দামেস্ক রাজপুরীমধ্যে পুরবাসিগণ, দাসদাসীগণ, মহা ব্যতিব্যস্ত। সকলেই বিষাদিত। মাবিয়ার জীবন সংশয়, বাক্রোধ হইয়াছে, চক্ষুতারা বিবর্ণ হইয়া ঊর্ধ্বে উঠিয়াছে, কথা কহিবার শক্তি নাই। এজিদের জননী নিকটে বসিয়া স্বামীর মুখে শরবত দিতেছেন, দাস-দাসীগণ দাঁড়াইয়া কাঁদিতেছে, আত্মীয়স্বজনেরা মাবিয়ার দেহ বেষ্টন করিয়া একটু উচ্চৈঃস্বরে ঈশ্বরের নাম করিতেছেন। হঠাৎ মাবিয়া একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া “লা ইলাহা ইলাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্” এই শব্দ করিয়া উঠিলেন; সকলে গোলযোগ করিয়া ঈশ্বরের নাম করিতে করিতে বলিয়া উঠিলেন, “এবার রক্ষা পাইলেন; এবারে আল্লাহ্ রেহাই দিলেন!” আবার কিঞ্চিৎ বিলম্বে ঐ কয়েকটি কথা ভক্তির সহিত উচ্চারিত হইল। সেবারে আর বিলম্ব হইল না! অমনি আবার ঐ কয়েকটি কথা পুনর্বার উচ্চারণ করিলেন। কেহ আর কিছুই দেখিলেন না। কেবল ওষ্ঠ দুইখানি একটু সঞ্চালিত হইল মাত্র। ঊর্ধ্ব চক্ষু নীচে নামিল। নামিবার সঙ্গে সঙ্গেই চক্ষের পাতা অতি মৃদু মৃদু ভাবে আসিয়া চক্ষুর তারা ঢাকিয়া ফেলিল। নিশ্বাস বন্ধ হইল। এজিদের জননী মাবিয়ার বক্ষে হস্ত দিয়া দেখিয়াই কাঁদিয়া উঠিলেন। সকলেই মাবিয়ার জন্য কাঁদিতে লাগিলেন। এজিদ্ অশ্ব হইতে নামিয়া তাড়াতাড়ি আসিয়া দেখিলেন, মাবিয়ার চক্ষু নিমীলিত, বক্ষঃস্থল অস্পন্দ; একবার মস্তকে, একবার বক্ষে হাত দিয়াই চলিয়া গেলেন। কিন্তু কেহই এজিদের চক্ষে জল দেখিতে পায় নাই। এজিদ্ পিতার মৃত দেহ যথারীতি স্নান করাইয়া ‘কাফন’ (কাফন-শবাচ্ছাদন বসন) দ্বারা শাস্ত্রানুসারে আপাদমস্তক আবৃত করিয়া মৃতদেহের সদ্গগতির উপাসনা (জানাজা) করাইতে তাবুতে (শেষ শয়নাসন) শায়ী করাইয়া সাধারণ সম্মুখে আনয়ন করিলেন। বিনা আহ্বানে শত শত ধার্মিক পুরুষ আসিয়া জানাজাক্ষেত্রে মাবিয়ার বস্ত্রাবৃত শবদেহের সমীপে ঈশ্বরের আরাধনার নিমিত্ত দণ্ডায়মান হইলেন। সকলেই করুণাময় ভগবানের নিকট দুই হস্ত তুলিয়া মাবিয়ার আত্মার মুক্তি প্রার্থনা করিলেন। পরে নির্দিষ্ট স্থানে ‘দাফন’ (মৃত্তিকা প্রোথিত) করিয়া সকলেই স্ব-স্ব গৃহে চলিয়া গেলেন।
মাবিয়ার জীবনের লীলাখেলা একেবারে মিটিয়া গেল। ঘটনা এবং কার্য স্বপ্নবৎ কাহারো কাহারো মনে জাগিতে লাগিল। হাসান-হোসেন মদিনা হইতে দামেস্কের নিকট পর্যন্ত আসিয়া মাবিয়ার মৃত্যুসংবাদ শ্রবণে আর নগরে প্রবেশ করিলেন না। মাবিয়ার জন্য অনেক দুঃখ প্রকাশ করিয়া পুনর্বার মদিনায় যাত্রা করিলেন। মাবিয়া জগতের চক্ষু হইতে অদৃশ্য হইয়াছেন; রাজসিংহাসন পরিত্যাগ করিয়া যে স্থানে গিয়াছেন, তথা হইতে আর ফিরিবেন না, এজিদের মুখও আর দেখিবেন না, এজিদকে পাপকার্য হইতে বিরত এবং হাসান-হোসেনের প্রতি নিষ্ঠুরাচরণ নিবারণ করিতেও আর আসিবেন না, এজিদকে র্ভৎসনাও আর করিবেন না। এজিদ্ মনে মনে এই স্থির সিদ্ধান্ত করিয়া দামেস্ক রাজসিংহাসনে উপবেশন করিলেন। রাজমুকুট শিরে শোভা পাইতে লাগিল। সত্যবাদী, নিরপেক্ষ ও ধার্মিক মহাত্মাগণ; যাঁহারা হযরত মাবিয়ার স্বপক্ষ ছিলেন, তাঁহাদের হৃদয় কাঁপিয়া উঠিল। আমরাও বিষাদ-সিন্ধুর তটে আসিলাম; এজিদ্ এক্ষণে স্বাধীন রাজ্যের রাজা। কখন কাহার ভাগ্যে কি হয়, ইহা ভাবিয়া সকলেই ব্যাকুল। রাজদরবার লোকে লোকারণ্য। পূর্বদিন ঘোষণা দেওয়া হইয়াছে, শহরের সম্ভ্রান্ত লোকমাত্রই দরবারে উপস্থিত হইবেন। অনেকের মনেই অনেক কথা উঠিল, কি করেন রাজ-আজ্ঞা-নিয়মিত সময়ে সকলেই ‘আম’ দরবারে উপস্থিত হইলেন। এজিদ্ও উপযুক্ত বেশভূষায় ভূষিত হইয়া সিংহাসনোপরি উপবেশন করিলেন। প্রধানমন্ত্রী মারওয়ান দরবারস্থ সম্ভ্রান্ত-মহোদয়গণকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “আজ আমাদের কী সুখের দিন, আজ আমরা এই দামেস্কের সিংহাসনে নবীনরাজের অধিবেশন দেখিলাম। উপযুক্ত পাত্রেই আজ রাজসিংহাসন সুশোভিত হইয়াছে। সম্ভ্রান্ত মহোদয়গণ! আজ হইতে আপনাদের দুঃখ ঘুচিল। দামেস্করাজ্যে আজ হইতে যে সুখ-সূর্যের উদয় হইল, তাহা আর অস্তমিত হইবে না। আপনারা এই নবোদিত সূর্যকে কায়মনে পুনরায় অভিবাদন করুন!” সভাস্থ সকলেই নতশিরে এজিদ্কে অভিবাদন করিলেন। মারওয়ান পুনরায় বলিতে লাগিলেন, “মহোদয়গণ! আমার একটি কথা আছে। আজ মহারাজ এজিদ্ নবীন রাজদণ্ড হস্তে করিয়াছেন, আজই একটি গুরুতর বিচার ভার ইহাকে বহন করিতে হইতেছে। আপনাদের সম্মুখে রাজবিদ্রোহীর বিচার করিবেন, এই অভিপ্রায়েই আপনাদের আহ্বান করা হইয়াছে।”
মারওয়ানের পূর্ব আদেশানুসারে প্রহরীরা মোস্লেমকে বন্ধনদশায় রাজসভায় আনিয়া উপস্থিত করিল। সভাস্থ সকলে মোসলেমের দুরবস্থা দেখিয়া একেবারে বিস্ময়াপন্ন হইলেন। মাবিয়ার এত বিশ্বাসী প্রিয়পাত্র, এত সম্মানাস্পদ, এত স্নেহাস্পদ, সেই মোসলেমের এই দুরবস্থা? কী আশ্চর্য! আজিও মাবিয়ার দেহ ভূগর্ভে বিলীন হয় নাই, অনেকেই আজ পর্যন্ত শোকবস্ত্র পরিত্যাগ করেন নাই, মাবিয়ার নাম এখনো সকলের জিহ্বাগ্রেই রহিয়াছে? আজ সেই মাবিয়ার প্রিয় বন্ধুর এই দুর্দশা! কী সর্বনাশ! এজিদের অসাধ্য কী আছে? অনেকেই মনে মনে ভাবিতে লাগিলেন, আর মঙ্গল নাই। দামেস্ক রাজ্যের আর মঙ্গল নাই। কী পাষাণ হৃদয়! উঃ!! এজিদ্ কী পাষাণহৃদয়!!! কাহারো মুখ ফুটিয়া কিছুই বলিবার সাহস হইল না; সকলেই কেবল মনে মনে ঈশ্বরের নাম জপ করিতে লাগিলেন; মোস্লেম চিন্তায় ও মনস্তাপে ক্ষীণকায় হইয়াছেন, এজিদ্ বলিয়াছেন, মাবিয়ার মৃত্যুতেই তাঁহার মুক্তি কিন্তু মাবিয়া আছেন কি-না, মোস্লেম তখন তাহাও নিশ্চয় করিতে পারিলেন না। কেহ কোন কথা তাঁহাকে বলিতে পারিবেন না এবং তাঁহার কথাও কেহ জানিতে পারিবেন না,-পূর্ব হইতেই এজিদের এই আজ্ঞা ছিল। সুতরাং মোস্লেমকে কোন কথা বলে কাহার সাধ্য?
নগরের প্রায় সমুদয় ভদ্রলোককে একত্র দেখিয়া মোস্লেম কিছু আশ্বস্ত হইলেন। মনে মনে জানেন, তিনি কোন অপরাধে অপরাধী নহেন। রাজাজ্ঞা প্রতিপালন করিয়াছেন, ইহাতে যদি এজিদ্ অন্যায়াচরণ করেন, তবে একমাত্র ঈশ্বর ভিন্ন আর কাহাকেও কিছু বলিবেন না, মুক্তিলাভের প্রার্থনাও করিবেন না। মাবিয়ার আজ্ঞামাত্রেই হাসান-হোসেনের নিকট মদিনায় যাইতেছিলেন; ইহাতে যদি অপরাধের কার্য হয়, আর সেই অপরাধেই যদি প্রাণ যায়, তাহাও স্বীকার, তথাপি চিত্ত বিচলিত করিবেন না, মনে মনে এইরূপ স্থির করিয়া ঈশ্বরের প্রতি নির্ভর করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। সভ্যগণকে সম্বোধনপূর্বক মারওয়ান কহিলেন, “এই ব্যক্তি রাজবিদ্রোহী, আজ ইহারই বিচার হইবে। আমাদের নবদণ্ডধর আপনাদের সম্মুখে ইহার বিচার নিষ্পত্তি করিবেন, ইহাই তাঁহার অভিপ্রায়।”
এজিদ্ বলিলেন, “এই কাসেদ্ বিশ্বাসী নহে। যাহারা ইহাকে বিশ্বাসী বলিয়া স্থির করিয়াছে এবং ইহার অনুকূলে যাহারা কিছু বলিবে তাহারাও বিশ্বাসী নহে। আমার বিবেচনায় ইহার স্বপ লোকমাত্রেই অবিশ্বাসী-রাজবিদ্রোহী।”
সকলের শরীর রোমাঞ্চিত হইল, ভয়ে হৃদয় কাঁপিতে লাগিল, আকণ্ঠ শুকাইয়া গেল। যাঁহারা মোসলেমের সম্বন্ধে কিছু বলিতে ইচ্ছা করিয়াছিলেন, তাঁহাদের মুখ একেবারে বন্ধ হইয়া গেল।
এজিদ্ পুনর্বার বলিতে লাগিলেন, “এই মিথ্যাবাদী বিশ্বাসঘাতক, আমার বিবাহ পয়গাম লইয়া জয়নাবের নিকট গিয়াছিল। আমার পয়গাম গোপন করিয়া আমার চিরশত্রু হাসান, যাহার নাম শুনিলে আমার দিগ্বিদিক্ জ্ঞান থাকে না, সেই হাসানের পয়গাম জয়নাবের নিকট বলিয়া, জয়নাবের সহিত তাহার বিবাহ দিয়াছে। আমি নিশ্চয় জানি, আমার পয়গাম জয়নাবের কর্ণগোচর হয় নাই। আমার নাম শুনিলে জয়নাব কখনোই হাসানকে ‘কবুল’ করিত না। হাসানের অবস্থা জয়নাবের অবিদিত কিছুই নাই। কেবল মিথ্যাবাদীর চক্রান্তে জয়নাবরত্ন শত্রুহস্তে পতিত হইয়াছে। আরো কথা আছে। এই মিথ্যাবাদী যাহা বলে, তাহাই যদি সত্য বিবেচনা করিয়া লওয়া যায়, তাহা হইলেও ইহার অপরাধ আরো গুরুতর হইয়া দাঁড়ায়। আমার চিরশত্রুর আজ্ঞা প্রতিপালন করিয়া আমারই সর্বনাশ করিয়াছে। হাসানের পয়গাম জয়নাবের নিকট লইয়া যাইতে আমি ইহাকে নিয়োজিত করি নাই। ইহার অপরাধের শাস্তি হওয়া আবশ্যক। না জানিয়া এই কার্য করিয়াছে, তাহাও বলিতে পারি না। জয়নাব লাভের জন্য আমি যাহা করিয়াছি, তাহা কে না জানে? মোস্লেম কি জানে না যে, যে জয়নাবের জন্য আমি সর্বস্ব পণ করিয়া শেষে জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলাম, সেই জয়নাবের বিবাহে আমার পক্ষে উকীল নিযুক্ত হইয়া অপরের সঙ্গে বিবাহ স্থির করিয়া আসিল, ইহা অপেক্ষা বিশ্বাসঘাতকতা আর কি আছে? আর একটি কথা। এই সকল কুকার্য করিয়াও এই ব্যক্তি ক্ষান্ত হয় নাই; আমারই সর্বনাশের জন্য,-আমাকেই রাজ্য হইতে বঞ্চিত করিবার নিমিত্ত, আমাকেই পথের ভিখারী করিবার আশয়ে, মাবিয়ার পত্র লইয়া হাসানের নিকট মদিনায় যাইতেছিল। অতএব আমার এই আজ্ঞা যে, অবিলম্বেই মোসলেমের শিরচ্ছেদন করা হউক।” সরোষে কাঁপিতে কাঁপিতে এজিদ্ পুনরায় বলিতে লাগিলেন, “সে দণ্ড বধ্যভূমিতে হইবে না, অন্য কোন স্থানেও হইবে না, এই সভাগৃহে আমার সম্মুখেই আমার দণ্ডাজ্ঞা প্রতিপালিত হউক।”
মারওয়ান বলিলেন, “রাজাজ্ঞা শিরোধার্য। কিন্তু প্রকাশ্য দরবারে দণ্ডবিধান রাজনীতি বিরুদ্ধ।”
এজিদ্ বলিলেন, “আমার আজ্ঞা অলঙ্ঘনীয়। যে ইহার বিরোধী হইবে, তাহারও ঐ শাস্তি। মারওয়ান! সাবধান!”
সকলের চক্ষু যেন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হইল। এজিদের মুখের কথা মুখে থাকিতে থাকিতেই অভাগ্য মোসলেমের ছিন্নশির ভূতলে লুণ্ঠিত হইতে লাগিল! জিঞ্জিরাবদ্ধ দেহ শোণিতাক্ত হইয়া সভাতলে পড়িয়া সভ্যগণের মোহ ভঙ্গ করিল! তাঁহারা চাহিয়া দেখিলেন, মোস্লেম আর নাই। রক্তমাখা দেহ মস্তক হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া ধরাতলে গড়াগড়ি যাইতেছে! মোসলেমের পবিত্র শোণিত-বিন্দুর পরমাণু অংশে দামেস্ক-রাজ-ভবনের পবিত্রতা, সিংহাসনের পবিত্রতা, দরবারের পবিত্রতা, ধর্মাসনের পবিত্রতা, মাবিয়া যাহা বহু কষ্টে সঞ্চয় করিয়াছেন, সেই সমস্ত পবিত্রতা আজ মোস্লেমের ঐ শোণিতবিন্দুর প্রতি পরমাণুতে মিশিয়া বিকট অপবিত্রতার আসন পাতিয়া দিল। মোস্লেমের দেহবিনির্গত রক্তাধারে “এজিদ্! ইহার শেষ আছে!” এই কথা কয়েকটি প্রথম অঙ্কিত হইয়া রক্তস্রোত সভাতলে বহিয়া চলিল। এজিদ্ সগর্বে বলিতে লাগিলেন, “অমাত্যগণ! প্রধান প্রধান সৈনিক ও সৈন্যাধ্যগণ! এবং সভাস্থ মহোদয়গণ! আপনারা সকলেই মনোযোগপূর্বক শ্রবণ করুন। আমার আজ্ঞা যে কেহ অমান্য করিবে, যে কেহ তাহার অণুমাত্র অবহেলা করিবে, সেই ব্যক্তি নিশ্চয়ই মোস্লেমের ন্যায় শাস্তি ভোগ করিবে। আমার ধনবল, সৈন্যবল, বাহুবল, সকলই আছে, কোন বিষয়ে আমার অভাব নাই। হাসান-হোসেনের যাহা আছে, তাহা কাহারো অজ্ঞান নাই। সেই হাসানের এত বড় সাহস! এত বড় স্পর্ধা! ভিখারিণীর পুত্র হইয়া রাজরাণীর পাণিগ্রহণ!-যে জয়নাব রাজরাণী হইত, সেই ভিখারিণীর পুত্র তাহারই পাণিগ্রহণ করিয়াছে। আমি উহার বিবাহের সাধ মিটাইব। জয়নাবকে লইয়া সুখভোগ করিবার সমুচিত প্রতিফল দিব। কে রক্ষা করিবে? কাহার আশ্রয় গ্রহণ করিবে? এজিদ্ জগতে থাকিতে জয়নাবকে লইয়া সে কখনোই সুখী হইতে পারিবে না। এখনো সে আশা আমার অন্তরে আছে, যে আশা একপ্রকার নিরাশ হইয়াছে, হাসান বাঁচিয়া থাকিতে জয়নাব লাভ হইবার আর সম্ভাবনা নাই। তথাচ সেই মহা-আসক্তি আগুনে এজিদের অন্তর সর্বদা জ্বলিতেছে। যদি আমি মাবিয়ার পুত্র হই, তবে হাসান-হোসেনের বংশ একেবারে নিপাত না করিয়া জগৎ পরিত্যাগ করিব না। শুধু হাসানের মৃতদেহ দেখিয়াই যে, সে মহাগ্নি নির্বাপিত হইবে, তাহা নহে; হাসানের বংশ মধ্যে সকলের মস্তক দ্বিখণ্ডিত করিয়াই যে এজিদ্ ক্ষান্ত হইবে তাহাও নহে। মোহাম্মদের বংশের একটি প্রাণী বাঁচিয়া থাকিতে এজিদ্ ক্ষান্ত হইবে না; তাহার মনোবেদনাও মন হইতে বিদূরিত হইবে না। আমার অভাব কী? কাহারো সাহায্য চাহি না; হিতোপদেশ অথবা পরামর্শের প্রত্যাশা রাখি না। যাহা করিব, তাহা মনেই থাকিল। তবে এইমাত্র বলি যে, হাসান-হোসেনের এবং তাহাদের বংশানুবংশ আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবের প্রতি এজিদ্ যে দৌরাত্ম্য-অগ্নি জ্বালাইয়া দিবে, যদি তাহা কখনো নিবিয়া যায়, যাইতে পারে, কিন্তু সে তাপ ‘রোজ কিয়ামত’ জগতের শেষ দিন পর্যন্ত মোহাম্মদীয়গণের মনে একইভাবে জাগরিত থাকিবে। আবার যাহারা হাসান-হোসেনের বেশি ভক্ত, তাহারা আজন্মকাল ছাতি পিটিয়াও ‘হায় হাসান! হায় হোসেন!’ বলিয়া কাঁদিতে থাকিবে।”
সভ্যগণকে এই সকল কথা বলিয়া এজিদ্ পুনরায় মারওয়ানকে বলিল, “হাসান-হোসেনের নিকট যে পত্র পাঠাইবে, সেই পত্রখানা পাঠ করিয়া ইহাদিগকে একবার শুনাইয়া দাও, ইহাদিগের মধ্যে মোহাম্মদভক্ত অনেক আছেন।” মারওয়ান পত্র পাঠ করিতে লাগিলেন,-
“হাসান! হোসেন!
তোমরা কি এ পর্যন্ত শুন নাই যে, মহারাজাধিরাজ এজিদ্ নামদার মধ্যাহ্নকালীন সূর্যসম দামেস্কসিংহাসনে বিরাজ করিতেছেন। অধীনস্থ রাজা প্রজা মাত্রেই তাঁহার অধীনতা স্বীকার করিয়া কেহ বা উপঢৌকন প্রেরণ, কেহ বা স্বয়ং আসিয়া অবনতশিরে চির-অধীনতা স্বীকার করিয়াছেন; আপন আপন রাজ্যের নির্ধারিত দেয় করে দামেস্ক রাজভাণ্ডার পূর্ণ করিয়াছেন। তোমাদের মক্কা-মদিনার খাজনা আজ পর্যন্ত না আসিবার কারণ কি? স্বয়ং মহারাজাধিরাজ দামেস্কাধিরাজের দরবারে উপস্থিত হইয়া, নতশিরে ন্যূনতা স্বীকারে রাজসিংহাসন চুম্বন কর। আর এই পত্র প্রাপ্ত হইয়া এজিদ্ নামদারের নামে খোৎবা পাঠ করিবে, ইহার অন্যথাচরণ হইলেই রাজদ্রোহীর শাস্তি ভোগ করিতে হইবে।
মারওয়ান, প্রধানমন্ত্রী।”
পত্র পাঠ শেষ হইল। তখনই উপযুক্ত কাসেদের হস্তে পত্র দিয়া নবীন রাজা সভাভঙ্গের অনুমতি করিলেন। অনেকেই বিষাদনেত্রে অশ্রুপাত করিতে করিতে সভাগৃহ হইতে বহির্গত হইলেন।
যোগ ও মনবিজ্ঞান পড়লাম মনে হল অমৃত পানকরলাম