মশক, মূষিক ও মার্জার

মশক, মূষিক ও মার্জার

বিশ্বকাকু প্লেটের শেষতম রসগোল্লাটা মুখে পুরে দিয়ে চোখ দুটো সামান্য বড় করে চোয়াল নাড়িয়ে মিষ্টিটাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছিল, হঠাৎই তার চোখ পড়ল বাবান টিভির নীচে মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে একটা বই পড়ছে, আর মৌ পাশেই সোফায় বসে ওয়ার্ক এডুকেশানের একটা হাতের কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছে। বিশ্বকাকু টেবিল থেকে জলের গ্লাস তুলে নিয়ে ঢকঢক করে জল শেষ করে প্রথম কথা বলতে পারল, ‘আঃ, এতক্ষণে বডিটা একটু জুত হল। জানিস তো, যারা নামকরা বডি বিল্ডার তারা রসগোল্লা দিয়ে ব্রেকফাস্ট করে। অবশ্য মিষ্টি সবাই সহ্য করতে পারে না, তাই তার বদলে দুধ আর ছানা খায়।’

বাবান-মৌ বিশ্বকাকুর কথায় কান দিয়েছে বলে মনে হল না। বিশ্বকাকু যখন-তখন ওদের বাড়িতে আসে যায়, খাবারদাবার খায়, তাদের সঙ্গে মজা করে, আর সত্যি ঘটনা বলে নানান উদ্ভট গল্প শোনায়।

বিশ্বকাকু সোফায় বসে বসেই হাঁক পাড়ল, ‘বউদি, বউদি―। চায়ের কথাটা আবার ভুলে যেয়ো না যেন।’

রান্নাঘর থেকে বাবান-মৌয়ের মা, অর্থাৎ বিশ্বকাকুর বউদি চেঁচিয়ে জবাব দিল, ‘ভুলিনি, ভুলিনি।’

বিশ্বকাকু এবারে সোফায় পা তুলে বসে হাত দুটোকে ব্যায়াম করার ভঙ্গিতে নাড়াচাড়া করে গম্ভীরভাবে বলল, ‘বাবান, তোদের টিভির তলায় সাদা বলের মতো ওটা কী পড়ে আছে রে?’

বাবান বই থেকে মুখ না তুলেই বলল, ‘ফেলিস ক্যাটাস—গৌতম।’ বিশ্বকাকু হাঁ করে বাবানের দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে ছোঁ মেরে ওর বইটা কেড়ে নিল ।

বাবানের উত্তর শুনে মৌ হেসে ফেলেছিল। এবারে হাতের কাজ রেখে ঘুরে বসল কাকুর দিকে।

বিশ্বকাকু বাবানের বইটা টেবিলে রেখে দিয়ে বলল, “ছিঃ, ছিঃ! তুই গুরুজনের সঙ্গে ইয়ার্কি মারছিস?’

বাবান হেসে বলল, “সে কী, কাকু, তুমি ফেলিস ক্যাটাস মানে জানো না! বেড়াল, বেড়াল—মার্জার!’

বিশ্বকাকু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ‘সে আর জানি না, জুওলজির বিজ্ঞানীরা গৃহপালিত বেড়ালকে ফেলিস ক্যাটাস বলে! তা গৌতম না কী একটা বললি যেন —।’

মৌ এবারে বলল, ‘দাদা বেড়ালটার নাম দিয়েছে গৌতম। দাদার ইস্কুলের এক বন্ধু আছে, নাম গৌতম। খুব ভালো ক্যারাম খেলে বলে খুব অহঙ্কার। দাদাকে চ্যালেঞ্জ করেছিল ক্যারামে। বলেছিল, “যদি আমাকে গেম দিতে পারিস তাহলে আমার নামে বেড়াল পুষিস।” দাদা ওকে হারিয়ে একেবারে ভূত করে দিয়েছে। তারপর কোত্থেকে একটা বেড়ালছানা জুটিয়ে নাম রেখেছে গৌতম।’

বাবান বলল, ‘কাকু, এবারে বইটা দাও। গল্পটা দারুণ ইন্টারেস্টিং—।’ বিশ্বকাকু আপনমনেই বিড়বিড় করতে লাগল, ‘বেড়াল…ফেলিস ক্যাটাস… বেড়াল…ফেলিস ক্যাটাস…বেড়াল…।’

তারপর হঠাৎই চিৎকার করে উঠল, ‘মনে পড়েছে! মশক, মূষিক ও মার্জার।’

বাবান-মৌ ফ্যালফ্যাল করে বিশ্বকাকুর দিকে তাকাতেই ওদের মা চায়ের কাপ হাতে ঘরে ঢুকে পড়ল, বলল, ‘ছোড়দা, তুমি কি সংস্কৃত আওড়াচ্ছিলে?’ বিশ্বকাকু চায়ের কাপে তেজি চুমুক দিয়ে বলল, ‘সে অনেক ব্যাপার, বউদি। আফ্রিকার একটা ঘটনা। দারুণ ইন্টারেস্টিং।’

‘তোমার গল্প তুমি ওদের শোনাও। আমার রান্না পুড়ছে।’ বলে মা চলে যেতেই বাবান-মৌ দুজনেই চেপে ধরল বিশ্বকাকুকে। বলল, ‘কুইক, স্টার্ট, ওয়ান, টু-থ্রি…

বিশ্বকাকু চোখ বুজে চায়ের কাপে পরপর তিনবার আমেজ করে চুমুক দিল। তারপর বলল, ‘ঘটনাটা আফ্রিকার কঙ্গোর। আজ থেকে বিশ বছর আগের কথা। কঙ্গো না বলে অবশ্য জায়ার বলাই ভালো, কারণ ১৯৭১ সাল থেকে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর নাম পালটে জায়ার রাখা হয়েছে। কঙ্গো নদীর নাম শুনেছিস তো? জায়ার হচ্ছে কঙ্গো নদীর খুব পুরোনো নাম। সেই থেকেই চলে এল দেশের নাম। তা এই দেশটার ওপর দিয়ে বিষুবরেখা চলে গেছে—একেবারে কঙ্গো নদীর ওপর দিয়ে, দু-জায়গায় নদীটাকে ভেদ করে। আর এইখানেই যত সব ভয়ঙ্কর ঘন জঙ্গল। চিরহরিৎ অরণ্য। বছরে বৃষ্টিপাত প্রায় একশো ইঞ্চি।

বিশ্বকাকু চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপ নামিয়ে রাখল টেবিলে। মৌ বলল, ‘কঙ্গোর সঙ্গে বেড়াল আসছে কোত্থেকে?’

বিশ্বকাকু বলল, ‘একটু ধৈর্য ধর, বাবা, এক্ষুনি বুঝতে পারবি।’

টিভির নীচ থেকে গৌতম মিয়াঁও-মিয়াঁও করে ডেকে উঠল। তারপর আড়মোড়া ভেঙে লেজটা পতাকার মতো সোজা ঊর্ধ্বমুখী করে পায়ে-পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

বিশ্বকাকু আবার বলতে শুরু করল, ‘এই রকমই একটা বেড়ালের বাজিমাতের ব্যাপার! জানিস তো, জায়ার হিরের জন্যে খুব বিখ্যাত। আমরা জায়ারের জঙ্গলে গিয়েছিলাম হিরেরই খোঁজে। বান্টুদের একটা গ্রাম থেকে খবরটা প্রথম ছড়াতে শুরু করেছিল। ওই গ্রামের কোনও একটা আদিবাসী নাকি কঙ্গো নদীর বিষুব অঞ্চলের কাছাকাছি একটা বড় হিরে কুড়িয়ে পেয়েছিল। ব্যস, ওই গুজবের ভিত্তিতে পশ্চিমের এক বড়লোক কোম্পানি বহু টাকা খরচ করে আমাদের চারজনের একটা অভিযাত্রী দলকে পাঠিয়ে দিল হিরের সন্ধানে। আমরা তো লোকলশকর নিয়ে রওনা হলাম। কখনও হেঁটে, কখনও ট্রেনে চড়ে, কখনও নৌকো ভাসিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। ক্রমে-ক্রমে আমরা পৌঁছে গেলাম লোমেলা নদীর কাছে। সেখানে গ্রামে আমরা বিশ্রাম নিলাম কয়েকদিন। এরপর থেকেই শুরু হবে আমাদের আসল অভিযান।

‘বাঁশের বাঁখারির তৈরি দেওয়াল আর বড়-বড় পাতার ছাউনি দেওয়া ঘরে আমাদের রাত কাটাতে দেওয়া হল। আর খাবার বলতে পেলাম আগুনে সেঁকা শুয়োরের মাংস। সেখানেই আবার এক বন্ধু জুটে গেল। যাকে তোরা বলিস ফেলিস ক্যাটাস, অনেকটা তাই। এর নাম হল ফেলিস ক্যাপেন্‌সিস বা সহজে সার্ভাল। লম্বা-লম্বা পা, খাটো লেজ, মাথার ঠিক ওপরে মুকুটের মতো এক জোড়া কান। চেহারায় দারুণ—ঝকঝকে হলদে রঙের ওপরে কালো-কালো ছোপ, আর প্রায় সাড়ে তিনফুট লম্বা হবে। বেড়ালটা কারও পোষা নয়। বনবেড়াল। খেয়ালখুশি মতো গাঁয়ে আসে, নয়তো জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়—

খরগোশ, ইঁদুর, হরিণছানা ধরে মেরে খায়। আর বেড়ালটা দেখলাম লাফাতে পারে দারুণ, এমনকী গাছেও চড়তে পারে। আমি বেড়ালটার নাম দিলাম ক্যাঙ্গো—মানে ক্যাট অফ কঙ্গোর শর্টকাট।

‘তোরা তো জানিস, পশুপাখিরা আমাকে দেখলে কেমন বশ হয়ে যায়। তা এই বেড়ালটাও কী করে যেন আমার বন্ধু হয়ে গেল। আমার থেকে মাংসটাংস খেতে লাগল, আর কেমন ওয়াঁও-ওয়াও করে ডাকতে লাগল। সে যাই হোক, রাতে তো একফোঁটা ঘুমোতে পারলাম না : কারণ মশা। কঙ্গোর মশা যে কী জিনিস—যে কামড় না খেয়েছে সে কিছুতেই বুঝবে না—পারলে চাটাই থেকে আমাদের লাশগুলো তুলে নিয়ে যায় জঙ্গলে। কোনওরকমে একটা রাত কাটিয়ে পরদিন সকালেই ঠিক করলাম, আগে এর একটা বিহিত করতে হবে। হিরের খোঁজ হবে পরে।

‘দিনের বেলা রোদ উঠল চড়া। দেখি, দূরে একটা বিশাল গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ক্যাঙ্গো একটা মেঠো ইঁদুরের ঘাড় মটকে খাচ্ছে। আর এদিকে বান্টুরাও তাদের রান্নার আয়োজন শুরু করে দিয়েছে। ওদের তো রান্না বলতে হয় সেদ্ধ না হয় পোড়া। সুতরাং সেরকমই গন্ধ ভাসছে বাতাসে। আমি খোলা জমিতে দাঁড়িয়ে এক্সাইজ করছিলাম— ‘

মৌ ফিক করে হেসে বলল, ‘কাকু, এক্সাইজ নয়—এক্সারসাইজ।’

বিশ্বকাকু হাত নেড়ে মৌয়ের কথা একরকম উড়িয়ে দিয়েই বলল, ‘এক্সাইজ কথাটাও এমন মারাত্মক কিছু ভুল নয়, বহু লোকে বলে। যাকগে, তারপর কী হল বলি। আমি তো ব্যায়াম করছি, হঠাৎ দেখি একটা বেঁটে আদিবাসী চারটে মেঠো ইঁদুর লেজ ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একেবারে জ্যান্ত ইঁদুর! তক্ষুনি আমার মাথায় একটা আইডিয়া খেলে গেল। জলদি আমাদের ইন্টাপিটার, মানে দোভাষীকে ডাকলাম…।’

বাবান গম্ভীরভাবে বলল, ‘ইন্টাপিটার নয়, ইন্টারপ্রিটার—।’

‘আবার তুই গুরুজনের ভুল ধরছিস?’ বিশ্বকাকু চোখ বড় করে তাকাল। বাবান কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘কী করব, কাকু, গুরুজনে বললেই কি ভুলটা ঠিক হয়ে যাবে? এই হয়েছে ছোটদের বিপদ!’

বিশ্বকাকু বলল, ‘তোর ওসব পাকা-পাকা কথা বাদ দে তো। এখন কাজের কথা শোন। আমার মাথায় তক্ষুনি যে-আইডিয়াটা এল তা একেবারে নোবেলজয়ী আইডিয়া। দোভাষী ছুটতে ছুটতে এল আমার কাছে। তখন তাকে আমি বললাম যে, ওইরকম জ্যান্ত মেঠো ইঁদুর আমার অন্তত একডজন চাই। দোভাষী বলল, এ আর বেশি কথা কী! ওদের কেউ-কেউ ইঁদুরের রোস্ট পছন্দ করে, তাই ইঁদুর প্রায়ই ওদের ধরতে হয়। সে যাই হোক, লোকটা সব ব্যবস্থা করে দিতেই আমার কাজ শুরু হল, ভিমরুল সাইজের মশাগুলো যথারীতি ভনভন আওয়াজ তুলে ঘুরছে আর কটাস-কটাস করে কামড়াচ্ছে। আমি মনে-মনে বললাম, জায়ারের মশা যদি নির্বংশ করতে না পারি তো আমারও নাম নেই। কলকাতার বাঙালির সঙ্গে টক্কর দেবে আফ্রিকার জংলি মচ্ছর!

‘আমার দলের লোকজন সব তো অবাক হয়ে গেল। ভাবল, লোকটা ঘরের ভেতরে উনুন তৈরি করে দিনরাত্তির করছে কী? এমনকী ক্যাঙ্গোও আমার পরীক্ষাগারের বাইরে লাগাতার ঘুরঘুর করতে লাগল আর কালোয়াতি ডাক ছাড়তে লাগল। কিন্তু আমি নট নড়নচড়ন—একেবারে স্টেডি রিসার্চ। ছোটবেলা থেকে যত কেমিস্ট্রি পড়েছিলাম সব লড়িয়ে দিলাম মশক নিধন সাধনায়। অ্যারোম্যাটিক কম্পাউন্ডের নাম শুনেছিস? সেইসব বিদ্যেও খুব কাজে লেগে গেল। এইভাবে সাতদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমে ফল পাওয়া গেল। সাকসেসফুল হলাম। দলের অভিযাত্রীদের বললাম, “ভায়া, হিরে তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না! কিন্তু হিরে তোলার আগেই মশা যদি আমাদের পটল তুলতে বাধ্য করে তাহলে আর অভিযানে এগিয়ে লাভ কী? কঙ্গো নদী পেরোনোর বদলে সোজা বৈতরণী পেরিয়ে গুডবাই করে দিতে হবে সবাইকে। এই দ্যাখো, আমার এই রিসার্চ পৃথিবী থেকে মশা একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। তখন একটা বাচ্চা ছেলেও আফ্রিকা-অভিযানে নির্ভয়ে এগোতে পারবে। সুতরাং, আগে মসকুইটো, পিছে ডায়মন্ড।”

‘অভিনব রিসার্চের যুগান্তকারী ফল প্রয়োগ করলাম আটদিনের মাথায়। ব্যস, অ্যাপ্লিকেশন করা মাত্রই অ্যাকশন হাতেনাতে। এই দ্যাখ—।’

বলে বিশ্বকাকু জামার আস্তিন গুটিয়ে কয়েকটা পুরোনো কাটা দাগ দেখাল। এই দাগগুলো বাবান-মৌ আগেও দেখেছে। কখনও ছুরিধারী গুণ্ডার আক্রমণে এই ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল, কখনও এর কারণ ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বোমার স্প্লিন্টার, আর কখনও বা ভিসুভিয়াসের জ্বালামুখ দিয়ে দড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে এই কাটাছেঁড়ার দাগ তৈরি হয়েছে।

বাবান বলল, ‘মশা তাড়ানোর রিসার্চের সঙ্গে তোমার হাত কাটার কী সম্পর্ক?’

বিশ্বকাকু বিজ্ঞের মতো হাত নেড়ে বলল, ‘আছে, আছে। ওখানে শুধু আমার নয়, সকলেরই কমবেশি চোট লেগেছিল। আর ওই হুলস্থুল কাণ্ডকারখানার জন্যেই তো শেষ পর্যন্ত হিরে উঠল মাথায়, আর চাচা আপন প্রাণ বাঁচা বলে আমরাও নৌকো বেয়ে পগারপার।

মৌ অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, ‘কিন্তু এই যে বললে রিসার্চ! সাকসেসফুল হয়েছিল—।’

বিশ্বকাকু ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘হ্যাঁ, হয়েছিল রে, বড্ড বেশি সাকসেসফুল হয়ে গিয়েছিল আমার রিসার্চ। যাকগে, শোন। আটদিনের মাথায় আমার যুগান্তকারী ওষুধ স্প্রে করে প্রয়োগ করলাম ওই গাঁয়ে। তারপরই সবাই লক্ষ করল, কোথা থেকে যেন তিরের বেগে ছুটে এল ক্যাঙ্গো। আর এসেই ঝপাঝপ ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল ভিমরুল সাইজের মশাগুলোর ওপরে, আর কপাকপ ধরে গিলতে লাগল। তারপর দেখতে-দেখতে ওখানে এসে হাজির হয়ে গেল অন্তত আট-ন’টা ক্যাঙ্গোর মতো সার্ভাল। আর ওরা সবাই মিলে যাবতীয় মশা কপাকপ গিলে ফেলতে লাগল। সব মিলিয়ে সে এক হইহই দৃশ্য।’

‘তখন গাঁয়ের সবাই তো মহাখুশি। মশার কামড়ে আর কাউকে কষ্ট পেতে হবে না। এমন সময় আমাদের দলের এক ইয়াং তেলুগু ছোকরা আমাকে এসে একেবারে ধরে পড়ল। বলল, “দাদা, এই মন্ত্রগুপ্তি আমাকে বাতলে দিতেই হবে। এই ওষুধে আমাদের রাজ্যে একেবারে তোলপাড় হয়ে যাবে।” বেচারার কষ্ট দেখে নিমরাজি হলাম। হয়ে ওকে ফর্মুলা বাতলে দিলাম।’

বাবান একেবারে মুখিয়ে ছিল, বলল, ‘কী সেই ফর্মুলা, কাকু?’

বিশ্বকাকু হেসে বলল, ‘মূষিক তৈল, বুঝলি! ওই যে একডজন মেঠো ইঁদুর আমাকে দিয়েছিল, ওগুলোর বডি থেকে ইঁদুরের গন্ধের একটা তেল তৈরি করেছিলাম আমি। কার্বন আর হাইড্রোজেনের তৈরি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটা অ্যারোম্যাটিক কম্পাউন্ড। অর্থাৎ, সোজা কথায় একটা স্পেশাল সেন্ট—আমি তার নাম দিয়েছিলাম মূষিকসুবাস। তার ফর্মুলাটা বড় জটিল—তোরা কি বুঝতে পারবি? কার্বন আর হাইড্রোজেনের পরমাণুতে একেবারে কিলবিল করছে। তো, সেই ইঁদুরের সেন্টে একেবারে লক্ষ্যভেদ হয়ে গেল। ওই এলাকার মশা একেবারে বেড়ালের পেটে সাবাড়। কিন্তু শেষমেষ বিপদও হল একটা।’

‘কী বিপদ?’ মৌ জিগ্যেস করল।

‘ওই সেই গন্ধের বিপদ। ক্যাঙ্গো যে কেন আমার পরীক্ষাগারের বাইরে সবসময় ঘুরঘুর করত এবারে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস। তা ক্যাঙ্গো আর তার দলবল তো মশার বংশ নির্বংশ করে দিল, কিন্তু তারপরই ওরা আমাদের আক্রমণ করল। ওই যে আমরা মশা মারার মূষিক তেল চারদিকে স্প্রে করেছিলাম সেটাই আমাদের কাল হল। সেন্টটা ছিল মারাত্মক রকমের পাওয়ারফুল।

‘তার একটা অণু কোনও ফ্লাইং মশার বড়িতে কোনওরকমে ল্যান্ড করলেই হল। ওই মশার গা থেকে টানা আটচল্লিশ ঘণ্টা মেঠো ইঁদুরের ফ্লেভার বেরোবে। তখন ক্যাঙ্গো বা তার কোনও জাতভাই মশাটাকে একেবারে চিকেন বিরিয়ানির মতো সাবড়ে দেবে। তো হয়েছিল কি, স্প্রে করার সময় ওই সেন্টের বেশ কিছু অণু আমাদের গায়েও লেপটে গিয়েছিল। মশার দল খতম হয়ে যেতেই বেড়ালগুলো আমাদের গা থেকে ওই একই সেন্টের গন্ধ টের পেতে লাগল। প্রথম-প্রথম আমাদের অ্যাটাক করতে ভয় পেলেও শেষের দিকে ওরা গন্ধে পাগল হয়ে উঠল। নিজেদের আর কন্ট্রোলে রাখতে পারল না। ইঁদুরের মনমাতানো গন্ধের টানে পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল আমাদের ওপরে। আঁচড়ে কামড়ে একেবারে প্রাণান্ত করে তুলল। তখন আমরা কোনওরকমে জান বাঁচিয়ে দিলাম পিঠটান।’

বিশ্বকাকু দম ছেড়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসল। বলল, ‘এখনও শুঁকলে আমার গায়ে বোধহয় মূষিক সেন্টের গন্ধ পাবি। দেখলি না, তোদের গৌতম কেমন বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছিল।’

বাবান বলল, ‘কাকু, ওই সেন্টের ফর্মুলাটা বলো না, আমি লিখে নেব।’ বিশ্বকাকু বলল, ‘সে আমার ডায়েরিতে বোধহয় টোকা আছে। শুধু এটুকু মনে আছে, ওই সেন্টের এক-একটা অণুতে ছত্রিশটা করে কার্বন পরমাণু ছিল। আর কী পাওয়ারফুল! বারো বছরেও গন্ধ পুরোপুরি যায়নি।’

এ-কথা বলতে না বলতেই গৌতম কোত্থেকে ছুটে এসে এক লাফে বিশ্বকাকুর কোলে উঠে বসল। আর বিশ্বকাকু ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে বলল, “দেখলি, দেখলি, যা বললাম হাতে-নাতে প্রমাণ হল কি না!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *