর করিতেছেন। পতির চিরবিচ্ছেদে দুঃখ নাই, ভবিষ্যৎ আশায় এবং জয়নাবের প্রতিহিংসায় কৃতকার্য হইয়াও সুখ নাই। অন্তরে শান্তির নামও নাই। সর্বদাই নিতান্ত অস্থির।
মায়মুনা ঐ নির্জন স্থানেই আসিয়া বলিতে লাগিল, “তিন দিন তো গিয়াছে, আজ আবার কী বলিবে?”
“আর কী বলিব? এখন সকলই তোমার উপর নির্ভর। আমার আশা, ভরসা, প্রাণ সকলই তোমার হাতে।”
“কথা কখনোই গোপন থাকিবে না। পাড়াপ্রতিবেশীরা এখনই কানাঘুষা আরম্ভ করিয়াছে। যে যাহাকে বলিতেছে, সেই তাহাকে অপরের নিকট বলিতে বারণ করিতেছে। ধরিতে গেলে অনেকেই জানিয়াছে, কেবল মুখে রইরই হইহই হয় নাই। হোসেন ভ্রাতৃশোকে পাগল, আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া দিবারাত্রি ঈশ্বরের উপাসনায় নিরত, আজ পর্যন্ত তোমার সম্বন্ধে কোন কথাই তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করে নাই! শোকের একটু উপশম হইলেই এ কথা তাঁহার কর্ণে উঠিবে। এ সাংঘাতিক সংবাদ শুনিতে কি আর বাকি থাকিবে? তোমার পক্ষ হইয়া কে দুটা কথা বলিবে বল তো?”
“আমি যে তাহা না ভাবিয়াছি তাহা নহে; আমার আশা আছে, সন্তোষ সুখ-ভোগের বাসনা আছে। যাহা করিব, পূর্বেই স্থির করিয়া রাখিয়াছি। এই তো রাত্রি অধিক হয় নাই, একটু অপেক্ষা কর, এখনই আমি তোমার সঙ্গে যাইতেছি। এই একটি বড় দুঃখ মনে রহিল যে, এখানে থাকিয়া জয়নাবের চিরকান্না শুনিতে পাইলাম না। তাহার বৈধব্যব্রত দেখিয়া চক্ষের সাধ মিটাইতে পারিলাম না।”
“খোদা যদি সে দিন দেন, তবে জয়নাবকে হাতে আনা কতক্ষণের কাজ? জয়নাব কি আজ সেই জয়নাব আছে? এখন তো সে পথের ভিখারিণী! যে ইচ্ছা করিবে, সেই তাহাকে হস্তগত করিতে পারিবে। দেখ দেখি, শীঘ্র শীঘ্র সকল কাজ শেষ হইলে কত প্রকার মঙ্গলের আশা? জয়নাবকে লইতে কতক্ষণ লাগিবে? আবার বিবেচনা কর, বিলম্বে কত দোষের সম্ভাবনা। মানুষের মন ক্ষণ-পরিবর্তনশীল। তাহার উপর একটু আসক্তির ভাবও পূর্ব হইতেই আছে;-বাধা-প্রতিবন্ধক সকলই শেষ হইয়াছে;-জয়নাবও যে আপন ভালমন্দ চিন্তা না করিতেছে, তাহাও মনে করিয়ো না,-এদিকে আসক্তির আকর্ষণ, ওদিকে নিরুপায়। এখন স্বেচ্ছায় বশীভূত হইয়া শরণাগত হইলে সে যে কোথাও স্থান পাইবে না, সে যে আদৃত হইবে না, তাহার বিশ্বাস কী? শত্রু নির্যাতনে মনের কষ্টের প্রতিশোধ লইতেই তোমার সঙ্গে এত কথা,-এমন প্রতিজ্ঞা। জয়নাবই যদি অগ্রে যাইয়া তাহার আশ্রয় গ্রহণ করে, তবে তো তোমার সকল আশাই এই পর্যন্ত শেষ হইল। এদিকেও মজাইলে, ওদিকেও হারাইলে।”
“না-না-আমি যে আজ-কাল করিয়া কয়েক দিন কাটাইয়াছি, তাহার অনেক কারণ আছে। আমি আজ আর কিছুতেই থাকিব না। লোকের কাছে কী করিয়া মুখ দেখাইব?-হাসনেবানু, জয়নাব, সাহরেবানু, এই তিনজনই আজ আমার নাম করিয়া অনেক কথা কহিয়াছে। দূর হইতে তাহাদের অঙ্গভঙ্গি ও মুখের ভাব দেখিয়াই আমি জানিয়াছি যে, সকলেই সকল কথা জানিয়াছে! হোসেনের কানে উঠিতেই বাকি। সঙ্গে আমি কিছুই লইব না। যেখানে যাহা আছে, সকলই রহিল, এই বেশেই চলিয়া যাইব।”
এই বলিয়া জায়েদা উঠিলেন। সেইসঙ্গে মায়মুনাও উঠিয়া তাঁহার পশ্চাদ্বর্তিনী হইল। রাত্রি বেশি হয় নাই, অথচ হোসেনের অন্তঃপুরে ঘোর নিস্তব্ধ নিশীথের ন্যায় বোধ হইতেছে। সকলেই নিস্তব্ধ। দুঃখিত অন্তরে কেহ কেহ আপন আপন গৃহে শুইয়া, কেহ কেহ-বা বসিয়া আছেন। আকাশ তারাদলে পরিশোভিত কিন্তু হাসান-বিরহে যেন মলিন মলিন বোধ হয়। সে বোধ,-বোধ হয় মদিনাবাসীদিগের চক্ষে ঠেকিতেছে।-বাটী-ঘর সকলই পড়িয়া রহিয়াছে, যে স্থানে তিনি যে কার্য করিতেন, তাহা কেবল কথাতেই আছে, পরিজনের মনেই আছে, কিন্তু মানুষ নাই। চন্দ্রমাও মদিনাবাসীর দুঃখে দুঃখিত হইয়া, হাসানের পরিজনের দুঃখে দুঃখিত হইয়া,-মলিনভাবে অস্তাচলে চলিয়া গেলেন। জায়েদাও যাহার অপেক্ষায় বিলম্ব করিতেছিলেন, সে অপেক্ষা আর নাই। মনের আশা পূর্ণ হইল। এখন অন্ধকার। মায়মুনার সহিত জায়েদা বিবি চুপি চুপি বাটীর বাহির হইলেন। কাহারো সহিত দেখা হইল না। কেবল একটি স্ত্রীলোকের ক্রন্দনস্বর জায়েদার কর্ণে প্রবেশ করিল। জায়েদা দাঁড়াইলেন। বিশেষ মনোযোগের সহিত শুনিয়া শুনিয়া আপনাআপনি বলিতে লাগিলেন, “তোকে কাঁদাইতেই এই কাজ করিয়াছি! যদি স্বামীকে ভালবাসিয়া থাকিস্, তবে আজ কেন,-চিরকালই কাঁদিবি! চন্দ্র, সূর্য, তারা, দিবা, নিশি সকলই তোর কান্না শুনিবে। তাহা হইলেই কী তোর দুঃখ শেষ হইবে? তাহা মনে করিস্ না। যদি জায়েদা বাঁচিয়া থাকে, তবে দেখিস্ জায়েদার মনের দুঃখের পরিমাণ কত? শুধু কাঁদাইয়াই ছাড়িবে না। আরো অনেক আছে। এই তো আজ তোরই জন্য-পাপীয়সী!-কেবল তোরই জন্য জায়েদা আজ স্বামীঘাতিনী বলিয়া চিরপরিচিত হইল। আজ আবার তোরই জন্য জায়েদা এই স্বামীগৃহ পরিত্যাগ করিয়া চলিল।”
তীব্রস্বরে এইরূপ কথা বলিতে বলিতে মায়মুনার সহিত দ্রুতপদে জায়েদা বাটীর বাহির হইলেন। বাহির হইয়াই দেখিলেন, কয়েকজন সৈনিক পুরুষ অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত হইয়া গমনোপযোগী বাহনাদির সহিত সম্মুখে উপস্থিত। কেহ কোন কথা বলিল না। সৈনিক পুরুষ মায়মুনার ইঙ্গিতে জায়েদাকে অভিবাদন করিয়া বিশেষ মান্যের সহিত এক উষ্ট্রে আরোহণ করাইল। মায়মুনাও উষ্ট্রপৃষ্ঠে আরোহণ করিল। কিছু দূরে যাইবার পর ছদ্মবেশী মারওয়ান তাঁহাদের সঙ্গে একত্র মিলিত হইলেন। নগরপ্রান্তের সেই নির্দিষ্ট পর্বতগুহার সন্নিকটে আসিয়া। মায়মুনার সহিত মারওয়ানের অনেক শিষ্টাচার ও কথোপকথন হইল। অনন্তর মারওয়ান আরো বিংশতি জন সৈন্য সজ্জিত করিয়া জায়েদার সহিত দামেস্কে পাঠাইয়া দিলেন।
রজনী প্রভাতে হোসেনের পরিজনেরা দেখিলেন, জায়েদা গৃহে নাই। শেষে হোসেনও সেই কথা শুনিলেন। অনেক সন্ধান করিলেন, কোন স্থানেই জায়েদার সন্ধান পাওয়া গেল না। জায়েদা কেন গৃহত্যাগিনী হইল, সে কথা বুঝাইয়া বলিতে, কী বুঝিতে কাহারো বাকি রহিল না। সকলেই বলিতে লাগিল, “কোন্ প্রাণে আপন হাতে বিষ পান করাইয়া প্রাণের প্রিয়তম স্বামীর প্রাণ হরণ করিল? উহার জায়গা কোথায় আছে? জগৎ কী পাপভরে এতই ভারাক্রান্ত হইয়াছে যে, মহাপাপাক্রান্ত জায়েদার ভার অকাতরে সহ্য করিবে?-স্বামীঘাতিনীর স্থান কি ইহলোকে কোন স্থানে হইবে?-নরক কাহার জন্য?-বোধ হয় সে নরকেও জায়েদার ন্যায় মহাপাপিনীর স্থান নাই।”
অনেকেই অনেক কথা বলিলেন, যাহা হয় নাই, তাহাও ঘটাইলেন। জায়েদা যাহা কখনো মনেও ভাবে নাই, তাহাও কেহ কেহ রটাইয়া দিলেন। হোসেন চক্ষের জল মুছিতে মুছিতে নূরনবী মোহাম্মদ মোস্তফার রওজা মোবারকের দিকে চলিয়া গেলেন। ভ্রাতার নিকটে প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন বিষদাতার সন্ধান জানিলেও তাহাকে কিছুই বলিবেন না,-তাহার প্রতি কোনরূপ দৌরাত্ম্যও করিবেন না। জায়েদা মদিনায় নাই, থাকিলেও কিন্তু হোসেন অবশ্যই ভ্রাতৃ-আজ্ঞা প্রতিপালন করিতেন। এখনো তাহাই মনে করিয়া ঈশ্বরের উপাসনায় প্রবৃত্ত হইলেন।