3 of 8

মরণ রে

মরণ রে

কবি বলেছিলেন,

মরণ রে

তুঁহু মম শ্যাম সমান।

এই কবিতা বাঙালি কবি মাত্রেই পাঠ করেছেন, কারণ রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতার প্রথম কবিতাই এটা, এই বিখ্যাত কাব্যসংকলন আরম্ভই হয়েছে এই কবিতা দিয়ে, মরণ বন্দনা করে।

মরণ বন্দনা এক জিনিস আর মরণ নিয়ে রসিকতা করা অন্য জিনিস।

তবে মরণ নয় আমরা দুয়েকটি মরণোত্তর রসিকতা করব।

প্রথমেই কলকাতার বড়বাজারের ব্যবসায়ী বনমালী পালের কথা বলি। সম্প্রতি পালমশায় দেহত্যাগ করেছেন। জীবিতকালে নানা উপায়ে সাদা-কালো, খারাপ-ভাল বহু টাকা তিনি উপার্জন করেছেন। কিন্তু তার স্বভাব-চরিত্র ভাল ছিল না। মদ, পরস্ত্রী, বিলাস, ব্যসন, লাম্পট্যে টাকা ব্যয় করেছেন। কোনওদিন গরিব দুঃখী, আত্মীয়স্বজন প্রায় কাউকেই কোনও সাহায্য করেননি।

এখন তাঁর আত্মা স্বর্গের দুয়ারে এসে কড়া নাড়ছে। চিত্রগুপ্ত স্বর্গের দরজার ফাঁক দিয়ে পালমশায়কে একবার দেখে নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি যে স্বর্গে ঢুকতে এসেছেন পৃথিবীতে অবস্থানকালে আপনি কী পুণ্যকাজ করেছেন যার জন্য স্বর্গে প্রবেশ করতে পারেন?’

পালমশায় বললেন, ‘গত বছর মহালয়ার দিন একটা ভিখিরিকে দশ পয়সা দিয়েছিলুম আর আমার ভাগ্নের ক্যানসার হয়েছিল প্রায় বছর দশেক আগে, তখন তার মাকে মানে আমার দিদিকে পনেরোটা টাকা দিয়েছিলুম।

চিত্রগুপ্তের পিছনেই বসেছিলেন স্বয়ং যমরাজা। তিনি চিত্রগুপ্তকে আদেশ দিলেন রেকর্ড দেখতে চিত্রগুপ্ত রেকর্ড দেখে বললেন, ‘হ্যাঁ, যা বলছে তা ঠিকই কিন্তু ওর রেকর্ড অতি খারাপ। জীবনে এমন কোনও অপকর্ম নেই যা ও লোকটা করেনি।’

যমরাজা নিজেও রেকর্ডটা খুব ভাল করে খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর চিত্রগুপ্তকে বললেন, ‘তহবিল থেকে একে পনেরো টাকা দশ পয়সা দিয়ে দাও। আর ওকে নরকে যেতে বলো।’

আঠারো শতকের স্কটল্যান্ডের কবি রবার্ট বার্নস বলেছিলেন, ‘হে মরণ, তুমি গরিব মানুষের প্রিয়তম বন্ধু, সবচেয়ে দয়ালু, সবচেয়ে ভাল।’

কবিরা মৃত্যু নিয়ে দার্শনিকতা করতে পারেন। সে অধিকার তাঁদের আছে। কিন্তু অতঃপর আমরা আরেকটি মরণোত্তর চরম ইয়ারকির গল্পে যাব।

ভবতারণবাবু গত মাসে মারা গিয়েছেন। যেমন সাধারণ বাঙালিরা হয় তিনিও যথেষ্ট পত্নীবৎসল ছিলেন। কঠিন অসুখে ভুগছিলেন ভবতারণবাবু, সেই যাকে ওযুগে টারমিনাল ডিসিস (Terminal Disease) বলে।

ভবতারণবাবুর স্ত্রী শ্ৰীযুক্তেশ্বরী ভবতারিণী দেবী। তাঁর দেব-দ্বিজে খুব ভক্তি। তার চেয়েও বড় কথা তিনি পরলোক, পুনর্জন্ম বেশ বিশ্বাস করেন।

মরণপূর্ব দিনগুলিতে ভবতারণ এবং ভবতারিণীর মধ্যে চুক্তি হয়েছিল মৃত্যুর পরেও ভবতারণ এবং ভবতারিণী পরস্পর যোগাযোগ রক্ষা করবেন, অবশ্য যতুটা সম্ভব ঠিক ততটাই।

ভবতারিণী প্ল্যানচেট আসক্তা ছিলেন। সোজা করে বোঝাতে গেলে প্ল্যানচেট ব্যাপারটা হল একটা অন্ধকার ঘরে একটা টেবিলের চারপাশে কয়েকজন বসে অশরীরী আত্মার আবাহন করা, যারা আবাহন করছে তাদের মধ্যে অন্তত একজন লোক যোগ্য মাধ্যম (Medium), যার মারফত পরলোকগত আত্মা আলাপচারিতায় ফিরে আসবে।

সেই সন্ধ্যার কথা বলছি। যে সন্ধ্যায় ভবতারিণী প্ল্যানচেট টেবিলে বসেছিলেন ভবতারণের আত্মার সঙ্গে কথা বলার জন্যে। যথাকালে ভবতারণের আত্মা প্ল্যানচেটে এল। কিন্তু অতঃপর ভবতারণের আত্মা ভবতারিণীকে কী বলেছিলেন সে বিষয়ে দ্বিমত আছে, দুটো বক্তব্যই কথোপকথন আকারে নিবেদন করছি, অন্যথায় স্পষ্ট করে বোঝানো যাবে না।

(এক)

ভবতারিণী: ওগো তুমি, তুমি কথা বলছ।

ভবতারণ: হ্যাঁ আমি, আমি কথা বলছি। তুমি কি বুঝতে পারছ না।

ভবতারিণী: বুঝতে পারছি কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছি না। ওগো, আবার তোমার সঙ্গে কোনওদিন কথা বলব এ কখনও ভাবিনি।

ভবতারণ: হুঁ।

ভবতারিণী: ওগো তুমি ভাল আছ? আমাকে ছেড়ে ভাল আছ?

ভবতারণ: খুব ভাল আছি। চমৎকার আছি।

ভবতারিণী (একটু দমে গিয়ে): স্বর্গ খুব ভাল জায়গা, তাই না।

ভবতারণ: আমি স্বর্গে নেই, নরকে আছি।

(এ নাটিকার সারমর্ম হল এই যে ভবতারিণীর হাত থেকে উদ্ধার পেয়ে নরকে থাকতেও ভবতারণের ভাল লাগছে, চমৎকার লাগছে।)

(দুই)

ভবতারিণী: ওগো তুমি, তুমি কথা বলছ।

ভবতারণ: হ্যাঁ আমি, আমি কথা বলছি। তুমি বুঝতে পারছ না।

ভবতারিণী: বুঝতে পারছি। কিন্তু বিশ্বাস করতে…

(ভবতারিণীর কথা শেষ না করতে দিয়ে)

ভবতারণ: থামো তো একটু। সামনের ছাগলটা কী সুন্দর। একেবারে হরিণের মতো দেখতে। কী সুন্দর কালো চোখ।

ভবতারিণী: (বিস্মিত হয়ে) ছাগল।

ভবতারণ:হ্যাঁ ছাগল। সামনের মাঠে আবার আরেকটা ছাগল এসেছে। একেবারে সাদা ধবধবে কী চমৎকার শিং, বোধহয় পেশোয়ারি ছাগল হবে।

ভবতারিণী: কী ছাগল, ছাগল করছ। মরে গিয়ে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি।

ভবতারণ: মাথা খারাপ হবে কেন? তুমি কিছু বুঝতে পারছ না। আমি যে পাঁঠা হয়ে জন্মেছি, রামপাঁঠা।

(এই নাটিকার নিশ্চয় কোনও টিকা প্রয়োজন নেই।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *