মরণ-ভোমরা
বড়দিনের ছুটি শেষ হইতে আর দেরি নাই। গত কয় দিন হইতে পছিয়াঁ বাতাস দিয়া দুর্জয় শীত পড়িয়াছে। সন্ধ্যার পর আমরা মাত্র তিনজন ক্লাবের সভ্য চারিদিকের দরজা-জানালা বন্ধ করিয়া দিয়া চিম্নির গন্গনে আগুনের সম্মুখে বসিয়াছিলাম। বাহিরের আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ও প্রবল বায়ু মিলিয়া একটা দুর্যোগ সৃষ্টির চেষ্টা করিতেছিল।
অমূল্য বলিল, “আজ আর কেউ আসছে না, চলো বাড়ি ফেরা যাক। তিনজনে ভূতের মতো বসে থেকে কোনও লাভ নেই—চারজন হলেও না হয় বৃজ্ খেলা যেত।”
বরদা স্তিমিতনেত্রে আগুনের পানে চাহিয়া বসিয়াছিল। কতকটা যেন অন্যমনস্কভাবেই বলিল, “সেবারে এই ডিসেম্বর মাসে কসৌলী গিয়েছিলুম—বাপ! কী শীত! মাথার ঘিলু পর্যন্ত জমে যাবার উপক্রম। পালিয়েই আসতুম—যদি না একটা ভারি আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে সব ওলট্-পালট্ করে দিত। —আচ্ছা, কত বড় গঙ্গাফড়িং তোমরা দেখেছ বলো দেখি?”
অমূল্য বলিল, “হুঁ, আষাঢ়ে গল্প ফাঁদবার মতলব। ওসব চালাকি চলবে না বরদা, আমি উঠলুম।”
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কসৌলী গিয়েছিলে কেন?”
বরদা বলিল, “কুকুরে কামড়েছিল; সেই কথাই তো—”
অমূল্য বলিল, “জানি, সে বিষ এখনও তোমার শরীর থেকে বেরোয়নি। আমি আর এখানে থাকছি না, তোমার গঙ্গাফড়িং নিয়ে তুমি থাকো।”
অমূল্য উঠিয়া পড়িল, শালখানা ভাল করিয়া গায়ে জড়াইয়া ঘোমটার মতো করিয়া মাথায় দিয়া দ্বারের দিকে অগ্রসর হইল।
দ্বার বন্ধ ছিল, ঠেলা দিয়া খুলিয়াই অমূল্য চমকিয়া বলিয়া উঠিল, “কে রে!”
“মশায়, আসতে পারি কি?”
অপরিচিত কণ্ঠস্বরে ফিরিয়া দেখিলাম, ওভারকোট ও মাঙ্কি-ক্যাপে সর্ব অবয়ব আচ্ছন্ন করিয়া একটি লোক দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া আছে। মুখচোখ কিছুই দেখা গেল না, শুধু ব্যালাক্লাভা ও ওভারকোটের কলারের অন্তরালে একজোড়া কালো গোঁফের আভাস পাওয়া গেল মাত্র।
অমূল্য জিজ্ঞাসা করিল, “কি চান?”
লোকটি বলিল, “এইটি কি বাঙালীদের ক্লাব?”
বরদা আহ্বান করিয়া বলিল, “হ্যাঁ, আসুন, ভেতরে এসে বসুন। অমূল্য, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে এসো হে, ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে।”
লোকটি ঘরে আসিয়া প্রথমে ম্যাঙ্কি-ক্যাপ ও পরে ওভারকোট খুলিয়া চেয়ারের পিঠের উপর রাখিল, তখন প্রকাণ্ড খোলের ভিতর হইতে অতি ক্ষুদ্র শামুকের মতো তাহার চেহারাখানা প্রকাশ হইয়া পড়িল। মানুষ যে এত শীর্ণ হইয়াও বাঁচিয়া থাকিতে পারে, তাহা এই লোকটিকে না দেখিয়া ধারণা করা কঠিন। বয়স বোধ করি পঁয়ত্রিশ ছত্রিশের বেশি নয়, কিন্তু কোনও দুরারোগ্য ব্যাধি বা মানসিক দুশ্চিন্তা তাহার নিরতিশয় ক্ষীণ শরীরটির প্রত্যেক অবয়বে যেন জরার ছাপ মারিয়া দিয়াছে। মাংসহীন মুখের উপর ঘনকৃষ্ণ একজোড়া গোঁফ মুখখানাকে আরও শুষ্ক শ্রীহীন করিয়া তুলিয়াছে। কপালে গভীর কালো রেখা—মুখের রং ফ্যাকাসে পীতবর্ণ। মাথার দুই পাশে বড় বড় একজোড়া কান যেন পাখা মেলিয়া উড়িবার উপক্রম করিতেছে। তাহার মুখের সমস্ত প্রত্যঙ্গই মৃত বলিয়া মনে হয়—কেবল কালিমাবেষ্টিত বড় বড় দুইটা চক্ষু যেন দেহের শেষ প্রাণশক্তিটুকু হরণ করিয়া জ্বলজ্বল করিয়া জ্বলিতেছে।
অজীর্ণ, ম্যালেরিয়া প্রভৃতি ব্যাধির তাড়নায় যাঁহারা শীতকালে সুজলা বাংলাদেশের মায়া কাটাইয়া পশ্চিমে বেড়াইতে আসেন, তাঁহাদের মধ্যে এই ধরনের চেহারা দুই-একটা যে দেখি নাই এমন নয়। বুঝিলাম, ইনিও একজন স্বাস্থ্যান্বেষী বায়ুভুক্ জীব। মনে মনে ভাবিলাম, কেবলমাত্র মুঙ্গেরের জলহাওয়া এই কংকালে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা করিতে পারিবে কি? ঘোর সন্দেহ হইল।
অমুল্য জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি কি ক্লাবের কোনও সভ্যকে খুঁজছেন?”
লোকটি একবার আমাদের তিনজনের মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল, তাহার গোঁফজোড়া নড়িয়া উঠিল। তারপর অদ্ভুত রকমের একটা হাসি হাসিয়া বলিল, “তা হতেও পারে, এখনও ঠিক বলতে পারছি না।”
আমরা অবাক্ হইয়া রহিলাম। লোকটি পুনশ্চ বলিল, “আমি এ শহরে নবাগত। আজ তিন দিন হল এসেছি—ডাকবাংলোয় আছি; কিন্তু এ ক’দিন বাঙালীর সঙ্গে কথা না কয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি, মশায়। আজ সন্ধ্যেবেলা বেয়ারার কাছে খবর পেলুম, এখানে বাঙালীদের একটা ক্লাব আছে, তাই খোঁজ করতে করতে এসে হাজির হয়েছি। আর থাকতে পারলুম না।”
আমি বলিলাম, “বেশ করেছেন। যতদিন থাকেন নিয়মিত আসবেন, আমরা খুব খুশি হব। তা—স্বাস্থ্য উপলক্ষে এখানে আসা হয়েছে বুঝি?”
লোকটি বলিল, “না, স্বাস্থ্য তো আমার বেশ ভালই।”—কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হঠাৎ তাহার উজ্জ্বল চক্ষু দুইটা তুলিয়া বলিল, “সে জন্যে নয়, মশায়; মৃত্যু আমাকে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তাই ভারতবর্ষময় ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছি; কিন্তু রেহাই নেই। যেখানেই যাই, মৃত্যু আমার পেছনে লেগে আছে। মনে ভাবি, আর বাঙালীর সঙ্গে দেখা করব না; কিন্তু পারি না, প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে।”
কথাটা খাপছাড়া ঠেকিল, কিন্তু তবু মৃত্যু যে তাহাকে তাড়া করিয়াছে এবং অচিরাৎ ধরিয়া ফেলিবে, সে বিষয়ে অন্তত আমার মনে কোনও সন্দেহ ছিল না। তথাপি তাহাকে সান্ত্বনা দিবার অভিপ্রায়ে বলিলাম, “এখানকার জলহাওয়া খুব ভাল, কিছু দিন থাকুন, নিশ্চয় সেরে উঠবেন।”
লোকটি পকেট হইতে চামড়ার সিগার-কেস্ বাহির করিয়া বলিল, “ধূমযাত্রা করেন কি?”—বলিয়া তিনটি ভীষণদর্শন সিগার আমাদের তিনজনকে দিয়া, একটি নিজে ধরাইয়া টানিতে আরম্ভ করিল। আমরা নির্বাক্ হইয়া তাহার মুখের দিকে চাহিলাম। এই শরীরের উপর এইরূপ বিকটাকৃতি বিষাক্ত কড়া সিগার টানিয়া লোকটা কয় দিন বাঁচিবে?
আমাদের মুখের প্রতি কিন্তু তাহার নজর ছিল, সে ঈষৎ হাসিয়া বলিল, “আপনারা ভুল করছেন। আমি দেখতে একটু রোগা বটে, কিন্তু আমার শরীরে কোনও রোগ নেই। ধরুন তো আমার পাঞ্জা।”—এই বলিয়া কাঠির মতো অঙ্গুলিযুক্ত কংকালসার হাতখানা আমার দিকে বাড়াইয়া দিল।
পাগল নাকি! আমি তাড়াতাড়ি বলিলাম, “না, না, সে কথা বলিনি। আমি বলছিলুম—”
“ধরুন পাঞ্জা—” লোকটির চক্ষু দু’টা ধক্ধক্ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। আমরা মনে মনে প্রমাদ গণিলাম; কোথা হইতে একটা উন্মাদ আসিয়া জুটিল! আমরা পরস্পর মুখ-তাকাতাকি করিতেছি দেখিয়া লোকটা নাছোড়বান্দা হইয়া বলিল, “আপনারা ভাবছেন, রোগা বলে আমার গায়ে জোর নেই। ভুল! ভুল! পাঞ্জায় গামা পালোয়ানও আমাকে হারাতে পারে না। ধরুন পাঞ্জা।”
কি করি, নিরুপায় হইয়াই তাহার পাঞ্জা ধরিলাম। নিজের দৈহিক শক্তি সম্বন্ধে ভাল ধারণাই ছিল; ভয় হইল, বুঝি একটু চাপ দিলেই ঐ প্যাকাটির মতো আঙুলগুলা মট্মট্ করিয়া ভাঙিয়া যাইবে। কিন্তু তাহার হাতে হাত দিয়াই বুঝিলাম, সে আশঙ্কা অমূলক। তাহার আঙুলগুলা ইস্পাতের তারের মতো আমার আঙুলগুলাকে জড়াইয়া ধরিল। আমি যতই বলপ্রয়োগ করি, তাহার কব্জি ততই লোহার মতো শক্ত হইতে থাকে। আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল। চাহিয়া দেখিলাম, আমার প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখ নির্বিকার, দাঁতে সিগার চাপিয়া স্বচ্ছন্দে ধূম উদ্গিরণ করিতেছে।
ক্রমে আমার হাত অসাড় হইয়া আসিতে লাগিল। তারপর সবিস্ময়ে দেখিলাম, হাতখানা অজ্ঞাতসারে ঘুরিয়া যাইতেছে।
আমার কব্জির কাছে মট্ করিয়া একটা শব্দ হইল। “ব্যাস! কাবার!”—বলিয়া লোকটা পাঞ্জা ছাড়িয়া দিল। আমি স্তম্ভিতভাবে অবশ হাতখানা তুলিয়া বসিয়া রহিলাম।
খানিকক্ষণ কেহ কোনও কথা কহিল না, লোকটা অর্ধমুদিতনেত্রে সিগার টানিতে লাগিল।
অবশেষে অমূল্য জিজ্ঞাসা করিল, “মশায়ের নামটি কি?”
সে বলিল, “ভূতনাথ শিকদার। দেখলেন তো যা বললুম সত্যি কি না? রোগ আমার শরীরে নেই মশায়, রোগ এইখানে।”—বলিয়া নিজের কপালে তর্জনী ঠেকাইল।
বরদা নিজের চেয়ারখানা ভূতনাথ শিকদারের পাশ হইতে একটু সরাইয়া লইয়া বলিল, “আপনি যে অদ্ভুত শক্তির পরিচয় দিলেন, তা তো চোখে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছে না; ভোজবাজি বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু শরীর যদি আপনার নীরোগই হয়, তবে আপনি এত রোগা কেন? মাথার কি কোনও অসুখ আছে?”
ভূতনাথ শিকদার বলিল, “মাথার অসুখ নেই, অসুখ আমার কপালের, ভাগ্যের। বলছি তো, মৃত্যু আমাকে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে।”
বরদা বলিল, “কথাটা আর একটু খোলসা করে না বললে ঠিক বুঝতে পারছি না।”
শিকদার চুরুটে তিন চারটা টান দিয়া যেন কি চিন্তা করিল, শেষে বলিল, “আচ্ছা, বলছি, কিন্তু এ কথা শোনবার পর আর আপনারা আমার মুখদর্শন করতে চাইবেন না। এই ভয়েই তো দেশ-দেশান্তরে পালিয়ে বেড়াচ্ছি—বাঙালীর ছায়া মাড়াতে চাই না; কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেরে উঠি না। আপনারা আমায় মাফ করবেন, আমি একটা মহা অলক্ষণ, যাদের সঙ্গে মিশি, তাদেরই অমঙ্গল হয়।”
তাহার কথাগুলা এমন একটা অবসন্ন করুণ রেশ রাখিয়া গেল যে, কিছু না-বুঝিয়াও আমার হৃদয় সহানুভূতিতে ভরিয়া গেল। হয়তো লোকটি জীবনে অনেক দুঃখশোক পাইয়াছে, তাই মাথাটা কিছু খারাপ হইয়া গিয়াছে—মনে করে, যাহার সহিত কথা কহিবে তাহারই অমঙ্গল ঘটিবে। আমার এক দূর-সম্পৰ্কীয় পিসীমার এইরূপ হইয়াছিল। এক বৎসরে মধ্যে স্বামী, তিন পুত্র ও সাতটি নাতি-নাতনী হারাইয়া তিনি প্রায় পাগল হইয়া গিয়াছিলেন, সর্বদা চোখে কাপড় বাঁধিয়া বসিয়া থাকিতেন, বলিতেন—আমি কাহারও মুখ দেখি না, আমার দৃষ্টি যাহার উপর পড়িবে, সে আর বাঁচিবে না। ভূতনাথ শিকদারেরও হয়তো সেই রকম কিছু হইয়া থাকিবে।
আমি বলিলাম, “তা হোক, আপনি বলুন। ও সব অলক্ষণ কুলক্ষণ আমরা মানি না।”
শিকদার বলিল, “আপনাদের তরুণ বয়স, ও সব না-মানাই স্বাভাবিক। ভূত-প্রেত, পরকাল, সূক্ষ্মদেহ এ সব আপনাদের মানতে বলছি না, কিন্তু আসন্ন দুর্ঘটনা যে আগে থাকতে মানুষের জীবনে ছায়াপাত করে, এ কথাও কি আপনারা স্বীকার করেন না?”
আমরা চুপ করিয়া রহিলাম। শিকদার বলিতে লাগিল, “তবে ব্যাপারটা গোড়া থেকেই বলি। আমার জীবন কেন যে মনুষ্যসমাজ থেকে একটা ঊর্ধ্বশ্বাস পলায়ন হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা শুনলে আপনার হয়তো আমাকে পাগল মনে করবেন; কিন্তু বাস্তবিক আমি পাগল নই, আপনাদের মতো সহজ মানুষ। পাঁচজনের সঙ্গে মিলে-মিশে, হেসে-কেঁদে সাধারণ মানুষের মতো জীবন কাটাতে চাই; কিন্তু পারি না। কেন পারি না, জানেন? ভয়! দারুণ ভয়ে আমি কারুর সঙ্গে মিশতে পারি না। একটা মহা আতঙ্ক সব সময় আমাকে গ্রাস করে আছে। যখন একলা থাকি বেশ থাকি, কিন্তু আপনারাই বলুন তো, মানুষ একলা সঙ্গিহীনভাবে কত দিন থাকতে পারে? তাই মাঝে মাঝে ছুটে বেরিয়ে পড়তে হয়।
“আমি বিবাহ করিনি, কেন করিনি তা সহজেই বুঝতে পারবেন। বাপ-মা অনেকদিন গত হয়েছেন, আত্মীয়স্বজনও এখন বড় কেউ নেই, চিৎপুর রোডে পৈতৃক বাড়িখানা এখনও বিক্রি করিনি, টাকাও যথেষ্ট আছে, কিন্তু তবু একটা সৃষ্টিছাড়া অন্ধকার ধূমকেতুর মতো কেবল শুন্যের মাঝখানে ছুটে বেড়াচ্ছি—কেন?
“যখন আমার যোল বছর বয়স, তখন একদিন গ্রীষ্মের দুপুরবেলায় তিনজন সমবয়স্ক বন্ধুর সঙ্গে আমি আমাদের বাড়ির তেতলায় একটা ঘরে বসে তাস খেলছিলুম। সেই দিনটা হচ্ছে আমার জীবনের একটা অভিশাপ। স্কুলে গরমের ছুটি হয়ে গেছে, রোজই আমাদের এই রকম খেলা বসে। তেতলার এই ঘরটি দিব্যি নিরিবিলি, চিৎপুর রোডের চিৎকার সেখান পর্যন্ত পৌঁছয় না, শুধু মাঝে মাঝে ট্রামের ঢং ঢং শব্দ শোনা যায়। সে দিন আমরা চারজন নিবিষ্টমনে বসে খেলছি, এমন সময় খোলা জানলা দিয়ে একটা কালো ভোমরা ঘরে ঢুকে আমাদের ঘিরে ভন্ভন্ করে ঘুরতে লাগল। খেলায় এত তন্ময় ছিলুম যে প্রথমটা লক্ষ্যই করিনি, কিন্তু সেটা যখন মাথার চারিদিকে ঘুরপাক খেতে আরম্ভ করলে, তখন আমরা চারজনেই উঠে তাকে তাড়াবার চেষ্টা করতে লাগলুম। কিন্তু সেও কিছুতেই যাবে না; পাখা দিয়ে, ব্যাড্মিন্টনের ব্যাট দিয়ে যতই তাকে মারবার চেষ্টা করি, সেও ততই আমাদের লক্ষ্য এড়িয়ে কখনও নিচুতে, কখনও প্রায় কড়িকাঠের কাছে উঠে ঘুরতে থাকে। আমরা যেই আবার খেলতে বসি, অমনই আমাদের কানের কাছে এসে ভোঁ ভোঁ শব্দ করে উড়তে আরম্ভ করে।
“প্রায় আধ ঘন্টা তার পেছনে লেগে থাকবার পর যখন আমরা হয়রান হয়ে পড়েছি, তখন ভোমরাটা ভন্ভন্ করে এসে একবার আমাদের মাথার চারিদিকে চক্র দিয়ে নিজে থেকেই জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল। বাইরের তপ্ত বাতাসে তার ক্রুদ্ধ গুঞ্জন ক্রমে ক্ষীণ হয়ে মিলিয়ে গেল।
“গোপাল বললে, ‘দেখ ভাই, আশ্চর্য ভোমরা! একবার আমি ব্যাড্মিন্টন ব্যাট দিয়ে মারলুম, ঠিক মনে হল ভোমরাটা তাঁতের ভেতর দিয়ে গলে গেল।’
“বীরেন বললে, ‘দূর! অত বড় ভোমরা কখনও অতটুকু ফাঁক দিয়ে গলতে পারে?’
“হরিপদ বললে, ‘কিন্তু এই কলকাতা শহরে ভোমরা এলো কোত্থেকে, ভাই? কাছেপিঠে কোথাও বাগানও তো নেই!’
“সত্যি তো, ভোমরা এলো কোত্থেকে? আমরা নানারকম আঁচ-আন্দাজ করতে লাগলুম, কিন্তু কোনটাই বেশ লাগসই হল না। তখন আমাদের বয়স কম, ভোমরা কোথা থেকে এলো, এ সমস্যা নিয়ে বেশি মাথা ঘামালুম না; কিন্তু ভোমরাটাকে মন থেকে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলতেও পারলুম না।
“পরদিন দুপুরে গোপাল তাস খেলতে এলো না। তিনজনে খেলা ভাল জমল না, সারা দুপুর গল্প করে আর গোপালকে গালাগাল দিয়ে কাটিয়ে দিলুম।
“গোপাল গ্রে স্ত্রীটে থাকত। বিকেলবেলা তার বাড়ি গিয়ে দেখলুম, সে বিছনায় শুয়ে আছে, মাথায় বরফ দেওয়া হচ্ছে। আমায় দেখে চিনতে পারলে কি না বোঝা গেল না,—চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে লাল। শুধু একবার গেঙিয়ে গেঙিয়ে কি একটা কথা বললে—মনে হল যেন বললে—ভোমরা!
“তার চারিদিকে ডাক্তার আর বাড়ির লোক ভিড় করেছিল; কিন্তু কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারলুম না, গোপালের কি হয়েছে। পরে শুনেছিলুম-সর্দিগর্মি। সান্-স্ট্রোক্।
“আমি চুপি চুপি চোরের মতো বাড়ি ফিরে এলুম; তার সেই অস্পষ্ট কথাটা আমার মাথার মধ্যে কেবলই গুমরে গুমরে উঠতে লাগল—ভোমরা! ভোমরা!
“পরদিন গোপাল মারা গেল। সেই থেকে, কি করে জানি না, আমার মনে গেঁথে গেল যে, সেই ভোমরাটা ছিল মৃত্যুর দূত। গোপালের দিন যে ফুরিয়ে এসেছে, এই খবরটা সে আমাদের দিতে এসেছিল।
“তারপর থেকে এই কুড়ি বছরের মধ্যে কতবার ভোমরা দেখেছি জানেন?—তিনশ’ একুশবার। আর, একবারও আমার ভোমরা দেখা নিষ্ফল হয়নি!”
নির্বাপিত সিগারটা আগুনের মধ্যে ফেলিয়া দিয়া শিকদার আর একটা সিগার ধরাইল। আমরা নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিলাম।
শিকদার বলিল, “প্রথম প্রথম মনে হত, বুঝি আমার মনের ভুল; কিন্তু তা নয়—ভোমরাটাকে সকলেই দেখতে পায় এবং দেখার তিন দিনের মধ্যে যারা দেখেছে, তাদের মধ্যে একজনের মৃত্যু অনিবার্য। বাবা মারা যাবার আগে ভোমরা দেখলুম,—মা’র বেলাতেও দেখা পেলুম।
“ক্রমে মানুষের সঙ্গ আমার কাছে ভয়াবহ হয়ে উঠল—সর্বদাই আতঙ্ক, কি জানি কখন ভোমরা দেখে ফেলি। হয়তো পাঁচজন বন্ধু-বান্ধব মিলে গল্প করছি, হঠাৎ ভোমরা দেখা দিলেন। দুম করে বুকের মধ্যে হাতুড়ির ঘা পড়ল। আমার এই সুস্থ সবল বন্ধুদের মধ্যে একজনের মেয়াদ ফুরিয়েছে—তিন দিনের মধ্যে তাঁকে যেতে হবে।
“একটা উৎকট কৌতূহল হত; জানতে ইচ্ছে করত, এদের মধ্যে কাকে ভোমরা নোটিশ দিয়ে গেল। মনে মনে আন্দাজ করবার চেষ্টা করতুম—এবার কার পালা; কিন্তু আন্দাজ ঠিক হত না। ভোমরার মৃত্যু-পরোয়ানার মধ্যে ঐটুকু ছিল কৌতুক—কার ওপর সমন জারি করে গেল, শেষ পর্যন্ত। বোঝা যেত না।
“একবারকার ঘটনা বলি। বর্ধমানে মামার বাড়ি গিয়েছি; মামার অনেকগুলি ছেলে-মেয়ে। পৌঁছনোর পরদিন সকালবেলা আমরা সকলে মিলে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছি, এমন সময় ভোমরার আবির্ভাব হল। আমার বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে উঠল। সুবী বলে মামার একটা বছর দশেকের মেয়ে দেয়ালের ধারে বসে চা তৈরি করছিল, ভোমরাটা উড়তে উড়তে দেয়ালে ঠোকর খেয়ে টপ্ করে পড়ল একেবারে সুবীর মাথায়। সুবী হাঁউমাউ করে উঠে দাঁড়াতেই জ্বলন্ত স্টোভটা উল্টে গিয়ে তার কাপড়ে আগুন ধরে গেল। ভোমরা ভোঁ করে উড়ে পালাল।
“আমরা পাঁচজনে মিলে সুবীর কাপড়ের আগুন নেবালুম বটে, কিন্তু তার পা দুটো ঝলসে সাদা হয়ে গেল। ডাক্তার এসে ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করে বলে গেলেন—সিরিয়াস্ কিছু নয়, খুব বেঁচে গেছে।
“আমি মনে মনে বললুম—বেঁচে মোটেই যায়নি,—এ ভোমরার নোটিশ, ব্যর্থ হবার নয়। ঘা থেকে সেপ্টিক্, তার পরেই সাফ।
“দুপুরবেলা সুবীর জ্বর এলো। সন্ধ্যের সময় আমি একটা ছুতো করে ঊর্ধ্বশ্বাসে বর্ধমান ছেড়ে পালালুম। সুবীটা বড় ভাল মেয়ে ছিল, মামাতো ভাইবোনের মধ্যে তাকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসতুম।
“বাড়ি ফিরে এসে কাউকে কিছু বললুম না। যথাসময়ে টেলিগ্রাম এলো—সুবীর কিছু হয়নি, মামা হঠাৎ হার্টফেল করে মারা গেছেন!
“ভোমরার অভিসন্ধি বোঝবার চেষ্টা করেছিলুম, তাই সে আমার সঙ্গে একটু ইয়ার্কি করে গেল।
“আমার মনের অবস্থাটা একবার ভেবে দেখুন,—সর্বদা যেন মৃত্যুর দূতকে সঙ্গে করে নিয়ে বেড়াচ্ছি। অনেক ভেবে ভেবে একটা মতলব ঠিক করলুম,—দিনের বেলা যতদূর সম্ভব একলা থাকতুম, রাত্তিরে বাড়ি থেকে বার হতুম। মনের ভাবটা এই যে, রাত্তিরে তো আর ভোমরা আসতে পারবে না!
“কিন্তু আমার ফন্দি খাটল না। দিন-রাত্রি নির্বিচারে ভোমরা আসতে লাগল—রাত্তিরে কানামাছির মতো টাউরি খেতে খেতে আসে, আবার টাউরি খেতে খেতে চলে যায়।
“আমার মানসিক অবস্থা ক্রমে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে লাগল, আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সকলেই জিজ্ঞাসা করে, ‘তুই অমন কুনো হয়ে যাচ্ছিস কেন? চেহারাটাও দিন দিন ভূতে-পাওয়া গোছের হয়ে যাচ্ছে। হয়েছে কি?’
“আমি চুপ করে থাকি—কি বলব? সত্যি কথা কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারি না।
“অতঃপর বাবা-মা মারা যাবার পর থেকে এই নিরুদ্দেশ যাত্রা শুরু হয়েছে। মানুষের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছি, কিন্তু মৃত্যু-দূত আমার সঙ্গ ছাড়ে না। এক এক সময় হাত জোড় করে ডাকি, ‘মরণ-ভোমরা! তুমি এবার আমাকে নাও, এই দুঃসহ শাস্তি থেকে আমাকে নিষ্কৃতি দাও।’—কিন্তু আমার প্রার্থনা মঞ্জুর হয় না। এ সংসারে কেবল আমিই যেন অমর, সকলের মৃত্যুর পরোয়ানা বয়ে বেড়াচ্ছি।”
শিকদারের কণ্ঠস্বর একটা গভীর নিরাশার মধ্যে মিলাইয়া গেল। তাহার কথাগুলা ঘরের মধ্যে যেন একটা অবাস্তব দুঃস্বপ্নের জাল বুনিয়া দিয়াছিল। আমরা আগুনের দিকে তাকাইয়া মোহাচ্ছন্নের মতো বসিয়া রহিলাম।
কিছুক্ষণ পরে অমূল্য জিজ্ঞাসা করিল, “আপনি শেষ কবে মরণ-ভোমরা দেখেছেন?”
শিকদার চোখের উপর দিয়া ডান হাতখানা একবার চালাইয়া বলিল, “সাত দিন আগে, আগ্রায়। তাজ দেখতে গিয়েছিলুম, সেখানে একটি বাঙালী দম্পতির সঙ্গে দেখা হল। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে তাজ দেখতে এসেছে—ছেলেমানুষ, নবপ্রণয়ী। প্রণয়ের মহাতীর্থে নিজেদের সম্মিলিত ভালবাসা বোধ হয় নিবেদন করতে এসেছিল। তার পর…ভোমরা… সেই রাত্রেই আগ্রা ছেড়ে চলে এলুম।”
চারজনেরই সিগার নিবিয়া গিয়াছিল, পুনশ্চ ধরাইয়া নিঃশব্দে টানিতে লাগিলাম।
মিনিট পনের সকলেই চুপচাপ।
হঠাৎ শিকদার বলিল, “একটু গরম বোধ হচ্ছে না? জানলাটা খুলে দিতে পারি?”
বদ্ধ ঘরে সিগারের কটু ধোঁয়া ও আগুনের উত্তাপে সত্যই দম বন্ধ হইবার উপক্রম হইয়াছিল। আমরা ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি দিতেই শিকদার উঠিয়া পশ্চিমদিকের জানালাটা খুলিয়া দিল।
বরদা আমার কানে কানে বলিল, “একেবারে বদ্ধ পাগল—মনোম্যানিয়াক্। ওর চোখের চাউনি দেখছ?”
শিকদার জানালা খুলিয়া দিতেই একটা এলোমেলো কন্কনে হাওয়া ঘরে ঢুকিয়া আমাদের উত্তপ্ত মুখের উপর যেন ঠাণ্ডা হাত বুলাইয়া দিল। টেবিলের উপর আলোটা নিব-নিব হইয়া আবার জ্বলিয়া উঠিল।
শিকদার ফিরিয়া আসিয়া চেয়ারে বসিয়াছে, এমন সময়—
ভন্ন্—
ও কিসের শব্দ? চারিজনেই চেয়ারের উপর সোজা শক্ত হইয়া বসিলাম।
পরক্ষণেই খোলা জানালা দিয়া একটা কালো কুচকুচে ভোমরা পাখার শব্দে আমাদের মগজ ভরিয়া দিয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমরা তাহার দিকে তাকাইয়া রহিলাম।
ভোমরা টেবিলের উপরের বাতিটাকে একবার প্রদক্ষিণ করিল; তারপর সোঁ করিয়া উপরে উঠিয়া গিয়া ছাদে বাধা পাইয়া টপ্ করিয়া মেঝেয় পড়িয়া গেল। কিছুক্ষণ তাহার গুঞ্জন নিস্তব্ধ।
আবার ভন্ করিয়া শব্দ হইল। ভোমরা মেঝে হইতে উঠিয়া একবার বিদ্যুদ্বেগে ঘরময় উড়িয়া বেড়াইল। তারপর আমাদের কানের পাশ দিয়া ছুটিয়া গিয়া জানালা দিয়া বাহির হইয়া গেল। তাহার গুঞ্জন ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া অবশেষে মিলাইয়া গেল।
শিকদার উঠিয়া দাঁড়াইল, তাহার চোখ দু’টা পাগলের মতো। প্রায় চিৎকার করিয়া বলিল, “ক্ষমা করুন, ক্ষমা করুন!—আমি একটা অভিসম্পাত। আর কখনও আমার দেখা পাবেন না!”—বলিয়া ওভারকোট ও টুপি ফেলিয়াই ঝড়ের মতো ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
আমরা তিন বন্ধু বিহুল জিজ্ঞাসুভাবে পরস্পরের মুখের পানে চাহিলাম। বুকের ভিতর তোলপাড় করিতে লাগিল।
তিন দিনের মধ্যে কাহাকে যাইতে হইবে?
৫ পৌষ ১৩৩৮