০৭.
জুম পাহাড় কোন উত্তর দিল না। আমার সমন্বয়ী অরমিক ভাষায় যারা কথা বলেছ, তারা কেউ নেই। আর্তনাদ করেছিল সাদইদ। তার নিজস্ব পাহাড়ও কোন জবাব দেয়নি। শিশুর গলার লকেটটি সে ঝুলিয়ে রেখেছে সাদা অশ্বের কপালে। এই চিহ্ন ছাড়া জুম পাহাড়ী জীবনের আর কোন অবশেষ নেই। কোন দিগন্তেই লোটার সাক্ষাৎ মেলেনি।
ঈগল উড়ে আসা যত অলৌকিক, তারও চেয়ে রহস্যময় লোটার হারিয়ে যাওয়া। সে যেন পয়গম্বরের মত কোথাও চলে গেছে। মৃত রাজার নাকের কাছে একটি লাল ইঁদুর মরে পড়ে আছে। রাজার নাকের ভিতর ইঁদুরের গা থেকে নেমে চলে গেছে লাল পিঁপড়ের একটা স্রোত। রাজার এই মৃত্যুও অলৌকিক।
প্রজাপতির রেণুর মত তুচ্ছ এ জীবন রাজা! বিড়বিড় করে একলা নিঃসঙ্গ মরু-যাযাবর সাদইদ বলে উঠল। গাছের ডালে বসে থাকা কালো ভয়ংকর ঈগল ছাড়া সেকথা কেউ শুনল না। দিগন্তে মিলিয়ে গেছে মহাত্মা ইহুদের জনতা।
একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল সাদইদ। তারপর নিনিভের দিকে অশ্ব হাঁকিয়ে দিল। চলতে চলতে সহসা তার দ্বিতীয় শিক্ষা শিবির, যেখানে সে আটাশ জন সৈন্য রেখে এসেছিল, যেখানে রয়েছে কিশোর সমেরু, মনে পড়ল সেকথা। সেখানে রয়েছে ক্ষুদ্র অরণ্য,সমুদ্রের হাওয়া সেখানে তবু লাগে–এখানেই সে রিবিকাকে কুড়িয়ে পেয়েছিল। শিবিরের ভিতর ঢুকে পড়ল সাদইদ। তাঁবুতে সামুদ্রিক হাওয়া এসে লাগছে। তাঁবু ফটাস ফটাস করে ক্রমাগত শব্দ করছে। যেন কোন ডানাঅলা প্রাণী।
অবাক হওয়ার শক্তিও সাদইদের ফুরিয়ে এসেছিল। সে দুই চোখ বিস্ফারিত করে চেয়ে রইল। কেউ কোথাও নেই। সমস্ত শিবির জনশূন্য। অশ্বগুলিও নেই। দেবদারুর ডালে ঝুলে আছে সমেরুর মৃতদেহ। সাদইদ বুঝল এ আত্মহত্যা নাও হতে পারে। সমেরু একটি তাঁবুর তলে তার মাকে নিয়ে থাকতে চেয়েছিল। এমন সুন্দর কিশোরের সঙ্গে রিবিকার দেখা হল না। একটি মরুশকুন ডালে বসে সমেরুর গলিত দেহ থেকে মাংস খুবলে চলেছে। শকুনের গলার শব্দে গদগদ স্ফূর্তির চলকানি।
সাদা অশ্বের গায়ে হাত রেখে সাদইদের সমস্ত দেহ থর থর করে কেঁপে উঠল। সে অশ্ব চালনা করল মরুভূমির বুকে। সমস্ত দিনটা মরুভূমির উপর শেষ হয়ে গেল। মানুষের প্রবাহ চারিদিক থেকে ছুটে চলেছে দিগ্বিদিক! সাদইদ সমস্ত রাত্রি অশ্ব চালনা করল, কেবল মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিয়েছে গাছের তলে।
কয়েক দিন পর কোন এক অপরাহে নিনিভে পৌঁছে গেল সে। মড়কে প্রাণহীন নগরী। রাত্রি আসন্ন, আলো জ্বালাবার কেউ নেই। পথের উপর দিয়ে গান গেছে যাচ্ছে একজন। চওড়া সড়ক, প্রকাণ্ড শহর। লোকটা গাইছে,নাকি আর্তনাদ করছে, বোঝা যায় না।
‘আমার বীণা টাঙানোর দেওয়ালখানা কই?
ওহে সুন্দরী নিনিভে!
পুড়ে গেছে সব, জ্বলে গেছে সর্বস্ব প্রভু!
কোথায় তারকাঁটা পোঁতা দেওয়ালখানি–
আমার বীণাখানি যে ইনিয়ে বিনিয়ে ওঠে,
মহানগরী নিনিভে! নানভী, আমার নানভী!’
বীণার মীড়ে নগরীর শেষ স্তব্ধতা জমাট বাঁধছে! সাদইদ লক্ষ্য করল পথের উপর গাছের নিচে বসে একটি অদ্ভুত ধরনের লোক কী যেন মাটির ফলকের উপর লিখে চলেছে!
‘কাল যে বেঁচে ছিল আজ সে বেঁচে নেই,
একটু আগে যে গান গাইছিল,
সে এখন শোকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।’
[মেসোপটেমিয়ার কবিতা]
–এসব কেন লিখে রাখছ তুমি?
সাদইদ প্রশ্ন করতেই লোকটা চমকে পিছন ফিরে চাইল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখ দুটি বিষয়, কিন্তু কোমল। কেমন শুকনো করে হেসে বলল-আর কেন! এটাই আমার অভিজ্ঞতা কিনা! মড়কে উচ্ছন্নে গেল, দাগা খেল প্রচুর! সবাই চারিদিক থেকে এসে ধ্বসিয়েই দিলে। তবু মায়া হয়। দু’ ছত্র লিখে রাখলাম–যদি কখনও কেউ পড়ে, ভাববে–আচ্ছা কী ভাববে বল তো!
লোকটার কথার মধ্যে পাগলামির লক্ষণ ছিল। সাদইদ কোন জবাব দিতে পারল না। লোকটা আরো হয়ত কিছু লিখত কিন্তু হাতের খোদাই করার বাটালি ফেলে দিয়ে বলল–নিয়ে যাও, তুমিও নিয়ে যাও। এখনও যা রয়েছে, দু’একটা গ্রাম বসাতে পারবে। গরু! প্রচুর গাভী! ভেড়া! ছাগল! একটু গাঁয়ের দিকে গেলেই এসব পেয়ে যাবে। নেবার লোক নেই। সবাই পালিয়েছে। মড়ককে যদি ভয় না করো, মন্দিরে ঢুকে পড়ো। প্রচুর সোনাদানা। তবে খাবার ছোঁবে না! মারা পড়বে। জল খাবে না। বিষ।
একটু থেমে লোকটা ফের পাগলের মত বলল–আজ এখানকার মানুষকে কেউ নেয় না। তুমি তো সৈনিক। আমায় নিয়ে চলো । আমি তোমার গুলাম হতে চাইছি। একটা নগর কীভাবে গড়ে ওঠে? খরিদা গুলামের মেহনতে! চাষার বেগারিতে। চাচা খাটে বলেই একটা নিনিভে তৈরি হয়। কারিগর পাড়ায় গিয়ে দেখে এসো সবাই ধুকছে। কেউ তাদের নিতে চাইছে না! ক্রীতদাস মানে হল মেহনত। উল্কির দাগা মারা ঘোটলোক! তবু বলছি, আমায় নিয়ে চলো, আমি মরব না। আমার মড়ক হয়নি।
–আপনি অসুস্থ!
–নাহ! আমি অসুস্থ নই। আমাকে রোগ এখনও ধরেনি। কিসের মায়ায় এখনও পড়ে আছি এখানে! আমার যা বলার ছিল এতক্ষণ খোদাই করলাম। চলো। আমি ভয়ে জল অবধি স্পর্শ করিনি। যদি দ্রুত কোথাও নিয়ে না যাও, আমি বাঁচব না। আমাকে বাঁচাও। আমি তোমাকে এই বাটালির মুখ থেকে হাতুড়ি থেকে একটা নগরী উপহার দেব। আমি পারি। যোদ্ধা নই। রাজাও নই। তবু পারি।
বলতে বলতে লোকটি তেষ্টায় জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে লাগল। তার চোখ দুটি ক্লান্ত হয়ে এসেছিল। মুদে আসতে চাইছিল।
সাদইদ ভাস্করের পাশে বসে পড়ে বলল–আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি হেরা! আপনি বিখ্যাত মানুষ।
সাদইদ হেরাকে চিনতে পেরেছে শুনেও হেরার চোখেমুখে তেমন কোন উৎসাহ দেখা গেল না। সাদইদ হঠাৎ মনে পড়ায় অশ্বের কপাল থেকে লকেটটা খুলে এনে হেরার হাতে দিতেই হেরার চোখ মুহূর্তে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল খুশিতে। পর মুহূর্তেই হেরার মুখ ম্লান হয়ে গেল।
হেরা বলল–আমার ছেলে কি বেঁচে আছে? কী দিয়েছ ওর মুখে? বলেই হেরা সাদইদের বুকের কাপড় সজোরে খামচে ধরল।
সাদইদ শান্ত গলায় বলল–আছে। বেঁচে আছে। মধুই দিয়েছি।
–তবে এক্ষুনি আমায় নিয়ে চলো!
বলতে বলতে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেও পারল না হেরা। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে বলল–জল!
অশ্বের পিঠে হেরাকে উঠিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে ফিরে চলল সাদইদ। পিছন ফিরে একবার নগরীর দিকে চেয়ে দেখে বলল–তোমার একটা দেওয়ালও আর আস্ত নেই। তোমাকে লুঠ করব এমন অবস্থাও তোমার নয়। তবে যা পেলাম, তার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাই। সেলাম নিনিভে! সেলাম ডানাঅলা বৃষ!
অনেক দূর আসার পর সন্ধ্যা ঘনালো ঘোরতর। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার নিবিড় রাত্রি । গত রাতে একাকী সাদইদ পথ চলেছিল। কিন্তু আজ অসুস্থ হেরাকে সঙ্গে করে অতিঘোর অন্ধকারে পথ চলার সাহস তার হল না। একটি ক্ষুদ্র মরূদ্যান তার চোখে পড়ল। চারিদিক গভীর নির্জন। এখানে জল রয়েছে। হেরার মুখে জল তুলে দিল সাদইদ। হঠাৎ চোখে পড়ল জলাশয়ের জলে অঞ্জলি পাতার সময় অন্ধকারেই একটি উট তার গলা নামাচ্ছিল–সে সামনেই বসে রয়েছে। সামনের দুপা ভাঁজ করে মাটিতে ভেঙে প্রাণীটি পিছনের অংশ তুলে জলে মুখ নামিয়েছে।
অত্যন্ত তীব্রভাবে লোটার কথা মনে পড়ে গেল। কোথায় গেল মানুষটা, কেনই বা ওভাবে হারিয়ে গেল! ওই প্রাণীটির কথা ভাবলে লোটাকেই শুধু মনে পড়ে না–কত ভাবনার উদয় হয়। মরুভূমির মানুষ তৃষ্ণার সময় এই প্রাণীটিকে হত্যা করে এর শরীর থেকে জলের থলি বার করে নেয়। বাঁচার জন্য এমন নৃশংসতার কথা একজন চাষী ভাবতে পারে না। একে না মারলে জীবন বাঁচে না।
বেঁচে থাকার এই নীতিই যুদ্ধের নীতি । মানুষ পশুর কাছে জীবন ভিক্ষা চেয়েছে হত্যার মাধ্যমে। এ ভিক্ষা নয়, অপর অস্তিত্বকে মুছে দিয়ে নিজেকে টেকানোর নামই যুদ্ধ। মানুষ যখন এভাবে বাঁচার শিক্ষা পায়–অন্য কোন উপায় ভাবতে পারে না, তখন যুদ্ধের নীতি হয়ে ওঠে আক্রমণলুঠ, হত্যা, বিনাশ। এই নীতি মানুষ তৃষ্ণা ও খাদ্যের বেলা যেমন পশুর উপর প্রয়োগ করে, তেমনি মানুষের উপরও প্রয়োগ করে।
এই নিয়মের বাইরে কি কিছু নেই? হিতেনকে হত্যা না করলে কি লোটার বাঁচা হয় না! লোটাকে না মারলে কি হিতেনের বাঁচা অর্থহীন হয়ে যায়। একটি নগর ধ্বংস না হলে কি আর একটি নগর গড়ে ওঠে না। জীবন কি মরুভূমি মাত্র! অঞ্জলিবদ্ধ হাত জলে ছোঁয়ানোর সময় সাদইদ লক্ষ্য করছিল উটটি সমান তালে মুখ নামাচ্ছে জলে।
উটের কোন গৃহ নেই। তাঁবুর পাশে তার নগ্ন আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে ঝিমোতে থাকা কাঠামো–সে শূন্য মরুভূমির উপর দাঁড়িয়ে থাকে একা। লোটা যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকত। উটকে মানুষ একটি কুকুর কি অশ্বের মত ভালবাসে না। তাকে ঘর দেয় না। স্নেহ দেয় না। তৃষ্ণার জল নেয়। হত্যা করে। তার পিঠে রতিবিহার করে। উটের কাঠামো শিল্পহীন, অশ্বের মত তার দেহে আকাশ ঝিকিমিকি বিদ্যুৎ নেই।
চাঁদ না হলে রাত্রি পার হওয়া যায় না। দিনে অশ্বারোহণ, রাত্রে বিশ্রামকতকাল এভাবে, আর কতকাল?–অন্ধকারে মুছে যাওয়া আকাশে চোখ তোলে সাদইদ। বহু দূরবর্তী এক নিঃসঙ্গ তারকা জ্বল জ্বল করে–যেন লোটার চোখ। সাদইদের এত কষ্ট হচ্ছিল যে,বুক ভেঙে পড়বে মনে হচ্ছিল। উটটা মরূদ্যান ছেড়ে অন্ধকার মরুভূমিতে নেমে চলে গেল–যেন একটি কবর ভেসে গেল, মানুষের মৃত্যু-গহ্বরের ভূপ। এই গহ্বরে তলিয়ে গেছে নগরী নিনিভে।
একজন চাষী ফলবান বৃক্ষের কাছে যা শেখে, একজন মরুভূমির যাযাবর তা কখনও শিখতে পারে না। গাছ মাটির তলে ‘আপন হৃদয় দিয়ে চিন্তা করে। নিজেরই জ্ঞানে শেকড় চালিয়ে দেয় রস টেনে নেয় দেহে, পাতার আড়ালে রচনা করে পুষ্প, দিয়ে তৈরি করে রসালো ফল। গাছ কোথাও যায় না। সে চুপচাপ ফুল ও ফল তৈরির ধ্যান করে, শেকড় ক্রমশ প্রসারিত করে। নিঃশব্দে–সে কখনও হুংকার দেয় না, আর্তনাদ করে না অযথা। একজন চাষী তাই কোথাও যেতে চায় না–সে ফোঁটাতে এবং ফলাতে ভালবাসে। অথচ রাজারা, দাসমালিকরা নগর গড়বার জন্য তাদের জমি থেকে উৎখাত করে নিয়ে যায়। কপিকলে জুড়ে দেয়। আর একজন যাযাবরকে পাকড়াও করতে পারলে মিশরের রাজা পিরামিড বানানোর পাথর বহন করিয়ে নেয়–তারা কবরের পাথর টানে উটের পিঠে করে। অথচ লোটা বৃক্ষের মত একটি নারীর ছায়ায় আশ্রয় চাইত।
অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে রিবিকার মুখটা, তার নগ্ন প্রজাপতির ছবি মনে পড়ে গেল। দিনের পর দিন ধূসর দিগন্তহারা মরুভূমি মানুষকে কী দিতে পারে? না কোন শিল্প, কোন বৃক্ষচরিত্রহায় প্রজাপতি!
আবার ভোরবেলা মরুভূমির বুকে নেমে এল হেরা আর সাদইদ। এভাবে ওরা কতদিন চলেছে খেয়াল ছিল না। কিন্তু মরুভূমি আজ আর দৃশ্যহীন নয়। একটি স্থির ছবি যেন অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। প্রায় স্থিরই বলা যায়। গরুবাছুর ছাগছাগী মেষ গাভীর দল অল্প অল্প লেজ নাড়ছিল বৃক্ষগুলির ছায়ার নিচে। বড় গাছটির তলায় মুখ খুঁজড়ে পড়ে আছে শিকড়ের আড়ালে একজন। যেন কোন মসীহ।
মুখটা শিকড়ের ভিতর গোঁজা। এতগুলি পশু নিয়ে লোকটা কোথায় যাচ্ছিল? পরনের কাপড় শতচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। চাষীর মতই খালি গা। খুব মেহনত করেছে বোঝা যায়। কিন্তু ওভাবে শুয়ে আছে কেন? নিনিভে থেকেই লোকটা দূরপাল্লার পথে নিশ্চয়ই যাত্রা করেছিল। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছে। যেন মসীহ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
সাদইদ ডাকল–অ্যাই শুনছেন! ওহে, এদিকে একবার দেখুন?
মুখ গোঁজা বেচারি কোনই সাড়া দিল না। এমনকি নড়ল না অবধি। সাদইদ বার কতক ডাকার পর ঘোড়া থেকে নেমে এল। ঠিক তখনই কোথা থেকে ছুটে এল কালো অশ্বটি। দ্রুত পড়ে থাকা মানুষটির গায়ে মুখ রেখে অদ্ভুতভাবে দাঁড়িয়ে রইল। অশ্ব স্থির। যেন সে শ্বাস নিতেও চাইছে না। সাদইদ অশ্বটিকে চেনবামাত্র মুখ গোঁজা লোটার কাছে ছুটে গেল। ঘোড়া সাদইদকেও চিনতে পেরেছিল। গা ধরে মুখটা চোখের উপর টেনে আনল সাদইদ। কষে রক্ত গড়ানো ফর্সা মুখ নির্বাপিত, পীতবর্ণ। ক্ষণকাল আগে রক্তাভায় জুলজুল করছিল, ঠোঁট কালো হয়ে গিয়েছে–দু চোখ মুদিত। লোটা জীবিত নেই। এভাবে অবশেষে এইভাবে দোস্ত!কথাগুলি উচ্চারণ করতে গিয়ে অভিমানী শিশুর মত সাদইদের ঠোঁটদুটি প্রবল আবেগে থর থর করে কেঁপে উঠল।
হেরা বলল–আকছার এমনটা ঘটছে সাদইদ! নিনিভের অভিশাপ আছে, সে পৌঁছতে দেয় না। দ্যাখো, একটু দূরেই তো গ্রাম শুরু হয়েছে! অথচ বেচারি আর যেতে পারল না। কত মানুষ এরকম রাস্তায় পড়ে রইল তার ইয়ত্তা হয় না।
কিন্তু তাই বলে লোটা এভাবে থেমে পড়বে। ও হয়ত মৃত্যুর একদণ্ড আগেও ভেবেছে, রিবিকার কাছে পৌঁছতে পারবে। ওর বিয়ে হয়েছে মাত্র কিছুদিন। আগে। ও রিবিকার জন্য ধর্ম অবধি ত্যাগ করেছিল। এই পশুগুলি সে প্রচণ্ড মেহনত করে জোগাড় করেছে। মৃত্যুর গহ্বর থেকে টেনে এনেছে।
এইসব ভাবতে ভাবতে সাদইদের বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠল। হেরা বোঝে কিনা জানা নেই, যে মানুষ মড়কের ভিতর থেকে পশুদের জোগাড় করে আনে, রাজা হিতেনকে বর্শায় গেঁথে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে ঘোড়া ছোটায় নিনিভের দিকে, তার থেমে পড়া উচিত নয়। এই মুহূর্তে তার জেগে উ পণ্ডদল তাড়িয়ে নিয়ে দিগন্ত পার হয়ে গ্রামে পৌঁছনো দরকার। লালমুখো ইঁদুর যখন দেখা দেয়, তখনই মড়ক লাগে–পশুর দিকে চেয়ে মানুষের কতকিছু জানতে হয়। মানুষের মড়কের সংবাদ বহন করছে লাল ইঁদুর–একথা লোটা নিশ্চয়ই জানত! সে জেনেশুনেই, ইঁদুরের সংকেত পেয়েও, রাজা হিতেন রিবিকাকে ছিনিয়ে না নিয়ে, লোটাকে বধ না করে ফিরে যেতে চাইল, পারল না–সমস্ত সংকেত জানা ছিল–সংকেত পেয়েই লোটা লাফিয়ে চড়ল ঘোড়ায়। ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। এভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল লোটা। লোটা শেষ হয়ে গেল।
–এখান থেকেই তোমাকে শুরু করতে হবে সাদইদ। ঠিক এখান থেকে। চমৎকারভাবে বলে উঠল স্থপতি হেরা–নিনিভের নির্মাতা।
একথা শুনে তামাম প্রত্যঙ্গ বিপুল এক বেগে, হৃদয় এক মহাভাবে আন্দোলিত হতে লাগল সাদইদের। এই মরুমর্ত কী নিঃসীম তৃষ্ণা জাগায়–এ তৃষ্ণা জলে মেটে না। নারী, শিশু এবং শিল্পেও মেটে না–একটি প্রজাপতির ইন্দ্রধনুর রঙেও সেই তৃষ্ণা ছড়ানো থাকে–এই বাঁচা যে কী, কেউ জানে না। লোটা যেভাবে মরে পড়ে রইল, সেই তৃষ্ণার কী রূপ,কোন ভাষায় তা আঁকা যায় না। সে পৌঁছতে চেয়েছে; ফিনিসীয় বর্ণমালায় তার বিবরণ নেই, হাম্বুরাবির অনুশাসনফলকে তার হদিস নেই, আমারনার পত্রাবলীতে তার ঠিকানা মেলে না। উগারীতের সাহিত্যে, মেসোপটেমিয়ার কবিতায় তার কোন চিহ্ন খুঁজে পাবে না কেউ। তবু এখান থেকেই শুরু করতে হবে।
লোটার গায়ে হাত দিল সাদইদ। হিম। খাস স্তব্ধ। সে শিশুর মত মুখ গুজড়ে পড়ে ছিল। যেন সে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কেন এভাবে পড়ে থাকা লোটা? লোটা কোন উত্তর দিল না। এই পশুদল নিয়ে তুমি কী করতে, আমায় বলে দাও। তোমার অশ্ব রইল, যাকে নিয়ে তুমি একলা খেলা করতে। কত অপরাহু কত প্রভাত তুমি একলা খেলা করেছ, আমার বানানো ভাষা তোমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ভাষা পারে না। ভাষার উর্ধ্বে থাকে হৃদয়।
সাদইদ সহসা লক্ষ্য করে কালো অশ্বের কপালে একটি মাটির ফলক। ভাঙাচোরা নকশা আঁচড় কেটে কেটে তৈরি, খুবই পুরাতন নকশা, একজন রাজার ছবি, অনেকটা ফেরাউনের মত, পায়ের তলায় দেবী ইস্তারের নগ্নমূর্তি। এ দেবী রিবিকা ছাড়া কেউ নয়।
অপটু হাতে মৃত্যুর আগে একজন যাযাবর একে রেখে গেল। ফলকে হাত রেখে হেরার দিকে ঈষৎ বিস্মিত চোখে চেয়ে রইল সাদইদ। হেরা পানসে হেসে বলল–তোমার বন্ধু খুব উচ্চাশী ছিল মনে হচ্ছে। সে সারগন হওয়ার স্বপ্ন দেখত।
–না হেরা। আপনি নোটার অভিপ্রায় বুঝবেন না।
–কেন?
–-ও এঁকেছে ওর স্ত্রীর ছায়া। সে যেন তোটাকে স্বীকার করে। এতগুলো পশু নিয়ে সে ফিরছে, সে রাজা ছাড়া কী? কী আশ্চর্য! কোন দেবদাসী কখনও ওকে সারগন বলে ডাকেনি!
ক্রমাগত লোটার স্মৃতি মরু আকাশের ভাসমান মেঘের পতিত ছায়ার মত দিগন্ত ছুঁয়ে ছুটে আসছিল। কালো ঘোড়ার কপালে ঝোলানো ফলক লোটা পরম আহ্লাদে পথ চলতে চলতে সংগ্রহ করে উৎকীর্ণ করেছে। এ ফলক শিলার মত মসৃণ। সহজে আঁচড় পড়ে। অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সাদইদ হাতে ধরা ফলক ছেড়ে দিয়ে বলল–তাহলে এখান থেকেই শুরু!
হেরা বলল–একজন যাযাবর ঠিক এখান থেকেই শুরু করে কিনা! ফেরাউনের রাজসভায় এমন অনেক যাযাবর মন্ত্রিত্ব করেছে, যার হাতে উটের লাগাম ধরা ছাড়া ধরবার কিছুই ছিল না। লোটা যদি একজন চাষী হত, কখনও মড়কের শহরে পা দিত না। দুঃখিত সাদইদ, একথায় আমি কিন্তু তোমায় কোন ইঙ্গিত করিনি।
অসহায় আর করুণ চোখ দুটি তুলে সাদইদ হেরাকে বলল–তুমি শিল্পী তোমার তো অহংকার থাকবেই। স্ত্রী মরেছে মড়কে, শিশু হারিয়ে গেছে। তথাপি বাঁচালতার কোন কামাই নেই। ইহুদের অহংকার লাঠি, ফেরাউনের পিরামিড, তোমার অহংকার ছেনি, বাটালি। কিন্তু লোটা? ওর ছিল উট। এই কালো ঘোড়াটা ওকে আমি উপহার দিয়েছিলাম। ফলে উটের পূজারী কখনও। মাথা তুলে কথা বলত না। ওর ছিল সাহস–তাই সে মড়ককেও ভয় পায়নি। যাক গে। লোটার ঘোড়াটা এবার তুমি নাও। তোমায় দিচ্ছি।
হেরা কেমন অসহায়ের মত ব্যস্ত সুরে বলে উঠল–না না। ওটা তুমিই নাও । আমার এই সাদাটাই ভাল। বেশ আছি এটার পিঠে!
–ওটা ভাল নিশ্চয়। এটাও খারাপ না। তবে সাদাটা কিঞ্চিৎ বজ্জাত। তোমায় ফেলে দিতে পারে।
–না না। ফেলবে কেন! আমরা তো ধীরে ধীরে যাব। এতগুলো জীবকে তো খেদিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
–সে আমি দেখব’খন তুমি কালোটার পিঠে উঠে পড়।
–না সাদইদ । আমায় বিরক্ত করো না। বলছি তো সাদাটায় বেশ আছি।
–আমি যা দিতে চাইছি, তোমার তাতে আপত্তি কিসের?
কিয়ৎক্ষণ চুপ করে থেকে হেরা বলল-লোটার অশ্ব! ভেবে দ্যাখো, সেটা কী হতে পারে। তা ছাড়া লোটা অসুস্থ ছিল বন্ধু সাদ! মিতে তোমায় গোপন করব না–তোমার মিতবউ মড়কে মরেছে–একটা লাল ইঁদুর কী ভয়ানক। আমায় ওভাবে বারবার তাগাদা দিচ্ছ কেন? একটা অসুস্থ উট-উপাসক ভাড়াটে সেনা–মানে, তুমি ঠিক বুঝবে না, আমি কী বলতে চাইছি! ইঁদুর কী ভয়ানক। তা ছাড়া উট-উপাসক! মানে ঠিক তোমায়…
–অ। ঠিক আছে!
দণ্ডভর দম বন্ধ রেখে সাদইদ দিগন্তের আবছা গ্রামগুলির দিকে চাইল। চেয়েই থাকল। তার চোখ অপ্রতিরোধ্য অশুতে ছলছল করে উঠল। শান্ত গলায় সে বলল ঠিক আছে। এখান থেকেই যখন শুরু করতে চাই! নাও, তুমি সাদাটায় গিয়ে উঠে পড়। আমি লোটার ঘোড়ায় চড়ছি। আমাকে মৃত্যু স্পর্শ করবে না। যদি তাই হত, তাহলে তোমাকে সঙ্গে নিলাম কেন? মড়ক আমাকে ধরবে না স্থপতি!
শেষের বাক্য দুটি সাদইদের গলার খাদে বুজে গেল। ততক্ষণে শ্বেত অশ্বের পানে এগিয়ে গিয়েছে, হেরা শুনতে পেল না।
সাদইদ কালো অষের পিঠে চড়ে হু হু করে কেঁদে ফেলল নিঃশব্দে। তারপর সে তার অনভ্যস্ত গলায় যাযাবরী স্বর নকল করে চিৎকার করে উঠল–হরররররহু! হরররররহ্! হাহা! হিররররর হে! হিরররর ইহ! হো হো! উররররহ্! হট হট হাঃ! হা হা হ্!
কালো অশ্ব পশুদলকে খেদিয়ে নিয়ে চলল। পড়ে রইল লোটার নিষ্প্রাণ দেহ। বৃক্ষের ডালগুলি মরুশকুনের ভিড়ে থিক থিক করছে। চোখগুলি হলুদ রেখার বৃত্তে তালশাঁসের ভিতরের জলের মত টলটলিয়ে উঠছে।
গ্রাম ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল। সবুজ গাছপালার নিবিড় ছবি। এই তার জন্মভূমি। সেই জন্ম যেন কিংবদন্তীর মত । পিতা নোহ কখনও এখানে ছিলেন নশ্চয়। মিশরেও ছিলেন তিনি। তিনি রয়েছেন রক্তে আর নিঃশ্বাসে।
সাদইদ মনে মনে বলল–এই জীবগুলি সবই লোটার দান পিতা। এদের তুমি রক্ষা কর। হেরার পুত্র যেন বেঁচে থাকে।