মর্মবেদনার ছবি
লেক মার্কেটে নাকি অন্য বাজারের চেয়ে ভালো মাছ পাওয়া যায়। যত সব বাজে কথা! এক একজন আছে, নিজের পাড়াটাকে সব ব্যাপারে বড়ো করে দেখাতে চায়। মর্নিং ওয়াকের সময় রোজ রোজ ধরণিধরের কাছে লেক মার্কেটের নানান গুণপনার কথা শুনে কিশোর আজ গিয়েছিলেন সেখানে। গিয়ে দেখেন কীসের কী। মাছের বদলে মাছির দৌরাত্মই বেশি। পড়ে আছে কিছু আড় মাছ আর বড়ো বড়ো নোনাজলের ভেটকি, যার কোনো স্বাদ নেই।
মনঃক্ষুণ্ণভাবে বাজার সারলেন কিশোর। এর মধ্যে অনেকবার ধরণিধরের মুণ্ডুপাত করা হয়েছে। জগুবাবুর বাজার এর চেয়ে অনেক ভালো, সেখানে দোকানিরা সবাই চেনা, কেউ খারাপ জিনিস দেয় না। কিশোর ঠিক করে ফেলেছেন, আর কোনোদিন পরের কথায় নাচবেন না। জীবনের আর যে-কটা দিন বাকি আছে, নতুন করে আর অচেনা লোকের সঙ্গে সম্পর্ক পাতাবার দরকার নেই। মানুষের জীবনের একটা সময়ে গণ্ডিটা ছোটো হয়ে আসে, তখন অল্প কয়েকজনকে নিয়েই খুশি থাকতে হয়। যাক, এই একটা শিক্ষা হল আজ।
ফলের দোকানগুলোর পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ একটা ঝুড়ির দিকে চোখ পড়ল। দোকানের বাইরে রাখা আছে ঝুড়িটা, তাতে ভরতি কামরাঙা ফল।
কিশোর থমকে দাঁড়ালেন। মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলেন কামরাঙাগুলোকে। তারপর নীচু হয়ে একটা তুলে নিলেন হাতে। ঠান্ডা সবুজ রঙের কামরাঙা ছুঁয়ে তাঁর হাতের অদ্ভুত আরাম হল। সেই মুহূর্তে তিনি অনুভব করলেন যে, ঠিক পঁয়ত্রিশ কিংবা তারও বেশি, বোধহয় চল্লিশ বছর বাদে তিনি কামরাঙা ফল হাতে ছুঁচ্ছেন। একটা চেনা জিনিস জীবনে এতদিন বাদ ছিল?
কোনোদিনই কিশোর কামরাঙা কেনেননি। তাই দাম সম্পর্কে তাঁর কোনো ধারণা নেই। এ দেশে কামরাঙা দুর্লভ জিনিস নিশ্চয়ই, নইলে এতদিন চোখে পড়েনি কেন?
এগুলো কত করে?
দোকানদারটিও বেশ বয়স্ক। গোঁফটি পুরো পাকা। বেশ ভরাট মুখ। দৃষ্টিতে গাম্ভীর্য আছে।
আশি পয়সা জোড়া। তিনটে এক টাকা।
কিশোর খুশি হলেন। বেশ সস্তাই বলতে হবে। পাঁচ টাকা জোড়া শুনলেও তিনি আশ্চর্য হতেন না। মনে মনে হিসেব করে তিনি বললেন, আচ্ছা, তা হলে নটা দিন।
নটা শুনে দোকানদারটি বিস্মিতভাবে তাকালেন কিশোরের দিকে। তারপর কিছু যেন বুঝতে পেরে হাসলেন। কিশোরের সঙ্গে তার একটা সমমর্মিতা স্থাপিত হল। তিনি বললেন, ন্যান, আপনে দশটাই ন্যান, তিন টাকা দেবেন।
বেশ মন দিয়ে বেছে বেছে একটা একটা তুলতে লাগলেন কিশোর। কয়েকটা আছে আধপাকা, কিন্তু সেই রং কিশোরের পছন্দ নয়। স্বচ্ছ সবুজ রঙটাই চোখকে স্নিগ্ধ করে। পাকা কামরাঙা কিশোর কখনো দেখেছেন কি না ঠিক মনে করতে পারলেন না। এগুলো বেশ ভালো জাতের, পাঁচটা শিরাই বেশ উন্নত।
মাছের ব্যাপারের দুঃখটা ভুলে গিয়ে তাঁর মন প্রফুল্ল হয়ে গেল। একটা নতুন জিনিস, বাড়ির সবাই অবাক হবে। ট্রাম ধরে তিনি চলে এলেন ভবানীপুরে।
ওপরের বারান্দা থেকে সুনন্দা তাঁকে দেখতে পেয়ে বললেন, দাঁড়াও কানাইকে পাঠাচ্ছি।
কিছুদিন আগে হৃৎপিণ্ডে একটা ছোট্ট খোঁচা লেগেছিল বলে ডাক্তার তাঁকে ভারী জিনিস বইতে বারণ করেছেন। কিন্তু কিশোর সব সময় সে নির্দেশ মানেন না। বাজার করা তাঁর বরাবরের অভ্যেস, এটা তিনি কিছুতেই ছাড়তে পারবেন না। সুনন্দা কানাইকে সঙ্গে দিতে চান, তাও কিশোরের পছন্দ নয়। বাজারে তিনি নানা রকম রঙ্গ-রসিকতা করেন, চাকর সঙ্গে থাকলে কি তা চলে?
কানাই আসবার আগেই তিনি দুটো থলে নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন। রিটায়ার করার পর শরীরটা একটু ভাঙলেও মনের জোর আছে যথেষ্ট। তিনতলায় উঠতে একটু হাঁপ ধরে গেলেও সুনন্দার সামনে সেটা গোপন করে গেলেন।
সুনন্দার হাতে তোয়ালে, এক্ষুনি বাথরুমে ঢুকলেন। এটা কিশোরের পছন্দ নয়। কানাই রান্না করে, সেই সব জিনিস গুছিয়ে রাখে, তবু বাজার এলে বাড়ির গিন্নি একবার তা দেখবে না? সুনন্দার এসব ব্যাপারে আগ্রহই নেই। কিশোর যে কত খুঁজে খুঁজে অসময়ে এঁচোড় কিংবা কাঁচা আম নিয়ে আসেন, সুনন্দা তা খেয়ালও করেন না। বাড়িতে কোনো গুণগ্রাহী না থাকলে বাজার করার আনন্দ নেই। কিশোরের মনে আছে, বাবা বাজার করে ফিরলেই মা সব কিছু ঢেলে ফেলতেন রান্নাঘরের সামনে, প্রত্যেকটি জিনিস সম্পর্কে মন্তব্য করতেন। বাবার ভুল ধরতেন। যেমন পুঁইশাক আনলে কুমড়োও আনতে হয়, কই মাছের দিনে ফুলকপি না আনলে চলে না, শোল মাছের সঙ্গে মুলো চাই আর পাবদা মাছের সঙ্গে বড়ি।
বাথরুমের দিকে যেতে যেতে একটা উড়ো দৃষ্টি দিয়ে সুনন্দা জিজ্ঞেস করলেন, ওগুলো কী?
কৃতার্থ হয়ে গিয়ে কিশোর এক গাল হেসে বললেন, কামরাঙা। তুমি চেনো না? সুনন্দা বললেন, চিনবো না কেন? কিন্তু অতগুলো—কী হবে ওগুলো দিয়ে?
খাবে। সবাই মিলে খাবে। রেয়ার জিনিস। আচ্ছা তুমি মনে করে দ্যাখো, এই যে আমরা কতলোকের বাড়িতে যাই, কোনো দিন, কারুর বাড়িতে তুমি কামরাঙা খেতে দেখেছ? কেউ তোমায় অফার করেছে? তাহলেই বুঝতে পারছো, এরকম একটা ভালো জিনিস চট করে পাওয়া যায় না।
সুনন্দা প্রশ্রয়ের হাসি হাসলেন।
মা বাবা শখ করে এঁর নাম দিয়েছিলেন কিশোর। তখন খেয়াল করেননি, তাঁদের ছেলে একদিন প্রৌঢ় ও বৃদ্ধ হবে, তখন এই নামটা কত বেমানান হবে। অবশ্য এই প্রসঙ্গ উঠলেই কিশোর বলেন, কেন, বোম্বাইতে এই নামে আমার চেয়েও অনেক বুড়ো বুড়ো লোক আছে।
বয়েস প্রায় বাষট্টি হলেও কিশোরের মনের মধ্যে একটা ছেলেমানুষির ভাব রয়ে গেছে এখনো। নানান ছোটোখাটো জিনিস থেকে আনন্দ পান। বাজার থেকে এক একদিন এক একটা অদ্ভুত জিনিস এনে মহা উৎসাহ দেখান, যেমন একদিন নিয়ে এলেন ঢেঁকি শাক, খুবই নাকি অপূর্ব ব্যাপার। কিন্তু কিশোর ছাড়া সেই শাক আর কেউ খেতে চায়নি।
কামরাঙার ব্যাপারেও প্রায় তাই হল।
দুই মেয়ে মিলি আর জুলি, এক জনের বয়েস তেইশ, অন্য জনের বয়েস একুশ। ওরা কেউ বাড়িতে শাড়ি পরে না, অন্তত সকালের দিকটা ঢোলা হাউসকোট পরেই কাটিয়ে দেয়।
পড়ার ঘর থেকে দুই মেয়েকে ডেকে আনলেন কিশোর। বেছে বেছে সব চেয়ে বড়ো দুটি কামরাঙা তাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, দ্যাখ, খেয়ে দ্যাখ, কোনোদিন তো খাসনি।
দুজনেই গভীর সন্দেহের চোখে ফল দুটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল।
জুলি বলল, এটা কী?
কিশোর রহস্য করে বললেন, কী বল তো? কখনো দেখিসনি তো?
মিলি বলল, আমি দেখেছি। একবার শান্তিনিকেতনে একটা বাড়িতে দিয়েছিল।
কামরাঙা না কী যেন নাম?
কিশোর একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়ে বললেন, শান্তিনিকেতন? সেখানে পাওয়া যায়? আশ্চর্য! এসব আমাদের পূর্ববঙ্গের ফল, আমরা ছেলেবেলায় কত—
এখন খেতে ইচ্ছে করছে না, বাবা।
খেয়ে দ্যাখ না! খেয়ে দ্যাখ না! একটা ফল খাবি।
একটু আগে চা খেয়েছি!
তাতে কী হয়েছে? চা খাবার পর অন্য কিছু খেতে নেই?
পরে খাবো। বিকেলে খাবো।
দুই বোনের মধ্যে ছোটোজনের ব্যক্তিত্ব বেশি। সে কামরাঙাটা রেখে দিল ফ্রিজের মাথায় বেতের ঝুড়িতে। মিলি এখনও সেটা হাতে ধরে আছে।
কিশোর ভাবলেন, শহরে মানুষ হবার এই দোষ। কোনো নতুন জিনিস খেতে চায় না, খাবার নিয়ে পরীক্ষা করতেও চায় না। ধরা-বাঁধা কয়েকটা জিনিস খেয়ে গেলেই হল। গ্রামে যারা মানুষ হয়, তারা নিত্যনতুন কত কিছু আবিষ্কার করে। কতরকম ফল তিনি খেয়েছেন ছেলেবেলায়। ডউয়া বলে একটা ফলের কথা তিনি কারুকে বোঝাতেই পারেননি। কেউ কেউ ডউয়া দেখেনি, নামও শোনেনি। এখানকার বাজারে ওঠেই না। অথচ কী চমৎকার স্বাদ ডউয়ার। শহরের ছেলেমেয়েরা আপেল খায়, আর আপেল জিনিসটা কিশোরের অখাদ্য লাগে। ঠিক মনে হয় রুগির পথ্য। তিনি ক্ষীণ অভিমানের সুরে বললেন, খাবি না?
মিলি তার বাবার এই অভিমানটুকুর মূল্য দেয়। সে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, আচ্ছা, আমি খাচ্ছি। একটা কামড় দিয়েই সে বলল, ও মা গো! ভীষণ টক।
কিশোর বললেন, টক তো হবেই। কামরাঙা টক হবে না? তবে কী রকম অন্যরকম টক সেটা বল? কাঁচা আম কিংবা তেঁতুল কিংবা পাতিলেবু কিংবা চালতা—কোনো কিছুর সঙ্গেই মিল নেই। কামরাঙার টক স্বাদটা একেবারে নিজস্ব। সেইটাই তো এর মজা। এই দ্যাখ, আমি খাচ্ছি।
কিশোর একটা কামরাঙাকে ঠিক মাউথ অর্গানের মতন মুখের সামনে ধরে সযত্নে একটি কামড় বসালেন।
মিলি বলল, না, বাবা, তুমি খাবে না। তোমার না অ্যাসিডিটি। এত টক খেলে—
কিশোর বললেন, কিচ্ছু হবে না। ফেভারিট জিনিস খেলে কখনো শরীর খারাপ হয় না।
কামরাঙা তোমার ফেভারিট। আগে কোনোদিন খেতে দেখিনি তো।
তোদের জন্মের আগে…
ছোটো ছেলে বাবুসোনা ছাদে খেলছিল। এই সময় সে জল খেতে নীচে এল। কিশোর খুব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, এই, তুই খাবি! এই দ্যাখ কামরাঙা, কোনোদিন খাসনি, খেয়ে দ্যাখ।
বাবা ও দিদিদের পারিবারিক দৃশ্যটি বাবুসোনা এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল, কারণ, তার হাতে এখন একটুও সময় নেই।
তবু বাবার কথা শুনে সে সবুজ রঙের পাঁচকোনা জিনিসটা হাতে নিয়ে কিছুই না দেখে ঘ্যাঁক করে এক কামড় দিল। সঙ্গে-সঙ্গে মুখটা কুঁচকে বলল, এঃ, বাজে!
কামরাঙাটা সে ছুঁড়ে ফেলে দিতে যাচ্ছিল, কিশোর দুহাত তুলে বললেন, ফেলবি না, ফেলবি না, আমাকে দে। একটি বিস্মিত দৃষ্টি সম্মত এঁটো ফলটি বাবার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে আবার দৌড়ে চলে গেল বাবুসোনা।
মিলি বলল, বাবা তোমার এ জিনিস চলবে না।
এরই মধ্যে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন সুনন্দা। তিনি স্বামীর প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে মেয়েদের বললেন, তোরা ওগুলো নষ্ট করিস না, রেখে দে। কানাইকে বলবো চাটনি করে দিতে। কিশোর প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, চাটনি। কক্ষনো না। সুনন্দা বললেন, কেন?
কামরাঙা কখনও রান্না করতে নেই।
রান্না করতে নেই, তার মানে?
অনেক ফল আছে, যা রান্না করা চলে না। যেমন আমলকী, পেয়ারা, বেল, কামরাঙা…
সুনন্দা বললেন, কেন, বেলের মোরববা হয় না?
মিলি বলল, পেয়ারার জেলি হয়।
কিশোর বিরক্তভাবে বললেন, ওসব এদেশে হয়—
সুনন্দা বললেন, তোমার বাঙাল দেশের কথা ছাড়ো তো। টক জিনিস দিয়ে ভালো চাটনি হবে।
কিশোর দুঃখ পেলেন। তিনি কোনোদিন কামরাঙার চাটনি খাননি। আর খেতেও চান না। নিজের হাতের কামরাঙাটা তিনি খেতে খেতে, আর একটিও কথা না বলে বারান্দার দিকে চলে গেলেন।
এত টক জিনিস তিনি আর খেতে পারেন না, লেবুর রস খেলেও পেট জ্বালা করে, তবু তিনি কামরাঙাটা ফেলবেন না, যেমন করেই হোক শেষ করবেনই।
এখন বারান্দায় ইজিচেয়ারে বসে তাঁর প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে কাগজ পড়ার সময়। তিনখানা কাগজ তন্নতন্ন করে পড়া চাই। যত রোদ বাড়বে, তত চেয়ারটা টেনে টেনে সরিয়ে নিতে হবে ছায়ায়!
একটু নুন পেলে ভালো হত, কিন্তু নুন চাওয়া মানেই পরাজয়। আশ্চর্য, আজকাল অল্প বয়েসি ছেলেমেয়েরা টক খেতে ভালোবাসে না। অথচ তাঁদের ছেলেবেলায় টক জিনিসগুলোই ছিল ছোটোদের সবচেয়ে প্রিয়। নুন দিয়ে কাঁচা আম মেখে খাওয়া, তারপর চালতা, করমচা। দিশি আমড়া, কাঁচা তেঁতুল…
টুসটুসে কামরাঙার রস গড়িয়ে পড়ল তাঁর জামায়। পাঁচটা দিক খাওয়া হয়ে যাবার পর মাঝখানটা চুষলেন খানিকক্ষণ, তারপর ভেজা হাতটাও তিনি পরম সন্তোষে তাঁর ধুতিতে মুছলেন।
তারপর চোখের সামনে লম্বা করে মেলে করলেন ইংরেজি কাগজটা। হেড লাইন কয়েকটা দেখতে না দেখতেই তাঁর মন উধাও হয়ে গেল। তিনি আর অক্ষর দেখছেন না। তিনি সবুজ রঙের ছবি দেখছেন।
দুটো গাছ ছিল। বেশি বড়ো নয়, তবে অনেক ডালপালা, পাতাগুলো মিহিন। কামরাঙা ফুল কী রকম যেন হয়? মনে পড়ছে না। আশ্চর্য, কেন মনে পড়ছে না। সাদা নয়? করমচার ফুল সাদা, আমড়ার সাদা।
একটা গাছ ছিল দত্ত বাড়ির পেছনে, আর একটা ওদেরই পুকুরে যাবার পথে। কিশোর দ্বিতীয় গাছটির পাশে এসে দাঁড়ালেন। স্পষ্ট মনে আছে, তিনি এই গাছটার ওপরের ডালগুলোর নাগাল পেতেন না। লাফিয়ে লাফিয়ে ফল পাড়তে হল। কিন্তু এখন তিনি নাগাল পাচ্ছেন, তাঁর বাষট্টি বছরের শরীরটি ওই গাছটার প্রায় সমান। কিন্তু এরকম হচ্ছে কেন? তাঁর সেই ছেলেবেলার চেহারাটা কোথায়? সতেরো-আঠারো বছর বয়েস, কী রকম দেখতে ছিলেন তিনি তখন? কই মনে পড়ছে না তো! পুকুর ধার থেকে হেঁটে আসছেন বেণুদি। বাইশ-তেইশ বছর বয়েস, ঠিক সেদিনকার চেহারা। বেণুদির এক মাথা চুল। দুর্গা ঠাকুরের মতন মুখ, চোখ দুটিতে সব সময় অবাক-অবাক ভাব। কামরাঙা গাছটার পাশে একজন বৃদ্ধকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেণুদি মুখটা নীচু করে চলে গেলেন। তাঁর দু-হাতে এক গাদা ভিজে কাপড়।
প্রায় হাহাকার গলায় কিশোর বললেন, বেণুদি, বেণুদি, আমার চিনতে পারছেন না? আমি কিশোর! আমি চ্যাটার্জিদের বাড়ির কিশোর!
বেণুদি শুনলেন না, মুখও ফেরালেন না।
একটা শব্দ পেয়ে কিশোর মুখের সামনে থেকে খবরের কাগজটা সরালেন। তাঁর বড়ো মেয়ে মিলি।
কিশোর মনে মনে হিসেব করে দেখলেন, সেই সময়ে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগে বেণুদিও তো মিলির বয়েসিই ছিল। অথচ, মিলি তো একটা বাচ্চা মেয়ে, হাবভাবে কত ছেলেমানুষ, কিন্তু বেণুদিকে কত বড়ো মনে হত। চেহারায়, ব্যবহারে পরিপূর্ণ এক নারী। তিনি মিলির দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইলেন।
মিলি এসব লক্ষ করল না, সে রেলিং দিয়ে উঁকি মেরে কী যেন দেখতে লাগল। কাগজের দিকে চোখ ফিরিয়েও কিশোর আর সেই কামরাঙা গাছটার ছবি ফিরিয়ে আনতে পারলেন না। মিলির উপস্থিতির জন্যই এরকম হচ্ছে? নিজের ছেলেমেয়ের কাছে নিজেকে সব সময় বয়স্ক বাবা মনে হয়। যদিও একথা স্বীকার করতে নিজের কাছে অন্তত বাধ্য যে মিলির বয়েসি অন্য কোনো মেয়ে দেখলে তিনি বেশ একটা সুখের উত্তেজনা বোধ করেন।
বেণুদি তাঁর চেয়ে বয়েসে চার পাঁচ বছরের বড়ো ছিলেন। গ্রামে ওই বয়সি সব মেয়েরই বিয়ে হয়ে যায়, বেণুদির হয়নি। কেউ কেউ যেন বলতো, অল্প বয়েসেই বেণুদি এক জায়গায় বিয়ের সব ঠিকঠাক হবার পর ভেঙে গিয়েছিল। বেণুদির ছোটো বোন রেণু কিশোরের চেয়ে এক বছরে ছোটো, কিন্তু রেণুর কথা মনে নেই। রেণু নয়, বেণুদিকে দেখলেই কিশোর যখন সত্যিকারের কিশোর ছিলেন, তখন বুক কাঁপত।
কী দেখছিস রে মিলি?
সুরঞ্জন আসবে বলেছিল নটার সময়। এখনো এল না। মহা ক্যাবলা ছেলে। কিছুতেই কথার ঠিক রাখতে পারে না।
সুরঞ্জন কি তোর বন্ধু? আমি তো ভেবেছিলুম জুলির।
জুলিরও বন্ধু না, আমারও বন্ধু না। সুরঞ্জন হল আমাদের জিপ গাড়ি! যখন ইচ্ছে ওকে নিয়ে যেখানে খুশি যাওয়া যায়।
কী অদ্ভুত কথা তোদের।
তোমরা এসব বুঝবে না।
কেন বুঝবো না রে?
তোমাদের আমলে তো ছেলে-মেয়েদের মেলামেশা ছিল না। ওই যে, সুরঞ্জন এসে গেছে—
কিশোরকে প্রতিবাদ করার সুযোগ না দিয়েই মিলি ছুটে চলে গেল।
কিশোর মনে মনে বললেন, তোরা কি আমাদের গত শতাব্দীর মানুষ ভাবিস। কে বললে মেলামেশা ছিল না? আমাদের পূর্ব বাংলার গ্রামে…কই পথে দাঁড়িয়েও মেয়েদের সঙ্গে কথা বলার বাধা ছিল না তো? মেয়েরাও বন্দি থাকত না ঘরের মধ্যে। এ বাড়ি ও বাড়ি যাতায়াত করত। ওরে মিলি, তোরা কী বুঝবি, তখন অনেক ভালো ব্যাপার ছিল, গ্রামের প্রত্যেকটির সুন্দরী মেয়েরই একজন দুজন প্রেমিক থাকত, জাতের মিল না হলে বিয়ে হতে পারতো না বটে, কিন্তু প্রেম কি কেউ আটকাতে পারত? প্রেমের পর বিরহ আর সারাজীবন তার মধুর স্মৃতি।
হ্যাঁ, আমারও ছিল একজন প্রেমিকা, চৌধুরীদের বাড়ির মাধুরী এখন সে লখনউতে থাকে। তোরা দেখিসনি তো তাকে, এখনও তোদের মায়ের চেয়েও অনেক সুন্দরী।
কিশোর এবারে দেখতে পেলেন চৌধুরী বাড়িটি। পাকা বাড়ি, দোতলা। তাদের গ্রামের সবচেয়ে ঝকঝকে বাড়ি। ডান পাশের দিঘিটি পদ্মপাতায় ভরা। সেই দিঘির ঘাটটায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে তিনটি ছেলে মেয়ে। তার মধ্যে গোলাপি রিবন বাঁধাটিই মাধুরী না? কত বয়েস, বড়ো জোর ন-দশ? এর থেকে অনেক বড়ো বয়সেও তো মাধুরীকে দেখেছেন কিশোর। মাধুরীর সেই চেহারা কোথায়?
চৌধুরীদের বাড়ির প্রতিটি ঘর মনে আছে কিশোরের। কিন্তু কোনো ঘরেই তিনি বড়ো বয়সের মাধুরীকে খুঁজে পাচ্ছেন না। এ যেন ফ্রেমটি রয়েছে অটুট, ভিতরে ছবিটি নেই। এতো বড়ো অস্বস্তি।
সিনেমার দৃশ্যান্তরের মতন আবার কামরাঙা গাছটির ছবি ফিরে এল। পুকুর ঘাট থেকে আসছেন বেণুদি। একেবারে পরিষ্কার, জীবন্ত। ভিজে কাপড়ে তাঁর শরীরের প্রত্যেকটি রেখা স্পষ্ট, ঠিক যেন কুমোরের তৈরি নিখুঁত কোনো মূর্তি, দেখলে এখনো মাথা ঘুরে যায়।
বেণুদি, বেণুদি, চিনতে পারছেন না, আমি কিশোর?
পাশেই একটা সুপুরি গাছ, তার আড়ালে নিজেকে ঢাকা দিয়ে বেণুদি থমকে দাঁড়ালেন, তারপর কিশোরের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেখে নিয়ে বললেন, কে, ধীরেনকাকা? আপনি এখানে?
ছবিটা আবার খবরের কাগজ হয়ে গেল। কিশোরের বুকে যেন আঘাত করেছে। বেণুদি চিনতে পারলেন না। বেণুদি তাঁকে ধীরেনকাকা ভাবলেন? ধীরেন তো ছিলেন কিশোরের জ্যাঠামশাই, কত বছর আগে মারা গেছেন। কিশোরকে কি ধীরেন জ্যাঠামশাইয়ের মতন দেখতে হয়েছে এখন? আগে কেউ বলেনি তো এরকম কথা।
ধীরেন জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে বেণুদির বাবার কী নিয়ে যেন একটা ঝগড়া ছিল। তাই তিনি এ বাড়িতে যেতেন না। সেই জন্যই বেণুদি অবাক হয়েছেন।
কাগজটা হাত থেকে পড়ে গেল কিশোরের। তিনি অন্য একটা কাগজ তুলে নিলেন। নিজের সতেরো-আঠারো বছরের চেহারাটা দেখতে পাচ্ছেন না বলে মন খারাপ লাগছে! পুরনো স্মৃতিতে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে একটা মাদকতা আছে, কিন্তু সেখানে তাঁর এই বুড়ো বয়েসের শরীরটা নিয়ে উপস্থিত হচ্ছে কেন?
মিলি এসে জিজ্ঞেস করল, বাবা, তুমি চা খাবে? কিশোর মুখ না ফিরিয়েই বলল, হঠাৎ এত দয়া?
সুরঞ্জন চা খেতে চাইছে। মায়ের এখন স্কুলে যাবার তাড়া, চা করতে বললেই কানাই চ্যাঁচাবে। তবু তোমার নাম করলে যদি দেয়।
বেশ, তাহলে বলো আমার নাম করে।
থ্যাঙ্ক ইউ। থ্যাঙ্ক ইউ, বাবা।
শোন মিলি, সুরঞ্জন যদি তোদের জিপ গাড়ি হয়, তাহলে আমি তোদের কী হলুম রে।
তুমি হচ্ছে আমাদের গুড ওল্ড ম্যান, তোমার সঙ্গে কার তুলনা।
সব সময় বুড়ো বুড়ো করিস, জানিস বাষট্টি বছর বয়েসে অনেকে নতুন করে…
ওল্ড ম্যান মানে বুড়ো নাকি? ওল্ড ম্যান মানে বাবা। কে তোমায় বুড়ো বলেছে? দেবানন্দ আর তুমি সমান বয়েসি।
কিশোর আবার ঝিম মেরে বসে রইলেন, কিন্তু কোনো ছবি ফিরে এল না।
একটু পরেই সুনন্দা সেজেগুজে এসে বললেন, আমি চললুম। তুমি দুপুরে কোথাও বেরুবে না তো। কিশোর দুদিকে মাথা নাড়লেন। এই সময় সুনন্দাকে বেশ কম বয়সি দেখায়। কিশোর রিটায়ার করে গেলেও সুনন্দার এখনো পাঁচ বছরের চাকরি আছে স্কুলে। খুব যে একটা দরকার আছে তা নয়। তবু সুনন্দা চাকরি করতে ভালোবাসে। সুনন্দাকে খানিকটা হিংসে করেন তিনি এজন্য।
পূর্ব বাংলার সেই গ্রাম থেকে কিশোর কত দূরে চলে এসেছেন। যেন অন্য গ্রহে। মাস্টারের বাড়ির ছেলে, তা অভাব অনটন কম দেখেননি। শৈশবের কত সাধ অতৃপ্ত থেকে গেছে, মা কত পুড়িয়ে পুড়িয়ে কথা শুনিয়েছেন বাবাকে।
শেষ বয়েসে বাবা-মাকে খানিকটা সুখের মুখ দেখিয়েছেন কিশোর। প্রথমে বেহালায় বাড়ি, তারপর সেটা বিক্রি করে ভবানীপুরে বড়ো রাস্তার ওপর এই বাড়িটা কিনেছেন। তা ছাড়া ঘাটশিলায় একটা বাড়ি আছে, বিবেকানন্দ রোডে একটা ওষুধের দোকান। এজন্য অবশ্য কিশোরকে খাটতে হয়েছে অনেক। যৌবনের মাঝামাঝি থেকে হঠাৎ হুস করে এতগুলো বছর কী করে যে কেটে গেল। বড্ড তাড়াতাড়ি চলে গেছে, কিশোরের খেয়ালই হয়নি এতদিন…
…কামরাঙা খেলেই জ্বর হত। একটা তো নয়। এক সঙ্গে তিনটে, চারটে, পাঁচটা। কচু পাতায় খানিকটা নুন আর কয়েকটা কাঁচা লঙ্কা নিয়ে এসে পুকুর ধারে বসে বসে খাওয়া। পরদিনই জ্বর। সত্যিই কি কামরাঙা খাওয়ার সঙ্গে ওই জ্বরের কোনো সম্পর্ক ছিল? মা বারণ করতেন, জ্বর হলেই বলতেন, আবার দত্তদের বাড়ি থেকে চুরি করে কামরাঙা খেয়েছিস?
কামরাঙা, কী সুন্দর না। অবশ্য কেন ওই নাম তা কে জানে। এ ফল তো কোনো দিন লাল হয় না। অবশ্য রাঙা মানে লালই হবে কেন, যে-কোনো রং। কামরাঙার পাতলা সবুজ রংটা কিশোরকে বরাবরই মুগ্ধ করেছে। পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে ফলগুলো, হঠাৎ একটা পেয়ে গেলে…যেগুলো উঁচু ডালের সেগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে…
বেণুদি একটা আঁকশি নিয়ে এসে বলেছিলেন, ওরে, গাছটা ভেঙে ফেলবি নাকি? কটা চাস বল, আমি পেড়ে দিচ্ছি।
শুধু বেণুদিকেই দেখা যাচ্ছে, কিশোরকে নয়। গাছ কোমর বাঁধা শাড়ির আঁচল পিঠের ওপর খোলা চুল, বেণুদি আঁকশি দিয়ে কামরাঙা পাড়ছেন। সেই বয়েসটায় পুরুষের চোখ অসম্ভব মাংস লোভী হয়, তাই বেণুদির শরীরের বিশেষ বিশেষ অংশই শুধু ঝলসে উঠছে, গাছ থেকে ফল-পাড়া নয়, যেন একটা নাচ, কিশোর দেখছে, চারদিকের নানা রকমের সবুজের মধ্যে এক গৌরবর্ণ মাংস প্রতিমা, আকাশটা নীচু হয়ে এসেছে চাঁদোয়ার মতন, একটা কুবো পাখি ডাকছে অবিশ্রান্ত সুরে, বেণুদির পায়ের ছন্দের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে সেই ডাক। হীরের গয়নার মতন এত উজ্জ্বল হয় স্মৃতির ছবি?
আজ কামরাঙা কিনে এনেছেন বলেই যে কিশোরের মনে পড়ছে বেণুদির কথা, তা নয়। বেণুদির মুখ তার জীবনে বরাবরই ফিরে ফিরে এসেছে। যেন বেণুদিকে ঘিরে তাঁর মধ্যে রয়েছে এক গভীর মর্মবেদনা। অথচ, বেণুদির সঙ্গে সেরকম তো সম্পর্ক কিছু ছিল না। পাড়ার আর পাঁচটা কমবয়েসি ছেলের চেয়ে কিশোরকে তিনি কখনো আলাদাভাবে দেখেননি। সেরকম মনোযোগই দেননি।
একদিন, কিংবা হয়তো কয়েকদিন হবে, বেণুদির সঙ্গে প্রতাপদাকে দেখেছিলেন কিশোর। ধুতির ওপর ঢোলা পাঞ্জাবি পরা, তার বুকের বাঁ দিকে বোতাম, সবাই বলত প্রতাপকে প্রমথেশ বড়ুয়ার মতন দেখতে। সেই প্রতাপদা বেণুদির কাছ থেকে আঁকশিটা নিয়ে বলেছিলেন, দাও, আমি পেড়ে দিচ্ছি। একটা মাত্র ফল পেড়ে, সেটা কিশোরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে প্রতাপদা বলেছিলেন, এই নে! এখন যা পালা।
কী সাংঘাতিক অপমান লেগেছিল সেই কথাটায়। এখনো যেন কানে ঝনঝন করে বাজে। কামরাঙা ফল পেকে পেকে গাছের নীচে পড়ে যায়। পাড়ার ছেলেরা যার যখন ইচ্ছে পেড়ে নিয়ে যায়, কেউ আপত্তি করে না। সেই ফল একটা মাত্র দিয়ে একটি সতেরো বছরের ছেলেকে অবহেলার সঙ্গে বিদায় করে দেওয়া! আশ্চর্য, বেণুদিও কোনো প্রতিবাদ করেননি তখন। বরং, খানিকবাদে, পুকুরধারে মুখ গোঁজ করে বসে থাকার সময় কিশোর শুনতে পেয়েছিলেন বেণুদি আর প্রতাপদার সম্মিলিত হাসি।
বাষট্টি বছর বয়েসেও এই কথা মনে পড়ায় কিশোরের শরীরের প্রতিটি রোমকূপ যেন সচকিত হয়ে উঠল। প্রতাপদাকে হাতের কাছে পেলে যেন তিনি এই মুহূর্তে তাঁর গলা চেপে ধরতে পারেন।
তারপরেই তিনি অবাক হলেন। প্রতাপদার ওপরে এখনো এত রাগ রয়ে গেছে কেন? প্রতাপদাকে তিনি আর বেশি দেখেননি, দিল্লি না কানপুর কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন তিনি। বেণুদিকে তিনি বিয়ে করেননি। কিশোরও তার পরের বছরই গ্রাম ছেড়ে চলে আসেন।
মিলি চা দিয়ে বলল, বাবা, আমি আর জুলি একটু বেরুবো সুরঞ্জনের সঙ্গে।
নিশ্চয়ই ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যাবি!
কী করে বুঝলে?
ওই জায়গাটার নাম বলাই তো সবচেয়ে সুবিধে, তাই না?
মোটেই না। আমরা যাচ্ছি অনাময়দার বাড়ি।
সে আবার কে?
ও একটা স্কাউন্ডেল। ওকে তোমার না চিনলেও চলবে।
তা একটা স্কাউন্ডেলের বাড়িতে যাওয়া হচ্ছে কেন দল বেঁধে?
অনাময়দা আমার বন্ধু, ভাস্বতীর সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। ভাস্বতী বেচারা আর লজ্জায় বাড়ি থেকে বেরুতেই পারে না।
তা সেখানে গিয়ে কি মারামারি হবে নাকি?
দরকার হলে মারতেও পারি। সেই জন্যই তো সুরঞ্জনটাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি?
থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়াবে না তো? দেখিস।
না, না, সেসব কিছু নয়। স্রেফ ভয় দেখাবো। ওর নামে কাগজে বিজ্ঞাপন দেবো। তুমি আবার বসে বসে চিন্তা করতে যেও না যেন আমাদের জন্য।
কিশোর প্রসন্নভাবে হাসলেন। ছেলেমেয়েদের কোনো গতিবিধিতেই বাধার সৃষ্টি করেন না তিনি। ওদের সঙ্গে ইয়ার্কি ঠাট্টা হয়। তার সুফল এই যে ওরা কখনো মিথ্যে কথা বলে না তাঁর কাছে। সত্যি কথার সৌরভই আলাদা। শুনলেই মন ভালো হয়ে যায়।
সুরঞ্জন ছেলেটা লেখাপড়ায় ভালো, অথচ জুলি-মিলি তাকে মনে করে জিপ গাড়ি। এরা দল বেঁধে যাচ্ছে এদের একজন বান্ধবীর পক্ষ নিয়ে অন্য একজনের সঙ্গে ঝগড়া করতে। এদের ধরন-ধারণই আলাদা।
হঠাৎ কিশোর ভাবলেন, এই যে মিলি-জুলি, সুরঞ্জন, ভাস্বতী আর অনাময় এরা কি কেউ কারুকে ঈর্ষা করে? দেখলে তো বোঝা যায় না। একালের ছেলেমেয়েরা বুঝি ঈর্ষা ভুলে গেছে।
নারীদের ব্যাপারে কিশোরের মনে সে রকম কোনো গুপ্ত অতৃপ্তি নেই। কাজের খাতিরে তাকে বহু জায়গায় ঘুরতে হয়েছে। নিজের স্ত্রী ছাড়াও নারীদের সঙ্গে তাঁর গভীর সম্পর্ক হয়েছে কোনো কোনো সময়ে। সুনন্দার সঙ্গে বিয়ের আগে অন্তত আরও দুজনকে চেয়েছিলেন। আজ তাঁর প্রথম প্রেমিকা সেই চৌধুরীদের বাড়ির মাধুরী, বেশ একটা মধুর বাল্যপ্রেম জমেছিল তার সঙ্গে। কিন্তু সেই মাধুরীর মুখখানাও ঠিক মতন মনে পড়ে না। অন্যান্য মেয়েদের তেমন করে মনে রাখেননি কারুকে। প্রথম যৌবনের খেলার সঙ্গীদের অনেকের নাম বা চেহারা অনেক কষ্ট করে স্মৃতিতে আনতে হয়। নিজের চেহারাটাই মনে নেই।
কিন্তু বেণুদি আর প্রতাপদা, বেণুদির হাত থেকে প্রতাপদার সেই আঁকশি নিয়ে নেওয়ার ছবি তার স্মৃতিতে যেন আগুনে ঝলসানো উল্কির মতন দগদগ করছে। সেই প্রথম অপমান, সেই প্রথম তীব্র ঈর্ষা, তা কিছুতে ভোলা যায় না।
পুকুরের ধারের পায়-চলা রাস্তাটাতে কাঁচা পাকা চুলের প্রৌঢ় মানুষটি দাঁড়িয়ে কাকুতিমিনতি ভরা গলায় বলতে লাগলেন, বেণুদি, একবার আমার দিকে তাকাও একবার আঁকশি-ধরা হাতখানি উঁচু করো, কুবো পাখিটার ডাকের ছন্দে তোমার পা উঠুক-নামুক, শুধু আমার জন্য। এখন তো প্রতাপদা কাছে নেই।