মরণের পরে – সুমথনাথ ঘোষ

মরণের পরে – সুমথনাথ ঘোষ

—কে? কে? ও কে?

ঘুমোতে ঘুমোতে চেঁচিয়ে ওঠে প্রবীর৷

গায়ে ঠেলা দিয়ে মা তাকে জাগিয়ে দেন—এই খোকা—খোকা…

ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে সে বলে—সে কোথায়…কোথায় গেল সে?

নেটের মশারি ফেলা খাটের ভেতর জমাট অন্ধকারে প্রবীরের চোখ দু’টো যেন টর্চের মতো এপাশে ওপাশে কাকে খুঁজতে থাকে৷

মা ছেলের গায়ে আবার হাত দিয়ে ডাকেন, এই খোকা, স্বপ্ন দেখছিলি বুঝি…

মায়ের কথা যেন তার কানে ঢোকে না৷ সম্মোহিতের মতো মোহাচ্ছন্ন কণ্ঠে তেমনি বলে যায়—এই তো ছিল, কোথায় গেল!

—কার কথা বলছিস? কে কোথায় গেল? মায়ের গলায় এবার বিরক্তি প্রকাশ পায়৷

—সেই যে, সেই মেয়েটা৷ আমায় ডাকছিল হাতছানি দিয়ে৷ কি সুন্দর ধবধবে তার হাত আর সরু সরু আঙুল!

তখনো ঘুমের ঘোর কাটেনি, মনে করে মা তার হাতটা ধরে আরো জোরে জোরে ঝাঁকানি দিয়ে বললেন—স্বপ্ন দেখেছিস, না?

—না না, ওইখানে আমাদের ওই দেওয়াল-জোড়া বড় আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়েছিল কালো শাড়ি পরে৷ মাথায় ছিল ঘোমটা৷

কালো শাড়ি পরে!

ছ্যাঁৎ করে ওঠে মায়ের বুকের ভেতরটা৷ সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন—মুখটা কার মতো দেখতে?

—তা জানি না৷ মুখটা তো তার দেখতে পাইনি৷ ঘোমটা টানা ছিল৷ শুধু নাকের আধখানা থেকে মুখের নীচের দিক ও পাতলা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে মুক্তোর মতো দাঁতগুলো ক’বার দেখেছি৷ সে আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছিল আর ফিক ফিক করে হাসছিল৷ কে মা সে?

তখন ওর মা মনে মনে ভাবতে থাকেন, শুনেছি মানুষ যা নিয়ে সারাদিন গভীরভাবে চিন্তা করে, অবচেতন মনে সেই সব নাকি গোপন থাকে, রাত্রে তাকেই স্বপ্ন দেখে৷ তাই সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে প্রশ্ন করলেন—ওই রকম কালো শাড়ি পরা মেয়েকে কি আজ বা অন্য কোনোদিন পথে-ঘাটে দেখেছিলি?

প্রবীর বললে—না মা৷ তবে হ্যাঁ, এর আগে—বেশ কয়েকদিন আগে যেন ঘুমের ঘোরে ঠিক ওই রকম কালো শাড়ি পরা ছায়ার মতো মূর্তি দু’একবার দেখেছিলুম, মনে হল যেন আমায় ইশারায় সে ডাকছে, কি বলতে চায়৷ কিন্তু আজকের মতো এত স্পষ্ট আর কখনো দেখিনি৷

মা তখন ছেলেকে বোঝান, স্বপ্নে এইরকম অবাস্তব অসম্ভব কত কি মানুষ দেখে, জানিস তো…শুয়ে পড়! ঝাঁ ঝাঁ করছে রাত…এটা তো বুঝতে পারছিস, এই দোতলার বন্ধ ঘরের মধ্যে কোনো লোক ঢুকতে পারে না?

প্রবীর বলে—হ্যাঁ, তা ঠিক মা৷ কিন্তু আজ এত স্পষ্ট দেখেছি যে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না যে এটা স্বপ্ন…

প্রবীর ভালো ছেলে৷ কেবল লেখাপড়ায় ভালো নয়, চরিত্রবান, আদর্শবাদী৷ ওকে দেখলে মনে হয় স্কুলে পড়ে৷ কিন্তু সে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়ে, পার্ট ওয়ান পরীক্ষার্থী৷ ওর বাবা কেন্দ্রীয় সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী, দিল্লিতে থাকেন৷

ওর মা তখন প্রবীরকে বলেন—এত রাত পর্যন্ত জেগে পড়াশুনা করতে তোকে বারণ করি, তা কিছুতেই শুনবি না৷ বেশি পড়ে মাথা গরম হয়ে যায়, তাই যা-তা স্বপ্ন দেখিস৷ কাল থেকে ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজলেই শুয়ে পড়বি৷ আমি আলো নিবিয়ে দেব ঘরের৷

—বা রে! আর দু’মাস তিনদিন মোটে বাকি পরীক্ষার, এখনই তো বেশি পড়ার সময়৷

—পড়ো না বাবা, সারাদিন ধরে যত পারো৷ রাত্রে কেন? ডাক্তাররা সবাই বলেন—ভালো ঘুম রাত্রে না হলে শরীর খারাপ হয়, ব্রেনও দুর্বল হয়ে পড়ে৷

মাকে প্রবীর খুব ভালোবাসে৷ তাই মায়ের কাছে না শুলে এখনো তার চোখে ঘুম আসে না৷ নইলে ওর পরের যে দুটি বোন, তারা তো পাশের ঘরে আলাদা থাকে৷

ভাই-বোনদের ভেতর মাঝে মাঝে এই নিয়ে ঝগড়া বাধে৷ বোনেরা বলে—তুই তো বুড়ো-খোকা, মা’র কাছে না শুলে তাই ঘুমোতে পারিস না!

ছোট বোনের বয়স দশ বছর৷ রাগটা তারই বেশি দাদার ওপর৷ কারণ তার ন্যায্য অধিকার থেকে দাদাই তাকে বঞ্চিত করেছে, এই তার ধারণা৷ এর জন্যে মনে মনে সে দাদাকে বেশ হিংসে করে৷ অথচ দাদার ওপর মায়ের এই পক্ষপাতিত্ব দেখে ও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না, শুধু মনে মনে গজরায়৷ আর রাত্রে শুয়ে শুয়ে দিদিকে বলে, মা সব চেয়ে বেশি ভালোবাসে দাদাকে, না রে দিদি?

দিদি বলে—ওকথা বলতে নেই৷ মা’র কাছে ছেলে-মেয়ে সবাই সমান৷

বেশ ক’দিন পরে আর এক কাণ্ড ঘটলো৷ এবার স্বপ্ন দেখে প্রবীর চেঁচিয়ে উঠলো না৷ সম্মোহিতের মতো বিছানা থেকে নেমে, ঘরের দরজা খুলে সিঁড়ি দিয়ে নীচে এসে সদর দরজার খিল খুলে একেবারে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে৷

আর সেই কালো শাড়ি পরা ঘোমটা দেওয়া মূর্তিটার পিছনে চলতে থাকে, সে যেন এবার তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে ডাকতে ঘর থেকে পথে টেনে নিয়ে আসে৷

নীচে সদর দরজায় খুট করে শব্দ হতেই হঠাৎ প্রবীরের মায়ের ঘুম ভেঙে যায়৷—খোকা, কিসের শব্দ হল রে? আলোটা একবার জ্বালা তো…! বলেই ছেলের গায়ে হাত দিয়ে তাকে জাগিয়ে দিতে গিয়েই তিনি চমকে ওঠেন…! কোথায় খোকা! এ্যাঁ, বিছানা যে শূন্য! সারা বিছানায় হাত বুলিয়ে দেখেন৷

ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসতেই বুকটা তাঁর কাঁপে থরথর করে৷ ঘর তো অন্ধকার, তবে খোকা গেল কোথায়? খোকা—খোকা বলে ডাকেন, কিন্তু কোনো সাড়া-শব্দ নেই৷

খাট থেকে নেমে এসে তাড়াতাড়ি আলোটা জ্বালাতেই আরো যেন বুকের স্পন্দন বেড়ে যায়৷ বাথরুম তো ঘরের সঙ্গে সংলগ্ন৷ ঘরের ভেতর দিয়েই ঢোকার দরজা৷ সেটা বন্ধ৷ শিকল টানা রয়েছে৷ তবে এত রাত্রে দরজা খুলে সে কোথায় গেল?

দেওয়ালের বড় ঘড়িটা টিক টিক শব্দ করছিল৷ তার দিকে চট করে তাকাতেই বুকের রক্ত হিম হয়ে যায়৷ তখন রাত্তির দুটো৷ ওমা, ওই রাতদুপুরে ছেলে গেল কোথায়!

শিউরে ওঠে তাঁর সর্বাঙ্গ৷ প্রবীর নাম হলে কি হয়, বড় ভীতুপ্রকৃতির ছেলে৷ একলা রাত্রে বাথরুমে যেতে গেলেও মাকে সে আগে ডাকে৷

কোনোরকমে শাড়িটা গায়ে জড়াতে জড়াতে পটপট করে দালান ও সিঁড়ির সুইচগুলো টিপতে টিপতে নীচে নেমে এলেন তিনি৷ কিন্তু সেখানে এসে সদর দরজাটা খোলা হাঁ-হাঁ করতে দেখে ভয়ে যেন হাত-পা তাঁর হিম হয়ে যায়৷ ‘লক্ষ্মণ—এই লক্ষ্মণ বলে চাকরের দরজায় ছুটটে গিয়ে ধাক্কা দিতে থাকেন৷

‘কি মা!’ বলে সে একেবারে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এল৷

—দেখ তো, দাদাবাবু এই রাত্রে কোথায় বেরিয়ে গেল৷ ওপরে নেই, বাথরুমে নেই, আমি তন্নতন্ন করে সব খুঁজে দেখেছি৷ নীচের দরজা খোলা দেখে আমার বুকের ভেতরটা থরথর করে কাঁপছে ভয়ে৷ নিশ্চয় সে রাস্তায় বেরিয়ে গেছে৷

‘সে কি!’ বলেই সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মণ ছুটে রাস্তায় বেরিয়ে গেল৷

সাদার্ন এ্যাভিন্যুর দীর্ঘ পথটা শূন্য জনহীন, শুধু নিওন বাতির আলোয় জ্যোৎস্নারাতের মতো চারিদিক ঝলমল করছে৷ সদর থেকে রাস্তায় নেমেই লক্ষ্মণ দ্বিধায় পড়ে যায়৷ কোন দিকে যাবে—সামনে লেকের দিকে, না বাঁয়ে গোলপার্কের দিকে? অথবা ডানহাতি রবীন্দ্র স্টেডিয়াম-এর দিকে?

হতভম্বের মতো এদিক-ওদিক তাকিয়ে কোথাও কোনো মানুষের চিহ্ন দেখতে না পেয়ে শেষে লেকের দিকেই ছুটলো লক্ষ্মণ৷ ও পল্লীগ্রামের মানুষ—অনেক রকম দৈত্যদানো, ভূত-প্রেতের কাহিনী ওর শোনা ও জানা ছিল৷ নিশির ডাকের কথাও জানে এবং বিশ্বাস করে৷

দৈত্যদানারা নিষুতিরাতে নাকি ওদের গাঁয়ে এমনি অনেক মানুষকে ঘর থেকে টেনে বার করে নিয়ে যায়৷ তারপর কাউকে গাছের ওপর তুলে সেখান থেকে ফেলে মারে৷ কাউকে বা পুষ্করিণী জলাশয়ে চুবিয়ে মারে৷

লক্ষ্মণের দৃঢ় বিশ্বাস, তেমনি কিছু একটা হয়তো হয়েছে৷ নইলে দাদাবাবু যা ভীতু, একা এই গভীর রাত্রে এইভাবে কখনই রাস্তায় বেরিয়ে আসতে পারে না!

খানিকটা ছুটে গিয়ে সে একবার থমকে দাঁড়ালো৷ তারপর ‘দাদাবাবু দাদাবাবু’ বলে চেঁচিয়ে ডাকলে৷ কিন্তু কোথাও কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে, আবার তেমনি সে ছুটতে লাগল লেকের দিকে৷

সুইমিং পুলের কাছাকাছি আসতেই সে চমকে উঠল—ওই তো দূরে মানুষের মতো একটা ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে! হ্যাঁ, ঠিকই৷ ওই তো দাদাবাবু, মোহাচ্ছন্নের মতো যেন এগিয়ে চলেছে পা-পা করে৷ তাহলে তার অনুমানই ঠিক৷ ‘দাদাবাবু!’ বলে সে যে এত চিৎকার করছে, কিছুই যেন তার কানে যাচ্ছে না৷ কিসের একটা ঘোরে যেন ডুবে আছে৷

প্রবীর তখনো তেমনি চলেছে৷ সত্যি কিছুই সে শুনতে পায়নি৷ একেবারে জলের ধারে তখন গিয়ে পড়েছিল প্রবীর৷ তাই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গিয়ে একেবারে পিছন থেকে তাকে জাপটে ধরল লক্ষ্মণ৷ আর দু’পা এগুলেই একেবারে জলের মধ্যে পড়ে যেত৷

‘কে?’ বলেই শিউরে উঠল বটে প্রবীর, কিন্তু তখনো তার সেই আচ্ছন্ন ভাবটা কাটেনি৷ তেমনি রয়েছে৷

—আমি লক্ষ্মণ, দাদাবাবু! আপনি এখানে কি করে এলেন? ভয়ার্ত স্বরে সে প্রশ্ন করলে৷

—কোথায় গেল সে? চোখেমুখে তখনো তেমনি মোহাচ্ছন্ন ভাব৷

—কে দাদাবাবু?

—ওই যে কালো শাড়ি পরা সেই মেয়েটা! যার মাথায় ঘোমটা—শুধু মুখের একটুখানি দেখা যায়, ধবধবে সুন্দর হাত দিয়ে যে আমায় হাতছানি দিয়ে ডেকে এনেছে! কোথায় গেল সে…বলতে বলতে ছোট ছেলের মতো তার গলা দিয়ে যেন কান্নার স্বর বেরিয়ে আসে৷

ওর হাত দুটো এবার দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে বেশ করে বারকতক ঝাঁকানি দিলে লক্ষ্মণ৷ তারপর এক আঁচলা জল খপ করে লেক থেকে তুলে নিয়েই ওর মুখের ওপর ঝাপ্টা মারলে৷

সঙ্গে সঙ্গে সেই মোহগ্রস্ত, আবিষ্ট ভাবটা কেটে গিয়ে প্রবীর যেন স্বপ্নের রাজ্য থেকে একেবারে বাস্তব জগতে ফিরে আসে৷ তখন চারিদিকে একবার সভয়ে তাকিয়ে লক্ষ্মণের হাতটা জড়িয়ে ধরে সে বলে উঠল—এখানে আনলে কেন আমায়? আমার বড্ড ভয় করছে! শিগগির বাড়ি চলো—মা কোথায়?

পরের দিন ওদের বাড়ির যিনি প্রবীণ ডাক্তার, তিনি এলেন প্রবীরকে দেখতে৷ তাকে ভালো করে পরীক্ষা করে বললেন, এর নাম ‘সম-নাম-ব্যুলিজম’৷ এ একরকম কঠিন ব্যাধি৷ ঘুমের ঘোরে ঘর থেকে অচৈতন্যের মতো বেরিয়ে যায় রুগী, তারপর এমন সব অসম্ভব অসম্ভব কাণ্ডকারখানা করে যে বিশ্বাস করা যায় না৷ আর এভাবে নানা দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় পড়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যু হয়৷

ভয়ে ওর মায়ের হাত-পা যেন ঠাণ্ডা হয়ে যায়৷ কি হবে তাহলে! ডাক্তারবাবুর কাছে কেঁদে পড়েন৷ তাঁর একমাত্র ছেলে ওই প্রবীর৷

ডাক্তারবাবু বড় বড় ‘নিউরোলজিস্ট’ ও ‘স্পেশালিস্ট’দের নাম করে দিলেন, যাঁরা ওইরকম মানসিক ব্যাধি ও নার্ভের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ৷

বড়লোকের ছেলে প্রবীর৷ টাকাপয়সার অভাব নেই৷ তাই সঙ্গে সঙ্গে ওর মা চিকিৎসকের বাড়ি ছুটলেন৷ এক ডাক্তার ছেড়ে আর এক ডাক্তার—এমনি করে কলকাতার বহু বড় ডাক্তারকে দেখালেন এবং এইভাবে চিকিৎসার পিছনে প্রবীরের মা বহু টাকা খরচ করলেন৷ কিন্তু তাতেও বিশেষ কোনো ফল হল না৷

ইতিমধ্যে আরো দু’দিন ওইভাবে ঘর থেকে গভীর রাত্রে নেমে গিয়েছিল প্রবীর৷ লক্ষ্মণ ইদানীং রাত্রে ঘুমোয় না, জেগে থাকে৷ তাই যেমন সদর দরজা খুলতে যাবে, অমনি লক্ষ্মণের কাছে ধরা পড়ে ফিরে এসেছে প্রবীর ঘরে৷

কিন্তু তার মুখে সেই এক কথা—কোথায় গেল সেই মেয়েটা? সেই কালো শাড়ি পরা ধবধবে ফর্সা মেয়েটা? যার মাথায় ঘোমটা, যে আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছিল এখুনি!

লক্ষ্মণ এবারও তার হাতদুটো জোর করে চেপে ধরে কোমরে বার বার ঝাঁকানি দিতেই আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে প্রবীর৷

চিন্তায় ভেঙে পড়েন প্রবীরের মা৷ পরীক্ষার আর সাত দিন বাকি৷ ছেলের যেন সব সময় কেমন একটা বিমর্ষ ভাব, কি যেন গভীর চিন্তায় মগ্ন৷ সামনে পড়ার বই খোলা পড়ে থাকে—ওর মন বুঝি চলে যায় অন্য কোনোখানে, কে জানে!

পুজোমানত, ঝাড়ফুঁক, মাদুলী, জলপড়া, হেকিমী, কবরেজী যে যা বলেছে সব করে যখন হতাশ হয়ে ভাবতে থাকেন প্রবীরের মা এখন কি করবেন, ঠিক সেই সময় এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর খবর পেলেন৷ তিনি নাকি এইরকম দুরারোগ্য সব ব্যাধি ভালো করেছেন অনেক৷ থাকেন দুর্লভপুর, হুগলী জেলার এক সুদূর পল্লীতে৷

লক্ষ্মণের সঙ্গে প্রবীরকে নিয়ে একদিন তিনি খুঁজে খুঁজে সেখানে গিয়ে হাজির হলেন৷

তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর ঘরে ঢুকে হকচকিয়ে যায় প্রবীর৷ তান্ত্রিক সন্ন্যাসীর কথা বইয়ে পড়েছিল, কিন্তু কোনোদিন চোখে দেখেনি৷ সে আশ্চর্য হয়ে যায়, ঠিক যেমনটি গল্পে-উপন্যাসে পড়েছিল, হুবহু সব মিলে যাচ্ছে৷ মড়ার খুলি, নরকঙ্কাল চারিদিকে ছড়ানো৷ ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা বিরাট ধুনি জ্বলছে৷ বাঘছালের একটা আসন তার সামনে পাতা৷ তার ওপর বসে আছেন রক্তবস্ত্র পরিহিত জটাজুটধারী এক সন্ন্যাসী, কপালে তাঁর লালচন্দনের রেখা—একটা নয় তিনটে৷

প্রবীরের মা সন্ন্যাসীকে প্রণাম করে তাঁর পায়ের কাছে বসে কাঁদতে কাঁদতে ছেলের রোগের কথা সব বললেন৷

সন্ন্যাসী নিঃশব্দে সব শুনলেন৷ তারপর ‘জয় তারা!’ বলে একটা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন৷ এমন বিকট সে কণ্ঠস্বর যে আতঙ্কে সবাই শিউরে ওঠে৷ বললেন—মায়ের কৃপায় সব ঠিক হয়ে যাবে৷ ভাবিসনি কিছু৷ জয় তারা!

কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন—কে ওকে এমনি করে ডাকে বাবা? ছেলে বলে, কালো শাড়ি পরা মেয়েছেলে৷ ধবধবে সুন্দর হাত দিয়ে কেবল ওকে ডাকে৷ তার মুখ একদিন মাত্র একটুখানি দেখেছিল, আর কোনোদিন দেখেনি৷ শুধু হাতছানি দিয়ে ডাকে৷ কে সে? কেন ওকে ডাকে বাবা?

প্রবীর এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল৷ হঠাৎ বলে ফেললে, আমি দেখব তাকে, আমায় দেখান!

—দেখবি কে ডাকে?

—হ্যাঁ, আমি দেখব৷ বড্ড আমার তাকে দেখতে ইচ্ছা করে৷ দেখাতে পারবেন? ঠিক বলছেন? মুখে একথা বললেও মনের মধ্যে কিসের একটা আতঙ্ক যেন প্রবীর চেপে রাখে৷ সন্ন্যাসী তখন জ্বলজ্বলে চোখে প্রবীরের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন—আচ্ছা দেখাচ্ছি৷ তোমার নাম-গোত্র কি বল তো মা?

প্রবীরের মা যেই বলে দিলেন৷ অমনি ‘তারা! তারা!’ বলে একটা বিরাট হুঙ্কার ছাড়লেন সন্ন্যাসী৷ তারপর ওদের হাতে জ্বলন্ত ধুনি থেকে একটু ছাই তুলে দিয়ে বললেন— দু’হাতে মুঠি করে চোখ বুজে থাক৷ আমি যখন বলব তখন চোখ খুলবি৷ কিন্তু তার আগে যদি চোখ চাস, তাহলে একেবারে মৃত্যু৷ কেউ রক্ষা করতে পারবে না, মনে রাখিস৷

প্রবীর ও তার মা, সন্ন্যাসী যেমন নির্দেশ দিলেন, সেইভাবে চোখ বন্ধ করে বসে রইলেন৷ চুপিচুপি তিনি ছেলেকে বললেন, খবরদার, তাকাসনি যেন বাবা!

এবার সন্ন্যাসী তাঁর তন্ত্রমন্ত্রের ক্রিয়া শুরু করলেন৷ সন্ন্যাসী অস্ফুট স্বরে কি সব মন্ত্র আউড়িয়ে যেতে লাগলেন৷ শেষে এক সময় ‘তারা! তারা!’ বলে এমন বিকট এক হুঙ্কার ছাড়লেন যে ওরা আঁতকে উঠল ভয়ে৷ সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলে উঠলেন—দেখ এবার চোখ খুলে!

প্রবীর বলে উঠল—হ্যাঁ, ওই তো—ওই তো সেই কালো শাড়ি পরা মেয়ে, মুখে ঘোমটা! সেই হাত! ওই ধবধবে সুন্দর হাত দিয়ে ও ডাকে আমায়—কে! কে তুমি? বলো—বলো আমায়?

প্রবীরের মা এবার বলে উঠলেন—বাবা, ওর মুখটা তো দেখতে পাচ্ছি না! ঘোমটা ঢাকা! যদি একবার দেখান দয়া করে! দেখি ও কে?

—আচ্ছা দেখাচ্ছি৷ আবার তোরা চোখ বোজ, যখন বলব খুলবি৷

মিনিট পাঁচেক বিড়বিড় করে আবার কি সব মন্ত্রতন্ত্র পড়লেন সন্ন্যাসী৷ তারপর বললেন—খোল চোখ!

চোখ খুলেই প্রথম চিৎকার করে উঠলেন প্রবীরের মা—এ্যাঁ, তুমি! ব্যস, শুধু ঐ দুটি কথা বলেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে মূর্ছা গেলেন৷

প্রবীর কেঁদে উঠল—মা, মাগো!

সন্ন্যাসী তখন ধুনি থেকে একমুঠো ছাই তুলে নিয়ে প্রবীরের হাতে মন্ত্র পড়ে দিয়ে বললেন—তোমার মায়ের মুখে বেশ করে এটা মাখিয়ে দাও!

প্রবীর সেই ছাই যেমন ওর মায়ের মুখে মাখিয়ে দিলে, অমনি তিনি ধীরে ধীরে চোখ খুললেন৷ তারপর উঠে বসলেন৷

প্রবীর তখন বললে, কে ওই মূর্তি মা? তুমি ওকে চেনো? বলো মা সত্যি করে! ওই মুখখানা আমি শুধু একদিন দেখেছিলুম৷ জানার জন্যে আমার বুকের ভেতরটা কেমন করছে! আমি আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারছি না, তুমি কি বুঝতে পারো না?

তখনো প্রবীরের মা তেমনি নীরব৷ নিরুত্তর৷ ছেলের কাছে কি বলবেন?

‘তারা! তারা!’ বলে সন্ন্যাসী আবার সেইরকম এক বিরাট হুঙ্কার ছেড়ে প্রবীরের মায়ের মুখের ওপরে গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন৷ যেন তাঁর ওই বড় বড় রক্তচক্ষু দুটো দিয়ে এখুনি তাঁকে ভস্ম করে ফেলবেন৷

সঙ্গে সঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল প্রবীরের মায়ের সারা গায়ে৷ এবার আর গোপন করতে পারলেন না তিনি৷ প্রবীরকে আস্তে আস্তে শুধু বললেন—ও তোর মা!

—এ্যাঁ, আমার মা! তাহলে তুমি কে? বিস্ময়ে হতবাক হয়ে প্রবীর তার মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে৷

প্রবীরের মা পাষাণ-মূর্তির মতো নিস্তব্ধ৷ তাঁর দুই চোখে ধারা বয়ে যায়৷

সন্ন্যাসী এতক্ষণ নিঃশব্দে প্রবীরের মায়ের দিকে তাকিয়েছিলেন, হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠলেন—ইনি তোর চোরনী মা! হাসপাতালের নার্সকে মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে তোকে বদলে নিয়েছিলেন নিজের মেয়ের সঙ্গে৷ পুত্রসন্তান ওঁর কোনোদিন হবে না, এই কথাই জ্যোতিষীরা গণনা করে বলেছিলেন৷ সেই গণনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্যে তোকে ওই মায়ের বুক ভেঙে চুরি করে ছিনিয়ে এনেছিলেন৷ তোর ওই আসল-মা মরে গিয়েছেন৷ তোকে দেখার বাসনা তাঁর মরেনি৷ তাই আর থাকতে না পেরে মাঝে মাঝে ছুটে আসেন দেখতে নিজের ছেলেকে৷

—আমি পাপী! আমি অপরাধিনী! আমায় ক্ষমা করো বাবা৷ বলে কাঁদতে কাঁদতে সন্ন্যাসীর পায়ে তিনি লুটিয়ে পড়েন৷

সন্ন্যাসী ঘৃণায় পা-দু’টো সরিয়ে নেন৷ তাঁকে ছুঁতে দেন না৷

তাই আবার যেই সন্ন্যাসীর পায়ে ধরতে গেলেন, অমনি তিনি হুঙ্কার দিয়ে প্রবীরের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন—ওর কাছে মাপ চা!

—না না, তা হয় না৷ প্রবীর কেঁদে মায়ের পায়ে লুটিয়ে পড়ে৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *