উপন্যাস
বড় গল্প
সংকলন
রচনা

মরণ বিজয়ীর দল

মরণ বিজয়ীর দল

রবীন্দ্রনাথের মুখে তোমরা বন্দিবীর বান্দার অপূর্ব কাহিনি শ্রবণ করেছ। চিত্তোত্তেজক গল্পের দিক দিয়ে ধরলে, ও গাথাটির তুলনা নেই।

কিন্তু এখানে সাধারণ পাঠকের কথা ছেড়ে দিচ্ছি। কারণ আমরা বলব ইতিহাসের কথা এবং রবীন্দ্রনাথের ওই কবিতাটি পাঠ করলে ঐতিহাসিকেরা খুব বেশি বোধ করি অভিভূত হবেন না।

বান্দা যে জাতির জন্যে, ধর্মের জন্যে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলেন, সে কথা কেহই অস্বীকার করতে পারবেন না। কিন্তু মোগল সম্রাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে মুসলমান নরনারী—এমনকী অজাত শিশুর উপরে তিনি যেসব অকথ্য, অমানুষিক ও পৈশাচিক অত্যাচার করেছিলেন, ইতিহাসে তা স্পষ্ট ভাষায় লেখা আছে। অধিকন্তু বান্দার অনুচরদের কবল থেকে বহু হিন্দুও মুক্তিলাভ করতে পারেননি। এইসব কথা মনে করলে বান্দার প্রতি আমাদের সহানুভূতি যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বলতে ইচ্ছা হয় যে, বান্দা একজন সাধারণ অপরাধী ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না।

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় উজ্জ্বল ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে, বান্দা কেমন করে স্বহস্তে নিজের পুত্রকে বধ করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাস বলে, বান্দা স্বহস্তে পুত্রহত্যা করেননি। ব্যাপারটা হয়েছিল আরও মর্মন্তুদ, আরও ভয়ানক।

বধ্যভূমিতে (দিল্লির কুতুব মিনারের সামনে) বন্দি বান্দার কোলে তার তিন বছরের ছেলেকে তুলে দিয়ে বলা হল, ‘একে হত্যা কর।’

বান্দা হুকুম গ্রাহ্য করলেন না। এমন হুকুম তামিল করতে পারে না কোনও পিতাই।

ঘাতক তখন এক সুদীর্ঘ ছুরিকার আঘাতে শিশুকে হত্যা করলে এবং তার উদরের ভিতর থেকে যকৃৎ টেনে বের করে বান্দার মুখের ভিতরে ঢুকিয়ে দিলে।

তারপর বিষম যন্ত্রণা দিয়ে একে-একে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নিয়ে বান্দাকেও হত্যা করা হল।

*

কয়েক বৎসর ধরে পাঞ্জাবের দিকে-দিকে বিদ্রোহের ধ্বজা তুলে রাজশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর যুদ্ধ করে বান্দা শেষটা সদলবলে বন্দি হলেন গুরুদাসপুর গড়ে (১৭১৫ খ্রিঃ)। দীর্ঘ ছয় বৎসর ধরে যে বিদ্রোহী মোগল সম্রাটের বিপুল জনবল ও অর্থবল ব্যর্থ করে এসেছিলেন, তাঁর ভাণ্ডার লুণ্ঠন করে পাওয়া গেল মাত্র ১,০০০ তরবারি, ২৭৮ ঢাল, ১৭৩ ধনুক, ১৮০ বন্দুক, ১১৪ ছোরা, ২১৭ লম্বা ছুরি, খানকয় সোনার গহনা, ২৩টি মোহর ও কিছুবেশি ৬০০ টাকা। গুরদাসপুর গড়ও মোগলরা গায়ের জোরে কেড়ে নিতে পারেনি, কেবল নির্জল উপবাসের যন্ত্রণা সইতে না পেরেই শিখেরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। কোনও কোনও ঐতিহাসিক বলেন, দুর্গের মধ্যে অবরুদ্ধ শিখদের দুর্দশা এমন চরমে উঠেছিল যে, অনেকে নাকি অন্য খাদ্যের অভাবে আপন-আপন উরু থেকে মাংস কেটে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে তারই সাহায্যে করেছিল উদরপূর্তি।

গুরুদাসপুর গড়ের পতনের পর যে নাটকীয় দৃশ্যের অভিনয় হয় এবং শিখদের যে অলৌকিক বীরত্বের পরিচয় পাওয়া যায়, তা নিয়ে একাধিক বিচিত্র কাব্য রচনা করা যেতে পারে। কিন্তু আমি এখানে কবিতা কিংবা অত্যুক্তির আশ্রয় গ্রহণ করব না। সাদাসিধে ভাষায় সোজাসুজি মূল ঘটনাগুলি বর্ণনা করে যাব। দেখবেন তার ভিতরেই অসাধারণ রূপ ফুটে উঠে হৃদয়কে অভিভূত করে দেবে।

অগুনতি শিখকে হত্যা করা হল। সাতশত চল্লিশ জন শিখ হল বন্দি। দিল্লির রাজদরবার থেকে হুকুম এল—ছত্রপতি শিবাজীর পুত্র রাজা শম্ভুজীকে বন্দি করে যেভাবে রাজধানীতে নিয়ে আসা হয়েছিল, বান্দা ও তাঁর অনুচরদেরও সেইভাবে দিল্লিতে নিয়ে আসতে হবে।

নির্দিষ্ট দিনে দিল্লি দুর্গের লাহোরী ফটক থেকে আমারাহাদ পর্যন্ত কয়েক মাইল-ব্যাপী পথের দুইধার জুড়ে দাঁড়াল অস্ত্রধারী সৈনিক। এবং পথের উপর ভেঙে পড়ল বিপুল জনতা-সাগরের তরঙ্গের পর তরঙ্গ।

প্রথমেই দেখা গেল, হাতির উপরে লোহার খাঁচা এবং তার ভিতরে বন্দি বান্দা। অঙ্গে তাঁর স্বর্ণখচিত সমুজ্জ্বল ও বহুমূল্য পোশাক। পিছনে দাঁড়িয়ে লৌহবর্মধারী মোগল সেনানী, হাতে তার নগ্ন তরবারি। বান্দার হাতির সুমুখে দেখা যাচ্ছে শত-শত বংশদণ্ডের উপরে নিহত শিখ যোদ্ধাদের ছিন্ন মুণ্ড তাদের লম্বা চুলগুলো মুখের উপরে পড়ে দুলছে ঝালরের মত।

বান্দার হাতির পিছনে পিছনে আসছে দলে দলে উট। প্রত্যেক উটের উপরে বসে আছে দুজন করে শিখ বন্দি। তাদের পরিয়ে দেওয়া হয়েছে বিসদৃশ পোশাক, অনেককে দেখতে হয়েছে পশুর মতো।

জনতার মধ্যে জাগল ঘন ঘন জয়ধ্বনি। বন্দিদের লক্ষ্য করে অনেকে টিটকারি দিতে লাগল। কিন্তু বন্দিরা তা শুনে বিচলিত হল না। মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তারা কেউ ভীত-ভাব প্রকাশ করলে না, বরং অনেকের মুখ দেখলে মনে হয় যেন তারা সানন্দে চলেছে কোন উৎসব-সভার দিকে।

কেউ ঠাট্টা করলে তারা নির্ভয়ে পালটা জবাব দিতেও ছাড়লে না। কেউ তাদের ‘খুন করব’ বলে ভয় দেখালে তারা বলে, ‘মারো, আমাদের মেরে ফেল, মৃত্যুকে আমরা ভয় করব কেন? কেবল ক্ষুধা-তৃষ্ণা সইতে না পেরেই আমরা তোমাদের হাতে ধরা দিয়েছি। আমাদের সাহস আর বীরত্ব কি তোমরা জান না?’

স্থির হল প্রতিদিন একশো জন করে বন্দিকে বধ করা হবে।

বধ্যভূমিতে দর্শকদের দলে উপস্থিত ছিলেন কয়েকজন ইউরোপীয় ভদ্রলোকও। সকলেই বলেন, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও শিখ বন্দিরা যে ধীরতা, দৃঢ়তা ও বীরত্বের পরিচয় দিলে, তা বিস্ময়কর!

বন্দিদের বলা হল, ‘জীবন ভিক্ষা চাও তো মুসলমান হও!’

প্রত্যেক বন্দি এককণ্ঠে বললে, ‘মুণ্ড দেব, ধর্ম দেব না।’

তাদের কারোর এতটুকু মৃত্যুভয় নেই, ঘাতককে ডাকতে লাগল ‘মুক্তিদাতা’ বলে। সকলে মহা আনন্দে ঘাতকের সামনে ছুটে গিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল, ‘মুক্তিদাতা, আগে আমাকে হত্যা কর!’

সাড়ে সাতশত শিখ বন্দি। প্রতিদিন নিয়মিতভাবে তরবারি শূন্যে ওঠে চকমকিয়ে এবং পরমুহূর্তে নীচে নেমে উড়িয়ে দেয় এক এক বীরের মুণ্ড। কাটতে কাটতে তরবারি ভোঁতা হয়ে যায়, আবার তাকে শানিয়ে নিতে হয়। সাতশত চল্লিশজন বন্দির ভিতর থেকে একজনও মৃত্যুভীত কাপুরুষকে পাওয়া গেল না। সাতশত চল্লিশ মহাবীর একে একে মুণ্ড দিলে, ধর্ম দিলে না। সাতশত চল্লিশ মহাবীরের রক্ত শোষণ করে বধ্যভূমি হয়ে উঠল বীরভূমি।

বান্দা তো দলের নেতা, সব দিক বুঝে প্রস্তুত হয়েই তিনি ধারণ করেছিলেন বিদ্রোহের পতাকা। কিন্তু এই সাতশত চল্লিশ জন শিখ, এদের অধিকাংশই সাধারণ লোক—অনেকেই হয়তো নিরক্ষর ও চাষাভুষো শ্রেণির। তবু ওদের কেউ ধর্মের বিনিময়ে জীবন ভিক্ষা করলে না। বান্দার মৃত্যুর চেয়েও তাদের আত্মদান অধিকতর গৌরবময়।

প্রতিদিনই উচ্চ হয়ে ওঠে মৃতদেহের স্তূপ। মৃত্যুর পরেও বীরদেহগুলির স্তূপ নগরের বাইরে চালান করা হল। তারপর প্রত্যেক দেহকে ঝুলিয়ে দেওয়া হল গাছের ডালে।

কিন্তু এর চেয়েও স্মরণীয় ঘটনা আছে। আমরা মরণের ভয়ের কথাই জানি, মরণের আনন্দের কথা বড় একটা শোনা যায় না। আজীবন প্রাণ বাঁচাতে বাঁচাতেই আমাদের প্রাণান্ত হয়, জীবনকে ঘৃণা করবার ও মরণকে ভালোবাসবার আশ্চর্য সুযোগ হয় কয়জনের?

কুতব-উল-মুল্ক ছিলেন তখন ভারত সম্রাটের উজির। তিনি হচ্ছেন সেই ইতিহাস-বিখ্যাত সৈয়দ ভ্রাতৃযুগলের অন্যতম—যাদের প্রভাবে বা কৃপা কটাক্ষে ময়ূর সিংহাসনের উপর বসেছেন সম্রাটের পর সম্রাট। কুতব-উল-মুল্কের হিন্দু দেওয়ানের নাম রতনচাঁদ। তিনি উজিরের বিশেষ প্রিয়পাত্র।

এক নারী রতনচাঁদের কাছে গিয়ে ধরনা দিয়ে পড়ল।

নারী বললে, ‘হুজুর, আমি অসহায় বিধবা। আমাকে দয়া করুন।’

রতনচাঁদ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে তুমি?’

‘আমি এক বালক শিখ-বন্দির মা।’

‘আমার কাছে এসেছ কেন?’

‘আমার বালক পুত্রের উপর প্রাণদণ্ডের হুকুম হয়েছে। ওই ছেলেটি ছাড়া এই দুনিয়ায় আমাকে আর দেখবার লোক কেউ নেই। সে মারা পড়লে আমার কী গতি হবে হুজুর!’

‘তোমার ছেলেকে বাঁচাবার ক্ষমতা আমার নেই। সে বালক হতে পারে, কিন্তু রাজবিদ্রোহী।’

‘হুজুর, আমার ছেলে রাজবিদ্রোহী নয়। এমনকী সে গুরু বান্দার শিষ্যও নয়। তার বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগ মিথ্যা। তাকে ভুল করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হুজুর, তাকে রক্ষা করে এই অনাথাকে রক্ষা করুন!’

অবশেষে মায়ের সেই করুণ ক্রন্দন আর সহ্য করতে না পেরে দেওয়ান রতনচাঁদ তার আরজি নিয়ে গেলেন উজিরের কাছে। প্রিয় পাত্রের অনুরোধ এড়াতে না পেরে কুতব-উল-মুল্ক সেই বিধবা নারীর বালক-পুত্রকে জীবন ভিক্ষা দিলেন।

বেচারা মা আনন্দের অশ্রুজল ফেলতে ফেলতে উজিরের আদেশপত্র নিয়ে ছুটল কোতোয়ালের কাছে।

বন্দিকে কারাগারের বাইরে এনে কোতোয়াল বললে, ‘তুমি মুক্ত।’

বালক সবিস্ময়ে বললে, ‘আমি মুক্ত? না না, এ অসম্ভব।’

তার মা কাছে এগিয়ে এসে বললে, ‘হ্যাঁ বাছা, তুমি মুক্ত। তুমি তো বিদ্রোহী গুরুর শিষ্য নও, তাই আমার কথা শুনে উজিরমশাই তোমায় ছেড়ে দিয়েছেন?’

ভয়াবহ মৃত্যুকে পিছনে রেখে সামনে এসে দাঁড়াল নবযৌবনের উদ্দাম জীবন। নতুন আশায় উচ্ছ্বসিত জননীর স্নেহ-হাসিমাখা মুখ। কিন্তু সেদিকে না তাকিয়ে প্রাণপণে হৃদয়ের আবেগ দমন করে বালক কঠিনস্বরে কোতোয়ালকে জিজ্ঞাসা করলে, ‘কে এই নারী?’

কোনও জননীর সামনে কোনও পুত্রের মুখে এমন নিষ্ঠুর কথা বোধহয় কখনও উচ্চারিত হয়নি। মা তো একেবারে অবাক! হয়ত ভাবলেন, জেলখানায় গিয়ে মৃত্যুভয়ে ছেলের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।

কোতোয়াল বিস্মিত কণ্ঠে বললে, ‘সেকী, ইনি যে তোমার মা!’

বালক অবিচলিত কণ্ঠে বললে, ‘না, এই নারীকে আমি চিনি না।’

‘ইনি তোমার মা নন?’

‘ইনি কী চান তাও আমি জানি না। এঁর কথা সত্যি নয়। আমি বিদ্রোহী, আমি গুরুজির শিষ্য। গুরুজির সঙ্গে আমিও প্রাণ দিতে চাই। জয়, গুরুজির জয়।’

বালক জীবন-ভিক্ষা নিলে না, জীবন দান করলে।

পৃথিবীর কোনও দেশের ইতিহাসে আছে এর চেয়ে অদ্ভুত কাহিনি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *