সময় যাইতেছে। যাহা যাইতেছে, তাহা আর ফিরিয়া আসিতেছে না। আজ যে ঘটনা হইল, কাল তাহা দুই দিন হইবে। ক্রমে দিনের পর দিন, সপ্তাহ, পক্ষ, মাস অতীত হইল, দেখিতে দেখিতে কালচক্রের অধীনে বৎসরে পরিণত হইবে। বৎসর, বৎসর, অনন্ত বৎসর। যে কোন ঘটনাই হউক, অবিশ্রান্ত গতিতে তাহা বহুদূরে বিনিপ্তি হইতেছে। জয়নাবের বৈধব্যব্রত সাঙ্গ হইল। হাসান স্বয়ং জয়নাবের ভবনে যাইয়া জয়নাবকে বিবাহ করিয়া আনিলেন। প্রথমা স্ত্রী হাসনেবানু, দ্বিতীয়া জায়েদা, তৃতীয়া জয়নাব! হাসনেবানু প্রথমা স্ত্রী, তদ্গর্ভজাত একমাত্র পুত্র আবুল কাসেম। আবুল কাসেম পূর্ণবয়স্ক, সর্বগুণে গুণান্বিত। এ পর্যন্ত পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন নাই। পিতার অনুবর্তী থাকিয়াই কালাতিপাত করিতেছেন। পুণ্যভূমি মদিনা অতি পবিত্র স্থান। লোকমাত্রেই ঈশ্বরভক্ত পাপশূন্য চরিত্র। কাসেম পবিত্র বংশে জন্মেয়াছেন। তাঁহার আপাদমস্তক পবিত্র। অস্ত্রবিদ্যাতেও বিশারদ। এই অমিত-তেজী মহাবীর কাসেমের কীর্তি বিষাদ-সিন্ধুর একটি প্রবল তরঙ্গ। পাঠকগণকে পূর্বেই তাহার কিঞ্চিৎ পরিচয় দিয়া রাখিলাম। জায়েদার সন্তান-সন্ততি কিছুই নাই। এক বস্তুর দুই গ্রীবা হইলেই মহা গোলমাল উপস্থিত হয়। সপত্নীবাদ কোথায় না আছে? হাসনেবানু হাসানের প্রধানা স্ত্রী সকলের মাননীয়া। তৎপ্রতি জায়েদার আন্তরিক বিদ্বেষভাব থাকিলেও তাহা কার্যে পরিণত করিতে পারিতেন না। কিন্তু জয়নাবের সহিত তাঁহার সমভাব চলিতে লাগিল। জায়েদা ভাবিয়াছিলেন, হাসান তাহাতেই অনুরক্ত। পূর্বে যাহা হইবার হইয়াছে, কিন্তু জায়েদা বাঁচিয়া থাকিতে পুনরায় দারপরিগ্রহ করিবেন না। এক্ষণে দেখিলেন, তাঁহার সে বিশ্বাস ভ্রমসঙ্কুল। এখন নিশ্চয়ই বুঝিলেন, হাসানের ভালবাসা আন্তরিক নহে;-আন্তরিক হইলে এরূপ ঘটিত না। এক মনও ভিন্ন ভিন্ন তিন ভাগে বিভক্ত করিতে পারিতেন না। ক্রমেই পূর্বভাবের অনেক পরিবর্তন দেখিলেন। হাসানের কথায়, কার্যে ভালবাসার কিছুই ত্রুটি পাইলেন না; তথাচ পূর্বভাব, পূর্ব প্রণয়, পূর্ব ভালবাসার মধ্যে কি যেন একটু ছিল তাহা নাই। সেই গৃহ, সেই স্বামী, সেই হাসান, সেই জায়েদা সকলই রহিয়াছে, তথাচ ইহার মধ্যে কি যেন অভাব রহিয়াছে। জায়েদা মনে মনে সাব্যস্ত করিলেন, এ দোষ আমার নয়, হাসানের নয়, এ দোষ জয়নাবের। জয়নাবকে যে এই দোষে দোষী সাব্যস্ত করিলেন আজিও করিলেন, কালিও করিলেন, জীবন শেষ পর্যন্ত করিয়া রাখিলেন। সে দোষ ক্রমেই অন্তরে বদ্ধমূল হইয়া শত্রুভাব আসিয়া দাঁড়াইল। জয়নাব এক্ষণে তাঁহার দুই চরে বিষ। জয়নাবকে দেখিলেই তাঁহার মনের আগুন জ্বলিয়া উঠে। হাসনেবানুর ভয়ে যে আগুন এতদিন চাপা ছিল, ক্রমে ক্রমে জয়নাবের রূপরাশিজ্যোতিঃতেজে উত্তেজিত হইয়া সেই আগুন একেবারে জ্বলিয়া উঠিল। অন্তরে আগুন, মুখেও জয়নাব নাম শ্রবণে একেবারে আগুন হইয়া উঠিতেন। শেষে হাসনেবানু পর্যন্ত জানিতে পারিলেন যে, জায়েদা জয়নাবের নাম শুনিলেই জ্বলিয়া উঠে। হাসনেবানু কাহাকেও কিছু বলিতেন না; কিন্তু জয়নাবকে মনে মনে ভালবাসিতেন। হাসান জয়নাবকে পূর্ব হইতেই ভালবাসিতেন, যত্নও করিতেন, এখন পর্যন্তও তাহার কিছুমাত্র ব্যতিক্রম হয় নাই। তথাপি জায়েদার মনে যে কি প্রকারের উদাসভাব উদয় হইয়াছে, তিনিই জানেন; আর কাহারো জানিবার শক্তি নাই।
এক অন্তরে দুই মূর্তির স্থাপন হওয়া অসম্ভব। ইহার পর তিনটি যে কি প্রকারের সঙ্কুলান হইল, সমভাবে সমশ্রেণীতে স্থান পাইল, তাহা আমাদের বুদ্ধিতে আসিল না; সুতরাং পাঠকগণকে বুঝাইতে পারিলাম না। আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধির ক্ষমতা কত? অপ্রশস্ত অন্তরের আয়ত্তই বা কত যে, ঐ মহাপুরুষের কীর্তিকলাপে বুদ্ধি চালনা করি। মনের কথা মনেই থাকিল। হাসান প্রকাশ্যে স্ত্রীত্রয়ের মধ্যে যে কিছু ইতর বিশেষ জ্ঞান করিতেন, তাহা কেহ কখনোই জানিতে পারেন নাই। তিন স্ত্রীকেই সম-নয়নে দেখিতেন, সমভাবে ভালবাসিতেন, কিন্তু সেই সমান ভালবাসার সঙ্গে সঙ্গে হাসনেবানুকে অপেক্ষাকৃত অধিক মান্য করিতেন। জয়নাব সর্বাপেক্ষা সুশ্রী, স্বভাবত তাঁহাকে বেশি আদর ও বেশি যত্ন করেন, জায়েদার মনে এইটিই বদ্ধমূল হইল। প্রকাশ্য কোন বিষয়ে বেশি ভালবাসার চিহ্ন কখনো দেখিতে পান নাই, তথাচ তাঁহার মনে সন্দেহ ঘুচিল না। কোন দিন, জায়েদার প্রতি যত্নের ত্রুটি, কি কোন বিষয়ে ক্ষতি, কি অণুমাত্রও ভালবাসার লাঘব দেখিলাম না। তথাচ জয়নাব তাঁহার পরম শত্রু, চরে শূল, সুখ-পথের প্রধান কণ্টক।
ইমাম হাসান ধর্মশাস্ত্রের অকাট্য বিধি উলঙ্ঘন করিয়া জয়নাবকে বিবাহ করেন নাই। ইচ্ছা হইলে এখনও চতুর্থ সংখ্যা পূর্ণ করিতে পারেন। ভালবাসার ন্যূনাধিক্যে তাঁহার কোন স্ত্রী তাঁহাকে কোন নিন্দা করিতে পারেন না। তবে জায়েদা এত বিষাদিনী হইলেন কেন? কেন জয়নাবকে বিষদৃষ্টিতে দেখিতে লাগিলেন? বোধ হয় জায়েদা ভাবিতেন যে, একটি স্ত্রীর তিনটি স্বামী হইলে সে স্ত্রীলোকটি যে প্রকার সুখী হয়, তিনটি স্ত্রীর এক স্বামীও, বোধ হয়, সেই প্রকার সুখভোগ করে। কিন্তু সেই স্বামীত্রয়ের মধ্যে যদি কোন বিষয়ে অসুবিধা কি কোন কারণে হিংসা, দ্বেষ ও ঈর্ষার প্রাদুর্ভাব হইয়া আত্মকলহ উপস্থিত হয় এবং একের অনিষ্ট চিন্তায় দ্বিতীয় যত্ন করে, তৃতীয় কাহারো স্বপক্ষে কি উভয়কে শত্রু মনে করিয়া শত্রুবিনাশে একেবারে কৃতসঙ্কল্প হয়, তবে আমারই বা না হইবে কেন? আমিও তো শরীরী, আমারও ক্ষুধা আছে, তৃষ্ণা আছে, মাংসপেশী, ধমনী, হৃদয়, শোণিত, অস্থি, চর্ম ও ইচ্ছা সকলই আছে, তবে মনোভাবের বিপর্যয় হইবে কেন? এক উপকরণে গঠিত শরীরে স্বাভাবিক নিয়ম লঙ্ঘন অথবা ভিন্ন ভাব হওয়া অসম্ভব। জগতে শত্রুও তিন প্রকার। প্রথমে প্রকৃত শত্রু, দ্বিতীয় শত্রুর বন্ধু, তৃতীয় মিত্রের শত্রু! এই সূত্র অনুসারে মৈত্রবন্ধন হইতে হাসান যেন অল্পে অল্পে সরিতে লাগিলেন।
স্বামীর নিরপেক্ষ ভালবাসা জায়েদা আর ভালবাসিলেন না, মনের কথা মনেই থাকিল। কোন দিন কোন প্রকারে কী কোন কথায় কী কোন কথার প্রসঙ্গেও সে কথা মুখে আনা দূরে থাকুক, কণ্ঠে পর্যন্তও আনিলেন না। স্ত্রীলোকমাত্রেই স্বভাবতঃ কিছু চাপা। তাহারা কাজকর্মে যেমন ভারী, পরিমাণেও তদপেক্ষা দ্বিগুণ ভারী; সহজে উঠাইতে কাহারো সাধ্য নাই। এক একটি স্ত্রীলোকের মনের কপাট খুলিয়া যদি বিশেষ তন্ন তন্ন ভাবে দেখা যায়, আর যাহা আছে, তাহা যদি চেনা যায়, তাহা হইলে অনেক বিষয়ে শিক্ষাও পাওয়া যায় এবং মনের অন্ধকার প্রায়ই ঘুচিয়া যায়। সে মনে না আছে, এমন জিনিসই নাই। সে হৃদয়ভাণ্ডারে না আছে, এমন কোন পদার্থই নাই। জয়নাব হাসনেবানুকে মনের সহিত ভক্তি করিতেন। জায়েদাকেও জ্যেষ্ঠ ভগ্নীর ন্যায় মান্যের সহিত স্নেহ করিতেন। কিছুদিন এই ভাবেই চলিল। কোন কালেই কোন প্রকার লোকের অভাব ছিল না, এজিদের চক্রান্তে আবদুল জাব্বারের দুরবস্থা হাসান পূর্বেই শুনিয়াছিলেন। আবার এখন পর্যন্ত জয়নাবের মোহিনী-মূর্তি এজিদের চক্ষে সর্বদা বিরাজ করিতেছে। তাঁহার বিবাহের পর এজিদের প্রতিজ্ঞা, মাবিয়ার র্ভৎসনা, সকল কথাই মদিনায় আসিয়াছে। কোন কথা শুনিতেই তাঁহার আর বাকি নাই। মাবিয়া দিন দিন ক্ষীণ ও বলহীন হইতেছেন, বাঁচিবার ভরসা অতি কমই আছে, তাহাও লোকমুখে শুনিতেছেন। এজিদের সহিত বাল্যকালে বাল্যক্রীড়া ঝগড়া বিবাদ হইত, এজিদ্ তাঁহাদের দুই ভ্রাতাকেই দেখিতে পারিতেন না, একথা লইয়াও সময়ে সময়ে গল্পচ্ছলে জয়নাবকে শুনাইতেছেন। এক্ষণে জয়নাবলাভে বঞ্চিত হইয়া শত্রুভাব সহস্রগুণে এজিদের অন্তরে দৃঢ়রূপে স্থায়ী হইয়াছে, তাহাও জয়নাবকে বলিতেন। হাসান অনেক লোকের মুখে অনেক কথা শুনিলেন; সে সকল কথায় মনোযোগ, কি বিশ্বাস করিয়া তাহার আদি অন্ত তন্ন তন্ন করিয়া কখনোই শুনিলেন না। সাধারণের মুখে এক কথার শাখা-প্রশাখা বাহির হইয়া শত সহস্র পত্রে পরিণত হয়। সে সময় মূল কথার অণুমাত্রও বিশ্বাসের উপযুক্ত থাকে না। হাসান তাহাই বিবেচনা করিয়া এক কর্ণে শুনিলেন, অন্য কর্ণে বাহির করিয়া দিলেন। ধর্মোপদেশ, ধর্মচর্চাই জীবনের একমাত্র কার্য মনে করিয়া ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন। যদিও মদিনার রাজা, কিন্তু রাজসিংহাসনের পারিপাট্য নাই, সৈন্য সামন্ত ধন জন কিছুই নাই। কিন্তু আবশ্যক হইলে ঈশ্বরপ্রসাদে অভাবও নাই। মদিনাবাসীরা হাসান-হোসেন দুই ভ্রাতার আজ্ঞাবহ কিঙ্কর, তাঁহাদের কার্যে, তাঁহাদের বিপদে বিনা অর্থে, বিনা স্বার্থে, বিনা লাভে জীবন দিতে প্রস্তুত।
হাসান সন্ধ্যাকালীন উপাসনা সমাধা করিয়া তস্বি (জপমালা) হস্তে উপাসনা-মন্দিরের সম্মুখে পদচালনা করিয়া ঈশ্বরের নাম জপ করিতেছেন, এমন সময় একজন ফকির জাতীয় প্রথানুসারে অভিবাদন করিয়া সম্মুখে দণ্ডায়মান হইল। ফকিরের মলিন বেশ, শতগ্রন্থিযুক্ত পিরহান, মলিন বস্ত্রে শির আবৃত, গলায় প্রস্তরের তস্বি, হস্তে কাষ্ঠযষ্টি। হাসানের কিঞ্চিৎদূরে দণ্ডায়মান হইয়া সেই বৃদ্ধ বলিলেন, “প্রভো! আমি একটি পর্বতের উপর বসিয়াছিলাম। দেখি যে, একজন কাসেদ্ আসিতেছে, হঠাৎ ঈশ্বরের নাম করিয়া সেই কাসেদ্ ভূতলে পতিত হইল। কারণ কিছুই জানিতে পারিলাম না। নিকটস্থ হইয়া দেখি যে, একটি লৌহশর তাহার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করিয়া পৃষ্ঠদেশ পার হইয়া, কঠিন প্রস্তর খণ্ড বিদ্ধ করিয়াছে। শোণিতের ধারা বহিয়া চলিতেছে। কোথা হইতে কে শর নিপে করিল, এমন লঘুহস্তে শর নিক্ষেপে সুনিপুণ যে, এক বাণে পথিকের হৃদয় বিদ্ধ করিয়া পৃষ্ঠ পর্যন্ত ভেদ করিল। তখনও তাহার প্রাণ বিয়োগ হয় নাই। দুই একটি কথা অস্ফুট স্বর যাহা শুনিলাম, আর ভাবেও যাহা বুঝিতে পারিলাম, তাহার মর্ম এই যে হজরত মাবিয়া আপনার নিকট কাসেদ্ পাঠাইয়াছিলেন। তিনি অত্যন্ত পীড়িত, বাঁচিবার ভরসা অতি কম। জীবনে শেষ দেখাশুনার জন্যই আপনাকে সংবাদ দিতে বোধ হয়, কাসেদ্ আসিতেছিল, আমি দ্রুতগামী অশ্বের পদধ্বনি শুনিয়া সম্মুখে লক্ষ্য করিলাম। দেখিলাম, এজিদ্ অশ্বোপরি বীরসাজে ধনুহস্তে বেগে আসিতে। পৃষ্ঠের বাম পার্শ্বে তূণীর ঝুলিতেছে, দেখিয়াই পর্বতের আড়ালে লুকাইলাম। আড়াল হইতে দেখিলাম, এজিদ্ অশ্ব হইতে নামিয়া পথিকের কটিবদ্ধ খুলিয়া, একখানি পত্র লইয়া, অশ্বে কষাঘাত করিতে করিতে চক্ষুর অগোচর হইল। আপনার নিকট সেই সংবাদ দিতে আসিয়াছি। আর আমার কোন কথা নাই।” এই বলিয়া আগন্তুক ফকির পুনারভিবাদন করিয়া একটু দ্রুতপদে চলিয়া গেল। হাসান ভাবিতে লাগিল ফকির কে? কেনই-বা আমাকে এ সংবাদ দিতে আসিয়াছিল? কথার স্বর ও মুখচ্ছবি একেবারে অপরিচিত বলিয়াও বোধ হইল না। অনেকণ পর্যন্ত ফকিরের বিষয় চিন্তা করিয়া তিনি শেষে সাব্যস্ত করিলেন যে, ফকির আর কেহই নয়, এ সেই আবদুল জাব্বার। একে একে আবদুল জাব্বারের অবয়ব ভাবভঙ্গি কথার স্বরে নিশ্চয়ই প্রমাণ হইল যে, আর কেহই নয়, এ সেই আবদুল জাব্বার। কী আশ্চর্য! মানুষের অবস্থা কখন কিরূপ হয় কিছুই জানিতে পারা যায় না। হজরত মাবিয়ার কথা যেরূপ শুনিলাম ইহাতে তাহার জীবনাশা অতি কমই বোধ হয়। যাহা হউক, হোসেনের সহিত পরামর্শ করিয়া যাহা করিতে হয় করিব; এই বলিয়া তৎণাৎ নিজ গৃহাভিমুখে চলিয়া গেলেন।