মরে গিয়ে বেঁচে ওঠা
ব্রহ্ম আর শক্তি। নিরাকার, নির্গুণ থেকে সাকার, সগুণ। শূন্য, মহাশূন্য থেকে রূপ, রস, গন্ধ, বর্ণ-সহ জগতের আবির্ভাব। জীব নানারকমের, কীটাণুকীট থেকে বুদ্ধি ও চৈতন্য-সমৃদ্ধ মানবের বিকাশ। সর্বত্র শক্তির বিস্ফোরণ। বিজ্ঞান এটিকে একভাবে বুঝতে চায়, ধর্ম এটিকে আরেকভাবে বুঝতে চায়। বিজ্ঞানীর পথ—বুদ্ধি, পরীক্ষা, আবিষ্কার, গণিত। বিজ্ঞানীর অহঙ্কার—আমি জানব, আমি বুঝব। আমার মেধা আমার ক্ষমতা যে-পর্যন্ত যেতে পারে যাবে, তারপর আসবেন পরবর্তী জন—প্রবাহের মতো, স্রোতের মতো। একটু একটু করে খুলে যাবে রহস্যের যবনিকা। ধীরে ধীরে উন্মোচিত হবে সৃষ্টির রহস্য।
ধর্মের কথা হলো, সৃষ্টির রহস্য বুদ্ধি অথবা মেধা-গ্রাহ্য নয়, ধ্যানগ্রাহ্য। যখনি ‘সৃষ্টি’ বলছি, তখনি একজন স্রষ্টাকেও স্বীকার করতে হয়। মানুষেরই ব্যাকরণ বলছে—কর্তা ছাড়া কর্ম হয় না।
এই কর্তা কে? হিন্দু বলবেন ‘ভগবান’, খ্রীস্টান বলবেন ‘গড’, মুসলমান বলবেন ‘আল্লা’, বিজ্ঞানী বলবেন ‘এনার্জি’–’শক্তি’। বিশ্বপ্রপঞ্চের উদ্ভাসের পিছনে মহাশক্তির খেলা। ‘এনার্জি’, ‘ভাইব্রেশন’। শক্তি ও তরঙ্গ। তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন—কার শক্তি? কে এই মহামহিম? রবীন্দ্রনাথ যেমন বলছেন— “মহাসিংহাসনে বসি শুনিছ, হে বিশ্বপিত, তোমারি রচিত ছন্দে মহান বিশ্বের গীত।” এই যে ‘ছন্দ’, ‘ভাইব্রেশন’, ‘রিদম’, ‘হারমনি’–এইটিই হলো সৃষ্টির উৎস। এরই নাম ‘ব্রহ্ম’। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের অপূর্ব উপলব্ধিতে ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ। বলেই বলছেন, ব্রহ্মের শক্তি, শক্তির ব্রহ্ম নয়। এই সিদ্ধান্ত একালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদেরও। হিন্দু দর্শন ও বিজ্ঞান এখন এক হয়ে গেছে।
বৃহদারণ্যক উপনিষদ্ বড় অদ্ভুত একটি তত্ত্ব জানালেন—সেটি হলো ‘মৃত্যু’। সৃষ্টির আগে কি কিছুই ছিল না? ছিল, অবশ্যই ছিল। যা ছিল সবই আবৃত ছিল মৃত্যুর দ্বারা। উপনিষদ্ এই মৃত্যুর অসাধারণ এক সংজ্ঞা দিলেন “অশনায়য়াহশনায়া হি মৃত্যুঃ…।” (১।২।১) সেই আদি মৃত্যুর রূপটি কি? ‘অশনায়া’ রূপ মৃত্যু। ‘অশনায়া’ হলো ভোগের ইচ্ছা—বুভুক্ষা, ক্ষুধার দাহ। ভোগেচ্ছাই হলো—মৃত্যু।
মরণ বলল, আমি খাব। কি খাব? “তন্মনোহকুরুতাত্মন্বী স্যামিতি।” (ঐ) মৃত্যু সঙ্কল্প করলেন, আমি আত্মন্বী হব। শরীরধারণ করব। সৃষ্টি, জীবজগৎ, আমারই কারণে—আমি খাব। আমি মৃত্যু, ক্ষুধার্ত মৃত্যু। জীব! তুমি মৃত্যুর কোলে বসে আনন্দ কর।
তন্ত্রের প্রবেশ। ব্রহ্মলাভ করে ব্রহ্মজ্ঞ ব্রহ্মের দিক থেকে দেখছেন—ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। সে অতি উচ্চ দর্শন। জীবের দিক থেকে দেখলে শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন—”ব্রহ্মও সত্য, জগৎও সত্য।” এইখানে গীতার প্রবেশ—
“দেহিনোহস্মিন যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মূহ্যতি।।” (২/১৩)
দেহী! তোমার কৌমার, যৌবন ও জরা—কালের অমোঘ নিয়তি। পরিশেষে মৃত্যু। সে তো তোমার ইন্দ্রিয়ের খাঁচায়। মৃত্যু তো দেহের বিকার। জেনে রাখ— দেহ হলো আত্মার পরিচ্ছদ মাত্র। আত্মার দেহ, দেহের আত্মা নয়।
জীব তুমি শিবস্বরূপ। ইন্দ্রিয়ের মুখ ঘুরিয়ে দাও। দমন নয়, মোড় ফেরানো আনন্দাসনে বসে আয়ত্ত কর—’রমণীর সঙ্গে থাকে, না করে রমণ।’ আরো এগোও, দেখ—”স্ত্রিয়ঃ সমস্তাঃ সকলা জগৎসু।” (চণ্ডী, ১১।৬) সৰ্বত্ৰ মা। মা! তুমি মৃত্যুরূপা কালী। অষ্টপাশে বেঁধেছ আমায়। হে শিব! তুমি যে মোক্ষদাতা। মোক্ষ হলো জ্ঞান। জ্ঞানই নির্বাণ। জয় মা!
ঠাকুর বলছেন, জ্ঞান তিন ধরনের। শুনেছে, দেখেছে, স্পর্শ করে গ্রহণ করেছে। ঠাকুর দুধের উপমা দিয়ে বোঝাতেন। দুধ কেমন? না, ধোব ধোব। দুধকে ছেড়ে দুধের ধবলত্ব ভাবা যায় না। আবার দুধের ধবলত্ব ছেড়ে দুধকে ভাবা যায় না।
এ বেদান্তের কথা। বেদান্তদর্শন ধৈর্যহীন, ছটফটে মানুষের অগম্য। আমাদের পূর্বপুরুষ গোবিন্দ ভগবৎপাদ, গৌড়পাদ, জৈমিনি, শঙ্করাচার্য প্রমুখ মহাজ্ঞানীদের নাম আমরা শুনেছি কি? যদি শুনেও থাকি, তাঁদের জ্ঞানভাণ্ডার আমাদের যুগের জ্ঞানে অস্পৃশ্য। পালিয়ে আয়। পালাবে কোথায় ভ্রাতৃগণ! দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর ক্যাঁক করে ধরবেন! ভবের হাটে এলে বাছা, কত রকমের নাচ দেখবে, দেখাবে-ধেইধেই নাচ! তারপর তো কাঁদতে বসবে। সে আবার কত রকমের কান্না! গুমরে গুমরে, ডুকরে ডুকরে। অবশেষে একটি জড়পদার্থ। ঠাকুরের কালে এক-আধটা ‘ব্যাঙের আধুলি’ ছিল। একালে অনেক ব্যাঙের অনেক আধুলি! গরবে সব ফেটে চৌচির! আরেক সর্বনাশ, একালের উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা আর মরতেই চাইছে না। ঘর আগলে, ঘাঁটি আগলে হাপরের মতো পড়ে আছে। প্রত্যেকের হাতের কাছে সেলোফেনের ঝুলিতে জপের মালা নয়, পাতাপাতা ওষুধ। সকালে খালি পেটে টকাস! ব্রেকফাস্টের পর টকাস! লাঞ্চের পর টকাস! বিকেলে টকাস! রাতে শয়নে প্রবেশের পূর্বে টকাস, টকাস! এক ট্যাবলেট নিদ্রা। শরীর নয় তো ‘ফ্যাকট্রি’! শ্বাসে কামারের হাপর। রক্তে সুগারের ‘ফ্যাকট্রি’! হার্ট চলছে পাম্পে। হজম হবে না, তবু লোভ! চোখে কাঁচ বসানো! ঘরে ঘরে অমৃতের বৃদ্ধ পুত্রকন্যারা বিছানার চাদর খামচে পড়ে আছে। সৃষ্টির আদিতে ‘অমৃতস্য পুত্রাঃ’ একবার বলে ফেলে ঋষিরা লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে রেখেছেন। অপেক্ষা করছেন কল্পান্তরের জন্য।
‘মানুষ’ নামক জীবটিকে ঈশ্বর নানাভাবে খতিয়ে দেখেছিলেন। প্রয়োজনে তাদের মুখের ওপর চোটপাট বলে দিতেন তার খামতির কথা। জানিয়ে দিতেন, মানুষ হলেও মানুষ থেকে তুমি বাছা কতটা দূরে আছ। কাউকে রেয়াত করতেন না। সে তুমি যেই হও। তুমি তকমাধারী ডেপুটি হতে পার। প্রতাপশালী জমিদার হতে পার। ধর্মগুরু হতে পার। শিক্ষাবিদ্ হতে পার। কারো রেহাই নেই। তাঁর অস্বস্তি হলো, মানুষের মতো দেখতে তুমি। শিক্ষিত ভদ্রলোক, অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতার অধিকারী। কেন তুমি মানুষ হবে না? আত্মবিস্মৃত হয়ে কেন তুমি তোমার মহৎ উত্তরাধিকারের অমর্যাদা করবে?
যে-জীবনদর্শন সর্বকালের মানুষে ছায়া ফেলবে, যার নাম মানুষের অন্বেষণ-তার শুরু দুদিক থেকে হতে পারে। চলতে হলে যেকোন একদিকে পা ফেলতেই হবে। ঈশ্বর থেকে দূরেই যেতে চাই, আর তাঁর দিকেই যেতে চাই। প্রশ্ন হলো, ঈশ্বর থেকে দূরে যাওয়া যায় কি? ঠাকুর বললেন, সবই তো ঈশ্বরের চৈতন্যে জরে আছে। যেন আচারের বয়ামে ফালি ফালি আম। মিছরির রুটি—আড় করে খাও আর সোজা করেই খাও, মিষ্টি লাগবেই।
‘জার্নি’ শব্দটা ভারি সুন্দর। আমার যাত্রা হলো শুরু। “পন্থ বিজন অতি ঘোর/একলি যাওব তুঝ অভিসারে/তুঁহুঁ মম প্রিয়তম, কি ফল বিচারে—/ভয় বাধা সব অভয় মুরতি ধরি পন্থ দেখায়ব মোর।” রবীন্দ্রনাথের এই কবিতার নাম ‘মরণ’। ধর্মের পথ তো মরণের পথ। ভয়ঙ্কর এক মরণের নাম ‘ধর্ম’। ভগবান — এসে আমার ‘আমি’টার গলা টিপে ধরবেন। চতুর্দিকে দহন। যত আবর্জনা তুলে গোলা ভরেছি। মন-মন্দিরে ছটা শকুন। অবিরাম ছেঁড়াছিঁড়ি। পণ্ডিতই হই আর মূর্খই হই, নামের যে বাহারই থাক–রাম, রাঘব, নারায়ণ, শঙ্কর, গৌতম, বুদ্ধ; স্বভাব অনুযায়ী আমার প্রকৃত নাম-শকুন। নিজের শাস্ত্রীয় সম্মান বাড়াবার জন্যে বলতে পারি—গৃধ্র। আমার একটিই বিশেষণ—আমি গৃধু। লুব্ধ, লোলুপ।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ জ্ঞানের উচ্চশিখর থেকে বললেন, জগতের সবাই শোন—জ্ঞানী শকুনি হওয়ার চেয়ে সরল বিশ্বাসী মূর্খ হওয়াই ভাল। জগতের অধিকাংশ জ্ঞানই হলো কুব্জা। কেবল ‘কু’ বোঝাবে। রাইয়ের পক্ষে একমাত্র শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁর একটিই কথা—”আমি মলে ঘুচিবে জঞ্জাল।” কাঁচা আমিকে পাকাও।