০৫.
লোটার কেবলই মনে হচ্ছিল তার সমস্ত গা পচে যাবে। শব বহনের সময় মানুষের মৃতদেহ থেকে গলিত রক্ত সারা দেহে লিপ্ত হয়েছে, দেহ থেকে একটা বীভৎস গন্ধ কিছুতেই নড়তে চাইছে না। একথা সে কাকে বলবে? কালো ঘোড়া ছুটিয়ে সমস্ত রাত সে জ্যোৎস্নায় মরুভূমি তোলপাড় করেছে। কিন্তু এভাবে তো বাঁচা যায় না।
সকালবেলায় রুহার মৃত্যু-সংবাদ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। রুহার মৃত মুখে গাঁজলা উঠছে। রুহা ভোররাতের কোন এক সময় বিষ গিলেছে। মরবার সময় সে অন্য দেবদাসীদের বলে গেছে–সে ছিল চাষীর মেয়ে। দেবী ইস্তার যেমন দুঃখী, সেও তাই। মরে যেতে তার বাধে না। আবার সে পৃথিবীতে আসবে। সঙ্গে থাকবে তামুজদেব। তামুজকে যুদ্ধের গহ্বর থেকে সে উদ্ধার করে ফিরে আসবে। সে আর দেবদাসীর জীবন নয়, চাষীকন্যার মত দুঃখে তাপে বেঁচে থাকবে। হাজার একটা লোক তাকে ছিঁড়ে খাবে দেবী ইস্তার তা চান না, তাই সে চলে যাচ্ছে।
খোড়ো মন্দিরের সিঁড়ির তলায় তক্তার উপর শোয়ানো হয়েছে তাকে। তার চোখ তুলে তাকানোর সাধ্য নেই। গা খিঁচুনি দিচ্ছে প্রবল ধাক্কায়। তার পা দু’টি তক্তার উপর স্থির রাখা যাচ্ছে না–মাথা পড়ে যাচ্ছে তক্তা ছাড়িয়ে। মাথা একজন, অন্যজন পা দু’খানি ধরে আছে চেপে। এই দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখছে লোটা। রুহার মুখে যাতে বাতাস লাগে, সেজন্য লোকজনের ভিড় সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। লোটা স্পষ্ট সব দেখতে পাচ্ছে। তার গায়ে গরম জল ঢালছে। এক কানা বুড়ি। এই বুড়ি ছাড়া কেউ লোটাকে স্পর্শ করে না। বুড়ি বোবা বলে তার ভাষার বালাই নেই। তাছাড়া বুড়ি তার নিজের ধর্ম কী বলতে পারে না। তার কাপড়ের আঁচলে বাঁধা থাকে গুটিকতক কুমীরের প্রতীক। তাই হয়ত তার দেবতা।
বুড়ি গরম জল ঢেলে ঢেলে পাথরের খোয়া দিয়ে নোটার গায়ের রক্ত ঘষে তুলতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। কানা বুড়ি এক চোখে ঝাঁপসা দেখতে পায়। লোটা কড়াইতে করে মৃতদের পরিত্যক্ত কাপড়-চোপড় সেদ্ধ করে চলেছে। জ্বালানি ঠেলে দিচ্ছে আর লাঠি দিয়ে কড়াইয়ের সেদ্ধ হতে থাকা বাষ্পময় বস্ত্রগুলি গুতোচ্ছে। মাঝে মাঝে গরম জল গায়ে পড়ার সময় লোটা সামান্য চেঁচিয়ে উঠছে। সে দেখছে চোখের সামনে রুহার মৃত্যু।
খিঁচুনি দিতে দিতে এক সময় রুহার দেহ স্থির হয়ে গেল। লোটা তখন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। সাদইদ লোটার সামনে এসে দাঁড়াল চুপচাপ। অনেকক্ষণ কোন কথাই বলল না । লোটা রক্তাক্ত চোখ তুলে সাদইদকে একবার। দেখল। তার বুকে কান্না জমাট বেঁধে গেল–সে আর কাঁদতে পারল না।
লোটা জানত এখন তাকে কী করতে হবে। ধীরে ধীরে সে উঠে দাঁড়াল। একটা উট টেনে আনল মৃতদেহের কাছে। সবাই সরে দাঁড়াল একটু তফাতে। মৃতদেহ স্পর্শ করা মাত্র লোটার তাবৎ দেহ থরথর করে কেঁপে উঠল।
লোটা অদ্ভুত একটা আর্তনাদ করে উঠল। তার ভাষা তো কেউ বোঝে না। বারবার সে সাদইদের দিকে চোখ তুলে কী যেন প্রশ্ন করছিল। সাদইদ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত করল রিবিকাকে আনা দরকার। ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে সাদইদ রিবিকাকে পাহাড় থেকে তুলে আনল।
লোটা তখনও আর্তনাদ করে চলেছে। রিবিকা দুই চোখ বিস্ফারিত করে শুনতে পেল–ছায়া। ছায়া থাকবে তো! রুহার ছায়া কি থাকবে না কোথাও?
কথা বলতে গিয়ে রিবিকার গলা কান্নায় বুজে এল। সকলে তার মুখের দিকে প্রশ্নাতুর চোখে চেয়ে আছে। রিবিকা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল–ছায়া। ও বেচারি রুহার ছায়ার কথা বলছে!
এখানকার কিছু মানুষ রিবিকার কথা বুঝতে পারল। রিবিকা বিচিত্র ভাষা জানে। কখনও সে আমারনার ভাষা, কখনও হিদ্দেকলের ভাষা, কখনও কনানী ভাষায় বলল-ছায়া কি থাকে না কোথাও!
পুরোহিত রুহার শেষ স্নান করিয়ে দিল। তারপর বলল–ছায়া তো থাকেই । থাকবে না কেন? কিন্তু কোথায় থাকে সে কি আর দেখা যায়। জ্ঞানী মানুষ দেখতে পান মাত্র। তুমি তো পাপ করেছ লোটা। সরে দাঁড়াও!
পুরোহিত আর লোটাকে রুহার দেহ স্পর্শ করতে দিল না। সাদইদ লোটাকেই মৃতদেহ উটের পিঠে তোলার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল। পুরোহিত সেই নির্দেশ বাতিল করে দিয়ে বলল–মানুষ মৃতাকেও গমন করে জানবেন। লোটা শবানুগমন করতে পাবে না।
রুহাকে পিঠে করে উট চলতে শুরু করল দিগন্তের দিকে। পুরোহিত প্রবল ঘৃণায় লোকটাকে বলল–ভাষা তো শিখলে না! আমি কতদিন তোমায় যুদ্ধের জরুরি ভাষা, তাঁবুর ভাষা শেখাতে চাইলাম। গা করলে না। নিজ ধর্মে তুমি একটা পাষণ্ড! সালেহর মত তোমারও কোথাও ঠাঁই নেই বাপু! চলো হে, শব এখন যাত্রা করুক, রোদ চড়া হয়ে যাচ্ছে! একটা উটই তোমার নিয়তি, ওই বিকট পশুটাই একদিন তোমাকে দিগন্তে পৌঁছে দেবে–ভাবনা কিসের!
যাত্রা যখন সবে শুরু হয়েছে, সকলে নড়েচড়ে চলতে শুরু করেছে, মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য, এ যে যুদ্ধে বিনাশ হওয়া নয়, তাই এর শবানুগমন আছে, উট একলা দিগন্তে নিয়ে যাবে না, মানুষও শবের পিছনে পিছনে যাবে মৃত্যুর খাদ অবধি–মানুষ সবে চলতে শুরু করেছে, সবার শেষে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ইহুদ। তিনি লোটার কাছে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে নিঃশব্দে কাঁধে হাত রাখলেন।
লোটা আশ্চর্য হল। মানুষটি তার চরম উন্মত্ত অবস্থায় কাঁধে হাত রেখেছিলেন, চরম দুর্দশার মুহূর্তে এবং এখন শোক আর ব্যর্থতার, অপমানের। শেষহীন সংকটকালেএগিয়ে এসে দ্বিতীয়বার হাত রাখলেন। এ কেমন মানুষ!
চাপা সুরে এই প্রথম ইহুদ কথা বললেন–তোমার ভাষায় যে কথা বলে সেই তোমার আপনজন লোটা। দুঃখ করো না। যবহ তোমায় বিচ্ছিন্ন করেছেন।
লোটা ইহুদের কথা বুঝতে পারল না বটে, কিন্তু মনে মনে কী যেন এক আশ্বাস অনুভব করল।
উট তখন বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে।
লোটাকে ইহুদও ছেড়ে গেলেন। শবানুগামী দলটি ক্রমশ দূরবর্তী দৃশ্যে মিলিয়ে যেতে থাকে। লোটার কালো ঘোড়াটি কাছে এসে পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রবল শক্তিমান নিবার্ক প্রাণীটিই তার একান্ত আশ্রয়। লোটার চোখ যবহের চোখের মত জ্বলতে থাকে। ইহুদের ভাষা সে বোঝেনি, কিন্তু কেমন এক ধারা আশ্বাস পেয়েছে, অবশ্য একজন গামছাবালার আশ্বাসেরই বা কী দাম! বেচারি এরপর অন্য দেবদাসীর তাঁবেদারি করবে। ইহুদের কোলে রুহার কালো বাচ্চাটা খেলা করছিল। একজন কোন দেবদাসীর কাছে বাচ্চাটা জমা হবে। যারা বৃদ্ধা, তারাই অবৈধ পিতৃমাতৃহীন শিশুদের আগলায়।
লোটা সাদইদকেও চলে যেতে দেখল পাহাড়ের দিকে–সুন্দরী ওই মেয়েটিকে ঘোড়ার উপর কোলের কাছে বসিয়ে নিয়ে রাজার হালে সাদইদ হেলেদুলে যাচ্ছে–এই দৃশ্য অসহ্য! নোটার কাঁধে তামাম যুদ্ধের ভার। অথচ সকলের জন্য রয়েছে নারী আর শিশু। লোটার কেউ নেই। আছে কেবল অপমান। রুহা আত্মহত্যা করেছে ঘৃণায়। পূর্বদেশে চাষীদের সঙ্গে উটবালাদের দাঙ্গা দীর্ঘকালের ঘটনা। চাষীরা উট উপাসকদের সহ্য করে না। যাযাবর বেদে বলে উপহাস করে। যারা থিতু জীবন পেয়েছে, তারা ভেসে বেড়ানোদের কেনই বা সইবে! হানাদার বলে প্রবল ঘৃণায় চোখ কোঁচকায়। সবই লোটা জানে।
অথচ সবই ভগবানের ইচ্ছে। বাবিলের জিগুরাত ঈশ্বর ধ্বংস করে দিলেন। মানুষের স্পর্ধা আকাশের দেবতাদের ভাল লাগল না। মানুষ স্বর্গের সিঁড়ি বানিয়ে দেবতাদের আক্রমণ করতে চেয়েছিল। দেবতাদের অন্তত তাই ধারণা। স্বর্গ ধ্বংস হল–এই শাস্তিই যথেষ্ট ছিল। ক্রুদ্ধ দেবতারা কিন্তু আক্রোশবশত মানুষকেই বিচ্ছিন্ন করে দিলেন! ভাষা আলাদা হয়ে গেল।
লোটা ভাবল, তার নিজের ভাষাটি ঈশ্বরের দান। ঈশ্বরই লোটার বিচ্ছিন্নতা চেয়েছেন। না চাইলে এই ভাষা তিনি যোগাচ্ছেন কোথা থেকে! ভাষা ত্যাগ করলে মানুষের আর রইল কী? সাদইদ তার ভাষাই কেড়ে নিতে চাইছে। ভাষা চলে গেলে ধর্মও আর আস্ত থাকবে না। সাদইদ তাকে কিছুই দেয়নি। বরং কেড়ে নিতে চাইছে। অথচ বারংবার আশ্বাস দিয়ে চলেছে, নিনিভে ধ্বংস হলে যুদ্ধের যা পাওনা লুঠ করে নিতে পারা যাবে, তাই হবে জীবনের পক্ষে যথেষ্ট। অতঃপর তারা কানের দিকে ঢুকে যাবে। সেইসব লুঠ করা পশু, খাদ্য, বস্ত্র, অলংকারাদি নিয়ে কনানে ঢুকতে পারলে জীবনটা অন্যরকম হতে পারে। আসলে কী হতে পারে কেউ জানে না। রাজা হিতেন সমস্তই কেড়ে নিতে পারে।
এই যুদ্ধে জীবন তো কোথাও আস্ত নেই। সর্বত্র ধ্বংসলীলা চলেছে। চাষীর খেতখামার জ্বালিয়ে দিয়েছে সর্বত্র। পশু বধ করে চলে গেছে অসুররা। চাষীরা যেসব রাষ্ট্রে খাল কেটে চাষ করার নতুন প্রণালী আবিষ্কার করেছে, তারাও গৃহছাড়া–খালগুলি বুজিয়ে দিয়ে গেছে যে যেমন পেরেছে–শুধু অসুর নয়, সর্বাত্মক এই যুদ্ধে সকলেই যেন সকলের শত্রু হয়ে গেছে।
সবচেয়ে দুঃখজনক, আঙুর কুঞ্জগুলি তছনছ করেছে এই যুদ্ধ। মানুষ মদ অবধি তৈরি করে খেতে পারছে না। মদ না পেলে সৈনিক লড়বে কী করে?
ভাবতে ভাবতে লোটার আকণ্ঠ তৃষ্ণা জেগে ওঠে। মদ আর শুঁটকির চাট তার রক্তের অধিকার, রক্তের উষ্ণতা এ ছাড়া হয় না। শীত আসার আগেই যদি নিনিভে ধ্বংস না হয়, তবে এই শিবির প্রাণীশূন্য হয়ে যাবে। সাদইদ কাপড়, মদ, খাদ্য কোনটাই পর্যাপ্ত জোগাড় করতে পারবে না। গ্রামগুলিতে দুর্ভিক্ষ, মহামারী–তন্দুর বিড়! একখানা রুমালটি আর চারখও ভেড়ার মাংস নিয়ে একটা পরিবারে হানাহানি অবধি হয়ে যাচ্ছে।
জীবনটা এখন অন্ধ কেঁচোর মত–কোনদিকে চলেছে বোঝা যায় না। যেদিকে অত্যধিক আঘাত পাবে মনে করে, সেদিক থেকে গা টেনে ভয়ে অন্যদিকে ছোটে। কিন্তু কোথায়, জানার উপায় নেই। চলেছে মাত্র। দিকহীন, অন্ধ এক যাত্রার নাম যুদ্ধ। ক্রীতদাস যারা, কেন ক্রীতদাস তা যেমন তারা জানে না, যুদ্ধ কেন, কিসের যুদ্ধ সে জানে না। ইহুদও কি জানেন এই যাত্রার অবধি? যাদের তিনি সঙ্গে করে এনেছিলেন মিশর থেকে, তারা কোথায়? সবই মরুভূমিতে হারিয়ে ফেলেছেন। লোকটা নিতান্তই বোকা! তাঁর অনুসরণকারী নেই। পশুদল নেই। অথচ লাঠিখানা হাতছাড়া করছেন না। সৈনিকরা তাঁকে বেঁধে এনে দেবদাসীর মন্দিরের সামনে টুল পেতে বসতে দিয়েছে। সাদইদ এই বেচারির সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। কেনই বা না হবে? লাঠিধারীদের এই যুদ্ধের সময় কত বেশেই না দেখা যায়। আসলে এসব লোক, আপনি বাঁচলে বাপের নাম করে, মোদ্দা হল বাঁচা-মাথাটা এখানে জড়ে দিয়েছে। তা, লোকটা বোকা, কিন্তু ভদ্র। কেঁচোবৎ নড়াচড়া করছে। কাঁধে হাত রাখলে মন্দ লাগে না। তবে গা কেমন সিরসির করে।
ভাবতে ভাবতে লোটার বুক হু-হুঁ করে উঠল। কোথায় চলেছি? কেন যুদ্ধ করছি! শীতে বাঁচব কিনা জানি না। সাঁজোয়া ভর্তি করে লাশ বহে এনে পোশাক ছিনতাই করছি–জীবনের এই তলানি এত উষর যে, সেখানে একটা নারী অবধি পাওয়া যায় না! কারুকে ছুঁয়ে ফেললে সে আত্মহত্যা করে! এই অন্ধ জীবন আর আমি চাই না, হা নবী!
লোটা আকাশে মুখ তুলে সুতীব্র চিৎকার করে উঠল। জেহাদী এই কণ্ঠস্বর যুদ্ধের আর্তনাদ। মানুষ যখন শত্রুপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন এভাবে চিৎকার করে। এই আর্তনাদ মনে হয়, তামাম চন্দ্রকলাকৃতি বাঁকা ভূখণ্ডকে মথিত করছে। আকাশ থেকে চোখ নামালো লোটা। দূরপথে চোখে পড়ল এক পুরোহিত একা ছুটছে রুহাকে বহে নিয়ে যাওয়া উটের শবযাত্রীর পশ্চাতে, সে পিছিয়ে পড়েছে। এই পুরুত টোলে বসে সাদইদের জুমপাহাড়ী অরমিক সমন্বয়ী ভাষা শেখানোর ওস্তাদি করে। শালা পা নাচায় আর উচ্চারণ করে ইয়াহো! ইয়াহো! হা খোদা! যখন লোটা টোলের বাইরে দেবদারুর তলায় বসে থাকে-ওই পুরুত বাঁকা তলচোখে যেন ব্যঙ্গ করে। একে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে হল লোটার।
লোটা ফের আর্তনাদ করে উঠল। এ গর্জন তার নাভিতে মোচড় দিয়ে আকাশে উঠে যাচ্ছিল। লোটা হাহাকার করে উঠল–এই মুহূর্তেও তার ভাষা কেউ বুঝতে পারছে না।
নোটার আর্তনাদে সাদইদের পাহাড় অবধি কেঁপে উঠল! গা কেঁপে উঠল। রিবিকা ব্যাকুল স্বরে বলে উঠল–লোটা কেন অমন করছে! ও কি মরে যাবে!
আবার আর্তনাদ ভেসে এল-সলেহও … …ও ও… পি. ই ই তা… আ… আ… আ…
রিবিকা আপাদমস্তক শিহরিত হয়। তার শরীর কণ্টকিত হয়ে ওঠে।
অগ্নিদগ্ধ গ্রাম। দুর্ভিক্ষ-কবলিত উৎসন্ন জনপদ। মারী-পীড়িত লোকশূন্য গৃহ। খুঁটায় ঝুলন্ত মৃতদেহ। শেয়াল-কুকুরে-শকুনে টানাটানি করা মৃত্যু। নগরীর একটি ধ্বস্ত দেওয়াল আগুনে পুড়ে কালো হয়েছে। মুহূর্তে চোখের উপর দিয়ে। ছবির মত ভেসে যায় সাদইদের। এ যেন সেই আর্তনাদ, যার নগর কিংবা গ্রাম বলে কিছু নেই–সর্বত্র এই প্রাণফাটা চিৎকার উঠছে! কিন্তু এ আর্তনাদ এখন লোটারই একান্ত হৃদয় থেকে নিংড়ে বার হচ্ছে। তার মুখ বন্ধ করার উপায় সাদইদ নির্ণয় করতে পারছে না।
সাদইদ অশ্বপৃষ্ঠ থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের দিকে চাইল। দিগন্তে ওরা পৌঁছে গেছে। ছোট পাহাড়টির মাথায় রয়েছে বালদেবের মন্দির। সেখান থেকে প্রকাণ্ড একটি ঘণ্টাধ্বনি কান পাতলে এই নির্জন দুপুরে শোনা যেতে পারে। সেখানে রয়েছে পবিত্র শিলা আর পবিত্র বৃক্ষ। পুংশক্তি আর স্ত্রীশক্তির প্রতীক। এ স্থান গ্রাম নয়, নগরও নয়। অথচ দেবতা ছোট পাহাড়টির শীর্ষস্থান কখন কীভাবে দখল করে বসেছেন সাদইদ জানতেই পারেনি। শুধু তাই নয়, সূর্য মন্দিরগুলির সামনে গাছের বদলে খুঁটি পুঁতে রেখেছে দেবদাসীরা। এর নাম ‘আসেরা’।
এরা দেবদাসী বটে, কিন্তু কেউই চাষী জীবনকে ভুলতে পারে না। দেবী ইস্তার অথবা বালদেবকে স্মরণ করে। আসেরা তারই প্রমাণ। এরা কেউ ছিল বাবিলে, আসিরিয়ায় অথবা মিশরেকীভাবে ভাসিয়ে এনেছে যুদ্ধ! নিনিভের অবরোধ। মিশরের দুর্ভিক্ষ। কিন্তু এদের বেশির ভাগ এরা অরমিক ভাষাটি মান্য করল, তাঁবুর ভাষা দ্রুত শিখল–কেবল উট-উপাসক বেদেটি মাথা নোয়াল না। তার কারণ, মিশরীয়, মোসোপটেমিয়া, হিটাইট আর কনানী হিব্রসদৃশ সমন্বয়ী ভাষাটি কীলকাকৃতি নকশার ভাষা নয়। অথচ এ ভাষা মরুভূমিরই ভাষা। এ কথা লোটা বুঝতেই চাইল না। সে ভয় পেয়ে গেল। নকশা থেকে লিপিতে এ ভাষার পরিণতি ঘটেছে, একথা লোটা সহ্য করল না। তার ভাষা কত পুরনো। ধর্মও পুরনো।
লোটা কি প্রাচীন আমালেক জাতির লোক? প্যালেস্টাইনের মরু অঞ্চলে এর পূর্বপুরুষরা বাস করত? বারো গোষ্ঠীর কোন এক গোষ্ঠীই কি তার গোষ্ঠী? কী যে তার অতীত ইতিহাস, জানা যায় না। এমন হতে পারে, তার গোত্রের নাম। হয়ত ‘আসের’ । সে যে চাষবাস মোটেও জানে না, তা বোঝা যায়।
তবে লোটা যে ইউসুফ’ গোত্র নয়,তা ঠিক। কারণ বারো গোষ্ঠীরা আব্রাহামী আমোরাইট। মোসি ছিলেন ইউসুফ গোষ্ঠীর লোক হয়ত। কী ছিলেন বোঝা ভার। বারো গোষ্ঠীর নামগুলি চমৎকার। রুবেন, সিমিওন, লেবি, যিহুদা, দান, নপ্তালি, গাদ, আসের, ইষাখর, সবুলুন, ইউসুফ। হতে পারে মোসি ছিলেন যিহুদা গোত্রের মানুষ। কী হতে পারে কেউ জানে না।
লোটার আমালেকরা হয়ত বারো গোষ্ঠীরই কোন গোত্র-উদ্ভূত। কী বিচিত্র। গোত্রধর্মগুলি! কেন যে লোটাকে বোঝানো গেল না, এ ভাষা যেমন চাষীর ভাষা, তেমনি তাঁরুর মাংসখেকোদের ভাষাও বটে। যাযাবরী সংস্কৃতি কী উচাটন!
না পারে গৃহনির্মাণ, না পারে ধাতু বা পাথরের কাজ কিংবা চাষবাস। পুরো এক যাযাবর! এ লোক যুদ্ধ ছাড়া কিছুই পারবে না। পারবে হানা দিতে, লুঠ করতে, ঘর জ্বালাতে, উট দিয়ে শস্যক্ষেত্র তছনছ করে দিতে! এ মেষ প্রকৃতি নয়। উটের মত শূন্যে ভাসমান জীব। খুব অদ্ভুত যে,এখানকার অন্য সৈনিক আর দেবদাসীরা নিজেদের চাষী মনে করে–দুঃখী, কিন্তু তাদের জমিজায়দাদ ছিল একদা–ঐশ্বর্য ছিল! এই গর্ব তাদের সম্বল। ক্রীতদাসত্বেও অনেকে তার চাষীত্বের স্বপ্ন বিসর্জন দিতে পারেনি। অথচ যখন একজন সৈনিক তার বেদনার্ত গলায় সুর করে বলে :
‘আমার থাকবে এক আঙুর বাগিচা–
এ আমার নিজের কুঞ্জখানি প্রিয়,
বসিতে দিও ঠাঁই বিছায়ে আঁচলখানি তব;
ডুমুর বৃক্ষের তলে, আমার সে নিজস্ব ডুমুর,
কেউ মোরে হানিবে না তীর, বর্শা বা কুড়ল,
নির্ভয় সে জীবন মম, সেই মোর অমরাবতী তীরে
স্বপ্নের কুটীর ॥ [মীখা ৪ : ৪ ]
বোঝা যায় না, এই সৈনিকটি কে? যাযাবর,নাকি চাষী! এ তার কিংবদন্তীর সত্যযুগে নিবিষ্ট দু চোখ মেলে চেয়ে থাকা। সাদইদ জানে, যাযাবর আর চাষী আলাদা থাকেনি চন্দ্রকলার বাঁকা মৃত্তিকায়–অথচ লোটাকে তারা সহ্য করল না।
অথচ নিশিমার মত সামান্য দেবদাসী তাকে কুকুরের মত ধাক্কা দিয়ে দুয়ারের বাইরে ঠেলে ফেলে দিলে। এই দেবদাসীরা আমনের বউ। দেবতা সামাশকে সহ্য করে তারা, গ্রহণ করেছে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের তুলাদণ্ডে মেপে। বালদেব আর আমন বা সামাশ অনেক শক্তিশালী–কিন্তু উট কী কাঙাল একটি জীব! অচ্ছুত ওই জীবটা, মৃতদেহ বহা ছাড়া কোনওই কাজ হয় না। চাষী বৃষভক্ত, তার শস্য বইবার গাড়ি কী উন্নত! দেবী ইস্তার কী লাবণ্যময়ী। হিত্তীয়রা রথ চালায়, আমনভক্তরানী ইবেলসূর্যের ধর্ম সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে গেছেন! রথের যুগ এখন শ্লথগতি ভাসমান উট কী বোকা! গা ঘৃণায় কুঁচকে যায়।
নিশিমারা সম্রাট ফেরাউনের ধাতুবলয় নির্মিত রথের চাকা বালুরাশির ঘর্ষণে আগুন-স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে ছড়াতে ধাবিত হতে দেখেছে। কী শৌর্য! এই রথ নিয়ে ফেরাউন মোসিকে লাল দরিয়া অবধি তাড়া করে গেছিল! রাজা হিতেন যখন সুন্দরীদের দেখতে আসে এই জুমপাহাড়ীতে, তখনও আগুন ঝলসায় চাকার আবর্তে। রাজার পায়ে লুটিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। সাধ হয় তেনার হারেমে গিয়ে থাকতে। রাজা হিতেনের দেহে রতি আর কামের সমান অবস্থা। কেমন সেই হারেম। নিশিমা বলেছে–আমি যাব! কিন্তু কে তাকে নিচ্ছে? ত রূপ তো নিশিমার নেই!
সাদইদ ভাবতে ভাবতে রিবিকার সুন্দর মুখোনির দিকে সকরুণ চোখে দেখল। রিবিকা বলল-লোটার কাছে একবার যাও। ও যে পাগল হয়ে গিয়েছে! রুহার অন্তরে এত ঘৃণা ছিল সারগন!
সাদইদ বলল–হ্যাঁ, রিবিকা! এখানকার দেবদাসীরা কোহিন আর বল-এর গল্প করতে ভালবাসে! আদম আর হবার দুই পুত্র! কোহিন চাষী। এবল মেশপালক, পশু চরায়। ওরা দুজনে ঈশ্বরকে খুশি করার জন্য পাথর দিয়ে দু’টি বেদী তোয়ের করে। কোহিন তার শস্যসবজির উপচার বেদীতে রাখল। এবল রাখল তার সবচেয়ে বলিষ্ঠ পশুর মাংস। তারপর দুজনই আগুন লাগিয়ে দিল। উদ্দেশ্য ছিল তাদের নৈবেদ্যের আগুনে পোড়া সুগন্ধ দেবতা গ্রহণ করবেন।
রিবিকা বলল-ইহুদের মুখে এ গল্প শুনেছি। এবলের ধোঁয়া আকাশে যবহের দিকে উঠে গেল। কোহিনের ধোঁয়া নিচে নেমে গেল। এই পাল্লাতে মেষপালক জিতেছে।
সাদইদ বলল–না রিবিকা! নিশিমারা কোহিনকেই জেতায়। বুঝতে পারি এই দ্বন্দ্ব যাবার নয়। অনেক দেবদাসী নিরামিষ আহার করে। অথচ মরুভূমির শীতে গা উষ্ণ রাখতে হলে মাংস-রুটিই খেতে হয়। ডুমুর-রুটি সৈন্যরা পছন্দ করে না। দেবদাসীরা কেউ কেউ ঘুচিবায় দেখায়। তবু শেষমেশ সেনাদের ঘরে নিতে আপত্তি দেখি নে! কিন্তু লোটা যে উট-উপাসক। খুব দুভাগ্য! আমরা যাযাবর, কে আর কে নয়-কারো বলার সাধ্য নেই। যুদ্ধ আমাদের এখানে গুতিয়ে এনে জড়ো করেছে। লোটা উটে করে মড়া বইবে–এ যেন একটা পেশা! এভাবে তাকে ঘৃণা করে ঠেলে দেওয়া হল! রুহার মৃত্যুর জন্য এই দুভাগ্য দায়ী। নবী সালেহও তো একটা শস্যসবুজ উপত্যকার স্বপ্ন দেখেছিলেন!
শুনতে শুনতে রিবিকা চমকে উঠল! সহসা তার চোখের সামনে আক্কাদের ভয়ংকর কঠোর মুখ ভেসে উঠল। উটের পিঠে দোলায়িত রমণের ক্ষুব্ধ বিষয় শোকাবহ স্মৃতি হৃদয়ে গুমরে উঠল।
রিবিকা সহসা এক অজ্ঞাত ভয়ে আপনমনে সিটিয়ে উঠল। সে তার অতীত জীবনের ছায়াকে মনের তলায় দেখতে পেয়ে জীবন সম্পর্কে এক অপূর্ব তৃষ্ণা অনুভব করছিল। এ তৃষ্ণা যে কিসের তা সে জানে না। সে আর সাদইদকে বলতে পারল না লোটার কাছে যাও। বরং তার মনে হল, সাদইদ তাকে এই মুহূর্তে যেন ছেড়ে না যায়। হঠাৎ তার মনের এই পরিবর্তন দেখে রিবিকা নিজেই কেমন হয়ে গেল।
বলল–এই দুপুরে আর কোথাও গিয়ে কাজ নেই তোমার। যা হবার তা হয়েই গেছে। আমাদের বাচ্চাটা একা রয়েছে, ঘুম থেকে জেগে উঠলে ভয় পাবে!
সাদইদ রিবিকার কথা শুনে আশ্চর্য হল। মনে হল, এই মেয়েটির মনেও একটা সংসারের ছবি বিরাজ করছে, যে কিনা যুদ্ধকে ভয় পায়–আর লোটা যেন যুদ্ধেরই বিভীষিকা! রুহার মৃত্যুকে যেন রিবিকা গোপন করতে চাইছে!
সাদইদ বলল–লোটা গৃহনির্মাণ, চাষবাস, পাথরকাটার কাজ কিছু নিশ্চয়ই পারবে না। কিন্তু দেশরক্ষার কাজে তার কোন জবাব নেই। অথচ দেখো লোটার নিজেরই কোন দেশ নেই।
রিবিকা এ প্রসঙ্গ আর শুনতে চাইছিল না। বলল–তোমার পাহাড়টা কি ভাল সারগন। আকাশের তলায় এ যেন আশ্চর্য স্বপ্ন!
–তোমার পছন্দ হয়েছে?
–খুউব! তবে আমার পছন্দের কীই-বা দাম!
–কেন?
–কালই তুমি আমায় তাড়িয়ে দেবে! দেবে না?
–কী করে বলব!
সাইদের এই জবাবে বক্তা এবং শ্রোতা দুজনই অবাক হয়। রিবিকা প্রথম থেকেই শুনছে সাদইদের প্রচুর সুন্দরী রয়েছে, অথচ নিজের বলতে তারা তার কেউ নয়-বাই মন্দিরের মাল। যুদ্ধের পড়ে-পাওয়া মজুত দ্রব্য। সাদইদ প্রকৃতপক্ষে লোটারই মত একা। কিন্তু লোটার মত বিচ্ছিন্ন নয়, বঞ্চিতও নয়। কাকে তবে সে ভালবাসে? একজন দেবদাসীর কী হবে–সেকথার জবাব তার জানা নেই–একথা বিশ্বাস করতে হবে! পরম আশ্চর্য হয়ে ঘাড় ফেরাল রিবিকা! সাদইদের চোখের দিকে তবু সে চাইতে পারল না।
সাদই অবাক হয়ে রিবিকাকেই অপলক দেখছিল। কী এমন ঘটল যে,এমন কথা তার মুখ থেকে বার হল! দেবদাসীর কী হবে কাল–এ যে বাতুল অতি নগণ্য প্রশ্ন! একজন দেবদাসী সূর্যমন্দিরের রক্ষিতা যুদ্ধের জ্বালানি–সৈনিকের দ্রাক্ষারস!
দিগন্ত থেকে এক ঝলক বাতাস এসে অশ্বের গায়ে লাগে। রিবিকার গাত্রাবরণ খসে পড়ে, সোনার মত শরীর, মায়াপুষ্পময় বক্ষস্থল, যা বর্ণবহুল। প্রজাপতির পুষ্পভ্রম ঘটায়, মরুর বুকে এক আশ্চর্য শীতলতা, কোন দামেই এ ঠিক খরিদ হবার নয়, এ যেন সৌন্দর্যের সকল আধারকে উপচে ফেলে!
আকাশে দীপ্যমান দেবতা সামাশ। দূরবর্তী মরুপ্রাঙ্গণে আর্ত তৃষ্ণার্ত লোটার। নিরাকুল চিৎকার চকিত হয় মাঝে মাঝে! দিগন্তে মানুষের সারিবদ্ধ ছায়া, সামনে শববাহক উট, জীবন চারিদিকে ধু-ধু করছে। ঘোট পাহাড় থেকে খোমশের (বালদেব) পূজার ঘণ্টা বিষয় বাতাসে অস্পষ্ট ভেসে আসে। এমন আবহের ভিতর জীবনের এক অবধিহারা বিস্ময় প্রজাপতির পাখার তরঙ্গের মত কাঁপতে থাকে–রিবিকার চোখ দুটি যেন ছায়াচ্ছন্ন রঙিন সবুজ হ্রদ–দুটি চোখ কাঁপে–পাতা কাঁপে, জল ভরে ওঠে।
ধরা গলায় রিবিকা সহসা বলে–পিরামিডের আকাশে চাঁদটা উঠত সারগন। মনে হত, ওই আকাশ আর চুড়ো ছেড়ে কোথাও সে যেতে পারবে না।
–তারপর?
–এখানে এসে দেখলাম, পাহাড়ের মাথায় চাঁদটা এসে পৌঁছেছে। এবার ফের মনে হল, চাঁদটা আর কোথাও যেতে পারবে না। পাহাড় ছেড়ে পালাবার সাধ্যই তার নেই। নীল নদীর আকাশে এই চাঁদটা অস্ত গিয়েছিল সারগন!
বলতে বলতে উচ্চকিত স্বরে কেঁপে উঠল রিবিকা। অষের পিঠের একপাশে রিবিকার পা দুখানি ঝুলছিল–তার পিছনে সূর্য সামনে পাহাড়।
–তারপর?
–কে জানত! চীদ আবার ওঠে! আকাশ কত দূর। তার শেষ নেই। এখানে রাত্রি এল! চাঁদ উঠল! আমি তাঁবুর তলে শুয়ে চাঁদ দেখেছি সারগন! কাল আমার কী হবে বলে দাও!
–সে তো গণকের কাজ রিবিকা!
–দেবদাসীর ভাগ্য তুমি জানো না? আমায় তুমি কুড়িয়ে পেয়েছ! কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস ফের হারিয়ে গেলে হৃদয় তবু খারাপ করে! করে না? যার কোনই দাম নেই, তা হারালে মন (হৃদয়) খারাপ হওয়া কী যে বাজে ব্যাপার!
–তারপর?
–তবু তুমি আমায় কিনবে কবি? নোহের সন্তান তুমি!
এই হৃদয়বিদারক আকুলতা যেন শেষহীন এক তরঙ্গ–যা লোটার আর্তনাদকে ছাপিয়ে উঠতে চায়। দুটি স্বরই নিরাকুল, নিরাশ্রয়-দুটি বিপরীত আঘাতে বুক ভাঙে। সাদইদের হৃদয় একটি দ্বীপের মত সমুদ্রে একা জলের তরঙ্গায়িত দোলায় বিধৌত হয়–সেই সমুদ্র, যার বাতাস কিনারে এসে সমুদ্রেরই গর্ভে ফিরে যায়–সে তেমনি এক রুদ্ধ সমুদ্রের মত তোলপাড় করতে থাকে।
–নোহের সন্তানের কাছে বেদামী মানুষও দাম চাইতে পারে সারগন। তুমি কবি। তুমি ছাড়া আমায় তো কেউ কিনবে না। মহাত্মা ইহুদ আমার বাবা। তাঁকে একটি ভাল কাজ দাও। অপমান করো না।
–অ!
–কী হল?
–না। কিছু নয়। আমি কবি নই রিবিকা! আমি ভাড়াটে সৈনিক।
–তুমি রাগ করলে? ইহুদকে মহাত্মা বলেছি বলে?
সহসা কড়া গলায় সাদইদ বলল–একজন দেবদাসী খুবই চালাক হয় রিবিকা! বাইরে সে সুন্দর হলেও অন্তরে অনেক ফাঁদ পেতে বসে থাকে। জানি নে তুমি আমার কাছে কী চাইছ? প্রজাপতি দুটি আমার মত ব্যর্থ কবির ভ্রান্তি মাত্র । দ্যাখ, দেবদাসী কী করে একই সঙ্গে এক পুরুষকে লেহন করে, অন্য পুরুষকে দেহ দেয়। যাকে পিতা বলে ডাকে, সে হয়ত তার প্রেমিক!
রিবিকার দুই চোখ দপ করে জ্বলে উঠল মুহূর্তে। তার মনে পড়ে গেল আক্কাদ তাকে কন্যারূপে খরিদ করে দাসীরূপে ব্যবহার করেছিল। যুদ্ধের সময় পুরুষের হৃদয়ে কোন সত্য থাকে না।
রিবিকা অত্যন্ত দৃঢ়স্বরে বলল কার কাছে কী চাইছি সারগন! কিছুই চাই না।! তুমি যা খুশি করতে পারো। তোমার কাছে দয়া চাওয়া যায়। ভদ্রতা আশা করা যায় না। ভাড়াটে সৈন্য বর্বর–সেকথা সবাই জানে! যুদ্ধই যার নেশা–তার কাছে চাইবার কী আছে! আমায় ঘোড়া থেকে নামতে দাও! তুমি হেরার পুত্রকে মধু দিতে চেয়েছ, তাই যথেষ্ট!
বলে রিবিকা গায়ের কাপড় সামলে তুলে নিচে লাফিয়ে পড়ল। তারপর দ্রুত পাহাড়ের দিকে ছুটল। পাহাড়ে ঢুকে এসে দেখল শিশু তখনও ঘুমিয়ে রয়েছে। ঘুমন্ত শিশুকে বারবার চুমু খাচ্ছিল আপন মনে রিবিকা–একসময় তার পিছনে এসে দাঁড়াল সাদইদ। তার আসা টের পেয়ে পিছন ফিরে স্পষ্ট চোখে দেখল সাদইদকে।
সাদইদ হঠাৎ বলে উঠল–যুদ্ধই আমার নিয়তি রিবিকা। তুমি তোমার কাল কী হবে জানতে চেয়েছিলে। রুহার মন্দিরটা খালি হয়ে গেল! সেখানে তুমি কালই
–সারগন!
দুচোখে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল রিবিকা।
–বাইরে ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে হিতেনের দৃত। হয়ত এখনই আমায় চলে যেতে হবে! তোমায় খরিদ করার সামর্থ্য আমার নেই বলেই সারগন বাইরে বেরিয়ে চলে গেল! রিবিকা তার পিছু পিছু ছুটে এসে দেখল একটি সোনালী অষের চালক সারা গায়ে কালো পোশাক মোড়ানো, সাদইদের সঙ্গে কথা বলছে। গোল কাগজে পাকানো পত্র পাঠ করল সাদইদ। তারপর তড়াক করে অশ্বে লাফিয়ে উঠে পিছন ফিরে রিবিকাকে দেখে ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে গেল! অস্বাভাবিক ক্রোধে মুহূর্তে তার মুখ কঠোর হয়ে গেল। সহসাই নেমে এল ঘোড়া থেকে। রিবিকার সামনে এগিয়ে এসে গালে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে বলল–কেন ছুটে এলে?…যাও!
এই সময় কালো পোশাক হা-হা করে অট্টহাস্য করে উঠল। তার কালো মুখ সাদা দাঁতে সবুজ একটা ছোপ লাগানো চামড়ায় হাসির চোটে কুঁচকে গেল।
এত জোরে চড়টা মেরেছিল সাদইদ যে,রিবিকার মাথা ঘুরে গেল! সে পড়ে গেল নিচে। আশ দুটি ছুটে গেল দিগন্তের দিকে। ঝাঁপসা চোখে কান্না-প্লাবিত রিবিকা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল পাহাড়ের পায়ের কাছে ছায়ায়, এই অংশে পাহাড়টি বেঁকে সূর্যকে আড়াল করেছে।
দিগন্ত থেকে শবানুগামীরা ফিরে আসছে। ফিরে আসছে শববাহক উট। নিঃসঙ্গ উট, যার দোলানো গলা শূন্যে ভাসে নিরবলম্ব। আর্তনাদ করছে লোটা। তার অশ্ব চিৎকার করে আকাশ মথিত করছে।
রিবিকার গালে সাদইদের পাঁচটি আঙুলের ছাপ স্পষ্ট বসে গেছে। গালে হাত বুলাতে বুলাতে কান্নায় ফোঁপানো রিবিকা চোখ মুদে ফেলে আশ্চর্য হল–সারগন কি তবে তাকে সত্যিই ভালবেসেছে! নাকি অন্য কিছু? সারগন হঠাৎ অত খেপে গেল কেন? কালো দূতটির সামনে তার বেরিয়ে আসায় কী অপরাধ হয়েছে? ওহো! মা গো! ও যে হিতেনের তাঁবেদার! এ যেন আর এক ফেরাউনের সেপাই।
হঠাৎ রিবিকার শিশু কেঁদে ওঠে। রিবিকা সেই কান্না ক্ষীণ সুরে ভেসে আসতে শোনে। দ্রুত ছুটে যায় পাহাড়ের ভিতর।
শিশু রিবিকার গালে স্পষ্ট ছাপ দেখে হাত বাড়ায়। একটু-আধটু অবোধ গলায় কথা বলার চেষ্টা করে। শিশুর কোমল আঙুলের ছোঁয়ায় রিবিকা শিহরিত হয়। সাদইদ শিশুর জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা করেছে। পর্যাপ্ত দুধ। মধু,আঙুর। এমনকি নানারকম খেলনা। তার মধ্যে মিশরের কাগজে আপন হাতে বানিয়েছে নৌকা। যার মধ্যভাগ পিরামিডের মত খাড়া হয়ে উঠেছে একটু বেশি।
শিশুকে বলেছে–এই তোমার নৌকা বাবুসোনা! নোহের কিস্তি। এই তোমার ফেরাউনের পিরামিড। সবই তোমায় দিলাম। মানকরোনা! পিরামিড তোমার ঐশ্বর্যের নিশানা। নৌকা তোমার দুঃখের ভার বইবে। জীব আর বীজের প্রতিপালক হবে তুমি। তোমার হাতে যেন মানুষ কখনও দুঃখ না পায়! তুমি কখনও আমার মত শিশুমেষকে হত্যা করবে না। তুমি পিঁপড়ে পাখি পতঙ্গের ভাষা বুঝবে। তুমি হবে নতুন স্বর্গের ভাস্কর।
রিবিকা ককিয়ে উঠল–সারগন যে আমায় কিনতে চাইলে না খোকা! তোর জন্য যে লোকটা ব্যবস্থা করেছে, সে যে কালই আমায় মন্দিরে ঢোকাবে! এই পাহাড়টার মতই মানুষটা কী রহস্যময়! আমি কী বোকা রে!
শিশুকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে অঝোরে অশ্রুপাত করছিল নিঃশব্দে রিবিকা। এমন সময় গবাক্ষপথে একটি রক্তমাখা অদ্ভুত মুখ ভেসে উঠল। কে ওটা? ও কি মানুষ? আঁতকে উঠল রিবিকা।
লোটা হা-হা করে হেসে উঠে বলল–শোন বোন! আমার ভাষা তুমি ছাড়া কেউ বোঝে না! তুমি কুমারী আনাথ। আমি তোমার ভাই বালদেব! ভয় কি? তুমি ছদ্মবেশী বকনাবাছুর! এখন চারিদিক নির্জন। কেউ জানবে না। দুয়ার খুলে দাও । আমি ক্ষুধার্ত! রুটি মাংস চাইনে। তোমাকে চাই। তোমার আমার মিলনে সমুদ্র মেঘ পাঠাবে! এ জীবন অমর নয় রিবিকা! আমি শববাহক। ঘেন্না হয় বুঝি! এসো আমরা দু’জন উঠের পিঠে মিলিত হই!
কনানী পৌরাণিক গল্পের কুৎসিত প্রসঙ্গ বারবার উত্থাপন করছিল লোটা । অপমানে ভয়ে রিবিকার মুখ কালো হয়ে উঠেছিল। স্বয়ং যুদ্ধের বিভীষিকা গবাক্ষ ধরে দাঁড়িয়েছে। ভয় হচ্ছিল সে যদি জোর করে পাহাড়ের ভিতর ঢুকে পড়ে!
লোটা ফের বলে উঠল–আমি পদাতিক নই। আমি সাদইদের অশ্বারোহী এক নম্বর সেনাপতি। আমার গোত্র ছোট হতে পারে, ধর্মে আমি কাঙাল হতে পারি কিন্তু আমার সম্মান আছে রিবিকা! আমি মন্দিরের সামনে যত্রতত্র লাইন দিয়ে দাঁড়াতে পারিনে। আমি নোংরা দেবদাসীর কাছে গিয়ে শরীরে রোগ বাধাতে পারিনে। আমার নবী সালেহ। তিনি পয়গম্বর। তিনি জীবন আর মৃত্যুর অধিপতি। জীবন আর মৃত্যুকে কেউ বহন করে না। তুমি দুয়ার খুলে দাও। যদি অনুমতি করো, আমি ভাল পোশাক পরে আসতে পারি। আমাকে একটিবার অন্তত সারগন বলে ডাকো তুমি। একবার ডাকো!
গবাক্ষের নিচে বিপজ্জনকভাবে ঝুলে আছে লোটা। যদি পড়ে যায়, দৈবাৎ হাত ফসকে গেলে মাথার খুলি পাষাণে পড়ে থেঁতলে যাবে নির্ঘাত।
মুখাকৃতি কেমন এক মায়াময় লোভে, রক্তের ছিটে দাগে করুণ আর ভয়ংকর দেখায়। ককানো আর্ত ভাষা পাগলের মত।
–ঠিক আছে, ছোট জাত বলে দুয়ার না হয় বন্ধ রাখো। আমি এই পাহাড়তলীর জনপদ রক্ষা করছি বিবিকা! মড়ার গন্ধে তিষ্ঠোতে পারতে না। এখন দুপুরে হালকা লু বইছে। কিন্তু সন্ধ্যার পর শীত পড়তে শুরু করবে। শীত আসন্ন। কত দেবদাসী আর শিশু মহা-শীতে নষ্ট হবে– বাঁচবে না। মড়ার গা থেকে পোশাক খুলে নিয়ে সেদ্ধ করার ছোট কাজটি কেউ করবে না। সালেহ। ছিলেন পবিত্র। তাঁর উম্মত বলে এ কাজ করি। তাই বলে জাত আমার ছোট নয়। তোমরা কেন উটের মত উপকারী প্রাণীকে শব বইবার দায়িত্ব দিয়েছ? শুঁটকি আর মদ বহে বেড়ায় এই জীবটা, কিন্তু প্রকাণ্ড পাথর টানা ছাড়াও সোনাদানাও তো বইতে পারে। পারে না? তোমরা চাষীবাসী, তোমরা মিশরের। দেবদাসী, দেবরাজ সামাশতোমাদেরভগবান। সব ঠিক। কিন্তু আমি তো শুধু পায়ে হাঁটা লাগাম ধরা চুটকিলা গাওয়া উটের চালক যাযাবর নই। আমি সেনাপতি, রিবিকা!
মানুষের দীনহীন এমন আকুলতা কখনও শোনেনি রিবিকা–যুগপৎ মর্যাদাবান অভিমানও দেখেনি কোনদিন। একই সঙ্গে তার আপন ধর্মের প্রতি, ভাষার প্রতি ভালবাসা আর সংকোচ লোটাকে দগ্ধাচ্ছে। লোটা যেন স্বয়ং যুদ্ধের অস্তিত্ব–যাযাবর জাতিগুলির সমষ্টি সত্তার রূপ, ক্রীতদাসের একান্ত-হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে ক্রমাগত। লোটা কাতরাচ্ছে পথ হারানো মরু যাযাবর পিতা আব্রাহামের মত। অধিকারহারা এমন মানুষটিকে একবার রিবিকার সারগন বলে ডেকে উঠতে মন চায়। পারে না।
ভয় করে। সংকোচ হয়। ঘৃণাও হয়। কেন এই ঘৃণা সে জানে না। সে নিজে দেবদাসী–যুদ্ধের পাপ মোছর রুমাল! জীবনের তলানি মদ, কটু কাদামাখা বালিভরা মরুকূপের জল। নানান পুরুষে লেহিত, এটো ঝুঠো পরিত্যক্ত মদপাত্র, কানাভাঙা, কুকুরে চেটে তোলা শীতার্ড বাটিখুরির ছবি। রক্তমাখা ওই মুখটা, ফাটা জামা ছিঁড়ে গা থেকে ঝুলছে, যুদ্ধের শোণিতে কালো ছোপঅলা শবগন্ধময় পোশাক দেখে, শক্ত চোয়াল, চোখের তলায় মরুভূমির বালি, খোঁচা-খোঁচা দাড়ির ভিতর লু ঝাঁপটানো উষরতা–চোখ করুণ আর রক্ত রাঙানো বদ গোপন ধূর্ততা জড়ানো–এ মূর্তি কী ভয়াল! এ দেখে বুক শুকিয়ে কাঠ হয়।
রিবিকার ঠোঁট থরথর করে কাঁপে। হেরার পুত্রকে বুকে আঁকড়ে ধরে সভয়ে বারবার। চোখ তুলে গবাক্ষে চাইতে গায়ে ঘাম দেয়। সারা মুখমণ্ডল ঘর্মাক্ত হয়ে ওঠে। মানুষের ক্ষুধার্ত কাতর চোখ এত তীব্র আর আকুল হয় করুণাঘন হয়? কী করবে রিবিকা?
–আমার ভাষা কেবল তুমিই বোঝে রিবিকা! এই মরুভূমিতে আর কেউ নেই। মানুষ কথা না বলে থাকতে পারে! বলল দেবী ইস্তার! কতকাল মুখ বুজে থাকব!
রিবিকা পারে না। মনে মনে বলে ওঠে–আমার সারগন যে একজনই লোটা!তাকে পাই না-পাই জীবনের শেষ বাসনা তারই পায়ে অঞ্জলি দিয়েছি। সারগন নিজেও জানে না আমার কী হয়েছে। মন্দিরে আমায় এভাবে ডেঝে না লোটা!
গবাক্ষ আঁকড়ে ধরায় পেশল কঠিন হাত দুখানি ফুলে উঠেছে শক্তির উল্লাসে। কিন্তু হাত ফসকে গেলে লোটা বাঁচবে না। একদিকে রিবিকার শেষ বাসনার সুতীব্র তৃষ্ণা, অন্যদিকে লোটার দুর্ভাগ্যের প্রতি ঘৃণা-মেশানো সহানুভূতি তাকে বিচলিত করে। সে ফুঁপিয়ে ওঠে।
লোটার মুখটা এই কান্নার স্পর্শে অসাধারণ কোমল হয়ে পড়ে। দগ্ধ রক্তাক্ত চোখ নিবে গিয়ে ঘষা নক্ষত্রের সুদূর আলোর মত ম্লান হয়ে ওঠে। ঠোঁটের ভাঁজে সিঞ্চিত হয় অপরাধের ভাষা। লোটা যেন অন্যায় করে ফেলেছে।
হঠাৎ তার মনে হয়, তারই কারণে রুহা আত্মহত্যা করেছে। এবার রিবিকার যদি কিছু হয়! লোটার আঁকড়ানো হাত মুহূর্তে শিথিল হয়ে পড়ে! হাত খসে যায়।
লোটা পাষাণের উপর পতিত হয়। রিবিকা প্রাণফাটা আর্তনাদ করে গবাক্ষর কাছে ছুটে আসে। নিচে চোখ মেলে বোবা হয়ে যায়। পাষাণেই পড়েছে বটে কানি-পরা আব্রাহাম। নড়ছে না। মৃদু ফোঁপানি চকিত হয় রিবিকার কণ্ঠে। কালো ঘোড়া মনিবকে এসে শোঁকে। ধীরে ধীরে নড়ে ওঠে দেহ। মরেনি। হৃদয় স্তব্ধ হয়ে পড়েনি। তবে পায়ে লেগেছে। লেংচে ওঠে লোটা।
ঘোড়ার পিঠে ওঠার আগে করুণ চোখে গবাক্ষর দিকে চায়। লোটা সেই যুদ্ধ, যার অবসান সহজ নয়। পা খোঁড়া হতে পারে, কিন্তু যে পড়ামাত্রই মরে না। কালো ঘোড়া লু-প্রবাহিত ঝাঁঝালো রৌদ্রে, কম্পমান রৌদ্র তরঙ্গে-তরঙ্গে কেঁপে ওঠে ছবির মত। অশ্ব আর অশ্বারোহী–দূরে ভেসে যায়। এবার একা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে রিবিকা।
আকাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেষশিশুর মত মেঘ জমতে থাকে। হঠাৎ রিবিকা দেখে ভগবানের বন্ধু মোসি লাঠি হাতে মেযেদের চালিত করছেন–আকাশে মানুষের মত একটা মেঘ দেখা যায়।
রিবিকা মহাত্মা ইহুদের নাম ধরে কেঁদে ওঠে সশব্দে। হঠাৎ তার মনে হয়, এ পাহাড়টি যেন এলিফেনটাইন দুর্গের মত। সে বন্দী। এই শিশু বন্দী। সাদইদ এক নব্য ফেরাউন।
সাদইদ যখন ফিরে এল, রাত্রি তখন যথেষ্ট গম্ভীর হয়েছে। চাঁদ পাহাড়ের উচ্চতা ছাড়িয়ে অনেক উপরে দাঁড়িয়ে। সাদা অশ্ব পাহাড়ের গা চাটছে। তার ফোঁসানি শোনা যায়। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একা সাদইদ। রিবিকা ঘুমাতে পারেনি।
রিবিকা ফোঁসানি শুনতে পায়। বাইরে বেরিয়ে আসে। বুঝতে পারে সাদইদ ফিরেছে। ভয়ে ভয়ে সে সাদইদের কাছে এগিয়ে আসে। সাদইদ রিবিকাকে ফিরে দেখে না। চাঁদের আলোয় তার মুখ অসম্ভব গম্ভীর। এক-পা এক-পা করে একটি উচ্চ শিলার দিকে এগিয়ে যায় সাদইদ। বসে পড়ে। সামনে পা মেলে দেয়। চওড়া শিলা। পিছনে হাত মেলে দেয়। হাতের উপর ভর দিয়ে পিছনে চিতিয়ে থাকে। চাঁদ দেখে যায় আপন মনে। তার এই নীরবতায় ভয় পায় রিবিকা।
সাদইদ যখন চোখ মুদে বসে থাকে–তখন রিবিকা ভয়ে অপরাধে, দুপুরের দূত আসার সময়ের ঘটনার কথা মনে করে, হঠাৎ বোকার মত পাহাড়ের বাইরে চলে আসার অপরাধ করার কথা ভেবে সাদইদের পায়ের তলায় চুপ করে বসে পড়ে। রিবিকার ছোঁয়ায় চোখ মেলে সাদইদ।
সাদইদের মনে হয় তার পায়ের তলায় একটি মেষ, যাকে সে বশায় গেঁথে ফেলেছিল, সে পড়ে আছে। বুকে তার এক পরমাশ্চর্য মায়া ছলছল করে ওঠে। সে জানে, এই বুক বৃষবক্ষ, নির্মম। তবু কোথাও একটা নদী আছে বিস্তীর্ণ সাদা মরুর তলায়–দেখা যায় না। নদীতীরে অমরাবতী–এক নগরীর কেন্দ্রে গড়ে উঠেছে। স্বর্গের হৃদয়ে এক কক্ষ–যেখানে বিরাজ করছে চির বসন্তের স্ফটিক স্বচ্ছ আলো–সেই আলোয় ঘুমিয়ে রয়েছে এক নারী–দুটি প্রজাপতি তাকে খুঁজছে। এই মোহ কি দূর হবে না কখনও? খুবই ভাবাবেগে হৃদয় যেন বুজে আসে!
রিবিকা হঠাৎ বলে–আমাকে মুক্তি দাও সারগন!
মুহূর্তে সেই নদী যেন সাদইদের পায়ের তলা ছুঁয়েছে–চাঁদ সাক্ষী! সাদইদ সহসা রিবিকাকে দু’হাতে আকর্ষণ করে বুকে টেনে নিয়ে বলে–আমি কিছুতেই আর পারছিনে রিবিকা! তোমাকে আমি কারুর জন্য দিতে পারি না। তুমি আমার যুদ্ধের পড়ে-পাওয়া, কুড়োনো! চাঁদ জানে, আমি কী বলছি!…