মরার পরেও
‘জানো, স্টেশন থেকে আসতে আসতে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম আজ!’— বলল ইথেল। অনেক দিন পরে ও আজ আমাদের বাড়িতে অতিথি আবার।
‘বলো কী?’— অবাক হয়ে গেলাম আমি, ‘আজ বিশ বছর যে তুমি হাঁটছ এই রাস্তায়! একটা ছাড়া দুটো বাস নেই, নামতে হবে মাউন্ট স্ট্রিটে, ব্যাস!’
‘ওই, ওই! নামতে হবে মাউন্ট স্ট্রিটে তো!’— ওর হারিয়ে যাওয়ার কৈফিয়তটা হাস্যকর শোনায়, ‘আমি নেমে পড়লাম আগের মোড়ে। পার্ক একটা করে ও-মোড়েও আছে, এ-মোড়েও আছে। দুটোরই চেহারা প্রায় একরকম। আমি গুলিয়ে ফেললাম।’
‘তারপর? মাউন্ট স্ট্রিট পর্যন্ত হেঁটে আসতে হল তো?’
‘মোটেই না। এমনভাবে সবকিছু গুলিয়ে ফেললাম, মাউন্ট স্ট্রিটের দিকে না-হেঁটে হাঁটতে শুরু করলাম উলটো দিকে। ভুল যে একটা হয়েছে, তা হুঁশ হল কয়েক মাইল পায়ে পায়ে দুরমুশ করার পরে। তখন আর কী! ট্যাক্সি ভাড়া করি একটা, মোড়ে মোড়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকি কাঁচুমাচু হয়ে— এইভাবে এখানে এসে পৌঁছুলাম ঘণ্টা দুই বাদে!’
‘অবাক কাণ্ড!’— বললাম আমি, ‘তোমার দিগ্বিদিক জ্ঞান নেই নাকি?’
‘স্রেফ না।’ চায়ের পেয়ালায় চামচ ঠুংঠুং করতে করতে খুবই চিন্তিতভাবেই ইথেল বলল, ‘আর ওই জ্ঞানটা নেই বলেই এবার শীতকালে কল্ডওয়েলদের বাড়িতে অমন একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার।’
‘কী? কী অভিজ্ঞতা? আর কল্ডওয়েলরাই বা কারা?’ চেপে ধরলাম আমরা।
‘কল্ডওয়েল— ওরা নিউ ইয়র্কে থাকে। আরে, কেরি স্পেনসারকে চিনতে তো? সে এক পয়সাওয়ালা উকিলকে বিয়ে করে কল্ডওয়েল হয়ে গিয়েছে এখন। আমার সঙ্গে বেশ একটু ঘনিষ্ঠতা রেখেছে এখনও, মাঝে মাঝে দুই-একদিনের জন্য যেতে হয় ওর কাছে। ফ্ল্যাটে থাকে, ছোটো ছোটো ঘর, কিন্তু সাজানো-গোছানো এমন চমৎকার, জায়গার অভাব যেন চোখেই পড়ে না।
‘এবারে গিয়েছি ডিসেম্বরের গোড়ায়, মোটে একটি দিনের জন্য। ওরা ডিনারের পরেই শুয়ে পড়ে। কারণ উঠতে হয় ওদের খুব ভোরে, আটটার ভিতরে পার্কে হাজিরা দিতে হয় স্বামী-স্ত্রীকে অশ্বারোহণের তালিম নেবার জন্য। আমার সে-তাগিদ নেই, আর তত ভোরে ওঠার অভ্যেসও আমি করিনি কোনোদিন। সুতরাং, যেমন বরাবর করি, তেমনই কালও সাড়ে আটটায় শয্যাত্যাগের মতলব নিয়ে চলে গেলাম নিজের ঘরে। কেরি আমার হাতে বই দিয়ে দিল একগাদা, ”তোর হয়তো ঘুম আসবে না এত সকালে, পড়তে পারিস শুয়ে শুয়ে!”
‘ঘরখানা যা পেয়েছি, অন্য বাড়ির ভাড়ার ঘরের চাইতেও ছোটো। কিন্তু খাটখানা কী মস্ত! আমার মতো চারজন অনায়াসে পড়ে থাকতে পারে, গায়ে-গায়ে ঠোকাঠুকি না-করে। অত্যল্প আসবাব, কিন্তু সবই নতুন, সবই দামি। শোবার পক্ষে ঘরখানা ভালোই, যদিও বাস করবার পক্ষে তা নয়।
‘যাহোক, আমি তো এক রাতের পাখি। অতশত বিচারের দরকারের কী আমার! নভেলের পাতায় ডুবে রইলাম রাত এগারোটা পর্যন্ত। তারপর আলো নিবিয়ে দিয়ে তৈরি হলাম নিদ্রা দেবার জন্য।
‘তখনই হল মুশকিল। দিক ভুল হতে লাগল আমার। এ-ঘরের দরজাটা কোন দিকে? একবার মনে হয় ডান দিকে, আর একবার বাঁ-দিকে। জানালা কী একটা দেখলাম, না দুটো? জামাকাপড়গুলো ওয়ার্ডরোবে তুললাম, না খাটের ছত্রিতেই ঝুলিয়ে রাখলাম?
‘কোনো প্রশ্নটাই এমন কিছু জরুরি নয় যে, তখন-তখনই তার মীমাংসা করতে হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠলেই তো চোখে পড়ে যাবে সব। ব্যস্ত হওয়ার কী আছে?
‘না, ব্যস্ত হওয়ার নেই কিছু, নিশ্চয়ই নেই। কিন্তু মনে স্বস্তি নেই যে! প্রশ্নগুলোর সমাধান যতক্ষণ না-হচ্ছে, ততক্ষণ ঘুমই আসবে না বোধ হয়। কিন্তু বরাতের ফের, আমার কেমন জেদ চেপে গেল, মনকে অত প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক হবে না। দরজা কোন দিকে, জানলা ক-টা, কাপড়জামা কী-অবস্থায় আছে, এই দুপুর-রাতে তার ফয়সালা না-করলেই চলবে না নাকি? চোখ রাঙিয়ে উঠলাম মনকে, ‘ঠান্ডা হয়ে শুয়ে থাকো বাপধন, কাল সকালে সব জানতে পারবে—
‘ছোটো ছেলের হাত থেকে খেলনা কেড়ে নাও, সে খুঁতখুঁত করতেই থাকবে ক্রমাগত, হয়তো মাটি খুঁড়তে শুরু করবে, নয়তো নিজের জামাটাই টেনে টেনে ছিঁড়বে। অনাছিষ্টি করবে হরেকরকম। আমার মনও অনাছিষ্টিতে মেতে গেল।
‘ছুটে গেল আমার শৈশবের দিনে। মস্ত বড়ো পুরোনো একখানা বাড়িতে আমরা থাকি। অনেক ঘর তার ভেঙেচুরে আর্বজনায় ভরতি হয়ে আছে, কেউ ঢোকে না সেসব ভাঙা ঘরে প্রাণান্তেও, তবে—
‘তবে সেসব ঘর থেকে রাত্রে নাকি বেরোয় কারা। পায়ে পায়ে চলে আসে হল পর্যন্ত। জানালা খুলে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষে। বেশি রাতের পথচর বা পাহারাওয়ালারা কেউ কেউ নাকি দেখেছে এ-বাড়ির জানালায় সাদা সাদা মুখ, ঘোলাটে ঘোলাটে চোখ, তাতে কান্না-ভরা চাউনি।
‘যাহোক, সেসব ঘরে যাই না আমরা। নীচে ওরকম ঘর যে কত কত আছে, তার হিসাবও নেই আমাদের কাছে। উপরের দু-খানার কথা জানি অবশ্য, না-জেনে উপায় নেই, কারণ বারান্দায় এর মাথায় আমাদের মানে বাচ্চাদের ঘর, অন্য মাথায় তালা-লাগানো দরজা একটা, ইয়া-বড়ো সেকেলে তালা। সেই তালা খুললেই নাকি দু-খানা ঘর, একখানার ভিতর দিয়ে অন্যখানায় যেতে হয়। এককালে নাকি একইলোক ব্যবহার করতেন দুইখানা ঘরই, একখানা ছিল তাঁর শোবার ঘর, অন্যখানা পড়ার ঘর।
‘কে তিনি? ঠাকুরদা পর্যায়েরই কেউ, যদিও সাক্ষাৎ ঠাকুরদা নয়। ছবি ছিল তাঁর, এখনও আছে বোধ হয়, নীচের হলঘরে। বড়ো ফ্রেমে বাঁধানো পুরো সাইজের ছবি। বছরে একদিন মাত্র পরিষ্কার করা হত বাড়ির ছবিগুলি, বড়োদিনের আগে কোনো একদিন। অথচ বড়োদিনের সময় এমন ফুরসত আমাদের হত না যে, পুরোনো ছবিগুলো নতুন করে দেখে বেড়াব। তখন মেতে থাকতাম বড়োদিন নিয়েই ক্রিসমাস তরু সাজানো, বাবার কাছ থেকে কার্ড চেয়ে নিয়ে বন্ধুবান্ধবকে পাঠানো, ডাকযোগে দূরদূরান্তে যাবে যে-সব উপহারের প্যাকেট, তাতে গালা-মোহর লাগানো— এইসব আর কী!
‘সেসব চুকেবুকে গেলে তখন হয়তো কোনোদিন মনে হত ঠাকুরদা-পর্যায়ের সেই ভদ্রলোকের ছবিখানার দিকে চোখ তুলে চাইবার কথা। এত ধুলো ওই ভাঙা বাড়িতে যে, এই কয় দিনেই সে-ছবি আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে গিয়েছে, কাচের উপরে পুরু একটা আস্তরণ পড়ে গিয়েছে ময়লার। তা সত্ত্বেও যেটুকু বোঝা যেত সে ছবির, তাতে মনে এমনই ধারণাই যেন জন্মাত যে, লোকটি ছিলেন আশ্চর্যরকম সুন্দর। এরই জন্য ওঁর সম্বন্ধে সেই বয়সেই আমার মনে অনুরাগ ছিল খানিকটা। সুন্দরকে কে না ভালোবাসে? তাঁর নাম বাবার কাছে হয়তো শুনে থাকব কোনোদিন, কিন্তু তা আর মনে নেই। তাঁর কথা মনে যদি হয় কখনো, সুন্দর-ঠাকুরদা বলেই চিন্তা করি তাঁর কথা।
‘অবাক কাণ্ড দেখ! কল্ডওয়েলদের ফ্ল্যাটে আট ফুট লম্বা ঘরে সাত ফুট লম্বা সেই অত্যাধুনিক পালঙ্কে শুয়ে সে রাত্রে সেই সুন্দর ঠাকুরদার কথাই মনে পড়ে গেল আমার। ধুলোয় মলিন জমকালো চেহারাটা যেন সেই অন্ধকার ঘরের ভিতরও স্পষ্ট ফুটে উঠল আমার চোখের সামনে। বিশেষ করে ফুটে উঠল দু-টি উজ্জ্বল চক্ষু। শুধু যে সুন্দর, তা নয়, সে চোখের গভীরে যেন কোনো অসীম রহস্য লুকিয়ে রয়েছে যুগ যুগ ধরে। সে রহস্য যেন সুন্দর ঠাকুরদা আমারই সমুখে উদঘাটিত করে দিতে চান আজ।
‘তাঁর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ক্রমশ একটু একটু করে যেন স্থান-কাল-পাত্র ভুল হয়ে আসছে আমার। মনে হচ্ছে, এই যে বিছানাটাতে আমি শুয়ে আছি স্তব্ধ নিশীথে, এটা নিউইয়র্কের ফ্ল্যাটের সাত ফুট লম্বা পালঙ্কের শৌখিন শয্যা নয়, এ আমার সেই শৈশব দিনের পাঁচ ফুট খাটিয়ার সাদামাটা বিছানা, ক্ষুদ্র শহর চিজউইকে আমার জীর্ণ ভগ্ন পৈত্রিক গৃহের দোতলায় একই কক্ষের তিনটি বিছানার একটি।
‘বাচ্চাদের ঘরে তিনটি বিছানার একটি আমার, আর দু-টিতে থাকে বারো বছরের বোন মার্জরি আর ছয় বছরের ভাই রবিন। আমার পায়ের দিকে একটা দরজা, সেটা খুললেই সামনে পড়বে টানা বারান্দা, যার ও-মাথায় তালাবন্ধ জোড়াঘর সুন্দর ঠাকুরদার। সে ঘর যাতে চোখে পড়তে না-পারে কোনোমতে, সেই উদ্দেশ্যেই আমার পায়ের কাছের দরজাটা চব্বিশ ঘণ্টা বন্ধ থাকে। ডবল আগল তো বটেই, উপরে-নীচে ছিটকিনিও শক্ত করে আঁটা! কত বছর যে সে দরজা খোলা হয়নি, তো কে জানে! ছিটকিনি এমনভাবে এঁটে রয়েছে যে, চেষ্টা করলেও এখন তা খোলা যাবে কি না সন্দেহ।
‘খোলা যাবে না, তাই ধারণা ছিল আমার। কিন্তু আজ এ কী দেখছি? সুন্দর ঠাকুরদাকে আমি দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট। কিন্তু আমার শোবার ঘরের ভিতর তো নয়! দেখতে পাচ্ছি ঘরের বাইরে, বারান্দায়, আমার ঘরের খোলা দরজার ভিতর দিয়ে। হ্যাঁ, যে দরজা কোনোদিন খোলা হয় না, আজ রাত্রে তা হাট করে খোলা একেবারে। সেই খোলা দরজা দিয়েই আমি সুন্দর ঠাকুরদাকে দেখতে পাচ্ছি— আমার দিকে মুখ করেই দাঁড়িয়ে আছেন হাসিমুখে।
‘হ্যাঁ, মুখে তাঁর মিটিমিটি হাসিই দেখছি আমি। কোথা থেকে যে একটা আলো এসে পড়েছে তাঁর মুখে, তা বুঝতে পারছি না। চাঁদ যদি-বা উঠে থাকে আকাশে, তার জ্যোৎস্না এ বারান্দায় এসে পড়ার কোনো উপায় নেই, কারণ বারান্দাটার ডাইনে-বাঁয়ে দু-দিকেই দেয়াল। যাকে বলে ঢাকা-বারান্দা আর কী!
‘তবু আলো একটা দেখতে পাচ্ছি তাঁর মুখে, আর মজা এই যে, আলো নিয়ে আমি মোটেই মাথা ঘামাচ্ছি না। অন্ধকার বারান্দায় সুন্দর ঠাকুরদার মুখখানি কোন আলোকে উজ্জ্বল হয়ে আছে, সে রহস্য ভেদ করবার কথা মনেই উদয় হচ্ছে না আমার। আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি তাঁর হাসি হাসি মুখখানির দিকে।
‘মুখ নড়ছে ওঁর। কিছু বলছেন কী? আমি কান পেতে শুনবার চেষ্টা করলাম।
‘যাচ্ছেও তো শোনা! মধুর গম্ভীর কণ্ঠ থেকে মৃদু আহ্বান যেন শুনছি আমি, ”ইথেল! এসো না, উঠে এসো আমার কাছে। অনেক দিন থেকেই ভাবছি, তোমাকে দু-একটা জিনিস দেখিয়ে রাখব। সুযোগ আর হয় না। ইচ্ছে হয় তো আসতে পারো আজ। দেখে রাখলে তোমার হয়তো উপকার হতে পারে পরে।”
‘আমি যেন বিছানায় উঁচু হয়ে উঠলাম কনুইয়ে ভর দিয়ে। ওঁকে যেন বললাম, ”কিন্তু আমাকে কেন? বাবাকে না-দেখিয়ে আমাকে কেন?”
‘উনি যেন আবারও হাসলেন। তবে এবারকার হাসি মধুর নয়, করুণ। বললেন, ”তোমার বাবাকে দেখানো চলে না এই কারণে যে, সবাই সব জিনিস দেখবার অধিকারী নয়। আরও একটা কারণ আছে, সেটা হল এই যে, এ বাড়িতে ছেলে বুড়ো মিলিয়ে এই যে বত্রিশটা মানুষ রয়েছে, এদের মধ্যে শুধু এক তোমাকেই আমি আপন বলে জানি—”
‘আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম! একমাত্র আমাকেই জানেন আপন বলে? কেন? প্রশ্নটা কথায় প্রকাশ করতে হল না, মনের কথা মনে থাকতেই উনি যেন তা পড়ে ফেললেন। জবাবও দিলেন সঙ্গেসঙ্গে, ”ত্রিসংসারে আপনও কেউ নেই, পরও কেউ নেই। যে যাকে ভালোবাসে, সেই তার আপন। আমি জানি, এই বহুকালের বিস্মৃত ঠাকুরদার জন্য একমাত্র তোমারই অন্তরের কোণে একটু ভালোবাসা এখনও আছে। সে জানা যদি আমার ভুল হয়, তবে তোমার আসবার দরকার নেই।”
‘আমি যেন আর কথা বাড়ালাম না। উঠে বসলাম বিছানার উপরে। তিন ফুট দূরেই রবিনের বিছানা, ওর মৃদু মৃদু নিশ্বাসের শব্দ পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি আমি। রবিনেরও ওপাশে শুয়েছে মার্জরি। সে স্বপ্ন দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল একবার। আমি ভাবলাম, আমার এই বুনো হাঁসের পিছনে ছুটোছুটি দেখেই বুঝি হাসছে পোড়ারমুখি। হাসুক আর যাই করুক, সুন্দর ঠাকুরদার আহ্বানে সাড়া না-দিয়ে আমি পারব না। বাড়ির বত্রিশটা লোকের মধ্যে আমাকেই যে উনি আপন বলে ঠাউরেছেন, তাঁর এ স্নেহের মর্যাদা দিতে হবে তো!
‘আমি যেন বিছানা থেকে নেমে গেলাম। খোলা দরজা দিয়ে বারান্দায় পৌঁছোলাম। হেঁটে যাচ্ছি সুন্দর ঠাকুরদার দিকে। ওইতো উনি সামনেই দাঁড়িয়ে। কত আর হবে? ছয় ফুটের বেশি নয় দূরত্বটা। তবু নাগাল পাচ্ছি না কিছুতেই। আমি এগিয়ে যাচ্ছি, উনি পিছিয়ে যাচ্ছেন। পা ফেলে ফেলে নয়, মেজের উপর দিয়ে পিছলে যাচ্ছেন যেন, কিংবা হাওয়ার ভিতর দিয়ে উড়ে।
‘নাগাল পাচ্ছি না যে, সেটা কিন্তু অস্বাভাবিক লাগছে না আমার। ওঁকে জিজ্ঞাসাও করছি না যে, ওভাবে উনি পিছিয়ে যাচ্ছেন কেন, বা যাচ্ছেন কোথায়। একটু বাদেই দেখি, ওঁরও ঘরের দরজা খোলা। যা আজন্ম তালাবন্ধ দেখেছি, আজ তার তালা খুলে গিয়েছে।
‘উনি সেই পিছু সরতে সরতেই ঘরে গিয়ে ঢুকলেন, আমিও ঢুকলাম সঙ্গে সঙ্গেই। এ ঘরটার মেজে থেকে ছাদ পর্যন্ত বইয়ে বইয়ে ঠাসা। মোটা মোটা বই, আগাগোড়া ধুলোয় আচ্ছন্ন, মাকড়সার জালে ঢাকা। সেই ঘরের মাঝখানে পাশাপাশি লম্বা টেবিল দু-খানা, কতরকম যে যন্ত্রপাতি তার উপরে। এ সবের উপরেও ধুলো জমে রয়েছে পুরু হয়ে। ধুলো আর ধুলো দেখে দেখে আমি বিরক্ত হয়ে উঠেছি ততক্ষণে, তীক্ষ্ন স্বরে বলে উঠলাম, ”এত নোংরার মধ্যে থাকেন কেমন করে আপনি? বাড়ির বত্রিশটা লোকের মধ্যে বারোটাই তো ঝি-চাকর। বললেই তো ধুলোগুলো ঝেড়ে দিতে পারে!”
‘শব্দ নেই, তবু তিনি যে হা হা করে হেসে উঠেছেন, তাতে সন্দেহই কিছু নেই আমার। হাসতে হাসতেই বললেন, ”পাগলি! তুই জানিস না আমি মরে গেছি? আজ ষাট বছর হল কাউকে ডেকে কোনো কথা বলার ক্ষমতা আমার নেই?”
‘মরে উনি গিয়েছেন, তা জানি বই কী! বিলক্ষণ জানি! কিন্তু সেটা মনে ছিল না। আর তা যে ছিল না, তাতে আশ্চর্য হওয়ারও কোনো কারণ দেখছি না। আমি তর্কটা চালিয়ে যাওয়ার দিকেই মন দিয়েছি। বললাম, ”কাউকে যদি কিছু বলবার ক্ষমতা না-থাকে, তাহলে আমায় কেমন করে বলছেন এত কথা!”
‘আমায় অবাক করে দিয়ে উনি জবাব দিলেন, ”আমি তোমায় কিছুই বলছি না, আমার মনে— হ্যাঁ, মরে যাওয়ার পরেও মনটা বেঁচে আছে বই কী, আমার মনে যে কথাগুলির উদয় হচ্ছে, তা শব্দময় হয়ে উঠতে পারছে শুধু তোমরই দরদের পরশ পেয়ে। তুমি শুনতে চাইছ বলেই শুনতে পাচ্ছ। এ বাড়ির বাকি একত্রিশটি লোকই চাইত না শুনতে, তাই পেতও না শুনতে।”
‘সবই যেন হেঁয়ালির মতো লাগছিল আমার, তাই এ আলোচনা ছেড়ে দিয়ে কাজের কথায় এলাম, ”কী দেখাবেন কথা ছিল যে! দেখান তাড়াতাড়ি, আমি রাত্রিবাসের উপরে একটা চাদর মাত্র জড়িয়ে এসেছি, দেখছেন না? শীত করছে।”
” ‘শীত করলে তো হবে না”— বললেন ঠাকুরদা, ”আমার কাজ তাড়াতাড়ি মিটবার নয়। ওই নাও তোমার পোশাক, পরে ফেল। আমি ততক্ষণ পাশের ঘর থেকে একটা জিনিস নিয়ে আসি।”
‘অবাক হয়ে দেখি, আমার পরিচ্ছদগুলো, যা শোবার সময় নিজেদের ঘরে ওয়ার্ডরোবে টাঙিয়ে রেখেছিলাম, সব উড়তে উড়তে এ ঘরে এসে আমার গায়ে মাথায় ঝুপ ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ছে। অবাক তো ক্রমাগতই হচ্ছি, তার জন্য এ অ্যাডভেঞ্চার থেকে পিছিয়ে যাওয়া তো আর চলে না! আমি চটপট পোশাকগুলো গায়ে চড়িয়ে নিলাম কোনোরকমে।
‘আর তারপরই সুন্দর ঠাকুরদা এ ঘরে এসে পড়লেন পাশের ঘর থেকে। এবার তিনি একা নন আবার। তাঁর পিছনে পিছনে, প্রায় ছুটতে ছুটতে আসছেন এক বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা।
‘ভদ্রমহিলা? হ্যাঁ, দূর থেকে বেশভূষা দেখে তাই মনে হয়েছিল বৃদ্ধাকে, কিন্তু কাছে আসতেই আমার সে ধারণা ছুটে গেল মন থেকে। ওঁর মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে দেখেই আমার চক্ষুস্থির! ও মুখ কোনো ভদ্রমানুষের হতে পারে না। ওরকম হিংস্র দৃষ্টি কোনো মহিলার চোখ থেকে বেরুতে পারে, এ আমি কখনো স্বীকার করব না।
‘যাহোক, মহিলা না-হলেও মহিলাই তাঁকে বলতে হবে, তা ছাড়া আর বলবই বা কী! তিনি সুন্দর ঠাকুরদাকে বকে চলেছেন ঝড়ের বেগে, ”তুই আমায় কোনোদিন দেখালি না সেসব, আমি তোর ধাই-মা, আমার বুকের দুধ খেয়ে তুই মানুষ, আমার কাছে ডাইনি-বিদ্যা শিখে তুই দেবতার দলে উঠে গিয়েছিলি, সেই আমাকে যেখানে নিয়ে গেলি না কোনোদিন, সেইখানে আজ নিয়ে যাচ্ছিস এই শত্তুরের মেয়েকে? তুই নেমকহারাম, তুই পাষণ্ড, তুই-তুই তুই—”
‘হাত নেড়ে তাকে নিরস্ত করবার চেষ্টা করতে করতে সুন্দর ঠাকুরদা বললেন, ”ধাই মা! তোমার আগাগোড়া ভুল। তুমি আমাকে ডাইনি-বিদ্যা শিখিয়েছিলে, তা মানি। ওইটি ধরে থাকলে আমি দেবতার দলে উঠতাম না কোনোদিন, নেমে যেতাম পিশাচের দলে, যেমন নেমে গিয়েছ তুমি। দেবতার দলে যদি উঠে থাকি, তা হলে তা উঠেছি, এই এদেরই আশীর্বাদে।”
‘হাত নেড়ে দেয়ালের গায়ে আলমারিতে আলমারিতে ঠাসা বইগুলি দেখিয়ে দিলেন ঠাকুরদা। তারপর বলতে থাকলেন, ”আর ইথেলকে যে শত্তুরের মেয়ে বলছ, সেও তোমার ভুল। শত্তুর ওরা কীসে? এক সময় উত্তরাধিকার নিয়ে ওর ঠাকুরদার বাবার সঙ্গে আমার বাবার ঝগড়া হয়েছিল বলে? সেসব তো কবে চুকেবুকে গিয়েছে। মরে গেলেও পিছনে ফেলে আসা সম্পদের উপরে যাদের মোহ থাকে, তাদের দলে আমি নই। নিজেই তো তুমি বলছিলে যে, আমি দেবতার দলে উঠে গিয়েছি।’
” ‘আর তোমার সবচে’েয় বড়ো নালিশ, ইথেলকে আমি সেই দেশে নিয়ে যাচ্ছি, যেখানে তোমায় আমি কোনোদিন নিয়ে যাইনি। কী করে নিয়ে যাব? সে দেশে যেতে হলে যেটুকু পবিত্রতা থাকা দরকার মনে ও প্রাণে, ধ্যানে ও ধারণায় তা তোমার কোনোদিন ছিল না। সে দেশের আলো তোমাকে ঝলসে দেবে এক নিমেষে। তোমার জন্য আমার কষ্ট হয়। কিন্তু সত্য কথা জেনে রাখাই তোমার ভালো, তোমার জায়গা উপরে নয়, নীচে—”
‘এই বলেই আমার দিকে তাকিয়ে ঠাকুরদা বললেন, ”নীচের যে ভাঙা ঘরগুলোতে কেউ ঢোকেনি, সেখানেই ছিল ওর মহল। মরার পরেও সেখানে আছে ও। একদিন ওর দোর্দণ্ডপ্রতাপ ছিল এ বাড়িতে। একটু আগে, আমিও যেই ও ঘরে গিয়েছি, ও বুড়িও সেখানে উঠেছে ছাদ ফুঁড়ে—”
‘আর কিছু শুনবার সময় আমার হল না। ডাইনির একখানা হাত অস্বাভাবিক লম্বা হয়ে সাঁ করে ছুটে এল আমার দিকে, আর আমাকে জাপটে ধরে ডাইনি বুড়ি লাফিয়ে উঠল ছাদের দিকে। সঙ্গেসঙ্গে ছাদ ফাঁক হয়ে পথ করে দিল তাকে। আমাকে নিয়ে বুড়ি তিরবেগে উড়ে চলল আকাশপথে। ”ঠাকুরদা, ঠাকুরদা—” আমি তখন চক্ষু বুজে পরিত্রাহি ডাকছি ঠাকুরদাকে!
‘সঙ্গেসঙ্গে কানে আসছে একটা আশ্বাস, ”ভয় নেই ইথেল, কোনো ভয় নেই।” আমাকে যেভাবে ধরেছিল ডাইনি বুড়ি, তাতে মুখখানা আমার পড়েছিল পিছন পানে। কাজেই চোখ মেলে তাকাতেই আমি ঠাকুরদাকে দেখতে পেলাম। একটা বিরাট অগ্নিশিখা বিদ্যুতের বেগে ছুটে আসছে উপর পানে। ছুটে আসছে ধাবমান ডাইনিকে পাকড়াবার জন্য। দেখতে দেখতে সেই আগুন এসে ঘিরে ফেলল ডাইনিকে আর আমাকে। ডাইনি যেন অসহ্য যন্ত্রণায় একটা আর্তনাদ করে উঠল, আর আমাকে ছেড়ে দিয়ে বহু-বহু নীচের মাটির পানে লাফিয়ে পড়ল একটা জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ডের মতো।
‘ওদিকে আমাকে যেন কে আদর করে কোলে জড়িয়ে ধরেছে ততক্ষণ। সেই স্নিগ্ধ উষ্ণ স্পর্শের মাঝে আমি যেন ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়লাম নিশ্চিন্ত অবসাদে। একটি মিষ্টি স্বর চেতনা হারিয়ে ফেলতে ফেলতেও আমি যেন শুনতে পেয়েছিলাম। ”সে দেশ আজ আর তোমায় দেখানো হল না নাতনি। রাত ভোর হয়ে গেল। আর একদিন হবে, ভেবো না।”
‘ভোর বেলায়, হইচই, কল্ডওয়েলরা আমায় আবিষ্কার করল তাদের ব্যালকনিতে। ফ্ল্যাট থেকে ব্যালকনিতে বেরুবার যে দরজা, তা তালাবন্ধ থাকে রাত্রে। চাবিটা অবশ্য পাশেই থাকে দেয়ালে ঝোলানো। কিন্তু কেন আমি বিছানা ছেড়ে ব্যালকনিতে বেরিয়েছিলাম, কেনই-বা অজ্ঞান হয়ে পড়লাম সেইখানে, তা তারাও বুঝতে পারল না, আমিও বললাম না তাদের।
প্রাতরাশের পরেই আমি বিদায় নিলাম তাদের কাছে।
ইথেলের কাহিনি শুনে আমরা শ্রোতারা থ মেরে রইলাম অনেকক্ষণ, তারপর কেউ বললাম, ‘অদ্ভুত গল্প’, কেউ বললাম, ‘দুঃস্বপ্ন’।
ইথেল বিষণ্ণভাবে জবাব দিল, ‘অদ্ভুত তো বটেই, দুঃস্বপ্ন বলে এটাকে অভিহিত করার পক্ষেও যুক্তি আছে। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা। প্রতি বছর বড়োদিনে একবার দেশের বাড়িতে যাই আমি। এবার যাওয়ার সাহস পাব কিনা, সন্দেহ আছে বিলক্ষণ। ওই ডাইনি বুড়ির চেহারাটা এখনও চোখের উপরে ভাসছে আমার।’