মহম্মদ নাজিম, হাজারিবাগী

মহম্মদ নাজিম, হাজারিবাগী

গোপালের সঙ্গে প্রথমবারে হাজারিবাগে গেছি ইন্টারমিডিয়েট চার্টার্ড অ্যাকাউন্টান্সির পরীক্ষা দিয়ে। বর্ষাকাল। সারারাত থার্ড ক্লাসে জেগে এসেছি, তারপর শেষ রাতে হাজারিবাগ রোড স্টেশনে নেমে বাসে উঠে পড়েই ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভেঙেছে টাটিঝারিয়াতে বাস এসে দাঁড়ালে। হাজারিবাগ রোড স্টেশন বা সারিয়া থেকে বগোদর হয়ে বিষুনগড় হয়ে বাস পৌঁছবে হাজারিবাগ শহরে, কোররার মোড় পেরিয়ে।

টাটিঝারিয়ার পণ্ডিতের দোকানের চা, কালাজামুন আর নিমকি খেয়ে ততক্ষণ রোদ উঠে—যাওয়া পথ বেয়ে হাজারিবাগে পৌঁছে দুপুরটা ঘুমিয়ে কাটালাম। সন্ধের মুখে মুখে একটি সাইকেল রিকশা নিয়ে সার্কিট হাউসের সামনের পথ দিয়ে কাছারির মধ্যে দিয়ে শর্টকাট করে বড়া মসজিদের সামনের অপ্রশস্ত গলিতে এক মুসলমানের জুতো আর মুঙ্গেরি বন্দুকের দোকানের সামনে রিকশা থেকে নামলাম।

গোপাল আলাপ করিয়ে দিল, নাজিম সাহেব। মহম্মদ নাজিম। চেয়ে দেখলাম, একজন রোগাসোগা খুবই লম্বা অত্যন্ত কুদর্শন মানুষ। মাথার আকৃতিটাও আশ্চর্য। বড় বড় দাঁত, সর্বক্ষণ কালি—পিলি জর্দা দেওয়া পান আর সিগারেট খেয়ে খেয়ে মুখের অদ্ভুত ছিরি হয়েছে। মানুষটির চোখ দুটি অতুলনীয়। পৃথিবীতে আর কারও অমন চোখ ছিল কি না, জানি না। কথা শোনা বা বলার সময়ে চোখ দুটি ক্রমাগত গাড়ির হেডলাইটের মতো ডিপার—ডিমার হতো। উত্তেজিত হলে বা বিস্মিত হলে ডিপার আর এমনি অবস্থাতে ডিমার।

স্বল্পক্ষণ আমার হিন্দি শুনেই বললেন, খাতা মে নাম উঠ গ্যয়া। যব তক ঠিকঠাক হিন্দি বোলি নেহি বোলনে পাইয়েগা তবতক নাম নেহি কাট্টা যায়েগা। নাজিম সাহেবের মৃত্যু অবধিও কাটা যায়নি নাম।

ইতিমধ্যে প্রচণ্ড বৃষ্টি এল আর সেই বৃষ্টি মাথায় করে এক দেহাতি যুবক দোকানে এসে ঢুকল কাকভেজা হয়ে। বলল, হাওয়াইয়ান চপ্পল দেখান।

তখন সবে ওই চপ্পলগুলো এসেছে কলকাতা এবং অন্যত্রর বাজারে।

নাজিম সাহেব তাকে আদর করে বসিয়ে চা পান খাইয়ে মিনিট দশেক পুটুর পুটুর করে কথা বলার পরে তাকে একজোড়া মোষের চামড়ার নাগরা, লোহার নাল লাগানো, বিক্রি করলেন। ছেলেটি চলে গেলে টাকা ক্যাশবাক্সে তুলে রেখে বললেন, অব বেলিয়ে।

আমি বললাম, গ্রাহক চাইল হাওয়াইয়ান চপ্পল আর আপনি তাকে বেচলেন মোষের চামড়ার নাগরা! মুনাফা বেশি ছিল বুঝি?

নাজিম সাহেব বললেন, বিলকুল নেহি। হাওয়াই চপ্পলমে তিন রুপিয়া জাদা মুনাফা থা।

তব? আমি বললাম।

নাজিম সাহেব আমাকে দাবড়ে বললেন, তব কা? গাহক আকর মাঙ্গেকা আম ঔর উসকো বিকেগা ইমলি, তবহি না ম্যায় দুকানদার হুঁ।

আমি আরও অবাক হয়ে বললাম, মতলব?

নাজিম সাহেব বললেন, গাহক কো ক্যা পাতা হ্যায় কওন চিজ উনকো চাহিয়ে। তারপর বললেন, ওকে হাওয়াইয়ান চপ্পল বিক্রি করলে ও যখন সেই চপ্পল পরে বাস থেকে নেমে কাদা ভরা তিন মাইল কাঁচা পথ জঙ্গলে হেঁটে তার গ্রামের বাড়িতে যাবে তখন তার চপ্পল কাদায় গেঁথে পথেই রয়ে যাবে, হয়তো স্ট্র্যাপও ছিঁড়ে যাবে, তারপর খালি পায়ে, বাড়ি পৌঁছে গাল পাড়বে নাজিম মিঞাকে। কিন্তু যে জুতো ওকে আমি দিলাম সে জুতো কমসে কম দু—বছর পাহাড়ে—জঙ্গলে পরে ছিঁড়ে ফেলার পরে আবার নাজিম মিঞার দোকানেই জুতো কিনতে আসবে।

আমি ভাবলাম, এই মানুষকে হায়দরাবাদের ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট ‘বেলা—ভিস্তাতে’ মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজির ওপরে বক্তৃতা করতে নিয়ে যাওয়া উচিত। অনেক বড় বড় মার্কেটিংয়ের গুরুও এই সহজ দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নিতে পারেন।

ওঁর দোকানের সামনে দিয়ে কোনও মোটর গাড়ি গেলেই (পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি হাজারিবাগ শহরে গণ্ডা গণ্ডা মোটর গাড়ি ছিল না, কলকাতায়ই ছিল না।) উনি হাত তুলে সেলাম করছেন দেখলাম।

কওন থা?

আমি শুধোলাম।

কওন জানে!

তব?

তব ক্যা? গাড়িমে যব যা রহা হ্যায় জরুর কোঈ না কোঈ ভারী আদমি হোগা। কোঈ ভারী অফসর নেহি ত কোঈ পয়সাওয়ালা আদমি। আমি রোজই তাঁর গাড়ি দেখে তাঁকে না চিনেই সেলাম ঠুকব তো, উনি ভাববেন আমি নিশ্চয়ই তাঁকে চিনি। আর তিনি যদি নেহাত কামিনা না হন তবে নিজের বা পরিবারের জুতো কিনতে আমার দোকানে অবশ্যই আসবেন।

নাজিম সাহেব ইংরেজি জানতেন না তবে উর্দু জানতেন ভালই। তাঁর মুখে শায়েরির ফোয়ারা ফিট করা ছিল। তবে ইংরেজি না জানলেও আমাকে ইংরেজিতেই চিঠি লিখতেন একটা ঘটনা পর্যন্ত। একবার চিঠি লিখলেন মাই ‘ওল্ডেস্ট’ সান হ্যাজ ডায়েড। ওঁর এল্ডেস্ট সান—এর নাম ছিল আজ্জু মহম্মদ। হাসি—খুশি সতেরো—আঠারো বছরের ছেলে, হিন্দি সিনেমার হিরোর মতো হাবভাব। আমাদের সঙ্গে বহুবার শিকারে গেছে। সে মরে গেছে শুনে নাজিম সাহেবকে টেলিগ্রামে সান্ত্বনা জানালাম—’মে হিজ সউল রেস্ট ইন পিস’ ইত্যাদি লিখে। তারপর পাঁচদিন পরই গোপালের সঙ্গে ফোনে কথা হল। গোপাল বলল, শুনেছ লালসাহেব, নাজিম মিঞার এগারো নাম্বার ছেলেটা মারা গেছে।

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। বললাম, বলো কী?

তখুনি আবার টেলিগ্রাম করে কনডোলেন্স রিভার্স করলাম।

এই ঘটনার পর থেকে নাজিম সাহেব ইংরেজি হরফে কিন্তু উর্দুমিশ্রিত হিন্দিতে চিঠি লিখতেন। প্রতি চিঠির শেষে লেখা থাকত ‘ফাদার মাদারকো দোয়া’।

নাজিম সাহেবের কাছ থেকে অনেকই শিখেছি। বনজঙ্গল সম্বন্ধে, শিকারের ঔচিত্য—অনৌচিত্য সম্বন্ধে, জীবনবোধ সম্বন্ধে।

আমার সঙ্গে যখন আলাপ হয় তখন এবং তার অনেকদিন পর পর্যন্ত উনি সাইকেল আরোহীই ছিলেন। সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে টিফিন ক্যারিয়ারে করে বিরিয়ানি, পায়া, চাঁব এবং নানারকম কাবাব নিয়ে আসতেন ‘পূর্বাচল’—এ। তখন তাঁর বাড়ি আমাদের নেমন্তন্ন করার যোগ্য ছিল না নাকি। পরে যখন নাজিম সাহেব বড়লোক হলেন, একাধিক গাড়ি ছিল, আজ্জু মহম্মদ হাজারিবাগ মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান হয়েছিল, যখনই আমরা একসঙ্গে জিপ বা গাড়িতে যেতাম তখনই রাতের বেলা উল্টোদিক থেকে আসা সাইক্লিস্টকে দেখেই আমাদের বলতেন, হেড লাইট ডিমার কিজিয়ে উও বিচারি নাল্লিমে গিড় পড়েগা।

আমার অভিজ্ঞতা বলে যে, গরিব থেকে বড়লোক হওয়ার পরে অধিকাংশ বড়লোকদের মধ্যেই তার গরিবীর স্মৃতি থাকে না—হয়তো তাঁরা তা ইচ্ছে করেই মুছে দেন। কিন্তু যাঁরা ভাগ্যবান নন তাঁদের প্রতি এই সহমর্মিতা ও শ্রদ্ধামিশ্রিত মনোভাব বহু বহু উচ্চচশিক্ষিত মানুষের মধ্যেও দেখিনি। অর্থ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষকে অমানুষ করে।

একবার কুসুমভা গ্রামের কাছে হাঁকোয়া হচ্ছে। কাড়ুয়ার খবর ছিল যে একটি বাঘ এসে ঢুকেছে ওই জঙ্গলে পানুয়ান্না টাঁড় থেকে। তাই মস্ত বড় হাঁকোয়ার বন্দোবস্ত হয়েছিল। প্রায় শ’দেড়েক মানুষ, টাঙ্গি আর তিরধনুক, নানা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে টানা পাঁচঘণ্টা ধরে হাঁকোয়া করল। আমি, গোপাল, নাজিম সাহেব, আমাদের বন্ধু সুব্রত চ্যাটার্জি, হাজারিবাগের পূর্বতন এস পি সাহেবের বড় ছেলে, তার ভাই মুকুল, শামিম মিঞা, টুটিলাওয়ার জমিদার আমাদের বিশেষ পরিচিত ইজাহারুল হক প্রমুখ অনেকেই ছিলেন। অত লোকের শ্রম বৃথা গেল, ধৈর্য ব্যর্থ হল। আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল। বাঘ তো দূরস্থান, আশ্চর্যের কথা, একটি ঘুঘু পর্যন্ত বেরুল না হাঁকাতে। অথচ কুসুমভার পেছনের জঙ্গল পাখি আর জানোয়ারে বোঝাই ছিল।

নাজিম সাহেব হাসছিলেন। বললেন, এও এক শিক্ষা লালাবাবু। কখনও কখনও গভর্নরের শিকারেও এমনই হয়। একটি পাণ্ডুক পর্যন্ত বের হয় না। পাণ্ডুক মানে ঘুঘু। আমি আজ ফজিরের নামাজ না পড়ে এসেছি। আপনাদেরও হয়তো কোনও না কোনও ত্রুটি—বিচ্যুতি হয়েছে। উপরওয়ালা খুশি নন।

নাজিম সাহেবের কথা শুনে আমার বাবার কথা মনে হয়েছিল। বাবা সব সময় বলতেন failures are the pillers of success। কখনও ভগ্নহৃদয় হবে না। জীবনে কখনও পেছন ফিরে তাকাবে না। সাহিত্যিক আর্নেস্ট হেমিংয়েও বলতেন, Never regret a thing you have done।

হাজারিবাগের অনতিদূরে বানাদাগ বস্তি থেকে হাঁটাপথে মাইল তিনেক গিয়ে কুসুমভা নামের একটি বস্তি ছিল। সাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ ওই পথেই হাজারিবাগ—চাতরার রুটে বাসের কন্ডাক্টর ছিলেন এক সময়ে। এক রাতে গভীর জঙ্গলের মধ্যে একটি বাঘের বাচ্চচা কুড়িয়ে পেয়ে তিনি পুষেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন বিলি। বিলি বড় হওয়ার পর তাকে বাড়িতে রাখার নানা অসুবিধে হওয়ায় উনি আর ওঁর এক বন্ধু বিলিকে এই কুসুমভা গ্রামেই ছেড়ে দিয়ে যান। এই গ্রামে নাজিম সাহেব ক্ষেতি—বাড়ি করতেন। একটি জানালাহীন স—বারান্দা মাটির ঘর ছিল তাঁর সেখানে। আমরা সেখানে গিয়েই উঠতাম। ক্ষেতি—বাড়ি আসলে বাহানা। তাঁর বিবিদের বোকা বানাবার জন্যে। আসলে নানা জানোয়ার শুয়োর, শম্বর, শজারু, খরগোশ, চিতল হরিণ যে সব ফসল খেতে ভালবাসে, সেই সবের ক্ষেত করতেন সেখানে আর বিবিদের হাজারিবাগ বাজারের মুদির দোকান থেকে উৎকৃষ্ট চাল, ডাল ইত্যাদি কিনে নিয়ে গিয়ে বলতেন কুসুমভার ক্ষেতে হয়েছে।

আগেই বলেছি নাজিম সাহেবের ইংরেজি জ্ঞানের কথা—আরেকটি উদাহরণ দিই। একবার আমি, গোপাল আর নাজিম সাহেব কাটকামচারির জঙ্গলে গেছি, উঠেছি এক মুসলমান বিড়িপাতার ছোট কারবারির বাড়িতে। সেখানের গভীর এবং চমৎকার জঙ্গলে পৌঁছে দিল খুস হয়ে গেল আমাদের। যেদিন পৌঁছলাম সেদিনই যাঁর অতিথি হয়েছিলাম আমরা, বললেন, এক মেমসাহেব এসেছিলেন এখানে হাজারিবাগ থেকে তাঁর সাহেবের সঙ্গে। জার্মান মেমসাহেব। সাহেবের নাম উইলি। কী হাত কী হাত! ইক ধারসে গোলি অন্দর তো সাথ্বেসাথ উস ধারসে জান বাহার।

নাজিম সাহেব বললেন, ওঁদের তো আমি চিনি। বোকারো না কোথায় উইলি সাহেব কাজে এসেছেন জার্মানি থেকে।

তারপর বললেন, হ্যাঁ উইলি সাহেবের হাত খুবই ভাল ছিল—গোলি ব্রেইনসে ঘুসকর ভেইন সে যা কর ঠোসে নিকাল যাতা থা। ‘ঠো’ অর্থাৎ ‘টো’। তারপরে বললেন, তব হাঁ। এক বাত। মেমসাব বড়ি ফ্রাঙ্ক মেমসাব থি।

আমি অবাক হলাম। যে মানুষ তেরো নাম্বার ছেলে বোঝাতে ওল্ডেস্ট সান বলেন, তাঁর সঙ্গে জার্মান মেমসাহেব ইংরেজিতে কী এমন কথোপকথন করলেন যে নাজিম সাহেবের ফ্র্যাঙ্ক মনে হল তাঁকে।

আমি বললাম, কেইসি ফ্র্যাঙ্ক থি?

নাজিম সাহেব বললেন, আরে ক্যা বোলে, ঠান্ডাকি রাত থি, হামলোগ সব আগকা সামনামে বৈঠকর কুসুমভামে গপসপ করা রহা থা, বিরিয়ানি বন রহা থা, ঔর মেমসাহেব হুঁয়াহি বৈঠকর হিসি কর রহি থি। বড়ি ফ্রাঙ্ক থি।

ওই ফ্র্যাঙ্কনেসের অভব্য গল্প আমি ‘কোয়েলের কাছে’তে যশোয়ন্তের মুখ দিয়ে বলিয়েছি, আপনারা যাঁরা ‘কোয়েলের কাছে’ পড়েছেন তাঁরা পড়ে থাকবেন।

বিরিয়ানির কথাই যখন উঠল তখন বলতেই হয় নাজিম সাহেবের মতো উমদা বিরিয়ানি খুব কম মানুষকেই বানাতে দেখেছি। আপনারা যদি আজও কেউ হাজারিবাগে যান তবে হাজারিবাগ ক্লাবের কাছে আগের পুলিশ ট্রেনিং ক্যাম্পের উল্টোদিকে একটি ছোট্টো দোকান দেখতে পাবেন। হান্নান মিঞার দোকান। হান্নান মিঞা আজ আর নেই কিন্তু তাঁর ছেলে আছে। ওদের দোকানের বিরিয়ানি, চৌরি, চাঁব, পায়া অথবা কাবাব আগে অর্ডার দিয়ে গেলে নাজিম সাহেবের বিরিয়ানির স্বাদের সামান্য আন্দাজ পাবেন।

একবার নাজিম সাহেবের সঙ্গে চাতরায় গেছিলাম শিকারে। ডাকবাংলোয় উঠেছিলাম। কলকাতা থেকে বিরাট দল এসেছিল গোপালের বন্ধুবান্ধবের, তাদের মধ্যে শিকারি কম, উৎসাহীই বেশি। সূর্য উঠতে না উঠতে শিঙাড়া আর জিলিপি খেয়ে সারাটা দিন আমরা নির্জলা উপোস দিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে চার—পাঁচটি বড় হাঁকোয়া করেছিলাম। শিকার হয়েছিল শুধু একটি শজারু—সুব্রতর ভাই মুকুল মেরেছিল। দিনশেষে বেশ কয়েকমাইল পাহাড়ে উপত্যকাতে হেঁটে যখন ডাকবাংলোতে সন্ধের মুখে ফিরি তখন দূর থেকে বিরিয়ানি রান্নার গন্ধ ক্ষুধার্ত আমাদের নাকে ভেসে আসছিল। আহা! সে কী খুশবু! আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর হতে চলল, সে গন্ধ আজও নাকে লেগে আছে। নফর আলির দাদা সফর আলির তদারকিতে সে বিরিয়ানি রান্না হয়েছিল। সে বিরিয়ানির কথা জীবনে ভোলার নয়। হাতমুখ ধুয়ে ইজিচেয়ারে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, নাজিম সাহেব যখন খেতে ডাকলেন, তখন জনা দশ—বারো ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত যুবক যে পরিমাণ বিরিয়ানি যে তৃপ্তির সঙ্গে খেয়েছিলাম তা বলার নয়।

যদিও নিমকহারামি হবে তবুও বলা দরকার এই সফর আলি নফর আলি বছর পনেরো—কুড়ি পরে আগ্নেয়াস্ত্র এবং গুলির চোরাচালানের জন্যে অ্যারেস্টেড হয়েছিল। সফর আলিরও দোকান ছিল দিশি বন্দুকের। নাজিম সাহেবের মতনই।

এক শীতে, সম্ভবত ১৯৫৭—৫৮—তে হবে, আমি আর গোপাল নাজিম সাহেবের সঙ্গে লাল মোটর কোম্পানির বাসে চড়ে এক দুপুরে জৌরিতে যাব বলে চড়ে পড়লাম। তখন শীতও পড়ত বটে হাজারিবাগে। চাতরা পৌঁছে নাজিম সাহেব পান্তুয়া আর শিঙাড়া খাইয়েছিলেন ‘ছঁওড়াপুত্তানদের’। উনি ভালবেসে আমাদের ‘ছঁওড়াপুত্তান’ বলে ডাকতেন। অমন পান্তুয়া আর শিঙাড়া অগণ্যবার খেয়েছি পালাম্যুর লাতেহারের কাছারির উল্টোদিকের পণ্ডিতের দোকানে।

যখন রাত নেমে গেছে, তখন গয়ার বাস হালকা চাঁদের আলোতে একটি ছোট্ট জনপদে দাঁড়াল। জায়গাটার নাম জৌরি। নামবার যাত্রী শুধুমাত্র আমরাই ক’জন। যাত্রীবোঝাই, জানলার খড়খড়ি তোলা বাস থেকে নেমেই ঠান্ডাটা ঠিক কীরকম তা মালুম হল। সামনেই একটি ছোট্ট মসজিদ, চাঁদের আলোতে তার সাদা রঙ আরও পরিষ্কার হয়েছে। পাশেই একটি ছোট্ট খাপরার চালের বাড়ি। সেটা মৌলবির বাড়ি। নাজিম সাহেবের বন্ধু। নাম ভুলে গেছি। দেখলাম একটি ছোট্ট ঘরের মধ্যে বড় চৌকির ওপরে জাজিম পাতা। তার ওপরে জনা দশেক মানুষ বসে হুঁকো খাচ্ছেন আর গল্প করছেন। মৌলবি তো উদ্বাহু হয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। তারপর বাড়ির বাইরে এসে গাড়ু করে আনা জলে পথের ওপরে হাতমুখ ধুলাম। যা ঠান্ডা, তাতে শরীরের কোথাওই জল ছোঁয়াতে ইচ্ছা করছিল না। হাতমুখ ধোওয়া হলে গাছতলাতে হিসি করে আবার ঘরে ঢুকলাম। ততক্ষণে খাবার এসে গেছে। মোটা মোটা বাজরার তৈরি রুটি তাক করে চৌকির ওপরে মস্ত থালাতে সাজানো আছে। আর পাশে লালনীল ফুলের কাজ করা একটি বিরাট এনামেলের গামলা—তার মধ্যে খুব ঝাল—মশলা দেওয়া সুগন্ধি মুরগির ঝোল। সকলেই দেখলাম দু হাতে রুটি নিয়ে ছিঁড়ছেন আর সেই গামলার মধ্যে হাত ডুবিয়ে ঝোলে রুটি ভিজিয়ে মুরগির ঠ্যাং অথবা বুক দিয়ে পরমানন্দে খাচ্ছেন। আমরাও তাই করলাম। তখন ছেলেমানুষ, খুব খিদে পেত।

খাওয়া হল। তারপর আবার গাড়ুর জলে হাতমুখ ধোওয়া পথে এসে। ওই গাড়ু নিয়েই সকালে মৌলবি সাহেব এবং তাঁর বাড়ির স্ত্রী পুরুষে প্রাতকৃত্য সারতে বাইরে যাবেন কিনা কে জানে। কোনওরকম বিকার থাকলে সিদ্ধিলাভ হয় না। আমার ঠাকুরমার ঘরের দেওয়ালে কালোর ওপরে সাদায় লেখা একটি বাণী কাচ—বাঁধানো ছিল। ‘লজ্জা মান ভয়, তিন থাকতে নয়।’ সেই সঙ্গে ‘বিকার’ যোগ করে দেব ঠিক করলাম কলকাতায় ফিরে।

খাওয়া তো হল, এখন শোওয়া? শুনলাম, এখন মাদ্রাসা ছুটি—মসজিদের উল্টোদিকে রাস্তার ওপারেই খাপরার চালের একটি ছোট্ট ঘর। সেটিই মাদ্রাসা। মেঝের ওপর প্রচুর পরিমাণ খড় ফেলে রাখা হয়েছে এবং একটি করে দুর্গন্ধ নোংরা কম্বল তিনজনের জন্যে। শৌখিন গোপাল সবসময়ে সঙ্গে আতর রাখত। সে একটু করে ‘রূহ অম্বর’ তিনটি কম্বলের ওপরেই ছড়িয়ে দিল। তাতে কিন্তু কম্বলের গন্ধ আরও উগ্র হল।

আমরা ঠিক করলাম যে—জামাকাপড় জুতো পরে আছি তাই পরেই শুয়ে পড়ব, প্রয়োজনে মিষ্টিগন্ধের খড় চাপা দেব গায়ে। তাও ভি আচ্ছা। একটা রাতও নয়, আমরা চারটের সময়ে অন্ধকার থাকতে গরুর গাড়ি চড়ে যার যার বন্দুক জড়িয়ে ফল্গু নদীর দুই শাখানদী জাঁম আর ইলাজান পেরিয়ে যাব সিজুয়াহারা নামের এক পাহাড়ে, রঘু শাহর ভাণ্ডারে। সেই রঘু শাহর বউ নাকি রঘু শাহর মুহুরীর সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী জীবনে অনেকই বউ—পালানো পুরুষ দেখেছি কিন্তু আমার জীবনে রঘু শাহই প্রথম বউ—পালানো পুরুষ—তাকে দেখার তীব্র আগ্রহ নিয়ে চোখ বুজলাম। ঘরের এক কোনায়, নাজিম সাহেবের হেফাজতে একটি ধোঁয়া—ওঠা লণ্ঠন জ্বলছিল। তাতে আলোর চেয়ে ধুঁয়ো বেশি হচ্ছিল। তবু ওই হাড়কাঁপানো শীতের রাতে কেরোসিনের মিষ্টি গন্ধ বেশ লাগছিল। কিন্তু চোখ বুজতেই বিপত্তি। প্রায় এক হাত লম্বা বড় বড় ছুঁচো চিঁক চিঁক চিঁক করে ঘরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে শায়ীন আমাদের ওপর দিয়ে গোলকিপারের মতো বডি থ্রো দিয়ে ঘোরাঘুরি করতে লাগল। তাদের হরকত দেখে ঘোরাঘুরি নয়, ওড়াউড়িই মনে হচ্ছিল।

নাজিম সাহেব আফটার—ডিনার জ্বলন্ত সিগারেটটা ভাল করে ঘষে ঘষে মেঝেতে নিভিয়ে দিয়ে বললেন, আরে ছঁওড়াপুত্তান, চুহা ক্যা করতা হ্যায়, জানতে হ্যায়?

বললাম, ক্যা?

আদমি কো বদনকা সবসে নরম জাগা খা লেতা হ্যায়।

ছুঁচো যে সদ্যোজাত শিশুর মাথার ঘিলু খেয়ে যায় তা আমি ওড়িশার পুরুনাকোটের জঙ্গলে জেনেছি।

আতঙ্কিত হয়ে বললাম, তব ক্যা হোগা? হামারা নাক খা লেগা ক্যা?

নাজিম সাহেব ছুঁচোর চিঁক চিঁক—এর মতো ছিঁক করে হেসে বললেন, মর্দকি বদনমে নাকসেভি জাদা নরম জাগা হোতা হ্যায়। ঔর উও খা লেনেসে আপলোগোঁকি আব্বালোগ যিতনাভি পইসাওয়ালা হো, উসকি কোঈ স্পেয়ার—পার্টস দুনিয়া ঢুন্ডকর নেহি মিলেগা। আভি বিয়া শাদীভি নেহি হুয়া আপলোগোঁকি—উও খা লেনেসে কভভি বিয়াশাদী হোগা ভি নেহি।

কী সর্ব্বোনেশে কথা। গোপাল স্বগতোক্তি করল, ‘সব্বোবাঁশ’। বিশ্বটাঁড়ে একলা খাসির মতো ঘুরে বেড়াতে হবে নাকি লালা? এ নাজিম মিঞা কী বিপদে ফেললে গো!

এই ‘বিশ্বটাঁড়’ শব্দটিও গোপালের নিজস্ব coinage। আর এমনভাবে তা ও উচ্চচারণ করত যে তার জবাব ছিল না।

আমি বললাম, তা আর বলতে। বলে, নিজের ঊরুসন্ধি পরম যতনে দু হাতের পাতা দিয়ে ঢেকে, গায়ে খড়চাপা দিয়ে দুর্গা দুর্গা বলে শুয়ে পড়লাম।

কিন্তু মৌলবি সাহেবের বাড়িতে যে বাজরার রুটি খেয়েছিলাম তা আজও হজম হয়নি। পেট ব্যথা করলেই মনে হয়, এ সেই যবনের বাড়ির রুটি, এ কি সহজপাচ্য হয়? নাজিম সাহেবের কথা আলাদা। এই ভব সংসারে নাজিম সাহেব একটিই প্যায়দা করেছিলেন খোদা।

নাজিম সাহেবের কথা কিছুই বলা হল না স্থানাভাবে। তার ভালবাসার ঋণ এ জীবনে শোধবার নয়। হাজারিবাগ থেকে বানাদাগ যাওয়ার পথে যে কবরখানা পড়ে সেখানে শুয়ে আছেন এখন উনি। আমি ওঁর মাজারে কলকাতা থেকে পাঠানো একটি মার্বেলের ফলক লাগিয়ে দিয়েছি, আমাদের সব বন্ধুদের নাম লিখে। যখনই যাই হাজারিবাগে, ওই মাজারে মোমবাতি আর ধূপকাঠি জ্বালিয়ে ফুল দিয়ে আসি।

এই পঙক্তি কটি লিখতে বসে মনে পড়ল শুধু মহম্মদ নাজিমই নন, আমার জঙ্গলের জিগরি দোস্ত গোপাল এবং সুব্রতও আজ নেই। সুব্রত ব্লাড ক্যান্সারে চলে গেছে প্রায় পাঁচ বছর হতে চলল। এ. বি. কাকুও চলে গেলেন দু’ হাজার ছ’ সালের জানুয়ারিতে। চব্বিশ তারিখে তাঁর শ্রাদ্ধ। তাঁর বড় সম্বন্ধী ফুটুদা তো গেছেন বছর দুয়েক আগেই। এখন চলে যাবার দিন এসেছে কেউ আগে কেউ পরে।

নাজিম সাহেব একটি হিন্দি দোঁহা গাইতেন, তার মানে হল—তুমি এ পৃথিবীতে যেদিন এসেছিলে সেদিন সবাই হেসেছিল আর তুমি কেঁদেছিলে। এখানে এমন কাজ করে যেও যে যাবার দিনে তোমার জন্যে যেন সবাই কাঁদে আর তুমি হাসতে হাসতে যেতে পারো।

গোপাল একদিন ফোন করে বলল, শুনছ লাল সাহেব, নিউজ অফ দ্যা ইয়ার।

কী?

নাজিম মিঞা নাকি গাড়ি কিনেছেন।

বলো কী?

তাই তো শুনছি। আর গাড়ি কিনেছেন আমাদেরই জন্যে, যাতে শিকারে যেতে অসুবিধা না হয়।

বললাম, শোনা কথা বিশ্বাস কোরো না। ভুতোকে পাঠাও হাজারিবাগে ব্যাপারটা সরেজমিনে তদন্ত করে আসবে।

অতএব আমরা চাঁদা করে ভুতোর ট্রেন ভাড়া আর রাহা খরচ দিয়ে তাকে হাজারিবাগে পাঠালাম। থাকতে তো পয়সা লাগবে না। পূর্বাচলেই থাকবে।

নাজিম সাহেব তাঁর একাধিক বিবি এবং দশ—বারোটি সন্তান, তার উপর অল্পবয়সে মারা যাওয়া দাদার পরিবারেরও তাবৎ ভার বহন করে কোনোক্রমে সংসার প্রতিপালন করতেন। অর্থ ছিল না কিন্তু আনন্দর কোনো ঘাটতি ছিল না। হৃদয়ের ঔদার্যরও কোনো অভাব ছিল না। ঠিক ওই ধরনের মানুষ পৃথিবী থেকে ক্রমশই কমে যাচ্ছেন। সাইকেলের হ্যান্ডেলে টিফিন ক্যারিয়ার ঝুলিয়ে তাতে গরম গরম বিরিয়ানি ও নানা উমদাপদ নিয়ে চলে আসতেন আমাদের জন্যে। তখনও তাঁর বাড়ি এমন ছিল না তা আমাদের মতো, ওঁর ভাষায়, কলকাতার ‘রহিস’ আদমিদের নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো যায়।

সে কারণেই নাজিম সাহেবের গাড়ি কেনার ব্যাপারটা একটু অবিশ্বাস্যই মনে হলো আমাদের।

কিন্তু ভুতো পার্টি সরেজমিনে তদন্ত সেরে কলকাতাতে ফিরে রিপোর্ট যা দিল তা শুনে আমাদের চক্ষুস্থির। ভুতো বলল, সবই সত্যি। পাটনার এক বুড়ি বাইজির কাছ থেকে নাজিমসাহেবের পুরনো দোস্তীর কারণে, যাকে আমরা বলি ‘ফর ওল্ড টাইমস সেক’, মাত্র পাঁচশো টাকাতে বাইজির নাইন টুয়েন্টি এইট—এর টি. মডেল ফোর্ড গাড়ি ড্রাইভার সমেত কিনে ফেলেছেন। এখন যে ড্রাইভার সে আগে বাইজির তবলচি ছিল। গলায় মাফলার জড়িয়ে এক সময়ে বাইজির সঙ্গে কত জমিদার জোতদারদের ম্যায়ফিলে তবলা বাজিয়েছে। বাইজির জেল্লা কমে যাওয়ায় গলাতে সুর না—লাগায় সাম্প্রতিক অতীত থেকে ড্রাইভারিতে শামিল হয়েছে। গাড়িও নাইনটিন টুয়েন্টি এইট মডেলের, ড্রাইভারও তাই। তার নাইনটিন টুয়েন্টি এইটের পাজামাটি ছিঁড়ে গিয়ে এখন আন্ডারওয়ার হয়ে গেছে। গাড়ির উপরে আমরা গেলে পর ধকল যাবে বলে গাড়ি এখন পারফেক্ট রেস্ট—এ আছে।

গোপাল সন্দিগ্ধ হয়ে বলল, কী রকম?

মানে গাড়ি ইটের উপরে বসে আছে যেন মস্ত একটি মুরগি—ডিমের উপরে তা দেওয়ার জন্যে বসে আছে।

গাড়িও লা—জওয়াব। সলিড রাবারের টায়ার, কাঠের স্পোক।

গাড়ির পাশেই ড্রাইভার বসে রোদ পোয়াচ্ছে। নাজিম সাহেব বলেছেন, ছঁওড়াপুত্তানলোগোঁকো জলদি জলদি আনে বোলো। ইক পোস্ট—কার্ড ডালকে চলা আনা, জমকে শিকার খেলেঙ্গে।

অতএব এক শীতের সকালে হাজারিবাগ রোড স্টেশনে বম্বে মেইল থেকে নেমে বন্দুক কাঁধে করে বাস স্টেশন থেকে সাইকেল রিকশা নিয়ে সোজা নাজিম সাহেবের বাড়ি।

নাজিম মিঞা তো আমাদের দেখেই রাত জেগে আসা ক্ষুধার্তদের জন্যে আন্ডার ভুজিয়া আর দেশি ঘি—এ ভাজা পরোটা বানাতে বিবিদের অর্ডার করে গাড়ির প্রশংসাতে মাতলেন। আমাদের খাওয়া হলে বললেন, আভিভ ঘর যাকর ডাটকে খাও আর মুতকে শো যাও। ম্যায় গাড়ি লেকর ঠিক সাত বাজে পৌঁছেগা পূর্বাচল মে।

ঠিক সাতটাতে আমরা রেডি হয়ে বসে রইলাম। হাজারিবাগের শীত, গ্রীষ্ম আর মশা এই তিনের তুলনা সত্যিই ছিল না। মশার কামড় খেতে খেতে অপেক্ষা করতে করতে রাত প্রায় নটা বাজল এমন সময় গেট এর সামনে কী একটা প্রাগৈতিহাসিক জন্তু এসে দাঁড়াল। অমন উদ্ভট দর্শন জানোয়ার আমরা আগে কেউই দেখিনি। সেই গাড়ি নামক জন্তুটিকে ব্যাক করল ড্রাইভার। সাইলেন্সার পাইপ দিয়ে দুর্বাশামুনির চোখ দিয়ে যেমন আগুন বেরোবার কথা তেমন আগুন বেরোচ্ছিল।

তখন ব্যারেথিয়া নামের একরকমের জলপাই—সবুজ গরম কর্ডুরয় পাওয়া যেত। অ্যামেরিকান আর্মির অফিসারদের শীতের পোশাক সেই কাপড়ে বানানো হত। আমিও শখ করে একটি ফুলহাতা সাফারি স্যুট বানিয়েছিলাম ওই কাপড়ের। আমি, গোপাল আর নাজিম সাহেব তাঁর আদরের ধন, পরম রতন গাড়ির পেছনের সিটে বসেছি। কিন্তু গাড়িতে উঠে বসামাত্রই আমার পেছনে কে যেন কামড়ে দিল। চমকে লাফিয়ে উঠতেই বুঝলাম যে ট্রাউজারের দেড় গিরে কাপড় সিটেই আটকে রইল এবং সঙ্গে সঙ্গে ট্রাউজারটা ফেটেও গেল এবং তজ্জনীত ফাঁক—ফোঁকর দিয়ে হাজারিবাগের হিমেল উত্তুরে বাতাস হু হু করে ঢুকতে লাগল।

ব্যাপারটা কী তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম যে, পেছনের সিটে ন্যাংটো কয়েল—স্প্রিং এর উপরে গোটা দুই উর্দু খবরের কাগজ গঁদের আঠা দিয়ে সাঁটা আছে। আমার পশ্চাতদেশ সেই কয়েল স্প্রিং স্পর্শ করতেই প্রচণ্ড প্রতিবাদ করে সেই স্প্রিং আমাকে আক্রমণ করেছে।

আর্তনাদ করে উঠে বললাম ঈ ক্যা? নাজিম সাহেব নির্বিকারভাবে বললেন, জংগলকি গাড়ি ওইসাই হোতা হ্যায়।

তারপর বিটোফোনিক অর্কেস্ট্রা বাজাতে বাজাতে টিং টিং টং টং ঢিক—ঢাক, চুঁই চুঁই নানা শব্দর তরঙ্গ তুলে গাড়ি কুড়ি মাইল স্পিডে এগোতে লাগল সীমারিয়ার পথে। একটু পরেই খেয়াল করলাম যে গাড়ির পেতলের হেডলাইট দুটি যা প্রায় ফিটন গাড়ির কেরোসিনের বাতির মতো বড়। ডানদিকে বাঁদিকে চকচক শব্দ করে সরে সরে যাচ্ছে।

গোপাল বলল, ঈ কা বাত নাজিম সাহাব?

নাজিম সাহেব গোপালকে দাবড়ে দিয়ে বললেন, ঈয়ে হ্যায় জংলকি গড্ডি। গাড্ডি লাজোয়াব। হেড লাইট ইকদফে রাস্তা দিখায়গা ঔর দুসরা দফে জাংগল।

আমরা চুপ করে গিয়ে চকাচক শব্দ শুনতে লাগলাম। সেই গাড়ির মকরমুখো লম্বা এয়ার—হর্নটি মাঝে মাঝেই কঁরর—র—র—র করে পিলে—চমকানো ডাক ছাড়তে লাগল। তাতে কতজন দুর্বল হৃদয়ের গ্রামবাসী যে হার্ট—ফেইল করে মারা গেল তা ঈশ্বরই জানেন।

জঙ্গলে ঢোকার পরে আরেক বিপত্তি। এতদিন এঞ্জিন বিশ্রামে থাকায় এবং ইটের পাঁজার উপরে বসে থাকাতে তার মধ্যে নেংটি ইঁদুরে বাচ্চচা পেড়েছিল ও সপরিবারে সেখানে বসবাস করছিল মহানন্দে। এখন এঞ্জিন আচমকা গরম হতে তারা ছ্যাঁকা খেয়ে উত্তেজনাতে লাফালাফি করতে করতে আমাদের গায়ে—মাথায় হুটোপুটি করতে লাগল।

এবার ভুতো বলল আপত্তি জানিয়ে, ঈ ক্যা বাত মিঞা?

নাজিম সাহেব ভুতোকে ডেঁটে দিয়ে বললেন, আররে ছাঁওড়াপুত্তান স্রিফ পাঁচশোহি রুপাইয়ামে গাড্ডি ঔর ড্রাইভার মুনায়াকো পাটানকি তিতলি বাইজি সে—তো ঈ গাড্ডি ক্যা রোলস—রয়েস নিকলে গা?

তারও পরে আরও গভীর জঙ্গলে ঢোকার পরে সামনের সিটে বসা ভুতোর মাথাটা একবার উঁচু আরেকবার নিচু হতে লাগল। আমরা পেছনের সিটে বসে তা দেখে হতবাক। গোপাল বলল, এই ভুতো তোমার কী হয়েছে?

—কিছু হয়নি তো।

—তবে তোমার মাথাটা উঁচু—নিচু হচ্ছে কেন?

—সে কী? আমি তো বুঝতে পারছি না। ভূত—প্রেতে থাপ্পড় মারছে না তো! মিঞার গাড়ির কত গুণ!

নাজিম সাহেব চটে ওঠে বললেন, ও ভুচু। আমাকে যা পারো বলো, আমার গাড়ি সম্বন্ধে একটি কথাও বলবে না।

ভুতো বলল, ও ড্রাইভার সাব। গাড্ডি রোকিয়ে। ম্যায় ইনসপেকশান করুঙ্গা।

ড্রাইভার ভুতোর কথা মান্য করে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল বনপথে।

ভুতো দরজা খুলে নেমে পড়ে তার পকেটে গোঁজা এক ব্যাটারির ছোট টর্চকে দিয়ে ভাল করে চাকাগুলো পরীক্ষা করল ট্রেইন—ইনসপেক্টরের মতো। এবং পরক্ষণেই হাঃ হাঃ করে হেসে উঠল। তাকে হাসি না বলে আর্তনাদ বলাই ভাল।

কী হয়েছে? খুব চিন্তান্বিত হয়ে জিগগেস করল গোপাল।

ভুতো বলল, টায়ারগুলো তো সলিড টায়ারের। অ্যামেরিকান টায়ার। আমরা যেমন ‘ফোরেন’ জিনিস দেখলেই হামলে পড়ি, হাজারিবাগী ছুঁচোরাও ওই সুখাদ্যের উপরে হামলে পড়ে রাবার খেয়ে গেছে যত্রতত্র। সেই ফুটি—ফাটা টায়ারের ওপরে দিশি টায়ারের রাবার গজাল দিয়ে সেঁটে দিয়েছেন। চাকা যেই ঘুরছে অমনি সেই পুলটিস দেওয়া জায়গাগুলোর সঙ্গে মাটির সংযোগ হতেই গাড়ি উঁচু হয়ে যাচ্ছে এবং সেই পুলটিস পেরুনোর পরই নিচু হয়ে যাচ্ছে। যাক, ভূত বা পেতিন এ যে ধরেনি ওই যথেষ্ট।

আবার গাড়ি ছাড়া হলো। কয়েক ফার্লং যাওয়ার পরই দেখা গেল লাল—মাটির পথের উপরে একটি কজওয়ে। পাহাড়ি এলাকাতে পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট পাকা ব্রিজ বানিয়েছে ছোট নদীর উপরে। বর্ষার সময়ে ওই সব নদীতে জলস্রোত এমনই তীব্র হয় যে তার জোরে ব্রিজ ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই সিমেন্ট পাথর অথবা কনক্রিট দিয়ে রাস্তার উপরটা বাঁধিয়ে দেওয়া হয় এবং সেই জায়গাতে পিলার বসিয়ে দেওয়া হয় পথের নিচে। জলস্রোত তার উপর দিয়ে বয়ে যায়। তবে সেই স্রোতের স্থায়িত্ব বেশিক্ষণ থাকে না কিন্তু যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ সাংঘাতিক হয় অবস্থা। অনভিজ্ঞদের কত গাড়ি যে ভেসে গেছে ভরা বর্ষাতে বিভিন্ন কজওয়েতে তা বলার নয়।

তবে এখন তো শীতকাল। কজওয়েকে ভয় নেই। নাজিম সাহেবের গাড়ি যেই সেই কজওয়ের উপরে গিয়ে পৌঁছেছে অমনি ড্রাইভার ইয়া আল্লা! বলে লাফিয়ে তিনি তার ড্রাইভিং সিটে এবং নিরুপায় আমাদের সকলের চোখের সামনে নাজিম সাহেবের ‘গাড্ডি লাজোয়াব’ কজওয়ে থেকে বালি ভরা শুকনো নদীর বুকে গড়িয়ে পড়ল। আমরা ছত্রখান হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটকে গেলাম।

নাজিম সাহেব আহত বাঘের মতো বালি মেখে উঠে দাঁড়িয়ে ড্রাইভারকে বললেন, হারামজাদা!

ড্রাইভারও ততক্ষণে ভূপতিত অবস্থা থেকে উত্থিত হয়েছে। সেও প্রবল বিক্রমে নাজিম সাহেবকে বলল, গালি মত দিজিয়ে।

নাজিম সাহেব বললেন, হামারা ফাসক্লাস গাড্ডিকি এহি হাল কিয়া হ্যায় তুমনে ঔর গালি নেহি দেগা। তো ক্যা চুমেগা তুমকো কামবকত কাঁহাকা।

ড্রাইভার বলল, ম্যায় মেরি জান বাঁচায়গা না আপকি গাড্ডি বাঁচায়গা? এক চুহা ঘুষ বৈঠাথা হামারা আন্ডারউয়ার মে। ক্যা করুঁ ম্যায়?

ঐ ভারী গাড়ি ধূলিশয্যা থেকে তোলার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। আমরা মাথা নিচু করে হাজারিবাগের দিকে হাঁটা দিলাম। রোরুদ্যমান নাজিম সাহেব কাঁদতে কাঁদতে স্বগতোক্তি করতে লাগলেন হায়! হায়! মেরি গাড্ডি লাজোয়াব। মেরি গাড্ডি লাজোয়াব।

কাটার উপরে নুনের ছিটে দিয়ে ভুতো পার্টি বলল, যেইস্যা মালিক ওইস্যাহি গাড্ডি। তার পর ব্যঙ্গোক্তি করে বলল হুঁ! গাড্ডি লাজোয়াব! গিনেস বুক মে নাম লিখোয়া লিজিয়ে ঘর পৌঁছকর।

[অনেক কথা, এবং অনেকের কথাই বলা হলো না সময়াভাবে এবং আমার স্ত্রী হঠাৎই অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়াতে। ইচ্ছে রইল দ্বিতীয় খণ্ডে তা লেখার। আপনাদের ভাল লাগল কি না তা প্রকাশককে অথবা আমাকে জানালে বাধিত থাকব। আমার ঠিকানা, সানী টাওয়ার্স, ৩, আশুতোষ চৌধুরী অ্যাভিন্যু, কলকাতা—৭০০০১৩]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *