মহাবস্ত্ববদান কোশলনৃপতির তুলনা নাই , জগৎ জুড়ি যশোগাথা ; ক্ষীণের তিনি সদা শরণ - ঠাঁই দীনের তিনি পিতামাতা । সে কথা কাশীরাজ শুনিতে পেয়ে জ্বলিয়া মরে অভিমানে — ‘ আমার প্রজাগণ আমার চেয়ে তাহারে বড়ো করি মানে ! আমার হতে যার আসন নীচে তাহার দান হল বেশি ! ধর্ম দয়া মায়া সকলি মিছে , এ শুধু তার রেষারেষি ।' কহিলা , ‘ সেনাপতি , ধরো কৃপাণ , সৈন্য করো সব জড়ো । আমার চেয়ে হবে পূণ্যবান স্পর্ধা বাড়িয়াছে বড়ো ! ' চলিলা কাশীরাজ যুদ্ধসাজে — কোশলরাজ হারি রণে রাজ্য ছাড়ি দিয়া ক্ষুব্ধ লাজে পলায়ে গেল দূর বনে । কাশীর রাজা হাসি কহে তখন আপন সভাসদ্ - মাঝে ‘ ক্ষমতা আছে যার রাখিতে ধন তারেই দাতা হওয়া সাজে ।' সকলে কাঁদি বলে , ‘ দারুণ রাহু এমন চাঁদেরেও হানে ! লক্ষ্মী খোঁজে শুধু বলীর বাহু , চাহে না ধর্মের পানে ! ' ‘ আমরা হইলাম পিতৃহারা ' কাঁদিয়া কহে দশ দিক — ‘ সকল জগতের বন্ধু যাঁরা তাঁদের শত্রুরে ধিক্ ! ' শুনিয়া কাশীরাজ উঠিল রাগি — ‘ নগরে কেন এত শোক ! আমি তো আছি , তবু কাহার লাগি কাঁদিয়া মরে যত লোক ! আমার বাহুবলে হারিয়া তবু আমারে করিবে সে জয় ! অরির শেষ নাহি রাখিবে কভু শাস্ত্রে এইমতো কয় । মন্ত্রী , রটি দাও নগরমাঝে ঘোষণা করো চারি ধারে — যে ধরি আনি দিবে কোশলরাজে কনক শত দিব তারে ।' ফিরিয়া রাজদূত সকল বাটী রটনা করে দিনরাত ; যে শোনে আঁখি মুদি রসনা কাটি শিহরি কানে দেয় হাত । রাজ্যহীন রাজা গহনে ফিরে মলিনচীর দীনবেশে , পথিক একজন অশ্রুনীরে একদা শুধাইল এসে , ‘ কোথা গো বনবাসী , বনের শেষ , কোশলে যাব কোন্ মুখে ? ' শুনিয়া রাজা কহে , ‘ অভাগা দেশ , সেথায় যাবে কোন্ দুখে ! ' পথিক কহে , ‘ আমি বণিকজাতি , ডুবিয়া গেছে মোর তরী । এখন দ্বারে দ্বারে হস্ত পাতি কেমনে রব প্রাণ ধরি ! করুণাপারাবার কোশলপতি শুনেছি নাম চারি ধারে , অনাথনাথ তিনি দীনের গতি , চলেছে দীন তাঁরি দ্বারে ।' শুনিয়া নৃপসুত ঈষৎ হেসে রুধিলা নয়নের বারি , নীরবে ক্ষণকাল ভাবিয়া শেষে কহিলা নিশ্বাস ছাড়ি , ‘ পান্থ , যেথা তব বাসনা পুরে দেখায়ে দিব তারি পথ — এসেছ বহু দুখে অনেক দূরে , সিদ্ধ হবে মনোরথ ।' বসিয়া কাশীরাজ সভার মাঝে ; দাঁড়ালো জটাধারী এসে । ‘ হেথায় আগমন কিসের কাজে ' নৃপতি শুধাইল হেসে । ‘ কোশলরাজ আমি বনভবন ' কহিলা বনবাসী ধীরে — ‘ আমার ধরা পেলে যা দিবে পণ দেহো তা মোর সাথিটিরে ।' উঠিল চমকিয়া সভার লোকে , নীরব হল গৃহতল ; বর্ম - আবরিত দ্বারীর চোখে অশ্রু করে ছলছল । মৌন রহি রাজা ক্ষণেকতরে হাসিয়া কহে , ‘ ওহে বন্দী , মরিয়া হবে জয়ী আমার'পরে এমন করিয়াছ ফন্দি ! তোমার সে আশায় হানিব বাজ , জিনিব আজিকার রণে — রাজ্য ফিরি দিব হে মহারাজ , হৃদয় দিব তারি সনে ।' জীর্ণ - চীর - পরা বনবাসীরে বসালো নৃপ রাজাসনে , মুকুট তুলি দিল মলিন শিরে — ধন্য কহে পুরজনে ।