মর্গের নেকড়ে ইঁদুর
১
আজ আমার সত্যিকারের কর্মজীবন আরম্ভের ঠিক এক মাস পূর্ণ হল৷
অবশ্য এর আগে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস, তারপর দিল্লির এইমস থেকে এম ডি, এইসবের ফাঁকে ফাঁকে হাউজস্টাফশিপ বা মাসকয়েকের জন্য প্রাইভেট নার্সিং হোমে পার্টটাইম প্র্যাকটিস কিংবা টুকটাক পেশেন্ট দেখা, এইসবই করেছি৷
তবু পুরোদস্তুর সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছি এক মাস আগে৷
সকাল থেকে এই নিয়ে মনটা বেশ উৎফুল্ল ছিল, কিন্তু অফিসে এসে যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হল, তাতে খুশি থাকা তো দূর, টেনশনে, চিন্তায় পুরো মেজাজটাই তেতো হয়ে গেল৷
আমার প্রথম পোস্টিং হয়েছে কলকাতা পুলিশের মর্গে৷ কাঁটাপুকুর অঞ্চলে৷ আমার সব বন্ধুবান্ধবরা যখন গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বাধ্যতামূলক রুরাল কোটা ফুলফিল করতে গিয়ে তাদের ভালোমন্দ মেশানো, বইপড়া জ্ঞানের সম্পূর্ণ উল্টো অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা তুলে ধরছে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ বা ফেসবুকের বন্ধুদের গ্রুপে, আমি তখন খাস কলকাতায় বসে পা দোলাচ্ছি, কলেজ স্ট্রিট, মেডিকেল কলেজ করে বেড়াচ্ছি৷ সপ্তাহে একদিন ছুটি মিলেই যায়, সেদিনটা নন্দন, অ্যাকাডেমি চষে ফেলি৷ কাজেই বন্ধুরা আমায় এখন বেশ ঈর্ষার চোখে দেখে৷ আমি তখন হাসি, ‘‘খুব যে কার্ডিও নিউরো গাইনো করে তখন লাফাচ্ছিলি, ফরেন্সিক নিয়ে স্পেশালাইজেশনটা করলেই তো পুলিশ লুফে নিত রে পাগলা!’’
কথাটা মিথ্যে নয়৷ ফরেন্সিক-এর ডাক্তার এখনো আমাদের দেশে ভীষণ কম৷ বিদেশের মতো আমাদের দেশে অটোপসি করার স্পেশালিস্ট ডাক্তার প্রায় পাওয়াই যায় না৷ ডাক্তারির প্রথম বছর থেকেই আমি ঠিক করে রেখেছিলাম হায়ার স্টাডি করতে হলে তাই ফরেনসিকেই করব৷
এই মর্গে আছি আমি আর ডঃ সরখেল৷ ডঃ সরখেল মাঝবয়সি অভিজ্ঞ ডাক্তার, এই কয়েকদিনে বেশ ভালোই মনে হয়েছে৷ এক সপ্তাহ ডঃ সরখেলের ডিউটি থাকে, অন্যটায় আমার৷ অল্টারনেট সপ্তাহগুলো আমরা লালবাজারের মেডিকেল রুমে বসি৷ এখানে কাজের চাপ মোটামুটি কমই থাকে, তবে মাঝেমধ্যে দুর্গাপুজোর সময় বা কোনো মিটিং মিছিল থাকলে হঠাৎ করেই অনেক ক-টা বডি চলে আসে অটোপসি, মানে সাধারণ ভাষায় যাকে বলা হয়ে পোস্টমর্টেম, সেইজন্য৷ তখন বেশ চাপ পড়ে যায়৷ এখানে আমার সহকারী বলতে লাল্টু আর ইরফান, দুজন ডোম, অটোপসি করে সেই স্পেসিমেন রিপোর্ট আমরা পাঠিয়ে দিই মেডিক্যাল কলেজের প্যাথলজি ডিপার্টমেন্টে, সেখান থেকে চলে যায় পুলিশের কাছে৷
আমাদের দেশে অটোপসি, মানে পোস্টমর্টেম মূলত করে ডোমরাই, আমরা শুধু সুপারভাইজ করি, ক্রিটিকাল কেস হলে তখন হাত লাগাতে হয়৷
লাল্টু, ইরফান, আমি আর ডঃ সরখেল ছাড়া আছে ক্লার্ক ষষ্ঠীদা, রান্নার মালতী মাসি আর দুজন সিকিউরিটি গার্ড৷ আমি আর ডঃ সরখেল অল্টারনেট সপ্তাহে আসি, কিন্তু বাকিদের এখানেই ফুল টাইম ডিউটি৷
ষষ্ঠীদার বয়স সত্তরের উপর হয়ে গেলেও জয়েনিং-এর সময় তার বয়স এতটাই কমানো ছিল যে সে মনে হয় আশি বছর বয়সে রিটায়ার করবে৷ আগে ছিল লালবাজারের হাবিলদার, বছর দশেক হল বয়সের ভারে ওই ঝক্কির কাজ সামলাতে পারছিল না বলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে এখানে৷ ওর কাজ মূলত মেডিকো লিগ্যাল ইনভেস্টিগেশনের জন্য কোন ডেডবডি আসছে, তার কেস হিস্ট্রি, কবে পোস্টমর্টেম হচ্ছে, এইসব ট্র্যাক করার রেজিস্টার মেনটেন করা৷
বাইরের গেটে আছে যোগিন্দর আর ভূপতি, ওরা এখানকার সিকিউরিটি গার্ড৷ একমাত্র ওরাই অল্টারনেট করে চব্বিশ ঘণ্টা মোতায়েন থাকে মর্গের দরজায়৷ ওরা থাকে একটু দূরে পুলিশ কোয়ার্টারে৷ বাকি আমরা সবাই সকাল দশটা থেকে বিকেল ছ’টা অবধি থাকি৷ ডাক্তার হিসেবে এরকম বাঁধাধরা ডিউটি পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার বইকি! এমনিতে নিয়ম অনুযায়ী সূর্যোদয়ের আগে আর সূর্যাস্তের পরে কোনো পোস্টমর্টেম করা হয় না, তাই আমাদেরও থাকার কোনো অর্থ নেই৷
আমাদের রান্না করে মালতী মাসি৷ মালতী মাসিকে আমরা মাসি বলি ঠিকই, কিন্তু তার বয়স পঁয়ত্রিশ মতো হবে বড়জোর৷ একটু মোটার দিকে গড়ন, হাসিখুশি, বেশ মা-মা টাইপ৷ মালতী মাসি পুলিশের কর্মচারী নয়, এই মর্গের স্টাফরাই নিজেদের খাওয়ার সুবিধার জন্য মাসিকে ঠিক করেছিল চার-পাঁচ বছর আগে, সরকার থেকে গ্যাস সিলিন্ডার, রান্নার সরঞ্জাম বাবদ কিছু টাকা মাসে দেওয়া হয়, আর বাকি খরচ, মালতী মাসির মাইনে, সব স্টাফেরাই ভাগাভাগি করে দেয়৷ মাসি এমনিতে খুব ভালো, কিন্তু মুখে এবং শরীরের বিভিন্ন জায়গায় শ্বেতির দাগ থাকায় গৃহস্থবাড়িতে রান্নার কাজ পেত না, এই কারণেই হয়তো মাসির বিয়েও হয়নি৷ কিন্তু আমাদের ওইসব ছুঁতমার্গ নেই৷ মাসির রান্নার হাত চমৎকার৷ তা ছাড়াও মাসি প্রোফেশনাল ধরনের নয়, নিজে থেকেই এটা ওটা করে দেয়৷ এই তো সেদিন আমার পেটটা একটু খারাপ হয়েছিল অফিসে এসে, বারবার ওআরএস-এর জল করে দিচ্ছিল, তারপর একদিন বৃষ্টিতে পুরো কাকভিজে হয়ে অফিসে এসেছিলাম, আমার শার্টটা কেচে দিয়েছিল যত্ন করে৷ তা ছাড়া সকালবেলাটা মাসি আনাজ বিক্রি করে বাজারে, কাজেই আমাদের বাজারে যাওয়ার ঝক্কিটুকুও সামলাতে হয় না৷ মাসিই সব নিয়ে আসে৷
আমরা এইটুকুতেই খুশি৷
বহু পুরোনো এই বাড়িটা, ধূলিধূসরিত আলমারি, তার মোটা ধুলোর আস্তরণে মোড়া সাবেক আমলের কাচ, কড়িবরগার ছাদ আর ঝুলে ভরা বড় বড় ঘর৷ একপাশে বিশাল কোল্ড স্টোরেজ রুম, তাতে সারসার ভল্ট, যার এক-একটায় রয়েছে প্রিজার্ভ করা বডি, কোনোটা এসেছে কয়েকদিনের জন্য, অটোপসি হবে, আবার চলে যাবে৷ কোনোটার আবার অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়ে কোনো পরিচয়ই পাওয়া যায়নি, অজ্ঞাতকুলশীল হয়ে সেই হতভাগ্য ঘুমিয়ে রয়েছে বরফশীতল ঠান্ডা ঘরে৷ আমাদের এখানে এইরকম গোটা পনেরো আনআইডেন্টিফায়েড বডি আছে যারা এখানকার লং টার্ম রেসিডেন্ট৷ বেশ কয়েকমাস তারা এখানে থাকে, পুলিশি ক্লিয়ারেন্স পেয়ে গেলে চলে যায় মেডিক্যাল কলেজের স্টুডেন্টদের অ্যানাটমি ক্লাসে৷
এ ছাড়া আছে দুটো পোস্টমর্টেম করার অপারেশন থিয়েটার আদলের ঘর, যার একটা অব্যবহারে প্রায় বন্ধই পড়ে থাকে৷ আর কিছু অফিস রুম৷
আর আছে লম্বা লম্বা অন্ধকার জমাট বাঁধা ফাঁকা করিডর, যেখানে পা রাখলেই প্রতিধ্বনি মনে করিয়ে দেয়, এখানে আমরা ছাড়াও হয়তো আরো কেউ আছে৷
অন্ধকার নৈঃশব্দ্যও যেন তাদের উপস্থিতির জানান দেয় ফিসফিস করে৷
মাঝে মাঝে মেডিক্যাল কলেজের স্টুডেন্টরা আসে পোস্টমর্টেম করা দেখতে, তখন এই শতাব্দীপ্রাচীন বাড়িটা প্রাণ ফিরে পেয়ে একটু হলেও যেন গমগম করে ওঠে, তারপর ওরা চলে গেলে আবার ফিরে যায় মৃত্যুরাজ্যে৷
আমরা এই কজন শুধু থাকি জীবন্তসমাজের প্রতিভূ হয়ে৷
আজও তেমনই এসে সবে বসেছিলাম নিজের কেবিনে, পেন্ডিং কাজ বলতে কাল একটা বডি এসেছিল বিকেলবেলা, সুইসাইড কেস, তার পোস্টমর্টেম করতে হবে আজ৷ তাড়াহুড়োর কিছু নেই, চা-টা খেয়ে শুরু করা যাবে’খন৷ আমরা যে তিন-চারটে ঘর ব্যবহার করি, সেগুলোকে ঝেড়েমুছে সাফসুতরো করে রাখে মালতী মাসি, বিশেষ করে আমার ঘরটা তো সবসময় ঝকঝকে হয়ে থাকে৷ বাকি সব ঘর অবশ্য খোলাই হয় না৷
চেয়ারে বসেই রুটিন মাফিক সঞ্চয়িতাকে ফোনটা করেছিলাম, ‘‘এই পৌঁছলাম, তুমি কোথায়? হসপিট্যালে পৌঁছে গেছ?’’
বাস-অটোর আওয়াজের মধ্যে সঞ্চয়িতার হাঁপানো ব্যস্ত গলা পেলাম, ‘‘এই ঢুকছি, রাস্তায় খুব জ্যাম, পরে করছি, কেমন?’’
সঞ্চয়িতা আমার প্রেমিকা কাম মেডিক্যাল কলেজের ক্লাসমেট, আমি দিল্লির এইমসে যখন ফরেন্সিক সায়েন্স নিয়ে এম ডি করতে গিয়েছিলাম, ও তখন সাইকিয়াট্রি নিয়ে কলকাতাতেই এম ডিতে ভরতি হয়েছিল৷ এখন ওর পোস্টিং বর্ধমানে৷ হসপিট্যালের কাছেই বাড়ি ভাড়া করে থাকে৷ দুই বাড়িতেই মোটামুটি ঠিক হয়ে আছে আর বছরদুয়েকের মধ্যে আমরা বিয়ে করে নেব৷ সারা সপ্তাহ কাজের ফাঁকে টুকটাক কথা হয় আমাদের, উইকএন্ডে ও এলে তখন দেখা হয়৷
আমি ফোনটা রেখে সকালের মিঠে রোদে বসে আজকের কাগজটা তুলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই ঘরে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল ইরফান, ‘‘পবিত্রদা, একবার চলুন শিগগিরই কোল্ড স্টোরেজে৷’’
এরা সবাই প্রথমে আমায় স্যার বলা শুরু করলেও, আমিই সবাইকে জোর করে দাদা বলিয়েছি, স্যার-ট্যার শুনতে আমার ভালো লাগে না৷ তাছাড়া মর্গের ডাক্তার হয়ে কাজ করতে গেলে যে ডোমেদের হাতে রাখতেই হবে, সেটা আমার ছাত্রাবস্থা থেকেই জানি, তাই এসেই দাদাগিরি চালু করে দিতে এরাও আমাকে বেশ আপন করে নিয়েছে৷
ইরফানের মুখ দেখে আমি বুঝতে পারলাম, সিরিয়াস কোনো ব্যাপারেই ও ডাকছে আমায়৷ আমি জলদি উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে৷
মালতীমাসি আমার চা নিয়ে ঘরে ঢুকছিল, আমি বললাম একটু ঢাকা দিয়ে টেবিলে রাখতে৷
লম্বা করিডর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললাম, ‘‘কী হয়েছে? আবার ইঁদুরের উৎপাত নাকি?’’
আমি জয়েন করার আগে আগেই এই মর্গ কাগজের শিরোনামে এসেছিল, তাও কয়েকমাস আগে৷ মুখ্যমন্ত্রীর আচমকা পরিদর্শনে সেবার ধরা পড়েছিল কোল্ড স্টোরেজে ইঁদুরের ভয়ানক উৎপাত৷ অনেক আনআইডেন্টিফায়েড বডিও মিউটিলেটেড কন্ডিশনে পাওয়া গিয়েছিল, যাদের বিভিন্ন অরগ্যান ইঁদুরে খুবলে খেয়েছে৷ আমার আগে এখানে যিনি ছিলেন, সেই ভারপ্রাপ্ত ডঃ বটব্যালকে তারপরেই সরিয়ে দেওয়া হয় এখান থেকে৷ আমি সেকথা ভেবে বেশ টেন্সড হয়ে পড়লাম, এরকম কিছু আবার হলে তো বেশ চাপের ব্যাপার৷
ইরফান মাথা নাড়ল, ‘‘না ওসব কিছু নয়৷’’
আমি বললাম, ‘‘তবে? রেফ্রিজারেটর কাজ করছে না ঠিকমতো?’’
ততক্ষণে আমরা পৌঁছে গেছি কোল্ড স্টোরেজে৷ লম্বা বিশাল একটেরে ঘর, তার দুপাশে মোট একশোটা ভল্ট৷ টিউবলাইট জ্বলছে গমগম করে, দূরে একটা স্ট্যান্ড ফ্যানও রয়েছে, তার সামনে দেখলাম আমাদের আরেকজন ডোম লাল্টু দাঁড়িয়ে রয়েছে৷
ভেতরে ঢুকতেই সেই ভ্যাপসা অদ্ভুত গন্ধটা এসে নাকে লাগল, যেটা এই ঘরের ট্রেডমার্ক গন্ধ৷
লাল্টু ছেলেটা এমনি বেশ হাসিখুশি, আমাদের এই কজনের নির্জন অফিসে ও সারাক্ষণই হইহুল্লোড় করে মাতিয়ে রাখে, আমাদেরও সময় কেটে যায়৷ কিন্তু এখন ও কেমন প্রচণ্ড ভয় পাওয়া গোরুর মতো চোখে আমাদের দিকে তাকাল৷
আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না৷ ইরফান লাল্টু কেউই খোলসা করে কিছু বলছে না৷
আমি এবার একটু জোরেই বললাম, ‘‘আরে কী হয়েছে বলো৷ চুপ করে আছ কেন!’’
আমার ধাতানিতে এবার কিছুটা কাজ হল৷ ইরফান দেখলাম আমার পাশ থেকে এগিয়ে গেল পায়ে পায়ে, উনিশ নম্বর ভল্টটার দিকে, ভল্টের সামনের হাতলটা ধরে টান মারল৷
উনিশ নম্বর ভল্টে তো কালকের কেসটা রয়েছে, যেটার আজ পোস্টমর্টেম করার কথা৷ আমি ভ্রূ কুঁচকে এগিয়ে গিয়ে ভল্টের দিকে তাকালাম আর সঙ্গে সঙ্গে আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমস্রোত নেমে গেল৷
ঠান্ডা লাশঘরের উনিশ নম্বর ভল্টের মধ্যের ট্রে’টা ফাঁকা৷
ভেতরে লাশের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই! সেই বিশ্রী গন্ধটা যেন জোরে এসে নাকে ঝাপটা মারল আরও একবার৷
২
আমি সাদা চোখে লাল্টু আর ইরফানের দিকে তাকালাম, তাকিয়েই বুঝলাম ওরা আমার চেয়েও অনেক বেশি ভয় পেয়ে গেছে, তাই ওদেরকে আরো ভয় পাওয়ানোর কোনো মানে হয় না৷
গোটা ঘরটায় একবার আলগা চোখ বুলোলাম, মাথা এখন ঠান্ডা রাখতে হবে৷ কী করণীয় ভাবতে ভাবতে বোকার মতো একটা প্রশ্ন করে ফেললাম, ‘‘অন্য ট্রেগুলোতে দেখেছ?’’
লাল্টু আর ইরফান হাঁ করে তাকাল আমার দিকে৷
প্রশ্নটা করেই বুঝতে পারলাম অত্যন্ত বোকার মতো প্রশ্ন করেছি৷ ডেডবডি কি এই ট্রে-টা পছন্দ হয়নি বলে হেঁটে হেঁটে গিয়ে অন্য ভল্টের ট্রে-তে ঢুকে শুয়ে পড়বে? নাকি উঠে বাইরে বেরিয়ে যাবে হাওয়া খেতে?
তবু আমাকে সম্মান দেওয়ার জন্যই হোক, বা অন্য যে-কোনো কারণে, লাল্টু আর ইরফান ক্যাঁচকোঁচ শব্দে ট্রেগুলো খুলে খুলে দেখতে লাগল৷
উনিশ নম্বর ছাড়া এদিকের কয়েকটায় লিগ্যাল কেসের জন্য কিছু বডি রয়েছে, যেগুলোর পোস্টমর্টেম হয়ে গেছে, এখনো পাঠানো হয়নি, আর পঞ্চাশ নম্বরের ওপাশের ভল্টগুলোয় সব আনক্লেইমড বডি৷
এদিকগুলো দেখা হয়ে গেলে ওইপাশেরগুলো দেখতে যাচ্ছিল লাল্টু, আমি অধৈর্য হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম৷ ওরা দেখছে দেখুক, কিন্তু ওপাশটা দেখে কোনো লাভ নেই, ওদিকটা খোলাই হয় না প্রায়৷
আমি জোরে জোরে হেঁটে চলে গেলাম ষষ্ঠীদার অফিসঘরে৷ যা ভেবেছি তাই, মাথার ওপরে মান্ধাতার আমলের ঘটাং ঘটাং পাখা চলছে মৃদু লয়ে, আধা আলো, আধা অন্ধকার ঘরটায় কেমন হোমিওপ্যাথি ওষুধের মতো গন্ধ ছাড়ছে, তারই মাঝখানে চেয়ারে বসে কুঁজো হয়ে টেবিলের উপর মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে ষষ্ঠীদা৷ সামনে রাখা বিবর্ণ হয়ে যাওয়া জাবদা রেজিস্টার খাতার উপরে ষষ্ঠীদার মাথায় যে ক-টা চুল এখনো অবশিষ্ট আছে, সেগুলো উড়ছে ফড়ফড় করে৷
আমি বেশি হট্টগোল করলাম না, শান্তস্বরে ষষ্ঠীদাকে ডাকলাম, ‘‘ষষ্ঠীদা, ও ষষ্ঠীদা!’’
ষষ্ঠীদার প্রথমে ঘুম ভাঙল না, তারপর আরো দু-তিনবার ডাকা-ডাকিতে হঠাৎ করে ধড়ফড়িয়ে উঠে সোজা হয়ে বসে আমার দিকে লাল চোখে তাকাল, ‘‘হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু বলুন! কী হয়েছে? বডি এসেছে কোনো?’’
আমি শান্তভাবেই বললাম, ‘‘না৷ বডি পালিয়েছে৷’’
ষষ্ঠীদা আমার দিকে তাকাল হাঁ করে, ‘‘অ্যাঁ! মা-মানে?’’
‘‘মানে কালকের বডিটা কোল্ড স্টোরেজের ভল্টে নেই৷ ট্রে ফাঁকা৷ আপনি রেজিস্টারটা বের করুন৷’’
ষষ্ঠীদার প্রায় কেশহীন ভ্রূ দুটো বিস্ময়ে অনেকটা উপরে উঠে গেল, ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে গেল, কিন্তু আমাকে কোনো প্রশ্ন করল না, জলদি হাতে রেজিস্টার খুলতে লাগল, ‘‘সে কী কথা স্যার! এইরকম তো কোনোদিনও শুনিনি জীবনে!’’
আমি উত্তর দিলাম না৷ চিন্তায় আমার মাথার ভেতরের স্নায়ুগুলো চঞ্চল হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে৷
‘‘লালবাজারে জানিয়েছেন ডাক্তারবাবু?’’ ষষ্ঠীদা আবার প্রশ্ন করল৷
ষষ্ঠীদার কথায় আমার হুঁশ এল, তাই তো! আগে তো ওখানে জানানো উচিত, আমাদের এখানকার সবকিছুই কন্ট্রোলড হয় ওখান থেকে৷
আমি ষষ্ঠীদার টেবিলের ল্যান্ডফোন থেকে লালবাজারের ডায়াল ঘোরাচ্ছিলাম, এমন সময় ঘরে ঢুকল লাল্টু, ‘‘পবিত্রদা, আটান্ন নম্বরও ফাঁকা!’’
আমি টেলিফোনটা কেটে দিয়ে বললাম, ‘‘মানে?’’
‘‘মানে, আটান্ন নম্বর ট্রে-তেও কোনো বডি নেই৷’’ পেছন থেকে বলল ইরফান৷
আমি দিশেহারা ভাবে ষষ্ঠীদার দিকে তাকালাম৷
আটান্ন নম্বর তো আনআইডেন্টিফায়েড বডি, এখানে পড়ে রয়েছে অন্তত মাসদুয়েক৷
কবে খোয়া গেছে ওটা?
অনেক সময় অভিজ্ঞতা শিক্ষার চেয়ে বেশি বড় হয়ে ওঠে৷ এক্ষেত্রেও সেটাই হল৷ আমার অনভিজ্ঞ বুদ্ধি যেখানে হোঁচট খাচ্ছিল, ষষ্ঠীদা সেখানে হঠাৎই অ্যাক্টিভ হয়ে উঠল, ‘‘দাঁড়ান ডাক্তারবাবু, আগেই লালবাজারে ফোন করবেন না, ওরা এসে পড়লে প্রথমেই আমাদের ধরবে, কোল্ড স্টোরেজের ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরাটা আপনি আসার আগে থেকেই খারাপ, ভুলে গেছেন? কেন এখনো সারানো হয়নি তাই নিয়ে জেরা করবে, তার চেয়ে আগে বরং গার্ড দুটোকে ডাকুন, ওরা কী বলে দেখি৷’’
আমি থতোমতো খেয়ে ফোনটা বন্ধ করলাম, ষষ্ঠীদা একদম ঠিক বলেছে৷ আমি আসার আগে আগেই শুনেছিলাম ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরাটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল, আমি এসে চার্জ বুঝে নেওয়ার পর ডঃ সরখেলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কোথায় রিকুইজিশন পাঠাতে হবে৷ উনিও তারপর কাজের মধ্যে ভুলে গেছেন, আমারও গড়িমসি করে করা হয়নি৷
এমনিতে সারা মর্গে কোথাও ক্যামেরা থাকে না, শুধু ওই কোল্ড স্টোরেজে, সেটাও খারাপ৷
আমি লাল্টুর দিকে তাকালাম, ‘‘চট করে গিয়ে যোগিন্দর আর ভূপতিকে ডেকে আনো তো!’’
লাল্টু ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল৷
আমি রুমাল দিয়ে কপালের বিন্দু বিন্দু ফুটে ওঠা ঘামটা মুছলাম, ‘‘ষষ্ঠীদা, আটান্ন নম্বর বডির রেকর্ড চেক করুন তো, কবে এসেছিল, কী কেস?’’
ষষ্ঠীদা এমনি যতই বুড়ো থুত্থুরে হোক, এখন দেখলাম খুব চটপটে হয়ে উঠল, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আনক্লেইমড আর আনআইডেন্টিফায়েড বডির রেজিস্টার থেকে বের করে ফেলল সব ডিটেইলস, ‘‘আজ্ঞে, গত মাস, মানে জুলাইয়ের তিন তারিখে এসেছে, পাঠিয়েছে বিধাননগর কমিশনারেট থেকে, নারকেলবাগান মোড়ে প্রচণ্ড রোদে মাথা ঘুরে পরে গিয়েছিল, আর জ্ঞান ফেরেনি৷ কোনো খোঁজও পাওয়া যায়নি৷ বয়স ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর, পুরুষ৷’’
সান স্ট্রোক, তার মানে শরীরে কোথাও ইনজুরি নেই৷
কালকেরটারও রিপোর্ট দেখেছিলাম পয়জন কনজিউম করে সুইসাইডের কেস, সেটাও ইয়ং মেল, তার মানে ওই বডিটাও ড্যামেজড নয়৷
কোনো পাচার চক্র নয় তো?
সেদিনই একটা বিদেশি মেডিক্যাল জার্নালে পড়ছিলাম মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আর টিস্যু পাচার রমরমিয়ে বেড়ে উঠছে, বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে৷ কিডন্যাপ করে কয়েকঘণ্টা অ্যানাস্থেশিয়া করে রেখে ফুসফুস, লিভার, প্যানক্রিয়াস, কিডনি, চোখের কর্নিয়া বের করে নিচ্ছে, তারপর ক্ষতবিক্ষত বডি ফেলে পালিয়ে যাচ্ছে৷ এমনকি হূৎপিণ্ড অবধি পাচার হচ্ছে৷ সারা পৃথিবী জুড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুর আগের মুহূর্তে গিয়ে অপেক্ষা করছেন অরগ্যান ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য, তাঁদের মধ্যে অনেকের কাছেই টাকাটা কোনো ইস্যু নয়৷ বিভিন্ন হাসপাতালের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়ে সেইসব জায়গাতেই পাঠানো হচ্ছে এইসব অরগ্যান, সাপ্লাই করা হচ্ছে টিস্যু, চড়া দামে বিক্রি করা হচ্ছে৷ বিদেশে নাকি একটা লিভার দেড় লক্ষ মার্কিন ডলারেরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে, ফুসফুস বা হূৎপিণ্ড প্রায় দু-আড়াই লাখ ডলার, মানে ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় দেড় কোটি টাকা৷
সেইরকমই কোনো গ্যাং কি কলকাতাতেও ঘাঁটি গাড়ল নাকি! কিন্তু এগুলো তো বহুদিনের প্রিজারভড বডি, এগুলোর অরগ্যানগুলো তো কোনো কাজে লাগার কথা নয়৷
সঞ্চয়িতা একটু পরে ফোনে সব শুনে-টুনে অবশ্য একটা ভালো পয়েন্ট বলল, ‘‘আমার তো মনে হয়, হেড অফিস হ্যারাস করলেও তোমার আগে ব্যাপারটা জানানো উচিত৷ থ্রু প্রপার চ্যানেল এগোও৷ আর অরগ্যানই যে হবে ভাবছ কেন, হাড় পাচার করার গ্যাং হতে পারে, কিংবা ধরো স্কেলেটনের, ওগুলোরও তো খুব ডিম্যান্ড!’’
আমি আরো চিন্তায় পড়ে গেলাম৷ এরকম কিছু হলে তো চিন্তার ব্যাপার৷ হ্যাঁ, কঙ্কাল পাচারের গ্যাং-ও আছে বটে৷ কিন্তু কলকাতাতে তাদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়নি আজ অবধি, যতদূর জানি৷
সবচেয়ে বড় কথা, ওই আটান্ন নম্বরের পুরোনো বডিটা কবে চুরি হয়ে গেছে আমরা বুঝতেই পারিনি, আর সেটার পর চোরেদের সাহসও বেড়ে গেছে, তারা নিশ্চিন্তে দু’নম্বর বডিটা সরিয়েছে কাল৷
ভূপতি আর যোগিন্দর একসঙ্গেই এল, যদিও আজ সকালে ডিউটিতে আছে ভূপতি, কিন্তু খবর পেয়ে কোয়ার্টার থেকে যোগিন্দরও চলে এসেছে৷
আমি ষষ্ঠীদার উল্টোদিকের চেয়ারে বসেছিলাম, ‘‘কাল রাতে কে ডিউটিতে ছিল?’’
‘‘হামি সাহাব! কাল রাতে আটটায় এসেছিলাম, আজ সকালে ভূপতিদা আসার পর চলে গেছি৷’’ যোগিন্দর রাত জাগা ক্লান্ত মুখে জবাব দিল৷ চোখেমুখে স্পষ্ট ভয়ের ছায়া৷
আমি ষষ্ঠীদার রেজিস্টারের দিকে তাকালাম, কাল উনিশ নম্বরের বডিটা ঢুকেছিল ঠিক বিকেল চারটে বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিটে, তখন ডিউটিতে ছিল ভূপতি, তারপর আমরা ছ’টা সাড়ে ছ’টা নাগাদ সবাই বেরিয়ে গেছি, আটটায় এসেছে যোগিন্দর, আবার আজ সকাল আটটায় ডিউটি হ্যান্ড ওভার হয়েছে ভূপতির হাতে৷
এর মধ্যেই একটা আস্ত লাশ পাচার হয়ে গেল?
আমি যোগিন্দরের দিকে একটু কড়া চোখে তাকালাম, ‘‘কাল রাতে কি গাঁজা-টাজা খেয়েছিলে?’’
‘‘হুজুর হনুমানজি কা কসম! হামি অন ডিউটি কুছ নেহি খাতে হ্যায়!’’ যোগিন্দর হাঁউমাউ করে উঠল, ‘‘গেটের সামনে সিধে হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম হোল নাইট সাহাব, কুচ্ছু সাউন্ড ভি পাইনি!’’
আমি একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলাম৷ কলকাতা পুলিশের একমাত্র মর্গ থেকে দু-দুটো লাশ গায়েব, তাও আবার একসঙ্গে নয়, প্ল্যানমাফিক কিছুদিন আগে পরে, মিডিয়া জানতে পারলে তো হয়ে গেল, মহাকরণ নড়েচড়ে বসবে, তারপর সেখান থেকে লালবাজারের ওপরমহলে ছোটাছুটি হবে, শেষমেষ দায় এসে পড়বে আমার আর লাল্টুর ভাষায় আমার পেছনে আগুন জ্বলে যাবে!
নাহ! এই চাপ আর নিতে পারছি না, একটা সিগারেট খেতেই হবে৷
আমি মর্গ থেকে বেরিয়ে বাইরের রাস্তায় এসে একটা সিগারেট ধরালাম৷ দু-তিনবার বড় বড় ধোঁয়া ছেড়ে যেন মাথাটা একটু পরিষ্কার হল৷
এমনিতে আমি খুব একটা ধূমপান করি না, কিন্তু কিছু কিছু সময় এতটাই চিত্তবৈকল্য এসে পড়ে, তখন না খেয়ে পারা যায় না৷
উল্টোদিকে ঝুনঝুনওয়ায়ালার বিশাল ওষুধের দোকান, সেখানে খদ্দের গিজগিজ করছে৷ সেদিকে তাকিয়ে ভাবলাম, ওদের জিজ্ঞাসা করে একবার দেখব কি? ওদের দোকান সারারাত খোলা থাকে৷
পরক্ষণেই ভাবলাম, পুলিশ এসে যা করার করবে, আমি আর মাথা ঘামাব না, যা আছে কপালে, তাই হবে৷
৩
আমি ফোন করার আগে মনে মনে পুরো ব্যাপারটা ছকে নিচ্ছিলাম৷ লালবাজারে জানানোর আগে পুরো জিনিসটা বুঝে নেওয়া উচিত৷ আমাদের এই মর্গটা অনেকটা পুরোনোদিনের গির্জা প্যাটার্নের, সামনেটা একটা মস্ত মরচে পড়া লোহার গেট, সেটা পেরিয়ে সামান্য খোলা জায়গা আগাছায় ভরে রয়েছে, সেটা পেরিয়ে গিয়ে প্রধান কোল্যাপসিবল গেট৷ আমরা বেরিয়ে গেলে বাইরের গেটে চাবি দিয়ে ভেতরের কোল্যাপসিবলের পাশে বসে থাকে গার্ডরা৷
কোল্যাপসিবলটা পেরিয়েই লম্বা করিডর শুরু, তার দুপাশে বেশ কয়েকটা ঘর৷ কিছুটা এগিয়ে গেলেই করিডরটা আরো দুটো করিডরে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, সেই দুটো করিডর কোনাকুনি বেঁকে যাচ্ছে দুপাশে, সেদুটোরও দুপাশে ঘর৷ বাঁদিকের করিডরটা দিয়ে গিয়ে বাঁদিকে দু-নম্বর ঘরটা হল কোল্ড স্টোরেজ৷ দুটো করিডর শেষে গিয়ে আবার মিশেছে একটায়, সেখানে রান্নাঘর, তারপর টয়লেট আর কিছু স্টোরেজ রুম৷ সবশেষে পেছনের দরজা, যেটা বন্ধই থাকে, বাইরে থেকে সেটা খোলার কোনো উপায় নেই৷
তাহলে?
আমি ভূপতি আর যোগিন্দরকে যেতে বলে ষষ্ঠীদার দিকে তাকালাম, ‘‘কী করি বলুন তো? ডঃ সরখেলকে ফোন করে জানাব আগে?’’
‘‘না না ওটি করবেন না!’’ হাঁ হাঁ করে উঠল ষষ্ঠীদা, ‘‘উনি তো ঘুরতে গেছেন৷ আর তাছাড়া, আপনি নতুন এসেছেন তো, জানেন না, উনি লোক ভালো নন৷ লাভ তো হবেই না, উল্টে মিডিয়ায় জানাজানি করে একাকার করবেন, ওর উইকেও যে আগের বডিটা চুরি হতে পারে, সেটা পুরো অস্বীকার করে আপনার ঘাড়ে দোষ চাপাবেন৷ ওর পেছনে অনেক বড় মাথাও আছে৷ দেখলেন না, সি এম ভিজিটের পর ওই ইঁদুরের কেসটা কেমন পুরোটাই ডঃ বটব্যালের উপর চাপিয়ে দিয়ে ওনাকে ট্রান্সফার করে দিল, আর নিজের গায়ে একটা দাগ পর্যন্ত লাগতে দিল না! আপনার নতুন চাকরি, এখনই ওর পাল্লায় পড়বেন না, তার চেয়ে আপনি বরং লালবাজারেই জানান, আর দেরি করে লাভ নেই, যা হবার হবে৷’’
আমি মাথা নাড়লাম৷ সঞ্চয়িতাও সেটাই বলল৷
দরজায় একটা শব্দ পেয়ে দেখি মালতী মাসি ঢুকছে, হাতে বড় বড় দুটো টিফিন ক্যারিয়ার৷ আগেই বলেছি মালতী মাসি আমাদের রাঁধুনি৷ যদিও এই বাড়িতে রান্নার অ্যারেঞ্জমেন্ট আছে, রান্নাঘরও রয়েছে, কিন্তু এই পরিবেশ বলে আমরা ইচ্ছে করেই এখানে রান্না করাই না৷ একটু দূরে পুলিশের পরিত্যক্ত ব্যারাকের দুটো ঘর আছে, কেউ থাকে না সেখানে৷ মালতী মাসি সকালের চা-টা দিয়েই আগে চলে যেত সেই ঘরে, সেইখানে রান্না করে নিয়ে আসত এখানে৷ কিন্তু আমি আসার চার-পাঁচমাস আগে ওখানে মারাত্মক সাপের উপদ্রব শুরু হওয়ায় এখন মাসি নিজের বাড়ি থেকে রান্না করে নিয়ে আসে৷
সকাল-বিকেলের চা, কোনো-কোনোদিন টুকটাক জলখাবার এইগুলো এই বাড়ির ছোট রান্নাঘরেই করে৷ তারপর আমাদের সঙ্গেই সন্ধেবেলা চলে যায় তার বাড়ি৷ সেটাও কাছেই, হাঁটা পথ৷
আমি বললাম, ‘‘মাসি, আজ একটু পরে খাব৷ কাল তুমি কখন বেরিয়েছিলে মনে আছে?’’
মাসি বলল, ‘‘কাল তো আপনারা বেরোলেন, তারপরেই আমি বাসনগুলো মেজে রান্নাঘরে রেখে চলে গেলাম৷ ভূপতিদা ছিল তো, বলে গেলাম যে?’’
‘‘না সে ঠিক আছে৷’’ ষষ্ঠীদা বলল, ‘‘তুমি বাসন মাজার পর দরজা ঠিকঠাক বন্ধ করেছিলে তো?’’
সবার খাওয়া হয়ে গেলে বিকেলে মালতী মাসি যায় পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে কলে থালাবাসনগুলো ধুতে৷ ধুয়ে নিয়ে এসে আবার সে-ই দরজা বন্ধ করে দেয়৷
কিন্তু সে তো সবাই থাকতে থাকতেই!
তবে অনেকগুলো ঘর খোলাই হয় না, সেগুলোর জানলা দরজাগুলো অক্ষত আছে কি? জানলা ভেঙেও তো ঢুকতে পারে৷ ভূপতিরা রোজ নিয়ম করে সব ঘর টহল দেয় বলেও তো মনে হয় না৷
আর তাছাড়া মর্গেও যে চুরি হতে পারে, তাও আবার লাশ, সেটা কে ভাবতে পারে?
আমি আর দেরি করলাম না, যা থাকে কপালে, ফোন করে সব জানালাম লালবাজারে৷
পুলিশ যখন এল, তখন আমরা খেতে বসেছিলাম৷ অন্যদিন সবাই মিলে পেছনের ঘরটায় খাই, আজ ষষ্ঠীদার ঘরেই খেয়ে নিচ্ছিলাম তাড়াতাড়ি, কারোরই মেজাজ ঠিক নেই৷
লালবাজার থেকে যে ইনস্পেক্টর এলেন, তাঁকে আমি চিনি৷ এই এক মাসেই রুটিন হেলথ চেক আপে আমার কাছে এসেছিলেন দুবার লালবাজারের ওই মেডিকেল রুমে৷ নামটাও মনে আছে, আশিস সেনগুপ্ত৷ বয়স আমাদেরই মতো হবে৷ পেটাই চেহারা, চুলবুল পান্ডের আদলে চোখে একটা কালো সানগ্লাস, বেশ জবরদস্ত অ্যাপিয়ারেন্স৷
আশিসবাবু এসেই আমার দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসলেন, ‘‘কী ব্যাপার ডাক্তারবাবু?’’
আমি আমতা আমতা করে পুরো ব্যাপারটা ওঁকে খুলে বললাম৷ তারপর কোল্ড স্টোরেজে নিয়ে গিয়ে সব দেখালাম৷ ওঁর সঙ্গে আসা দুজন কনস্টেবল সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটার কিছু ছবি তুলে নিল৷
পুরো কোল্ড স্টোরেজের লম্বা হলঘরটা আশিসবাবু খুঁটিয়ে দেখছিলেন৷ পুরো ঘরটাই রিসার্চ ইন্সটিটিউটের ল্যাবরেটরির আদলে ক্লোজড, মোট বারোটা এসি চলছে সব মিলিয়ে৷ একপাশে এতগুলো রেফ্রিজারেটর চালু রাখার যে বিশাল আপৎকালীন জেনারেটর, তারও একটা ছোট্ট ঘর রয়েছে৷
আশিসবাবু বললেন, ‘‘এই ঘরের চাবি কার কাছে থাকে?’’
আমি বললাম, ‘‘আমার আর ডঃ সরখেলের কাছে তো একটা করে থাকেই, এ ছাড়া আমাদের ডোম লাল্টুর কাছেও রাখা থাকে৷’’
‘‘ডঃ সরখেলকে জানিয়েছেন?’’
‘‘উনি এই সপ্তাহটা ছুটিতে আছেন, কোথায় একটা ঘুরতে গেছেন স্যার৷’’ ষষ্ঠীদা পাশ থেকে বলে উঠল৷
হলের চারকোনায় চারটে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা তাকিয়ে রয়েছে আমাদের দিকে৷ সেদিকে তাকিয়ে আশিসবাবু বললেন, ‘‘ফুটেজ দেখার মনিটরটা কি আপনার ঘরে?’’
আমি মিনমিন করে বললাম গণ্ডগোলটা৷
শুনে-টুনে আশিসবাবু মাথা নেড়ে চুপ করে গেলেন৷ এদিক ওদিক ঘুরে এগিয়ে গেলেন উনিশ নম্বর ভল্টের দিকে৷ হাতল ধরে টানতেই ফাঁকা ট্রে বেরিয়ে এলো বাইরে, ‘‘এর মধ্যে কালকের বডিটা ছিল?’’
‘‘হ্যাঁ৷’’ আমি উত্তর দিলাম৷
বডি রাখার ভল্টগুলো ছোটখাটো চৌকো শেপের ফ্রিজের মতো, তবে পেছন দিকে অনেকটা লম্বা৷ যদিও আমি যখন দিল্লির এইমসে ছিলাম, সেখানকার মর্গে এই ফ্রিজগুলোতেও লক করার সিস্টেম ছিল, আমাদের এখানে তা নেই৷
হঠাৎ ঝুঁকে পড়ে আশিসবাবু মেঝে থেকে কিছু একটা কুড়িয়ে নিলেন৷ আমি উঁকি মেরে দেখলাম, একটা ছোট পাতা, সবুজ রঙের, একদিকটা গুটিয়ে এসেছে কিছুটা, তাতে সামান্য কাদাও লেগে রয়েছে যেন৷
‘‘এই ঘরটা কি রোজ পরিষ্কার করা হয়?’’ পাতাটা দেখতে দেখতে আশিসবাবু জিজ্ঞাসা করলেন৷
আমি সত্যি কথাই বললাম, ‘‘না না৷ ছ’সাত মাস অন্তর, মানে কোনো ভিজিট-টিজিট থাকলে৷ আমাদের তো ফুলটাইম সুইপার কেউ নেই৷’’
এরপর আশিসবাবু এগিয়ে গেলেন আটান্ন নম্বর ভল্টটার দিকে, সেখানটাও ঘুরে ফিরে দেখলেন৷ তারপর মাথা নেড়ে এগিয়ে এলেন, ‘‘হুম৷ ঠিক আছে, চলুন বাইরে গিয়ে বসা যাক৷’’
আমরা বেরিয়ে আসতে কনস্টেবল দুটো ঘরটা সিল করে দিল৷ ভেতরে যারা শুয়ে রইল, হঠাৎ করেই তাদের জন্য আমার মনটা কেমন করে উঠল, এই থমথমে করিডরে দাঁড়িয়ে তাদের নিরাপত্তার অভাব অনুভব করলাম যেন বড্ড৷
এরা চিরঘুমে ঘুমোচ্ছে, কাউকে বিরক্ত করছে না, কারা তাতেও ব্যাঘাত ঘটাতে চাইছে?
আশিসবাবু এরপর আর ষষ্ঠীদার ঘরে গেলেন না, এসে বসলেন আমার ঘরে৷ আমার উল্টোদিকের চেয়ারে বসে দু-একটা জায়গায় ফোন করে কিছু নির্দেশ দিলেন, তারপর চিন্তিতভাবে বললেন, ‘‘ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরাটা ফাংশনাল থাকলে কোনো চিন্তা ছিল না৷ এই রিসেন্ট ওই ইঁদুরের কেসটা হয়েছিল তো, তারপর থেকে এদিকে হায়ার অথরিটির নজর আছে৷’’ একটু থেমে বললেন, ‘‘যাই হোক, আপাতত আমি সবার জবানবন্দিগুলো নিয়ে যাই, তারপর আবার আসতে তো হবেই৷’’
প্রথমেই ডাকা হল ইরফানকে৷
আমি একপাশে চুপ করে বসে রইলাম, আশিসবাবু একে একে প্রশ্ন করতে লাগলেন৷
অতিরিক্ত কথা কিছুই পাওয়া গেল না তেমন৷ আমি যা বললাম ইরফানও সেই কথাই বলল৷ লাল্টুও তাই৷ আসলে আমরা তিনজন তো মোটামুটি একসঙ্গেই আসা যাওয়া করি, কাজেই সবাই একই জানি৷
ষষ্ঠীদার কাছ থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া লাশ দুটোর ডিটেইলস নিয়ে এরপর আশিসবাবু ডাকলেন ভূপতি আর যোগিন্দরকে৷ কিন্তু তাদের নিয়ে বসে রইলেন না, ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন পুরো বাড়িটা৷ অগত্যা আমিও সঙ্গে ছিলাম৷
পোস্টমর্টেম যে ঘরে হয়, সেই ঘরে ঢুকে অপারেশন টেবিল, দেরাজ সব পরখ করলেন আশিসবাবু, তারপর গেলেন অতিরিক্ত পোস্টমর্টেম ঘরে৷ তারপর একে একে সব বাড়তি ঘরগুলোয়৷
কিছুই তেমন পাওয়া গেল না৷ ভূপতি আর যোগিন্দর, ওরা কেউই কোনো অস্বাভাবিকত্ব লক্ষ করেনি কাল৷
‘‘কাল তোমরা কখন এই দরজাটা বন্ধ কি না দেখতে এসেছিলে?’’ পেছনের দিক দিয়ে বেরোনোর দরজাটা খুলে সেইখানে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন আশিসবাবু৷
‘‘আজ্ঞে!’’ ভূপতি বলল, ‘‘এদিকটা তো বন্ধই থাকে, মালতীদি বাসন ধুয়ে আবার ছিটকিনি দিয়ে দেয় ভেতর থেকে, তাই এদিকটা তো দেখিইনি৷’’
এর মধ্যেই মালতী মাসি চা নিয়ে এসেছে সবার জন্য, চায়ের পেয়ালায় একটা চুমুক দিয়ে আশিসবাবু মালতী মাসির দিকে তাকালেন, ‘‘আপনি এখানে কতবছর ধরে কাজ করছেন?’’
‘‘এই চার বছর মতো স্যার!’’ মালতী মাসি শান্তভাবে জবাব দেয়৷
‘‘কোথায় থাকেন?’’
মালতী মাসি বলল, ‘‘দাসপাড়া আছে না? ওরই ভেতরে৷’’
‘‘হুম৷’’ আশিসবাবুর চা-টা যে বেশ পছন্দ হয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে, ‘‘রান্নাঘরটা কোনদিকে?’’
মালতী মাসি মাথা নেড়ে কী বলতে যাচ্ছিল, আমি ওকে থামিয়ে দিয়ে রান্নার ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম আশিসবাবুকে৷ মালতী মাসি তো আর পুলিশের লোক নয়, পুলিশি জেরায় খামোখা ভয় পেয়ে যাবে৷ মালতী মাসি যে রান্না করে নিয়ে আসে আর বাকি সময় বাজারে আনাজ বিক্রি করে, সেটা আশিসবাবুকে বুঝিয়ে বললাম আমি৷
আশিসবাবু মর্গ থেকে বেরিয়ে বাইরে কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করলেন লোকজনকে, তারপর চলে গেলেন৷
কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলাম আমরা সবাই, তারপর বাড়ি ফেরার তোড়জোড় করতে লাগলাম৷ মনটা ভালো লাগছে না একদম, কপালে কী আছে কে জানে! আশিসবাবুর সঙ্গে আসা কনস্টেবল দুটো কিন্তু যায়নি, ওরা আজ আমাদের গার্ডের সঙ্গে এখানে থাকবে৷
এখনো অবধি আমাদের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আসেনি, কাজেই আমরা বাড়ি চলে যেতে পারি৷
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালাম৷
৪
বিরস ক্লান্ত মুখে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে রওনা দিলাম বাড়ির দিকে৷ অন্যদিন বাসে-মেট্রোয় বাড়ি যাই, কিন্তু আজ যেন শরীর আর চলছে না, অথচ কায়িক শ্রম বলে কিন্তু কিছুই হয়নি আজ, তবু স্নায়ুর চাপে সবকটা মাংসপেশী যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করছে৷
ট্যাক্সিতে উঠে একটা সিগারেট ধরিয়ে সঞ্চয়িতাকে ফোন করলাম৷ ভাবলাম অন্য ব্যাপার নিয়ে কথা বলে স্ট্রেসটাকে একটু কাটাব, কিন্তু যা হয়, এই নিয়েই কথা চলতে লাগল৷
সঞ্চয়িতা বলল, ‘‘আচ্ছা তোমাদের গার্ড দুটো এরকম কোনো গ্যাঙের সঙ্গে যুক্ত নেই তো? ওদের পক্ষেই কিন্তু লাশ সরানোটা সবচেয়ে সোজা৷’’
আমি বললাম, ‘‘কিন্তু সরিয়ে নিয়ে যাবেটা কোথায় বলো তো? আমাদের গেট পেরিয়ে লাশ নিয়ে যদি কোনো গাড়িতেও ওঠাতে যায়, উল্টোদিকেই তো ঝুনঝুনওয়ালাদের অতবড় মেডিকেল স্টোর, চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে৷ আজ মর্গ থেকে বেরিয়ে পুলিশের ওই ইনস্পেক্টর ওদের সব জিজ্ঞাসা করেছেন, সবাই একবাক্যে বলেছে ভূপতি আর যোগিন্দরকে কেউ কোনোদিনও রাতে গেটের পাশ ছেড়ে কোথাও যেতে দেখেনি, গাড়ি আসা তো দূর৷ হ্যাঁ, কখনো সখনো হয়তো ঘুমে ঢুলছে সেটা দেখেছে, কিন্তু এইসব…!’’
সঞ্চয়িতা বলল, ‘‘আর তোমাদের ওই মাসি যে দরজা দিয়ে বাসন মাজতে বেরোয়, সেইখান দিয়ে যদি গার্ড দুটো নিয়ে যায়?’’
আমি হেসে বললাম, ‘‘ধুস! তুমি তো কখনো আসোনি এখানে, আমার থেকে শুনে আর কী বুঝবে! আমাদের মর্গের পেছনেই বিশাল ঝোপজঙ্গল৷ দু-একটা পুরোনো ব্যারাক আছে পুলিশের, তারপর বিরাট পাঁচিল৷ ওদিক দিয়ে গেলে সাপখোপেই মরে যাবে, লাশ নিয়ে যাওয়া তো দূর, নিজেরাই লাশ হয়ে যাবে৷ মালতী মাসিই ভয়ে ভয়ে কোনোমতে কলতলায় বাসনগুলো মেজে চলে আসে৷’’
সঞ্চয়িতা কী বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই দেখলাম বিপ বিপ করে আরেকটা ফোন ঢুকতে লাগল৷ সঞ্চয়িতাকে ছাড়তে বলে পরের ফোনটা রিসিভ করলাম আমি, ‘‘হ্যালো?’’
‘‘ডঃ পবিত্র লাহিড়ি তো? আমি আশিস সেনগুপ্ত বলছি, লালবাজার থেকে৷’’
‘‘হ্যাঁ স্যার, বলুন!’’ আমি মুহূর্তেই সোজা হয়ে বসলাম৷
রিপোর্ট এর মধ্যেই লিখে ফেলল নাকি? করিৎকর্মা তো!
কে জানে কী লিখল লোকটা!
‘‘আপনি কি বেরিয়ে গেছেন?’’
আমি বললাম, ‘‘হ্যাঁ মানে, সন্ধের পর তো আর কোনো কাজ হয় না, আর আমার কাছে তো আর কিছু ইন্সট্রাকশনও ছিল না যে থাকতে হবে…!’’
‘‘না না, সে ঠিক আছে৷’’ আশিসবাবুর আশ্বস্ত করা গলা শোনা যায় ওপাশ থেকে, ‘‘বলছি, আমি আসার পর আমাদের কিছু লোক পাঠিয়েছিলাম পুরো জায়গাটা সার্চ করতে৷ একটা বডি ওরা পেয়েছে৷ মোস্ট প্রোব্যাবলি কালকেরটাই৷ আপনি একবার এলে খুব ভালো হয়৷ কাল সকাল হলে অনেকটা দেরি হয়ে যাবে তো!’’
‘‘অ্যাঁ!’’ আমি ধড়মড় করে ট্যাক্সিওয়ালাকে গাড়ি ঘোরাতে বললাম, ‘‘এই ভাই, ঘোরাও গাড়ি ঘোরাও শিগগিরই!’’
‘‘আরে স্যার, এটা তো ওয়ান ওয়ে, ঘোরাব কী করে? এই তো বললেন টালিগঞ্জ যাবেন!’’ ট্যাক্সিওয়ালা বেজায় বিরক্ত৷
‘‘বলেছিলাম, কিন্তু এখন আর যাব না, যেখান থেকে উঠেছিলাম সেখানেই যাব, তুমি ভাই কাঁটাপুকুরেই চলো আবার, তোমায় একশো টাকা বেশি দেব!’’ আমি কোনোমতে কথা ক-টা বলে আবার ফোন কানে দিলাম, ‘‘আমি এখুনি আসছি স্যার! এর মধ্যেই পেয়ে গেলেন? কোথায়?’’
আশিস সেনগুপ্তের চাপা গলা শোনা গেল, ‘‘হ্যাঁ, একদম কাঁচা কাজ৷ আপনি একাই আসুন৷ আর ইরফান বা লাল্টুকে কিছু জানাবেন না, ওদের দরকার নেই৷ মর্গের একদম কাছ অবধি না এসে ঝুনঝুন-ওয়ালার দোকানের একটু আগে দাঁড়াবেন, আমার লোক গিয়ে আপনাকে নিয়ে আসবে৷’’
ওদিকে ট্যাক্সিওয়ালা গজগজ করতে করতে গাড়ি অন্য একটা গলিতে ঢুকিয়েছে৷ এই এক হলুদ ট্যাক্সিদের নিয়ে ঝামেলা, এমনিই যেতে চায় না, তার ওপর একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই এদের মেজাজ!
চলে এসেছি প্রায় কুড়ি মিনিট মতো রাস্তা, যেতে যেতে উত্তেজনায় আমার শরীর গরম হয়ে যাচ্ছিল৷
মর্গের কাছাকাছি যেতে বলেছে, তার মানে ওখানেই কোথাও?
তাহলে কি অরগ্যান পাচারের আশঙ্কাটাই ঠিক?
ঝুনঝুনওয়ালার দোকানের উল্টোদিকে নামতেই টুপি মাথায় লোকটাকে দেখতে পেলাম৷ পুলিশ, তা সে যতই সিভিল ড্রেসে থাকুক, দেখেই চিনতে পারি অন্তত এই কদিন একসঙ্গে কাজের সূত্রে৷ ওদের চাউনিটাই আলাদা হয়৷
এদিকে ট্যাক্সিওয়ালাটা তো দেখি মহা বেয়াদপ, বলে দুশো টাকা এক্সট্রা দিতে হবে, ফিরতি পথে প্যাসেঞ্জার পাবে না৷ একবার ভাবলাম, বাছাধন জানে না একটু দূরেই পুলিশ দাঁড়িয়ে রয়েছে আর আমিও পুলিশেরই ডাক্তার, দিই ব্যাটাকে কড়কে৷
কিন্তু এইসময় আর ঝামেলা করতে ভালো লাগল না৷ টাকাটা দিয়ে এগিয়ে গেলাম লোকটার দিকে৷
লোকটা কিছু না বলে আমার দিকে একবার ইশারা করে হাঁটতে শুরু করল৷ পকেটে একটা হাত ঢোকানো, অন্য হাতটা ধীরে ধীরে একই তালে দুলে দুলে চলছে পায়ের গতির সঙ্গে৷
এগিয়ে গিয়ে পা মেলালাম লোকটার সঙ্গে, ‘‘কোথায় পাওয়া গেছে বলুন তো? আশিসবাবু কোথায়?’’
লোকটা সংক্ষেপে উত্তর দিল, ‘‘মর্গের পেছনের জঙ্গলে৷ এদিক দিয়ে আসুন৷’’ বলে ঝুনঝুনওয়ালার দোকান থেকে ডানদিকে ঘুরে মর্গের সামনের দিকে যাওয়ার কথা, কিন্তু তা না করে লোকটা বাঁদিকের একটা সুঁডিপথ ধরল৷ গলিটা সরু, কোনোমতে একটা রিকশা ঢুকতে পারে, এমন চওড়া, কিন্তু অসম্ভব নোংরা এবং অন্ধকার, ফলে যাতায়াত নেই তা সহজেই অনুমেয়৷
গলিটার ঢোকার মুখে দেখতে পেলাম এটা এমন একটা জায়গা কেউ এখান দিয়ে ঢুকলে বাইরের কেউ বুঝতে পারবে না, রাস্তা থেকেও ঠাহর করা যাবে না৷
এই এক মাসে এই গলিতে কখনো না ঢুকলেও আন্দাজে বুঝতে পারছিলাম এই গলিটা দিয়ে ঘুরপথে আমাদের মর্গের পেছন দিকটায় যাওয়া যায়৷ গলিতে ঢোকার আগে অস্পষ্ট ডানদিকে দূরে মর্গের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা যোগিন্দরকে এক ঝলক মনে হল যেন পাহারা দিতে দেখলাম৷
অন্ধকারে লোকটা একটা টর্চ জ্বালল৷ সেই টর্চের আলোয় আমরা দুজন খচরমচর পাতা মাড়িয়ে এগোতে থাকলাম৷ যত এগোচ্ছি, এইদিকটা ধীরে ধীরে কেমন জলা জলা হয়ে পড়ছে৷ গলিটা গিয়ে শেষ হয়েছে আমাদের মর্গের পেছনদিকের জঙ্গলে৷ ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকে মনে হচ্ছে এরপর নিজেদের কথাও শুনতে পাব না৷
আমি আড়ষ্টভাবে হাঁটছিলাম৷ বিড়াল জাতীয় কোনো একটা জন্তুর ওপর মনে হয় একবার পা পড়ল, সেটা একটা চিৎকার করে ছুটে পালাল৷
‘‘দেখে হাঁটুন, এখানে কিন্তু খুব বেজির উপদ্রব৷’’ লোকটা এতক্ষণ বাদে কথা বলল, ‘‘একটু আগে এখান দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের একজনের পায়ে কামড়েছে৷ আসলে কালকের বডিটা দুর্গাপুরের এক এম এলএ-র ছেলের বডি, উপরমহল থেকে চাপ আসছিল, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট জলদি চাইছে৷ এদিকে বডিই গায়েব, কী অবস্থা বলুন তো! তাই আশিসস্যারের অর্ডারে আমরা বিকেল থেকেই এইদিকটায় ছিলাম, আপনারা টের পাননি৷’’
‘‘তারপর?’’ পায়ের নীচের দিকটা চুলকোতে চুলকোতে বললাম আমি৷ কথা বলতে বলতে আমরা পৌঁছে গেলাম পেছনদিকটায়৷ অস্বীকার করব না, আমার একটু ভয় ভয় করছিল৷
আমাদের মর্গের পেছন দিকের বর্ণনাটা এইখানে সংক্ষেপে একটু দিয়ে দিই৷ প্রথম যেদিন কৌতূহলবশত মালতীমাসির সঙ্গে কলতলা দিয়ে বেরিয়ে দুপুরের আলোয় বাইরেটা দেখেছিলাম সেদিন সকালে বেশ বৃষ্টি হয়েছিল৷ সেই বৃষ্টিভেজা চোখে এক ঝলক দেখে সবচেয়ে প্রথমে যেটা মনে হয়েছিল সেটা হল, বাইপাসের আবর্জনার যে সেই বিশাল পাহাড়প্রমাণ স্তূপ, তার একটা ছোটখাটো সংস্করণের মধ্যে মধ্যে প্রচুর সবুজ লতাপাতা, আগাছা জন্মে গেলে যেমন হতে পারে ঠিক সেইরকম৷ জায়গাটার কোনো সংস্কার হয়নি অন্তত কয়েক বছর ধরে, দেখলেই বোঝা যায়৷ অথচ এটা কিন্তু পুলিশের প্রপার্টি৷
আগেই বলেছি, এই জলাজঙ্গলের মধ্যে একটু দূরেই বহুকাল আগে ব্যবহার হওয়া পুলিশের দুটো শ্যাওলায় ভরা ব্যারাক, যার আবছা দেওয়াল আমাদের কলতলা থেকে চোখে পড়ে৷ বহুকাল আগে ওখানে হয়ত কেউ থাকত, কিন্তু এখন পুরোপুরি পরিত্যক্ত৷ আমরা ভুলেও কখনো এদিকটায় আসি না, সাপখোপ তো আছেই, আমি আসার আগেই নাকি মালতী মাসির বাসন ধোয়ার জায়গায় উঠে এসেছিল একটা মাঝারি মাপের গোখরো সাপ৷
এই গভীর অন্ধকারে সেই কথাটা মনে পড়তেই গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল৷
চাকরি করতে এসে শেষে প্রাণটাই খোয়াব নাকি!
আমার সঙ্গের লোকটা অন্ধকারের মধ্যে হ্যাঁচোড়প্যাচোর করে দেখলাম এগোতে লাগল ওই ব্যারাক দুটোর দিকে৷
আমি সভয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিলাম, তার আগেই দেখলাম ব্যারাকটার বাইরে আশিসবাবু দাঁড়িয়ে রয়েছেন, হাতে একটা জোরালো টর্চ৷ পায়ে হাঁটু অবধি জুতো৷
আমি কাছাকাছি যেতেই আশিসবাবু বললেন, ‘‘আসুন ডাক্তারবাবু৷’’
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, ‘‘ভেতরে? সাপ ভর্তি তো শুনেছিলাম!’’
‘‘ভুল শুনেছিলেন৷’’ আশিসবাবু আমার দিকে চেয়ে কথাটা বলে ভেতরে ঢুকে গেলেন লতাপাতার ফাঁক দিয়ে৷
আমার সঙ্গের লোকটাও পেছন পেছন ঢুকে গেল৷
বাইরে থেকে যেন ক্ষীণ আলো চোখে পড়ল ভেতরে, আর এরা যেভাবে কনফিডেন্টলি ভেতরে ঢুকে গেল, আমি একটু সাহস করে ঢুকেই পড়লাম ভেতরে৷
ঢুকে কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না, মনে হল কোনো পোড়োবাড়িতে এসে পড়েছি, ঘরের একটা দিক ভেঙেচুরে দ্বিতীয় ঘরটায় যাওয়ার মস্ত ফাটল তৈরি হয়েছে, মোটা মোটা বট-অশ্বত্থ গাছের ঝুরি এসে ঢেকে ফেলেছে চারিপাশ, ঘরের এক কোণে বেশ কয়েকটা নোনা ধরে যাওয়া বাঁশ লম্বালম্বি দাঁড়িয়ে রয়েছে৷
ক্ষীণ আলোর উৎসটা ওই ভেতরের ঘর থেকেই আসছে৷
আশিসবাবুর ডাকে সংবিৎ ফিরল, ‘‘ডাক্তারবাবু, এদিকে! এদিকে আসুন৷’’ দেখলাম উনি ওই ঘর দিয়ে ফাটলের মুখটায় দাঁড়িয়ে আমায় ডাকছেন৷
আমি কোনোমতে সাবধানে এগিয়ে ফাটল দিয়ে উঠে ছোট্ট একটা লাফ দিলাম৷ আমি তেমন লম্ফঝম্প করতে পারি না কোনোকালেই, এমনিতেই একটু নাদুসনুদুস গড়ন আমার, বই, সিনেমা এইসব নিয়ে থাকতেই ভালোবাসি চিরকাল৷ এইসবও যে করতে হবে, কোনোদিনও ভাবিনি৷
লাফটা দিয়ে অবশ্য খুব একটা লাগল না, শুধু কনুইয়ের নীচটা পুরোনো ইটের ঘষায় ছড়ে গেল৷ পায়ে গোড়ালির উপরটাও কেমন চুলকোচ্ছিল, আমি ঝেরেঝুরে মোবাইলের আলো জ্বেলে সেখানটায় চুলকোতে গেলাম, হঠাৎ সামনের দৃশ্যটা দেখে আমার চোখ প্রায় ঠিকরে বেরিয়ে এল৷
এই ঘরটার অবস্থা আগেরটার চেয়ে আশ্চর্যভাবে অনেকটা ভালো, পরিষ্কারও, আশিসবাবু, আমাকে নিয়ে আসা লোকটা আর আরো দুজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা বড় টেবিলের চারপাশে, সবার হাতেই জ্বলছে টর্চ৷
সেই টর্চের আলোতে বিস্ফারিত চোখে দেখলাম টেবিলটার একপাশে পড়ে আছে কালকেই মর্গে আসা উনিশ নম্বরের সেই লাশ৷ একইরকমভাবে৷
আমি এগিয়ে গিয়ে আশিসবাবুর দিকে তাকালাম, ‘‘এটা এখানে কী করে এল? মানে, কে নিয়ে এল?’’
‘‘সেটাই তো জানার ডাক্তারবাবু! আপনি আগে বডিটাকে ভালো করে দেখুন তো, কোনো অরগ্যান রিমুভ-টিমুভ হয়নি বলেই তো মনে হচ্ছে!’’
কাছে যেতেই একটা পচা গন্ধ পেলাম, সেটাই স্বাভাবিক৷ কাল রাত থেকে যদি এখানে পড়ে থাকে, এতক্ষণে রাইগার মর্টিস তো বটেই, পরের ধাপ লাইভর মর্টিসও শুরু হয়ে গেছে, অর্থাৎ যেহেতু এতক্ষণ ধরে হূৎপিণ্ড কোনো রক্ত পাম্প করছে না, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সেটাকে টানতে শুরু করেছে নীচের দিকে, ফলে মাটির দিকের অংশগুলোয় স্বাভাবিকভাবেই লালচে গোলাপি রঙের রক্ত জমাট বাঁধা দাগ দেখা দিয়েছে, ডাক্তারি পরিভাষায় আমরা যেটাকে বলি পোস্টমর্টেম স্টেইন৷
আমি খুঁটিয়ে দেখছিলাম বডিটা, রাইগর মর্টিসের নিয়ম মেনে মাংসপেশিগুলো শিথিল হচ্ছে আস্তে আস্তে৷ খুব শিগগিরই এবার ভেতরের কোশ আর টিস্যুগুলো পচতে শুরু করবে৷ ধীরে ধীরে দেখতে দেখতে শরীরের নীচের দিকে তাকাতেই কী যেন একটা অস্বাভাবিকত্ব টের পেলাম৷
আমি ভালো করে তাকালাম৷ তলপেট, জেনিটালস, দুই ঊরু, না কিছুই তো নেই!
তবু আমার ডাক্তারি ষষ্ঠেন্দ্রিয় যেন আমার মস্তিষ্কে আরো একবার বার্তা পাঠাল, কিছু একটা গণ্ডগোল আছে৷
ডেফিনিটলি আছে৷
আমি আমার মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বেলে আরো ভালো করে দেখতে লাগলাম৷ পুরো পেনিস অর্থাৎ পুরুষাঙ্গটাই যেন একটু বেশি ফুলে রয়েছে৷ একদম উপরের অংশের ফোরস্কিনটা যেন খোবলানো৷
পাক্কা তিন মিনিট ধরে দেখে গোটা পেনিসটাতে অজস্র কামড়ের দাগ আবিষ্কার করলাম, সঙ্গে কিছু নখেরও আঁচড়ও৷
আরেকটু নীচে, যেখানটায় করপাস স্পঞ্জিওসাম থাকে, সেইখানটাতেও দাঁতের দাগ সুস্পষ্ট, এতটাই জোরে কামড়ানো হয়েছে, যে রক্ত বেরিয়ে এসে কালো হয়ে রয়েছে৷
পেনিসের নীচের স্ক্রোটামেও পাশবিক কামড়ের দাগ৷
আমি আরো প্রায় পনেরো মিনিট ধরে দেখে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে আশিসবাবুর দিকে তাকালাম, সবাই হাঁ করে আমার দিকে তাকিয়ে৷ আমি বললাম, ‘‘অরগ্যান সব ঠিকই আছে৷ কোনো স্টিচও নেই৷’’
‘‘তবে? এখনো কি নিয়ে যেতে পারেনি বলছেন এখান থেকে? টেম্পোরারিলি লুকিয়ে রেখেছে?’’ আশিসবাবু উদগ্রীব হয়ে উঠলেন৷
‘‘না তা নয়৷ বডিটার ওপর সেক্সুয়াল টর্চার করা হয়েছে৷ আর সেটা মোস্ট প্রোব্যাবলি মারা যাওয়ার পরেই, না হলে বাইট মার্কস এতটা ক্লিয়ার থাকত না৷’’
‘‘সে কী? ডেডবডি, তার ওপর মেল, সেখানেও সেক্সুয়াল টর্চার?’’ আশিসবাবু হতভম্ব হয়ে গেলেন৷
‘‘হ্যাঁ, নেক্রোফিলিয়া৷’’
‘‘মানে? এরকম আবার হয় নাকি?’’
‘‘হয়৷ খুব রেয়ার কেস৷ কোনো কোনো মানুষের মৃতদেহের সঙ্গে সেক্স করার বা মৃতদেহের ওপর টর্চার চালানোর বিকৃত প্রবণতা থাকে৷ যেমন কিছু পার্ভার্ট বাচ্চাদের উপর সেক্সুয়াল টর্চার করে আনন্দ পায়, তাদের পিডোফিল বলা হয়, তেমনই এদের বলা হয় নেক্রোফিলিয়াক৷ ছোটবেলায় খুব হিংসে বা অত্যাচারের শিকার হলে অনেকসময় এই পার্ভারশনগুলো দেখা যায়৷ তবে…’’ আমি গলা ঝেড়ে বললাম, ‘‘আজ অবধি নেক্রোফিলিয়াকদের কথা কেস স্টাডিতেই পড়েছি, কোনোদিন দেখিনি৷ ইন্ডিয়াতে কেউ আছে বলেও শুনিনি৷ আপনি এক কাজ করুন, আপাতত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটাকে মাইক্রোস্কোপিক এগজামিনেশনে পাঠিয়ে দিন, সেখান থেকে আরো ডিটেইলড জানা যাবে৷ বেশি দেরি করলে সেই প্রুফটাও চলে যাবে৷’’ কথা বলতে বলতে আমি আর থাকতে পারলাম না, হাঁটুর নীচটা বড্ড চুলকোচ্ছে, হাত দিয়ে চুলকোতে যেতেই বড় কিছু একটা ঠেকল৷
চমকে উঠে টর্চের আলোয় দেখি, একটা জোঁক তখন থেকে মহানন্দে আমার রক্ত চুষে ফুলে ঢোল হয়ে উঠেছে আর আমি কিছু বুঝতেই পারিনি৷
আমার গা-টা শিরশির করে উঠল৷
৫
সঞ্চয়িতা শুনে তো ফোনে উত্তেজনা আর চেপে রাখতে পারছে না, ‘‘কী বলছ তুমি! নেক্রোফিলিয়াক? কলকাতায়? এ তো রেয়ার স্যাম্পল! ইশ, পুলিশ ধরতে পারলেই বলবে, আমি ছুটে চলে যাব এখান থেকে, আমাকে কয়েকটা সেশন স্টাডি করতে কিন্তু দিতেই হবে৷’’
‘‘আরে দাঁড়াও তুমি!’’ আমার বিরক্তিতে মুখ বেঁকে গেল, ‘‘যে আছে যার তালে, সত্যি! আমার এখানে অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে কপালে কী ঝুলছে ভেবে, আর তুমি তোমার সাইকিয়াট্রির সাবজেক্ট খুঁজছ!’’
সঞ্চয়িতা একটু দমে গেল, ‘‘আবার কীসের চাপ, বডি তো পেয়ে গেছ!’’
‘‘আরে পেলেও বা!’’ আমি সঞ্চয়িতার এরকম অদ্ভুত প্রশ্নে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে উঠলাম, ‘‘আগের বডিটা কোথায় গেল, কীভাবে চুরি হল আর এই নেক্রোফিলিয়াক লোকটাকে পুলিশ তো খুঁজে বের করবে, নাকি? সেই পুরো ইনভেস্টিগেশন প্রসেসেই তো আমাকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া চলবে, তোমার কি বুদ্ধিশুদ্ধি সব লোপ পেল নাকি!’’
আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা টেবিলে রেখে চেয়ারে হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লাম৷
বিরক্ত লাগছে৷ খুব আশ্চর্যও লাগছে৷ এটা যে নেক্রোফিলিয়াক কারও কাণ্ড, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু কে সে? সঞ্চয়িতার কথা অনুযায়ী বেশিরভাগ নেক্রোফিলিয়া ডেভেলপ করে নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসহীনতা আর কারও থেকে রিজেক্ট বা উপেক্ষিত হবার ভয় থেকে৷ তেমন কে আমাদের মর্গে এসে হানা দিয়েছে?
সে কী করে ঢুকল ভেতরে, কী করেই বা লাশটাকে বয়ে নিয়ে গেল ওখানে? ব্যারাকের ঘরের ওই টেবিলটা সম্ভবত অনেকদিন আগে থেকেই পড়ে আছে, কিন্তু সেখানে এতটা রাস্তা লাশ বয়ে নিয়ে যাওয়াটাও তো একটা ফ্যাক্টর৷
তার ওপর নেক্রোফিলিয়ার নজির হিসেবে অ্যানাল ইনজুরি থাকার কথা, সেটাও নেই৷ শুধু জেনিটালিয়ায় কামড়ের দাগ৷
সময় পায়নি বলেই কি?
কাল রাতের ওই ঘটনার পর আমি আর বাড়ি যাইনি, সামনের দিকে গিয়ে যোগিন্দরকে ডেকে দরজা খুলিয়ে ভেতরে এসে আমার ঘরে এসে বসে পড়েছিলাম৷ মাথা বনবন করে ঘুরছিল৷ বাড়িতে ফোন করে বলে দিয়েছিলাম আজ ফিরব না৷
আমি অবশ্য একা ছিলাম না, এখানে পাহারার জন্য রাখা দুজন কনস্টেবল, আর সুজয় বলে আশিসবাবুর ওই অ্যাসিস্ট্যান্টটাও ছিল আমার ঘরেই৷ সবাই ভোরে উঠে কোথাও বেরিয়েছে হয়তো বাইরে, শুধু একপাশে একজন কনস্টেবল দেখলাম বসেই বসেই ঘুমোচ্ছে৷
ঘড়িতে দেখলাম সকাল সাড়ে সাতটা৷ একটু আগে ঘুম ভেঙে যেতে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে সঞ্চয়িতাকে ঘুম থেকে তুলে বলেছিলাম পুরো ঘটনাটা৷ এখন উঠে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ খিদে খিদে পাচ্ছে, কাল থেকে তো কিছুই খাওয়া হয়নি, কিন্তু কিছু খেতেও ইচ্ছে করছে না৷ কেমন একটা অরুচিতে বিস্বাদ হয়ে আছে মুখটা৷
আমার ঘরের জানলা দিয়ে দূরের সেই পরিত্যক্ত ব্যারাক আর আশপাশের জঙ্গলের একটা অংশ অল্প দেখা যাচ্ছে৷ কেউ ভাবতে পেরেছিল যে ওর মধ্যে কোনো মানবরূপী পশু এইরকমভাবে ডেডবডি নিয়ে গিয়ে টর্চার করেছে?
আবার আমার মনে হল, নিয়ে গেলটাই বা কী করে?
যোগিন্দররা তো সামনে পাহারায়, আর পেছনের দরজা বন্ধ! নিঃশব্দে রাতের অন্ধকারে একটা লাশ বয়ে নিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়৷
নিজের মনেই ভাবছিলাম, হঠাৎ দেখি ষষ্ঠীদা ঢুকছে ভেতরে, ‘‘কী ব্যাপার ষষ্ঠীদা, এত সকাল সকাল?’’
‘‘আরে সকাল কি, আমি তো যোগিন্দরের থেকে ফোনে শুনে ছুটতে ছুটতে আসছি, কী নেকড়ের মতো একটা জন্তু নাকি বডিটাকে খুবলেছে?’’
আমি এই অবস্থাতেও হাসলাম, কাল আশিসবাবু পইপই করে ব্যাপারটা গোপন রাখতে বলে গিয়েছেন, কিন্তু এর মধ্যেই দেখছি যোগিন্দর বলে দিয়েছে ষষ্ঠীদাকে, তাও আবার নিজের মতো করে৷
‘‘নেকড়ে নয়, নেক্রোফিলিয়াক৷’’ আমি বললাম৷
‘‘অ্যাঁ! কী বস্তু সেটা? খায় না মাথায় দেয়?’’ ষষ্ঠীদা মুখ ভেটকে বসে পড়ল আমার সামনের চেয়ারে৷
‘‘খায়ও না, মাথাতেও দেয় না, এটা একটা মানসিক বিকৃতি, যাতে মৃতদেহের প্রতি যৌন ইচ্ছা হয়, মানে ভালো বাংলায় শবকামী৷’’ আমি ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করলাম৷
ষষ্ঠীদা বিস্ফারিত চোখে ঘৃণা-অবিশ্বাস মেশানো একটা এক্সপ্রেশন দিয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, ‘‘মানে? তারা মানুষ?’’
‘‘আলবাত মানুষ!’’ আমি ষষ্ঠীদার বলার ধরনে হেসে ফেললাম, ‘‘তোমার আমার মতোই তারা ঘোরে ফেরে, খায়দায়, কিন্তু তাদের সেক্স করার ইচ্ছে জীবন্ত মানুষের সঙ্গে হয় না, হয় ডেডবডির সঙ্গে৷’’
ষষ্ঠীদা হাঁ-টা বন্ধ হল না, ‘‘মড়ার সঙ্গে! মড়ার সঙ্গে ওইসব করে কী পাবে? মানে ইয়ে, আপনি আমার ছেলের মতো, এসব বলতে লজ্জা করছে, তবু বলছি, মড়া কি নিজে থেকে কিছু করতে পারে?’’
একটু আগে সঞ্চয়িতা নেক্রোফিলিয়া নিয়ে আমাকে বেশ কিছুক্ষণ বোঝাচ্ছিল, আমি নিজের এবং সেই জ্ঞান মিলিয়ে মিশিয়ে বললাম, ‘‘আসলে এই প্রবৃত্তিটা আসেই কোনো প্রোটেস্ট ছাড়া সেক্স করবার ইচ্ছা থেকে৷ পার্টনার যতই সেক্সে আগ্রহী হোক, সে তো জীবন্ত মানুষ, সে নিজের মতো মুভমেন্ট করবে ইন্টারকোর্সের সময়, নিজের পছন্দ অপছন্দ অনুযায়ী চলবে, এরা সেটুকুও চায় না৷ আবার অনেকে রিজেক্ট হওয়ার ভয় থেকেও এটা করে৷’’
‘‘তাই মর্গের মড়ার সঙ্গে এইসব নোংরামি করে সাধ মেটায়! ছি ছি! ভাবতেই গা গুলিয়ে উঠছে! অ্যাদ্দিন ইঁদুরের উৎপাত ছিল, এখন এ যে দেখি নেকড়ে ইঁদুর!’’
‘‘নেকড়ে নয়, নেক্রোফিলিয়াক!’’ আমি আবার ভুল শুধরে দিলাম৷
‘‘ওই হল৷’’ ষষ্ঠীদা আমাকে পাত্তাই দিল না, ‘‘ভাবতেই গা ঘিনঘিন করছে৷ ছ’টা ছেলেমেয়ের বাপ হয়েও এমন সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড কোনদিনও শুনিনি বাপু! আচ্ছা,’’ ষষ্ঠীদা আমার দিকে ঝুঁকে এল, ‘‘এরা কি সত্যিই হয়, না তোমাদের ওই ডাক্তারি থিওরিতেই আছে শুধু!’’
‘‘কী বলছেন! হয় না মানে!’’ আমি বললাম, ‘‘আমেরিকার একটা কেস এখুনি সঞ্চয়িতা বলল ফোনে, নাম হল এডমুন্ড কেম্পার৷ সে শুধু নেক্রোফিলিয়াকই ছিল না, সেক্সের পর ডেডবডির মাংসও খেত৷ লিফট দেওয়ার নাম করে মেয়েদের গাড়িতে তুলত, তারপর বাড়ি নিয়ে গিয়ে খুন করে তাদের বডির সঙ্গে ইন্টারকোর্স করত৷ এমনকি, নিজের মায়ের সঙ্গেও এই কাণ্ড করেছিল৷ এদিকে তার চেহারা, কথাবার্তা অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত, আপনি বুঝতেই পারবেন না কিছু৷ সেইজন্য পুলিশের ধরতেও প্রায় কালঘাম ছুটে গিয়েছিল৷ জেলে বসে ইন্টারভিউতে বলেছিল, তার নাকি জীবন্ত মানুষের প্রতি কোনো আকর্ষণই আসে না, তার ওপর মা ছোট থেকে খুব শাসনে রাখত, সেই আক্রোশও ছিল৷ ডেডবডির সঙ্গে সেক্স করলে নিজে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে, প্রবল ডমিনেট করার ইচ্ছা থেকেই জন্ম নিয়েছিল নেক্রোফিলিয়া৷ তবে সারা পৃথিবীতে এই রুগি খুবই রেয়ার৷’’
‘‘কী সাংঘাতিক!’’ ষষ্ঠীদা বলল, ‘‘এরকম কে এখানে এসে বাসা গাড়ল রে বাবা! শুনেই তো ভয় করছে৷ দেখা গেল ওই নেকড়ে ইঁদুর কাউকে না পেয়ে জ্যান্ত মানুষকেই মেরে তারপর ওইসব করার ফন্দি আঁটতে লাগলো৷ এই বুড়ো বয়সে এসে এ কী উৎপাত রে ভাই!’’
আমি ষষ্ঠীদার বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেললাম, ‘‘নেকড়ে ইঁদুর আবার কী!’’
‘‘ওই যে নেকড়েফিলি না কী, আর যে মর্গের মড়াদের সাথে এইসব করে, সে তো ইঁদুরেরও অধম!’’ ষষ্ঠীদার সরল ব্যাখ্যা৷
কি একটা বলতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই আশিসবাবুর ফোন এল৷
আমি ফোনটা নিয়ে বাইরের করিডরে এলাম৷ আশিসবাবুও গোপনীয়তার ওপর খুব জোর দিচ্ছেন৷
‘‘ডাক্তারবাবু শুনুন, একটু বাদেই একটা বডি যাবে আপনাদের মর্গে, এটাও ওই দুটোর মতোই, ইয়ং, মেজর কোনো ড্যামেজ নেই, মেল৷’’
আমি বলতে গেলাম, ‘‘কিন্তু এখন তো কোল্ড স্টোরেজ সিল করা রয়েছে?’’
‘‘আমাদের লোক গিয়ে সিল খুলে ঢোকাবে৷ আর আজ রাতে কোনো সিল বা গার্ড থাকবে না, সেটা সবাইকে কনভে করে দেবেন৷ শুধু আপনাদের নিজস্ব গার্ড বাইরে যেমন থাকে, থাকবে৷ আপনি নরম্যালি সবাইকে নিয়ে সন্ধে ছ’টা সাড়ে ছ’টার মধ্যে বেরিয়ে যাবেন৷ বোঝা গেল?’’
আমি বললাম, ‘‘হ্যাঁ৷’’
‘‘আর এই ব্যাপারটা কাউকে জানাবেন না৷ আপনাদের স্টাফেদেরও বলবেন, পুলিশ আর বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করছে না ব্যাপারটা নিয়ে৷’’
আমি বললাম, ‘‘বুঝেছি৷ আপনি আজকেও ট্র্যাপ ফেলে লোকটাকে ধরার চেষ্টা করছেন৷ কিন্তু বডিটা ওখানে না পেলেই তো সে বুঝে যাবে, আমরা জায়গাটা ট্রেস আউট করে ফেলেছি, আর সে ওখানে নতুন বডি নিয়ে যাবে কেন?’’
‘‘বডি ওখানেই আছে৷ ল্যাবে স্যাম্পল নিয়ে আবার ওখানেই রেখে আসা হয়েছে৷ কাল রাতে দেখে না থাকলে বা কালকের ঘটনা না জানলে কেউ বুঝতে পারবে না আমরা ওখানে গিয়েছিলাম৷ আপনি কিন্তু কাউকে বলবেন না ব্যাপারটা৷’’
আমি আড়চোখে ষষ্ঠীদার দিকে তাকালাম, আমার দুম করে রাগ গিয়ে পড়ল যোগিন্দরের ওপর৷ ব্যাটা একটা কথা চেপে রাখতে পারে না৷ ফোনটা রেখে আমি ষষ্ঠীদাকে গিয়ে বললাম, ‘‘ষষ্ঠীদা, এই ব্যাপারটা কিন্তু কাউকে জানাবেন না!’’
ষষ্ঠীদা মাথা দুলিয়ে জানাল, এই ভুল কেউ করে!
একটু পরে সবাই একে একে এল৷ লাল্টু, ইরফান, ভূপতি৷ মালতী মাসি সবার জন্য চা নিয়ে আসতে আমি আশিসবাবুর কথামতো ঘোষণা করলাম, ‘‘যা হওয়ার হয়ে গেছে৷ পুলিশ আর থাকবে না আজ থেকে, তবে কাল পরশু করেই ক্যামেরা বসে যাবে ওই ঘরে আবার৷’’
‘‘আর ওই দুটো বডি?’’ ইরফান বলল৷
‘‘ওগুলো তো আর পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না!’’ আমি ঠোঁট উল্টোলাম৷
আশিসবাবুর কথামতো বডিটা এল ঠিক দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ৷ ষষ্ঠীদা রেজিস্টারে সব ডিটেইলস এনরোল করল, তারপর বেসিক প্রিজারভেশন মেথড ফলো করে লাল্টু আর ইরফান সেটা ঢুকিয়ে দিল ভল্টে৷
এবার উনত্রিশ নম্বর৷
আমি একঝলক দেখলাম৷ তেত্রিশ বছর বয়স, গলায় দড়ি৷ তার মানে গলার সারভিকাল ভারটিব্রা ভাঙ্গা ছাড়া আর কোনো ড্যামেজ নেই বডিতে৷
আগেই বলেছি, সূর্যোদয়ের আগে এবং সূর্যাস্তের পরে পোস্টমর্টেম করার নিয়ম নেই৷ আমরা সাড়ে ছ’টা নাগাদ সবাই বেরিয়ে এলাম৷
মনটা কেমন একটা অস্থির অস্থির লাগছিল৷ সঞ্চয়িতা ফোনে সব শুনে বলল, ‘‘আরে এ তো মারাত্মক অ্যাডভেঞ্চারাস ব্যাপার গো! তা তোমাদের এডমুন্ড কেম্পার আজ আসবে তো?’’
‘‘দেখা যাক!’’ আমি সিগারেট টানতে টানতে রাস্তায় হাঁটছিলাম৷ আজ আর ট্যাক্সি নিতে ইচ্ছা করল না, ভাবছি বাস ধরে চলে যাব বাড়ি৷
আজ রাতে ঘুম এলে হয়!
বড় রাস্তার মোড়ে গিয়ে সবে বাসে উঠতে যাব, আশিসবাবুর ফোন এল আবার, ‘‘ঠিক রাত সাড়ে দশটায় বাড়িতে রেডি হয়ে থাকবেন, সুজয় বাইক নিয়ে গিয়ে নিয়ে আসবে আপনাকে৷’’
‘‘কোথায়?’’
‘‘কাল যেখানে এসেছিলেন৷ একজন ডাক্তার লাগবে আমাদের৷’’
*****
কী মনের অবস্থা নিয়ে বাড়ি গেলাম, তারপর রাত সাড়ে দশটা অবধি কী করে ওয়েট করলাম, তারপর কখন সুজয়ের সঙ্গে বাইকে চেপে মর্গের পেছনের ঘরে ফেরত এলাম, সেইসবের বিশদ বর্ণনায় আর যাচ্ছি না৷ শুধু এটুকু বলতে পারি, অত্যন্ত উত্তেজনায় এতটাই টেনসড হয়ে পড়েছিলাম, যে কোনো কাজই ওইটুকু সময়ের মধ্যে ঠিকভাবে করতে পারিনি, শুধু এক প্যাকেট ক্লাসিক ধ্বংস করেছি৷
সোজাসুজি চলে আসি রাত এগারোটা পনেরোর সময় আমার আর সুজয়ের ওই ব্যারাকের ঘরে যাওয়াতে৷
সেই সুঁড়িপথ, সেই অন্ধকারে হাতড়ানো, তারপর ফাটলের মধ্য দিয়ে লাফ মেরে ওই দিকের ঘরে যাওয়া৷ তবে আজ ওই গলিতে ঢোকার আগে একবার যেন আবছা দেখলাম, মর্গের সামনের দিকটায় ঝুনঝুনওয়ালার দোকান থেকে একটু এগিয়ে একটা পুলিশের ভ্যান দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ আশিসবাবুই কি দাঁড় করিয়ে রেখে গেছেন?
কাল অত খেয়াল করিনি, আজ বুঝলাম, আমরা ফাটল দিয়ে যে ঘরে যাচ্ছি, সেই ঘরেই সোজা আসা যায় আমাদের মর্গের পেছন দিয়ে৷ তবে সেই পথ লতাপাতা-আগাছা-সাপখোপে ভর্তি৷
যে আসে সে নিশ্চয়ই এদিক দিয়েই আসে, না হলে আমাদের মর্গের পেছনের দরজা তো বন্ধ৷
আশিসবাবু আর আরো দুজন পুলিশ বসে ছিলেন একপাশে ঘাপটি মেরে, যেখান থেকে কেউ এলে বাইরের চাঁদের আলো এসে পড়বে তার মুখে, এখান থেকে দেখা যাবে, কিন্তু সে আমাদের বুঝতে পারবে না৷ আমিও সেখানে গিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে পড়লাম৷
কালকের মড়াটা একইভাবে টেবিলের উপর পড়ে আছে, যেন কিছুই হয়নি৷
শুরু হল আমাদের অনন্ত প্রতীক্ষা৷
মশা কামড়াচ্ছে মাঝে মাঝেই, আরো কী যেন সুড়সুড় করছে শরীরের বিভিন্ন জায়গায়৷ কালকের মতো জোঁক নয়তো? আমি থেকে থেকে পা-টা নাড়াচ্ছিলাম৷
আশিসবাবু ফিসফিস করলেন, ‘‘মাইক্রোস্কোপিকের রেজাল্টে কী পাওয়া গেছে জানেন লোকটার জেনিট্যাল অরগ্যানে?’’
আমি বলতে গেলাম, ‘‘কী?’’ কিন্তু তার আগেই একটা খচরমচর শব্দতে যেন আমরা সবাই চুপ করে গেলাম৷
একটা বড় কিছু জিনিষ যেন ঘষটে ঘষটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পাতাভর্তি ওই রাস্তার মধ্যে দিয়ে৷
সেই শব্দটা এই নিঃশব্দ অন্ধকারে আস্তে আস্তে বাড়তে থাকল, একসময় মনে হল, ব্যারাকের একদম পেছন দিয়েই যাচ্ছে সেটা, তারপর শব্দটা আবার কমতে লাগল, তারপর আস্তে আস্তে যেন মিলিয়ে গেল আমাদের মর্গের পেছনের দিকে চলে যেতে যেতে৷
আমি আশিসবাবুর দিকে তাকালাম, ‘‘কে গেল বলুন তো? এত ভারী শব্দ?’’
আশিসবাবু উত্তর দিলেন না৷ শুধু তর্জনী ঠোঁটে ঠেকিয়ে আমাকে চুপ করে থাকতে বললেন৷
এক-একটা মিনিট যেন মনে হচ্ছে এক-এক ঘণ্টা৷ আশিসবাবুর ওইপাশের দুজন পুলিশকে এখনো ভালভাবে দেখতে পাইনি, আন্দাজে ঠাহর করতে পারছিলাম তারাও উশখুশ করছেন৷
আরো কিছুক্ষণ অতিকষ্টে বসে থাকার পর সেই শব্দটা আবার শুনতে পেলাম৷ একটা ভারী কিছু কেউ যেন টানতে টানতে নিয়ে আসছে৷ আর সে আসছে আমাদের মর্গের দিক থেকে৷
শব্দটা ক্রমেই কাছে আসছে৷
একটু পরেই সেটা এসে থমকে দাঁড়াল এই ঘরের দরজার সামনে৷
আমার বুকে তখন হাতুড়ি পেটার মতো আওয়াজ হচ্ছে৷ আমার এই স্বল্প কয়েকবছরের ডাক্তারি অভিজ্ঞতায় এইরকম পরিস্থিতিতে কখনো পড়তে হয়নি৷
একটা ক্যাঁচ শব্দ শুনে চমকে তাকালাম৷
একটা বিশাল কিছু এই ঘরটায় ঢুকছে৷
বড় গাড়ি?
না, গাড়ি নয়, একটা ঠেলাগাড়ি৷ তার ওপরে কিছু একটা শোয়ানো৷
ঠেলাগাড়িটাকে ঠেলে যে ভেতরে ঢোকাচ্ছে, তাকে এখনো দেখতে পারছি না, কিন্তু তার যে এই গাড়িটা ঠেলতে খুব কষ্ট হচ্ছে আর গাড়ির ওপরে শোয়ানো জিনিষটা যে আজকের লাশটা, সেটা চাঁদের আলোয় দেখতে পাচ্ছি৷
লোকটা অনেক কষ্টে ঠেলাগাড়িটাকে নিয়ে এল টেবিলের সামনে, তারপর আগের দিনের লাশটাকে ঠেলেঠুলে সরাল পাশে, তারপর ঠেলাগাড়ির লাশটার পা’দুটো ধরে আস্তে আস্তে ওঠাতে লাগল টেবিলের ওপরে৷
আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখছি এই জমাটবাঁধা অন্ধকারে ঘটে চলা নাটকটা৷ কোনো সন্দেহ নেই, অপরাধী আশিসবাবুর টোপে পা দিয়েছে৷ আজকে পুলিশ পাহারা নেই, কাল পরশু থেকে ক্যামেরা বসবে, সুতরাং আজকের সুযোগ সে আর ছাড়েনি৷
আশিসবাবু ঠিকই বলেছিলেন৷ কাঁচা কাজ৷
পা-টাকে ওই টেবিলে তুলে এবার লোকটা মনোযোগ দিয়েছে মুণ্ডুসমেত ধড়টার দিকে৷ মিনিট পাঁচেকের কসরতে পাশের বডিটার পাশে শোয়াতে সক্ষম হল সে৷
একটু মনে হয় হাঁপিয়ে নিল৷
তারপর যে কাজটা করল, সেটা ভালোভাবে দেখতে না পেলেও আন্দাজ করতে পেয়ে আমার ঘৃণায় বমি পেয়ে গেল৷
লোকটা একহাতে আজকের লাশের পুরুষাঙ্গটা ধরে কচলাতে কচলাতে চরম আশ্লেষে চুমু খেতে লাগল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ঠোঁটে৷ তারপর উঠে বসতে গেল লাশটার উপর৷
আশিসবাবু আর অপেক্ষা করলেন না৷ তড়িৎগতিতে উঠে হাতের রিভলভারটা তাক করলেন আর পাশের পুলিশের হাতে হঠাৎ জ্বলে ওঠা জোরালো টর্চটা অপরাধীর মুখের উপর সোজাসুজি আলো ফেলে তাকে তো বটেই, আমাকেও স্তম্ভিত করে দিল৷
যে হাতে বিকৃত লালসায় মৃতদেহের যৌনাঙ্গ থেকে অপরাধী তার খিদে মেটাতে চাইছে, সেই হাত দুটোকে আমি খুব ভালোভাবে চিনি৷
আমাদের প্রতিদিন সেই হাতই মর্গে খেতে দেয়, পরম মমতায়, মাতৃস্নেহে৷
মালতীমাসি!
**********
পরের দিন সকালে আমরা সবাই ষষ্ঠীদার ঘরে বসেছিলাম৷ আশিসবাবু আর সুজয়ও এসেছিলেন রুটিন কিছু প্রশ্ন করতে৷ কেউ কথা বলছিলাম না৷ বিশ্রী একটা অনুভূতি তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল সবাইকে৷
ষষ্ঠীদাই প্রথম মুখ খুলল, ‘‘দাসপাড়ার বস্তি থেকে আমিই খুঁজে পেতে নিয়ে এসেছিলাম৷ শুনেছিলাম, তিনকুলে কেউ নেই, কয়েক বছর আগে কোথাও থেকে এসে ওখানে থাকতে শুরু করে৷ ভেবেছিলাম, শ্বেতি আছে বলে মনে হয় বিয়ে করেনি৷ এরকম যে নোংরামি থাকতে পারে কী করে জানব!’’
ভূপতি বলল, ‘‘আমার সঙ্গে কত গল্প করত, বলেছিল বাপমা ছোটবেলাতেই মারা গেছে, কাকার কাছে মানুষ, সেও নাকি খুব অত্যাচার করত৷ বিক্রিও করে দিয়েছিল ছোটবেলায় একবার৷’’
ছোট থেকে অত্যাচার, হিংসার শিকার হয়েও নেক্রোফিলিয়ার জন্ম হতে পারে তীব্র আক্রোশ আর চাপা কষ্ট থেকে, সঞ্চয়িতার বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল আমার৷ আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে আশিসবাবুর দিকে তাকালাম, ওইজন্যই ভদ্রলোক মহিলা পুলিশ নিয়ে এসে ভ্যানে বসিয়ে রেখেছিলেন কাল রাতে, ‘‘আমি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে এটা কোনো মহিলার কাজ, তাও মালতীমাসি৷ কী করে বুঝলেন আপনি?’’
আশিসবাবু বললেন, ‘‘প্রথম দিন উনিশ নম্বর ভল্টের সামনে কাদামাখা টাটকা পাতা পড়ে থাকতে দেখেছিলাম, সেটা ছিল কলমিশাকের পাতা৷ তারপর যখন শুনলাম আপনাদের ওই রান্নার লোক অন্য সময় আনাজ বিক্রি করে, তখন একটা খটকা লেগেছিল৷’’
আমি বিস্মিত মুখে শুনছিলাম৷
আশিসবাবু বলে চললেন, ‘‘তখন ভেবেছিলাম ও হয়তো হেল্পার মাত্র৷ তারপর লাশ পাওয়া যেতে মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষায় পেনিসে ভ্যাজাইনাল এপিথেলিয়ামের স্পষ্ট স্যাম্পল পাওয়া গেল৷ আমরা নিঃসন্দেহ হলাম যে কঙ্কাল পাচার বা অরগ্যান পাচারের গ্যাং নয়, কোনো পুরুষও নয়, এটা কোনো মহিলার কাজ৷ এবং কাঁচা কাজ৷ ভেবে দেখলাম, ওই রান্নার মহিলার পক্ষেই কাজটা সবচেয়ে সহজ৷ রান্নার বাসন ধুয়ে পেছনের দরজাটা বন্ধ করার ভান করে চলে যায়, পরে নিজের আনাজ বেচার ঠেলাগাড়ি নিয়ে ওই অন্ধকার গলি দিয়ে সবার অলক্ষে এসে ঢোকে, লাশ নিয়ে চলে যায় ওই ব্যারাকে৷’’
‘‘কিন্তু আগের লাশটা?’’ জিজ্ঞেস করল ইরফান৷
‘‘আমরা খোঁজ চালাচ্ছি৷ সম্ভবত পুঁতে দেওয়া হয়েছে ওই জঙ্গলেই৷’’
ভূপতি বলল, ‘‘এতবছর কাজ করেছে, এতদিন কিছু করল না, হঠাৎ এখন…!’’
সুজয় বলে পুলিশটা বলল, ‘‘ভেতরে ভেতরে প্রবণতাটা নিশ্চয়ই ছিল, সেটা কীভাবে মেটাত আমি আপনি জানব কী করে! এখানে ক্যামেরা খারাপ হতে সুযোগ পেল৷ আমার তো মনে হয় মর্গে রান্না করতে আসার কারণও এটা একটা ছিল, না হলে চট করে কোনো মহিলা মর্গে রান্না করতে আসতে চাইবে না৷ কী বলেন, ডাক্তারবাবু?’’
আমি নিঃশব্দে মাথা নাড়লাম৷
‘‘কিন্তু মালতীমাসি একজন মহিলা হয়ে একটা লোকের লাশ টেনে নিয়ে গিয়ে এত কিছু করতে পারত কী করে!’’ লাল্টুর চোখে বিস্ময়৷
তুমি আর কি বুঝবে লাল্টু, আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানলা দিয়ে দূরের সেই রহস্যভরা জঙ্গলের দিকে তাকালাম, কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ মাৎসর্য, এই ষড়রিপু মানুষকে দিয়ে অনেক কিছুই করাতে পারে, শৈশবের তিক্ত স্মৃতি জন্ম দিতে পারে অনেক বিকৃতির, সেই বিকৃতি প্রশমিত করতে কে যে কখন কী পন্থা নেয়!
কত শিশু ছোটবেলাতেই কত বিকৃতমনস্ক পশুর লালসার শিকার হয়, কত বাচ্চা মেয়ে ধর্ষিতা হয়, আমরা দুদিন আহা উহু করি, পরে ভুলে যাই৷ সেই শিশুর মনে কী ছাপ পড়ে, বড় হয়ে সেই রাগ কোনদিকে টার্ন নেয়, তা কি আমরা জানি? না জানতে চেষ্টা করি? উল্টে উপেক্ষায়, অবহেলায় তাকে একঘরে করে দিই৷
মালতী মাসির মায়ামমতা, স্নেহ এইগুলো থাকলেও ছোটবেলার অত্যাচার, বড় হয়ে শ্বেতি হওয়ার কারণে লোকের উপেক্ষা, একঘরে হয়ে যাওয়া, কারও ভালোবাসা না পাওয়া, এই সবই হয়তো ওর মনের অবচেতনে জন্ম দিয়েছিল এই বিকৃত শবকামিতা, সবার সামনে প্রতিবাদী হওয়ার সাহস ছিল না, তাই গুমরে কষ্ট পাওয়ার থেকে জন্ম নিয়েছিল নিজে রুল করতে চাওয়ার এক সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা, যেখানে সে নিজেই শাসকের ভূমিকা নেবে, অন্যপক্ষ বাধা দিতে পারবে না, আর ওকে ঘৃণাও করতে পারবে না৷
জটিল মনস্তত্ত্ব !
সবাই আলোচনা করছে, যুক্তি সাজাচ্ছে, ঘৃণা উগড়ে দিচ্ছে মালতীমাসির প্রতি৷
কিন্তু আমি যেন অন্য সবার মতো বিষ উগড়ে দিতে পারলাম না, মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালাম৷
সঞ্চয়িতাকে জানাতে হবে ফোন করে, আমাদের নেক্রোফিলিয়াক একাই দোষী নয়৷
মালতীমাসি একাই অপরাধ করেনি, সমাজও আছে ওর সঙ্গে, সমাজ ওকে অপরাধী বানিয়েছে, উপর্যুপরি অবহেলায়, অত্যাচারে শৈশব নষ্ট করে ঠেলে দিয়েছে পাঁকের অন্ধকারে৷
তাই দায় আমাদের প্রত্যেকের থেকেই যায়!
___