০৪.
দুপুরে মরুভূমির উত্তাপ বেড়েছে। প্রকাশ্য দিনের বিপুল ক্ষমাহীন আলোয় মৃতদেহগুলি পড়ে আছে। খুব ভোরের দিকেই হয়ত খুন হয়ে গিয়েছে। ভাড়াটে সৈনিকরাই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। মরুযাত্রীরা ছিল সকলেই পায়ে হাঁটা মানুষ, সম্পূর্ণ নিরস্তু। অসুররা হত্যা করলে খুঁটায় টাঙিয়ে দিত মৃতদেহ। মুণ্ডু ছিন্ন করত । ঘাতকরা যখন তা করেনি, বুকে কেবল বশ বিদ্ধ করেছে, বোঝা যায় এরা কারা। মৃতদের সঙ্গে কোন গৃহপালিত পশুদল ছিল না, শস্যও ছিল না তেমন। মিস্ত্রী আর পাথরকাটিয়ে শ্রমিক এবং কিছু ভাস্কর পরিবার নিনিভে ছেড়ে চলে যাচ্ছিল প্রাণের ভয়ে। অত্যন্ত লোভী, ভয়ানক বোকা আর স্বার্থপর নির্দয় কোন সৈন্যদল এই-ধারা নিরীহ মানুষদের হত্যা করে ফেলে গেছে।
সামান্য দু’চার রত্তি কানের সোনা আর কাপড়ের পুঁটুলি বাঁধা যবের দু’চার কুনকে ছাতুর লোভেই মানুষ মানুষকে হত্যা করতে পারে–যুদ্ধ আর নগর-সভ্যতা মানুষের জন্য এমনই পরিণাম রচনা করেছে। মরবার আগে এরা ভয়ে চেঁচাতেও পারেনি। শিশুটি কিন্তু আশ্চর্যভাবে জীবিত। মৃতা মায়ের চন্দ্রোদিত নগ্ন বুকে মুখ ঠেকিয়ে স্তন্যপানের চেষ্টা করছে। হঠাৎ কেন যেন সাদইদের মনে হল, দুধের বদলে শিশুর মুখে রক্ত উঠে আসবে।
দ্রুত হাত বাড়ায় সাদইদ। শিশুটাকে বুকে তুলে নেয়। ভাড়াটে সৈনিক মানেই খুব দয়ালু এমন ভাববার তেমন যোগ্য কারণ নেই। বরং তারা খাদ্যাভাবে, বস্ত্রাভাবে এইভাবে দুস্যুবৃত্তি পোষণ করে। সাদইদ ভাবছিল, কোথাও মানুষ সম্পর্কে আশার আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। এই শিশুটিকে নিয়ে এখন সে কী করবে? গলায় শিশুটির একটি ঝকঝকে রূপার লকেট ঝুলছে। মৃতদেহের ভিতর পা ফেলতে বরাবরই সাদইদের খারাপ লাগে।
সমস্ত দৃশ্যটি চেয়ে চেয়ে প্রায় নিষ্পলক দেখছিল দেবতাদের দেহের মত শুভ্র অশ্বটি। মৃতদেহের তূপ দেখলেই ঘোড়াটা এভাবে স্থির হয়ে দাঁড়ায়–পুরনো নক্ষত্রের মত চোখ মেলে চেয়ে থাকে।
পায়ে পায়ে ঘোড়ার কাছে এগিয়ে এল সাদইদ। শিশুটিকে রিবিকার দিকে তুলে ধরে বললনাও। যুদ্ধের পাওনা। আজ আমার ভাগ্যটা খুব প্রসন্ন দেখছি । বিনে যুদ্ধে একটা আশ্চর্য নারী এবং অত্যাশ্চর্য শিশু উপহার পেলাম। শিশুটি মেয়ে নাকি ছেলে–ওহো ছেলেই বটে–তা বেশ। ওর গলায় এই লকেটটা ঝুলছিল। দাঁড়াও দেখি লকেটের খোপে কী রয়েছে!
মুখটা খুলতেই চোখে পড়ল খুদে খুদে লিপি-লকেটটা ছিনিয়ে নেবার আগে শিশুকে বিষ আর মধু দাও–ইতি হেরা। নিনিভের ভাস্কর হেরা–এ তারই পুত্র। সেই পরিচয় লিপিবদ্ধ রয়েছে।
–কী লেখা আছে সারগন?
সাদইদ খোপ বন্ধ করে শিশুর গলায় লকেটটা অত্যন্ত গম্ভীর মুখে ঝুলিয়ে দেয়। কথা বলে না। ধীরে ধীরে ঘোড়ায় লাফিয়ে উঠে বসে। অশ্ব হাঁকিয়ে দেয়।
–বললে না কী লেখা আছে?
লকেটের ঢাকনা দু’টি প্রজাপতির পাখনার মত। অশ্ব থেকে সাদইদ সহসা নেমে পড়ে বলে–রিবিকা তুমি পিছনে বসে আমাকে দুহাতে ধরে থাকবে–পুত্রটিকে আমায় দাও–তুমি সামলাতে পারবে না।
সেইভাবে বিন্যস্ত হল দৃশ্য। অশ্ব ধাবিত হল। চোখের সামনে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে জুম পাহাড়। চলতে চলতে সাদইদ রিবিকার প্রশ্নের জবাব দেয়। তারপর বলে–এই লকেটটা হেরার নিজের হাতের তৈরি। অথবা তারই নির্দেশে কোন মণিকার বানিয়ে দিয়েছে। ওই শব্যুপে এই শিশুর পিত্তা পড়ে রইল কিনা জানি নে। অথচ আমি এই শিশুকে মধু দিতে পারি, কিন্তু বিষ দিতে পারি না রিবিকা!
শিশুটিকে কোলে তুলে নেবার সময় সাদইদের বারবারই মনে হচ্ছিল আরো একটি শিশুর কথা। তার মা তাকে প্রসব করা মাত্র জিব্রিল মাকে হত্যা করে। সে ভেসে যেতে থাকে ঝুড়িতে। যে দ্বীপে তার জন্ম সেই দ্বীপ নাকি সমুদ্রের তলায় তারপর তলিয়ে যায়। কুফর দ্বীপে তার জন্ম–সে দ্বীপ আর নেই। তাকে তার ভিস্তি পিতা কাফেরের পুত্র বলে ডাকত। কুফর এক অভিশপ্ত দ্বীপ। এই শিশুটি তারই মত কাফের নিশ্চয়। কোন স্বপ্নদর্শী এই শিশুকে দেখলে হয়ত বলতে পারতেন, এ বেচারি ঈশ্বর বিশ্বাস করবে না, আকাশের দেবতাদের অবজ্ঞা করবে, নবীদের করবে উপহাস। কেননা এর জন্ম আর শৈশব মৃতদের তূপে এসে ঠেকেছে, এতদূর হতভাগ্য শিশু কোথাওই তার আস্থা এবং বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে না–বরং সে নিজেকেই ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে। সে তার নিজেরই মত করে একটি একটি আকাশ, সূর্য, চন্দ্র এবং অজস্র তারকাপুঞ্জ আর পাহাড় বন নদী সৃষ্টি করে আপন মনে। তার কেবলই মনে হয় এই আকাশ, বন, নদী, সমুদ্র কোন দেবতার সৃষ্টি নয়–এরা সূর্যের মত আপনাতে আপনি পূর্ণ–এদের কোন নির্মাতা নেই। মানুষও জন্মের পর নিজেকে বানায় নিজেকে সে খাদ্য দেয়, বস্ত্র দেয়, গৃহ দেয়–সে নিজেই তবে জীব-দেবতা।
জন্ম মৃত্যু অপরিজ্ঞাত, জীবনও রহস্যময়। চাঁদ, সূর্য, তারকার যেমন আকাশ রয়েছে, মানুষের রয়েছে জীবন। আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সূর্য-চন্দ্র, তেমনি মানুষও ভাসছে জীবনভর। একটি ঝুড়িতে করে শিশুর ভেসে যাওয়া কি কম কথা!
একবার পাহাড়, একবার আকাশ দেখল সাদইদ। দূরে সমুদ্র গর্জন করছে। সাদইদ শিশুর মুখের দিকে চেয়ে থেকে ভাবল, শিশুটা এখনও ভেসেই রয়েছে, তার রয়েছে মনের আকাশ–তার রয়েছে চন্দ্র-সূর্য, সমুদ্র, অরণ্য, পাহাড়, নদী এবং পিরামিড আর জিগুরাত–তাছাড়া রয়েছে অজস্র অহিংস পশুপাখি। সে ভাসছে।
এই শিশু যতদিন জীবন না পায় ততদিন ভাসে। যতদিন ভাসে ততদিন জীবন পায় না। জীবন মানে শ্রম, নির্মাণ, প্রতিষ্ঠা। জীবন মানে সুরক্ষা। নিজেকে বাঁচানো, খাদ্য বস্ত্র গৃহ এইসব দেওয়া, নিজেকেই দেওয়া–মানুষ যখন দেবতাদের আক্রোশ থেকে, ফোঁসানি থেকে, চোখ রাঙানি থেকে, ক্রোধ এবং অভিশাপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে–তখনই তার সার্থকতা। এই সার্থকতার নাম জীবন। জীব এবং বীজকে রক্ষা করার নাম জীবন। মহাপিতা নোহ ছিলেন জীবনের দেবতা। নবী ছিলেন। মানুষ আসলে জীব-দেবতা।
শিশুর মুখপানে চেয়ে থাকতে থাকতে সাদইদের মনে হচ্ছিল, জীবন-দেবতাই যেন তার কোলে হাত-পা নেড়ে খেলা করছে।
শিশুর সঙ্গে হঠাৎ সে কথা বলে উঠল–শোন সারগন, দুষ্টুমি করো না। আমায় কিছু বলতে দাও।
সহসা এমন উক্তি শুনে আশ্চর্য হয় রিবিকা। সে সাইদের মনের থই পায় না। একদা সে আবীরুদের সঙ্গে অশ্বারোহণ করেছিল। পাশে প্রবাহিত নীল নদী। আজ সম্মুখে পাহাড়, নীল আকাশের গায়ে হেলানো, দূরে সমুদ্রের সংগীত ভাসছে। এ তার জীবনের দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা। সে সাদইদকে পিছন থেকে দু’হাতে আলিঙ্গন করে রয়েছে। পাশ দিয়ে মুখটা ঠেলে সে শিশুকে দেখবার চেষ্টা করছে। শিশু সাদইদের মুখে হাত বাড়িয়ে ঠোঁট আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করছে, কথা বলতে দিচ্ছে না।
বেলা পড়ে আসছে। পাহাড়-চূড়ায় আলো রাঙা হয়ে উঠছে। সাদইদ কথা বলে শিশুর সঙ্গে–। দ্যাখো ভাই, তোমার লকেটটা ভারী সুন্দর! প্রজাপতির দুটি ডানা যেভাবে পিঠের উপর খাড়া হয়ে জুড়ে যায়–এ ঠিক তাই। একটি প্রজাপতিকে বাঁচানো তেমন সহজ নয়, শিশুকে বাঁচানোও সমান শক্ত। পতঙ্গের। ডানায় যেমন ইন্দ্রধনু খেলে ওঠে, এটা সূর্যের বিষ–আর তোমার হাসিটাও তাই। নারীর বুকে চাঁদের বিম্ব, তোমার মুখে সূর্যের বিষ–তাহলে আকাশ থেকে। স্বর্গও নামতে পারে এখানে। দেবতাদের ক্ষুণ্ণ করব না শিশু-সারগন, তুমি বোঝে। সব কিছুর ছায়া থাকে হেরার পুত্র। তোমার দেহে নোহের ছায়া পড়বে, তুমি একটি জাহাজ বানাবে, তুমি পিরামিড গড়বে। তুমিই স্বৰ্গকে নামিয়ে আনবে মাটিতে।
বলতে বলতে সাদইদ শিশুকে আবেগে আহ্লাদে চুম্বন দিতে থাকে। শিশু হেসে ওঠে। সেই হাসির দোলায় যেন সাদইদ নিজেই আত্মহারা হয়ে আকুল হাসিতে স্ফূরিত হয়। রিবিকাও হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে ভাবে, এ কোন অশ্বারোহণ তার!
তবু ভয় করে তার। বিশ্বাস হয় না। অশ্বারোহী পুরুষটি শিশুর জন্য বরাদ্দ করছে একটি স্বর্গের, যা আকাশ থেকে মরুতে বিম্বিত হবে!
কীভাবে মরুতে স্বর্গ বিম্বিত হয় রিবিকা ভাবতে পারে না। হৃদয় কীভাবে এইসব চিন্তা করে তার জানা নেই। তবে সাদইদের কথা শুনতে শুনতে কেবলই তার মনে হচ্ছিল, পিরামিডের শবাধারলিপির কথাগুলি, যে সম্রাট অথবা অভিজাত মানুষটি শবাধারে শুয়ে চিরনিদ্রায় অভিভূত এবং নির্বাক সে কি
ঘোষণা করছে সে কখনও কারুকে আঘাত করেনি, কাউকে কাঁদায়নি, এমনকি একটা পশুকেও সে যাতনা দেয়নি–এভাবে আদর্শ মানুষ ঘুমিয়ে থাকে।
অথচ ওই কথাগুলি যে প্রতারণা, তা প্রমাণিত হয়েছে। জীবন একরকম। বাণী অন্যরকম। মানুষ দেবতা হওয়ার লোভে অমন বাণী রচনা করে। অশ্বারোহী পুরুষটি পতঙ্গের দাম দেয় অথচ সে মেষ-শিশুকে হত্যা করে। পতঙ্গের পক্ষধ্বনি শুনতে পায় অথচ নিনিভের মনুষ্য-আর্তনাদ তাকে বিচলিত করে না–শবস্তূপ থেকে জীব প্রাণ খুঁটে তুলে আনে অথচ সমেরুর মত কিশোরকে সে প্রবল যাতনার ভিতর নিক্ষেপ করে। আক্কাদই শুধু প্রতারক নয়, একজন ফেরাউন সম্রাটও ক্রীতদাসীর গর্ভ তল্লাশ করে শিশুহত্যার পরোয়ানা জারি করে। কতকাল মানুষ এইরকম দু’মুখো জীব–এক মুখে অহিংসা, অন্য মুখে যুদ্ধের শিঙা ফুঁকে চলেছে। শিশুর গলায় লকেট দেখে যে অভিভূত, সে আদৌতে একটি ক্ষুদ্র শিঙা লটকে রেখেছে গলায়।
–তুমি আমার শিশুমেষকে হত্যা করেছ সারগন–ক্ষমা করব না কখনও! আমার জন্য একটি সূর্যমন্দিরই যথেষ্ট। তাই দাও। তোমার কাছে যাচনা করার কিছু নেই।
আপন মনে বলে যেতে থাকে রিবিকা। কতকগুলি তাঁবুক্ষেত্র তারা অতিক্রম করে আসে। তারপর দেখতে পায় সার সার মন্দির। মন্দিরগুলি সব এক। ধরনের নয়। আকাশে আলো নরম হয়েছে। অশ্বের গতি অনেকক্ষণ খুবই মন্থর। শিশুকে পাওয়ার পর ঘোড়া যেন আর চলতেই চাইছে না। পাহাড় ক্রমশ আরো নিকটবর্তী হয়ে এল। দিনের আলোতেই দেখা গেল পাহাড়ের মাথায় রূপালি চাঁদ উদ্ভাসিত। মন্দিরের সিঁড়িতে দেবদাসীরা বুকের কাপড় ফেলে দিয়ে বসে আছে। সুগন্ধি পাতা চিবিয়ে চলেছে। পেয়ালা থেকে গড়িয়ে খাচ্ছে দ্রাক্ষাসব। পথের উপর মদপাত্র সাজিয়ে বসেছে মানুষ।
মাটির কাঁচা ইট মরুবালিতে শুকানো হয়েছে। তাই দ্বারা নির্মিত হয়েছে মন্দির। তাঁবুর আকৃতির এই ঘরগুলি খড়ো। যবের গমের বিচালি ছাওয়া। কোথাও পাথরের লেশমাত্র নেই। অবশ্য দু’একটি মন্দিরে কিছু তফাত রয়েছে। তাঁবু বলতে যেগুলি গোলাকার তাঁবু, মন্দির সেই আকৃতিবিশিষ্ট হওয়ার পর চুড়ো তুলেছে গোলার মত। দু’একটি মন্দির সহসা রাজকীয়। সম্পূর্ণ পাথর কেটে তৈরি, তা পিরামিড-সদৃশ।
রিবিকা বুঝতে পারছিল পরিচ্ছন্ন মন্দির বলতে কী বোঝাচ্ছিল সাদইদ। তাকে দেওয়া হবে পিরামিড মাকা কোন একটা মন্দির। সন্ধ্যার মুখে মন্দির প্রাঙ্গণে ঢোল আর বীণা বেজে উঠল। মরুভূমির একধরনের বুনো তীব্র গন্ধ ফুলের মালা কব্জিতে জড়িয়ে বেঁধে জুম পাহাড়ী সৈন্যরা তাঁবু থেকে নির্গত হতে লাগল। মুখে মদের ঝাঁঝালো গন্ধ, গায়ে আতর ছিটিয়েছে। পোশাক পরেছে মসীহদের মত। কিন্তু এমনভাবে তা পেঁচানো হয়েছে পরনে এবং গায়ে যে, একখানি পায়ের থাই অবধি চোখে পড়ছে। চোখে ঢুলু ঢুলু চাউনি আচ্ছন্নতা পীড়িত, ঈষৎ তির্যক । গোঁফ জুমরে মদের প্রলেপ দিয়েছে, চোখে কেউ কেউ সুমা পরেছে। আতরে মদে মাখামাখি বাতাস রূপালি চাঁদে হল্লা তুলে ছুঁয়ে নামছে মাটিতে। অত্যন্ত কম বয়েসী পাঁচটি মেয়েকে দেখা যাচ্ছে একটি ছোট মন্দিরের সামনে। পাথরের পাটাতন পাতা বদ্বার ঠাই, একে বলা হয় দীঘল কেদারা। এখানে বিশ-পঁচিশজন সেপাই মাথা নিচু করে বসে রয়েছে।
মাথা নিচু করে বসে থাকার কারণ যে সাদইদ, ক্রমে বুঝতে পারে রিবিকা। কচি মেয়েগুলি দাঁত বার করে হাসছে। বুকের জামা খুলে একটি কুঁড়ি দেখিয়ে জামার তলে ঢুকিয়ে রাখছে একটি পাজি মেয়ে। ক্রমাগত এই-ধারা করছে।
সাদইদ ঘোড়া নিয়ে গিয়ে ওখানে থেমে গেল। সুন্দরী রিবিকার দিকে সবাই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। কচি সেই পাজি মেয়েটি রিবিকাকে বুকটা দেখিয়ে জিভ ভেংচে বলল–নতুন নাগরী বুঝি! তা বেশ। ক’খানা ভেড়া দিয়ে খরিদ করল তোকে!
সাদইদ ঘোড়া থেকে লাফ দিয়ে নেমে শিশুটাকে রিবিকার কোলে ছুঁড়েই দিল একপ্রকার। তারপর সটান কচিটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললকনানী ভাষাটা তো বেশ মজবুত করে বলতে পারো কিন্তু এইসব আদিখ্যেতা কেন? সহবত বোঝো না?
বলেই গালে একটা চটাস করে চড় মারল সাদইদ। তারপর ধমক দিয়ে উঠল–বেয়াদব! শরীর সামলে রাখো!
–আ বাপ! তিন ভেড়ার খরিদানা মাগী আমি, তুমি মিনসে হলে বতাই হবা নাকি ভিস্তির পো? জানি তুমি লোকটা অতি মন্দ নও, শুদু হিতেনের পেটোয়া বটো। আমায় একবার হারেমে দাও দিকিনি, ঘুরে আসি! আঙুর চটকালে মদ, মাগী চটকালে বদ–তা বুঝি জানো না!
বলেই সাদইদকে জিভ বার করে ভেংচে উঠল পাজিটা। সাদইদ রেগে গিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিতেই মেয়েটি পড়ে গিয়ে কেঁদে ফেলল ভয়ে।
একজন গামছাবালা সাদইদের কাছে এগিয়ে এসে বলল–হুঁজুর! ঘাট মাফ করবেন! ওটার মাথা খারাপ! খালি বকবে,যতই কেন বলুন! আসলে যুদ্ধে ওর বাপ-মা দুটিই খতম হয়েছে। পরে এক মদঅলা শুঁটকিঅলা ওকে তিন ভেড়ার। বদলি কিনে আনে, সেই গল্পটা ও করে! কী করে শুঁটকিঅলা-উটবালাকে ও নিজেই ওদের উঠানে ডেকে নিয়ে গেল। একটাই কেচ্চা কেবলই আউড়াবে। ওর কাকারা ওকে বেচে দিয়েছে! ওর দুখখু একটাই–ও কেন নিজেই ব্যাপারীকে ডেকে নিয়ে গেল! বিশদ করে বলা ওর স্বভাব। মাথাটা গেছে। হুজুর! মারলেও শুনবে না। আপনি চলে যান। আমি ওকে দেখছি!
গামছাবালা ঘাড় থেকে গামছা নামিয়ে হাতের মুঠোয় ধরে কপাল অবধি তুলে নাচিয়ে অভিবাদন জানালো সাদইদকে। সাদইদ সহসা ঘাড় নিচু করে ঘোড়ার লাগাম ধরে সামনে এগিয়ে চলল।
সেই যে সাদইদ ঘাড় নামালো, পথের উপর থেকে আর চোখ তুলল না। পাহাড়টা মনে হচ্ছিল খুব কাছে, কিন্তু মোটেই তত নিকটে নয়। সুদীর্ঘ সময় সাদইদ পথ হেঁটে এল। সন্ধ্যা ঘনাল। রিবিকা একটি কচি মেয়ের ভিতর তার অতীতকে এক ঝলকে প্রত্যক্ষ করল। হুবহু একই জীবন। তিনটি ভেড়া অবধি সঠিক। কচিটা যে নিজেই বণিকটিকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল না-বুঝে পথ থেকে, এই বেদনা তার কিছুতেই শেষ হতে চাইছে না।
কেউ আসার পথে প্রশ্ন তোলেনি বটে, তেমন খুব আশ্চর্যও হয়নি রিবিকাকে দেখে। কারণ তারা নিজেদের কাহিনীতেই অশেষ বিস্ময় সংগ্রহ করেছে। হঠাৎ এই অশ্ব যেন একটি উটের অবয়ব লাভ করে। কিছুতেই রিবিকা ভাবতে পারে না, এ উট নয়, ঘোড়া। দীর্ঘদেহী, সুউচ্চ ঘোড়াটা অতঃপর উট হয়ে যায়। লাগাম ধরা মানুষটিকে মনে হয় ফরাতের উটচালক। হঠাৎ চোখে পড়ে আর এক আশ্চর্য ছবি। বালির ঢিবির উপর বসে রয়েছে একটি একহাত কাটা ভয়ানক। রূপসী মহিলা, ফুলের মত বুক খুলে সে একটি কালো কেঁদো বাচ্চাকে স্তন্যদান করছে। দু’হাত তফাতে ঘাড় নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি লোক। ঘাড়ে গামছা, কিন্তু হাতে একখানা লাঠি। কে ওরকম দাঁড়িয়ে রয়েছে? ও যে চেনা চেনা কেউ।
মহিলার কাটা হাতটা স্তন্যদান করায় ক্রমাগত লাফাচ্ছে এক অনির্বচনীয় পুলকে আর বিষাদে। স্বর্ণালী সূর্য টলটল করছে। রূপালি চাঁদ অন্য গগনে ফটফটিয়ে হাহাকার করছে। কাটা হাতের প্রত্যেকটি কম্পন যেন কিছু একটা ধরতে চায়। চামড়ার ক্রমপ্রসারণ ও সংকোচন যেন কাটা নগ্ন হাতটির হৃদয়। অথবা ফুসফুস। যা কিনা বাতাস পাচ্ছে না। দম আটকে আসতে থাকে রিবিকার।
মন্দির ছেড়ে এখানে কী করছে মা, শিশু আর গামছাবালা চেনা চেনা লোকটি? বোধহয় এদিকে কোথাও এসেছিল, সন্ধ্যায় ফিরে যাওয়ার কথা, ফিরতে পারেনি।
ফর্সা কাটা হাত, কিন্তু কাঁধের পাশে ঝুলন্ত, কনুই-হীন, কনুইয়ের উপর অবধি কিছুদূর যুদ্ধের কোপে উধাও, কাটা অংশটি কালো আর অদ্ভুত দলা দলা কদর্য কোষযুক্ত, যেন-বা ফুসফুস। কালো ফুসফুস। বারবারই মনে হয় রিবিকার। সে ভয়ে শিউরে উঠে মুখে আর্ত শব্দ করে ফেলে। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে। সেই শব্দে সচকিত হয় রুহা। স্তন ঢেকে ফেলে কাপড়ে। সন্তানকে স্তনচ্যুত করে কাঁধে ফেলে উঠে দাঁড়ায়। লাঠিধারী গামছাবালা কিন্তু নড়ে না। যেন মূর্তি।
পশ্চিম আকাশে রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ডের আলো ক্রমশ ম্লান। অন্য দিগন্ত ক্রমে ব্যাপ্ত করে সাদা রূপার গলিত বিভা। তাই মহাঘোর এই বালুকাবিস্তীর্ণ পটভূমি-সম্মুখে খাড়া ভীষণ পাহাড়। পাহাড়ের পায়ের তলায় মসীহ ইহুদ মূর্তিবৎ স্থির। কাঁধে গামছা, হাতে জাদুকীর্ণ লাঠি একাভিমুখিতার প্রতীক এই দণ্ড। গামছাখানি তার আত্মার অপমান। অবধারিতা একারণে যে, অপমান চন্দ্রকলাকৃতি বঙ্কিমা প্রসারিত ভূখণ্ডের সমান। কোথাও লুকোবার ঠাঁই নেই। যবহ দেখছেন, তাঁর বান্দা কী অসীম বেদনায় অপমানে নির্বাক।
রুহা অশ্ব দেখে ছুটে আসে। সাদইদের প্রতীক্ষায় সে অস্থির হয়েছে। একদণ্ড থামে না। ককিয়ে ওঠে–আমার সেপাইকে দেখলেন হুজুর! খোঁজ পেয়েছেন! কোথায় আছে? কবে আসবে?
সাদইদ থেমে পড়েছে। মনে হচ্ছে এ দৃশ্য নতুন নয়। এই প্রতীক্ষা পুরনো হয়ে গিয়েছে। এই প্রশ্ন ধারহীন। এই বিড়ম্বনা সোয়াস্তিশূন্য। সাদইদ খাদে নামানো ঈষৎ ভেজা গলায় যতদূর সংক্ষিপ্ত সম্ভব জবাব করে–আসবে!
–কবে?
এতক্ষণে মুখ তোলে সাদইদ। হঠাৎ কড়া উত্তর–তোমাদের সমস্ত জবাব সামান্য ভাড়াটে সৈনিক দিতে পারে না রুহা!
–তুমি দেবে না তো কে দেবে তবে? ভিস্তির পোলা হয়ে আমার নাগরকে তুমিই কেড়ে খেয়েছ বদমাশ! নতুবা লুকিয়ে রেখেছ। দাও। ফিরিয়ে দাও। সাদইদ ফের মুখ অবনত করেছিল। ফের তুলল। বলল–আসবে রুহা!
–কবে!
–আমি স্বপ্নদর্শী নই। মসীহ নই। আমি নক্ষত্রবিজ্ঞান জানি না।
–তুমি পিঁপড়ের ভাষা বুঝতে পারো। পিঁপড়ের গতিবিধি দেখে কখন বৃষ্টি হবে বলতে পারো। তবে কেন বলতে পারবে না আমার সেপাইয়ের খবর? তুমি ওকে নিনিভের দিকে পাঠিয়েছ। একদল সেনা তো ফিরল না! কেন ফিরল না? কী হল ওর? লোটাই বা কবে ফিরবে?
–ফিরে আসবে নিশ্চয়।
–দেখা হয়েছে বল তাহলে?
–যা হয়েছে! এবার পথ ছাড়ো!
–কখন আসবে!
–কাল।
–রোজই তো বল কাল। আসে না কেন? আমার শিশু যে কাঁদে!
–মধু খেতে দাও।
–আমার বুকে কি গরল আছে বলছ?
–আমি সেকথা বলিনি রুহা। সামনে মরুভূমিতে শীত আসছে–আমি সেপাইদের বলেছি মৃতদেহ থেকে কাপড় সংগ্রহ করতে। এখানে নদী নেই! শস্যক্ষেত্র নেই। এমনকি সমুদ্রের গর্জন শোনা যায় মাত্র, সমুদ্র উত্তাল হয়–কিন্তু বাতাস লাট খেয়ে কিনারা ছুঁয়ে সমুদ্রের ভিতর ঘুরে চলে যায়–কেবল একটা নির্দিষ্ট সময়ে সামান্য মেঘ উড়ে আসে। তখন সমুদ্র বাতাস খুলে দেয়। এই ঊষর জীবন কেবল যুদ্ধে খরচ হয় রুহা। মৃতদের পরিত্যক্ত খাদ্য বস্ত্রে জীবন বাঁচে। এ এক ধরনের চুরি। লুঠ নয়। পরাক্রম নয়। তোমার সেপাই আসবে একদিন প্রচুর বস্ত্র আর খাদ্য নিয়ে। সমুদ্র সর্বক্ষণ হাওয়া দেবে সেই জীবন তো আমরা পাইনি।
–আমি কী করব মা গো!
বলে উধ্বাকাশে মুখ তুলে রুহা আর্তনাদ করে উঠল।
আকাশে চন্দ্রকিরণ ঘনীভূত হচ্ছে, সূর্যালোক আর নেই। রুহা চাঁদের আলোর দিকে চেয়ে কেঁদে উঠল–আমার এই কাটা হাতটাকে কে আর ভালবাসবে! কেউ তো রইল না!
এবার অনড় মূর্তিটা কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। রিবিকা ইহুদকে ধীরে ধীরে চিনতে পারে! একজন মসীহের এই পরিণাম অভাবিত। বোঝা যায় সাদইদ তাঁকে জীবনের একেবারে তলায় ঠেলে দিয়েছে। তাঁর এই-ধারা ঘাড় নিচু করে থাকা অবিচল মূর্তি প্রকৃতই এক সুতীব্র অপমানের দীনতম দশা–যার পর আর কিছু নেই।
সমুদ্র রয়েছে এখানে, কিন্তু সমুদ্র কিছুই দেয় না–বায়ু অথবা মেঘ। এ এক আশ্চর্য জমি। তেমনি জীবন এখানে রুদ্ধ হয়নি, কিন্তু তার কোন রূপ বা আকার নেই, একটা পিণ্ডবৎ পড়ে আছে, গর্ভনাশের ফলে মানবী যেমন পিণ্ড প্রসব। করে। এ উপমা রিবিকার মনে আসে কেন সে বুঝতে পারে না। সে আমারনায় থাকার সময় ওইধারা পিণ্ড প্রসব করেছিল। আবীরুদ তখন তার কাছে আসতে শুরু করেছে। সেই সময় তার তলপেট নড়ছে, নমরুর বাচ্চা ধরেছে সে। সে এক মর্মান্তিক অনুভূতি। গা সিরসির করে। পায়ের তালু সিরসির করে। মাথা ঘুরে ওঠে রিবিকার। সে শিশুসহ বালির উপর খসে পড়ে যায়।
তারপর সে যখন চেতনা ফিরে পায় দেখে অদ্ভুত একটি জায়গায় সে শুয়ে আছে। চোখ মেলেছে সে। প্রজ্বলন্ত চাঁদ টইটই করছে আকাশে। দু’একটি তারকা ভাসছে। বাতাস আসছে হু-হুঁ করে। অথচ চারপাশ পাষাণে মোড়া। ছাদবিহীন এ এক আশ্চর্য ঘর। জ্যোৎস্না আর হাওয়ায় যেন আকাশে ভাসমান। পাশে শায়িত শিশু। কেউ কোথাও নেই। এ তবে রক্ষঃপুরীর মত কোন স্থান।
মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার সময় সে কি ‘বাবা’ বলে কোন আর্তনাদ করেছিল? তার গলায় কি কোন স্বর ফুটে ওঠেনি? জীবনই যেন তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করে দিয়েছে। কান্না তার গলায় দলা হয়ে জমে উঠেছিল। সে মহাত্মা ইহুদকে ডেকে উঠতে পারেনি। তার মনে হয়েছিল ডাক শুনে মহাত্মা ইহুদ লজ্জা পাবেন। সমস্ত অপমানের শেষ দশায় পৌঁছেও কেন এই লজ্জা অবশিষ্ট থাকে–ভাবলে চরম অবাক হতে হয়। ভাবতে ভাবতে রিবিকা ঘুমে তলিয়ে যায়।
খুব ভোরে তিনতলা সুউচ্চ একটি সাঁজোয়া গাড়ি এসে দাঁড়ায় পাহাড়টির কাছে। তিনতলা পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে লাশ। চারটি অশ্ব টেনে এনেছে। অশ্বের গায়ে ঘাম, চোখগুলি তীব্রভাবে হলুদ–সবই কালো ঘোড়া। চারটি ঘোড়াই বুঝি মৃত্যুর ফেরেস্তা–আজরাইল।
সাঁজোয়ার পিছু পিছু ছুটে আসছে উন্মত্ত রোরুদ্যমান প্রবল জনস্রোত–জুমপাহাড়ী স্ত্রী-পুরুষ। মহাশক্তিমান লোটা এই সাঁজোয়া ভর্তি করে এনেছে সৈনিকের লাশ–এর মধ্যে কারা যে সাদইদের সেনা,স্থির করতে পারেনি। সে মনে করেছে, এরই ভিতর থেকে দেবদাসীরা তার আপন পুরুষটিকে চিনে নিতে পারবে। তাছাড়া শিশুরা তার জনককে চিনবে । এই ভয়াবহ দৃশ্যটি কেন রচনা করল লোটা,সাদইদ বুঝতে পারে না। অস্থির কান্নায় আকাশ উতলা হয়ে উঠল।
সেই আর্তরব কানে পৌঁছতেই রিবিকা ভয়ে শিশুকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে। গবাক্ষপথে সে চেয়ে দেখে দৃশ্য। কান্না যেন সমুদ্রের মত বিহ্বল। দেবদাসী আর। শিশুর আর্তনাদ। যাদের আত্মীয়-বিয়োগ হয়েছে সেই পুরুষাও কেঁদে ওঠে। সবাই তো আর এখানে নিঃসঙ্গ ছিল না। কারো ভাই কারো পিতা বিনষ্ট হয়েছে–তারা কাঁদছে। দেবদাসী, যারা কিনা রুহার মত ভালবাসা করেছে, তাদের কান্নাই সবচেয়ে উচ্চকিত। মথিত এ কান্না যেন মরু লু-এর মত দিগন্তপ্লাবী প্রহার।
সমস্ত বেগ এসে সাদইদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পাষাণবিধৌত জলরাশি যেভাবে সমুদ্র পাঠাতে থাকে এবং টেনে নেয়–ফের পাঠায় কান্নার তরঙ্গ সেইরূপ। জলপাহাড়ের মত ডুবে যেতে থাকে সাদইদ। সে যেন সমুদ্রের তলা থেকে কথা বলতে থাকে।–এমন কেন করলে লোটা?
সাঁজোয়া থেকে লোটা লাশ নামায় কাঁধে করে, একাকী। কেউ কিন্তু হাত লাগাচ্ছে না বলে তার কোন বিকার নেই। সে সাঁজোয়ার পিছু পিছু লাগামের দড়ি সাঁজোয়ায় বেঁধে টেনে এনেছে চারটি উট। সে সকলকে বলছে–দেখে নাও। কার কোনটা পুরুষ। কে বাপ, কে সন্তান, কেইবা পুত্র! যারা বিচ্ছেদ চাওনি, তারা দেখে নাও। আমি কিন্তু উটের পিঠে তুলে দেব!
নোটার ভাষা এখানে কেউ বোঝে না। বোঝে একমাত্র রিবিকা। কিন্তু রিবিকা সেকথা বুঝতে পারে না। লোটার ভাষা খুব পুরনো যে-ভাষায় একমাত্র আক্কাদের মা, সেবার মা কথা বলত। এ ভাষা শুনে রিবিকা কতকাল পর অসম্ভব চমকে উঠল। শিশুর লকেটটা ধরেছিল সে হাতের মুঠোয়। ঘর থেকে বেরিয়ে সে সাদইদের কাঁধের নিচে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল কখন,তার নিজেরই। অজান্তে।
সাদইদ মন্দ্রস্বরে বলে উঠল–তোমার মুখের ভাষা আমরা কেউ জানিনে লোটা! তোমার ব্যাকুলতা আমরা বুঝব না। কেবল তোমার ইঙ্গিত আমরা বুঝতে পারি!
লোটার আর্তনাদে, মন্ত্রজব্দ সমুদ্র যেভাবে স্তব্ধ হয়, তরঙ্গ হয় জমাট, এ ঠিক তাই, সেভাবে কান্না থেমেছে। সেই নিস্তব্ধতার ভিতর একটি কণ্ঠস্বর ক্রমাগত চিৎকার করে চলেছে, সে লোটার দিগন্তবিদীর্ণ স্বর। সাদইদ আপন মনে বলে উঠল–তোমার ভাষা ঈশ্বরের মত। আমরা তো বুঝতে পারি না।
–আমি বুঝতে পেরেছি সারগন! বুঝতে পেরেছি!
বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠল রিবিকা। আশ্চর্য হয়ে চমকে সাদইদ পাশে দাঁড়ানো রিবিকার মুখের দিকে চাইল। বিস্ময়-পীড়িত অভিভূত স্বরে বলল–তুমি জানো! তবে বলে দাও এদের!
রিবিকা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, যেতে লাগল আমার দেবতা একমাত্র দেবতা, যিনি জীবন এবং মৃত্যুকে বহন করেন। আমার ভাষা একমাত্র ভাৰা, যা। নবী সালেহ বলতেন। আমার উটগুলি সেই দেবভাষা ছাড়া কিছুই জানে না। আমি আজ প্রমাণ করতে চলেছি, আমার ভাষা আর ধর্ম অনশ্বর। চিরন্তন। এর ক্ষয় নেই। প্রতিটি মৃতদেহ আমার উট বহন করে নিয়ে যাবে দূর দিগন্তের দিকে ফেলে রেখে আসবে দেহ। আসলে নবী সালেহ যেখানে রয়েছেন, সেখানে লুকিয়ে ফেলবে উট,এই মৃতদেহগুলি। তোমরা আমার ভাষা বোঝে না। আমিও বুঝি না তোমাদের। যদি জানতে মৃত্যুকে বহন করার দেবতা একমাত্র উট! জীবনকে বইবার ক্ষমতা একমাত্র তারই। আমার ব্যাকুলতা যদি
বুক চাপড়ে চাপড়ে আর্তনাদ করতে থাকে লোটা। মৃতদেহ কাঁধে করে নামাতে থাকে, উটের পিঠে তুলে দিতে থাকে।
জুমপাহাড়ী ভাষায় অনুবাদ করে দিতে গিয়ে থেমে পড়ে সাদইদ। উট শব নিয়ে দিগন্তের দিকে রওনা হয়। রুহা তার প্রিয়তম মৃত্যুকে চিনতে পেরে আগলে বসে পড়ে। মৃতদেহ ছাড়তে চায় না। তার কোলের বাচ্চাটা মৃত পুরুষের বুকে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে পড়তে চায়। সৈনিকপুরুষটি শিশুকে আদর দিয়েছে অনন্ত, সেকথা শিশু ভোলেনি। কেন তবে চোখ মেলছে না লোকটা? হাত বাড়াচ্ছে না কেঁদোটার দিকে?
রিবিকা আর সহ্য করতে পারল না। তার কণ্ঠস্বর বুজে এল। সাদইদ অসহিষ্ণুর মত বলল–থাক আর বলতে হবে না। লোটার উন্মাদনা প্রশমিত হবে না। ও কপাল চাপড়াবে। আপন বুকে কিল-ঘুষি ছুঁড়বে–এই ওর রোগ!
রিবিকা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। গুহায়িত ছাদবিহীন গৃহে শিশুকে বুকে করে ফিরে এসে লকেটটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আকাশে মুখ তুলে সজোরে বিলাপ করে উঠল–হায় দেবী! মা গো!
লকেটটাকে এখন স্পর্শ করতেও তার ভয় করছিল। শিশুর মুখে ঈশ্বরের মত হাসি নিঃশব্দে ঝরছে। যেন দেবতা আমন শিশুর মুখমণ্ডলকে উদ্ভাসিত করে রেখেছেন। রিবিকা সেদিকে চেয়ে দেখতে দেখতে ডুকরে ডুকরে উঠতে থাকল।
বাইরে মৃতদেহকে চেনার উপায় সহজ ছিল না। কারো দেহ স্বাভাবিক নেই। কারো চোখ দুটি ঝলসে দিয়ে মুখকে বিকৃত করে দেওয়া হয়েছে। কারো মুখেরই আধখানা কেটে নামিয়ে দেওয়া। কারো দেহ আছে, মুণ্ডু সাঁজোয়ায় তোলা। হয়নি। কারো মুখ সহজ নয়। তথাপি কিছু কিছু আশ্চর্য ঘটনা ঘটছিল। বহুকাল বাদে একজন তার স্বামীকে মৃতদেহের ভিতর আবিষ্কার করতে পেরে সহসা ভয়ানক আর্তনাদ করে উঠল।
উটের পিঠে তোলার আগে মৃতকে নগ্ন করা হচ্ছিল। কাপড় খুলে নিয়ে একদিকে জড়ো করে রাখছিল লোটা। ওগুলি জলে সেদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে শিবিরে বিলি করা হবে। এই সাঁজোয়ায় একেবারেই অচেনা পুরুষ কম নেই। কিছু নারীও মরেছে, অল্প শিশুও। সকলকে নগ্ন করে অন্তিম প্রস্থানে পাঠানো হচ্ছে। হঠাৎ একজন, নাম সুব্বা, ভয়ানক খেপে গিয়ে লোটাকে আক্রমণ করল! ঝাঁপিয়ে পড়ল লোটার উপর। কী হয়েছে? না, সুব্বা তার হারিয়ে যাওয়া কিশোর ভাইকে মৃতদেহের ভূপে আবিষ্কার করতে পেরেছে। আক্রান্ত লোটা আক্রমণ মুহূর্তে প্রতিহত করে হো-হো করে পাগলের মত উচ্চহাস্য করে উঠল।
সাদইদ ভাবল, কেন সে নোটাকে পাঠালো সৈনিকদের না-ফেরার খোঁজ নিতে? লোটা বহুদিন নিঃসঙ্গতা রোগে ভয়ানক হয়ে উঠেছিল। কীভাবে সে সাঁজোয়া ভর্তি করেছে, কেউ জানে না।
গবাক্ষে চোখ রাখে রিবিকা। শব বোঝাই উট চলেছে দূর দিগন্তের দিকে। লোটার নির্দেশই যথেষ্ট। মৃতদেহ নিয়ে ছুটে যাচ্ছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। শক্ত আংটা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে শব।
একে একে সমস্ত দেহ বহে নিয়ে গেল উটেরা। কোথায় ফেলে দিয়ে এল কেউ জানে না। এইভাবে নবী সালেহর মৃতদেহ উট বহে নিয়ে গিয়ে শূন্য পিঠে ফিরে এসেছিল। খালি পিঠে, প্রকাণ্ড গলা ভয়ানক দোলাতে দোলাতে ফিরছে। দিগন্ত থেকে উটেরা। কুঁজগুলি কবর। পায়ের আঘাতে বালিও উড়ছে। সমস্ত শরীর মৃত্যুর পর উটের ভিতর আশ্রয় পায়। একথা জোরে জোরে চিৎকার করে বলছে লোটা।
লোটা বলছে–হা নবী! সমস্ত যুদ্ধ ওই কুঁজে থেমে যায়। যুদ্ধের অবশেষকে তুমিই বহন করো পিতা!
সূর্য মাথার উপর দীপ্যমান। কখন সে মধ্য আকাশে উঠে গেছে কারো খেয়াল নেই। কান্নার মন্থন পারাবার-প্রমাণ উত্তাল। মরুর বুক ঝড়ের মত হু-হুঁ করছে।
সূর্য চলে গেল দিগন্তে। শেষ দেহটি রুহার পুরুষটির উত্তোলিত হল। উট ক্লান্ত পায়ে অগ্রসর হল। রুহার হাত থেকে মৃতদেহ ছিনিয়ে নিয়ে লোটা উটের পিঠে বেঁধে দিল।
দিগন্তের কাছাকাছি চলে যেতেই রুহা বুকফাটা আর্তনাদ করে উটের দিকে ছুটে চলল। তার কেঁদোকে সে বালির উপর ফেলে রেখে ছুটল। কী আশ্চর্য! কেউ তাকে ধরবার চেষ্টাও করল না। হঠাৎ দেখা গেল ইহুদ দিগন্তের দিকে ছুটতে শুরু করলেন। উটকে আর দেখা যাচ্ছে না।
সহসা লোটা কী যেন চিৎকার করে বলল। কেউ বুঝল না। রিবিকা শুনতে পেল–আপনি যাবেন না মশায়! উট কোথায় যায় কেউ জানে না। মরুভূমির পাহাড়ের ওদিকে কোথায় যে যায়…ও মশায় যাবেন না।
তারপর স্বয়ং লোটা তীব্র বেগে দৌড়তে লাগল দিগন্তের দিকে। দেখতে দেখতে লোটা ইহুদকে অতিক্রম করে গেল। উট কোনদিকে ছুটেছে কেউ জানে না। সাদইদ শুভ্র অশ্বের পৃষ্ঠে লাফিয়ে উঠে অশ্ব ছুটিয়ে দিল, যখন একজন বলে উঠল–রুহা বাঁচবে না। ওকে আমনদেব ডেকেছেন!
অতঃপর সীমাহীন মরুর বুকে আর এক যুদ্ধ শুরু হল! মরুবাঘের মত লোটা পাগলিনী রুহার বেদনাকাতর দেহে ঝাঁপ দিল। মৃতদেহ পিঠে করে দাঁড়িয়ে রয়েছে উট। রুহা কঁকিয়ে উঠল–আমায় ছেড়ে দাও।
একটি পাহাড়গুহার ভিতর টেনে আনার চেষ্টা করছে একটি পুরুষ একটি নারীকে। দুজন দুজনের ভাষা বোঝে না। লোটার বিদ্বেষ আরো ভয়াবহ। পাহাড় নারীকণ্ঠে তীব্র আর্তনাদ করে ওঠে। অশ্বারোহী সাদইদ সেই কান্না শুনতে পায়–কিন্তু কোথায় রুহা বুঝতে পারে না। ইহুদ তখনও পৌঁছতে পারেননি।
অত্যন্ত ছোট পাহাড় এটি। সাদইদ অশ্বকে দ্রুত পাহাড়ের চারপাশ প্রদক্ষিণ করে আনে। দেখতে পায় ওদের। লাফিয়ে নামে। ছুটে এসে ক্ষুধার্ত বাঘের মুখ থেকে শিকার কেড়ে নেয়। ইহুদ ততক্ষণে পৌঁছে গেছেন।
সাদইদ প্রবল বলপ্রয়োগ করে লোটার গালে চপেটাঘাত করে। এই সময় উটটা খাদের কাছে গিয়ে গা ঝাড়া দিতেই আংটা ছিঁড়ে মৃতদেহ খাদে পড়ে যায়। পাহাড়ের নিচে খাদটা ভরে এসেছে। শবের গন্ধে চারিদিক ভারী হয়ে রয়েছে। দেরি না করে সাদইদ রুহাকে অশ্বের পিঠে তুলে নেয়। অশ্ব ছুটে আসে জুম পাহাড়ের মন্দিরের দিকে। অপমানিত লোটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ইহুদ এসে লোটার কাঁধে হাত রাখেন…
.
রাত্রি গম্ভীর হয়েছে। লোটা আর রুহার ঘটনা কী ঘটল রিবিকা জানে না। সে সাদইদকে জিজ্ঞাসা করতেও সাহস পাচ্ছে না। উটের শব বহনের দৃশ্য তার মনে এক নিরাশ্রয় ভয় সৃষ্টি করেছে। সাদইদ এখন রিবিকার চোখের সামনে চুপচাপ থুতনিতে হাত রেখে একটি বেদীর মত উচ্চ পাথরের আসনে বসে আছে। চাঁদের আলো সারা ঘরকে ভরিয়ে দিয়েছে সাদা পুষ্পের মত। শিশু ঘুমন্ত। সাদইদ একবারও রিবিকার মুখের দিকে মুখ তুলে চাইছে না। সামনে। বসে আছে অন্যমনস্ক–কী এক গভীর চিন্তায় মগ্ন বলে মনে হচ্ছে!
হঠাৎ বাইরে ঘোড়ার একটা চিৎকার শোনা যায়। একটু পরেই লোটা এসে ঢোকে। সাইদের সামনে পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে বলে আমায় ক্ষমা করুন সারগন! আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।… বলেই লোটা শিশুর মত উচ্চ গলায় কাঁদতে লাগল। পিঠে হাত রাখল সাদইদ। সস্নেহে বলল–আমি তোমার দুঃখ বুঝি না লোটা! তুমি চুপ করো, শিশু জেগে যাবে। জানি, বলপ্রয়োগে কখনও কারো হৃদয় পাওয়া যায় না। রুহা যাকে ভালবাসত সে তো। শেষ হয়ে গেল। তুমি তার চরম দুঃখের মুহূর্তে কেন ওরকম করলে! এ। তোমার ঠিক হয়নি। তুমি ব্রাত্য–তোমার ভাষা, ধর্ম আলাদা। তোমার জন্য কোন দেবদাসীর ব্যবস্থা আমি করে উঠতে পারিনি। তাই বলে তুমি রুহার উপর। বলপ্রয়োগ করবে? আমাকে দেখে তুমি শিখতে পারো না? আমার সব আছে মনে করো! অথচ কী আছে আমার? কোন দেবদাসীর প্রতি আমার কোনই। আগ্রহ নেই। আমিও তোমারই মত নিঃসঙ্গ। যদি তুমি বুঝতে!
কথাগুলি সে অনুভবে সমস্তই বুঝতে পেরেছিল বটে, তাই তার কান্না থেমে গেল। কী মনে করে উঠে দাঁড়িয়ে রিবিকাকে দেখিয়ে ভয়ানক লোভার্ত চোখে লোটা বলল–ওই তো তোমার সব আছে। শিশু আর নারী! তোমার কপাল তো রাজচক্রবর্তীর কপাল! বন্ধু, আমি লোভ করছিনে। তবে আমি কোথাও চলে যেতে চাই। যুদ্ধ আছে, অথচ নারী নেই, এই অবাস্তব জীবন কত আর বইব! রুহার কাছে তবু আমি ক্ষমা চাইব! আমার ভাগ্যে একটা হাতকাটা মেয়েও জুটল না। আমি খুব ছোট জাত, আমার ভাষা বেদেজনের ভাষা–ঠিক আছে!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে চলে যায় লোটা। যাবার সময় চোখে বিদ্যুৎ ঝলসে তালে–তীব্র কামাগ্নি! মনে হল, রিবিকা পুড়ে যাবে।
রিবিকা সমস্তই বুঝে ফেলেছিল। সাদইদ রিবিকার দিকে দৃষ্টি ফেরালো না। বলল–আমার ভয় হচ্ছে রিবিকা! লোটা যদি আত্মহত্যা করে! ভেবে দ্যাখ লোটা কি সাহসী! ওর জন্যই আমরা বেঁচে আছি। আচ্ছা! তুমি একটা কথা শুনবে! না থাক!
বলে আবার চুপচাপ বসে থাকল সাদইদ। সাদইদের উপর সহসা রিবিকার কেমন মায়া হচ্ছিল! কাছে এগিয়ে যায় রিবিকা।
–আপনি আমাকে সব কথা বলতে পারেন! আমি শুনব!
রিবিকা সাদইদের ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে প্রায় নিজেরই অজ্ঞাতে বলে ফেলে।
–যদি ধরো লোটা আত্মহত্যা করে! আমার তো কেউ নেই। লোটাই একমাত্র বন্ধু! অথচ ও আমার তৈরি ভাষা নিল না । ও আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছে। ও বলে, একদিন সে উটের পিঠে চড়ে বৃষ্টির ভিতর দিয়ে ঝাঁপসা হয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাবে। ভাবতে পারিনে রুহার মত একটা সাধারণ মেয়ের ওপর।
সে পাহাড়ের ওদিকে…কী বলব…খুব খারাপ সেই দৃশ্য!
বলতে বলতে আবার থেমে পড়ে সাদইদ। আবার বিষণ্ণ হয়ে পড়ে।
–আচ্ছা! লোটা এতক্ষণ তোমায় দেখিয়ে কী বলছিল, কোন মন্দ কথা বুঝি! তুমি কিছু মনে করো না!
ফের চুপ করে থাকে সাদইদ।
–আপনার কষ্ট কিসের! যুদ্ধই তো আপনার সর্বস্ব! নারীকে জোর করলে অন্যায় তো হয় না। দেবদাসীদের ঠাঁই দিয়েছেন তাই অনেক।
বলল রিবিকা।
সাদইদ বলল–কারো জন্য দয়া নয় রিবিকা। আমি ভাড়াটে সেনা! আগেই বলেছি, তোমার চেয়ে ভাগ্য আমার উর্বর নয়। শুধু অস্তিত্বের জন্যই সব, শুধু বাঁচা–আর কিছু নয়–কে আমায় চালিয়ে নিয়ে ফিরছে জানিনে। আজ সমস্ত দিন মনটা বিষণ্ণ হয়ে থেকেছে–কেন আমি মেষ-শিশুকে হত্যা করেছি! প্রতিনিয়ত যুদ্ধ দেখে দেখে হৃদয় নষ্ট হয়ে গেছে। আমি তো শৈরীর মানুষ। জন্মের আগে থেকে যুদ্ধ আমাকে নিয়তির মত অনুসরণ করেছে। অথচ আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হল না! একটি পতঙ্গ যা জানে আমি তা জানি না। একটি কুকুর কখনও বিশ্বাস ভঙ্গ করে না। প্রভুর জন্য প্রাণ অবধি ত্যাগ করে! সূর্যদেবতা সামাশের চেয়ে একটি শিশু অধিক পবিত্র। আমি তোমার বুকে ইন্দ্রধনুর রঙ। আর আলো দেখেছি রিবিকা!
বলতে বলতে স্বর যেন গলার ভিতর নিবে আসে সাদইদের।
–তোমার কেউ নেই?
–আমার জন্মের কথা আগেই বলেছি!
–মহাত্মা ইহুদকে এভাবে হীন কাজে নিয়োগ করলে কেন? উনি আমার পিতা।
–কে তিনি?
–যাঁর হাতে লাঠি রয়েছে!
যুদ্ধই তাঁকে নিয়োগ করেছে বিবিকা!
–এ তোমার চালাকি! তোমার সৈন্য ওঁকে বেঁধে এনেছে। আমাদের তামাম দলটাকে হত্যা করেছে।
–যুদ্ধ যে তাই করে আমনের বউ!
–তোমার শিশুবিলাসকে আমি ঘৃণা করি সারগন! শিশুকে স্পর্শ করার অধিকার তোমার নেই।
রিবিকা সাদইদের কাছ থেকে সরে চলে এসে হেরার পুত্রকে কোলে তুলে নিয়ে দুই চোখ মুদে নিঃশব্দে অশ্রুপাত করতে থাকে।
সাদইদ সেই দৃশ্য দেখে ভাবে–এই ছবি একটি স্বর্গের ছায়া। তখনই একটি উট এসে গবাক্ষপথে গলা বাড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গায়ে ওর শব বহনের ঘ্রাণ।
রিবিকা সুতীব্র ভয়ে শিশুকে বুকে সজোরে চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠে। সাদইদ দ্রুত আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠে গবাক্ষের কাছে সরে আসে। তারপর ত্বরিতে গবাক্ষের ঝাঁপ ফেলে দেয়।
বাইরে চলে আসে একাকী সাদইদ। তার মনে হয়, একটি প্রস্তাব উত্থাপন। করতে গিয়ে সে থেমে গেল কেন? লোটার ভাষা বোঝে রিবিকা। এই যুক্তিই যথেষ্ট। লোটাকে নিঃসঙ্গতার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে রিবিকাই।
কিন্তু কেবলই তার চোখের উপর ভাসছে প্রজাপতি–অধিকৃত এক কোমল সৌন্দর্য। কী অপার সেই রূপ! পতঙ্গ যার সুরক্ষার দাবি করে তার জন্য কী করতে পারে একজন ভাড়াটে সৈনিক? কিছুই কি পারে না? মধু আর বিষ–ভাস্কর হেরা জগৎকে প্রশ্ন করেছে কী দেবে মানুষ শিশুর মুখে!
উটটা চলে যাচ্ছে জ্যোৎস্নার প্লাবনে ক্রমশ। কালো অষের পিঠে চড়ে একলা মরুর উপর অকারণ ছুটে বেড়াচ্ছে লোটা। এ যেন তার একলার উৎসব। লোটা মুখে স্ফূর্তির তীব্র চাপা এক-ধারা শব্দ করছে। এ তার কান্নাও হতে পারে!
হঠাৎ কখন পাশে এসে চুপটি করে দাঁড়িয়েছে রিবিকা। সাদইদ ঘাড় ঘুরিয়ে মায়াবতী রূপসী দেবদাসীকে দেখল। রিবিকার মাথার কাপড় বাতাসের ধাক্কায় কাঁধে খসে পড়ল। চাঁদের পানে মুখ তুলল রিবিকা। তার চোখের কোণে গড়ানো অশ্রু নিচের পাতার তলে বিন্দুবৎ জমেছে। চাঁদের আলো ঠিকরে এসে পড়ছে সেই বিন্দুর উপর।
জ্যোৎস্নায় এত মোহ, এত তীব্র ভাললাগা থাকে সাদইদ জানত না। সে ভাবল, এই নারী কেন চিরকাল থাকে না এই চন্দ্রকলাকৃতির দেশে! সে কেন ফুরিয়ে যায়?
ভাষা থাকে, ধর্ম থাকে, দেবতারা আকাশে থেকে যান, এমনকি পিরামিড ধ্বংস হয় না। এই নারী কেন এমন থাকে না চিরকাল? রিবিকা তুমি থাকবে–বলে হাত বাড়াতে গিয়ে থেমে গেল সাদইদ। দেখল, উটটা দিগন্তে হারিয়ে যাচ্ছে, কালো ঘোড়া লাফাচ্ছে!