মর্নিং ওয়াক
‘জানিস। এসব কুকুর হল জাতের কুকুর। তোর দেশি নিড়ি কদুকুর নয়। খাস জার্মান শেফার্ড ডগ। মাতৃভাষা জার্মান। অল্প সল্প সংস্কৃত বোঝে। উত্তিষ্ঠিত, বললে ওঠে। জাগ্রত বললে ঘেউ করে। প্রাপ্য বরান, বললেই লাফিয়ে বিস্কুট ধরে।’
মেজোমামা বললেন, ‘সংস্কৃতে এতটা পারদর্শী হওয়ার কারণ?’
বড়মামা হুঁহুঁ করে এক চিলতে ব্যঙ্গের হাসি ছেড়ে বললেন, ‘এই তো ভ্রাতা, তোমার শিক্ষার দৌড়! তুমি একজন নামকরা দর্শনের-অধ্যাপক, তোমার ছাত্র-ছাত্রীরা সব মুড়ি-মুড়কির মতো ডক্টরেট পায় অথচ তুমি জান না, সংস্কৃতের সঙ্গে জার্মানের কি সম্পর্ক। লজ্জা, লজ্জা, আরক্ত বদনে আমার হাঁড় হাঁউ করিয়া ক্রন্দন মিশ্রিত হাস্য করিবার ইচ্ছা হইতেছে।’
মেজোমামা বললেন, ‘জল মিশ্রিত দুগ্ধের ন্যায়? অথবা তিন্তিড়ী বারিতে ভাসমান লোচিকার ন্যায়।’
আমি পাশে বসেছিলুম বড়মামা কানে কানে জিগ্যেস করলেন, ‘দ্বিতীয়টা কি রে?’
আমি বললুম, ‘এখন যেমন চলছে চালিয়ে যান, আমি পণ্ডিতমশাইকে জিগ্যেস করে পরে জানিয়ে দোব। এখন চালিয়ে যান। হেরে যাবেন না।’
ভোরবেলা বাড়ির বাগানে বাঁধানো বকুলতলায় বসে এই সব হচ্ছে। আর বড়মামার সবচেয়ে আদরের অ্যালসেশিয়ান কুন্তলা কখন ছুটছে, কখন বসছে। একটু পরেই আমরা চারজন মর্নিংওয়াকে বেরবো। তখন কুন্তলার গলায় একটা বাহারি বগলশ আর খুব দামি চামড়ার তৈরি লম্বা বেল্ট পরানো হবে। বড়মামার হাতে থাকবে খুব সুন্দর একটা ব্যাটন।
মেজোমামা তখন আমাকে বললেন, ‘ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ, লর্ড মাউন্ট ব্যাটন।’
বড়মামা হঠাৎ একটা সত্য কথা বললেন, ‘দেখ মেজো, মর্নিং ওয়াক-এর চেয়ে মর্নিং স্লিপ অনেক ভালো; ভোরের মিষ্টি ঘুম।’
মেজোমামা বললেন, ‘সে-কথাটা তো আমি আমার ছাত্রজীবন থেকে শুধু বলে আসছিলুম না করেও আসছিলুম, হঠাৎ তোমারই মাথায় ঢুকলো মর্নিং ওয়াক। তার ঠেলায় শরীরটাই নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে। জান! কলেজের ক্লাসে আমার কী অবস্থা, থেকে থেকে হাই, বিরাট বিরাট হাই। কাঁহাতক চাপা যায়! তারপর ছেলেবেলা থেকে মা অভ্যাস করিয়েছিলেন, হাই তোলার সময় হাঁ-মুখের সামনে দু আঙুলে টুসকি। সেই অভ্যাস রক্তে চলে গেছে। মনে থাকে না ক্লাসে পড়াচ্ছি, থেকে থেকে হাই তুলছি আর টাস টাস করে টুসকি মারছি। ছাত্র ছাত্রীরা প্রথমে হাসাহাসি করত, এখন তারা সমবেত টুসকি মারে। ভেবে দেখ, তোমার এই মর্নিং ওয়াকের জন্যে আমার কি হেনস্তা! আমি একটা হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট!’
বড়মামা বললেন, ‘আরে ধুর, সবাই নিজের দুঃখটাকে বড় করে দেখে, আমার কি হয়েছে শুনবি, আমি এত বড় একজন ডাক্তার…’ মেজোমামার যা স্বভাব, বড় মামাকে আর এগোতে না দিয়ে বললেন, ‘আপনারে বড় বলে বড় সেই নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।’
অন্য সময় হলে লেগে যেত ধুমধাম। মাসিমাকে ছুটে আসতে হল সব ফেলে, বড়মামা এখন নিজের দুঃখের কথাটা বিনা বাধায় বলতে চান। তাই বললেন, ‘বেশ! কোনটা বাদ দেবো বল? ডাক্তার বাদ দিলে বড় থাকে, সেটা বেঠিক কিছু নয়, আমি তোর বড়। আর যদি বড় বাদ দিতে বলিস, তাহলে থাকে ডাক্তার। সেটাও অসত্য নয়। এখন বল, কোনটা থাকবে কোনটা যাবে?’
‘বড়টা তুলে নাও, ডাক্তারটা থাক।’
‘বেশ, আমি একজন ডাক্তার, আমার কি লজ্জা। রুগির বুকে স্টেথো বসিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। ঝুঁকে দেখছিলুম। আমার মাথাটা সামনে ঝুঁকতে ঝুঁকতে রুগির বুকে। মাথা আর স্টেথিস্কোপ দুটোই পড়ে আছে বুকে। রুগির আত্মীয়স্বজন ভাবছে, কেস খুব সিরিয়াস। তোরা তো সবাই জানিস, আমি ফ্ল্যাট হয়ে ঘুমোলে নাকে পাখোয়াজ, আর বসে ঘুমোলে সেইটাই প্রেসার কুকার—সিঁ সিঁ। সবাই ভাবছে, শব্দটা আসছে রুগির বুক থেকে। কতক্ষণ ওইভাবে ছিলুম কে জানে, খেয়াল হতেই মাথা তুলে নিলুম। সবাই করুণ গলায় জিগ্যেস করলো, ডাক্তারবাবু বাঁচবে তো! আমি গম্ভীর মুখে বললুম, কেস খুব সিরিয়াস। ঘরে একটা বিচ্চু টাইপের বাচ্চা ছিল, সে কেবল বলতে লাগল, ডাক্তারবাবু, আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? ডাক্তারবাবু আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?’
মেজোমামা জিগ্যেস করলেন, ‘রুগি পুরুষ না রমণী?’
বড়মামা গম্ভীর গলায় বললেন, ‘রমণী!’
মেজোমামা বললেন, ‘ছিঃ ছিঃ ছিছি। তুমি কোনদিন মারধোর খেয়ে মরবে।’
‘সবই তো ভাই এই মর্নিং ওয়াকের জন্যে!’
‘এই উৎপাতটাকে আমাদের জীবন থেকে হাটাও না।’
‘উপায় নেই রে ভাই, কুসি আমাদের খাওয়া বন্ধ করে দেবে। তোর আর আমার ভুঁড়ির সাইজ দেখছিস। তুই চিৎ হয়ে শুয়ে পায়ের আঙুল দেখতে পাস?’
‘তুমি পাও?’
বড়মামা খুব দুঃখের গলায় বললেন, ‘না রে ভাই।’
মেজোমামা বললেন, ‘আমি তো এখনো পাই, পরিষ্কার দেখতে পাই, তাহলে আমার আর মর্নিং ওয়াকের দরকার কি? কাল থেকে তোমার সঙ্গে আমি আর নেই।’
বড়মামা কুঁক করে খানিক হাসলেন। সেই বিখ্যাত হাসি, যে হাসি শুনলে মাসিমা একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন। হাসি থামিয়ে বললেন, ‘বৎস। একদা আমিও অনুরূপই ভাবিতাম। তাহার পর প্রতিরাত্রেই ইঞ্চি ইঞ্চি করিয়া বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। ইহা একপ্রকার বেলুন বিশেষ। বেলুন ফুঁ মারিতে হয়, ইহা অটোমেটিক। আর একবার বাড়িতে থাকিলে বাড়িতে থাকিবে, সেই বৃদ্ধি রোধ করিবার ক্ষমতা কাহারো নাই। কেশ বৃদ্ধি পাইলে কর্তন করা যায়, উদর বৃদ্ধি পাইলে কিছুই করিবার নাই। আজ তুমি তোমার পদত্রদ্বয় দেখিতে পাইতেছ, অচিরেই আর দেখিতে পাইবে না।’
পেছন দিক থেকে মাসিমার গলা পেয়ে আমরা তিন জনেই চমকে উঠেছি, ‘এই তোমাদের মর্নিং ওয়াক হচ্ছে! মর্নিং ওয়াক থেকে ইভনিং ওয়াক, সেটাও হবে না, যা হবে আমি জানি—স্লিপ ওয়াক। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নে হাঁটবে। তোমাদের দুজনের এত কী কথা থাকে বলো তো। সেই কখন উঠেছ। সবাই বেড়িয়ে ফিরছে, তোমরা এখনো বেরতেই পারলে না!’
বড়মামা বললেন, ‘খেলতে নামার আগে বড় বড় খেলোয়াড়রা কী করে। ওয়ার্ম আপ। আমরা তাই করছি।’
মাসিমা বললেন, ‘বসে বসে ওয়ার্ম আপ? এরপর তো শুয়ে পড়বে!’
মেজোমামা বললেন, ‘ও ঠিক বোঝাতে পারলে না, ওয়ার্ম আপ নয় মোটিভেসান। মনকে দৃঢ় করছিলুম। প্রাতঃভ্রমণের সুফল ও কুফল সম্পর্কে দেশ বিদেশের মনীষীদের অভিমত। ওর অভিমত।’
মাসিমা বললেন, ‘ওর আবার অভিমত কী? ও আবার মনীষী হল কবে?’
মেজোমামা বললেন, ‘আহা, ও ডাক্তার তো! একজন নামকরা বড় ডাক্তার!’
বড়মামা বিনয়ে গলে গিয়ে বললেন, ‘কি যে বলিস! বড় কেন ভাই, আমি একজন সামান্য চিকিৎসক।’
মাসিমা বললেন, ‘কারো অভিমত শোনার প্রয়োজন নেই, আমার অভিমত শোনো। প্রাতঃভ্রমণের হাতে হাতে ফল—সুফল ও কুফল। করলে খেতে পাবে, না করলে উপবাস। মাছ, মাংস, ডিম, আইসক্রিম, ফুলকো লুচি, ছোলার ডাল। সেই বুঝে কাজ, এখানে বসে আড্ডা মেরে পুড়ুক করে পাঁচ মিনিট ঘুরে আসবে—ও চালাকি চলবে না। পাক্কা এক ঘণ্টা জোরে জোরে হাঁটা যতক্ষণ না নাভিশ্বাস বেরোচ্ছে।’
বড়মামা বললেন, ‘নাভিশ্বাস বলিস না বোন! ওটি বেরিয়ে গেলে ডেড বডি। বল, হাঁসফাঁস।’
‘তোমাদের তো দু’পা হাঁটলেই হাঁসফাঁস।’ আমাকে বললেন, ‘তুই কড়া নজর রাখবি, আমাকে রিপোর্ট দিবি। রোববারে রোববারে আমি ভুঁড়ি মাপব। তখনই ধরা পড়ে যাবে।’
মাসিমা চলে যেতেই দুজনে বলাবলি করলেন খুব দুঃখের গলায়, ‘দেখ ভাই, বোন ভালো, এত কড়া বোন কি ভালো!’
‘বরাত ভাই! সবই মানুষের বরাত!’
গঙ্গার ধারটা ভারি সুন্দর। বিশাল ঘাসে ঢাকা একটা মাঠ। বড় বড় গাছ। গাছের তলায় তলায় বাঁধান বেদি। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা। বাঁধা নৌকো, ভাসা নৌকো। বাঁশ থেকে বাঁশে টেনে বাঁধা জাল। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ হোঁত হোঁত করে হাটছেন এপাশ থেকে ওপাশে। এদিক থেকে ওদিকে তো ওদিক থেকে এদিক। সারা মাঠ জুড়ে ভয়ঙ্কর এক ব্যস্ততা। এরই মধ্যে একপাশে চলছে জগিং, যোগাসন। কয়েকজন ভীষণ বৃদ্ধ লাঠি ঠুকঠুক করে হাঁটছেন, দু দশ পা হেঁটেই থমকে দাঁড়াচ্ছেন, অসহায় মুখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। দৃষ্টি কমে এসেছে। দেখার চেষ্টা করছেন সকালটা কেমন! একে অপরের খবর নিচ্ছেন। পরিচিত জন নিত্যানন্দের ভয়ঙ্কর অবস্থা। বাহাত্তর ঘণ্টা না কাটলে কিছুই হবে না, বলাই যাবে না, নিত্যানন্দ থাকবে কী যাবে। সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য, ‘আর কি, আমাদেরও ডাক এল বলে।’ বলেই লাঠি উঁচিয়ে নবীন শক্তিতে দুজন দুদিকে হাঁটা দিলেন।
বড়মামাকে হাঁটতে হচ্ছে না। কুন্তলা হিড় হিড় করে টানছে, বড়মামা টাল খেতে খেতে তার পেছনে পেছনে চলেছেন। মেজোমামাকে দেখে মনে হচ্ছে, মাঠে নয় বাড়ির দোতলার বারান্দায় দার্শনিক চিন্তা নিয়ে পায়চারি করছেন। মাঝে মাঝে দাঁড়াচ্ছেন, নিজের মনেই হাসছেন। এমন একটা জায়গা বেছেছেন যেদিকটা নির্জন। মেজোমামার সঙ্গে কেউ কোনও কথা বলেন না ভয়ে। সবাই জানেন, তিনি পৃথিবীতে থেকেও পৃথিবীতে থাকেন না। আর বড়মামার সঙ্গে কে কথা বলবে। সর্বক্ষণ বিশাল একটা কুকুর হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে চলেছে এদিক, ওদিক, ওদিক থেকে এদিক।
অনেক দিন পর আজ বেড়াতে এসেছেন সমরবাবু। নামকরা ব্যক্তি। সারা জীবন ইওরোপেই কেটেছে। বৃদ্ধ বয়সে দেশ এমন টান মেরেছে সব ছেড়ে চলে এসেছেন। গঙ্গার ধারের পৈতৃক বাগান বাড়িটি অঢেল টাকায় মেরামত করে জাঁকিয়ে বসেছেন। নিরহঙ্কারী, সদা হাস্যমুখ মানুষ। আমাকে খুব ভালোবাসেন।
বড়মামার বিব্রত অবস্থা দেখে সমরবাবু বললেন, ‘এটা তো ট্রেনড ডগ!’
বড়মামা হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘অবশ্যই। ব্যারাকপুরের স্কুল থেকে ট্রেনিং দিয়ে আনা।’
‘তা হলে অত কষ্ট করছেন কেন? বিলেতে সায়েবরাও কুকুর নিয়ে বেরোয়, বেল্টটেল্ট বাঁধে না। এ তো কুকুরের অপমান। বেল্ট খুলে দিন। মানুষের মতো স্বাধীনভাবে ঘুরতে দিন।’
বড়মামা বললেন, ‘যদি কামড়ে টামড়ে দেয়।’
‘কেন কামড়াবে ট্রেনড ডগ! দিন খুলে দিন।’
বড়মামার একটু ইতস্তত ভাব ছিল, তবু খুলে দিলেন। আমার মন বললে, কাজটা ভালো করলেন না। কতকগুলো ব্যাপারে কুন্তলার অ্যালার্জি আছে। একটা হল বেড়াল, সে দেশি, বিদেশি সব কুকুরেরই আছে। আর একটা হল গরু। সাদা মতো বিশাল, মন্থর গতি, বোকা বোকা চেহারার, বড় বড় চোখ ওই প্রাণীটিকে দেখলেই ট্রেনিং ফ্রেনিং সব ভুলে কুন্তলা সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যায়।
এমনই বরাত, বেল্টটা খোলা মাত্রই হরেনদের অতি অবাধ্য সেই গরুটা মর্নিং ওয়াকে চলে এল। হরেনরা খুব ক্যালাস। বহুবার বলা হয়েছে, ভোরবেলা ওকে মাঠে আসতে দিও না, প্লিজ অনেক অসুবিধে আছে। শোনে না। যে হেতু পার্টি করে, সেই হেতু, সারা দেশ, আইন-কানুন সব তার। দেড় চোখে বিশ্রী ভাবে তাকিয়ে, কর্কশ গলায় বলবে, কার অসুবিধে, কিসের অসুবিধে! আমার গরুরও মর্নিং ওয়াক করার রাইট আছে। ওই মাঠটা কারুর একার নয়।
সেই পলিটিক্যাল গরুটি গদাইলস্করি চালে মাঠে ঢুকল। আর সঙ্গে সঙ্গে কুন্তলা তার আদিমতায় ফিরে গিয়ে নেকড়ে বাঘের চেহারা নিল। এইবার পর পর যা হল তার ধারা বিবরণী :
লেজ উঁচিয়ে চার পা তুলে সারা মাঠে গরু ছুটছে গোল হয়ে। কুন্তলা কখনো তার পেছনে, কখনো তার সামনে, যখন সামনে তখন ঝুল কেটে ঘেউ ঘেউ করে তার দৌড়ের দিক পরিবর্তন করে দিয়েই পেছন পেছন ছুটছে। বড়মামা একটা বেদীর ওপর উঠে প্রবল উত্তেজনায় গরুর বদলে নিজেই চিৎকার করছেন, ‘হেল্প, হেল্প!’ খেয়াল নেই, কুন্তলার বেল্টটা নিজের গলায় চড়িয়েছেন। মেজোমামা ধারে কাছে কোথাও নেই, মনে হয় গঙ্গার পাতায় নেমে গেছেন। উত্তেজনা, বিপদ, দুর্যোগ, অশান্তি একেবারেই সহ্য করতে পারেন না, সঙ্গে-সঙ্গে অম্বল, তারপরেই মাথা ধরা। একজন যোগাসনের পর শবাসনে ছিল, গরু তাকে টপকে চলে গেল, ঝাঁপিয়ে গেল কুন্তলা। ভাগ্য ভালো, বুকের মাঝখানে গরুর পা দুটো পড়লেই প্রকৃত শব। দুজন বৃদ্ধের একজন চিৎপাত, লাঠিটা মাঠের মাঝখানে, আর একজন বৃদ্ধ দূরে মোটামুটি নিরাপদ স্থানে দাঁড়িয়ে, গরুর উপকারিতা ও কুকুরের অনুপকারিতা সম্পর্কে অনর্গল বলে চলেছেন। গরু বৈদিক প্রাণী। বেদের কোথাও কুত্তার উল্লেখ নেই। মহাভারতে একবার মাত্র উল্লেখ আছে, সেও আসল কুকুর নয়, ছদ্মবেশী ধর্ম। একটা বাচ্চা আত্মরক্ষার আর কোনও উপায় না দেখে তারস্বরে কেঁদে চলেছে, আর তার বাবা একটা বেদীর ওপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে চলেছেন, ছুট্টে চলে আয়, গাধা কোথাকার ছুটে চলে আসতে পারছিস না!’ ভদ্রলোক ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, ‘আপনি আনুন না উপদেশ না দিয়ে!’ একজন বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘দেখছেন তো মেয়েটা ঘাবড়ে গেছে, মাঝমাঠে চোখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে, ঝট করে কোলে তুলে নিয়ে চলে আসুন না!’ ভদ্রলোক বললেন, ‘মেয়েটা তো আপনার!’ তিনি বললেন, ‘পরোপকারে আবার আমার তোমার কী? আমার তোমার আসে কোথা থেকে!’ কুন্তলা গরু তাড়া করে একটা মজার খেলা পেয়ে গেছে। কুন্তলা বাচ্চা খুব ভালোবাসে। সে ফাঁক পেয়ে মেয়েটার সামনে একটুখানি দাঁড়িয়ে মেয়েটার গলা দুটো চুক চুক করে চেটে দিলে। মাঠে রোল উঠল, ‘খেয়ে ফেলল, খেয়ে ফেলল।’ বড়মামা সবার ওপরে গলা চড়িয়ে চিৎকার করছেন, ‘খাচ্ছে না, খাচ্ছে না। চাটছে।’ সঙ্গে সঙ্গে মন্তব্য, ‘কখনো চেটে খায়, কখনো খেয়ে চাটে।’
স্পট জগিং আর ওয়াকিং এখন রানিং। সব এলোপাতাড়ি ছুটছে। গরুটা এইবার পাশের একটা থানায় হুড়মাড় করে পড়ে গেল। কুন্তলা খানার ধারে দাঁড়িয়ে ঝুল কেটে কেটে ঘেউ ঘেউ করছে। এটা তার আদরের ডাক। যেন বলতে চাইছে, বোকা মেয়ে, আমি তো তোর সঙ্গে খেলা করছিলুম গাধা! কে তোকে খানায় পড়ে যেতে বলেছিল!
সব শান্ত! গরু খানায়। ভ্রমণকারিরা বিশ্রামরত। বড়মামা কুন্তলাকে বেল্টবন্ধ করেছেন। মেজোমামা আবার আবির্ভূত হয়েছেন। এইবার শুরু হল দ্বিতীয় পর্ব। হরেনদা লেটরাইজার, কারণ তাঁর ব্যবসাটাই এমন, ভয়ঙ্কর রাত জাগতে হয়। তবে ব্যবসাটা কি পরিষ্কার করে কেউ বলতে পারে না, তিনিও পারেন না। ঠেলে ঠুলে ঘুম থেকে তোলা হয়েছে। সকালবেলা তাঁর মুখটা বেশ আদুরে আদুরে দেখায়। তাঁর মুখের কনস্ট্রাকসানটা অবিকল চালতার মতো। ভগবান একপিস চালতা গাছ থেকে পেড়ে এনে একটুকরো হোসপাইপ ফিট করে ধরে সেঁটে দিয়েছেন।
তিনি খানার ধারে দাঁড়িয়ে জনে জনে প্রশ্ন করতে লাগলেন, ‘কী করে হল? কেমন করে হল! মাতালরাই তো মাঝরাতে এটার মধ্যে পড়ে। পরশু রতন পড়েছিল। অ্যাঁ, এই গরুটা আমাকে পাগল করে ছাড়বে। এই সেদিন দাঁয়ের পাতকোতে পড়েছিল। দমকল কল করতে হল। এর চেয়ে একটা গাধা পোষা ভালো ছিল!’
বড়মামা আগ বাড়িয়ে বললেন, ‘আই অ্যাম সরি হরেন!’
হরেনদা তীব্র প্রতিবাদ করলেন, ‘না, না, ডাক্তারবাবু, এইরকম একটা গরুর মতো গরুর জন্যে আপনার সরি হবার কোনও কারণ নেই।’
জনতা বললেন, ‘ডাক্তারবাবুর কুকুর তাড়া করে ফেলে দিয়েছে।’
হরেনদা বললেন, ‘হতেই পারে না, ওই কুকুর আমি নিউ আলিপুরের কেজরিওয়ালদের বাড়ি থেকে বাচ্চা অবস্থায় এনে ডাক্তারবাবুকে দিয়েছি। ওর বংশলতিকা শুনলে সবাই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে। ওর ঠাকুরদা ছিল কেনসিংটন প্যালেসে, আর ক্রেমলিন প্যালেস থেকে এসেছিল ওর ঠাকুমা। এ কুকুর সে কুকুর নয় গো দাদা!’
একজন বললেন, ‘তাহলে পড়ল কী করে।’
হরেনদা বিপ্লবীর মতো বললেন, ‘স্বভাবে পড়েছে। মানুষ নিজের ভাগ্য নিজে তৈরি করে। ও থাক পড়ে, যখন ইচ্ছে হবে উঠে আসবে। আমার এখনো দুঘণ্টা ঘুম বাকি। আমি চললুম। হেলথ ইজ ওয়েলথ। এই ব্যাটা গরুর আমার ওয়েলথ নয়।’
হরেনদার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে গুঞ্জন উঠল, ‘যা ব্বাবা।’
গরুটা বড় ফ্যাল ফ্যাল চোখে বড়মামার দিকে তাকিয়ে আছে। দু চোখে জলের ধারা। আমার পশুপ্রেমী বড়মামা এ দৃশ্য সহ্য করতে পারবেন কেন। খানার ওধারে দাঁড়িয়েছিল বড়মামার বড় পেয়ারের পরান আর তার দলবল। ওদের ক্লাবের নাম দুর্গতিনাশিনী। নন পলিটিক্যাল। ব্রত হল, জীবের দুর্গতি দূর করা। কথার কথা নয়, প্রকৃতই করে থাকে। আর যেটা থাকে, সবরকমের কালীপুজো, রক্ষাকালী, ফলহারিনী, রটন্তি। ঢালাও খিচুড়ি ভোগ! পাথরকোঁদা চেহারা পরানের। গঙ্গায় মাছ ধরে। বছরের প্রথম ইলিশটা বড়মামাকে নিবেদন করে যায়। দুর্দান্ত ছেলে।
বড়মামা পরানের দিকে তাকিয়ে শুধু একটি কথাই বললেন, ‘অ্যাকশান।’
সঙ্গে-সঙ্গে এসে গেল বাঁশ, দড়ি, প্লাস্টিক শিট, বাণ্ডিল-বাণ্ডিল খড়, সাবান, বালতি, বুরুশ, পাইপ। গরু উঠে এল। বড়মামা ভীষণ আবেগের গলায় বলতে লাগলেন, ‘ওমা, তোমার লাগেনি তো মা! তোমার লাগেনি তো মা।’
গরুর ভাষা লেজে। কাদামাখা বিশাল লেজটি সপাং করে ঘুরিয়ে দিল। বড়মামার কর্দম, স্নান। পরান বললে, ‘ডাক্তারবাবু, একটা জিনিস শিখে রাখুন, গরুর লেজের দিকে কখনো দাঁড়াবেন না, সপাং করে মেরে দেবে। মাথার দিকে দাঁড়াবেন না, গুঁত্তে দেবে। সব সময় দাঁড়াবেন পেটের দিকে।’
জল দিয়ে সাবান মাখিয়ে, খড় ঘষে শুরু হল গরুর চান। কত বছর চান করছে কে জানে। গরুটার সে কি আরাম! বড় মামা হঠাৎ বললেন, ‘আমাকেও চান করিয়ে দাও। এইসব নিয়ে বাড়ি ঢোকাটা ঠিক হবে না। বেশ তোড়ে জল আসছে পাইপে। প্রাথমিক ধোয়াটা হয়ে যাক। তারপর দেখা যাবে।’
মেজোমামা মন্ত্রোচ্চারণের মতো বলে চলেছেন, ‘আমাদের একটা প্রেস্টিজ আছে তো।’
কে কার কথা শোনে, যেন হোলি খেলা হচ্ছে। ‘কি আনন্দ! মায়ে পোয়ে স্নান, মায়ে পোয়ে স্নান।’ মেজোমামা যোগ করলেন, ‘স্নানান্তে বিচালি ভোজন।’
এইবার শেষ দৃশ্য। ভিজে সপসপে বড়মামা বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে। অদূরে কুন্তলা বসে, আধ হাত জিভ বের করে হ্যা হ্যা করছে। মেজোমামা যথেষ্ট দূরে। সামনে গম্ভীর মুখে মাসিমা।
মেজোমামা মিন মিন করে বললেন, ‘বিশ্বাস কর, আমি কিছু করিনি। একেবারে ইনোসেণ্ট।’
মাসিমার এক ধমক, ‘চুপ। মর্নিং ওয়াক করতে গিয়েছিলে না জলে ডুবতে!’
বড়মামা মিন মিন করে বললেন, ‘আমি কিছু করিনি, কুন্তলা…’
মাসিমার আবার ধমক, ‘চুপ, মর্নিং ওয়াক বন্ধ। কাল থেকে ডন, বৈঠক।’
মেজোমামা বললেন, ‘পাঁচশো টাকা দিয়ে এসেছে।’
মাসিমা স্তম্ভিত হয়ে বললেন, ‘কেন?’
‘গোমাতার পুজো।’
মাসিমা বললেন, ‘টাকা খোলাম কুঁচি। আজ থেকে এক মাস তোমাদের দুজনেরই কফি বন্ধ।’