ছোটো গল্প
উপন্যাস
প্রবন্ধ
ফিচার
কবিতা

মরণ খেলার খেলোয়াড়

মরণ খেলার খেলোয়াড়

খেলার নেশা দারুণ নেশা।

খেলাধুলা করতে যারা ভালোবাসে সেই দুরন্ত খেলোয়াড়ের দল খেলার নেশায় নানারকম বিপদের সম্ভাবনাকে তুচ্ছ করে থাকে। সব খেলাতেই অল্পবিস্তর বিপদের ভয় আছে।

মুষ্টিযুদ্ধ বা কুস্তির মতো বিপজ্জনক খেলার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম- ফুটবল, হকি প্রভৃতি নিরীহ খেলাতেও অনেক সময় খেলোয়াড় ভীষণভাবে আহত হয়। এইসব খেলাতে মারাত্মক আঘাতের ফলে অঙ্গহানির কথা কখনো কখনো শোনা যায়, এমনকী আঘাতের ফলে খেলোয়াড়ের মৃত্যু হয়েছে এমন ঘটনাও নিতান্ত বিরল নয়…

তবে পৃথিবীতে যতরকম বিপজ্জনক খেলা আছে তার মধ্যে বোধ হয় শিকারের মতো ভয়ংকর খেলা আর নেই। এমন তীব্র উত্তেজনার খোরাক আর কোনো খেলাতে পাওয়া যায় কি না সন্দেহ…

নিরীহ হরিণ অথবা পাখির উপর গুলি চালিয়ে যারা আনন্দ বোধ করে আমি তাদের কথা বলছি না। আমি বলছি সেই দুঃসাহসী মানুষগুলোর কথা যারা শিকারের নেশায় বুঁদ হয়ে ছুটে যায় শ্বাপদসংকুল অরণ্যের বুকে, রাইফেল হাতে চ্যালেঞ্জ জানায় হিংস্র পশুকে জীবনকে উপভোগ করতে চায় মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

খেলার মাঠ থেকে পরাজিত খেলোয়াড় মাথা নীচু করে ফিরে আসে, আবার প্রস্তুত হয় পরবর্তী প্রতিযোগিতার জন্য এবং ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে তার পরাজয়ের গ্লানি মুছে যায় জয়লক্ষ্মীর স্নিগ্ধ আশীর্বাদে।

কিন্তু শিকার খেলা বড়ো ভীষণ খেলা।

মুহূর্তের ভুলে এই খেলাতে শিকারিকে প্রাণ দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় বিদ্যুদ্গতি শ্বাপদের দন্তে ও নখরের আলিঙ্গনে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় শিকারির দেহ, আহত হস্তীর পদাঘাতে স্তব্ধ হয়ে যায় রাইফেলের আগ্নেয় গর্জন, বন্য মহিষের নিষ্ঠুর শিং দুটি লাল হয়ে যায় লক্ষ্যভ্রষ্ট শিকারির তপ্ত রক্তধারায়।

অরণ্যের হিংস্র সন্তান পরাজিতকে ক্ষমা করে না। হয় মারো নয় মরো, এই হচ্ছে অরণ্যের আইন।

শিকারের রক্তাক্ত খেলায় জয়লাভ করতে না পারলে অধিকাংশ সময়ে শিকারিকে প্রাণ দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়।

কী ভীষণ খেলা!

লাভে ব্যাং অপচয়ে ঠ্যাং।

 পরাজিত খেলোয়াড়ের প্রতি এমন অলিখিত মৃত্যুদণ্ডের বিধান আর কোনো খেলাতেই নেই।

কিন্তু জয়লাভ করলে লক্ষ লক্ষ দর্শকের করতালি বিজয়ী খেলোয়াড়কে সংবর্ধনা জানায় না। কেবল শিকারের মস্তক ও দেহচর্মের অধিকারী হয়ে আত্মপ্রসাদের আনন্দ উপভোগ করেন সকল শিকারি এবং সেই আনন্দের মাসুল জোগাতে তাঁর নিজস্ব মস্তকের অকস্মাৎ স্কন্ধচ্যুত হওয়ার ভয়াবহ সম্ভাবনাকেও অনায়াসে তুচ্ছ করতে পারেন।

লাভ-ক্ষতির প্রশ্নটা এখানে নিতান্তই গৌণ, খেলার আনন্দটাই এখানে আসল কথা।

ছোটো ছোটো লাভ-ক্ষতি, জয়-পরাজয়ের নিন্দা ও প্রশংসার ক্ষুদ্রগণ্ডির মাঝে আবদ্ধ নয় এই ভয়ংকর খেলার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ।

জীবনটাকে বাজি রেখে হিংস্র পশুর সঙ্গে মানুষ যখন জুয়া খেলতে নামে শুধুমাত্র খেলার আনন্দ উপভোগ করার জন্য, সে-খেলার তুলনা কোথায়?

না, তুলনা নেই।

পৃথিবীতে বহু ধরনের খেলা আছে কিন্তু শিকারের মতো তীব্র উত্তেজনা কোনো খেলাতেই নেই। কিন্তু শিকারি জীবনের সার্থকতা কেবল হত্যা আর হানাহানির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। নির্ভীক শিকারি তার জীবন বিপন্ন করে কর্তব্যের অনুরোধে, মনুষ্যত্বের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সে ছুটে যায় নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে।

মহাচীনের উপকূলে দুর্গম অরণ্যের বুকে যে অখ্যাত মানুষটি নরখাদক রাক্ষসের গ্রাস থেকে ভয়ার্ত বিদেশি নরনারীকে রক্ষা করার জন্য নিজের জীবন বিপন্ন করতেও কুণ্ঠিত হয়নি তার কথা অনেকেই হয়তো জানে না।

এই নাম-না-জানা লোকটির নাম হল্টন ম্যাককোয়েড। একটি অর্ধছিন্ন শিকারের বই থেকে তার ঘটনাবহুল জীবনের একটি কাহিনি পড়া সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কাহিনিটি পড়লেই পাঠক বুঝতে পারবেন এই দুনিয়ার আনাচেকানাচে এমন অনেক অখ্যাত মানুষ লুকিয়ে আছে যাদের বীরত্ব ও সাহস ভুবনবিখ্যাত শিকারিদের চাইতে কোনো অংশেই কম নয়। আমাদের বর্তমান কাহিনির নায়ক একজন শ্বেতাঙ্গ, সে এই হল্টন ম্যাককোয়েড।

সে কোন দেশের অধিবাসী আমি তা জানি না, তবে যে ছেঁড়াখোঁড়া বইখানা থেকে আমি কাহিনিটি উদ্ধার করেছি সেটা ইংরেজি ভাষায় লেখা এবং এই কাহিনি লিখিত হয়েছে হল্টনের নিজস্ব জবানিতে। তাই আমার মনে হয় সে ইংল্যান্ড কিংবা আমেরিকার অধিবাসী। যারা খুব বেশি খুঁতখুঁতে এবং ব্যাকরণ-প্রিয় তারা হয়তো শুধু নাম শুনে সন্তুষ্ট হবেন না, ধামটাও জানতে চাইবেন। তাদের খুশি করতে আমার আপত্তি ছিল না কিন্তু অর্ধচ্ছিন্ন বইখানার মধ্যে লেখকের কোনো পরিচয় দেওয়া হয়নি, তাই হল্টন ম্যাককোয়েড নামধারী মানুষটি কোন দেশের লোক সেকথা জানিয়ে খুঁতখুঁতে ব্যাকরণ-প্রিয় পাঠকদের সন্তুষ্ট করতে পারছি না। তবে আমার মনে হয়, নাম ধাম আর বংশ-পরিচয়ের মধ্য দিয়ে একটা মানুষের যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায় না। দেশ আর প্রদেশের সীমানা ছাড়িয়ে, সাদা কালো আর হলুদ রঙের কথা না ভেবে যে মানুষ মনুষ্যত্বের বৃহত্তর দাবিকে মেনে নিয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করতে পারে সে সত্যিই শ্রদ্ধার পাত্র এবং পৃথিবীর বিখ্যাত শিকারিদের তালিকায় যদি তার নাম না ওঠে তাতে কিছু আসে যায় না।

আমি বলব হল্টন মাককোয়েড সত্যিকার শিকারি, একটা মানুষের মতন মানুষ। কাহিনিটি পড়লেই পাঠক বুঝবেন আমার কথা সত্যি কি না।

চীনদেশে হুইলাই নামে যে ছোট্ট শহরটি আছে তার দক্ষিণ দিকে একটা মানুষখেকো বাঘ ভীষণ উপদ্রব শুরু করেছিল। ওই অঞ্চলে চাষের উপযুক্ত জমি প্রচুর পরিমাণে আছে এবং সে-কারণেই আশেপাশে অনেকগুলি ছোটো ছোটো উপনিবেশ গড়ে উঠেছে। এই ছোটো ছোটো লোকালয়গুলি খুব সুসংবদ্ধভাবে সাজানো নয়– নিতান্ত এলোমেলো চেহারা নিয়ে তারা ছড়িয়ে আছে এদিক সেদিক। একটা উপনিবেশ থেকে আর একটার দুরত্ব প্রায় এক মাইল।

বাঘ যদি একটি উপনিবেশে মানুষ মারে তাহলে পার্শ্ববর্তী লোকালয়ের লোকজন দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়ার আগেই সে অনায়াসে সরে পড়তে পারবে। যে বাঘ একবার নরমাংসের স্বাদ পেয়েছে তার পক্ষে জায়গাটি অতিশয় লোভনীয়। হুইলাইয়ের নরখাদক বাঘ তার শিকারের ক্ষেত্র এই অঞ্চলটিকেই বেছে নিয়েছিল। উপনিবেশগুলিতে বিভীষিকার রাজত্ব ছড়িয়ে হুইলাইয়ের ব্যাঘ্র মহারাজ দীর্ঘদিন ধরে নরমাংসের খাজনা আদায় করছিল। ওই এলাকার মানুষজন ভয়ে পাগলের মতো হয়ে উঠল। বহু শিকারি বাঘটাকে মারার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ধূর্ত নরখাদক তাদের ফাঁকি দিয়ে নির্বিবাদে মানুষ-শিকার করতে লাগল। একজনের পর একজন শিকারি আসে, বাঘটাকে মারার চেষ্টা করে, তারপর শয়তান নরভুককে সেলাম জানিয়ে বন্দুক ঘাড়ে করে স্বস্থানে ফিরে যায়। হুইলাইয়ের বাঘ জীবন্ত অভিশাপের মতো সমগ্র অঞ্চলে টহল দেয়– সুযোগ বুঝে বিদ্যুদবেগে আক্রমণ করে, এক একটি মানুষকে মুখে তুলে নিয়ে আবার ঘন জঙ্গলের মধ্যে গা ঢাকা দেয়, তারপর কয়েকদিন ধরে নরমাংসের ভোজে সে তৃপ্ত করে তার পৈশাচিক ক্ষুধা। একবার শিকার ধরলে সে কিছুদিন শান্ত থাকে, কিন্তু নিহত মানুষের মাংস যখন শেষ হয়ে যায় তখনই আবার তার শিকার ধরার প্রয়োজন হয়। যে বাঘ একবার নরমাংসের স্বাদ পেয়েছে সে সহজে অন্য পশুর মাংস খেতে চায় না ক্ষুধার আগুন উদরে দংশন করলেই ক্ষুধিত শার্দূল আবার লোকালয়ে হানা দেয় নরমাংস সংগ্রহ করার জন্য।

পেট ভরা থাকলে বাঘ সাধারণত শিকার করে না। তাই একবার বাঘ মানুষ মারলে ওই অঞ্চলের মানুষ কয়েকটা দিন একটু নিশ্চিন্তে থাকত। কিন্তু অবস্থাটাকে আরও শোচনীয় করে তুলল এক ইংরেজ ছোকরা।

এই অপরিণতবুদ্ধি ব্রিটিশ যুবক কোনোদিন বাঘ শিকার করেনি। হংকং থেকে মানুষখেকো বাঘের খবর পেয়েই সে সোজা হুইলাইতে এসে উপস্থিত হল। ছোকরার অভিজ্ঞতা না থাকলে কী হবে মুখের আড়ম্বর বড়ো কম ছিল না– সে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সবাইকে জানিয়ে দিলে নরখাদক বাঘটিকে সে দুই-একদিনের মধ্যেই মেরে ফেলবে, এটি এমন কিছু গুরুতর ব্যাপার নয়।

ইংরেজ ছোকরা বন্দুক বাগিয়ে টহল মারতে শুরু করল এবং ভাগ্যক্রমে হঠাৎ একদিন বাঘের দেখা পেয়ে গেল। জন্তুটাকে সে খুব ভালোভাবে দেখতে পায়নি– চাষিদের কয়েকটা ভাঙাচোরা কুঁড়েঘরের পিছন থেকে হঠাৎ বাঘটা ফাঁকা জায়গায় লাফ দিয়ে এসে পড়ল।

বাঘের মতো জানোয়ারকে মারতে গেলে একেবারে মর্মস্থানে আঘাত করা প্রয়োজন এবং অভিজ্ঞ শিকারিমাত্রেই জানেন যে আহত ব্যাঘ্রের মতো ভয়ংকর জানোয়ার পৃথিবীতে খুব কমই আছে। সেইজন্য অভিজ্ঞ শিকারি খুব নিশ্চিত না হয়ে গুলি চালান না কারণ খোঁচা-খাওয়া বাঘ শিকারিকে জব্দ করতে না পারলে নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর অনবরত হামলা চালিয়ে তাদের জীবন বিষাক্ত করে তুলবে।

ছোকরা এত কথা জানত না, জানার দরকার মনে করেনি।

শরীরী-বিদ্যুতের মতো ধাবমান ব্যাঘ্ৰকে লক্ষ করে সে বন্দুকের ঘোড়া টিপে দিল।

হুইলাইয়ের বাসিন্দাদের কপাল মন্দ– গুলি বাঘের বাঁ-পায়ের মাংসপেশি ভেদ করে চলে গেল।

বাঘ একটুও থামল না, চটপট পা চালিয়ে সে তিরবেগে অন্তর্ধান করল।

ইংরেজ ছেলেটি আগে বোকামি করলেও পরে বিলক্ষণ বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিল। আহত নরখাদক ব্যাঘ্রের পশ্চাদ্ধাবন করলে যে জীবন বিপন্ন হতে পারে একথাটা বুঝতে তার একটুও অসুবিধে হল না। সুদূর ইংল্যান্ড থেকে চীনের জঙ্গলের মধ্যে ক্রুদ্ধ শার্দুলের মুখে পৈতৃক প্রাণটাকে বিসর্জন দেওয়ার ইচ্ছা তার ছিল না।

বাঘের পায়ে একটা ফুটো করে দিয়ে সে আবার স্বস্থানে ফিরে গেল।

সে তো চলে গেল, কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দারা যাবে কোথায়? আহত বাঘ ওই অঞ্চলের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে। তিনদিনের মধ্যেই বাঘের কবলে প্রাণ হারাল তিন-তিনটি মানুষ। প্রতি রাত্রেই সে জনবহুল বসতিগুলোর মধ্যে হানা দিতে শুরু করলে। অন্ধ আক্রোশে আর পাশব প্রতিহিংসার আগুনে প্রতি রাতেই প্রাণ হারাতে লাগল এক-একটি নিরীহ মানুষ নির্বোধ শিকারির পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে লাগল নিরীহ কৃষক ও দরিদ্র গ্রামবাসী। এই সময়ে ঘটনাস্থলে আবির্ভূত হল আমাদের কাহিনির নায়ক হল্টন ম্যাককোয়েড। হুইলাই থেকে সোয়াটো শহরে গিয়ে একজন স্থানীয় লোক খবর দিলে। খবর পেয়েই সোজা সোয়াটো থেকে ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছোল হল্টন ম্যাককোয়েড। হুইলাইতে এসেই সে শুনল, আহত বাঘ জঙ্গলের মধ্যে একটা গুহার ভিতরে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। কয়েকজন কৃষক বাঘটাকে লক্ষ করেছিল, তারা গুহার মুখে আগুন জ্বালিয়ে পাহারা দিচ্ছিল এবং অপেক্ষা করছিল হল্টনের জন্য। হল্টন যখন গুহার সামনে এসে দাঁড়াল তখন আগুন প্রায় নিভে এসেছে। একজন বৃদ্ধ চীনাম্যান আগুনের মধ্যে কয়েকটি শুকনো গাছের ডাল ফেলে দিলে আগুন আবার দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল… বৃদ্ধ চীনাম্যান এবার দন্তবিকাশ করে বললে, এই আগুনের জন্যই বাঘ গুহার বাইরে আসতে পারেনি। সমস্ত রাত সে গুহার ভিতরেই থাকবে। শয়তানটা আগুনকে ভয় করে।

হল্টন ম্যাককোয়েড পাকা শিকারি, এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে সে বাঘ শিকার করেছে ব্যাঘ্র চরিত্র তার অজানা নয়। সে একথাও জানাত যে আগুন সম্বন্ধে বাঘের ভীতি থাকলেও সবসময় আগুন জ্বালিয়ে বাঘকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। আহত ও ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্ৰকে শুধুমাত্র আগুনের সাহায্যে গুহার মধ্যে বন্দি করে রাখা সম্ভব নয়। একসময় ক্ষুধার যাতনায় সে উন্মত্ত হয়ে উঠবে এবং আগুনের বেড়া ডিঙিয়ে মানুষগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। ক্ষিপ্র ব্যাঘ্রের সেই সংহার-মূর্তির সঙ্গে হল্টনের ভালোভাবেই পরিচয় দিল। গুহার সামনে দাঁড়িয়ে সে কিছুক্ষণ চিন্তা করলে। এই নরখাদক রাক্ষস যদি গুহার ভিতর থেকে বেরিয়ে ঘন জঙ্গলের মধ্যে আত্মগোপন করে তাহলে তাকে আবার খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব বললেই চলে। কিন্তু হল্টন একথাও জানতে যে আহত বাঘ যেকোনো সময়েই বেরিয়ে আসতে পারে এবং গুহার ভিতর থেকে সেই দুর্দান্ত জানোয়ার যদি একবার বাইরে আসে তাহলে কয়েকটা মানুষকে সে ঘায়েল করবেই করবে। দিনের আলোতে বাঘ বাইরে আসার চেষ্টা করলে তাকে গুহার মুখে দাঁড়িয়ে গুলি করা খুব কঠিন নয় কিন্তু ধূর্ত নরখাদক প্রকাশ্য দিবালোকে আত্মপ্রকাশ করবে না, রাত্রির অন্ধকার যখন মানুষের দৃষ্টিকে অন্ধ করে দেবে, তখনই গুহার বাইরে হানা দেবে সেই হিংস্র শ্বাপদ। অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে অগ্নিকুণ্ডের অস্পষ্ট আলোকে শরীরী-বিদ্যুতের মতো ধাবমান ব্যাঘ্ৰকে লক্ষ করে গুলি চালালে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে ক্ষিপ্ত শার্দূল এই নিরস্ত্র চীনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যে বীভৎস হত্যাকাণ্ড চালাবে সে কথা ভাবতেই হল্টন শিউরে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে সে কর্তব্য স্থির করে ফেলল। হেডল্যাম্প জ্বালিয়ে সে আলোটাকে মাথার সঙ্গে বেঁধে নিলে। (হেডল্যাম্প এক ধরনের বৈদ্যুতিক আলো মাথার সঙ্গে আলোটাকে আটকে রাখার ব্যবস্থা আছে। টর্চ বা বিজলি বাতি ব্যবহার করালে দু-হাত দিয়ে রাইফেল বাগিয়ে ধরা যায় না, তাই শিকারিরা হেডল্যাম্প অর্থাৎ মাথার আলো ব্যবহার করে।) হল্টন মাথার সঙ্গে আলোটাকে আটকে নিয়ে কাঁধে ঝোলানো রাইফেলের ফিতা খুলে অস্ত্রটাকে দু-হাতে বাগিয়ে ধরল। অস্ত্রটাকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে সে গুহার মুখে পা বাড়িয়ে দিলে।

হল্টন ম্যাককোয়েড অভিজ্ঞ শিকারি। এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে সে বাঘ শিকার করেছে মাটির উপর দাঁড়িয়ে আক্রমণোদ্যত ব্যাঘ্রের মোকাবেলা করেছে একাধিকবার মাচায় চড়ে হাতির পিঠ থেকে বাঘ শিকারের অভিজ্ঞতাও তার ছিল। কিন্তু আহত শার্দুলের সন্ধানে বদ্ধ গুহার মধ্যে সে কখনো প্রবেশ করেনি। হল্টনের নিজস্ব জবানিতেই বলছিঃ গুহার ভিতরে ঢুকে বাঘ শিকারের চেষ্টা কখনো করিনি। যদি কেউ আমায় এমন নির্বোধের মতো কাজ করতে বলত তাহলে নিশ্চয়ই তাকে আমি উপহাস করতুম। যাই হোক, মাথায় হেডল্যাম্প জ্বালিয়ে রাইফেল বাগিয়ে ধরে হল্টন গুহার মধ্যে প্রবেশ করলে।

খোঁচা-খাওয়া বাঘ অতি ভয়ংকর জীব, তার উপর এই জন্তুটা নররক্তের স্বাদ পেয়েছে হল্টন বুঝেছিল আহত নরভুক যদি আজ পলায়ন করতে পারে তবে এই অঞ্চলটাকে সে শ্মশান করে দেবে। অপরিচিত বিদেশি মানুষগুলির জীবন রক্ষা করার জন্য হল্টন ম্যাককোয়েড স্বেচ্ছায় এগিয়ে গেল। সে গুহার মধ্যে প্রবেশ করলে। দু-ধারে উঠে গেছে খাড়া পাথরের দেয়াল, মাঝখান দিয়ে চলে গেছে একটা পথ গুহার ভিতর দিকে। পথটা হঠাৎ ভিতর দিকে ঘুরে গেছে। হল্টন পথটা ধরে এগিয়ে এসে বাঁ-দিকে ফিরল, তারপর স্থির হয়ে দাঁড়াল। গুহার ভিতর দিকে আলোর প্রবেশ নিষেধ। অস্পষ্ট অন্ধকার ভেদ করে হেডল্যাম্পের আলোর রেখা জ্বলন্ত বর্শার মতো পাথরের দেওয়ালে আছড়ে পড়ল। হল্টন মাথা ঘুরিয়ে চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে। বাইরের আলো থেকে গুহার অন্ধকারের মধ্যে এসে তার চক্ষু প্রায় অন্ধ হয়ে পড়েছিল। ধীরে ধীরে গুহার অন্ধকার সহনীয় হয়ে এল শিকারির চোখে… পিছন থেকে ভেসে এল চীনাদের কোলাহল-ধ্বনি। তারা উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। কাঠে কাঠে ঠোকাঠুকি করে তারা শব্দ করছে… ঠক ঠক ঠক…

গুহার মুখ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে আগুনের রক্তিম আলোকধারা কালো পাথরের বুকে তীব্র প্রতিফলনে জ্বলছে রক্তরাঙা আলোর জ্বলন্ত স্বাক্ষর… ফট ফট করে কাঠ ফাটার শব্দ হল। পাথরের বুকে প্রতিফলিত অগ্নিশিখা হয়ে উঠল আরও উজ্জ্বল, আরও তীব্র। হল্টন বুঝল চীনারা শুধু শিকারির ক্ষমতার উপর নির্ভর করতে রাজি নয়। বাঘ যদি কোনো কারণে শিকারিকে ফাঁকি দিয়ে গুহার মুখে চলে আসে তাহলেও যাতে সে বাইরে এসে তাদের আক্রমণ করতে না পারে সেইজন্যই গাছের ডাল প্রভৃতির সাহায্যে তারা আক্রমণের তেজ বাড়িয়ে দিলে।

হল্টন এগিয়ে চলল।

হেডল্যাম্পের আলো অন্ধকার ভেদ করে ছুটে গেল, তারপর হারিয়ে গেল দীর্ঘ প্রস্তর-আবৃত পথের উপর। আলোর সীমানার মধ্যে ধরা দিল কঠিন প্রস্তর-সরণীর একটা ক্ষুদ্র অংশ, তারপরই আলোর রেখাটা হারিয়ে গেল অন্ধকারের গর্ভে। হল্টন নিঃশব্দে পা ফেলার চেষ্টা করছিল, কিন্তু তার চেষ্টা সফল হল না। প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গেসঙ্গে নীচে ক্ষীণ শব্দে প্রতিবাদ জানাতে লাগল কঠিন পাথুরে জমি, ঘর্ষিত চর্মপাদুকার ক্ষীণধ্বনি অস্পষ্ট প্রতিধ্বনি তুলল গুহার দেয়ালে…

শিকারির মনে হল অন্ধকারের বিদেহী আত্মা যেন ফিস ফিস করে গুহাবাসী ভয়ংকরকে সাবধান করে দিচ্ছে, ভাষাহীন ভাষায় জানিয়ে দিচ্ছে অবাঞ্ছিত আগন্তুকের আগমন-বার্তা হিংস্র শ্বাপদের কানে কানে। হল্টন একবার পা ফেলে আবার থমকে দাঁড়ায়, কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে… যদি কোনো সন্দেহজনক শব্দ কানে আসে, ব্যাঘ্রের অসতর্ক পদক্ষেপে স্থলিত প্রস্তরখণ্ড যদি একবার জানিয়ে দেয় তার অস্তিত্ব। উৎকর্ণ উদগ্রীব শিকারি কম্পিত বক্ষে এগিয়ে চলে সামনের দিকে। আতঙ্ক ও উদবেগের শীতল স্রোত ছুটে যায় দেহের শিরায় শিরায়… কিন্তু তবু সে এগিয়ে চলে। তার উপর নির্ভর করছে অনেকগুলি মানুষের নিরাপত্তা। অন্ধকারের অশরীরী আত্মা যেন অকস্মাৎ রূপ পরিগ্রহ করল- আলোর রেখার মধ্যে হঠাৎ দেখা দিল একটা উড়ন্ত কালো ছায়া– বাদুড়। হল্টন চমকে উঠল। বাদুড়টা উড়ে এল হল্টনের দিকে, কয়েকবার তার মাথার চারদিকে পাক খেয়ে ঘুরল–তীব্র তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বারংবার চিৎকার করে জানিয়ে দিলে, গুহার অন্ধকারের মধ্যে আলোকধারী আগন্তুককে তার মোটেই পছন্দ হয়নি। শুধু একটিমাত্র বাদুড় নয়। আরও তিন চারটে বাদুড়ের আবির্ভাবে সচকিত শিকারি গুহার ছাদের দিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করতেই দৃষ্টিপথে ধরা দিল অসংখ্য বাদুড়। হ্যাঁ, অসংখ্য যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই দেখা যায়, দলে দলে বাদুড় গুহার ছাদ অবলম্বন করে ঝুলছে। চুন আর জলের সংমিশ্রণে নিরেট পাথরের মতো শক্ত স্ট্যালাকটাইট (stalactite) বর্শাফলকের মতো গুহার ছাদ থেকে নীচের দিকে নেমে এসেছে পাথুরে চুনের সেই কঠিন আধারগুলি হয়েছে বাদুড়দের আশ্রয়স্থল। শুধু ছাদের উপর নয়- বর্ষার জল গলিত চুনের উপর পড়েছে, গুহার দিকে দিকে উপরের স্ট্যালাকটাইটের স্পর্শলাভ করার জন্য ভূমিপৃষ্ঠ থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে অসংখ্য সুচিময় চুনের স্তম্ভ স্ট্যালাগমাইট (stalgamite)। নিরেট চুনের স্তম্ভগুলি ঝক ঝক করে উঠল– শিকারির মনে হল এক মহাকায় দানবের প্রসারিত মুখগহ্বর থেকে উঁকি দিচ্ছে দু-পাটি করাল দন্তের সারি…

হঠাৎ গুহার অন্ধকার যেন এক জায়গায় সজীব হয়ে উঠল। ভূমিপৃষ্ঠে দণ্ডায়মান চুনের স্তম্ভগুলির ভিতর দিয়ে হেডল্যাম্পের আলোক-রেখা যেখানে ঘন অন্ধকারের প্রান্তদেশ চুম্বন করেছে, ঠিক সেই জায়গায় যেন একটা কালো ছায়া নড়ে উঠল…

এক এক জায়গায় চুনের স্তম্ভগুলি খুব কাছাকাছি পরস্পরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। গোড়ার দিকে প্রায় ছ-ফুট বা আট ফুট ব্যাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক-একটি স্ক্যালাগমাইট বা চুনের স্তম্ভ। এই স্তম্ভগুলির মধ্যে যেকোনো একটির আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে বাঘ যদি বসে থাকে তাহলে হেডল্যাম্পের আলো তাকে কিছুতেই আবিষ্কার করতে পারবে না। হল্টন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। অবস্থাটা দস্তুরমতো অস্বস্তিকর। ধূর্ত শার্দুল তার নাগালের মধ্যে শিকারিকে পাওয়ামাত্র আক্রমণ করবে– একটা চুনের স্তম্ভের পিছন থেকে যদি সে হঠাৎ শিকারির উপর লাফিয়ে পড়ে তাহলে গুলি চালানোর সময়ই পাওয়া যাবে না, নিশানা স্থির করে রাইফেলের ঘোড়া টেপার আগেই ক্ষুরধার দত্ত ও নখরের প্রচণ্ড আপ্যায়নে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে শিকারির দেহ। হল্টন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। সে চারদিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করলে বিশাল গুহাকন্দরের দক্ষিণে, বামে, সম্মুখে শুধু স্ট্যালাগমাইটের সারি সারি স্তম্ভ- কোনটার আড়ালে বাঘ লুকিয়ে আছে কে জানে! হঠাৎ পিছন থেকে হল্টনের কানে একটা শব্দ ভেসে এল খট! পরক্ষণেই সেই ক্ষীণ শব্দ প্রচণ্ড প্রতিধ্বনি তুলল গুহার আনাচেকানাচে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো রাইফেল উঁচিয়ে হল্টন পিছন ফিরল কিছু নেই, কেউ নেই। হল্টন মাথায় বাঁধা আলোটাকে চারদিকে ঘুরিয়ে দেখল। কোথাও কিছু নেই। সে ভাবল হয়তো উপর থেকে এক টুকরো স্ট্যালাকটাইট গুহার মেঝের উপর এসে পড়েছে কিন্তু তার তীব্র অনুভূতি এই যুক্তি স্বীকার করতে চাইল না। দারুণ আতঙ্কে তার বকের ভিতর হৃৎপিণ্ডটা চঞ্চল হয়ে উঠেছে, নিশ্বাস হয়ে উঠেছে দ্রুত অতি দ্রুত… ওঃ! একবার যদি জন্তুটাকে দেখতে পেত… সে জানত হিংস্র শ্বাপদ তার প্রতিটি পদক্ষেপ লক্ষ করছে, আলো-আঁধারির ছায়ামাখা ভূতুড়ে চুনের স্তম্ভগুলির ভিতর থেকে তার দৃষ্টি একবারও জন্তুটার অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে পারল না। হঠাৎ একটা চুনের স্তম্ভের দিকে হল্টনের নজর পড়ল। স্ট্যালাগমাইটের ঘন অরণ্যের মধ্যে এই স্তম্ভটার বৈশিষ্ট্য তার দৃষ্টি আকৃষ্ট করলে– মাঝখান থেকে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে উঠে গেছে এই অদ্ভুত চুনের স্তম্ভ ঠিক ইংরেজি অক্ষরের মতো। হল্টনের মনে হল এই y-এর মধ্যবর্তী স্থলে যেন কোনো সজীব পদার্থের অস্তিত্ব আছে। খুব ভালো করে নজর চালিয়েও সে কিছুই দেখতে পেল না, তবু শিকারির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন তাকে বারংবার সাবধান করে দিল।

আছে! আছে! আছে!

দৃঢ় মুষ্টিতে রাইফেল চেপে ধরে সে এগিয়ে চলল, তার সতর্ক চক্ষুর তীব্র দৃষ্টি সন্দেহজনক জায়গাটার উপরেই আটকে রইল– মুহূর্তের জন্যও সে অন্যদিকে চোখ ফেরাতে সাহস করল না। ঠিক বাঘের মতোই গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চলল হল্টন ম্যাককোয়েড…

কাছে, কাছে, আরও আছে… মুহূর্তের জন্য তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল অস্পষ্ট আলো-আঁধারির মধ্যে জ্বলে উঠেছে একজোড়া কপিশ-সবুজ চক্ষু। ভয়ংকরের সামনে এসে দাঁড়াতেই শিকারির ভয় দূর হয়ে গেল। অকম্পিত অভ্যস্ত হাতে সে তুলে ধরলে রাইফেল। আর একটি মুহূর্ত– তারপরই নরখাদকের মৃতদেহ লুটিয়ে পড়বে তপ্ত বুলেটের দংশনে। হঠাৎ নিভে গেল জোনাকির মতো জ্বলন্ত দুই চোখের আগুন। রাইফেল অগ্নি-উদগার করার আগেই বাঘ স্থান পরিবর্তন করেছে। হল্টন চমকে উঠল। গুহার নীরবতা ভঙ্গ করে বেজে উঠেছে এক অবরুদ্ধ কণ্ঠের গর্জনধ্বনি! ক্রমশ সেই অনুচ্চ ওঃ গভীর কণ্ঠস্বর হয়ে উঠল তীব্র থেকে তীব্রতর, অকস্মাৎ শ্বাপদের রুদ্ধ আক্রোশ বজ্ৰনাদে ফেটে পড়ল গুহার অন্দরে কন্দরে। ক্রুদ্ধ শার্দুল তার ক্রোধ প্রকাশ করছে, গর্জিত কণ্ঠে সাবধান করে দিচ্ছে শিকারিকে এসো না! এসো না! এসো না। এদিকে পা বাড়ালে নিশ্চিত মৃত্যু।

মুহূর্তের জন্য শিকারির দৃষ্টিপথে ধরা দিল একটা বিশাল ডোরাকাটা দেহ। কিন্তু শুধু একটি মুহূর্ত পরক্ষণেই বিদ্যুৎ-ঝলকের সেই মহাকায় মার্জার প্রবেশ করলে ঘনসন্নিবিষ্ট স্ট্যালাগমাই জটিল অরণ্যে। কিন্তু হল্টন নাছোড়বান্দা শিকারি। সে তৎক্ষণাৎ দ্রুতপদে বাঘকে অনুসরণ করলে। মাথা ঘুরিয়ে সে জন্তুটাকে হেডল্যাম্পের সীমানার মধ্যে রাখতে চাইল। শিকারির উদ্দেশ্য বুঝতে বাঘের বিলম্ব হয়নি। অভিজ্ঞ নরভুক আলোর রেখাটাকে ফাঁকি দেবার চেষ্টা করতে লাগল, তার দ্রুত ধাবমান দেহের রেখাগুলি আলো-আধারির মধ্যে বার বার চমকে উঠল আর মিলিয়ে গেল, চমকে উঠল আর মিলিয়ে গেল এক ভৌতিক দুঃস্বপ্নের মতো… হল্টন আর ছুটছে না। হেডল্যাম্পের আলোর রেখাটাকে ফাঁকি দিয়ে বাঘ অন্ধকারের গর্ভে আত্মগোপন করেছে। খুব সাবধানে পা টিপে টিপে এগিয়ে চলল হল্টন- ধূর্ত নরখাদক হয়তো অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে প্রতীক্ষায় ওত পেতে রয়েছে… হল্টন এগিয়েছে– সাবধানে, অতি সাবধানে সতর্ক পদক্ষেপে… বিরাট গুহাপথের যেন শেষ নেই- চুনের স্তম্ভগুলি আর এখন বেশি চোখে পড়ছে না– গুহার প্রস্তর-প্রাচীর দু-পাশ থেকে চেপে ধরেছে মধ্যবর্তী সরণিকে, ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে আসছে প্রশস্ত গুহাপথ।

অন্ধকার! অন্ধকার! অন্ধকার!

 গুহার অন্দরমহলে যেন অন্ধকারের চির-রাজত্ব এখানে দাঁড়িয়ে কেউ বলতে পারবে না যে গুহার বাইরে পৃথিবীর বুকে জ্বলছে সূর্যের আলোকধারা। শিকারি যত ভিতরদিকে ঢুকছে, গুহার অন্ধকার যেন ততই ঘন হয়ে উঠছে। হেডল্যাম্পের আলোতে হঠাৎ হল্টনের দৃষ্টিপথে ভেসে উঠল আরও অনেকগুলি গুহাপথ। মূল রাস্তাটার দু-পাশ দিয়ে চলে গেছে একাধিক সংকীর্ণ রাস্তা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় শিকারি দাঁড়িয়ে পড়ল। বাঘ কোন পথে গেছে? শক্ত পাথুরে জমিতে বাঘের পদচিহ্ন আবিষ্কার করা সম্ভব নয়- হল্টন একবার বাঁ-দিকের গলিপথে মাথার আলোটাকে ঘুরিয়ে ধরলে। ঠিক সেই মুহূর্তে ডান দিকের গলির ভিতর থেকে একটা শব্দ ভেসে এল শিকারির কানে। অভিজ্ঞ শিকারি তৎক্ষণাৎ শব্দের কারণ বুঝতে পারল প্রস্তর-কঠিন গুহাপথের বুকে দ্রুত সংঘাতে আওয়াজ তুলেছে শ্বাপদের তীক্ষ্ণ নখর। শব্দ লক্ষ করে বিদ্যুদূবেগে ঘুরে দাঁড়াল হল্টন- কিন্তু দেরি হয়ে গেছে। এক মুহূর্তের জন্য শিকারির চোখে পড়ল একজোড়া জ্বলন্ত সবুজ চক্ষু, রক্তিম মুখগহ্বরের ভিতর থেকে ঝকঝক করে উঠল ইস্পাতশুভ্র তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি– হল্টন নিশানা করার সময় পেল না, ক্ষিপ্রহস্তে রাইফেলের ঘোড়া টিপে দিলে। বদ্ধ গুহাপথে প্রচণ্ড প্রতিধ্বনি তুলে সগর্জনে অগ্নিবৃষ্টি করলে শিকারির রাইফেল। হেডল্যাম্পের আলোতে হল্টন দেখল, জন্তুটার মস্তক ভেদ করে ছিটকে উঠছে। লাল রক্তের ফোয়ারা। রাইফেলের বুলেট বাঘের মাথায় কামড় বসিয়েছে। কিন্তু দুরন্ত শ্বাপদ ভূমিশয্যা গ্রহণ করতে রাজি হল না। ধারালো নখরযুক্ত একটা প্রকাণ্ড থাবা এগিয়ে গেল। শিকারির দিকে। সংকীর্ণ গুহাপথের মধ্যে সরে গিয়ে আত্মরক্ষা করার উপায় ছিল না, একটা সনখ থাবা বিদ্যুদবেগে শিকারির মস্তক স্পর্শ করে পিছলে গেল- পরক্ষণেই ব্যাঘ্রের বিপুল সংঘাতে একপাশে ছিটকে পড়ল হল্টন ম্যাককোয়েড। গুহার কঠিন পাথরে স গেল শিকারির মাথা– অসহ্য যাতনায় অবশ হয়ে এল তার সর্বশরীর, আতঙ্কের হিমশীতল স্রোত ছুটে গেল দেহের শিরায় শিরায়। সরে যাও! সরে যাও! পালিয়ে যাও এই মৃত্যুপুরী থেকে.. হল্টন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুট দিল এবং পাথরে হোঁচট খেয়ে আবার ভূমিশয্যায় লম্বমান হয়ে পড়ল। বিষে বিষক্ষয়–দ্বিতীয়বার আঘাত পেয়ে হল্টনের সম্বিত ফিরে এল। এতক্ষণে সে বুঝল তার চারদিকে বিরাজ করছে নিবিড় নিরন্ধ্র অন্ধকার।

হেডল্যাম্পের বিজলিবাতি?

ব্যাঘ্রের আক্রমণে সে যখন ছিটকে পড়েছিল তখনই পাথরের গায়ে ধাক্কা লেগে বাতিটা ভেঙে গেছে।

রাইফেল? রাইফেল কোথায়?

হল্টন অন্ধকারে মেঝের উপর হাত বুলিয়ে খুঁজতে লাগল তার একমাত্র হাতিয়ার। কিন্তু কোথায় রাইফেল? তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছে, মাথার স্নায়ুগুলো অসহ্য যাতনায় তবু অবশ দুই হাত বাড়িয়ে গুহার পাথুরে জমি হাতড়াতে লাগল বিমূঢ় শিকারি।

হল্টনের পিছনে একটা শব্দ শোনা গেল। মৃদু, অস্পষ্ট নিশ্বাসের শব্দ। সেই অস্পষ্ট ধ্বনিতরঙ্গ এগিয়ে আসছে শিকারির দিকে মৃত্যুর সংকেতধ্বনি। দুই চক্ষু বিস্ফারিত করে হল্টন অন্ধকারের মধ্যেই দৃষ্টি সঞ্চালন করলে। কিন্তু আঁধার-সমুদ্র ভেদ করে কিছুই দেখতে পেল না। যে শত্রু তাকে গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে, অন্ধকার তাকে গ্রাস করেছে।

আবার! আবার শোনা গেল সেই অস্পষ্ট শব্দ!

আহত বাঘ অতি কষ্টে নিশ্বাস ফেলছে, রুদ্ধশ্বাসনালীর ভিতর থেকে সেই নিশ্বাস বেরিয়ে আসছে। শিকারি বুঝল ব্যাঘ্রের অন্তিমকাল উপস্থিত, কিন্তু শ্বাপদের তীব্র প্রতিহিংসা এখনও তৃপ্ত হয়নি, তাই মরণাহত শার্দুল এগিয়ে আসছে শিকারির দিকে… ভয়াবহ অবস্থা! গুহার নীরন্ধ্র অন্ধকার শিকারির দৃষ্টিকে করে দিয়েছে অন্ধ, কিন্তু জান্তব চক্ষু অন্ধকার ভেদ করে শত্রুকে দেখতে পেয়েছে যাতনা-কাতর দেহটাকে কোনোরকমে বহন করে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তার প্রতিহিংসা-বৃত্তিকে চরিতার্থ করতে। তীক্ষ্ণ নখের ঘর্ষণে পাথরের বুকে বেজে উঠেছে মৃত্যুর পদধ্বনি…

হল্টনের বাঁ-হাত হঠাৎ একটা কঠিন বস্তুর উপর পড়ল। জিনিসটা পাথর নয় আঙুল দিয়ে অনুভব করে সে বুঝল বস্তুটি অতিশয় মসৃণ শিকারির বুকের ভিতর জাগল আশ্বাস ও আনন্দের শিহরন; মসৃণ বস্তুটি আর কিছুই নয়, রাইফেলের বাঁট!

যেদিক থেকে বাঘের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে, সেইদিকে ঘুরে হল্টন জমির উপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল এবং রাইফেল বাগিয়ে ধরল। পাথরের উপর ধারালো নখের ঘর্ষণ-ধ্বনি শোনা গেল। অন্ধকারের মধ্যেই হল্টন অনুভব করলে, নরখাদক খুব কাছে এসে পড়েছে বাঘের গায়ের দুর্গন্ধ তার নাকে ধাক্কা মারল। অন্ধকারের মধ্যে হাত বুলিয়ে হল্টন রাইফেলটাকে পরীক্ষা করলে। তারপর প্রস্তুত হল চরম মুহূর্তের জন্য। বাঘের কণ্ঠনিঃসৃত অস্পষ্ট শব্দ এবার খুব কাছে এসে পড়েছে। অতিকষ্টে শ্বাস ফেলছে বাঘ, নিশ্বাসের সঙ্গেসঙ্গে কণ্ঠনালীর মধ্যে সশব্দ আলোড়ন তুলে চঞ্চল হয়ে উঠছে রক্তের ফোয়ারা। অন্ধকারের কালো যবনিকা শিকারির দৃষ্টিকে অন্ধ করে দিলেও অভিজ্ঞ শিকারির শ্রবণ-ইন্দ্রিয় তাকে আহত পশুর শোচনীয় অবস্থা জানিয়ে দিলে। শব্দ এগিয়ে আসছে- নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, রুদ্ধ হয়ে আসে কণ্ঠনালী। তবু এগিয়ে আসে মরণাহত শার্দুল, দন্ত আর নখরের মৃত্যু-আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরতে চায় শত্রুকে, স্খলিত চরণে অন্ধকারের মধ্যে অতিকষ্টে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে মুমূর্ষ হিংসার প্রতিমূর্তি। একটা চাপা গর্জন শোনা গেল। তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল সেই শব্দ– শ্বাপদ কণ্ঠের রুদ্ধ গর্জন ক্রমশ গভীর বজ্রনাদের মতো প্রচণ্ড হুংকারে সাড়া দিয়ে উঠল– আক্রমণের পূর্বাভাস। হল্টন শব্দ লক্ষ করে রাইফেলের ঘোড়া টিপল। আঁধার-সমুদ্র ভেদ করে রাইফেলের মুখে জ্বলে উঠল চকিত অগ্নিশিখা। পলকের জন্য হল্টনের দৃষ্টিপথে ভেসে উঠল ব্যাঘ্রের ভয়াবহ মুখমণ্ডল।

প্রদীপ্ত হিংস্র চক্ষু আর দীর্ঘ শ্বাপদ-দন্তের নিষ্ঠুর বিস্তারে আত্মপ্রকাশ করেছে অরণ্যের ভীষণতম সৌন্দর্য। হল্টন আবার রাইফেলের ঘোড়া টিপল। আবার দেখা দিল রাইফেলের মুখে অগ্নিশিখার রক্তরাগ। অগ্নিময় এক শানিত ছুরিকার মতো গুহার অন্ধকারকে লেহন করে আবার অন্ধকারের গর্ভেই হারিয়ে গেল সেই রক্তিম আলোকের জ্বলন্ত জিহ্বা। শিকারির দৃষ্টিকে অন্ধ করে দিয়ে আবার নেমে এল আঁধারের যবনিকা… রাইফেলের বজ্রকণ্ঠে প্রচণ্ড রবে প্রতিধ্বনি তুলল গুহার অন্দরে-করে, বদ্ধ গহ্বরের মধ্যে সেই ভীষণ শব্দ শিকারির কানে দারুণ আঘাত করলে তবু ভূমিশয্যয় শুয়ে আহত ব্যাঘ্রের গতিবিধির শব্দ শোনার জন্য উদগ্রীব, উৎকর্ণ হয়ে রইল হল্টন… শিকারি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলে। তার চারদিকে বিরাজ করছে ঘন অন্ধকার নিঃশব্দ, ভয়ংকর… খুনে জানোয়ারটার কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে। না। পকেটে হাত দিয়ে হল্টন একটা দেশলাই বার করে জ্বালিয়ে ফেললে। সেই অস্পষ্ট আলোতে তার চোখের সামনে ভেসে উঠল ধরাশায়ী ব্যাঘ্রের বিপুল দেহ। গুহার পাথুরে জমির উপর লম্ববান হয়ে মরণ ঘুমে ঘুমিয়ে আছে রক্তাক্ত শার্দুল। এ জীবনে সে আর নরহত্যা করবে না। রাইফেলের বুলেট একেবারে তার মর্মস্থানে আঘাত করেছে। প্যান্টের পকেটে একটা কঠিন বস্তুর অস্তিত্ব অনুভব করলে হল্টন– কী ওটা?

সে নিজের মনেই হেসে উঠল। মনে পড়েছে। হ্যাঁ, মনে পড়েছে এতক্ষণে তার মাথাটাও পরিষ্কার হয়ে গেছে… ওটা একটা তেলের শিশি। সবসময় ওই ছোট্ট শিশিটাকে পকেটে রাখত হল্টন– দারুণ উদবেগ আর আশঙ্কায় ওই শিশিটার কথা সে ভুলেই গিয়েছিল। (শিশিতে অবশ্য সাধারণ তেল ছিল না। ওটা gun-oil. আগ্নেয়াস্ত্র পরিষ্কার করার জন্য ওই তেল শিকারিরা ব্যবহার করে।) ভিজে স্যাঁৎসেঁতে জায়গায় রাইফেলের পরিচর্যা করার জন্য তেলের শিশি এবং একটু করে কাপড় সবসময় হল্টনের পকেটে থাকত। কাপড়টাকে সে দড়ির মতো করে পাকিয়ে নিলে, তারপর সেই পাকানো বস্ত্রখণ্ডের একপ্রান্তে দেশলাই জ্বালিয়ে অগ্নিসংযোগ করলে। সেই অদ্ভুত কাপড়ের মশাল হাতে নিয়ে গুহার প্রবেশপথের দিকে অগ্রসর হল হল্টন।

চীনারা অপেক্ষা করছে গুহামুখে আগুন জ্বালিয়ে। তাদের মুখে-চোখে ফুটে উঠেছে আতঙ্ক ও উদবেগের ছায়া। গুহার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তারা দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করছে আর অপেক্ষা করছে আর অপেক্ষা করছে…।

আচম্বিতে গুহার মুখে আবির্ভূত হল এক মনুষ্যমূর্তি- হল্টন ম্যাককোয়েড। তার মুখের দিকে তাকিয়েই উদবিগ্ন চীনাম্যানরা বুঝল নরখাদক আর জীবিত নেই— দুশ্চিন্তা আর আতঙ্কের ছায়া সরে গেল ভয়ার্ত মানুষগুলির মুখ থেকে, চোখে-মুখে ফুটে উঠল আনন্দ আর আশ্বাসের চিহ্ন, কৃতজ্ঞ দৃষ্টি মেলে ভাষাহীন ভাষায় তারা অভিনন্দন জানাল বিদেশি শিকারিকে। গুহার মুখ ছেড়ে এগিয়ে এল হল্টন। সবচেয়ে বুড়ো চীনা কৃষকটিকে উদ্দেশ্য করে বললে, আমি জানি বাঘের নখ আর গেঁফ দিয়ে চমৎকার ওষুধ তৈরি হয়– তাড়াতাড়ি যাও, তোমাদের প্রাপ্য পুরস্কার গুহার ভিতরেই পড়ে আছে। হল্টন জানে চীনাদের কাছে বাঘের নখ এবং গোঁফ অতিশয় মূল্যবান বস্তু। চীনদেশে নবাগত হলেও যে লোকটি স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছিল, নিজের ব্যাধবৃত্তিকে চরিতার্থ করে শখের আনন্দে, কুড়িয়ে নেবার জন্য মূর্খ এশিয়াবাসীদের নরখাদক রাক্ষসের গ্লাসে ফেলে রাজি হয়নি যে শ্বেতাঙ্গ– সেই নাম-না-জানা লোকটির নাম হল্টন ম্যাককোয়েড।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *