মরণে মুক্তি (প্রথম অংশ)

মরণে মুক্তি 

প্রথম পরিচ্ছেদ 

বেলা দশটার সময় একটা চোরাই মালের সন্ধানে বাহির হইতেছি, এমন সময় সংবাদ পাইলাম, কাশীপুর রোডে একটা ভয়ানক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হইয়াছে এবং তাহারই তদ্বির করিবার জন্য আমাকে তখনই কাশীপুরে যাইতে হইবে। অগত্যা যে কাৰ্য্যে যাইতেছিলাম, তাহা কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত রাখিলাম এবং একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ি করিয়া কাশীপুরাভিমুখে যাইতে লাগিলাম। 

বেলা দশটা বাজিয়াছে, স্কুল-কলেজের ছাত্রগণ পুস্তক লইয়া দলে দলে গল্প করিতে করিতে রাজপথ দিয়া গমন করিতেছে, কেরাণীর দল হাসিতে হাসিতে কেহ বা পদব্রজে কেহ বা ট্রামের সাহায্যে আপন আপন আফিসের দিকে ছুটিতেছেন, ভাড়াটিয়া গাড়ির কোচমানগণ হাঁকাহাঁকি করিলেও সেদিকে কেহই ভ্রুক্ষেপ করিতেছেন না। আমি একা সেই গাড়িতে বসিয়া কত কি চিন্তা করিতে করিতে প্রায় একঘণ্টার পর কাশীপুরে গিয়া উপস্থিত হইলাম। 

অট্টালিকার দ্বারদেশে উপনীত হইয়া দেখিলাম, বাড়ীখানি প্রকাণ্ড ও দ্বিতল। বহিদ্দেশে দুইজন দ্বারবান্ একখানি বেঞ্চের উপর অতি বিমর্ষভাবে বসিয়া ছিল। একজন কনেষ্টবল তাহাদের নিকট বসিয়া অতি মৃদুস্বরে কি কথা কহিতেছিল। আমাকে দেখিয়াই সে দাঁড়াইয়া উঠিল, এক সুদীর্ঘ সেলাম করিল, পরে আমাকে লইয়া ভিতরে প্রবেশ করিল। দ্বারবাদ্বয়ের মধ্যে একজন আমাদের অনুসরণ করিল। অপর ব্যক্তি দ্বারদেশে প্রহরীর কার্য্যে নিযুক্ত রহিল। 

ভিতরে প্রবেশ করিয়া বাড়ীর লোককে দেখিতে পাইলাম না। কেবল একজন সরকার আমার নিকটে আসিল। তাহার আকৃতি দেখিয়াই বুঝিতে পারিলাম, সেও অত্যন্ত শোকান্বিত হইয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলাম “তোমার নাম কি? বাড়ীর বাবুরা কোথায়?” 

সরকার অতি বিমর্ষ ভাবে উত্তর করিল “আমার নাম হরিদাস। আমি এ বাড়ীর সরকার। বাবুদের মধ্যে কর্তাবাবুই মারা গিয়াছেন। বড় দাদাবাবুকে সন্দেহ করিয়া পুলিসে গ্রেপ্তার করিয়া লইয়া গিয়াছে। ছোট দাদাবাবু এখনও আসিয়া পঁহুছান নাই। এখান হইতে তার পাঠান হইয়াছে, তিনি শীঘ্র আসিয়া পড়িবেন।” 

আমি আন্তরিক বিরক্ত হইলাম। জিজ্ঞাসা করিলাম “বাবুদের মধ্যে কি কেহই বাড়ীতে নাই?” 

সরকার কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিল “ছোট দাদাবাবুর একজন বন্ধু এ বাড়ীতে আছেন। কিন্তু আজ প্রাতঃকাল হইতে তাঁহাকে দেখিতে পাইতেছি না।” 

আ। “বাড়ীতে কয়জন লোক?” 

স। কর্তাবাবু-যিনি মারা গিয়াছেন; তাঁহার দুই ভ্রাতুষ্পুত্র; জ্যেষ্ঠের নাম সত্যেন্দ্র, কনিষ্ঠের নাম নগেন্দ্র। এক ভ্রাতুষ্পুত্রবধু—নাম সরযূবালা, সত্যেন্দ্রবাবুর স্ত্রী। নগেন্দ্রনাথ এখনও অবিবাহিত। ইহারা ভিন্ন, গিন্নির দূর-সম্পর্কীয় এক ভগিনী আছেন। আর সম্প্রতি নগেন্দ্রবাবুর এক বন্ধু কিছুদিনের জন্য এখানে বাস করিতেছেন। 

আ। নগেন্দ্রবাবুর বন্ধুটির নাম কি? 

স। অহীন্দ্রনাথ। 

আ। তাঁহার আদি নিবাস? 

স। শুনিয়াছি ঢাকায় 

এই প্রকার কথাবার্তা হইতেছে, এমন সময় স্থানীয় থানার দারোগাবাবু তথায় আগমন করিলেন এবং আমায় দেখিয়া হাসিতে হাসিতে বলিলেন “যখন হত্যাকারী গ্রেপ্তার হইয়াছে, তখন আর আপনাকে বিশেষ কোন কষ্ট পাইতে হইবে না।” 

আমি ত হাসিতে হাসিতে তাঁহাকে সকল কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেন “রাত্রি প্রায় দুইটার সময় একজন ভৃত্য থানায় গিয়া সংবাদ দিল, রাধামাধববাবুকে কে খুন করিয়াছে। রাধামাধববাবু এখানকার একজন মাননীয় লোক। এখানকার সকলেই তাঁহাকে শ্রদ্ধা-ভক্তি করিয়া থাকেন। তাঁহাকে খুন করিয়াছে শুনিয়া আমি তখনই এখানে আসিয়া উপস্থিত হইলাম এবং সেই ভৃত্যের সহিত একেবারে বাবুর শয়ন-গৃহে গমন করিলাম। দ্বারদেশে উপনীত হইবামাত্র সহসা সেই গৃহদ্বার উন্মুক্ত হইল এবং সঙ্গে সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথ শাণিত রক্তাক্ত ছোরা হস্তে বাহির হইলেন। সত্যেন্দ্রবাবু আমার পরিচতি—তাঁহার তৎকালীন বিমর্ষ মুখ, সশঙ্কিত ভাব ও পলায়নের চেষ্টা দেখিয়া আমি তাঁহাকেই দোষী বলিয়া সন্দেহ করিলাম এবং তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিয়া থানায় চালান দিলাম। তাহার পর গৃহের ভিতর প্রবেশ করিয়া চারিদিক ভাল করিয়া পরীক্ষা করিলাম। দ্বার রুদ্ধ করিয়া হেড আফিসে টেলিগ্রাম করিলাম। এখন আপনি আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন, আমায় যেমন আদেশ করিবেন, সেইমত কার্য্য করিব।” 

দারোগাবাবু আমার পরিচিত ছিলেন। আমি তাঁহার কথায় তখন কোন কথা বলিলাম না। প্রথমেই রাধামাধববাবুর শয়ন-কক্ষ পরীক্ষা করিবার ইচ্ছা হইল। আমি তখনই নিজ অভিপ্রায় দারোগাবাবুর কর্ণ গোচর করিলাম। তিনিও দ্বিরুক্তি না করিয়া আমায় সেই গৃহে লইয়া গেলেন। 

গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, ঘরকানি বেশ বড়। দৈর্ঘ্যে প্রায় বার হাত, প্রস্থেও দশ হাতের কম নয়। ঘরে একটি দরজা বটে, কিন্তু আটটি বড় বড় জানালা ছিল। আসবাবের মধ্যে একখানি অতি সুন্দর মূল্যবান খাট, তাহার উপর দুগ্ধফেননিভ সুকোমল শয্যা। সেই শয্যার উপর রাধামাধববাবুর রক্তাক্ত দেহ। ঘরের অপর পার্শ্বে একটা প্রকাণ্ড আলমারি; তাহার দুইপার্শ্বে দুইটি ক্ষুদ্র দেরাজ। একটি দেরাজের উপর একখানা প্রকাণ্ড আয়না, অপরটির উপর একটি বিলাতী ঘড়ী। ঘরের মধ্যে তিন চারিটি আলোকাধার। সমুদয় মেঝের উপর মাদুর পাতা। 

প্রথমেই মৃতদেহ পরীক্ষা করিলাম। দেখিলাম, কোন শাণিত ছোরার আঘাতেই তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছেন। পৃষ্ঠের এমন স্থানে আঘাত করা হইয়াছে যে, সেই এক আঘাতেই তাঁহার প্রাণবায়ু দেহত্যাগ করিয়াছে। আঘাতের অবস্থা দেখিয়া স্পষ্টই বোধ হইল যে, রাধামাধবাবুর সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারেই হত্যাকারী সেই গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল এবং তাঁহার পশ্চাৎ দিক হইতে সজোরে এক আঘাত করিয়াছিল। 

এই সকল ব্যাপার অবলোকন করিয়া আমি দারোগাবাবুকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “সত্যেন্দ্রনাথ কি নিজদোষ স্বীকার করিয়াছেন?” 

দারোগাবাবু অগ্রাহ্য ভাবে উত্তর করিলেন, “না করিলেও তিনি যে হত্যাকারী সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।” আমি বিরক্ত হইলাম। পরে দারোগাবাবুর মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “তিনি কি বলিয়াছেন সেই কথা বলুন? আমি আপনার সন্দেহের কথা জিজ্ঞাসা করিতেছি না।” 

দারোগাবাবু অপ্রতিভ হইলেন। তিনি বলিলেন, “আজ্ঞে তিনি ত আপনাকে নিদোষীই বলিবেন। তিনি বলেন, সহসা “খুন করিল” “খুন করিল” এই শব্দ শুনিয়া তিনি আপনার গৃহ হইতে বহির্গত হন এবং তখনই চারিদিক অন্বেষণ করেন। কিন্তু কোথাও কাহাকে দেখিতে না পাইয়া যেমন পুনরায় নিজ গৃহে প্রবেশ করিতেছিলেন, সেই সময়ে তাঁহার মাসিমা আসিয়া বলিলেন যে, তাঁহার জ্যেঠামহাশয়কে কোন লোক হত্যা করিয়া পলায়ন করিয়াছে। তিনি তখনই তাঁহার সহিত পরামর্শ করিয়া থানায় সংবাদ পাঠাইয়া দেন। পরে যখন তিনি তাঁহার জ্যেঠামহাশয়ের ঘর হইতে বাহির হইতেছিলেন, সেই সময়ে একখানি শাণিত ছোরা মেঝের উপর দেখিতে পান। ছোরাখানি তুলিয়া লইয়া যেমন তিনি সেই ঘর হইতে বাহির হইতেছিলেন, ঠিক সেই সময়ে আমি আসিয়া উপস্থিত হই।” 

এই বলিয়া দারোগাবাবু ঈষৎ হাস্য করিলেন। পরে বলিলেন “আমি ত সে কথা বিশ্বাস করিতে পারিলাম না। তাঁহার মুখের অবস্থা ও সদাই ভীতিভাব দেখিয়া তাঁহাকেই হত্যাকারী বলিয়া স্থির করিয়াছি।” 

আ। বাড়ীর আর কাহাকেও কোন কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন? 

দা। বাড়ীতে আর কোন পুরুষমানুষ নাই; কেবল চাকর নফরের কথায় বিশ্বাস করিয়া কোন কাজ করা যায় না। বাড়ীর সরকার হরিদাসের মুখে যেরূপ শুনিয়াছি, তাহাতে সত্যেন্দ্রনাথের উপরই অধিক সন্দেহ হয়। 

আ। হরিদাস কি বলিয়াছিল? 

দা। সত্যেন্দ্রনাথের সহিত রাধামাধববাবুর সম্প্রতি ভয়ানক কলহ হইয়াছিল। তাহাতে সত্যেন্দ্রনাথ তাঁহার জ্যেঠামহাশয়কে যৎপরোনাস্তি অপমানিত করেন এবং রাধামাধববাবু সত্যেন্দ্রনাথকে বাড়ী হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দেন। 

আ। তবে আবার সত্যেন্দ্রনাথ এ বাড়ীতে আসিলেন কিরূপে? 

দা। রাধামাধববাবু তাঁহাকে দূর করিয়া দিলে কিছুদিন পরে তিনি পুনরায় জ্যেঠামহাশয়ের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া বাড়ীতে বাস করিবার অনুমতি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। 

আ। নগেন্দ্রনাথের একজন বন্ধু না কি এ বাড়ীতে বাস করেন? 

দারোগাবাবু যেন আকাশ হইতে পড়িলেন। তিনি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “সে কি! কে আপনাকে এ সংবাদ দিল?” 

আ। কেন? হরিদাস – বাড়ীর সরকার। বোধ হয় আপনি কোন কথা জিজ্ঞাসা করেন নাই। 

দা। না জানিলে কেমন করিয়াই বা জিজ্ঞাসা করিব? 

আ। আমিও জানিতাম না — তবে বাড়ীতে কয়জন লোক জিজ্ঞাসা করায় হরিদাস সকল কথাই বলিয়াছিল। দারোগাবাবু ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন “যখন বাড়ীতে প্রবেশ করিবামাত্র হত্যাকারীকে অস্ত্র সমেত গ্রেপ্তার করিতে সক্ষম হইলাম, তখন আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিবার প্রয়োজন হয় নাই।” 

আমিও হাসিয়া বলিলাম “সত্যেন্দ্রনাথ দোষী কি না, যতক্ষণ তিনি নিজে না বলিতেছেন, ততক্ষণ আপনি তাঁহাকে শাস্তি দিতে পারিতেছেন না।” 

দারোগাবাবু আমার কথায় বিরক্ত হইলেন। আমার কথা তাঁহার মনোমত হইল না। তিনি অতি মৃদুস্বরে বলিলেন “তাঁহাকে দোষী প্রমাণ করিতে অধিক কষ্ট পাইতে হইবে না।”

আমি ঈষৎ হাসিলাম মাত্র—কোন উত্তর করিলাম না। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ 

দারোগাকে বিদায় দিয়া আমি পুনরায় হরিদাসকে ডাকিয়া পাঠাইলাম। সে আসিলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “তোমার ছোটদাদাবাবু কোথায় গিয়াছেন?” 

হ। আজ্ঞে নৈহাটী। 

আ। কবে গিয়াছেন? 

হ। কাল বৈকালে। 

আ। কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে গিয়াছেন কি? 

হ। হাঁ-কর্তাবাবুর কোন আত্মীয়ের বাড়ীতে গিয়াছেন। 

আ। কখন তার পাঠান হইয়াছে? 

হ। আজ প্রাতে। 

আ। সত্যেন্দ্রনাথই কি কর্তাবাবুকে খুন করিয়াছেন? 

হরিদাস চমকিয়া উঠিল। কিছুক্ষণ ভাবিয়া সে বলিল “দারোগাবাবু এইরূপই সন্দেহ করেন। সেই জন্যই তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিয়াছেন।” 

আ। তোমার কি মনে হয়? 

হ। আমি বড় দাদাবাবুকে বিলক্ষণ চিনি, তাঁহার দ্বারা এ কার্য্য হইতে পারে না। 

আ। তবে তাঁহার হাতে রক্তাক্ত ছোরাখানি কোথা হইতে আসিল? 

হ। সে কথা বলিতে পারি না। তিনি এখানে ছিলেন না; কখন আসিলেন, তাহাও বলিতে পারি না। তবে আমার বোধ হয়, কৰ্ত্তাবাবু খুন হইয়াছে শুনিয়া তিনি তাঁহার ঘরে প্রবেশ করিয়াছিলেন। সম্ভবত রক্তাক্ত ছোরাখানি ঘরেই ছিল। তিনি ছোরাখানি হাতে লইয়া দেখিতেছিলেন, এমন সময় দারোগাবাবু সেখানে উপস্থিত হন। 

হরিদাসের কথা শুনিয়া আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করিলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম, “তিনি কোথায় ছিলেন?” হ। আজ্ঞে বৈদ্যনাথে। নানাপ্রকার দুশ্চিন্তায় তাঁহার স্বাস্থ্য ভঙ্গ হইয়াছিল। 

আ। একাই সেখানে ছিলেন? 

হ। আজ্ঞে হাঁ। 

আ। কতদিন? 

হ। প্রায় দুই মাস। 

আ। আজ কি তাঁহার আসিবার কথা ছিল? 

হ। আজ্ঞে হাঁ—কিন্তু তিনি যে কখন আসিয়াছেন, তাহা জানিতে পারি নাই। নিশ্চয়ই অধিক রাত্রে আসিয়াছিলেন। আমি গত রাত্রে প্রায় এগারটা পর্যন্ত জাগিয়াছিলাম। 

আমি কোন উত্তর করিলাম না। সত্যেন্দ্রনাথ কখন বাড়ী ফিরিয়াছিলেন, তাহা না জানিলে কোন কাৰ্য্যই হইবে না দেখিয়া, আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করিলাম। পরে হরিদাসকে আবার জিজ্ঞাসা করিলাম, “সত্যেন্দ্রনাথ কোন্ সময় বাড়ী ফিরিয়াছিলেন, এ সংবাদ কি বাড়ীর কেহই জানেন না? এ বড় আশ্চর্য্য কথা যে, বহুদিন পরে বাড়ীতে একজন লোক ফিরিয়া আসিলেন, এ সংবাদ বাড়ীর অপর কেহ রাখিলেন না? কেহই কি এ কথা বলিতে পারেন না?” 

হরিদাস কিছুক্ষণ কি ভাবিতে লাগিল। পরে অতি বিনীতভাবে বলিল “তাঁহার স্ত্রী জানেন? তিনি নিশ্চয়ই স্বামীর জন্য অপেক্ষা করিয়াছিলেন।” 

আমি বিষম ফাঁপরে পড়িলাম। কিন্তু হরিদাসকে বলিলাম, “তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া আইস।” 

হরিদাস চলিয়া গেল এবং কিছুক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল “কাল রাত্রি দুপুরের সময় দাদাবাবু বাড়ীতে ফিরিয়াছেন। আসিবার প্রায় একঘন্টা পরেই তিনি পুনরায় গৃহ হইতে বাহির হন। আর তাঁহাকে ফিরিয়া যাইতে হয় নাই। আপনার শয়নগৃহ হইতে বাহির হইবার কিছু পরেই গ্রেপ্তার হইয়াছেন।” 

আ। কেন তিনি বাহির হইয়াছিলেন? 

হ। তাঁহার স্ত্রী বলেন, ‘খুন হইয়াছে’’খুন হইয়াছে’”খুন করিল’ এই প্রকার চীৎকার ধ্বনি শুনিয়াই তিনি গৃহ হইতে বাহির হইয়া যান। 

আ। তাহা হইলে সত্যেন্দ্রবাবু ও তাঁহার স্ত্রী সে সময় জাগ্রত ছিলেন? 

হ। আজ্ঞে—নিশ্চয়ই ছিলেন। দুই মাস পরে দাদাবাবু গৃহে ফিরিয়াছেন। 

হরিদাসের কথায় আমার তৃপ্তি হইল না। কোন্ উপায়ে আমি আরও নূতন সংবাদ সংগ্রহ করিতে পারিব তাহাই চিন্তা করিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ পরে হরিদাসকে জিজ্ঞাসা করিলাম “তুমি ত প্রবীণ লোক, এ বাড়ীত কতকাল চাকরী করিতেছ?” 

হরিদাস ঈষৎ হাসিয়া বলিল, “আজ্ঞে এ বাড়ীতে চাকরী করিয়া মাথায় চুল পাকাইয়াছি, অধিক আর আর কি বলিব।” 

আমি সন্তুষ্ট হইলাম। পরে জিজ্ঞাসা করিলাম “সত্যেন্দ্রবাবুর কি কোন সন্তানাদি হইয়াছে?” 

হ। আজ্ঞে না। তাঁহার স্ত্রীর বয়স তের বৎসর মাত্র, দুই বৎসর হইল দাদাবাবুর বিবাহ হইয়াছে। 

আ। সত্যেন্দ্রনাথ কেমন চরিত্রের লোক? 

হ। অতি সচ্চরিত্র-আজ-কাল তেমন চরিত্রের লোক প্রায় দেখা যায় না। 

আমার বড় ইচ্ছা হইল সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রীর নিকট হইতে আরও অনেক কথা জানিয়া লই। কিন্তু কোন উপায় ত দেখিতে পাইলাম না। গৃহস্থের কন্যা, গৃহস্থের বধূর সহিত কেমন করিয়া কথা করিব? কিছুক্ষণ ভাবিয়া হরিদাসকে জিজ্ঞাসা করিলাম “তুমি সত্যেন্দ্রনাথকে ভালবাস? তাহা না হইলেই বা তাঁহাকে নির্দোষী বলিবে কেন?” 

হরিদাস বলিল “আমি কেন, দাদাবাবুকে ভালবাসে না এমন লোক অতি কম।” 

আ। বেশ কথা। তাহা হইলে তাঁহার মুক্তি হইলে তুমি নিশ্চয়ই আনন্দিত হও। 

হ। আজ্ঞে–নিশ্চয়ই। 

আ। আমিও তাঁহাকে নির্দোষী বলিয়া মনে করিতেছি; কিন্তু প্রমাণ করিবার কোন উপায় দেখিতে পাইতেছি না। যখন তিনি ধরা পড়েন, তখন তাঁহার হস্তে রক্তাক্ত ছোরা ছিল। শুনিয়াছি, ছোরাখানিতে তাঁহারই নাম লেখা—সুতরাং তাঁহারই। তাহার পর তাঁহার সহিত তাঁহার জ্যেঠামহাশয়ের কলহ। এই সকল কারণে তিনি নিশ্চয়ই দোষী বলিয়া সাব্যস্ত হইতে পারেন। আমার মুখের কথায় লোকে তাঁহাকে নির্দোষী বলিয়া মনে করিবেন না। যতক্ষণ না আমি প্রমাণ করিতে পারিব, ততক্ষণ কেহ বিশ্বাস করিবে না।” 

আমার কথায় হরিদাস যেন আন্তরিক সন্তুষ্ট হইল। সে সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিল “কি করিলে আপনি প্রমাণ করিতে পারেন, বলুন—আমি আপনার সাহায্য করিব।” 

আমি বলিলাম “আপাততঃ আমি কতকগুলি কথার উত্তর চাই। সেগুলির কিন্তু তুমি উত্তর করিতে পারিবে না। সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী করিবেন। তবে তিনি হিন্দুমহিলা, আমি কোন্ লজ্জায় তাঁহার সম্মুখে যাইতে সাহস করিব?” 

আমার কথায় হরিদাস ঈষৎ হাসিতে হাসিতে বলিল “আপনি তাহার পিতার সমান। বিশেষতঃ সরযূকে দেখিতে বালিকামাত্র, তাহার নিকট লজ্জিত হইবার কোন কারণ নাই। যদি বলেন, আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া আসি।” 

আমি সম্মত হইলাম, হরিদাস প্রস্থান করিল। কিছুক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল “সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী আপনার সহিত দেখা করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছেন। আপনি যে সত্যেন্দ্রনাথকে নির্দোষী মনে করিয়া তাহা প্রমাণ করিবার প্রয়াস পাইতেছেন, তাহা শুনিয়া তিনি বড় সন্তুষ্ট হইয়াছেন এবং আপনার নিকট বারম্বার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিয়াছেন।” 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ 

হরিদাসের কথা শুনিয়া আমি তখনই প্রস্তুত হইলাম এবং তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ অন্দরে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। হরিদাস আমাকে একটি গৃহের ভিতর লইয়া গেল। ঘরখানি নিতান্ত ক্ষুদ্র নয়। বাতাস ও আলোকের জন্য অনেকগুলি জানালা ছিল। ঘরের ভিতর একখানি পালঙ্কের উপর এক সুকোমল শয্যা। মেঝেয় একটা ঢালা বিছানা। আমি সেইখানে বসিতেছিলাম, হরিদাস নিষেধ করিল এবং আমায় সেই পালঙ্কের উপর বসিতে অনুরোধ করিল।” 

আমি সে অনুরোধ উপেক্ষা করিতে পারিলাম না – ধীরে ধীরে গাত্রোত্থান করিয়া পালঙ্কের উপর গিয়া উপবেশন করিলাম। হরিদাস আমায় সেখানে রাখিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল এবং কিছুক্ষণ পরে একটি বালিকাকে সঙ্গে লইয়া আমার নিকট আগমন করিল। 

বালিকাকে দেখিতে অতি সুন্দরী – বয়স ত্রয়োদশ বৎসরের অধিক নহে। বালিকা অৰ্দ্ধাবগুণ্ঠনবতী ছিল। তাহার চক্ষুদ্বয় রক্তবর্ণ ও স্ফীত হইয়াছিল। তখনও সেই আকর্ণবিস্তৃত লোচনদ্বয় হইতে ক্রমাগত অশ্রুধারা ঝরিতেছিল। বালিকা গৃহে প্রবেশ করিয়া আমার সম্মুখে আসিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিল। পরে মস্তক অবনত করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। 

হরিদাস গৃহের মধ্যেই ছিল। বালিকা গৃহে প্রবেশ করিলে পর সে গৃহদ্বার রুদ্ধ করিল। পরে আমার দিকে চাহিয়া বলিল “ইনিই বড়দাদাবাবুর স্ত্রী, কাল রাত্রি হইতে ক্রমাগত রোদন করিতেছেন। আমরা এত বুঝাইতেছি, ইনি কিছুতেই শান্ত হইতেছেন না। আপনি দাদাবাবুকে নির্দোষী বলিয়া মনে করেন শুনিয়া ইনি স্বইচ্ছায় আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছেন।” 

হরিদাসের কথা শুনিয়া আমি বালিকার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “মা– যখন কর্তাবাবু খুন হন, তখন তুমি ও সত্যেন্দ্রবাবু জাগ্রত ছিলে কি? আমি তোমার পিতার সমান। আমার নিকট কোন কথা গোপন করিও না। আমি জানি, তোমার স্বামী নির্দোষ; কিন্তু মা, আমার কথায় জজ সাহেব বিশ্বাস করিবেন কেন? যতক্ষণ না প্রকৃত হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করিতে পারিব, ততক্ষণ সত্যেন্দ্রনাথকে জেলে থাকিতে হইবে। তাই মা, তোমার সাহায্য প্রার্থনা করিতেছি। তোমার মুখে সকল কথা শুনিয়া কার্য্য আরম্ভ করিব।” 

আমার কথায় বালিকা আরও রোদন করিতে লাগিল। তাঁহার চক্ষু দিয়া অনর্গল বারিধারা বিগলিত হইতে লাগিল। আমি কোন কথা কহিলাম না। কিছুক্ষণ নীরবে রোদন করিয়া বালিকা অবশেষে আপনা আপনিই শান্তমূর্ত্তি ধারণ করিল এবং আমার পদতল লক্ষ্য করিয়া বলিল “কি করিলে আপনার সাহায্য করিতে পারি বলিয়া দিউন, আমি এখনই তাহা করিব। সরকারবাবুর মুখে শুনিলাম, আপনি তাঁহাকে নির্দোষী মনে করেন। তাই আমি কুলবধূ হইয়াও লজ্জা-সরমের মাথা খাইয়া আপনার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছি। তিনি এ যাত্রা রক্ষা পাইবেন ত?” 

আ। যতক্ষণ না প্রকৃত হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করিতেছি, ততক্ষণ তিনি মুক্তি পাইবেন না। তবে আমি তোমার নিকট প্রতিজ্ঞা করিতেছি, শীঘ্রই তিনি মুক্ত হইবেন। এখন আমার কতকগুলি কথার উত্তর দাও 

বা। কি কথা জিজ্ঞাসা করুন – আমি যাহা জানি, সমস্তই নিবেদন করিতেছি। 

আ। তোমার স্বামীর সহিত রাধামাধববাবুর কি কলহ হইয়াছিল? 

বা। আজ্ঞে হাঁ-হইয়াছিল। 

আ। কারণ কিছু জান মা। 

বালিকা কিছুক্ষণ কোন উত্তর করিল না। আমার পায়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া কি চিন্তা করিতে লাগিল। আমি পুনরায় ওই প্রশ্ন করিলাম। তখন বালিকা যেন নিতান্ত অনিচ্ছার সহিত বলিল, জানি, কারণ অতি তুচ্ছ, কিন্তু বড় গোপনীয়। এ বাড়ীরও অনেকে তাহা জানে না। 

আ। আমি কাহারও নিকট সে কথা ব্যক্ত করিব না; তুমি সাহস করিয়া সকল কথা খুলিয়া বল। 

বা। আমার শাশুড়ীর দূর-সম্পর্কের এক ভগিনী এখানে বাস করেন। তাঁহার বয়সও অল্প এবং তাঁহাকে দেখিতেও সুন্দরী। শাশুড়ীর মৃত্যুর পর তিনিই আমার শ্বশুরকে হস্তগত করিয়াছেন। সকল কার্য্যেই তিনি কর্তৃত্ব করিতেছেন, যেন তিনি বাড়ীর গৃহিণী। আমার স্বামী কার্তিকের মত সুপুরুষ। তাঁহাকে দেখিয়া বোধ হয়, আমার শাশুড়ীর ভগ্নীর লোভ হইয়াছিল। একদিন তিনি গোপনে সাক্ষাৎ করিয়া সেই সকল কথা প্রকাশ করেন এবং নিজের দুষ্টাভিলাষ ব্যক্ত করেন। আমার স্বামী দেবতার সমান। তিনি নিশ্চয়ই তাঁহার কথায় কর্ণপাত করেন নাই। কাজেই অপর পক্ষের ক্রোধ হইল। দুষ্টা রমণীর ছলের অভাব নাই। তিনি আমার শ্বশুরকে ঠিক বিপরীত বলিলেন। শ্বশুর মহাশয় তাঁহারই বশীভূত, তিনি দোষ গুণ বিচার না করিয়া আমার স্বামীকেই দোষী বলিয়া সাব্যস্ত করিলেন এবং তাঁহেক ডাকিয়া যৎপরোনাস্তি তিরস্কার করিলেন। তিনি নিজ দোষ অস্বীকার করিলেন কিন্তু সেই দুষ্টা রমণীর নামে কোন দোষারোপ করিতে সাহস করিলেন না। দুই এক কথায় মহা কলহ হইল। শ্বশুর মহাশয় আমার স্বামীকে বাড়ী হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন। তিনিও রাগের মাথায় তখনই চলিয়া গেলেন। 

বালিকার কথায় আমার চক্ষু ফুটিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “সেই রমণী কি এখনও এখানে আছেন? “ বা। আজ্ঞে হাঁ–আছেন বৈ কি? তিনিই ত এখন সৰ্ব্বেসৰ্ব্বা। 

আ। তোমার স্বামীর সহিত তোমার শ্বশুর মহাশয়ের বিবাদ মিটিয়া গিয়াছিল কি? তিনি কি ইহার আগে বাড়ীতে আসিয়াছিলেন? না কাল রাত্রে প্রথম আসিয়াছেন? 

বা। আজ্ঞে পূর্ব্বে আর একবার এখানে আসিয়াছিলেন কিন্তু কিছুদিন থাকিয়া নানাপ্রকার দুশ্চিন্তায় তাঁহার শরীর ভগ্ন হইয়া পড়ে। সেইজন্যই তিনি বৈদ্যনাথে গিয়াছিলেন। 

আ। কাল কি হঠাৎ আসিয়াছেন? 

বা। আজ্ঞে না, তিনি যে কাল রাত্রে আসিবেন এ কথা ত পত্রে লিখিয়াছিলেন। তবে তাঁহার যে সময়ে আসিবার কথা ছিল, সে সময়ে তিনি আসিতে পারেন নাই। প্রায় দুই ঘণ্টা বিলম্ব হইয়াছিল। 

আ। কেন? 

বা। পথে কোন বন্ধুর সহিত সাক্ষাৎ হওয়ায় তিনি তাঁহার বাড়ীতে যাইতে বাধ্য হইয়াছিলেন। 

আ। কত রাত্রে আসিয়াছিলেন? 

বা। রাত্রি দুপুরের পর 

আ। তখন বাড়ীর আর কোন লোক জাগ্রত ছিল না? 

বা। বোধ হয়, না। আমার অনুরোধে দ্বারবানেরা দ্বার বন্ধ করে নাই। তবে তিনি যখন আসিলেন, তখন তাহারাও নিদ্রিত হইয়া পড়িয়াছিল। 

আ। তখন তোমার শ্বশুর মহাশয় কোথায় ছিলেন? 

বা। যে ঘরে এখন তিনি আছেন, সেই ঘরে শয়ন করিয়াছিলেন। তাঁহার গৃহে সমস্ত রাত্রি আলোক থাকে এবং তিনি কখনও দ্বার বন্ধ করিয়া নিদ্রা যাইতে পারেন না। 

আ। তোমরা কত রাত্র পর্য্যন্ত জাগিয়াছিলে? 

বা। সমস্ত রাত্রি। 

এই বলিয়া বালিকা আবার রোদন করিতে লাগিল, আমি পুনরায় তাহাকে মিষ্ট কথায় শান্ত করিলাম এবং জিজ্ঞাসা করিলাম “কর্তাবাবু যখন খুন হন, তোমরা কি জানিতে পারিয়াছিলে?” 

বা। আমরা গল্প করিতেছি, এমন সময় “খুন করিল, খুন করিল” এই শব্দ আমাদের কর্ণ গোচর হয়। আমি ত ভয়ে জড়সড় হইয়া ঘরের এক কোণে লুকাইয়া থাকিলাম। তিনি তখনই ঘর হইতে বাহির হইলেন এবং একে একে সকল গৃহের দ্বারের নিকট গিয়া পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। অবশেষে যখন শ্বশুর মহাশয়ের ঘরের দ্বারদেশে আগমন করিলেন, তখনই বুঝিতে পারিলেন যে তাঁহারই সর্ব্বনাশ হইয়াছে। তাহার পর বাড়ীর সকলেই জাগ্রত হইল। তিনি তখনও সেই ঘরের ভিতর ছিলেন। সুতরাং তাঁহার আগমনের কথা কেহই জানিতে পারে নাই। অগত্যা সকলে পরামর্শ করিয়া থানায় সংবাদ দিল। দারোগাবাবু সঙ্গে সঙ্গে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঠিক সেই সময়ে আমার স্বামী সেই ঘর হইতে বাহির হইতেছিলেন, কাজেই হত্যাকারী বলিয়া গ্রেপ্তার হইলেন। শুনিয়াছি, তাঁহার হাতে একখানা রক্তাক্ত ছোরা ছিল। দারোগাবাবুর সন্দেহ, যে তিনিই আমার শ্বশুর মহাশয়কে হত্যা করিয়াছেন। 

আ। ছোরাখানি কাহার জান? 

বা। শুনিয়াছি, তাহাতে আমার স্বামীর নাম লেখা ছিল। সেখানি তাঁহারই ছোরা। 

আ। বাড়ীতে কি আর কোন পুরুষমানুষ ছিল না? 

বা। কে থাকিবে? আমার দেবর কালই নৈহাটী গিয়াছেন। তবে তাঁহার এক বন্ধু এ বাড়ীতে ছিলেন, কই, তাঁহাকে ত আজ প্রাতঃকাল হইতে দেখিতে পাইতেছি না? সত্যই ত—তিনি কোথায় গেলেন? তাঁহার কেহ খোঁজ লইতেছেন না? 

বালিকার শেষ কথা শুনিয়া আমার মনে এক নূতন আশার সঞ্চার হইল। আমি হরিদাসের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “তাঁহার কথা কিছু জান হরিদাস?” 

হরিদাস মাথা চুলকাইতে চুলকাইতে বলিল “আজ্ঞে কর্তাবাবুর খুনের কথা আর বড় দাদাবাবুর গ্রেপ্তারের কথায় আমরা এত দুঃখিত ও ব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি যে, তাঁহার কথা আমাদের কাহারও মন মধ্যে উদয় হয় নাই।” 

আমি বলিলাম, অগ্রে তাঁহার সন্ধান না লইয়া কোন কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করা উচিত হয় নাই। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ 

আমার কথা শুনিয়া হরিদাস বলিল, “তবে একবার তাঁহার ঘরটা দেখিয়া আসি।” 

আমি আর নিশ্চিন্ত থাকিতে পারিলাম না, বলিলাম, “চল, আমিও তোমার সঙ্গে যাই। এতক্ষণ নিশ্চিন্ত থাকা ভাল হয় নাই। যদি তিনি বাস্তবিকই দোষী হন, তাহা হইলে এতক্ষণ অনেক দূর পলায়ন করিয়াছেন।” 

আমার কথায় হরিদাস তখনই গাত্রোত্থান করিল এবং গৃহদ্বার উন্মুক্ত করিয়া আমার অগ্রে অগ্রে যাইতে লাগিল। আমিও বালিকাকে বারম্বার সান্ত্বনা করিয়া তাঁহার অনুসরণ করিলাম। 

যাইতে যাইতে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “কতদিন তিনি এ বাড়ীতে বাস করিতেছেন?” 

হ। প্রায় তিন মাস হইবে। 

আ। লোক কেমন? 

হ। ভাল বলিয়াই ত বোধ হয়। 

আ। কর্তাবাবুর সহিত সদ্ভাব কেমন? 

হ। বেশ সদ্ভাব। উভয়ে প্রায়ই বসিয়া গল্প করিতেন। 

এইরূপ কথা কহিতে কহিতে হরিদাস সেই গৃহদ্বারে উপস্থিত হইল। তখনও দ্বার বন্ধ দেখিয়া হরিদাস দ্বারে করাঘাত করিল, কিন্তু ভিতর হইতে কোন সাড়া পাওয়া গেল না। 

হরিদাস আশ্চর্যান্বিত হইল। কোন কথা না করিয়া সে আমার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিল। আমি তাহার মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া দ্বারে বার কয়েক সবলে আঘাত করিলাম। ভয়ানক শব্দে চারিদিক প্রতিধ্বনিত হইল। বাড়ীর লোকজন যে যেখানে ছিল, সকলেই জমায়েৎ হইল। কিন্তু দরজা খুলিল না। 

আমি তখন হরিদাসকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এ ঘরে প্রবেশ করিবার আর কোন পথ আছে হরিদাস?” 

হ। আজ্ঞে না—ঘরে একটি বই দরজা নাই। কিন্তু অনেকগুলি জানালা আছে। 

আ। বাহির হইতে সেই জানালাগুলি দেখা যায়? 

হ। আজ্ঞে হাঁ—কিন্তু আমার বোধ হয়, সেগুলিও বন্ধ। খোলা থাকিলে নজরে পড়িত। 

আ। তবে ঘরের দ্বার ভগ্ন করা ভিন্ন উপায়ান্তর নাই। 

এই বলিয়া দ্বারে সজোরে তিন চারিবার পদাঘাত করিলাম। দরজা ভাঙ্গিয়া গেল। অগ্রে আমিই ভিতরে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম, যাহা ভাবিয়াছিলাম, ঠিক তাহাই ঘটিয়াছে। ঘরের ভিতর জনপ্রাণী নাই। 

প্রথমেই ঘরের বিছানা দেখিলাম। একখানি তক্তাপোষের উপর বেশ সুকোমল এক শয্যা ছিল। কিন্তু তাহার অবস্থা দেখিয়া স্পষ্টই বুঝিতে পারিলাম যে, পূর্ব্ব রাত্রে সেখানে কেহই শয়ন করেন নাই। ঘরের আসবাবের মধ্যে একটা আল্লা, একটা আলমারী ও একটা প্রকাণ্ড সিন্দুক ছিল। কিন্তু ছোটখাট বাক্স একটিও দেখিতে পাইলাম না। আমার কেমন সন্দেহ হইল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “হরিদাস! ঘরের ভিতর যে সকল জিনিষ দেখিতেছি, তাহা ত তোমাদের বলিয়াই বোধ হইতেছে। অহীন্দ্রনাথের কি কোন জিনিষ ছিল না? তিনি রিক্তহস্তে দুই তিন মাস এখানে বাস করিতেছিলেন? 

হ। আজ্ঞে না—তাঁহার একটি ক্ষুদ্র ক্যাসবাক্স ছিল। কই, সেটিকে ত দেখিতে পাইতেছি না। আর বিছানার চাদর ই বা কোথায় গেল? এই বিছানার উপর দুইখানি ভাল চাদর ছিল। 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “বল কি? তবে তিনি সরিয়া পড়িয়াছেন। একবার জানালাগুলি ভাল করিয়া দেখ দেখি।” 

এই বলিয়া আমি নিজেই এক একটি করিয়া সকল জানালাগুলিই দেখিতে লাগিলাম। এবং কিছুক্ষণ পরেই একটি জানালার গরাদের নিম্নে চাদর দুইখানি বাঁধা রহিয়াছে দেখিতে পাইলাম। হরিদাসও তখনই আমার নিকট যাইল, এবং চাদরগুলিকে জানালা হইতে টানিয়া তুলিল। দেখিলাম, দুইখানি চাদর এক করিয়া প্রায় আটহাত আন্দাজ দীর্ঘ হইয়াছিল। তাহারই একদিক জানালার বাঁধিয়া অপর অংশ বাহিরে ঝুলান হইয়াছিল। পরে তাহারই সাহায্যে গৃহ হইতে বহির্গত হইয়া পথে পতিত হন এবং তখনই পলায়ন করেন। 

ব্যাপার দেখিয়া হরিদাস স্তম্ভিত হইল। এবং শশব্যস্তে বলিয়া উঠিল, “তবে ত অহীন্দ্রবাবুই কর্তাবাবুকে খুন করিয়াছেন?” 

আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম, “কেমন করিয়া জানিলে যে, তিনিই হত্যা করিয়াছেন?” 

হ। তাঁহার কার্য্য দেখিয়া বোধ হইতেছে, যদি তাঁহার দোষ না থাকিবে, তবে তিন পলায়ন করিলেন কেন? যাইবার সময় নিশ্চয়ই তিনি ক্যাস্ বাক্সটিী লইয়া গিয়াছেন, নতুবা সে বাক্স কোথায় যাইবে? 

এই কথা বলিবার অব্যবহিত পরেই একজন দাসী আসিয়া হরিদাসকে বলিল, “ছোট দাদাবাবু আসিয়াছেন—তিনি আপনাকে ডাকিতেছেন।” 

হরিদাস দাসীকে বিদায় দিয়া আমার মুখের দিকে চাহিল। আমি তাহার মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া বলিলাম, “চল, আমিও তোমার সঙ্গে যাইতেছি। তাঁহার সহিত আমারও সাক্ষাৎ করা উচিত। এখন তিনিই এ বাড়ীর কর্তা। এখানে আমার আর বিশেষ কোন প্রয়োজন নাই। তোমার ছোট দাদাবাবুর বন্ধুটি বড় ভাল লোক নহেন। যে প্রকারে যে সময় তিনি পলায়ন করিয়াছেন, তাহাতে অনেকেই তাঁহাকে সন্দেহ করিবে। আমি আশ্চৰ্য্য হইলাম, যেহেতু স্থানীয় দারোগার এ বিষয়ে ভ্রুক্ষেপ নাই। 

আমার কথায় হরিদাস তখনই জানালাটি বন্ধ করিয়া গৃহ হইতে বহির্গত হইল। আমি তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে লাগিলাম। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ 

নগেন্দ্রনাথ নিজের গৃহেই বসিয়াছিলেন। হরিদাস আমাকে সঙ্গে লইয়া সেই ঘরে প্রবেশ করিল। নগেন্দ্রনাথকে দেখিতে মন্দ নহে। তাঁহার বয়স প্রায় পঁচিশ বৎসর। তাঁহাকে দেখিতে শীর্ণ। বোধ হয় অতিরিক্ত নেশা ও রাত্রি জাগরণ করিয়া চক্ষুদ্বয় কোটরে প্রবেশ করিয়াছে। চক্ষের নিম্নে যে কালিমা-রেখা ছিল, তাহাও পূর্ব্বোক্ত কারণেই হইয়াছিল। 

আমরা যখন গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলাম, তখন তিনি ভোজন করিতেছিলেন। তাঁহার চক্ষুদ্বয় দিয়া অনর্গল অশ্রুবারি ঝরিতেছিল। আমাকে দেখিয়া তিনি যেন চমকিত হইলেন। তাঁহার মুখ সহসা যেন আরও মলিন হইয়া গেল। তিনি আমার মুখের দিকে অধিকক্ষণ চাহিতে পারিলেন না। 

তাঁহাকে আন্তরিক শোকান্বিত দেখিয়া এবং বালকের মত কাঁদিতে দেখিয়া আমি মিষ্ট কথায় তাঁহাকে সান্ত্বনা করিতে চেষ্টা করিলাম। প্রথমে আমার কথায় তিনি আরও যেন শোক পাইলেন, তাঁহার চক্ষের অশ্রুধারা পূর্ব্বাপেক্ষা দ্বিগুণ তেজে বহির্গত হইতে লাগিল। কিন্তু ক্রমেই তিনি শান্ত হইয়া আসিলেন। 

তাঁহাকে কিছু শান্ত দেখিয়া আমি বলিলাম “নগেন্দ্রবাবু, বৃথা রোদন করিলে কি হইবে? যখন বিপদ উপস্থিত হইয়াছে, তখন তাহার হাত হইতে নিষ্কৃতি লাভের উপায় দেখিতে হইবে। আপনি শোকে অধীর হইয়া বেড়াইলে তাহার কিছুই হইবে না। এ বিষয়ে আমি আপনার সাহায্য প্রার্থনা করি। যদিও আপনার দাদা হত্যাকারী বলিয়া গ্রেপ্তার হইয়াছেন এবং স্থানীয় পুলিস তাঁহাকেই দোষী বলিয়া সাব্যস্ত করিয়াছেন, তত্রাপি আরও কিছু প্রমাণের প্রয়োজন। যতক্ষণ সেই প্রমাণগুলি সংগ্রহ না হইতেছে, ততক্ষণ তাঁহাকে প্রকৃত প্রস্তাবে দোষী বলিয়া স্থির করা যাইতে পারে না।” 

আমার কথায় নগেন্দ্রনাথ যেন শিহরিয়া উঠিলেন। পরে আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তবে কি আপনি দাদার বিরুদ্ধে আরও প্রমাণ সংগ্রহ করিতেছেন? আর সেই বিষয়েই কি আমার সাহায্য প্রার্থনা করিতেছেন? যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে আমার আশা ত্যাগ করুন। আমি কোন্ প্রাণে দাদার বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া দিব।” 

নগেন্দ্রনাথের কথা শুনিয়া আমি হাসিতে হাসিতে বলিলাম “আজ্ঞে না–আমি সে কথা বলি নাই। আপনার দাদাকে অপর লোকে দোষী বলিতে পারেন, আমি কিন্তু সেরূপ মনে করি না। তিনি সম্পূর্ণ নিদোষী।” 

নগেন্দ্রনাথ আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলেন। কিছুক্ষণ কোন কথা বলিলেন না। পরে অতি মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তবে আপনি কাহাকে সন্দেহ করেন?” 

ক্ষণমাত্র বিলম্ব না করিয়া আমি উত্তর করিলাম “আপাততঃ যেমন বুঝিতেছি, তাহাতে আপনার বন্ধুর উপরই সন্দেহ হইতেছে।” 

নগেন্দ্রনাথ স্তম্ভিত হইলেন। পরে জিজ্ঞাসা করিলেন “বলেন কি? তিনি কোথায়? আমি ত ফিরিয়া আসিয়া অবধি তাঁহাকে দেখিতে পাই নাই।” 

আমিও ঈষৎ হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “আপনি কেন, আজ প্রাতঃকাল হইতে কেহই তাঁহাকে দেখিতে পান নাই। তিনি গেলেন কোথায় বলিতে পারেন?” 

ন। হয়ত এখনও ঘুমাইতেছেন। হয় ত গত রাত্রে অনেকক্ষণ জাগিয়া ছিলেন, সেই কারণে ঘর হইতে বাহির হন নাই। 

আ। আজ্ঞে না—ঘরের জানালা দিয়া তিনি গত রাত্রেই পলায়ন করিয়াছেন। দুইখানি বিছানার চাদর একত্রে বন্ধন করিয়া তাহারই একপার্শ্ব জানালায় বাঁধিয়াছিলেন। পরে সেই চাদরের সাহায্যে ঘর হইতে পথে পতিত হন। তাহার পর পলায়ন করেন। 

নগেন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ কি ভাবিতে লাগিলেন। পরে যেন আপনা আপনি বলিয়া উঠিলে “কি ভয়ানক! আজকাল লোককে বিশ্বাস করিয়া কোন কার্য্য করা বড় কঠিন। এখন কোন উপায়ে তাহাকে গ্রেপ্তার করা যায়? এদিকে যে বিনা অপরাধে দাদাকে জেলে যাইতে হইয়াছে।” 

আমি বলিলাম “সেইজন্যই ত আপনার সাহায্য চাইতেছি। তিনি যখন রাত্রি দুপুরের পর পলায়ন করিয়াছেন, তখন অনেক দূর গিয়া পড়িয়াছেন। কোথায় যাইলে তাঁহাকে সহজে গ্রেপ্তার করিতে পারা যায়, তাহাই আপনাকে বলিতে হইবে।” 

ন। কেমন করিয়া বলিব? 

আ। কেন? তিনি যখন আপনার বন্ধু, তখন তিনি কোথায় যাতায়াত করেন, তাহাও আপনার জানা আছে। আমায় সেই সেই স্থান নির্দ্দেশ করুন, আমি এখনই তাহার সন্ধান লইতেছি। 

নগেন্দ্র অপ্রতিভ হইলেন। অতি ধীরে ধীরে বিনীত ভাবে উত্তর করিলেন “বন্ধু হইলেও আমি তাঁহার অন্য কোন সংবাদই রাখি না।” 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। কিছুক্ষণ পরে বলিলাম “এ বড় আশ্চর্য্য কথা। অহীন্দ্রবাবু তবে আপনার কিরূপ বন্ধু? কেমন করিয়া তাঁহার সহিত প্রথম আলাপ হয়? 

ন। অতি আশ্চর্য্যরূপেই তাঁহার সহিত আমার আলাপ হইয়াছিল। আমি কোন লাইব্রেরীর একজন সভ্য। প্রতি শনি ও রবিবারে সেখানে সভা ও বক্তৃতাদি হইয়া থাকে। সভ্য ছাড়া আরও অনেক লোক সেখানে উপস্থিত হন। প্রায় একবৎসর হইল একদিন আমি লাইব্রেরীর পাঠাগারে বসিয়া আছি, এমন সময়ে অহীন্দ্রনাথ সেখানে উপস্থিত হন এবং দুই এক কথায় আমার সহিত আলাপ করেন। অহীন্দ্রনাথ একজন কৃতবিদ্য লোক, অনেক তাঁহার পাঠ করা আছে, গল্প করিয়া লোকের মন ভুলাইতে তিনি সিদ্ধহস্ত। বিশেষত নানা স্থানে পরিভ্রমণ করিয়া অনেক নূতন বিষয় তাঁহার জানা আছে। এইরূপে কথায় কথায় তাঁহার সহিত আলাপ হইল। 

আ। তাঁহার নিবাস শুনিয়াছি ঢাকায়। তিনি কি তখন কলিকাতায় থাকিতেন? 

ন। আজ্ঞে হাঁ—কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, তিনি কোথায় থাকিতেন, তাহা একদিনও জিজ্ঞাসা করি নাই।

আ। তাঁহার দেশেরও ঠিকানা জানেন না? 

ন। আজ্ঞে না। 

আ। তবে কি আপনার বন্ধুর বিষয় আপনি আর কিছুই জানেন না? 

ন। আজ্ঞে না। 

আ। তবে আর আপনার দ্বারা কোন কার্য্যই হইতে পারে না। লাস বাড়ী হইতে বাহির করিয়া আমাকেই ওই কার্য্য করিতে হইবে। যখন আপনার বন্ধ গত রাত্রে গোপনে পলায়ন করিয়াছেন, তখন তাঁহারই উপর আমার অধিক সন্দেহ হইতেছে। 

আমার কথায় নগেন্দ্রনাথ দাঁড়াইয়া উঠিলেন, এবং আমার সহিত ঘরের বাহির হইয়া আসিলেন। আমি তখন পুনরায় কর্তাবাবুর গৃহে প্রবেশ করিলাম এবং সত্বর তাঁহার মৃতদেহ হাসপাতালে পাঠাইয়া দিলাম। 

এই সকল কাৰ্য্য শেষ করিয়া আমি বাড়ী হইতে বাহির হইতেছি, এমন সময় একজন দাসী আসিয়া হরিদাসকে বলিল “সরকারবাবু! মঙ্গলা কোথায় গেল? বৌ-দিদি তাহাকে অনেকক্ষণ হইতে খুঁজিতেছেন।” 

দাসীর কথা শুনিয়া হরিদাস আশ্চর্যান্বিত হইল। কিছুক্ষণ কোন উত্তর করিতে পারিল না। পরে বলিল “সত্যই ত! আমিও ত তাহাকে আজ সকাল হইতে দেখিতে পাই নাই। সে মাগী গেল কোথায়?” 

দাসী কোন উত্তর করিল না। তখন হরিদাস স্বয়ং বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করিল এবং আমাকেও যাইতে অনুরোধ করিল। আমি তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ পুনরায় অন্দরে গিয়া উপস্থিত হইলাম। 

সেবার অন্দরে গিয়াই এক যুবতীকে দেখিতে পাইলাম। তিনি হরিদাসকে কি বলিতে যাইতেছিলেন, কিন্তু আমাকে দেখিয়াই পলায়ন করিলেন। যুবতী বিধবা – তাঁহার বয়স প্রায় বাইশ বৎসর-দেখিতে অতি সুন্দরী। তাঁহার চক্ষু দেখিয়া বোধ হইল, এতক্ষণ তিনি রোদন করিতেছিলেন। তাঁহাকে দেখিয়াই বুঝিলাম, তিনিই কর্তবাবুর দূর-সম্পর্কীয়া শ্যালিকা এবং কর্তাবাবুর স্ত্রীর মৃত্যুর পর হইতে তিনি ইঁহারই সম্পূর্ণ বশীভূত হইয়া পড়িয়াছিলেন। 

অনুমান যথার্থ কি না জানিবার জন্য তিনি প্রস্থান করিলে আমি হরিদাসকে জিজ্ঞাসা করিলাম “হরিদাস! এ রমণী কে? ইনি এই হত্যাকাণ্ডের বিষয় কিছু জানেন কি?” 

হরিদাস উত্তর করিল “ইনি স্বর্গীয়া মাতাঠাকুরাণীর দূর-সম্পর্কীয়া ভগিনী। সম্প্রতি ইনিই গৃহিণীর কার্য করিতেছিলেন। মার মৃত্যুর পর হইতে কর্তাবাবু ইহারই বশীভূত হইয়াছিলেন।” 

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম “তিনি কি বলিবার জন্য তোমার নিকট আসিয়াছিলেন জান?”

হরিদাস বলিল “আজ্ঞে না, বলেন ত জিজ্ঞাসা করিয়া আসি। কিন্তু বলিতে কি, উনি আমাদের কাহারও উপর সন্তুষ্ট নহেন।” 

আমি সম্মত হইলাম। হরিদাস চলিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল “তিনি মঙ্গলার কথাই জিজ্ঞাসা করিতেছেন। মাগীকে বাড়ীর কেহই সকাল হইতে দেখিতে পাইতেছে না।” 

আমি কোন উত্তর করিলাম না। ভাবিলাম, হয়ত সে অহীন্দ্রবাবুর সহিত পলায়ন করিয়াছে। হয়ত উভয়েই পরামর্শ করিয়া ওই কার্য্য সম্পন্ন করিয়াছে। কিন্তু অহীন্দ্রবাবুর স্বার্থ কি? কোন্ উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিবার জন্য তিনি রাধামাধববাবুকে হত্যা করিলেন? তাঁহার মৃত্যুতে তিনি নিশ্চয়ই কোন অংশে লাভবান হইবেন না। 

এইরূপ নানাপ্রকার চিন্তা করিয়া বলিলাম “তোমাদের মঙ্গলা অহীন্দ্রনাথের সহিতই পলায়ন করিয়াছে। মাগীর চরিত্র কেমন?” 

হরিদাস বলিল “মঙ্গলা সচ্চরিত্রা; সে বড় মুখরা, মধ্যে মধ্যে অবাধ্য হয় বটে কিন্তু তাহার চরিত্র ভাল। সে কখনও কোন পুরুষের দিকে চাহিয়া থাকে না। কথা কহিবার সময় ঘাড় হেঁট করিয়া বলে। অহীন্দ্রবাবুর সহিত সে কখনও পলায়ন করিবে না।” 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। পরে বলিলাম “তবে সে না বলিয়া কোথায় গেল? মনে পাপ না থাকিলে সে রাত্রে বাড়ী হইতে চলিয়া যাইবে কেন? সে যাহা হউক, এখন ওই রমণীকে জিজ্ঞাসা কর, তিনি এই হত্যাকাণ্ডের বিষয় কিছু জানেন কি না?” 

হরিদাস চলিয়া গেল এবং কিছুক্ষণ পরে সেই যুবতীকে সঙ্গে লইয়া পুনরায় আমার নিকট আগমন করিল। এবার তিনি অবগুণ্ঠনবতী ও সর্ব্বাঙ্গ আবৃতা হইয়াই আসিয়াছিলেন। হরিদাস আমার সমক্ষে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলে পর তিনি কোমলকণ্ঠে বিনীত ভাবে উত্তর করিলেন,- “কর্তার মৃত্যু সম্বন্ধে আমি কোন কথা বলিতে পারি না। তিনি ছিলেন বলিয়া আমি এ বাড়ীতে অন্ন পাইতাম। তাঁহার মৃত্যুকে আমার সেই অন্ন উঠিল।” 

এই বলিতে বলিতে তাঁহার কণ্ঠরোধ হইল। তিনি আর বলিতে পারিলেন না। আমিও তাঁহার কথায় বিচলিত হইলাম এবং আর কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করিলাম না। হরিদাসকে লইয়া তথা হইতে প্রস্থান করিলাম। 

বাড়ীর সদর দ্বারে আসিয়া আমি হরিদাসকে জিজ্ঞাসা করিলাম “মঙ্গলা কতদিন এখানে চাকরী করিতেছে?”

হ। প্রায় দশ বৎসর। মঙ্গলা বালবিধবা — বিধবা হইবার একমাস পরে সে এখানে চাকরী করিতে আইসে।

আ। এখানে তাহার আত্মীয় কেহ নাই? 

হ। আত্মীয়ের মধ্যে তাহার মা–সে মারা গিয়াছে, বাপ আগেই মারা গিয়াছিল। ভাই বোন নাই। শ্বশুর বাড়ীর কে আছে না আছে জানি না। সে এ দেশে নয়। 

আ। এখানে তাহার বেশী আলাপী কোন লোক নাই? কিম্বা দূর-সম্পর্কেরও আত্মীয় নাই? 

হরিদাস কিছুক্ষণ কি চিন্তা করিল। পরে বলিল “একজন বুড়ী আছে বটে। মঙ্গলা তাহাকে মাসী বলিয়া থাকে। খালের ধারে তাহার একখানি খোলার ঘর আছে। সে একাই সেখানে বাস করে।” 

আ। ভরণ-পোষণ কোথা হইতে হয়? 

হ। ভিক্ষা দ্বারা। মঙ্গলাও বোধ হয় কিছু কিছু দেয়। 

আ। মাগীর নাম কি—বলিতে পার? 

হরিদাস কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। সে যেন আমার কথা ভাল বুঝিতে পারে নাই। আমি পুনরায় ওই কথা জিজ্ঞাসা করিলে সে বলিল “নাম কি জানি না – লোকে তাহাকে কামিনীর মা সর্দারনি বলিয়া ডাকে।” 

আখ্যা শুনিয়া আমি হাস্য সংবরণ করিতে পারিলাম না। কিছুক্ষণ আরও দুই একটি কথার পর আমি হরিদাসের নিকট বিদায় লইলাম। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ 

যখন বাড়ীর বাহির হইলাম, তখন বেলা প্রায় একটা। ভাবিলাম, যদি কামিনীর মা সত্য সত্যই ভিক্ষা দ্বারা জীবিকা নির্ব্বাহ করে, তাহা হইলে তাহার সহিত দেখা করিবার ইহাই উপযুক্ত সময়। বেলা একটার সময় সে নিশ্চয়ই আপনার কুটীরে আসিয়া আহারাদির যোগাড় করিতেছে। 

এই মনে করিয়া আমি তাহারই সন্ধানে চলিলাম। রাধামাধববাবুর বাড়ী হইতে খালের ধার প্রায় দেড় মাইল পথ আমি পদব্রজেই ওই পথ অতিক্রম করিয়া অনেক কষ্টে কামিনীর মার সন্ধান পাইলাম। তাহার বিষয় যেমন শুনিয়াছিলাম, ঠিক তেমন নহে। সে এখন বৃদ্ধা হইয়াছে, আর ভিক্ষা করে না। পূর্ব্বে সদারনি ছিল, অনেক লাভ করিয়াছে; ভিক্ষা দ্বারা অনেক উপায় করিয়াছে। তাহার কিয়দংশের দ্বারা এখন জীবিকা নির্ব্বাহ করিতেছে, আর মঙ্গলাও তাহাকে কিছু কিছু দিয়া থাকে। এ সকল সংবাদ আমি তাহারই এক প্রতিবেশীর মুখে শুনিয়াছিলাম। 

কুটীরে প্রবেশ করিয়া দেখিলাম, একটা সুন্দরী যুবতী বৃদ্ধার সেই মলিন শর্য্যায় শয়ন করিয়া রহিয়াছে। মুখ ভিন্ন তাহার সর্ব্বাঙ্গ একখানি কম্বলে আবৃত। মুখের অবস্থা দেখিয়া বোধ হইল যুবতী অজ্ঞান। 

ঘরের ভিতর একখানি তক্তাপোষ, তাহার উপরে মলিন শয্যায় সেই যুবতী। তক্তার পার্শ্বে যুবতীর মস্তকের নিকট কামিনীর মা তাঁহার মাথায় হাত বুলাইয়া দিতেছিল এবং এক মনে কি বকিতেছিল। এমন সময় আমি সেখানে উপস্থিত হইলাম। 

আমাকে দেখিয়া সে যেন চমকিত হইল। আমি কিন্তু বিষম ফাঁপরে পড়িলাম। যে যুবতী সেই শয্যায় শয়ন করিয়া রহিয়াছে, সে মঙ্গলা কি না তাহা বুঝিতে পারিলাম না। একবার মনে হইল, হয় ত মঙ্গলার হঠাৎ কোনরূপ পীড়া হইয়া থাকিবে, তাই সেখানে গিয়াছে। কিন্তু আবার ভাবিলাম, যেখানে বিধবা হইয়া অবধি চাকরী করিতেছে, প্রায় দশ বৎসর বাস করিয়া আসিতেছে, সেস্থান আপনার বাড়ীর মতই হইয়া গিয়াছে। পীড়িত হইলে সে মনিবের বাড়ীই অগ্রে যাইবে। এইরূপ চিন্তা করিতেছি, এমন সময়ে বৃদ্ধা আমাকে কর্কশস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “কি চাও গা? এখানে কেন? গরিব বলিয়া কি মান-ইজ্জত নাই?”

আমি হাসিয়া উঠিলাম। পরে বলিলাম “মঙ্গলা যে রাত্রি হইতে মনিব-বাড়ীতে যায় নাই, তাহার কি? সে কোথায়? বৃদ্ধা যেন আশ্চৰ্য্যান্বিত হইল। কিছুক্ষণ পরে বলিয়া উঠিল “সে কি! কোথায় গেল?” 

আমি বৃদ্ধার কথায় বুঝিলাম, সে মঙ্গলার সংবাদ জানে। কর্কশস্বরে জিজ্ঞাসা করিলাম “মঙ্গলার কোন খবর জান?” বুড়ী আমার ধমকে ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল “না বাবা! আমি কেমন করিয়া জানিব সে কোথায় গেল। বরং সে আমাকেই বিপদে ফেলিয়া গিয়াছে। আমি যে কোথা হইতে এই রমণীর ঔষধ ও পথ্য সংগ্রহ করিব, তাহা বলিতে পারি না। সেই ত আমায় এই আপদ যোগাড় করিয়া দিল।” 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইয়া তাহার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিলাম। বৃদ্ধা কি ভাবিল বলিতে পারি না, কিন্তু হাতযোড় করিয়া বলিল “কাল রাত্রি প্রায় একটার সময় মঙ্গলা এই যুবতীকে অজ্ঞান অবস্থায় এখানে আনয়ন করে। অনেক শুশ্রূষার পর আজ প্রাতে ইহার জ্ঞান হইয়াছিল। এখন রমণী গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত।” 

বৃদ্ধার মুখে এক নূতন কথা শুনিয়া আমার কৌতূহল বৃদ্ধি হইল। আমি সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলাম, “এ যুবতী কে?” 

বৃ। চিনি না, আমার সম্পূর্ণ অপরিচিতা। 

আ। মঙ্গলা গত রাত্রে ইহাকে কোথা হইতে এখানে আনিয়াছে? 

বৃ। তাহার মুখে শুনিলাম, খালের ধার হইতে একজন দস্যু যুবতীকে ধাক্কা মারিয়া জলে ফেলিয়া দিয়াছিল। অনেক কষ্টে রক্ষা পাইয়াছে। 

আ। কে রক্ষা করিল? 

বৃ। মঙ্গলা। 

আ। রমণীকে কে হত্যা করিতে চেষ্টা করিয়াছিল? 

বৃ। তাহা জানি না।—সে কথা শুনি নাই। 

আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম “এ রমণীর জ্ঞান হইয়াছে?” 

বৃ। বোধ হয়, হইয়াছে। 

আ। তাহার পূর্বকথা স্মরণ আছে বলিয়া বোধ হয়? 

বৃ। সে কথা ঠিক বলিতে পারিলাম না। 

বৃদ্ধার নিকট হইতে আর কোন সংবাদ পাওয়া যাইবে না জানিয়া, আমি কিছুক্ষণ সেই কুটীরেই অপেক্ষা করিতে মনস্থ করিলাম; এবং তদনুসারে বৃদ্ধাকে বলিলাম “এ রমণী যেই হউক, আমাকে তাহার সন্ধান লইতে হইবে এবং কে ইহাকে হত্যা করিতে চেষ্টা করিয়াছিল, তাহাও আমায় জানিতে হইবে। যতক্ষণ না রমণীর নিদ্রাভঙ্গ হইতেছে, ততক্ষণ আমাকে এখানে অপেক্ষা করিতে হইবে।” 

বৃদ্ধা শশব্যস্তে উত্তর করিল “সে ত আমার সৌভাগ্যের কথা। কিন্তু বাবা, আপনার মত লোকের স্থান কোথায়? এই সামান্য কুটীরে আপনি কোথায় বসিবেন? 

আমি ঈষৎ হাসিয়া বলিলাম “সেজন্য তোমায় চিন্তা করিতে হইবে না। আমরা পুলিসের লোক, কখন কোথায় যাই, কোথায় থাকি, কিছুরই স্থিরতা নাই। কষ্ট সহ্য করা আমাদের অভ্যাস আছে।” 

এই প্রকার কথাবার্তায় নিযুক্ত আছি, এমন সময়ে রোগিনী পার্শ্বপরিবর্তন করিল। আমার মনে আশার সঞ্চার হইল। আমি তখনই তাহার শয্যার নিকট গিয়া উপবেশন করিলাম। 

কিছুক্ষণ পরেই রমণীর নিদ্রাভঙ্গ হইল। সে সম্মুখে আমায় দেখিয়া যেন চমকিতা হইল এবং বৃদ্ধাকে অন্বেষণ করিবার জন্য চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে লাগিল। আমি তাহার মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া বলিয়া উঠিলাম “যাহাকে তুমি খুঁজিতেছ, সে যে আমারই পার্শ্বে রহিয়াছে। কি বলিতে চাও বল?” 

আমার কথায় বৃদ্ধা রমণীর সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। রমণী একবার তাহাকে ভাল করিয়া নিরীক্ষণ করিল। পরে অতি কোমল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল “ইনি কে?” 

বৃদ্ধা বলিল “ইনি পুলিসের লোক। তোমার বিপদ শুনিয়া সাহায্যের জন্য এখানে আসিয়াছেন।” 

র। কে ইঁহাকে এখানে পাঠাইয়াছেন? 

বৃদ্ধা সে কথা আমাকেও জিজ্ঞাসা করে নাই; সুতরাং রমণীর প্রশ্নের কোন উত্তর করিতে পারিল না; আমার দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল। আমি তাহার অভিপ্রায় বুঝিয়া বলিলাম “মঙ্গলার মুখে শুনিয়া আমি এখানে আসিয়াছি; কিন্তু তাহার পর সে যে কোথায় গেল, তাহা বলিতে পারিলাম না।” 

বৃদ্ধা বড় চতুরা, সে তখনই জিজ্ঞাসা করিল “তবে কি মঙ্গলার সহিত কাল রাত্রে আপনার দেখা হইয়াছিল?” আমি অগত্যা উত্তর করিলাম “হাঁ –হইয়াছিল। সে এই সংবাদ দিয়াই যে কোথায় গেল তাহা বলিতে পারি না।” রমণী কোন উত্তর করিল না দেখিয়া, আমি তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম “কে তোমাকে খালে ফেলিয়া দিয়াছিল?” রমণী যেন আশ্চর্যান্বিত হইল। আমার কথায় সে যেন শিহরিয়া উঠিল। কিছুক্ষণ পরে অতি মৃদুস্বরে বলিল “আমি আপনি পড়িয়া গিয়াছিলাম, কেহই আমাকে ফেলিয়া দেয় নাই।” 

আমি আন্তরিক বিরক্ত হইলাম। কিন্তু আত্মসংবরণ করিয়া অতি মিষ্ট কথায় বলিলাম “মঙ্গলা কি আমার সহিত উপহাস করিয়াছিল? যে রমণী তোমাকে খাল হইতে উদ্ধার করিয়াছিল, আমি তাহার মুখে সকল কথাই শুনিয়াছি এবং তাহার তদ্বির করিবার জন্য এখানে আসিয়াছি। যদি তুমি কোন কথা না বল, আমার কোন ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। কিন্তু জানিও, ভবিষ্যতে কাহারও বিরুদ্ধে কোনপ্রকার নালশ করিলে তাহা অগ্রাহ্য হইবে।” 

রমণী কিছুক্ষণ কোন কথা বলিল না – আমার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। আমি পুনরায় ওই সকল কথা জিজ্ঞাসা করিলাম। কিন্তু রমণী কিছুতেই আমার কথার উত্তর দিল না। তখন আমি নিতান্ত বিরক্ত হইয়া বৃদ্ধার নিকট বিদায় লইলাম; এবং তথা হইতে বহির্গত হইলাম। 

বৃদ্ধ আমার সহিত পথে আসিল। কিছুক্ষণ অগ্রসর হইয়া বলিল “আপনি কি আর মঙ্গলার মনিব বাড়ী যাইবেন?”

আ। হাঁ-আর একবার মঙ্গলার খোঁজ লইতে হইবে। 

বৃ। তবে যে ডাক্তারকে সে পাঠাইব বলিয়াছিল, মঙ্গলা যেন তাহাকে শীঘ্র পাঠাইয়া দেয়। 

আমি সম্মত হইলাম। বুঝিলাম, পুলিসের বেশে যে কার্য্য শেষ করিতে পারি নাই, ছদ্মবেশে হয় ত তাহাতে কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিব। এই মনে করিয়া থানায় ফিরিয়া আসিলাম, এবং তখনই ডাক্তারের ছদ্মবেশ পরিধান করিয়া বেলা প্রায় তিনটার সময় পুনরায় সেই বৃদ্ধার কুটীরে উপনীত হইলাম। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ 

যদিও বৃদ্ধা কিছুক্ষণ পূৰ্ব্বে আমায় দেখিয়াছিল এবং প্রায় একঘণ্টা কাল কথাবাৰ্ত্তা কহিয়াছিল, তত্রাপি আমি যখন ডাক্তারের বেশে পুনরায় তথায় গমন করিলাম, তখন কি বৃদ্ধা কি সেই যুবতী কেহই আমার উপর সন্দেহ করিল না। উভয়েই মনে করিল, মঙ্গলাই আমাকে পাঠাইয়া দিয়াছে। 

আমাকে দেখিয়াই বৃদ্ধা আনন্দিত হইল এবং অতি যত্নের সহিত রোগিণীর পার্শ্বে উপবেশন করিয়া তাহাকে ভালরূপ পরীক্ষা করিতে অনুরোধ করিল। রোগিণীর গলদেশ স্ফীত ও রক্তবর্ণ হইয়াছে। বোধ হইল, যেন কোন লোক সবলে তাহার গলা চাপিয়া ধরিয়াছিল। 

বৃদ্ধাই প্রথমে কথা কহিল। আমাকে পরীক্ষা করিতে দেখিয়া সে অতি বিনীত ভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “বাবা, বাঁচিবে ত? আহা, এ বেচারীর আর কেহ নাই।” 

আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। যুবতীর কেহ আছে কি না বৃদ্ধা কেমন করিয়া জানিল। ইতিপূৰ্ব্বে আমি যখন পুলিসের পোষাক পরিয়া গিয়াছিলাম, তখন ত বৃদ্ধা সে কথা বলে নাই, কিন্তু তখন কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলে পাছে বৃদ্ধার সন্দেহ হয়, এই জন্য আমি ঈষৎ হাসিয়া উত্তর করিলাম “বাঁচিবে না কেন? তিন দিনে আরোগ্য করিয়া দিব। আঘাত ত গুরুতর নহে। গলাটা টিপিয়া ধরিয়াছিল বটে, কিন্তু তাহাতে বিশেষ কোন অপকার করিতে পারে নাই।” 

রক্ষা পাইবে শুনিয়া রোগিণীর সাহস হইল। সে আমার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল “যিনি আমায় রক্ষা করিয়াছেন, তিনি কোথায় গেলেন? আর কি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইবে না?” 

আ। নিশ্চয়ই হইবে। সে কোন কার্য্যে গিয়াছে শুনিলাম, নতুবা আমার সহিত তাহার এখানে আসিবার কথা ছিল। 

রো। আপনি কি তাঁহার মনিব-বাড়ীতে চিকিৎসা করেন? 

আ। হাঁ, বহুদিন হইতে আমার সেখানে যাতায়াত আছে। কিন্তু সে যাহাই হউক, তাহার এরূপ সবলে গলা চাপিয়া ধরা ভাল হয় নাই। না জানি তোমার তখন কত কষ্টই হইয়াছিল। 

রোগিণী স্তম্ভিত হইল। সে বলিল “আপনি এ সকল কথা কেমন করিয়া জানিলেন?” 

আমি হাসিয়া উঠিলাম। হাসিতে হাসিতে বলিলাম “তিনি যে আমার পরম বন্ধু। আমাকে না বলিয়া তিনি কোন কাজ করেন না।”

রোগিণী আরও আশ্চৰ্য্যান্বিত হইল। সে বলিল “বলেন কি! তিনি -অহীন্দ্রবাবু, আপনাকে তবে সকল কথা বলিয়াছেন, আপনাদের তবে বিশেষ বন্ধুত্ব আছে?” 

অহীন্দ্রনাথের নাম শুনিয়া আমি আশ্চৰ্য্যান্বিত হইলাম। ভাবিলাম, এ আবার কি রহস্য! অহীন্দ্রবাবুর সহিত এই রমণীর সম্বন্ধ কি? কেনই বা তিনি এই অসহায়া রমণীকে হত্যা করিতে চেষ্টা করিবেন? রহস্য ক্রমেই বাড়িতে লাগিল। আমি যাহা ভাবিয়াছিলাম, তাহা হইল না দেখিয়া আন্তরিক দুঃখিত হইলাম। কিন্তু তখন কোন কথা ব্যক্ত না করিয়া বলিলাম “বন্ধুত্ব না থাকিলে কি আর তিনি নিজে আমার নিকট এ সকল কথা বলিতে পারেন?” 

রোগিণী কিছুক্ষণ কোন কথা বলিল না। আমার কথায় তাহার যেন আনন্দ হইল। সে জিজ্ঞাসা করিল “আমি যে এখানে আছি তাহা কি অহীন্দ্রবাবু জানেন না? 

আ। জানেন বৈ কি? 

রো। তবে আমি জীবিতা আছি তিনি শুনিয়াছেন? 

আ। হাঁ, শুনিয়াছেন। তিনি ত তোমায় হত্যা করিবার জন্য আঘাত করেন নাই; রাগের মাথায় একটা কাজ করিয়া ফেলিয়াছেন; নতুবা তিনি তোমায় বাস্তবিকই ভালবাসেন। 

আমার শেষ কথায় রোগিনী যেন উত্তেজিতা হইল, সে সাগ্রহে বলিয়া উঠিল “আমাকে ভালবাসেন? আমাকে ভালবাসেন? এ কথা আগে বলেন নাই কেন? তাহা হইলে ত আমি হাসি মুখে এ যন্ত্রণা সহ্য করিতে পারিতাম!” 

আ। তোমার কি বড় যন্ত্রণা হইতেছে? 

রো। এখন আর নাই। যখনই শুনিলাম, তিনি আমাকে ভালবাসেন, তখনই যেন আমার সকল যাতনার লাঘব হইয়াছে; আর আমার কোন কষ্ট নাই। 

রমণীর কথায় আমি স্তম্ভিত হইলাম। ভাবিলাম, যে রমণী এতদূর ভালবাসিতে পারে, সে ত দেবী। অহীন্দ্রবাবু কেন তাহাকে হত্যা করিতে চেষ্টা করিলেন? 

এইরূপ চিন্তা করিতেছি, এমন সময়ে রমণী পুনরায় আমার দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তিনি আর কোন কথা বলেন নাই?” 

আ। তিনি আন্তরিক দুঃখিত হইয়াছেন। বলিয়াছেন, আর কখনও তোমার প্রতি অসদ্ব্যবহার করিবেন না।

রো। তিনি বলিয়াছেন? এ কথা আপনাকে বলিয়াছেন? আমার সৌভাগ্য। তিনি ত আন্তরিক মন্দলোক নহেন। তাহা হইলে আমিই বা মরিব কেন? 

আ। তাঁহার আর সব ভাল, কেবল মেজাজটা সময় সময় বড় গরম হইয়া উঠে, এই তাঁহার দোষ। 

রোহিণী কিছুক্ষণ কোন কথা কহিল না। পরে বলিল “তিনি ত আপনার বন্ধু?” 

আ। হাঁ—বিশেষ বন্ধু। 

রো। নিশ্চয়ই আপনার কথা তিনি শুনিবেন? 

আ। হাঁ–শুনিবেন বৈ কি? কিছু বলিতে হইবে? 

রো। আজ্ঞে হাঁ—তাঁহাকে বলিবেন, যেন তিনি আর অস্ত্র ব্যবহার না করেন। আমি তখনই জিজ্ঞাসা করিলাম “তিনি কি তোমায় ছোরা মারিয়াছিলেন?” 

রো। হাঁ–সৌভাগ্যের বিষয় আঁচড় গিয়াছে মাত্র। 

আ। তোমার বলিবার পূর্ব্বেই তিনি ছোরাখানি আমায় দিয়াছেন। 

রো। সত্য না কি– কেন? 

আ। তোমায় আঘাত করিয়া তাঁহার বড় দুঃখ হইয়াছে। 

রো। আপনার কথায় সন্তুষ্ট হইলাম। 

আমি কিছুক্ষণ চিন্তা করিলাম। ভাবিলাম, কিজন্য ইহাদের মধ্যে বিবাদ হইয়াছিল, না জানিলে কোন কাৰ্য্য হইবে না। কিন্তু সাক্ষাৎ সম্বন্ধে সেকথা জিজ্ঞাসাও করিতে পারি না। 

এইরূপ নানা প্রকার চিন্তা করিয়া আমি বলিলাম, “যখন তুমি তাঁহার মেজাজ জান, তখন তাঁহাকে না রাগাইলেই ভাল হইত।” 

রমণী ঈষৎ হাসিয়া বলিল “আমি কি আর সাধ করিয়া রাগাইয়াছি। আমায় আশা দিয়া শেষে অপর রমণীকে ভালবাসিবে, এ আমার প্রাণে সহ্য হইবে কেন?” 

আমি বলিলাম “সে কথা সত্য। এখন ত তিনি রাধামাধববাবুর বাড়ীতে বেশ মজায় আছেন। বোধ হয় তোমার কথা মনেই ছিল না। কেমন?” 

রমণী বলিল “আপনি ঠিক বলিয়াছেন। আমাকে প্রথমে চিনিতেই পারিল না। আমি যে তাঁহার সাহায্য করিয়াছিলাম, আমি না হইলে যে তিনি কোনরূপে মুক্তিলাভ করিতে পারিতেন না, এ সকল কথা বোধ হয় আর এখন তাঁহার মনেই নাই।” 

আমি হাসিয়া বলিলাম “তবুও সে পুরুষ, তুমি রমণী। তুমি যদি বাস্তবিক তাঁহাকে ভালবাসিয়া থাক, তাহা হইলে তাঁহাকে রাগান ভাল হয় নাই।” 

রমণী লজ্জিতা হইয়া বলিল, “তিনি ত জানেন, আমি তাঁহাকে নিজের প্রাণ অপেক্ষা ভালবাসি? তবে কেন আমার কথায় রাগিয়া গেলেন? তিনি কি জানেন না যে, যখন আমিই সাহায্য করিয়া তাঁহাকে মুক্ত করিয়াছি, তখন আমি আবার কোন্ প্রাণে তাঁহাকে সেই স্থানে পাঠাইয়া দিব!” 

রমণীর কথা ভাল বুঝিতে পারিলাম না। সে যে কোন্ বিষয়ে অহীন্দ্রবাবুর সাহায্য করিয়াছিল, কোথা হইতে তাঁহাকে উদ্ধার করিয়াছিল এবং কোথায়ই বা পুনরায় প্রেরণ করিবে তাহা বুঝিতে পারিলাম না। জিজ্ঞাসা করিলে সমস্ত কৌশলই ব্যর্থ হইবে ভাবিয়া কোন উত্তর করিলাম না; নীরবে রমণীর দিকে চাহিয়া রহিলাম। রমণী পুনরায় আপনা আপনিই বলিতে লাগিল, “যিনি একবার সেখানে গিয়াছেন, তিনিই বুঝিবেন, জেল কি ভয়ানক স্থান। পৃথিবীর মধ্যে নরক বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।” 

রমণীর শেষ কথায় আমি স্তম্ভিত হইলাম। তবে কি অহীন্দ্রনাথ জেলের ফেরৎ? জেল হইতে এই রমণীর সাহায্যে পলায়ন করিয়াছিলেন? এ যে ভয়ানক রহস্য, এ রমণীই বা কে? কে বলিতে পারে, ইনিও কোন সময়ে জেলে ছিলেন কি না? হয় ত সেই স্থানেই উভয়ের মধ্যে প্রণয় জন্মিয়াছিল। তাহার পর উভয়েই পলায়ন করে। অহীন্দ্রনাথ বড় লোকের আশ্রয়ে আসিয়া পড়িয়াছে। রমণী হয় ত এতকাল তাঁহার সন্ধান পায় নাই। এখন জানিতে পারিয়া এখানে আসিয়া অহীন্দ্রনাথের সহিত দেখা করিয়াছিল। অহীন্দ্রনাথ প্রথমে চিনিতে পারেন নাই। অবশেষে রমণীর সহিত বিবাদ করেন ও তাহাকে হত্যা করিতে মনস্থ করিয়া খালে ধাক্কা দিয়া ফেলিয়া দেন। মঙ্গলা হয় ত সেখান দিয়া যাইতেছিল, রমণীকে উদ্ধার করিয়া বৃদ্ধার কুটীরে রাখিয়া যায়। 

এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি রমণীর নিকট বিদায় লইলাম। ফিরিয়া আসিতেছি, এমন সময় রমণী জিজ্ঞাসা করিল “যিনি আমায় রক্ষা করিয়াছেন, তিনি কোথায়? এখনও আসিলেন না?” 

আমি বলিলাম “আমার সহিত দেখা হইলে পাঠাইয়া দিব। আমার বোধ হয় সে তাহার মনিবের বাড়ীতেই আছে।” এই বলিয়া আর বিলম্ব না করিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিলাম। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ 

থানায় যখন ফিরিয়া আসিলাম, তখন বেলা প্রায় পাঁচটা বাজিয়াছে। ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করিয়া গভীর চিন্তায় নিযুক্ত হইলাম। ভাবিলাম, অহীন্দ্রনাথ জেলের ফেরৎ আসামী। রাধামাধববাবুর বাড়ীতে আসিয়া বাস করিবার নিশ্চয়ই কোন অভিসন্ধি ছিল। কি সেই অভিসন্ধি? রাধামাধববাবুকে হত্যা করিয়া তিনি কি লাভবান হইলেন বলিতে পারি না। আর যদি তিনি হত্যাই না করিলেন, তাহা হইলে বাড়ী হইতে পলায়নই বা করিলেন কেন? 

কিছুক্ষণ এইরূপ ভাবিয়া মনে হইল, হয় ত অহীন্দ্রনাথ ওই রমণীকে হত্যা করিয়াছে ভাবিয়াই পলায়ন করিয়াছেন। তিনি নিশ্চয়ই জানেন না যে, রমণী রক্ষা পাইয়াছে। মঙ্গলা যে তাহাকে রক্ষা করিয়াছে অহীন্দ্রনাথ তাহা অবগত নহেন। 

এইরূপ স্থির করিয়া ভাবিলাম, মঙ্গলা কোথায় গেল? সে রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময় হঠাৎ খালের ধারে গেল কেন? 

কেমন করিয়াই বা ওই রমণীকে রক্ষা করিতে সমর্থ হইল? রমণী যাহা বলিল, তাহাতে সেও যেন একজন জেলের আসামী তাহাও বুঝিতে পারিলাম। কেমন করিয়া সে অহীন্দ্রনাথের সন্ধান পাইল তাহা না জানিলে এ রহস্য ভেদ করিতে পারিব না। 

এইরূপ মনে করিয়া সে রাত্রি যাপন করিলাম এবং পরদিন প্রত্যুষে আবার ডাক্তারের ছদ্মবেশ পরিধান করিয়া সেই বৃদ্ধার কুটীরে গমন করিলাম। বৃদ্ধা আমায় দেখিয়া বড়ই সন্তুষ্ট হইল। আমি অগ্রে রোগিণীর সংবাদ লইলাম। পরে তাহার পার্শ্বে গিয়া বেশ করিয়া পরীক্ষা করিলাম। দেখিলাম, জ্বর অনেকটা কমিয়া গিয়াছে। তবে ক্ষতস্থান হইতে তখনও বিন্দু বিন্দু রক্ত পড়িতেছিল দেখিয়া, আমি উহা পুনরায় ভাল করিয়া বন্ধন করিয়া দিলাম। পরে অন্য কথা পাড়িলাম। 

কিছুক্ষণ পরে আপনা আপনি বলিলাম “অহীন্দ্রনাথের সন্ধান বাহির করিতে তোমায় যে কি কষ্ট পাইতে হইয়াছিল বলিতে পারি না।” 

রমণী আমার কথায় ঈষৎ হাসিল। পরে বলিল, “আপনি জানেন না, আমি তাঁহাকে কত ভালবাসি। কত স্থান যে অন্বেষণ করিয়াছি, কত লোকের নিকট যে অপদস্থ ও অপমানিত হইয়াছি তাহা বলিতে পারি না। শেষে আমার দূর-সম্পর্কের এক ভাই কথায় কথায় বলিল যে, তিনি রাধামাধববাবুর বাড়ীতে বেশ আরামে বাস করিতেছেন। আমি সেই কথা শুনিয়া একখানি পত্র লিখিলাম এবং বাড়ীর নিকট ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। যিনি আমায় উদ্ধার করিয়াছেন, তিনি সেই সময়ে বাড়ীতে প্রবেশ করিতেছিলেন। আমি তাঁহার হাতে পত্রখানি দিয়া বলি, তিনি যেন সেখানি অহীন্দ্রবাবুর নিকট দেন। তিনি তাহাই করিয়াছিলেন। 

আ। কেমন করিয়া জানিলে? 

র। তাহা না হইলে তিনি আমার পত্রের কথামত কার্য্য করিবেন কেন? 

আ। তোমার পত্র কি ছিল? 

র। রাত্রি এগারটার পর খালের ধারে দেখা করিবার কথা ছিল। 

রমণীর শেষ কথা শুনিয়া আমি সমস্ত ব্যাপার বুঝিতে পারিলাম। মঙ্গলা নিশ্চয়ই সেই পত্রের মর্ম্ম অবগত ছিল, এবং রাত্রি এগারটার পর অহীন্দ্রনাথের সহিত খালের ধারে আসিয়া কোন নিভৃতস্থানে লুকাইয়া ছিল। নিশ্চয়ই সে ইহাদের কথোপকথন শুনিতে পাইয়াছিল। তাহার পর যখন অহীন্দ্রনাথ সেই রমণীকে আঘাত করিয়া পলায়ন করেন, তখন সে ইহাকে উদ্ধার করিয়া বৃদ্ধার কুটীরে লইয়া যায়। 

এইরূপ স্থির করিয়া আমি আর তথায় থাকা যুক্তিসিদ্ধ মনে করিলাম না। তখনই বৃদ্ধার নিকট বিদায় লইয়া প্রস্থান করিলাম। 

সম্পূর্ণ 

[ কার্তিক, ১৩১৬ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *