[মরুতীর্থ হিংলাজ বাংলা ভাষায় রচিত একটি আত্মজৈবনিক কাহিনি। এটির রচয়িতা অবধূত তথা দুলালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। পাকিস্তানে বেলুচিস্তান প্রদেশে অবস্থিত মরু এলাকা হিংলাজ’ হিন্দুদের একটি তীর্থস্থান; ৫১ শক্তিপীঠের এক পীঠ।
মন্দিরের নামেই গ্রামটির নাম হিংলাজ। বাংলা, হিন্দি, অসমীয়া ও সিন্ধি ভাষায় দেবীর নাম হিংলাজ হলেও মূল সংস্কৃত শব্দটি হলো “হিঙগুলা”।
হিংলাজের তীর্থযাত্রীরা সেকালে যেতেন উটের পিঠে চড়ে। যাত্রা শুরু হত করাচি শহরের কাছে হাব নদীর ধারে। সঙ্গে থাকত এক মাসের রসদ, যেমন শুকনো খাবার, মরুদস্যুদের প্রতিরোধ করার জন্য অস্ত্র, পানীয় জল ইত্যাদি। এছাড়া সঙ্গে থাকত হিংলাজ মাতার প্রসাদের জন্য শুকনো নারকেল, মিছরি, বাতাসা ইত্যাদি। এক মাসের অত্যন্ত কঠোর যাত্রার পর শ্রান্ত তীর্থযাত্রীরা পৌঁছতেন হিংলাজে। অঘোর নদীতে স্নান সেরে তাঁরা দর্শন করতে যেতেন হিংলাজ মাতাকে। এই মন্দির স্থানীয় বালুচ মুসলমানদের কাছেও পরম আদরণীয়। তাদের কাছে এটি “নানী কী হজ” নামে পরিচিত।
হিংলাজের মন্দিরটি একটি গুহার মধ্যে অবস্থিত। এটি আসলে একটি অগ্নিকুণ্ড। অগ্নিজ্যোতিকেই হিংলাজদেবীর রূপ বলে মানা হয়।
বাঙালী ঔপন্যাসিক কালিকানন্দ অবধূত-রচিত ‘মরুতীর্থ হিংলাজ এবং ‘হিংলাজের পরে’ উপন্যাস-দুটিতে হিংলাজ ও কোটেশ্বর তীর্থদ্বয়ের বিস্তৃত ও অনুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে।
বইটি কেবল হিংলাজে গমনাগমনের কাহিনী নয়, এতে আছে একজন সংসারবিরাগী মানুষের জীবনদর্শন। চমৎকার গদ্যের জন্য এর সাহিত্যমূল্যও উঁচু। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর দুলালচন্দ্র সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন এবং উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরে গিয়ে অবধূত হন। তাঁর নতুন নাম হয় কালিকানন্দ অবধূত। অবধূত বলতে একরূপ সাধক বোঝায়। হিংলাজ যাত্রা শুরু হয় বাংলা ১৩৫৩ সনের আষাঢ় মাসে। এই উপন্যাসটি অবলম্বনে ১৯৫৯ সালে একটি জনপ্রিয় চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়, যার কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন বিকাশ রায় ও উত্তমকুমার।]
মরুতীর্থ হিংলাজ – অবধূত
১৩৫৩, আষাঢ় মাস। ছিটে-ফোঁটা বৃষ্টিরও দেখা নেই। ধূলার সমুদ্রের মাঝে সর্বপ্রকার আভিজাত্যের ছোঁয়া এড়িয়ে করাচী শহরের শেষ প্রান্তে একটি বস্তি, সেইখানে নাগনাথের আখড়ায় অতি প্রাচীন দালানটার এক কোণে আশ্রয় নিয়েছি হিংলাজ-যাত্রী আমরা কয়জন।
এই স্থানটি করাচী শহরের অনেকগুলি ফালতু মানব মানবীর রাত্রের আস্তানা। পথে কাটে যাদের দিন, তাদের অনেকে রাতটা এখানেই কাটায়। সারাদিনের দেওয়া-নেওয়ার হিসাব নিকাশের জের রাতের আঁধারে এখানেই টানা হয়। পাশাপাশি শয়ন করলে জনা-শতেক লোক এখানে ধরে। কিন্তু গরজ যখন অনেকের তখন একটু আপদ-বালাই যে ঘটবেই তাতে সন্দেহ কি-তার ওপর অনেকের আবার তিন দিক খোলা দালানটায় ওরই মধ্যে একটু আড়াল সম্ভব হওয়া চাই। বিড়ি ধরাবার প্রয়োজনে রাত্রে দিয়াশলাই জ্বালানোও নিষিদ্ধ। শালীনতায় আঘাত লাগতে পারে।
এই নাগনাথের আখড়া একদা নাথ-সম্প্রদায়ের সাধুরা স্থাপন করেন। সেই একদা যে কবে তার ইতিহাস জানা অসাধ্য। কালে তাঁরা যথাস্থানে প্রস্থান করেছেন। বর্তমানে আখড়া যারা দখল করেন তাঁরাই এর চারিদিকে সসংসার বসবাস করছেন।
এঁদের পেশার অন্ত নেই। জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত। তার মধ্যে বড় পেশা-বছরে দু-একদল যাত্রী নিয়ে হিংলাজ যাত্রা। একদা সাধুরা এই আখড়া স্থাপন করেন হিংলাজ দর্শনাভিলাষী সাধুসন্তের আশ্রয়স্থানের অভার পূরণের জন্যেই।
কিন্তু আজ যাঁরা পেশা হিসাবে হিংলাজ-যাত্রী নিয়ে তীর্থদর্শন করাতে যান তাঁদের পোড়া পেটের দাবি মেটাবার মতো উদ্বৃত্ত এ পেশায় সম্ভব নয়। সারা ভারত থেকে প্রাণের মায়া ত্যাগ করে রসকষহীন এই তীর্থে যাত্রীই বা জোটে কয়জন? যদিও বা কেউ আসেন তিনি হয় লোটা-কম্বল-চিমটা-সম্বল মাকে-খানেওয়ালা অথবা বড়জোর একদল কাথওয়াড়ী চাষি। সম্বল যাদের আটা লবণ মরিচ ও কম্বল।
সুতরাং হিংলাজের ছড়িদারদের সংসার ও সংসার-লক্ষীদের চেহারায় আর যে কোনো পরিচয়ই থাকুক, শ্রী ও শান্তির চিহ্নমাত্র নেই, থাকতেও পারে না।
দু-জন চার-জন করে জমতে জমতে শেষ পর্যন্ত যাত্রীদল ত্রিশ পর্যন্ত পৌঁছল গোটা এক মাস অপেক্ষা করে। আর অপেক্ষা করাও সম্ভব নয়। পথের নদীগুলো শুকনো থাকতেই ফিরে আসা চাই। অনেকবার নাকি এমনও ঘটেছে যে নদীর জল বৃদ্ধির ফলে দিনের পর দিন আটকে পড়ায় যাত্রীদলের আহার্য গেছে ফুরিয়ে, তারা আর কখনো ফিরে আসেনি। পরের বছর যারা গেছেন তারা এখানে-ওখানে বালুর ওপর রাশি রাশি শুকনো শুভ্র হাড় দেখতে পেয়েছেন।
ছড়িদারদের তরফ থেকেও এবার যাত্রার তাগিদ দেখা দিল। এখন উটওয়ালা এলেই হয়।
গোটা একটা মাস পার হয়ে গেল সেই নাগনাথের আখড়ার দালানটায়। নিশীথ রাত্রে চারিদিকের রহস্যময় ঘুমন্ত মানুষগুলির মধ্যে শুয়ে কত কি যে ভাবতাম-জন্ম মৃত্যু, পাপ-পুণ্য, ইহকাল-পরকাল। কোনো কিছুরই কূল-কিনারা নেই। সারা জীবনটা চোখের সামনে গড়গড় করে বয়ে চলে যেত। আমি নামক লোকটি যেন এই জীবন-নাটকটার নাম ভূমিকার অভিনেতা। কিন্তু নাটকটা যাঁর লেখা-তাঁর ইচ্ছা ও মর্জির বাইরে এক পা ফেলবার ক্ষমতা আমার নেই। সবচেয়ে বড় মজা, এখনও যে অঙ্কগুলি বাকি আছে-তাতে যে আমাকে কি অভিনয় করতে হবে, তাও জানবার উপায় নেই।
ঐ যে দূরে আকাশের পশ্চিম দিকে আস্তে আস্তে সন্ধ্যাতারাটি চলে যাচ্ছে, ঐ দিকেই কোথাও হিংলাজ। আজও জানি না ঐখানে পৌঁছানো আমার কপালে ঘটে উঠবে কিনা! আর এই সুদীর্ঘ ধৈর্য পরীক্ষার শেষ ফল যখন মিলবে তখন কৌতূহল নিবৃত্তির আফশোস ছাড়া আর কি আমার ঘরে পড়বে তাই বা কে জানে!
দীর্ঘনিঃশ্বাস আপন হতেই বুক থেকে বেরিয়ে আসে। ছুটে চলেছি যেখানে সতীর ব্রহ্মরন্ধ্র পড়েছিল, সেই মহাপীঠ হিংলাজে। ভগবান রামচন্দ্র রাবণ-বধ করে ব্রহ্মহত্যার পাপ-ভাগী হয়েছিলেন, তাঁর সেই পাপস্খলন হয় এই মহাতীর্থ-দর্শনে। অত বড় পাপ অবশ্য আমার হিসাবের ঘরে জমা থাকা সম্ভব নয়। এ যুগে ব্রাহ্মণ কোথায় যে ব্রহ্মহত্যার পাপ ঘটবে আমার! তবে অন্তত এইটুকু আমার কপালে নিশ্চয়ই জুটবে যাতে আমার এই জীবন-নাটকের অনাগত অজানা অঙ্কগুলিতে ছুটোছুটির পালা আর থাকবে না, আকুলি-বিকুলির যবনিকাপাত হবে। এই আশাটুকুই মনের কোণে চেপে আগামী কালের অপেক্ষায় পাশ ফিরে শুই।
দিনের বেলা ব্যস্ত থাকি-পাথেয় জোগাড়ে। শেঠ ভগবান দাস সব থেকে বড় সোনার ব্যবসায়ী করাচী শহরে। তিনি কলকাতার কালি আর গৌহাটির কামাখ্যা মাকে দর্শন করেছেন। তিনি ব্যবস্থা করলেন আমাদের হিংলাজ দর্শনের। কামাখ্যার তান্ত্রিক ভৈরব-ভৈরবীর প্রতি তার অটল আস্থা-যদিও তিনি নিজে গোড়া জৈন। পোকা খাবার ভয়ে অর্থাৎ পাছে জীবহত্যা হয় এ কারণে সন্ধ্যার পর তিনি জলও পান করেন না।
কিন্তু মুশকিল বাধল বাংলা দেশের আওরাতকে নিয়ে। হিংলাজ-পথের কষ্ট সহ্য করা কোনোক্রমেই তার পক্ষে সম্ভব নয়।
শেষ পর্যন্ত প্রচুর অর্থ ব্যয় করে একটা আস্ত উট ব্যবস্থা করলেন তিনি ভৈরবীর জন্যে। সেই উটের পিঠে উঠল মুখঢাকা টিনে টিনে বোঝাই চীনাবাদাম আখরোট
কিশমিশ খেজুর মিছরি আর বস্তা বস্তা চাল আটা লবণ মরিচ আলু পেঁয়াজ। বড় বড় বোম্বাই পেঁয়াজ কেন হিংলাজে চলছে? শেঠজি আমাদের বোঝালেন, বালুর মধ্যে এই পেঁয়াজ চিবিয়ে খেলে ‘লু লাগবে না আর পিপাসাও কম পাবে।
ব্যবস্থা এতই দরাজ হাতে হল যে দলসুদ্ধ সবাই মায় ছড়িদাররা আমাকে মোহান্ত মহারাজ বলে ডাকতে শুরু করলে।
তারপর বিপুল পরিমাণ লটবহরকে দুই ভাগে ভাগ করে উটের দু-ধারে ঝুলিয়ে দেওয়া হল, তাতে তার পিঠের উপর খানিকটা সমতল স্থান তৈরি হল। তার উপর একটা খাঁটিয়া চিত করে পেতে উটের সঙ্গে আচ্ছা করে বেঁধে দেওয়া হল। শেষে খাঁটিয়ার পায়া চারটে ঘিরে দড়ি বাঁধা হল। সেই চিত করা খাঁটিয়ার মধ্যে দড়ি ধরে বসে চললেন ভৈরবী। তাজ্জব ব্যাপার হচ্ছে এই যে, যাওয়া আসার ষোল দুগুণে বত্রিশ দিন দৈনিক আধঘণ্টা হিসাবে সমানে তিনি ঝাঁকি খেলেন। আর সে কি ঝাঁকানি! উট এক কদম চরণ ফেললে ঈশান অগ্নি নৈঋত বায়ু চারকোণে চারবার টাল সামলাতে হয় তাঁকে যিনি উপরে চড়ে বসে থাকেন। কিন্তু কোনো অভিযোগের কোনো তোয়াক্কা নেই ভৈরবীর। খুশি মনে সামনের চীনাবাদাম ও খেজুর চিবনোই হচ্ছে তার কাজ। একেবারে রাজসিক ব্যাপার। লটবহর নিয়ে যাত্রা আরম্ভ হল একদিন বিকেল তিনটের সময়। তার পূর্বে প্রত্যহ সকাল-সন্ধ্যা অষ্টপ্রহরে কমসে কম অষ্টআশী বার ‘উটওয়ালা কবে আসবে এই কথা জিজ্ঞেস করতে করতে আমাদের নাভিশ্বাস উঠবার উপক্রম হল। এদিকে আমাদের শ্রদ্ধেয় ছড়িদারগণ নির্বিকার ভাবে উত্তর দিতেন, “কে জানে কবে আসবে, সংবাদ তো দেওয়া হয়েছ; স্বাধীন মুল্লুকের লোক তারা, সবই তাদের মেজাজের উপর নির্ভর করে।”
স্বাধীন দেশের লোক উটওয়ালারা। আমরা যেখানে তীর্থ করতে যাব–সেইদেশ লাসবেলা স্টেট। করাচী সীমানা পার হয়ে সেই দেশের আরম্ভ এবং শেষ বালুচিস্থানের সীমানায়। সেখান থেকে আসবে সেই দেশের উট আর উটওয়ালা। লোক গুনে সরকাররে খাতায় লিখিয়ে দিয়ে আমাদের ভার নেবে সে। ফিরিয়ে দিয়ে যাওয়াও তার দায়িত্ব। রাস্তা সে-ই জানে, কিন্তু কার্যক্ষেত্র প্রমাণ হল, না তা নয়, জানে তার উট।
অবশেষে একদিন এসে পৌঁছল তারা চারজন। উটের মা ও মেয়ে দুজন, আর বাপ ছেলে উটওয়ালারা দুজন।
শেখ গুলমহম্মদ অর্থাৎ বাপ-মহাশয় বকতে বকতে উপস্থিত হলেন। তাঁর ভয়ানক ক্ষুধা এবং ক্ষুধার তাড়নাতেই এত বয়সে তাঁকে ঘর ছেড়ে এই শক্ত কাজ করতে হচ্ছে। সবই নসীব! তবে হ, ধর্মপিপাসু ‘নানী কি হজ’ যাত্রিগণের তিনি নোকর, সুতরাং পরপারে তাঁর বেহেস্ত বাস ঠেকায় কে।
আমাদের সকলকে নত হয়ে বার বার সেলাম করে উটদের তিনি বলতে লাগলেন যে, তাদেরও জন্ম সার্থক, কারণ এ হেন পুণ্যাত্মা যাত্রিগণ ইতিপূর্বে আর কখনো আসেনি এবং এটা একেবারে সুনিশ্চিত যে, এবারের যাত্রায় খয়রাৎ যা জুটবে তাতে নিশ্চিন্তে এক বছর ঘরে বসে আরাম করা যাবে। আরও কত কি তিনি বলে যেতে লাগলেন কে তার হিসাব রাখে।
রৌদ্রদগ্ধ সাড়ে ছয়ফুট লম্বা গুলমহম্মদ এককালে রূপবান ছিলেন। পুত্র দিলমহম্মদও লম্বায় সাড়ে ছ’ফুট, স্বাস্থ্যও বেশ সুন্দর। রূপ, রং ও মুখ টিপে হাসি সমস্ত মিলিয়ে যেন রূপকথার রাজপুত্র। একমাত্র বিপদ হচ্ছে ওদের পরিধেয়গুলির দুর্গন্ধ। কলকাতায় কাবুলিওয়ালা দেখা যায় অনেক। সুতরাং এদের আকৃতি সম্বন্ধে সকলেরই মোটামুটি একটা ধারণা থাকতে পারে। কিন্তু সাজ-পোশাকের কদর্য নোংরা অবস্থাটা কল্পনা করাটা অসাধ্য। আর তাদের প্রকৃতির মাধুর্যের তুলনা দিতেও আমি সম্পূর্ণ অক্ষম।
বত্রিশ দিন এদের হাতে জীবন-মরণ, মান-ইজ্জত সব কিছু সমর্পণ করে জনমানবহীন আকাশ তলে ঘুরেছি আর প্রতি পদে পদে মর্মে মর্মে এই সত্যটুকু অনুভব করেছি যে, দরিদ্রতা আর নীচতা এক বস্তু নয়। সেবা করার প্রবৃত্তি উপদেশ শুনে বা বই পড়ে কারও মধ্যে গজায় না। সততা ব্যাপারটা পেনাল কোডও পুলিশের চোখ রাঙানিতে বেঁচে আছে এও সত্য নয়। ভাল-মন্দ, ন্যায় অন্যায়-এই সমস্ত প্রশ্নের বাইরে আলাদা আর একটা জগৎ আছে যেখানে নিদারুণ অভাবেও প্রকৃতির নিরাভরণ নিঃস্ব সন্তানেরা দরদওয়ালা বুকের ছাতি নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সেই বুকগুলির মধ্যে একমাত্র প্রেম ও ভালোবাসারই রাজত্ব। সেই রাজত্বের রাজা ও রাজপুত্র নির্বিকারচিত্তে আমাদের সকল দায়িত্ব তুলে নিলে।
আমাদের যাত্রা হল শুরু। উটের মায়ের পিঠে উঠল জনা-প্রতি বত্রিশ সের হিসাবে আটা লবণ মরিচ গুড়। মেয়ের পিঠে উঠলেন সভোজ্য ও সবস্ত্র ভৈরবী। দল বেঁধে বস্তির মেয়েরা ভৈরবীকে বিদায় দিতে ঘিরে দাঁড়াল। মেটে সিঁদুরে তাঁর কপাল লালে লাল, লাল সুতোর গুচ্ছ কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত সকলে বেঁধে দিল। সকলের চক্ষু সজল।
সূর্য তখন অস্তগামী। অস্তগামী সূর্যকে সামনে রেখে আমরা এগিয়ে চললাম। ফিরে আসার পর-গুলমহম্মদ ও দিলমহম্মদকে পুরো দু-থান পাগড়ির কাপড়ের অঙ্গীকার করলেন শেঠজি। ভৈরবীর পিঠে কমসে কম দশ সের ওজনের পাঞ্জাখানা রেখে গুলমহম্মদ তার জীবনভর না-মাজা সত্তর বছরের পুরনো হলুদ রঙে-এর বত্রিশখানা মজবুত দাঁত বার করে শপথ করলে-জান কবুল করে তার মায়ের মান-ইজ্জত সে রাখবেই। উপযুক্ত পুত্র তার সহায়, আর খোদা উপরে আছেন।
প্রথমে মিনিট-কুড়ি করাচীর পিচঢালা রাস্তা, তারপর খানকতক চষাজমি। সর্বসমেত দেড়ঘন্টা চলার পর আমরা হাব নদীর ধারে রাত্রের জন্য থামলুম। বাঁয়ে করাচী এরোড্রামের লাল আলোগুলি মাথা উঁচু করে পাহারা দিচ্ছে। আমরা নদীর কিনারায় পুলের দক্ষিণে খোলা মাঠে আসন পাতলুম, এইখানে অতি প্রত্যূষে আমাদের যাত্রার সংকল্প গ্রহণ করতে হবে। তারপর নদী পার হয়ে আমাদের সত্যকার যাত্রা শুরু হবে।
আমাদের ছড়িদার যে কারা তখনও তা আমরা জানতে পারিনি। ছড়ি, অর্থাৎ হিংলাজ থেকে আনা একটা গাছের ডাল, দেখতে অনেকটা ত্রিশূলের মতো। জিনিসটাকে সিঁদুর মাখিয়ে এক অপূর্ব বিস্ময়কর বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে। মুশকিল-আসানদের মতো তাতে বিচিত্র বর্ণের কাপড়ের ফালি ঝোলানো। এটি একটি ভয়ানক পবিত্র বস্তু। যেখানে পৌঁছে প্রতিদিনের যাত্রার বিরতি হবে সেখানে এটিকে বালির উপর পুঁতে সর্বপ্রথম এর ভোগ লাগানো হবে। ভোগ লাগানো মানে হচ্ছে এক ছিলিম গাঁজা সেজে এঁকে সসম্ভ্রমে নিবেদন করে নিজেরা কষে দম একটি ভয়ানক পবিত্র বস্তু। যেখানে পৌঁছে প্রতিদিনের যাত্রার বিরতি হবে সেখানে। এটিকে বালির উপর পুঁতে সর্বপ্রথম এর ভোগ লাগানো হবে। ভোগ লাগানো মানে হচ্ছে এক ছিলিম গাঁজা সেজে এঁকে সসম্ভ্রমে নিবেদন করে-নিজেরা কষে দম লাগানো। এই ছড়ির প্রসাদাৎ-অর্থাৎ একে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য না করলে-আমাদের যাত্রা হবে নির্বিঘ্ন।
শেষ রাত্রে হাব নদীর কিনারায় আমরা দলসুদ্ধ লোক সন্ন্যাসী সাজলাম। প্রত্যেকের জন্য এক একখানা রুমালের মাপে নূতন কাপড় গেরুয়া রঙে ছুপিয়ে নিয়ে এলেন এক প্রৌঢ় পান্ডা। তিনি গুরুগম্ভীর গলায় তার নিজস্ব ভাষায় আমাদের শপথ করালেন। যে, মাতা হিংলাজ দর্শন করে এখানে ফিরে আসা পর্যন্ত আমরা আমাদের সন্ন্যাস-ব্রত পালন করব এবং কেউ কাউকে হিংসা করব না। আমরা সকলে সকলকে সাধ্যমতো সাহায্য করব কিন্তু কোনোক্রমেই নিজ নিজ কুঁজোর জল অপরকে দান করব না। এমন কি স্বামী, স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে, মা ছেলেকে বা ছেলে মাকেও নিজের কুঁজোর জল দিতে পারবে না। তার কারণ, তাতে শেষ পর্যন্ত দুটো জীবনই নষ্ট হতে পারে। প্রত্যেকের মাথায় সেই গেরুয়া বস্ত্রখণ্ড বেঁধে দিয়ে দলের মধ্যে একজনকে মোহন্ত, একজনকে ভাণ্ডারী ইত্যাদির কার্যভার দিয়ে তিনি ব্রাহ্মমুহূর্তে আমাদের নদী পার করে । দিয়ে বিদায় দিলেন। হিংলাজ মাতার জয়ধ্বনির সঙ্গে ছড়ি উঠল। সবিস্ময়ে দেখলাম আমাদের ছড়িদার বা সঙ্গী দুজনের বয়স এক সঙ্গে যোগ দিলে ত্রিশ পার হবে না। অর্থাৎ বড়োটি সতেরো বা আঠারো এবং ছোটটি বারো বা তেরোর সীমানা পার হয়নি। ভরসা কোথায়?
এদের দু-জন সারা দিনরাত্রে ছিলিম তিরিশেক গাঁজা খেতে পারে, অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করতে পারে এবং সদাসর্বদা হিন্দি ফিল্মের গান গাইতে পারে।
আমরা যাত্রীরা হলাম এঁদের যজমান। আমরা এঁদের ভক্তি করব, এঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করব, এঁদের সেবাও করব। নচেৎ তীর্থদর্শনের কষ্টটুকুই লভ্য হবে, পুণ্যটা উবে যাবে।
এঁরা চললেন ছড়ি ঘাড়ে করে প্রথমে; কণ্ঠে হিন্দি ফিল্মের গান। আমরা চললাম পিছনে; কণ্ঠ রুদ্ধ, মাথায় দুশ্চিন্তা।
ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। পাখিরা জাগছে, পিছনে ফেলে আসা এরাড্রোমের লাল আলোকগুলো তখনও বোধহয় আমাদের ফিরে যেতেই ইশারা করছে। পায়ের তলায় কাঁটা ফুটছে, কাঁটাগাছের ঝোঁপগুলির মধ্যে দিয়েই পথ।
পিছনে পূর্ব আকাশে আলো ফুটে উঠল। মনে পড়ল, এতক্ষণ পুরীতে সূর্যোদয় হয়েছে। আলোয় ভেসে যাচ্ছে সমুদ্র-সৈকত। বহুবার দেখা জগন্নাথদেবের মন্দিরের চূড়াটি ভেসে উঠল চোখের সামনে। নূতন সূর্যের আলোয় সর্বপ্রথম চূড়াটিই ঝলমল করে উঠে।
কি বিচিত্র এই সৃষ্টি! এখানে এখনো আঁধার। বই-পড়ে-জানা প্রকৃতির এই বিচিত্র রূপ মূর্তিমান বিস্ময়ের মত চোখের উপর ধরা পড়ল। এই সৃষ্টির যিনি হেতুস্বরূপ, সেই জগন্নাথদেবকে মনে মনে বার বার প্রণাম করে এগিয়ে চললাম।
আমরা চলেছি…