মোস্লেমকে জয়নাবের নিকটে পাঠাইয়া এজিদ্ প্রতিদিন দিন গণনা করিতে লাগিলেন। তাঁহার গণনা অনুসারে যেদিন মোস্লেমের প্রত্যাগমন সম্ভব, সেদিন চলিয়া গেল। মোস্লেমের আগমন প্রতীক্ষায় এজিদ্ সূর্য অস্তের কামনা করিয়া সন্ধ্যাদেবীর প্রতীক্ষায় ছিলেন। তমোময়ী সন্ধ্যাও দিবাকরের অস্তাচলে গমনের সঙ্গে সঙ্গেই দেখা দিলেন। কিন্তু এজিদ্ মোস্লেমকে দেখিতে পাইলেন না। তাহার পর ক্রমে সপ্তাহ যায়, মোস্লেমর সংবাদ নাই। যে পথ অতি কষ্টে এক দিনে অতিক্রম করা যায়, সে পথ এজিদ্ মনঃকল্পিত গণনায় অর্ধ দিনে আসিয়া, মোস্লেমর প্রত্যাগমন সম্ভব স্থির করিয়া যে আশ্বস্ত হইয়াছিলেন, সে তাঁহার ভ্রম নহে। কারণ প্রণয়াকাঙ্খীর প্রাণ আকাঙ্খিত প্রণয়রত্ন লাভের সুসংবাদ শুনিতে অমূল্য সময়কে যত শীঘ্র হয়, দূর করিয়া একদিনে দুই তিন বার সূর্যকে উদয় অস্ত করিতে ইচ্ছা করে। আবার সুখসময়ের দীর্ঘতার জন্য অনেকে অনেক সময়ে লালায়িত হয়; ল্যাপল্যান্ডবাসীকে সহস্রবার ধন্যবাদ করে। ইহা চিরকালই প্রসিদ্ধি আছে যে, সুখসূর্য শীঘ্রই অস্তমিত হয়। সুখনিশি শীঘ্র শীঘ্র ঊষাকে আমন্ত্রণ করিয়া প্রভাতকে আনয়ন করে। সুখী দুঃখী পরস্পর সকলেরই আক্ষেপ এবং সকলেরই দুঃখ। কিন্তু স্বভাব কাহারো কথায় কর্ণপাত করে না। প্রণয়ীর প্রতি অথবা প্রণয়ের প্রতিও ফিরিয়া তাকায় না। বিরহীর দুঃখেও দুঃখিত হয় না। সময় যে নিয়মে যাইতেছে, সেই নিয়মে কতদিন যাইবে, তাহা কে বলিতে পারে? এজিদের মনে কত কথাই উদয় হইতেছে। কথা ভাঙ্গিবার একমাত্র দোসর মারওয়ান। সে মারওয়ানও এক্ষণে উপস্থিত নাই। নানাপ্রকার চিন্তায় চিন্তিত।
মাবিয়া পীড়িত। তাঁহার ব্যাধি সাংঘাতিক, বাঁচিবার আশা অতি কম। এজিদের সে দিকে দৃক্পাত নাই, পিতার সেবা-শুশ্রূষাতেও মন নাই; প্রস্ফুটিত গোলাপদলবিনিন্দিত জয়নাবের সুকোমল বদনমণ্ডলের আভা, সে আয়তলোচনার নয়নভঙ্গির সুদৃশ্য দৃশ্য,-দিবারাত্রি তাঁহার অন্তরপটে আঁকা! ভ্রূযুগলের অগ্রভাগ, যাহা সুতীক্ষ্ণ বাণের ন্যায় অন্তর ভেদ করিয়া অন্তরে রহিয়াছে, দিবারাত্রি সেই বিষেই বিষম কাতর। সেই নাসিকার সরলভাবে সর্বদাই আকুল। ঈষৎলোহিত অধরোষ্ঠ পুনঃ পুনঃ দেখিবার আশা সততই বলবতী। আজ পর্যন্ত চিকুরগুচ্ছের লহরীশোভা ভুলিতে পারেন নাই। সামান্য অলঙ্কার, যাহা জয়নাবের কর্ণে দুলিতে দেখিয়াছিলেন, সেই দোলায় তাঁহার মস্তক আজ পর্যন্ত অবিশ্রান্ত দুলিতেছে, ললাটের উপরিস্থিত মালার জালি (‘জালি’-আরবদেশীয় অলঙ্কার) যাহা অর্ধচন্দ্রাকারে চিকুরের সহিত মিলিত হইয়া কিঞ্চিৎভাগ ললাটের শোভাবর্ধন করিয়াছিল, তাঁহার মনপ্রাণ সেই জালে আটক পড়িয়া আজ পর্যন্ত ছট্ফট্ করিতেছে। সেই হাসিপূর্ণ মুখখানির হাসির আভা, জয়নাবের অজ্ঞাতে একবার দেখিয়াছিলেন, কতবার নিদ্রা গিয়াছেন, কত শতবার চক্ষের পলক ফেলিয়াছেন, তথাচ সেই মধুর হাসির আভাটুকু আজ পর্যন্তও চক্ষের নিকট হইতে সরিয়া যায় নাই, সমস্তই মনে জাগিতেছে। মোস্লেম আসিলেই জয়নাবের কথা শুনিবেন। কত আগ্রহে জয়নাব তাঁহার প্রস্তাবে সম্মত হইয়াছে, কথার ছলে সে কথাটি অন্ততঃ দু’বার তিনবার দোহরাইয়া শুনিবেন। কি ভাবে বলিয়াছিল, মোস্লেমকে বারবার জিজ্ঞাসা করিয়া তাহার আদি অন্ত তন্ন তন্ন রূপে শুনিবেন। প্রথম মিলনের নিশীথে জয়নাবকে কি বলিয়া সম্বোধন করিবেন, আজ পর্যন্তও তাহার মীমাংসা করিয়া উঠিতে পারেন নাই। সালেহার বিবাহের আদি অন্ত ঘটনা এবং তাঁহার ভগ্নীমাত্র কেহই নাই, অথচ সালেহা নাম-এই ষড়যন্ত্র যে কেবল জয়নাব লাভের জন্য হইয়াছিল, তাহা অকপটে বলিবেন কি না আজ পর্যন্তও স্থির করিতে পারেন নাই। এই সকল অমূলক চিন্তায় এবং মোস্লেমর প্রত্যাগমনের বিলম্বে পূর্ব হইতে আরো অস্থিরচিত্ত হইয়াছিলেন। আজ খাদ্যসামগ্রী যথাস্থানেই পড়িয়া রহিয়াছে, সেবকগণ প্রভুর আহারের প্রতীক্ষায় কিঞ্চিৎ দূরে বসিয়া কত কি বলিতেছে, মৃদু ভাবে নানাপ্রকার অকথ্য কথনে এজিদের নিন্দা করিতেছে, ‘ঈশ্বর দাসত্বশৃঙ্খলে আবদ্ধ করিয়াছেন, কি করিব উপায় নাই’, এই বলিয়া নিজ নিজ অদৃষ্টকে ধিক্কার দিতেছে। রজনী দ্বিপ্রহর গত হইল, তথাচ এজিদের চিন্তার শেষ হইল না। কখনো উঠিতেছেন, গৃহমধ্যে দুই চারি পদ চালনা করিয়া আবার বসিতেছেন, ক্ষণকাল ঐ উপবেশনশয্যাতেই শয়ন করিয়া এপাশ ওপাশ করিতেছেন। ক্ষুধাতৃষ্ণা থাকিলে অবশ্যই আহারের প্রতি মনোযোগ করিতেন। সমস্তই ভুল, কিছুতেই মন স্থির করিতে পারিতেছেন না।
সকল সময়েই সকল স্থানেই, এজিদের নিকট মারওয়ানের যাইবার অনুমতি ছিল। মারওয়ান আসিয়াই অভিবাদন করিয়া সম্মুখে উপবেশন করিলেন। এজিদের চিত্তচাঞ্চল্য দেখিয়া চিন্তিতভাবে বলিলেন, “যখন কোন পথ ছিল না, তখনই চিন্তিত হইবার কথা, এখন তো হস্তগত হইবারই অধিক সম্ভাবনা; এখন আর চিন্তা কী? বলুন তো জগতে সুখী হইতে কে না ইচ্ছা করে? আবার সে সুখ সামান্য সুখ নয়, একেবারে সীমার বহির্ভূত। অবস্থার একটু উচ্চ পরিবর্তন হইলেই লোকে মহা সুখী হয়; এ তো একটু পরিমাণ নয়, একেবারে পাটরাণী। বিশেষ স্ত্রীজাতি বাহ্যিক সুখপ্রিয়। আপনি কোন প্রকার সন্দেহ মনে স্থান দিবেন না; নিশ্চয় জানিবেন, জয়নাব কখনোই অসম্মত হইবে না। আমি স্পষ্টাক্ষরে লিখিয়া দিতে পারি যে, জয়নাব আপনারই হইবে এবং আপনারই অঙ্ক শোভা করিবে।”
এজিদ্ বলিলেন, “সন্দিহান মনের সন্দেহ অনেক। সকলগুলি যে যথার্থ সন্দেহ, তাহা নহে। আমি সেজন্য ভাবিতেছি না। জয়নাবের বৈধব্যব্রত সমাধা হইতে এখনও অনেক বিলম্ব।”
“সেই বা আর কত দিন? সময় যাইতেছে, ফিরিতেছে না, এক ভাবেও থাকিতেছে না। সময়ে গতির বিশ্রাম নাই, ক্লান্তি নাই, শ্রান্তি নাই। অবশ্যই যাইবে, অবশ্যই বিধব্যব্রত সমাধা হইবে।”
এজিদ্ সর্বদাই চকিত। কোন প্রকারের শব্দ কর্ণে প্রবেশ করিলেই এজিদের মন কাঁপিয়া উঠিত। কারণ আর কিছু নহে, কেবল মোস্লেমের আগমন সম্ভব। এজিদ্ উঠিয়া বসিলেন। বোধ হয় তাঁহার কানে কোন প্রকারের শব্দ প্রবেশ করিয়াছিল, তাহা না হইলে উঠিয়া বসিলেন কেন? মারওয়ানের তত মনোযোগ নাই। এজিদ্ উঠিয়া দেখিলেন যে, তাঁহার মাতার প্রধানা পরিচারিকা ত্রস্তে আসিতেছে। নিকটে আসিয়া বলিল, “শীঘ্র আসুন, মহারাজ আপনাকে মনে করিয়াছেন।”
এজিদ্ যে বেশে বসিয়াছিলেন, সেই বেশেই পিতার নিকটে গমন করিলেন। মারওয়ানকে বলিয়া গেলেন, “তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি আসিতেছি।” এই বলিয়া এজিদ্ চলিয়া গেলেন।
মাবিয়া পীড়িত শয্যায় শয়ন করিয়া আছেন, এজিদের মাতা শয্যার পার্শ্বে নিন্মতর আর একটি শয্যায় বসিয়া বিষন্নবদনে চাহিয়া আছেন। এজিদ্ সসম্ভ্রমে মাতার চরণ বন্দনা করিয়া নিকটেই বসিলেন। মাবিয়া মৃদুস্বরে বলিলেন, “মোস্লেম ফিরিয়া আসিয়াছে। (এজিদ্ চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন, কাহাকেও দেখিলেন না।) জয়নাবের বুদ্ধিতে আমি শত শত ধন্যবাদ করি। এত অল্পবয়সে এত ধৈর্যগুণ কাহার? এমন ধর্মপরায়ণা-সতীসাধ্বীর নাম আমি কখনোই শুনি নাই। জয়নাবের প্রত্যেক কথায় মন গলিয়া যায়। ইচ্ছা হয় যে, ধর্মবিষয়ে উপদেশ তাহার নিকট আমরাও শিক্ষা করি। ঈশ্বর তাহাকে যেমন সুশ্রী করিয়াছেন, তেমনি বুদ্ধিমতী করিয়া আরো দ্বিগুণ রূপ বাড়াইয়া দিয়াছেন! আহা! তাহার ধর্মে মতি, ঈশ্বরের প্রতি অচলা ভক্তি এবং ধর্মনীতি সুনীতি কথা শুনিলে কে না তাহাকে ভালবাসিবে? আবদুল জাব্বার নিরপরাধে ঐ অবলা সতীর মনে যে দুঃখ দিয়াছে, তাহার প্রতিফল সে অবশ্যই পাইবে।”
এজিদ্ আসল কথার কিছুই সন্ধান পাইতেছে না। জিজ্ঞাসা করিতেও সাহস হইতেছে না; মনের মধ্যে মনের ভাব তোলপাড় করিতেছে। কী বলিয়া জিজ্ঞাসা করিবেন, তাহাও হঠাৎ স্থির করিতে পারিলেন না। তবে মনে মনে একটু স্থির করিলেন, এত প্রশংসা কেবল আমার শিক্ষার নিমিত্ত। ইহার অর্থই এই যে, আমি তাহাকে বিশেষ আদরে রাখি ও যত্ন করি। এই ভাবিয়া বিশেষ আগ্রহে শুনিতে লাগিলেন।
এজিদের মাতা বলিলেন, “ধর্মে মতি অনেকেরই আছে, সুশ্রীও অনেক আছে।”
এজিদের অন্তরস্থিত জয়নাবের ভ্রূযুগলের অগ্রভাগস্থ সুতীক্ষ্ণ বাণ, যাহা অন্তরে বিঁধিয়াই ছিল, তাহাতে আঘাত লাগিল।
মাবিয়া কহিলেন, “অনেক আছে, বটে, কিন্তু এমন আর হইবে না। এই তো মহৎগুণের পরিচয় এখনই পাইলে। জয়নাব,-রূপ, ধন সম্পত্তির প্রত্যাশী নহে রাজরাণী হইতেও তাঁহার আশা নাই। যাঁহার পদাশ্রয় গ্রহণ করিলে পরকালে মুক্তি পাইবেন তাঁহার পয়গামই তিনি কবুল করিয়াছেন।”
এজিদ্ জিজ্ঞাস করিলেন, “কাহার পদাশ্রয় গ্রহণ করিলে পরকালে মুক্তি হয়? সে ব্যক্তি কে?”
মাবিয়া বলিলেন, “তিনি প্রভু মোহাম্মদের দৌহিত্র মাননীয় আলীর পুত্র হাসান। তুমি যাঁহাদের নাম শুনিতেও কষ্ট বোধ কর, জয়নাব স্ত্রীবুদ্ধি প্রভাবে সেই মহাত্মার গুণ জানিয়াই তাঁহার পয়গাম সন্তোষের সহিত স্বীকার করিয়াছেন। দেখ এজিদ্! তুমি আর হাসান হোসেনের প্রতি ক্রোধ করিয়ো না। মন হইতে সকল পাপ দূর কর। সত্যপথ অবলম্বন কর। পৈতৃক ধর্ম রক্ষা কর। পরকালের সুগম্য পথের দুরূহ কণ্টক সত্যধর্মের জ্যোতিঃপ্রভাবে বিনষ্ট করিয়া স্বর্গের দ্বার আবিষ্কার কর। সেই সঙ্গে ন্যায়পথে থাকিয়া এই সামান্য রাজ্য রক্ষা কর। আমি আর কয়দিন বাঁচিব? আমি যে প্রকারে হাসান-হোসেনের আনুগত্য ও দাসত্ব স্বীকার করিলাম, তুমি তাহার চতুর্গুণ করিবে। তোমা অপেক্ষা তাঁহারা সকল বিষয়েই বড়?”
তখন এজিদের মুখে কথা ফুটিল, বাক্শক্তির জড়তা ঘুচিল। পিতৃবাক্যবিরোধী হইয়া বলিতে অগ্রসর হইলেন, “আমি দামেস্কের-রাজপুত্র। আমার রাজকোষ ধনে সদা পরিপূর্ণ, সৈন্য-সামন্তে সর্ববলে বলীয়ান্! আমার সুরম্য অত্যুচ্চ প্রাসাদ এদেশে অদ্বিতীয়। আমি সর্ববিষয়ে পরিপূর্ণ এবং অভাবশূন্য। আমি যার জন্য প্রাণ পর্যন্ত পরিত্যাগ করিতে প্রস্তুত, আমি যার জন্য রাজ্যসুখ তুচ্ছ করিয়া এই কিশোর বয়সে জীবন পর্যন্ত বিসর্জন করিতে অগ্রগামী, যার জন্য এতদিন এত কষ্ট সহ্য করিলাম, সেই জয়নাবকে হাসান বিবাহ করিবে? এজিদের চক্ষে তাহা কখনোই সহ্য হইবে না। এজিদের প্রাণ কখনোই তাহা সহ্য করিতে পারিবে না। যে হাসানের একসন্ধ্যা আহারের সংস্থান নাই-উপবাস যাহাদের বংশের চিরপ্রথা, একটি প্রদীপ জ্বালিয়া রাত্রের অন্ধকার দূর করিতে যাহাদের প্রায় মতা হয় না, সেই হাসানকে এজিদ্ মান্য করিবে? মান্য করা দূরে থাকুক, জয়নাব লাভের প্রতিশোধ এবং সমুচিত শাস্তি অবশ্যই এজিদ্ তাহাদিগকে দিবে। আমার মনে যে ব্যথা দিয়াছে, আমি তাহা অপেক্ষা শত সহস্রগুণে তাহাদের মনে ব্যথা দিব! এখনি হউক, বা দুদিন পরেই হউক, এজিদ্ বাঁচিয়া থাকিলে ইহার অন্যথা হইবে না, এই এজিদের প্রতিজ্ঞা।”
মাবিয়া অতি কষ্টে শয্যা হইতে উঠিয়া সরোষে বলিতে লাগিলেন, “ওরে নরাধম! কি বলিলি? রে পাষণ্ড! কি কথা আজ মুখে উচ্চারণ করিলি? হায়! হায়!! নূরনবী মোহাম্মদের কথা আজ ফলিল! তাঁর ভবিষ্যৎবাণী আজ সফল হইল। ওরে পাপাত্মা! তুই কিসের রাজা? তুই কোন্ রাজার পুত্র? তোর কিসের রাজ্য? তোর ধনাগার কোথায় রে বর্বর? তুই তো আজই জাহান্নামী (প্রধান নারকী) হইলি! আমাকে সঙ্গী করিলি। রে দুরাত্মা পিশাচ! তোকে সে দিন কে বাচাঁইল? হায়! হায়!! আমি তোর এই পাপমুখ দেখিয়াই হাতের অস্ত্র হাতে রাখিয়াছিলাম। তাহার ফল হাতে হাতেই পাইলাম। ওরে বিধর্মী এজিদ্! তোর পিতা যাঁহাদের দাসানুদাস, তুই কোন্ মুখে তাঁহাদের প্রতি এমন অকথ্য বলিলি? তোর নিস্তার কোন কালেই নাই-ইহলোকেও নাই, পরলোকেও নাই। তুই জানিস্, এ রাজ্য তোর পিতার নহে। সেই হাসানের পিতা আলী অনুগ্রহ করিয়া-ভৃত্যের কার্যে সন্তুষ্ট হইয়া প্রভু যেমন কিছু দান করেন,-সেইরূপে তোর পিতাকে কেবলমাত্র ভোগের জন্য এই রাজ্য দান করিয়াছেন। বল্ তো তুই কোন্ মুখে এমন কর্কশ শব্দ তাঁহাদের প্রতি ব্যবহার করিলি? আমার সম্মুখ হইতে দূর হ! তোর ও পাপমুখ আমি আর এ চে দেখিব না! আর দেখিব না! তুই দূর হ!”
এজিদ্ ম্লান্ মুখে উঠিয়া চলিয়া গেলেন। এজিদের মাতা নানা প্রকার সান্ত্বনা করিয়া মাবিয়াকে বুঝাইতে লাগিলেন, “আপনি স্থির হউন। ইহাতে আপনার পীড়াই বৃদ্ধি হইবে। আপনি যত বেশি উত্তেজিত হইবেন, ততই আপনার পীড়া বৃদ্ধি হইবে।”
মাবিয়া বলিলেন, “পীড়ার বৃদ্ধি হউক, আর আমার প্রাণ বাহির হইয়াই যাউক, যে কথা আমি আজ শুনিয়াছি, তিলার্ধকাল বাঁচিতে আমার আর ইচ্ছা নাই।”-সজোরে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া মাবিয়া দুই হস্ত তুলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। “হে দয়াময়! হে করুণাময়! তুমি সর্বশক্তিমান!-আমাকে উদ্ধার কর। আমি যেন এজিদের পাপমুখ আর না দেখি। এজিদের কথাও যেন কর্ণে না শুনি। এজিদ্ আজ আমার অন্তরে যে আঘাত দিয়াছে, আর ক্ষণকাল বাঁচিতেও আমার ইচ্ছা নাই। শীঘ্র আমাকে এই পাপপুরী হইতে উদ্ধার করিয়া লও।” হযরত মাবিয়া এই প্রকার কাতর উক্তিতে ঈশ্বরের উপাসনা করিয়া ব্যাধিশয্যায় শয়ন করিলেন।