মহড়া

মহড়া

বম্বে রোডের বাঁ প্রান্তে সূর্য ডুবছে। লাজুক নতুন বউয়ের উদ্ধত টিপের মতো সূর্য। খেত, জলা, গাছপালার ওপর আহ্লাদি আলো। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে চলন্ত নিসর্গ দেখছে অজয়, সেভাবে উপভোগ করে উঠতে পারছে না। খড়্গপুরই পার হল না এখনও। গন্তব্যে পৌঁছোতে রাত হয়ে যাবে। অল্পস্বল্প টেনশন হচ্ছে অজয়ের। দিবাকরদা বলেছিল, সন্ধে থাকতেই ঝাড়গ্রামে ঢুকে যাবি। মাঝে হল্ট মারবি না। ওদিককার রাস্তাঘাটের অবস্থা একদম ভাল নয়! ‘অবস্থা’ বলতে রাস্তার চেহারার কথা বলেনি দিবাকরদা, পারিপার্শ্বিক রাজনৈতিক আবহাওয়া খেয়াল করিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ মাওবাদী উপদ্রব। মাওবাদীদের সম্বন্ধে সবিশেষ ধারণা নেই অজয়ের। কাগজে, টিভিতে এত চর্চা হচ্ছে ইদানীং, দিবাকরদার না-বলা অংশ বুঝতে অসুবিধে হয়নি।

অজয়রা বেরিয়েছে দুপুরে। ভাবতেও পারেনি কলকাতা থেকে ঘণ্টা চারেকের রাস্তা পেরোতে রাত করে ফেলবে। সেকেন্ড ব্রিজ থেকে নেমে, বম্বে রোড ধরে খানিকটা এগোতেই জ্যামে পড়েছিল। পাক্কা আড়াই ঘণ্টা গেল ওখানে। গাড়িতে বসে শুধু ঘেমেছে। পুজো চলে গেছে, গরম কমার নাম নেই। জ্যাম ছাড়ার পর দিব্যি চলছিল গাড়ি, মেচেদায় এসে ব্রেকডাউন। গ্যারেজে অবশ্য নিয়ে যেতে হয়নি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সারিয়ে ফেলল রবি। তারপর থেকে ভাল স্পিডে চালাচ্ছিল, এখন আর পারছে না। হাইওয়েতে ধান শুকোতে দিয়েছিল গ্রামের মানুষ, পথ আগলে সেসব তুলে নিচ্ছে।

যদিও সন্ধে নামছে অত্যন্ত ঢিমেতালে। যেন অজয়কে আশ্বস্ত করতে এই বিলম্বিত সূর্যাস্ত। লাভ হচ্ছে না কিছু। অজয়দের গাড়িকে পাত্তা দিচ্ছে না গ্রামের লোক। অলস চালে কাজ সারছে তারা। মুরগি, ছাগল বম্বে রোডে অবলীলায় বিচরণ করছে। রবিও হর্ন টর্ন তেমন মারছে না। সম্ভবত সমঝে চলছে স্থানীয় মানুষজনকে। রবির এই সম্ভ্রম দেখেই মাওবাদীদের ভাবনাটা মাথায় এল অজয়ের। কাগজ, টিভি ছেড়ে তারা যেন এখন আশেপাশের হাওয়ায় মিশে আছে। আপশোস হয় অজয়ের, ওদের সম্বন্ধে আর একটু খুঁটিনাটি জেনে রাখলে ভাল হত। ওদের বেল্ট ঠিক কোনখান থেকে কোথায়… আচ্ছা, রবি এখন কী ভাবছে? ওর মাথায় কি মাওবাদীর আশঙ্কা এসেছে? ঘুরিয়ে জানতে চায় অজয়, কী মনে হচ্ছে, রাত্তিরের আগে পৌঁছোতে পারব?

সোজা তাকিয়ে থেকে রবি বলে, এগারোটা বাজবে। তার মানে তো অনেক রাত। রিস্ক হয়ে যাবে না?

কীসের রিস্ক? একটু যেন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে রবি।

ডাকাতি ফাকাতি, মাওবাদীদের হামলা…

কথা শেষ করেনি অজয়। রবি ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়। কেমন একটা হাসে। অজয়ের ভয়টা যেন ছেলেমানুষি। দুশ্চিন্তাটা যে অমূলক নয়, বোঝাতে অজয় বলে, এদিকের রাস্তায় প্রায়ই এই ধরনের ঝামেলা হয়, তুমি জানো?

কবে হয়েছে বলুন? রাস্তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন রাখে রবি। একটু বেশিই যেন আত্মবিশ্বাসী লাগছে ওকে। উত্তর না দিয়ে কারণটা খোঁজার চেষ্টা করে অজয়। কোম্পানির দেওয়া পোস্ট অনুসারে রবির সঙ্গে তার একটা দূরত্ব রাখা উচিত। অজয় কোম্পানির ম্যানেজার। রবি সামান্য ড্রাইভার। যদিও কোম্পানিটা খুব একটা বড় কিছু নয়, কলকাতার মাঝারি ক্যাটারিং সংস্থা। মালিক দিবাকর ঘোষ। ঝাড়গ্রামের এক বাগানবাড়িতে পার্টি থ্রো করেছে কলকাতার নামী অ্যাড হাউস। আউটিং মেশানো পার্টি। এ ধরনের কাজ আগেও করেছে অজয়। দিঘা, ডায়মন্ড হারবারের দিকে। এবারের রুটটা বড্ড অড। কেন যে পছন্দ করল পার্টি! মাওবাদী ব্যাপারটা কি ওদের মাথায় আসেনি? কিন্তু কথা হচ্ছে রবি কেন অকুতোভয়! ও কি এলাকাটা চেনে? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই অজয়ের মনে পড়ে যায়, তাই তো, রবির বাড়ি তো মেদিনীপুরেই। মাস ছয়েক হল কোম্পানিতে ড্রাইভার হিসেবে বহাল হয়েছে। দিবাকরদা যখন ওর ইন্টারভিউ নিচ্ছিল, পাশে ছিল অজয়। তখনই রবি তার জেলা, গ্রামের নাম বলেছিল।

তোমার গ্রামের নামটা কী যেন? জিজ্ঞেস করে অজয়।

কুসুমডিহা। বলল, রবি।

সূর্যটাও ডুবে গেল। আকাশটাকে মনে হচ্ছে জ্বলন্ত হারিকেনের কাচ। রাস্তা এখন ফাঁকা। সজোরে গাড়ি চালিয়েছে রবি। মাঠের গোরু ফিরে যাচ্ছে ঘরে। লেট করে ফেলা পাখিরা দ্রুত ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে চলেছে ঝাঁকালো গাছের দিকে। অজয় জানতে চায়, এখান থেকে কত দূরে তোমাদের গ্রাম?

অনেক দূরে। সেই লোধাগুলি পেরিয়ে।

‘লোধাশুলি’ নামটাই অচেনা অজয়ের কাছে। দূরত্বের ধারণা করা সম্ভব নয়। সে আপাতত জানে খড়্গপুর এখনও ডিঙোতে পারেনি। তারপর আছে পানাগড়। অজয় ফের জিজ্ঞেস করে, এই এলাকাটা মোটামুটি তোমার জানা, তাই না?

রবি ঘাড় হেলায়। অভ্যেসবশে ঠিকঠাক গাড়ি চালালেও রবিকে বেশ অন্যমনস্ক লাগছে অজয়ের। কী ভাবছে এত! সিগারেট ধরায় অজয়। রবিকে অফার করে। মাথা নেড়ে ‘না’ বলে রবি। হু-হু বাতাস ঢুকছে জানলা দিয়ে। খুব তাড়াতাড়ি ঠান্ডা হয়ে গেছে হাওয়া। শরৎকালের এই এক মজা। অজয় বলে, এদিকে বলছ মাওবাদীদের ঝামেলা নেই? কিন্তু কাগজে যে লেখে…

কথা শেষ না করে উত্তরের অপেক্ষায় থাকে অজয়। একটু পরে রবি বলে ওঠে, ওদের ডেরা অনেক ভেতরে। বিনপুর, ফুলকুসুমা, বেলপাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে। হাইওয়েতে এসে ছুটকো-ছাটকা ডাকাতি ওরা করে না।

অজান্তেই নিজের কোম্পানিকে তাচ্ছিল্য করে ফেলল রবি। এই গাড়িতে প্রায় চল্লিশ

হাজার টাকার মাল আছে। অবশ্যই স্কচের দাম ধরে। সকালবেলা লিস্ট ধরে শপিং করেছে অজয়। ভেটকির ফিলেট, খাসি, মুরগির মাংস। সব আইসবক্সে প্যাক করা আছে। কাজুবাদাম, কিসমিস, দামি চাল, ঘি, তেল। স্যালাডের সবজি। ডাকাতি যদি সত্যিই হয়, আশাহত হবে না ডাকাতরা। দিবাকরদা লস খাবে প্রচুর। তারপর আছে বদনাম। ভোর থাকতে ম্যাটাডোরে চেপে রান্নার ঠাকুর, জোগাড়ে রওনা দিয়েছে ঝাড়গ্রামে। ওরা এতক্ষণে হয়তো পৌঁছে গেছে। ওদের গাড়িতে আছে গ্যাস ওভেন, বাসনকোসন, বুফের সরঞ্জাম। অজয়রা যদি কোনওভাবে আটকে যায়, তা হলেই কেলো। একই সঙ্গে অজয় লক্ষ করে, সে যেন বিপদ নিয়ে একটু বেশিই ভাবছে। কারণটা হয়তো চাকরি হারাবার ভয়। অনেক চেষ্টাচরিত্র করে এই চাকরিটা পেয়েছে। মাইনেটা ভদ্রস্থ। পাশ কোর্সের বি এ, এর থেকে বেশি আশা করা ঠিক নয়। বাবা রিটায়ার করেছে তিন বছর। ট্রামের কন্ডাক্টার ছিল। অজয়ের থেকে সাত বছরের ছোট বোন আছে একটা। বিয়েটা অজয়কেই দিতে হবে। পৃথিবীতে দেরি করে আসা বোনের জন্য অজয় বাবার ওপর বেশ বিরক্ত। বাবাও অজয়কে নিয়ে বিশেষ খুশি নয়। স্কুলজীবনে অজয় প্রথম পাঁচজনের মধ্যে থাকত। স্কুলটা যদিও তেমন পদের ছিল না। বাবা বুঝত না সেটা। ধারণা ছিল ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে। হায়ার সেকেন্ডারিতে অন্য স্কুলে ভরতি হয়ে অজয় টের পেল তার অবস্থান। চারপাশে থিকথিক করছে ভাল স্টুডেন্ট। কোনওক্রমে গ্র্যাজুয়েট হল অজয়। তারপর শুরু চাকরি খোঁজা। মাসখানেক করে বহু প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেছে। এখানে এসে থিতু হল। মাঝারি ক্যাটারিং কোম্পানিকেও কিছু কেতা মেনটেন করতে হয়। ইস্ত্রি করা শার্ট, ট্রাউজার, টাই… বাড়ি থেকে অজয় যখন বেরোয়, বাবা এমনভাবে তাকিয়ে থাকে, যেন ইঞ্জিনিয়ার ছেলেকেই দেখছে। বোন রুমা মাঝেমধ্যে বায়না করে, তোদের ক্যাটারিং-এ কত ভাল ভাল খাবার হয়, প্যাকেট করে নিয়ে আসিস না কেন? নষ্টও তো হয় শুনেছি।

আনতেই পারে অজয়। অনেক স্টাফই বাঁচলে নিয়ে যায় বাড়ির জন্য। অজয় পারে না। কারণ, কাজে বেরোনোর আগে বাবার ওই গর্বিত দৃষ্টি। বড়লোকের উদ্বৃত্ত তো আসলে উচ্ছিষ্টের সমান। বাবাকে ছোট করতে ইচ্ছে হয় না।… ভাবনার মাঝে অজয় লক্ষ করে আলোকিত হয়ে উঠেছে রাস্তা। শহরে ঢুকছে গাড়ি। অজয় বলে, খড়্গপুর ঢুকে গেলাম, রবি?

হ্যাঁ দাদা।

চায়ের দোকানে দাঁড় করিয়ো। মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে।

দেরি হয়ে যাবে না?

হোক। একটানা এতক্ষণ গাড়িতে বসে থাকা যায় নাকি! তা ছাড়া তুমি বলেছ, এই রাস্তায় তেমন বিপদের কিছু নেই।

আছে। লোধাশুলির পর বারো কিলোমিটার জঙ্গলটাকে নিয়ে যা একটু চিন্তা। মুখে দুশ্চিন্তার কথা বললেও চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করায় রবি।

চায়ের দোকানে কিছু সময় কাটিয়ে ফের গাড়িতে উঠেছে অজয়রা। সন্ধে গড়িয়ে এখন

রাত। ঘড়িতে আটটা বাজছে। আকাশে পূর্ণিমার আগের দিনের চাঁদ। ফলে অন্ধকার তত ঘন নয়। গাড়ির জোরালো হেডলাইট অন্ধকারের কিছুটা অস্তিত্ব মুছে দিচ্ছে। উলটোদিকে গাড়িও আসছে হামেশা। ভয় অনেকটা কাটিয়ে ফেলেছে অজয়। সবচেয়ে বড় ভরসা রবি। ও তো এই জেলার ছেলে।

চা খাওয়ার সময় অজয়ের সেলে ফোন এসেছিল দিবাকরদার। প্রায় নিশ্চিত হয়েই জানতে চেয়েছিল, কী রে, পৌঁছে গেছিস তো? ঘরদোরের অবস্থা কেমন? পরিষ্কার করতে লোক লাগিয়ে দে।

একটানা কথা বলে দিবাকরদা যখন থামল, অজয় ধীরেসুস্থে জানাল তাদের অবস্থা। জ্যাম, গাড়ি ব্রেকডাউন সবই বলল। শুনে দিবাকরদা পরামর্শ দেয়, খড়্গপুরেই কোনও হোটেলে থেকে যা। রাতে জঙ্গলের রাস্তা পার হোসনি।

ফোনে ‘আচ্ছা’ বললেও গাড়িতে উঠে বসেছিল অজয়। আলোকোজ্জ্বল শহরের কারণেই ভয়টা তেমন কাবু করেনি। এখন চারপাশে জঙ্গল জেগে উঠতে, একটু যেন ভয় ভয় করছে। শালবনটা দাড়া-ভাঙা-চিরুনির মতো ফাঁকা ফাঁকা। ডালপালা গলে আসা চাঁদের আলো ভীষণ রহস্যময়। গাড়িঘোড়া কমে গেছে রোডে। সাহস সঞ্চয় করতে ইতিমধ্যে দুটো সিগারেট খেয়ে ফেলেছে অজয়। ভাবছে সেইসব ছেলেমেয়ের কথা, ভুল হোক অথবা ঠিক, একটা বিশ্বাস আঁকড়ে ওরা কেমন এই জঙ্গলে দিন-রাত কাটিয়ে দিচ্ছে! অজয় শুনেছে ওদের মধ্যে অনেকেই শহরের শিক্ষিত পরিবারের সন্তান। অজয়ের তো নিজের বিছানা ছাড়া ভাল ঘুম হয় না কোথাও। ওরা যে কী ধাতুতে গড়া !

অন্যান্য ট্রিপের তুলনায় এবার যেন রবি একটু বেশিই চুপচাপ। একঘেয়ে গাড়ির শব্দ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই। নিঝুম ভাব কাটাতে অজয় বলে, এটা সেই লোধাশুলি জঙ্গল, তাই না?

ঘাড় হেলায় রবি। মুখে কথা নেই। অজয় ফের বলে, এর কাছাকাছি তোমার গ্রাম?

হ্যাঁ দাদা। কথা ফুটল রবির মুখে।

নামটা ভারী সুন্দর। কুসুমডিহা।

রবি হাসে। একটু যেন ম্লান হাসি। নাকি আলো কম বলে এরকম লাগল? অজয় জানতে চায়, এখান থেকে কত কিলোমিটার যেন?

আড়াই মতো হবে।

জানলা দিয়ে যে বাতাসটা এখন আসছে, গন্ধ একদম অন্যরকম। কলকাতার মতো ভিজে ভাবটা একেবারে নেই। মহুয়া, শালফুলের গন্ধ মিলে মাতাল করা ভাব। কথা চালিয়ে যায় অজয়, কতদিন দেশে যাওনি?

মাস ছয়েক হয়ে গেল। আপনাদের এখানে জয়েন করার পর আর আসা হয়নি।

রবির গলায় যেন মনখারাপের ছোঁয়া। দেশবাড়ির এত কাছ দিয়ে যাচ্ছে অথচ ঘরের লোকের সঙ্গে দেখা করতে পারছে না। তাই কি এত কম কথা বলছে রবি? ওর আচরণের একটা মানে করতে পেরে নিশ্চিন্ত হয় অজয়। কিন্তু জঙ্গল যে আরও ঘন হচ্ছে। দমচাপা নির্জনতা। অজয় বলে, চলো, আজ রাতটা তোমার বাড়িতে কাটিয়ে দিই।

ব্রেকে পা পড়ে গিয়েছিল রবির। ঝাঁকুনি দিয়ে চালু হল গাড়ি। অবিশ্বাসের কণ্ঠে বলে, আপনি যাবেন?

হ্যা, না যাওয়ার কী আছে! তা ছাড়া এই জঙ্গলে গাড়ি চালানো সেফ নয়।

গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফেলল রবি। ইঞ্জিন বন্ধ করেনি। অল্প আলোতেও ওর মুখ এখন চকচক করছে। তবু সংকোচের গলায় বলে, আমাদের ঘরে আপনি থাকতে পারবেন না দাদা। বড্ড খারাপ অবস্থা। অনেকদিন সারাই-সোরাই হয়নি। খাট-বিছানা ভাল নয়। ইলেকট্রিক যায়নি আমাদের গ্রামে।

অসুবিধে হবে না। তুমি চলো তো! একটা তো রাত।

তবু এক্সেলেটারে চাপ দেয় না রবি। হেডলাইট দুটো জ্বালিয়ে রেখেছে। বলে, এত রাতে আপনাকে খাওয়াব কী? বাজার-দোকান করা নেই।

ছাড়ো তো! ভাতে ভাত খেয়ে নেব। গাড়ি চালু করো।

গাড়ির হেডলাইট ঘুরে যায় জঙ্গলের দিকে। মাঠে নেমে আসে গাড়ি। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আবছা পথরেখা। বড্ড এবড়োখেবড়ো। রবি বলে, সকালের দিকে কিছুক্ষণ থাকবেন তো দাদা? গ্রামটা একটু ঘুরিয়ে দেখাব।

অতটা সময় পাব না রবি। ভোর ভোর স্পটে পৌঁছোতে হবে। একগাদা কাজ জমে আছে।

একটু যেন দমে যায় রবি। বলে, গ্রামটা কিন্তু আমাদের দেখবার মতো। সীতাকুণ্ড, কিয়াঝরিয়া নালা, জটিবুড়ির হাড়, আসলে হাজার বছরের পুরনো গাছের কঙ্কাল। কী গাছ কেউ বলতে পারে না। কত মজাদার মানুষ আছে গ্রামে। তাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতাম। হাবিলদার রমানাথকাকা, পুলিশের চাকরি থেকে রিটায়ার করে গেছে কবে, তবু ওরকম একটা ড্রেস পরে ঘুরে বেড়ায়। পিয়ন কালীকাকা, চিঠি নিয়ে গ্রামের দিকে আসছে, যদি দেখে কারও জমিতে ক’দিন আগে বোনা বীজদানা তছনছ করছে চড়াই, শালিখ, দাঁড়িয়ে যাবে। ঢেলা তুলে তাড়াবে পাখিগুলোকে। ভুলেই যাবে চিঠি দেওয়ার কথা। তারপর ধরুন আমাদের গ্রামের গর্ব স্বপনদা, হায়ার সেকেন্ডারিতে ডিস্ট্রিক্টে ফার্স্ট হয়েছিল। এখন কলকাতার বিরাট নামকরা ডাক্তার। ওদের বাড়িটা দেখাতাম। ফোয়ারাটোয়ারা দিয়ে জমিদার বাড়ির মতো সাজিয়েছে স্বপনদা। নিজে অবশ্য আসার সময় পায় না।… একে একে গ্রামের মানুষের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে রবি। বোঝা যাচ্ছে গোটা গ্রামটাই আসলে ওর বাড়ি।

রাস্তা আরও খারাপ হচ্ছে। রীতিমতো দুলছে গাড়ি। রবির ভ্রূক্ষেপ নেই। অন্য সময় হলে গজগজ করত। চাঁদের অস্পষ্ট আলোয় যতটুকু দেখা যাচ্ছে, জমিতে চাষের চিহ্ন নেই। গাছপালাও কম। কয়েকটা চালাভাঙা বাড়িও চোখে পড়ল। চারপাশে কেমন নিঃস্ব নিঃস্ব ভাব। রবির কুসুমডিহা কি অনেক দূরে? নিজের গ্রামের যে-বর্ণনা সে দিচ্ছে, তার সংলগ্ন গ্রামের অবস্থা এরকম হওয়ার কথা নয়।

আর কত দূর তোমার গ্রাম? জানতে চায় অজয়।

ঢুকে গেছি দাদা। বলেই স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে পাশের জমিতে চলে গেল রবি। একটু গড়িয়ে ফের রাস্তায় উঠে পড়ল।

এটা কী করলে? রাস্তা থেকে নেমে আবার উঠে এলে যে!

সে একটা ব্যাপার আছে।

কী ব্যাপার বলো না?

রবি বলতে থাকে, ওখানে একটা বটগাছ দেখলেন, যার পাশ দিয়ে আমি নেমে এলাম মাঠে। ওই গাছতলায় স্বপনদার বাবাকে খুন করা হয়েছিল।

এই আবছা আঁধার প্রকৃতিতে ‘খুন’ শব্দের অভিঘাতটা অজয়ের চেতনায় সজোরে লাগল। জিজ্ঞেস করে, কারা খুন করল, কেন?

ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে রবি বলে, সব পার্টি-পলিটিক্সের ব্যাপার বুঝলেন। জনাজ্যাঠা ছিল গ্রামপাগল মানুষ। ছেলেকে ডাক্তারি পড়াতে পাঠানোর সময় বলেছিল, হপ্তায় একদিন অন্তত গ্রামে এসে রুগি দেখে যাস। কথা রাখেনি ছেলে। উলটে বাবাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কলকাতায়। জনাজ্যাঠা যায়নি। জ্যাঠা যে যাবে না জানতুম। কতদিন দেখেছি, চলার রাস্তায় যদি জমির ধানগাছ এসে পড়ে, আলতো করে তুলে দিতেন জমিতে। এখান থেকে দু’ক্রোশ দূরে গোপীবল্লভপুরে সাইকেল চেপে হাইস্কুলে মাস্টারি করতে যেতেন। আমাদের গ্রামে প্রাইমারি স্কুলও নেই। জনাজ্যাঠা বিনা মাগনায় বাড়িতে পড়াতেন। আমিও পড়েছি। মডার্ন চাষের ব্যাপারে জ্যাঠার জ্ঞান ছিল প্রচুর। এখানকার মাটি পাথুরে। সেচের বন্দোবস্ত নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে চাষ। জনাজ্যাঠা গ্রামের লোকেদের বলতেন, ধার করে সার না কিনে, যে-মাটির যা চাষ, তাই করো। শুধু ধান গম নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে!… খাঁটি মানুষ পার্টির লোকেদের সহ্য হয় না। খুন হয়ে গেলেন জ্যাঠা। এর ভেতরেও অবশ্য আরও অনেক কারণ আছে। আমি সবটা জানি না।

এত কথার পরেও আসল বিষয়টা বলে উঠতে পারল না রবি। অজয় জিজ্ঞেস করে, রাস্তা ছেড়ে গাড়িটা জমিতে নামালে কেন, সেটা তো বললে না!

রবি বলে, আমাদের গ্রামের কোনও মানুষই বটতলার সামনের রাস্তায় হাঁটে না। কোনও ধরনের গাড়িও চালায় না। সরকারি গাড়ি অবশ্য যাতায়াত করে। আমাদের কেন জানি মনে হয় জ্যাঠা বুঝি আজও শুয়ে আছেন ওখানে। বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে যাব…

গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে অজয়ের। খাঁ খাঁ শূন্য গ্রামের বাসিন্দাদের বুকটা কিন্তু শ্রদ্ধায় ভরা। অজয় বলে, ওখানে একটা শহিদবেদি করে দিলে তো হয়।

করা হয়েছিল, পার্টির লোক ভেঙে দিয়ে গেছে। বলতে বলতে উঁচুমতো জমিতে গাড়ি তুলল রবি। বলল, এসে গেছি।

হেডলাইট পড়েছে ভাঙা ঝুরঝুরে মাটির দেওয়ালে। আরও জরাজীর্ণ লাগছে বাড়িটা। সদরে এসে দাঁড়ায় এক কোলকুঁজো বুড়ো। চোখে ঘোলাটে চশমা। রবি বলে, আমার বাবা। গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে। হেডলাইট নিভে যায়। জোনাকি জ্বলে ওঠে চারপাশে।

অপ্রত্যাশিতভাবে রবিকে পেয়ে বাড়ির লোক খুব খুশি। মা-বাবা, ভাই-বোন সকলের মুখে আনন্দ উপচে পড়ছে। অপর দিকে অতিথিকে নিয়ে কিছুটা বিব্রত ওরা। অজয়কে বসানো হয়েছে মাঝের ঘরে একটা চেয়ারে। মেঝেতে হারিকেন। ঠিক যেন এ-বাড়ির সবচেয়ে

পুরনো সদস্য। জুলজুল করে দেখছেন অজয়কে। ওই ঝিমানো আলোতে ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে অজয় দেখেছে অজস্র অভাবের ছাপ। রবি বোধহয় একাই রোজগেরে। কলকাতায় নিজেরটা চালিয়ে ক’টা টাকাই বা পাঠাতে পারে!

অজয়ের পিঠে হাতপাখার খোঁচা লাগে। ইজের পরা খালি গায়ের একটা বাচ্চা মেয়ে সেই থেকে হাওয়া করে যাচ্ছে অজয়কে। পাখাটা একবার মাটিতে ঢুকে নিল। মেয়েটা রবির কে হয়, কে জানে! ,

এত রাতেও পাড়ার মানুষ একবার করে দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে অজয়কে। সিনেমার মতো পাত্রীযোগ্য সুন্দরীকে এখনও দেখা যায়নি। নিজেকে এভাবে দ্রষ্টব্য হতে দেখে, বেশ অস্বস্তি হচ্ছে অজয়ের। রবিটা যে কোথায় গেল? সম্ভবত ভদ্রস্থ ভোজনের আয়োজন করতে। আর কী আশ্চর্য বৈপরীত্য, গাড়ি ভরতি মহার্ঘ খাবার। সেখান থেকে এক পিস কিছু তুলে নেওয়ার উপায় নেই অজয়দের।

ঘরে ঢোকে রবি, চলুন দাদা, রান্না রেডি।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় অজয়। খিদে অনেকক্ষণ ধরে চাগাড় মারছে। শরীরও ভীষণ ক্লান্ত। খেলেই ঘুম পাবে।

পাশের ঘরে খেতে দেওয়া হয়েছে। পাড় দেওয়া হাতেবোনা আসন, বড় কাঁসার থালা, গ্লাস, জামবাটি। মেনু মন্দ নয়, মোটা চালের লালচে ভাত, ডাল, আলুপোস্ত, ডিমের ঝোল। মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছে অজয়। জানে, চোখ তুললেই দেখতে পাবে অনেক কৌতূহলী দৃষ্টি। পাড়ার লোক কেউই বাড়ি ফেরেনি। চাপা কোলাহল শুনে আন্দাজ করা যাচ্ছে, বাইরে লোক বাড়ছে। অনেকদিন পর এই গ্রামে ঢুকেছে জলজ্যান্ত একটা গাড়ি। অজয়কে ভাবছে মালিক। পাশে রবি বসেছে খেতে। বারবার আক্ষেপ করছে, কিছুই খাওয়াতে পারলাম না। আগে ঠিক করা থাকলে খাসির মাংস আনিয়ে রাখা যেত।

অজয় বলে, কী দরকার। এই তো বেশ খাচ্ছি। রান্নাও হয়েছে দারুণ।

প্রশংসাটা অবশ্য মিথ্যে নয়। ঘোমটা মোড়া রবির মা ডালের বাটি নিয়ে এসেছে সামনে, এক হাতা দিই বাবা?

মুখ তুলে ‘না’ করতে যাবে অজয়, চোখ আটকে যায় একটা বাচ্চা ছেলের ওপর। বাচ্চাটা উলঙ্গ, ওর হাতে ঝুলছে বরখাস্তের নোটিশ। চিঠিটা অজয়ের নামে পাঠিয়েছে কোম্পানি।

মুখের গ্রাস নামিয়ে হতভম্ব অজয় রবিকে কনুইয়ের গুঁতো মারে। রবি মুখ তুলে বাস্তব দৃশ্যটা দেখে, ল্যাংটো ছেলেটার হাতে দামি বিস্কিটের প্যাকেট। যে-প্যাকেট আজ গাড়িতে বইছে অজয়রা। কোথা থেকে ওর হাতে এল! লালা মাখা মুখে মেজাজে বিস্কিট খাচ্ছে ছেলেটা।

খাবারের থালা ছেড়ে ছিটকে উঠে যায় রবি। বাচ্চাটার কান ধরে আধ ফুট মাটি থেকে তুলে নিয়ে জানতে চায়, কোথায় পেলি?

এক হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটা কাঁদতে কাঁদতে কী যেন বলে। ওর বাড়ানো হাত বরাবর

তাকিয়ে অজয় রবি দেখে, দালানে আরও অনেক ছেলেমেয়ের হাতে নানান প্যাকেট। কাজু, চানাচুর, বাটার, কিসমিস, গুঁড়ো দুধ… আগের বাচ্চাটার থেকে এরা বড়। তাই মুখে চিলতে অপরাধের ছোঁয়া। বোকার মতো ঘরে ঢুকে পড়েনি।

সর্বনাশ করেছে! বলে, রবি দৌড়ে যায় বাড়ির বাইরে। অনুসরণ করে অজয়।

পড়ে থাকা মিছরির ওপর যেমন ডেয়ো পিঁপড়ে ছেয়ে যায়, অজয়দের গাড়ির অবস্থা এখন সেরকমই। অত বড় গাড়ি প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। হেঁকে ধরেছে নানান বয়সের পুরুষ, মহিলা। এদের আচরণ পিঁপড়ের মতোই নিঃশব্দ। ভুল করে বোধহয় গাড়ির একটা জানালা খোলা রেখেছিল রবি, সেখান দিয়েই মাল বেরিয়ে আসছে। দু’-চারটে বাচ্চা নিশ্চয়ই ঢুকে আছে ভেতরে। চাঁদের আলোয় সবই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। একটা হেটোমেঠো লোককে স্কচের বোতল হাতে অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে দেখল অজয়।

এঁটো হাতেই রবি গাড়ি থেকে টেনে টেনে লোক নামাচ্ছে। হাত চালাচ্ছে এলোপাতাড়ি। তারা রুখে দাঁড়াচ্ছে না আবার ভয়ও পাচ্ছে না রবিকে। ফের সেঁটে যাচ্ছে গাড়িতে। রবির একেবারে পাগল পাগল অবস্থা। দেদার গালাগালি করে যাচ্ছে পাড়ার লোকগুলোকে।

অজয়ের মাথা ঠান্ডা। বুঝে গেছে, এদের বাধা দিয়ে লাভ নেই। ক্ষতি যা হওয়ার হয়েই গেছে। আইসবক্স, কন্টেনার, প্যাকেট, ট্রে, ছড়িয়ে আছে সামনের জমিতে। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় অজয়। রবির কাঁধ ধরে টেনে আনে। অজয়ের চোখে বরফ দেওয়া মাছের চাউনি। সেদিকে তাকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে রবি। হাঁটু মুড়ে বসে মাটিতে ঘুসি মারতে থাকে। বারংবার একই কথা বলে যায়, শালা ভিখারি। সব ক’টা ভিখারি।

অজয় বুঝতে পারে না, রবি ঠিক কী কারণে কাঁদছে, পরিজন ভিখারি হয়ে গেল বলে, নাকি চাকরি যাওয়ার আশঙ্কায়।

আলো ফোটার আগেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অজয়, রবি। গাড়িটা বড্ড বেশি লাফাচ্ছে। স্বাভাবিক। ভেতরে মাল নেই। রাতের ঘটনা নিয়ে কোনও আলোচনাই করছে না দু’জনে। কর্তব্য এবং ফলাফল দুটোই জানা। গাড়ি ফেরত দিতে হবে মালিককে। পত্রপাঠ চাকরি থেকে বিদায়। আর একটা সম্ভাবনার কথা মাথায় আসছে রবির। জিজ্ঞেস করেই ফেলে, কী মনে হয় আপনার, পুলিশ কেস দেবে নাকি আমাদের নামে?

দিতেও পারে। গ্রামেও পাঠাতে পারে পুলিশ। বলে, অজয়।

পুলিশের বিষয়টা সে এতক্ষণ ভাবেনি। দুশ্চিন্তা বাড়ল। টেনশনে থেকেও রবি কিন্তু বটতলার কাছে এসে নেমে গেল জমিতে, একটু ঘুরে উঠল রাস্তায়। বলল, আপনি মাওবাদীর ভয় পাচ্ছিলেন, আমাদের গ্রামের লোকই লুঠ করে নিল সব!

অত্যন্ত সহজ সরলভাবে বলা কথাটার মধ্যে অজয় দেখতে পেল বিশাল সমাধান। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ইয়েস গোটা ঘটনাটা মাওবাদীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে হবে। বলব, ওরাই লুঠ করেছে।

একটু ভেবে নিয়ে রবি বলে, বিশ্বাস করাতে পারবেন?

করাতেই হবে। গাড়িটা দাঁড় করাও তো!

রবি কিছু না বুঝেই গাড়ি থামায়। অজয় গেট খুলে নামতে নামতে রবিকে বলে, বেরিয়ে এসো।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাতে ঢিল তুলে নেয় অজয়। ছুড়ে মারে গাড়িতে। রবিকে বলে, কী হল, মারো!

আমি পারব না দাদা। আমি ড্রাইভার।

গাড়ি তো তোমার নয়। মারো, মারো। না হলে ওদের বিশ্বাস করানো যাবে না।

হাতে ঢিল তুলেও দাঁড়িয়ে থাকে রবি। অজয় একাই পর্যাপ্ত ক্ষতি করেছে গাড়ির। জানলার কাচও ভেঙেছে একটা। লুঠেরাদের হাতে পড়ার মতো বিশ্বাসযোগ্য চেহারা হয়েছে। অজয় এবার রবিকে বলে, আর একটা কাজ বাকি আছে। কী?

তুমি আমার জামা-প্যান্ট ছিঁড়বে, চুল ঘেঁটে দেবে, আমিও তোমাকে তাই করব। না।

রবি হেসে ফেলে। বলে, ধুর, ওসব আমার দ্বারা হবে

হতেই হবে। নয়তো গ্রামে পুলিশ পাঠাবে দিবাকরদা।

রাজি হয় রবি। চার পা দূরে একটা পতিত জমি। রবি বলে, চলুন ওখানে যাই। ছোটবেলায় ওই মাঠে ম্যাচ খেলতাম।

মাঠের প্রায় মাঝামাঝি চলে এসেছে দু’জনে। ঠাট্টার ছলে একে অপরের জামা ছেঁড়ে। রবি একটু লজ্জা পাচ্ছে। ধমকে দেয় অজয়, কী হচ্ছে কী, ছাড় দিচ্ছ কেন আমাকে? ধরা পড়ে যাব যে!

হাসতে হাসতে ওরা ধস্তাধস্তি করে। মাঠে গড়াগড়ি খায়। একটা গোরু ঘাস খাচ্ছিল দূরে, মুখ তুলে একবার ওদের দেখে। ফের ঘাস খাওয়ায় মন দেয়।

আর কোনও সাক্ষী রইল না। ওদের গটআপ মারপিটের উল্লাস, হাসি রয়ে গেল মাঠের বাতাসে। ধুলোমাখা বিধ্বস্ত দু’জন উঠে এল গাড়িতে। ওরা ফিরে চলল ঝাড়গ্রামের উদ্দেশে।

তিনদিন কেটে গেল। চাকরি যায়নি ওদের। মাওবাদীর নাম শুনে দিবাকরদা ভয়ে পুলিশকে জড়ায়নি। চেপে গেছে গোটা ব্যাপারটা। সেদিন লোকাল মার্কেট থেকে শপিং করে সামলানো হয়েছে পার্টি। আজ কোম্পানির কোনও অর্ডার নেই। সকালে অফিসঘরে এসে কাগজ পড়ছে অজয়। একটা খবরে চোখ থামে।

বাইরে সদ্য সারানো গাড়িটা কাপড় দিয়ে মুছছে রবি। অজয় ডাকে, রবি, শুনে যাও। রবি অফিসঘরে ঢোকে। অজয় বলে, কাগজে কী বেরিয়েছে দেখেছ? না, কাগজ পড়ার সময় পাই কই।

খবরটা পড়তে থাকে অজয়, গতকাল রাতে উত্তর কলকাতায় মাওবাদী সন্দেহে দুই যুবককে তাদের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নাম যথাক্রমে অজয় রায়, রবি বেরা। ধ্যাত ইয়ারকি মারছেন। হাসতে হাসতে বলে রবি।

সত্যি, দেখো। প্রিন্টিং মিসটেকও হতে পারে অবশ্য। বলে, কাগজটা বাড়িয়ে ধরে অজয়।

অজয়ের সম্মানরক্ষার্থে নাকি অল্প বুদ্ধির কারণে রবি ঝুঁকে পড়ে কাগজে। খবরটা পড়ে বলে, কই, এখানে তো অন্য দু’জনের নাম লিখেছে।

রবির মাথায় আলতো চাঁটি মেরে অজয় বলে, জানি রে বাবা, জানি। আমাদের ধরা পড়তে এখনও অনেক দেরি।

দেশ অক্টোবর ২০০৬

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *