মদিনাবাসীরা কিছুদিন এজিদের পত্র লইয়া বিশেষ আলোচনা করিলেন। সর্বসাধারণের অন্তরেই এজিদের পত্রের প্রতি ছত্র, প্রতি অক্ষর, সুতীক্ষ্ণ তীরের ন্যায় বিঁধিয়াছিল। হাসান-হোসেনের প্রতি এজিদ্ যেরূপ অপমানসূচক কথা ব্যবহার করিয়াছে, তাহার শাস্তি কোথায় হইবে, ঈশ্বর যে কী শাস্তি প্রদান করিবেন, তাঁহারা তাহা ভাবিয়া স্থির করিতে পারিলেন না। প্রাচীনেরা দিবারাত্রি হাসান-হোসেনের মঙ্গলকামনায় ঈশ্বরসমীপে প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। পূর্ণবয়স্কেরা বলিতে লাগিলেন, “আমরা বাঁচিয়া থাকিতে কাহার সাধ্য ইমাম হাসান-হোসেনের প্রতি দৌরাত্ম্য করে? আমরা বাঁচিয়া থাকিতে যে নরাধম ইমামের প্রতি অযথা ব্যবহার করিবে, তাহাকে শীঘ্রই নরকের জ্বলন্ত অগ্নিরাশির মধ্যে জ্বলিতে হইবে।” নব্য যুবকেরা বলিতে লাগিলেন, “দামেস্কের কাসেদকে একবার দেখিতে পাইলে মদিনার খাজনা দিয়া বিদায় করিতাম। এত দিতাম যে, বহন করিয়া লইয়া যাইতে তাহার শক্তি থাকিত না। দেহটি এখানে রাখিয়া শুদ্ধ প্রাণ লইয়া দামেস্কে ফিরিয়া যাইতে হইত। স্ত্রীপুরুষমাত্রেই এজিদের নামে শত শত পাদুকাঘাত করিয়াছিলেন। কিছুদিন গত হইল, দামেস্কে আর কোন সংবাদ নাই। এজিদের আন্দোলন ক্রমে ক্রমে অনেক পরিমাণে কমিয়া আসিল।
মদিনাবাসীরা আপন আপন গৃহে শুইয়া আছেন, নিশা প্রায় অবসান হইয়া আসিয়াছে, এমন সময় সহসা নাকাড়ার শব্দ শুনিতে পাইয়া অগ্রে প্রান্তসীমাবাসীরা জাগিয়া উঠিলেন। অসময়ে রণবাদ্যের কোন কারণই নির্ণয় করিতে পারিলেন না। প্রভাত নিকটবর্তী। ইহার সঙ্গে সঙ্গে সেই বাজনাও নিকটবর্তী হইতে লাগিল। সূর্যোদয় পর্যন্ত নগরের প্রায় সমস্ত লোকের কানেই সেই তুমুল ঘোর রণবাদ্য প্রবেশ করিয়া দীর্ঘসূত্রীরও নিদ্রাভঙ্গ করিল। অনেকে নগরের বাহির হইয়া দেখিলেন যে, বহুসংখ্যক সৈন্য বীরদর্পে গম্য পথ অন্ধকার করিয়া নগরাভিমুখে আসিতেছে। সূর্যদেব সহস্র কিরণে মদিনাবাসীদিগকে নিজ মূর্তি দেখাইয়া এজিদের চিহ্নিত পতাকা ও সৈন্যদিগের নূতন সজ্জাও দেখাইলেন। সকলেই স্থির সিদ্ধান্ত করিলেন যে, হাসান-হোসেনকে নির্যাতন এবং তাঁহাদের প্রাণহরণ মানসে এজিদ্ সসৈন্যে সমরে আসিতেছেন।
আবদুর রহমান আর বিলম্ব করিলেন না। দ্রুতগমন করিয়া হাসান-হোসেনের নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত জানাইলেন। তাঁহারাও আর কালবিলম্ব না করিয়া এজিদের বিরুদ্ধে জেহাদ (ধর্মযুদ্ধ) ঘোষণা করিয়া যুদ্ধের আয়োজনে ব্যতিব্যস্ত হইলেন। মুহূর্ত মধ্যে মদিনার ঘরে ঘরে জেহাদ রবের প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল। মোহাম্মদীয়গণ জেহাদের নাম শুনিয়া আহ্লাদে নাচিয়া উঠিলেন। বিধর্মীর অস্ত্রাঘাতে প্রাণত্যাগ করিলেই শহীদ (ধর্মযুদ্ধে শোণিতপাতে প্রাণত্যাগে মুক্ত) হইব, স্বর্গের দ্বার শহীদদিগের নিমিত্ত সর্বদাই খোলা রহিয়াছে, ধর্মযুদ্ধে বিধর্মীর অস্ত্রাঘাতে রক্তপ্রবাহে মোহাম্মদীয়গণের সমুদয় পাপবিধৌত হইয়া পবিত্রভাবে পুণ্যাত্মা-রূপধারণে নির্বিচারে যে স্বর্গসুখে সুখী হয়, ইহা মুসলমান মাত্রেরই অন্তরে জাগিতেছে এবং অনন্তকাল পর্যন্ত জাগিবে।
মদিনার বালক, বৃদ্ধ, পূর্ণবয়স্ক সকলেই রণবেশে সুসজ্জিত হইতে লাগিলেন। নগরবাসীরা হাসান-হোসেনকে প্রাণাপেক্ষা ভালবাসিতেন। ঘোষণা প্রচার হইতে হইতেই সহস্রাধিক লোক কাহারো আদেশের অপেক্ষা না করিয়া যাহার যে অস্ত্র আয়ত্ত ছিল, যাহার যে অস্ত্র সংগ্রহ ছিল, যে যাহা নিকটে পাইল, তাহাই লইয়া বেগে শত্রুর উদ্দেশে ধাইয়া চলিল। তদ্দৃষ্টে এজিদের সৈন্যগণ আর অগ্রসর হইল না; গমনে ক্ষান্ত দিয়া শিবির নির্মাণে প্রবৃত্ত হইল। নগরবাসীরাও শত্রুপক্ষকে নিরুদ্যম দেখিয়া আর অগ্রসর হইলেন না, নগরেও আর ফিরিলেন না, বৃক্ষমূলে প্রস্তরোপরি স্ব স্ব সুযোগমত স্থান নির্ণয় করিয়া হজরত ইমাম হাসানের অপেক্ষায় রহিলেন। এজিদের সৈন্যগণ বহুমূল্য বস্ত্রাদি দ্বারা শিবির রচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছে, এ সংবাদ হোসেনের নিকট পাঠাইলেন।
হাসান ও আবদুর রহমান প্রভৃতি আত্মীয়-স্বজন সমভিব্যাহারে রওজা-মোবারকে যাইয়া হাসান প্রথমেই ঈশ্বরের উপাসনা করিলেন, “দয়াময়! আমার ধনবল, বুদ্ধিবল, সৈন্যবল কিছুই নাই। তোমার আজ্ঞানুবর্তী দাসানুদাস আমি। তুমি দয়া করিয়া এ দাসের অন্তরে যে বল দিয়াছ, সেই ধর্মবলেই আমার সাহস এবং উৎসাহ। দয়াময়! সেই বলের বলেই আমি এজিদ্কে-এক এজিদ্ কেন, শত শত এজিদ্কে তোমার কৃপায় তুচ্ছ জ্ঞান করি। কেবল তোমার নাম ভরসা করিয়াই অসীম শত্রুপথে যাইতেছি। তুমিই সহায়, তুমিই রক্ষাকর্তা।”
সকলেই “আমিন আমিন” বলিয়া পরে নূরনবী মোহাম্মদের গুণানুবাদ করিয়া একে একে অশ্বারোহণে রাজপথে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। নগরবাসীরা ব্যগ্রতা-সহকারে তাঁহাদের চারিদিকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। বলিতে লাগিল, “আমরা বাঁচিয়া থাকিতে আপনাকে শত্রুসম্মুখে যাইতে দিব না। আমরা এই চলিলাম। পৃষ্ঠে আঘাত লইয়া আর ফিরিব না। আঘাতিত দেহ আর মদিনাবাসীদিগকে দেখাইব না। হয় মারিব! নয় মরিব!!”
হাসান অশ্ব হইতে নামিয়া বলিলেন, “ভ্রাতৃগণ! ঈশ্বরের রাজ্যে বাস করিয়া ঈশ্বরের কার্যে জীবন শেষ করাই জীবের কর্তব্য! লোকে আমাকে মদিনার রাজা বলে, কিন্তু ভ্রাতৃগণ। তোমরা তাহা কখনোই কর্ণে স্থান দিয়ো না। এ জগতে কেহ কাহারো রাজা নহে, সকলেই সেই মহাধিরাজ সর্বরাজাধিরাজ ওয়াহ্দাহু লা শরিকালাহু (একমেবাদ্বিতীয়ম্) দয়াময়ের রাজ্যের প্রজা; সকলেই সেই মহান্ রাজার সৃষ্ট, তাঁহার শক্তি মহান্! আমরা সেই রাজার রাজ্যের প্রজা। সাধ্যানুসারে সেই সর্বশক্তিমান, অদ্বিতীয় মহারাজের ধর্মরাজ্য রক্ষণাবেক্ষণ করাই আমাদের সর্বতোভাবে কর্তব্য এবং তাহাই আমাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য। সেই ধর্মরাজ্যের বিরোধী হইয়াও অনেক নরাধম এই অস্থায়ী রাজ্যে বাস করিতেছে। আজ তোমার যে নরাধমের বিরুদ্ধে একাগ্রচিত্তে অগ্রসর হইয়াছ, তাহার ধনবল, সৈন্যবল, এত অধিক হয় যে, মনে ধারণা করিতেও শঙ্কা বোধ হয়। যদিও আমাদের অর্থ নাই, যুদ্ধের উপকরণ নাই, বাহ্যিক আড়ম্বরও নাই, তথাচ আমাদের একমাত্র ভরসা-সেই অদ্বিতীয় ভগবান। তাঁহার নামই আমাদের আশ্রয়। সেই নাম সহায় করিয়াই আমরা তাঁহার ধর্মরাজ্য রক্ষা করিব। ভ্রাতৃগণ! যে পাপাত্মার সৈন্যগণ এই পবিত্র ভূমি,-আমাদের জন্মভূমি আক্রমণ করিবার আশা নগরের বাহিরে শিবির স্থাপন করিয়া রহিয়াছে, সেই বিধর্মী এজিদ্ মদিনার খাজনা আমার নিকট চাহিয়া পাঠাইয়াছিল। আমি তাহার উত্তর দিই নাই; সেই আক্রোশে এবং বিবি জয়নাব আমার সহধর্মিণী হইয়াছে, সেই ক্রোধে এজিদ্ আমার প্রাণবধ করিবে। তাহা হইলে এজিদের উভয় উদ্দেশ্যই সাধিত হইবে। কারণ আমার অভাবে মদিনার সিংহাসন তাহারই অধিকৃত হইবে মনে করিয়াছে। সেই বিধর্মী এজিদ্ নূরনবী হজরত মোহাম্মদের বিরোধী ঈশ্বরের বিরোধী পবিত্র কোরানের বিরোধী। নরাধম এমনি পাপী যে, ভ্রমেও কখনো ঈশ্বরের নাম মুখে আনে না। ভাই সকল! আমরা যে রাজ্যে বাস করি, যে রাজা আমাদের সুবিধার জন্য কত উপকরণ, কত সুখসামগ্রী সৃষ্টি করিয়াছেন, বিনা স্বার্থে, বিনা প্রত্যুপকারের আশয়ে যে রাজা অকাতরে কত কী দান করিয়াছেন, আমরা আজ পর্যন্ত সে দানের উদ্দেশ্যের কণামাত্রও বুঝিয়া উঠিত পারি নাই। সেই অদ্বিতীয় রাজার বিরুদ্ধাচারী আজ পুণ্যভূমি মদিনা আক্রমণ করিতে,-আমাদের স্বাধীনতা হরণ করিতে,-ধর্মপথে বাধা দিতে,-মূল উদ্দেশ্য-আমার জীবন-প্রদীপ নির্বাণ করিতে অগ্রসর হইয়াছে; মহাশক্তিসম্পন্ন মহাপ্রভু জগৎপিতার নামে কত কলঙ্ক রটাইয়াছে। তিনি মহান্, তাঁহার মহিমা অপার, তাঁহাতে ক্রোধ, বিরাগ, অপমান কিছুই নাই। কিন্তু আমরা সহ্যগুণবিহীন মানব,-আমাদের রিপু-সংযম অসাধ্য। যে কেহ ঈশ্বরের বিরোধী, আমরা তাহার বিরোধী। আমরা কি সেই বিরোধীর প্রতিবিধান করিব না? আমাদের অস্ত্র কি চিরকালই কোষে আবদ্ধ থাকিবে? বিধর্মীর মুণ্ডপাত করিতে সেই অস্ত্র কি নিষ্কোষিত হইয়া কাফেরের রক্তে রি ত হইবে না? ঈশ্বরের প্রসাদে জয়-পরাজয় উভয়ই আমাদের মঙ্গল। যদি তাঁহার কৃপায় বিধর্মীয় রক্ত আজ মদিনাপ্রান্তরে বহাইতে পারি, ধর্ম রা ও জন্মভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করিতে বিধর্মীর অস্ত্রে যদি আত্মবিসর্জন হয়, তাহাতেও অক্ষয় স্বর্গলাভ। ভ্রাতৃগণ! আজ আমাদের এই স্থির প্রতিজ্ঞা যে, হয় জন্মভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করিয়া মহম্মদীয় ধর্মের উৎকর্ষ সাধন করিব, না হয় অকাতরে রক্তস্রোতে আমাদের এই অস্থায়ী দেহ খণ্ডে খণ্ডে ভাসাইয়া দিব।”
এই পর্যন্ত শুনিয়াই শ্রোতাগণ সমস্বরে “আল্লাহু আক্বার!” বলিয়া পাগলের ন্যায় কাফেরের মুণ্ডপাত করিতে ছুটিলেন। হাসান সকলকে একত্র শ্রেণীবদ্ধ করিয়া লইয়া সমরেক্ষেত্র যাইতে মনস্থ করিয়াছিলেন; তাহা আর হইল না; কেহই আর তাঁহার কথা শুনিল না।
হাসান-হোসেন ও আবদুর রহমান পুনরায় অশ্বারোহণে কিঞ্চিৎ দূর গমন করিয়া যে দৃশ্য দর্শন করিলেন, তাহাতে হাসান আর অশ্রুসম্বরণ করিতে পারিলেন না। আবদুর রহমানকে বলিলেন, “ভাই! তুমি যত শীঘ্র পার, হোসেনের সহিত যাইয়া মদিনাবাসীদের পৃষ্ঠপোষক হও। আমি অবলাগণকে সান্ত্বনা করিয়া আসিতেছি। ইহাদের এ বেশে আমার চক্ষে বড়ই কষ্টকর বোধ হইতেছে। আমি বাঁচিয়া থাকিতে ইহাদের হস্তে অস্ত্রভার সহিতে হইল, ভাই ইহা অপেক্ষা আর দুঃখ কী? তোমরা যাও আর অপেক্ষা করিয়ো না।”
এই কথা বলিয়া অশ্ব হইতে নামিয়াই ইমাম হাসান অতি বিনীতভাবে নারীগণকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভগ্নিগণ! নগরের প্রান্তভাগে মহাশত্রু। নগরবাসীরা আজ শত্রুবধে উন্মত্ত, জন্মভূমি রক্ষা করিতে মহাব্যস্ত। এই বিপদ সময়ে তোমরা এ বেশে কোথা যাইতেছ?”
স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে একজন বলিলেন,-“হজরত! আর কোথা যাইব? আপনার এই মহাবিপদকালেও কী আমরা অবলাচারের বাধ্য হইয়া অন্তঃপুরেই আবদ্ধ থাকিব? ভ্রাতা, পুত্র, স্বামী সকলকেই শত্রুমুখে পাঠাইয়াছি, ফিরিয়া আসিতে পাঠাই নাই; একেবারে চিরবিদায় প্রদান করিয়াছি;-আর আমাদের পৃথিবীতে থাকিবার প্রয়োজন কী? আপনার জন্য স্বামী, পুত্র, ভ্রাতা যে পথে যাইবে, আমরাও সেই পথের অনুসরণ করিব; বিপদ সময়ে অবশ্যই কিছু না কিছু সাহায্য করিতে পারিব। আর তাহারাই যদি বিধর্মীর রক্তে রঞ্জিত হইয়া ধর্মরক্ষা ও জন্মভূমি রক্ষা করিতে পারে, তবে আমরাই-বা কাফেরের মাথা কাটিতে অস্ত্র গ্রহণ করিব না কেন? নূরনবী হজরত মোহাম্মদের পবিত্র দেহ যে মদিনা ক্রোড়ে ধারণ করিয়া রহিয়াছে, রোজকেয়ামত পর্যন্ত থাকিবে, সেই মদিনা এজিদ্ অধিকার করিবে? যে মদিনার পবিত্রতা-গুণে জগতের চারি খণ্ড হইতে কোটি কোটি ভক্ত কত কষ্ট স্বীকার করিয়া সুদ্ধ একবার রওজা-শরিফ দর্শন করিতে আসিতেছে, সেই পবিত্র ভূমি কাফেরের পদস্পর্শে কলঙ্কিত হইবে? এ কথা শুনিয়া কে স্থির হইয়া ঘরে থাকিতে পারে? দুনিয়া কয় দিনের? আরো দেখুন, আমরা অবলা, পরাধীনা; যাহাদের মুখাপেক্ষী তাহারাই অস্ত্রসম্মুখে দাঁড়াইল, তখন আমরা শূন্যদেহ লইয়া কেন আর ঘরে থাকিব?”
আর একটি স্ত্রীলোক কহিলেন, “হজরত! আমরা যে কেবল সন্তান-সন্ততি প্রতিপালন করিতেই শিখিয়াছি, তাহা মনে করিবেন না, এই হস্ত বিধর্মীর মস্তক চূর্ণ করিতেও সম; এই অস্ত্রে কাফেরের মুণ্ডপাত করিতেও জানি। সামান্য রক্তবিন্দু দেখিলেই আমাদের মন কাঁপিয়া উঠে, অঙ্গ শিহরিয়া উঠে, হৃদয়ে বেদনা লাগে; কিন্তু কাফেরের লোহিত-তরঙ্গের শোভা দর্শনে আনন্দে ও উৎসাহে মন যেন নাচিতে থাকে।”
বিস্মিত হইয়া হাসান বলিলেন, “আমি আপনাদের অনুগত এবং আজ্ঞাবহ। আমি বাঁচিয়া থাকিতে বিধর্মীবধে আপনাদিগকে অস্ত্র ধরিতে হইবে না। আমার বংশ বাঁচিয়া থাকিতে আপনাদিগকে এ বেশ পরিতে হইবে না। ভগ্নিগণ! আপনারা ঘরে বসিয়া ঈশ্বরের নিকট ধর্ম ও জন্মভূমির রার জন্য কায়মনে প্রার্থনা করুন। আমরা অস্ত্রমুখে দাঁড়াইব; আপনারা ঈশ্বরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া আমাদিগকে রা করিবেন। আমি মিনতি করিয়া বলিতেছি, আপনারা শত্রুসম্মুখীন হইয়া আমার মনে বেদনা প্রদান করিবেন না।”
প্রথমা স্ত্রী সবিনয়ে বলিলেন, “আপনার আদেশ প্রতিপালন করিলাম; কিন্তু ইহা নিশ্চয়ই জানিবেন যে, মদিনার একটি অবলার প্রাণ দেহে থাকিতে এজিদ্ কদাচ নগরের সীমায় আসিতে পারিবে না।” এই কথা বলিয়া স্ত্রীলোকেরা দুই হস্ত তুলিয়া ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিলেন, “এলাহি! আজ আপনার নামের উপর নির্ভর করিয়া হাসানকে শত্রুসম্মুখে দিলাম। হাসানের প্রাণ, পবিত্র ভূমি মদিনার স্বাধীনতা এবং ধর্ম রা করিতে ভ্রাতা, পুত্র ও স্বামীহারা হইলে আমরা কাতর হইব না। এলাহি! স্বামী, পুত্র, ভ্রাতৃগণ বিধর্মীর অস্ত্রে প্রাণত্যাগ করিলে আমাদের চে কখনোই জল আসিবে না-কিন্তু মদিনা নগর কাফেরের পদস্পৃষ্ট হইলে আমরা অকাতরে প্রাণ বিসর্জন করিব। এলাহি! হাসানের প্রাণ আমাদের প্রার্থনীয়। সে প্রাণ রক্ষা হইলেই সকল রক্ষা হইবে। এলাহি! হাসানের প্রাণ রক্ষা কর। মদিনার পবিত্রতা রক্ষা কর! নূরনবী হজরত মোহাম্মদের রওজার পবিত্রতা রা কর।”
এই প্রকারে উপাসনা শেষ করিয়া নগরবাসিনী কামিনীগণ হাসানকে আশীর্বাদ করিতে লাগিলেন, “এলাহীর অনুগ্রহ কবচ আপনার শরীর রক্ষা করুক। বাহুবলে হজরত আলীর দৃষ্টি হউক। বিবি ফাতেমা খাতুনে জান্নাত আপনার ক্ষুৎপিপাসা নিবারণের প্রতি দৃষ্টি রাখুন। শত্রুবিজয়ী হইয়া আপনি নির্বিঘ্নে নগরে আগমন করুন।”
এইরূপ আশীর্বাদ করিয়া কামিনীগণ স্ব-স্ব নিকেতনে চলিয়া গেলেন। হাসানও ‘বিস্মিল্লাহ্’ বলিয়া অশ্বে আরোহণ করিলেন। মুহূর্তমধ্যে নগরপ্রান্তে আসিয়া ভীষণতর শব্দ শুনিতে শুনিতে যুদ্ধক্ষেত্রের নিকটস্থ হইলেন। দেখিলেন যে, বিষমবিক্রমে মদিনাবাসীরা বিপক্ষগণকে আক্রমণ করিয়াছে যুদ্ধের রীতিনীতির প্রতি কাহারো লক্ষ্য নাই। কেবল মার মার শব্দ, অস্ত্রের ঝন্ঝনা ও মুহূর্তে মুহূর্তে ‘আল্লাহ্’ রবে চতুর্দিক কাঁপাইয়া তুলিতেছে। রণভূমিতে শোণিতের প্রবাহ ছুটিয়াছে সে অভাবনীয় ভয়ানক দৃশ্য দেখিয়া হাসান নিস্তব্ধভাবে অশ্বপৃষ্ঠে উপবিষ্ট রহিলেন, যুদ্ধে ব্যাপৃত হইলেন না।
মদিনাবাসীরা শত্রুদিগকে প্রায় শেষ করিয়া ফেলিয়াছে। শত শত বিধর্মীর মস্তকোচ্ছেদন করিয়া শেষে নিজে নিজে ‘শহীদ’ হইতেছে। কেহ কাহারো কথা শুনিতেছে না, কিছু বলিতেছে না, জিজ্ঞাসাও করিতেছে না। হোসেনের চালিত তরবারি বিদ্যুতের ন্যায় চমকিতেছে। শত্রুপক্ষীয়েরা যে পলাইয়া প্রাণ রা করিবে, তাহারও উপায় নাই। তবে বহুদূর হইতে যাহার সেই ঘূর্ণিত তরবারির চাকচিক্য দেখিয়াছিল কেবল তাহারাই, কেহ জঙ্গলে, কেহ পর্বতগুহায় লুকাইয়া প্রাণ রক্ষা করিল।
হোসেনের অশ্ব শ্বেতবর্ণ; শরীরও শ্বেতবসনে আবৃত। এক্ষণে বিধর্মী বিপক্ষরে রক্তে একেবারে তাহা লোহিত বর্ণে পরিণত হইয়াছে, কিন্তু স্থানে স্থানে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শুভ্রাংশে আরও অধিক শোভা হইয়াছে সেই শোভা বিধর্মীর পকে ভীষণভাবে প্রতিফলিত হইতেছে। অশ্বের পদ নিক্ষিপ্ত রক্তমাখা বালুকার উৎক্ষিপ্ততা দেখিয়াই অনেকে ছিন্ন দেহের আবরণে লুকাইয়া হোসেনের তরবারি হইতে প্রাণ বাঁচাইতেছে। বামে দক্ষিণে হোসেনের দৃষ্টি নাই। যাহাকে সম্মুখে পাইতেছেন, তাহাতেই নরকে পাঠাইতেছেন।
হাসান অনেকক্ষণ পর্যন্ত একস্থানে দাঁড়াইয়া ক্রমে ক্রমে অগ্রসর হইয়া এই ভীষণ যুদ্ধ দর্শন করিতে লাগিলেন। হস্তপদ খণ্ডিত অগণিত দেহ, শোণিত-প্রবাহে ডুবিয়া, কতক অর্ধাংশ ডুবিয়া রক্তস্রোতে নিন্মস্থানে গড়াইয়া যাইতেছে। মদিনাবাসীদের মুখে কেবল “মার! মার! কোথায় এজিদ্? কোথায় মারওয়ান?” এইমাত্র রব। মধ্যে মধ্যে নানাপ্রকারের ভীষণতর কাতর স্বর হাসানের কর্ণগোচর হইতে লাগিল।
মদিনাবাসীরা প্রথমে বিধর্মীর মস্তক ভিন্ন আর কিছুই দেখেন নাই; ক্রমে দুই একটির প্রতি দৃষ্টি। হোসেন ও আবদুর রহমান প্রভৃতিকে দেখিয়াছিলেন; অথচ কেহ কাহারো কোন সন্ধান লন নাই। জিজ্ঞাসাও করেন নাই। এক্ষণে পরস্পর পরস্পরের সহিত দেখা হইতে লাগিল। যাহারা তাঁহাদের দৃষ্টিপথের প্রতিবন্ধকতা জন্মাইয়াছিল, ঈশ্বর কৃপায় তাহারা আর নাই, প্রায় সকলেই রক্তস্রোতে ভাসিয়া যাইতেছে। ক্রমে সকলেই একত্র হইতে লাগিলেন। দেখিতে দেখিতে হাসানেরও দেখা পাইলেন। সকলেই উচ্চৈঃস্বরে ঈশ্বরের নাম করিয়া জয়ধ্বনির সহিত “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্” বলিয়া যুদ্ধে ক্ষান্ত দিলেন। অনন্তর রক্তমাখা শরীরে আঘাতিত অঙ্গে মনের আনন্দে হাসানের সহিত আলিঙ্গন করিলেন। হাসানও সকলকে আশীর্বাদ করিয়া সমস্বরে ঈশ্বরের নাম করিতে করিতে সিংহদ্বার অতিক্রম করিয়া নগর মধ্যে প্রবেশ করিলেন। বালক, বৃদ্ধ ও স্ত্রীলোকেরা পথের দুই পার্শ্ব হইতে ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞতার উপাসনা (শোক্রাণা) করিয়া বিজয়ী বীরপুরুষগণকে মহানন্দে অভ্যর্থনা করিতে লাগিলেন। জাতীয় ধর্ম ও জন্মভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করিয়া বীরগণ বিজয় পতাকা উড়াইয়া গৃহে আসিতেছেন, সে সময়ে “বাগে এরামের” (স্বর্গীয় উপবনের) পুষ্প তাঁহার মস্তকে বর্ষণ করিতে পারিলেও সকলের মনের আশা মিটিত না। নগরবাসীরা কি করেন, মদিনাজাত যাহা আমাদের পারিজাত পুষ্প, মনের আনন্দে, মহা উৎসাহে সেই পুষ্পগুচ্ছ বৃষ্টি করিয়া অভ্যর্থনা করিতে লাগিলেন। বিজয়ী বীরগণ একেবারে প্রভু মোহাম্মদের রওজা শরিফে আসিয়া ঈশ্বরের উপাসনা করিলেন। শেষে হাসান-হোসেন ও আবদুর রহমানের নিকট বিদায় হইয়া সকলেই স্ব স্ব গৃহে গমনপূর্বক পরিবারমধ্যে সাদরে গৃহীত হইলেন। মদিনার প্রতি গৃহ, প্রতি দ্বার, প্রতি পল্লী ও প্রতি পথ এককালে আনন্দময় হইয়া উঠিল।
মদিনাবাসীরা বিজয়-নিশান উড়াইয়া রণভূমি পরিত্যাগ করিলে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মৃতদেহ মধ্যে প্রাণের ভয়ে যাঁহারা লুকাইয়াছিলেন, ক্রমে ক্রমে তাঁহারা মস্তক উত্তোলন করিয়া দেখিলেন, আর জনপ্রাণীমাত্র যুদ্ধেক্ষেত্র নাই। সহস্র সহস্র মস্তক ও সহস্র সহস্র দেহ রক্তমাখা হইয়া বিকৃতভাবে পড়িয়া রহিয়াছে। কেহ অশ্বসহ দ্বিখণ্ডিত হইয়া অশ্বদেহে চাপা পড়িয়াছে, কাহারো খণ্ডিত হস্ত পড়িয়া রহিয়াছে; শরীরের চিহ্নমাত্র নাই! কোন শরীরে হস্ত নাই, কাহারো জঙ্ঘা কাটিয়া কোথায় পড়িয়াছে, অপরাংশ কোন অশ্বের পশ্চাৎ পদের সহিত রক্তে জমাট বাঁধিয়া রহিয়াছে। অশ্বদেহে মনুষ্যমস্তক, মনুষ্যদেহে অশ্বমস্তক সংযোজিত হইয়াছে, এইরূপ শোচনীয় অবস্থা অবলোকন করিয়া হতাবশিষ্ট সেনাগণ কি করিবে, কোন উপায়ই নির্ধারণ করিতে পারিল না। ক্রমে ক্রমে দুইটি তিনটি করিয়া একত্র হইলেন। পর্বতগুহায় যাঁহারা লুকাইয়া ছিলেন, তাঁহারাও যুদ্ধক্ষেত্রের নীরব নিস্তব্ধভাব বুঝিয়া ক্রমে ক্রমে বাহির হইলেন। তন্মধ্যে মারওয়ান ও ওত্বে অলীদ উভয়েই ছিলেন। সঙ্গীদিগের এই হৃদয়বিদারক অবস্থা দেখিয়া তাঁহারা কিছুই দুঃখিত হইলেন না। কেবল মারওয়ান বলিলেন, “ভাই অলীদ! মদিনাবাসীর অস্ত্রে এত তেজ, হোসেনের এত পরাক্রম, ইহা আমি স্বপ্নেও ভাবি নাই। যাহা হইবার হইয়াছে, গত বিষয়ের চিন্তায় আর ফল কি? পুনরায় চেষ্টা। মহারাজ এজিদের আজ্ঞা মনে কর। যে ‘যদি’ শব্দে তাঁহার হৃদয় কাঁপিয়া উঠিয়াছিল, তাহাই যদি সফল হইল, তবে ইহা তো নূতন ঘটনা নহে। মহারাজের শেষ আজ্ঞা পর্যন্ত পরীক্ষা করিয়া যাইব,-জীবন লইয়া আর দামেস্কে যাইব না; এ মুখ আর দামেস্কবাসীকে দেখাইব না। পুনরায় সৈন্য সংগ্রহ করিব, পুনরায় হাসান-বধ চেষ্টা করিব। মহারাজ এজিদের অভাব কিসের? সৈন্যগণ! তোমরা একজন এখনই দামেস্কনগরে যাত্রা কর। যাহা স্বচক্ষে দেখিলে ভাগ্যবলে মুখে বলিতেও সময় পাইলে, অবিকল মহারাজ সমীপে এই মহাযুদ্ধের অবস্থা বলিয়ো। আর বলিয়ো যে, মারওয়ান মরে নাই, হাসানের প্রাণ সংহার না করিয়া সে মদিনা পরিত্যাগ করিবে না। আরো বলিয়ো যে, মহারাজের শেষ আজ্ঞা প্রতিপালন করিতেই সে এক্ষণে প্রস্তুত হইয়াছে। যত শীঘ্র হয়, পুনরায় সৈন্য সংগ্রহ করিয়া মদিনায় প্রেরণ করুন। আর যাহা স্বচক্ষে দেখিলে, কিছুই গোপন করিও না, তৎসমস্তই অকপটে প্রকাশ করিয়া বলিয়ো।”
মারওয়ানের আজ্ঞামাত্র এম্রান নামক এক ব্যক্তি দামেস্কে যাত্রা করিলেন। মারওয়ান ছদ্মবেশে নগরের কোন এক গুপ্ত স্থানে অলীদের সহিত বাস করিতে লাগিলেন। আর আর সঙ্গীরা নিকটস্থ পর্বতগুহায় মারওয়ানের আদেশক্রমে অবস্থিতি করিতে লাগিলেন।