মরণের পরেও – গজেন্দ্রকুমার মিত্র
মৃত্যু-পথযাত্রিীকে কে আর কটু কথা বলতে চায়? তবু যে অমরেশের মুখ দিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে গেল, সে অনেক দুঃখেই।
আজ ছ’মাস শুয়ে আছে সুহাসিনী, কঠিন রোগ—কিন্তু তাতেও কি স্বভাবের এতটুকু পরিবর্তন হয়েছে? বিয়ের পর এই দীর্ঘ আটটা বছর অমরেশের কেটেছে যেন একটানা একটা দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়ে। একটু বেশি বয়সেই বিয়ে করেছিল অমরেশ, সে বয়সে রোম্যান্সের লোভে মানুষ ততটা বিয়ে করে না, যতটা করে গৃহে শান্তি, শৃঙ্খলা এবং একটু সেবার লোভে। তবু ফুলশয্যার রাত্রে নবোঢ়া বধূর সঙ্গে প্রথম পরিচয়—মন কিছু স্বপ্ন দেখেছিল বৈকি! কিন্তু সে স্বপ্ন ভাঙতেও বেশি দেরি হয়নি। সামান্য দু’একটা কথার পরই—অপরিচয়ের অন্তরাল দূর হওয়ামাত্র সুহাসিনী জানতে চেয়েছিল যে বিবাহের আগে অমরেশ কী পরিমাণ প্রেম করে বেড়িয়েছিল, আর কতগুলি মেয়ের সঙ্গে।
সেই সূত্রপাত—কিন্তু শেষ নয়।
প্রশ্নটার উত্তর পেয়ে সুহাসিনীর তৃপ্তি হয়নি—অথাৎ সংশয় যায়নি। অমরেশও ডাগর মেয়ে বিয়ে করেছিল—এ প্রশ্ন, এ সংশয় তার মনেও জাগতে পারে, সে কথাটা কিন্তু সুহাসিনী একবারও ভাবেনি। যেন তা অসম্ভব, সুহাসিনী সমস্ত সংশয়ের ঊর্ধ্বে—সিজারের পত্নীর মত। অথচ তারপর থেকে একদিনও অমরেশকে সে শান্তি দেয়নি। ‘ওদিকে চেয়েছিলে কেন, ওদের বাড়ির সেই ধিঙ্গি অসভ্য মেয়েটা বুঝি জানলায় ছিল?…অতই বা ঠাকুরঝির বাড়ি যাওয়া কেন? ওর ননদ বুড়ীকে দেখে বুঝি আর আশ মেটে না?…এতক্ষণ কোথায় ছিলে? অফিসে তো তোমাদের ছুটি হয় পাঁচটায়—তুমি নটা পর্যন্ত অফিসে ছিলে? কাকে বোকা বোঝাও বল তো ? আমি যেন কিছু বুঝি না!…আজ আবার এত দেরি কেন ? আজ তো অফিস নেই? বায়স্কোপে গিয়েছিলে? তা তো যাবেই। আমাকে নিয়ে যেতেই তোমার সময় নষ্ট হয়!..কী বললে? বন্ধুরা জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল? কে বন্ধু? সমর সেন নিশ্চয়? বেবিটা সঙ্গে ছিল তো? আর বলতে হবে না। সেইজন্যে এত দেরি। সাড়ে আটটায় শো ভাঙে, বাড়ি ফিরলে রাত সাড়ে নটায়। তারপর? কতগুলি টাকা বেবির পিছনে খরচ হল?…বাজারে গিয়েছ সেই কখন? একঘন্টা ধরে বাজার? না অমনি যাবার পথে আরতিদের বাড়ি চা খেয়ে যাওয়া হল?’ ইত্যাদি। সহস্র প্রশ্নের মধ্যে কয়েকটি তুলে দেওয়া হল। বেশি বলার প্রয়োজন নেই—পাঠকদের অনেকেরই এসব প্রশ্নের সঙ্গে পরিচয় আছে, নিজের ‘মনের মাধুরী’ মিশায়ে বাকিগুলো তৈরি করে নেবেন।
তবে শুধু যদি প্রশ্ন হত তো অত ভাববার ছিল না। ঝি চার মাসের বেশি রাখবার উপায় নেই। যেমন করেই হোক তাকে তাড়াবে সুহসিনী। তা কে জানে যুবতী, কে জানে প্রৌঢ়া। ঘরের জানলা খোলা প্রায় বন্ধ করতে হয়েছিল, সুখের চেয়ে সোয়াপ্তি ভাল—এই ভেবে। আর প্রতিবাদ করা বৃথা—মান-অভিমান কান্নাকাটি উপবাস—এসব অস্ত্র সুহাসিনীর তূণে যেন যোগানো। সুতরাং সব আশাই অমরেশ বিসর্জন দিয়েছিল। অশান্তির ভয়ে তার মানসিক অবস্থা এমন হয়েছিল যে বাস করবার মত একটা কুয়া পেলেও সে বেঁচে যেত!
তারপর এই অসুখ: এ আরও অসহ্য। কোন কাজ নেই, শুয়ে শুয়ে শুধু স্বামীকে সন্দেহ করা ছাড়া। সেবা করার জন্যে যে কোন আত্মীয়াকেই আনায়, তার সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে বসে সুহাসিনী। পথ্য না খাওয়া, ওষুধ না খাওয়া—এ তো অমোঘ অন্ত্র। শুধু পাগল হয়ে যেতে বাকি ছিল অমরেশের। ইদানীং সে সমস্ত মনে-প্রাণে প্রতীক্ষা করত স্ত্রীর মৃত্যুর—যদিও প্রার্থনা করতে তার সংস্কারে বাধত। মনের কাছে সে কিছুতেই স্বীকার করতে চাইত না যে সে স্ত্রীর মৃত্যুই চাইছে।
সবচেয়ে মজা এই—ওর এ মনোভাব সুহাসিনীও জানত। প্রায়ই বলত, ‘ওগো আর দেরি নেই—আমি মলে যে তোমার শান্তি হয় তা আমিও জানি। আর ক’টা দিন? হয়ে এল। এতদিন পারলে আর ক’টা দিন ধৈর্য ধরে থাকো…আমার শেষ হয়ে এসেছে—’
আবার পরক্ষণেই হয়তো বলত, ‘আমার তো হয়ে এসেছে। যাই—তারপর যত খুশি মজা লুটো। তখন তো আর বলতে আসব না। এই ক’টা দিন আর সহ্য হচ্ছে না। এত তাড়া!’ সেদিনও কথাটা উঠেছিল এই প্রসঙ্গেই। কেউ নেই সেবা করার, অমরেশেরও আর অফিস কামাই করা সম্ভব নয়—সে প্রস্তাব করেছিল একটা নার্স রাখার। সুহাসিনী যেন জ্বলে উঠেছিল একেবারে—‘হ্যাঁ—তার কম আর নেশা জমবে কেন। আমি এ ঘরে পড়ে পড়ে শুষব আর উনি পাশের ঘরে নার্সকে নিয়ে ফুর্তি করবেন!…আর হয়তো বড় জোর মাসখানেক আছি, তাও তোমার সহ্য হচ্ছে না? দগ্ধে দগ্ধে না মারলে আর চলছে না বুঝি? উঃ, কী পিশাচ তুমি, মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা দিতে একটু মায়া হয় না?…মরবার পর যা করবে তুমি তা তো বুঝতেই পারছি—শেষ ক’টা দিন একটু শান্তিতে থাকতে দাও!’
এতটা বলার পরিশ্রমেই তার শ্বাস আটকে আসছিল। কোনমতে দম নিয়ে বলেছিল, ‘তবে তাও বলে রাখছি, মনে করো না যে আমি মরে তোমাকে অব্যাহতি দেব। সারা জীবন জ্বালিয়েছ, মরে তার শোধ তুলব। আবার জন্মাব, তোমার কাছে-কাছেই জন্মাব—ছায়ার মত লেগে থাকব সঙ্গে—যা খুশি তাই করবে, তা করতে দেব না কিছুতেই!’
অতখানি স্বার্থত্যাগের পর এতটা অকৃতজ্ঞতা পেলে কার মাথার ঠিক থাকে? অমরেশও সামলাতে পারেনি—বলে ফেলেছিল, ‘মরবার পর যদি জন্মাও তো মানুষ হয়ে আর জন্মাবে না—এটা ঠিক। কুকুর বেড়াল হয়েই জন্মাবে। কিংবা যে খল তুমি, সাপ হওয়াই বেশি সম্ভব!’
অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে চেয়ে সুহাসিনী বলেছিল, ‘বেশ তো, তাই না হয় জন্মাব। কিন্তু তাতেই কি রেহাই পাবে ভেবেছ? দেখে নিও!’
কিন্তু এসব তো কথার কথা। মনে করে রাখবার কথাও নয়, কেউ মনে রাখেওনি।
কথাটা বলার দিন-আষ্টেকের মধ্যেই সুহাসিনীর মৃত্যু হয়েছিল। স্বস্তির নিশ্বাস, মুক্তির নিশ্বাস ফেলে বেঁচেছিল অমরেশ ঠিকই—তবু একটু দুঃখও হয়েছিল স্ত্রীর জন্য। বেচারী!…ও-ই কি অশান্তি কম পেলে! চির-জীবন যে ঈর্ষার আগুন অমরেশকে ঘিরে ছিল তা কি ওকেও দগ্ধ করেনি? জীবনে শাস্তি যে কেমন তা তো অনুভবই করতে পারলে না কখনও। আর এই অসময়ে যে—স্বামীকে সে এক দণ্ডও চোখের আড়ালে রেখে স্বস্তি পেত না—তাকেই চিরকালের মত ত্যাগ করে চলে যেতে হল!
আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবরা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার বিয়ের প্রস্তাবটা এনেছিলেন। সত্যিই—এমন কিছু বয়স হয়নি। চল্লিশ-একচল্লিশ বছরে আজকাল অনেকেই প্রথম বিয়ে করে। ঘরেও তে লোক চাই একটা—শুধু চাকর-বাকরের ভরসায় কিছু এখন থেকে থাকা যায় না। বলতে গেলে সারা জীবনটাই তো পড়ে রইল!
কিন্তু অমরেশ কারুর কোন কথাই শোনেনি। বাবা, আবার! অনেক কষ্টে রেহাই পেয়েছে সে—মুক্তির আনন্দে সে যেন পাগল হয়ে উঠেছে। শুধু যখন খুশি এবং যত খুশি বাইরে ঘোরা, আর যত রাত্রে ইচ্ছা বাড়ি ফেরার মধ্যে যে এত আনন্দ আছে, কে জানত! একবারেই যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে তার—আর দরকার নেই, ধন্যবাদ! খাওয়া-দাওয়া? তার জন্য হোটেল আছে। অসুখ-বিসুখ? হাসপাতালের অভাব কি? না হয় পেভ্মেন্ট তো কেউ ঘোচায়নি? মরবার পরের কথা সে ভাবে না—যেখানে মরবে তারাই গন্ধ হবার ভয়ে যেমন করে হোক লাশ সরাবার ব্যবস্থা করবে।
তবে এ তো প্রথম আনন্দের উম্মত্ততা! এ কেউ বিশ্বাস করেনি। শুধু এইটে বুঝেছিল যে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করেত হবে।
বছর খানেক পরে পূজার সময় বেশি ছুটি নিয়ে রাজগীরে গেল অমরেশ। সেখানে ঠিক ওর পাশের বাংলোতে যিনি ভাড়া ছিলেন সেই শুভ্রাংশুবাবুর সঙ্গে হঠাৎ খুব ভাব জমে গেল। ওরা একসঙ্গে কুণ্ডে স্নান করতে যায়—অত ভোরে এবং অত রাত্রে আর কেউ যেতে চায় না। দুজনের রুচির সঙ্গে দুজনের মিল হওয়াতে ক্রমে অন্তরঙ্গতা বেড়ে গেল। শুভ্রাংশুবাবুর চব্বিশ পঁচিশ বছরের অনূঢ়া ভগ্নীটির সঙ্গেও পরিচয় হতে যে বিলম্ব হল না তা বলাই বাহুল্য। এবং সেই ভগ্নীটি, রুচিরা তার নাম—শিগগিরই আবিষ্কার করল যে একটি বাচ্চা চাকরের ওপর অমরেশের গৃহস্থালীর ভার। সে রান্না করে অখাদ্য, চা করে জলের মত এবং কোন কাজটাই ভাল করে করতে পারে না।
ফলে প্রত্যহই একটা দুটো ব্যঞ্জন ও-বাংলো থেকে এ-বাংলোতে এসে পৌঁছতে লাগল। সকালে দুপুরে বিকেলে এবং সন্ধ্যায়—চায়ের কাপ নিয়ে রুচিরা নিজেই আসত। একদিন দুদিন ছাড়া ও-বাংলোতেই আহারের নিমন্ত্রণ হতে লাগল এবং কয়েকদিন পর থেকেই অমরেশ দেখল যে, ওর ঘরকন্না ও শয্যার বিশৃঙ্খলা ঘুচে গেছে। কে যেন ওর অনুপস্থিতিতে এসে তার মায়া-হস্ত বুলিয়ে সব কিছু সুন্দর করে গুছিয়ে রেখে যায়।
ঋষিরা একেই বোধ হয় মহামায়ার ফাঁদ বলেছেন। অমরেশের অত তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্বেও সে আবার রুচিরাকে নিয়ে গৃহস্থালী পাতবার কথাটা ভাবতে লাগল। সুবিধাও হয়ে গেল খানিকটা। কথাটা ওপক্ষ থেকেই প্রথম উঠল। শুভ্রাংশু একদিন বলেই ফেলল কথাটা, ‘এমন করে আর কতদিন চলবে অমরেশবাবু, আর একবার সংসার পাতুন। দেখুন, বলেন তো—আমরা তো আপনাদেরই পাল্টি ঘর, রুচিরাও কিছু খারাপ মেয়ে নয়। লেখাপড়াও কিছু জানে, গৃহস্থালীর কাজ—যেটা আপনার বেশি দরকার, সেটার সার্টিফিকেট ওকে বোধ হয় আপনিই দিতে পারবেন—’
অমরেশ আর না বলতে পারলে না। বলল, ‘সে আপনি ভেবে দেখুন। আগে আপনার ভগ্নীর মত নিন—আমার মত প্রৌঢ়কে—অবশ্যি একটা বাড়িও আছে কলকাতায়, মোটা মাইনের চাকরিও করি—তবু আমাকে ওর পছন্দ হবে কি?’
‘বিলক্ষণ। ওই কি আর কচি খুকি?’
কথাটা রাত্রে কুণ্ড থেকে ফেরবার পথে হয়েছিল। অন্ধকার নির্জন রাস্তা তার মনে মোহ বিস্তার করেছিল রুচিরার চিন্তাকে ঘিরে। অমরেশ লঘু মনেই বাসায় ফিরল। ঘরে ফিরে দেখলে শয্যাটি পরিপাটি সাজানো। কাপড়-জামা গুছিয়ে কিছু বাক্সয়, কিছু আনলায় তোলা হয়েছে। আলোটি পরিষ্কার ঝকঝক করছে। তৃপ্তি ও কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল। তিক্ত অভিজ্ঞতার আশঙ্কা চলে গেল বহুদূরে। রাত্রে খাওয়ার আগে ও-বাড়ি থেকে মাংস এবং মিষ্টান্ন এসে পৌঁছাতে আরও ভাল লাগল। এমনি জীবন-সঙ্গিনীই তো মানুষের কাম্য—অমরেশও তো তাই চেয়েছিল।
খেতে বসে সবে এক গাল মাত্র রুটি মাংসের ঝোলে ডুবিয়ে মুখে পুরেছে অমরেশ—তার স্বাদ ও গন্ধ সমস্ত অনুভূতিকে অধিকতর লালায়িত করে তুলেছে মাত্র, এমন সময়ে অকস্মাৎ একটা প্রকাও বন-বেড়াল ও-পাশের জানলা দিয়ে লাফিয়ে পড়ল, একেবারে মাংসর বাটিটার ওপর। বাটিটা উল্টে মাংসও যেমন পড়ে গেল, আবার লাফিয়ে ফেরবার পথে মিষ্টান্নের প্লেট্টাও ভেঙে খানখান হয়ে গেল ওর পায়ের আঘাতে।
হৈ-হৈ করে উঠল ওর চাকর রাজু, অমরেশ নিজেও। কিন্তু ততক্ষণে অনিষ্ট যা হবার তা হয়েই গেছে। চোখের নিমেষে যেন ঘটে গেল ঘটনাটা। রুচিরা আর তার বৌদিও ছুটে এল ও-বাড়ি থেকে। অমরেশের কোন নিষেধ না শুনে ওরা নতুন করে খাবার এনে দিল—ব্যাপারটা তখনকার মত মিটেই গেল। রাজু বলল, ‘বাপ রে, বেড়ালটা যেন বাঘের মত, দেখেছেন বাবু? দেখলে ভয় করে।’
রুচিরা বললে, ‘আজ ক’দিনই দেখছি আমাদের বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরছে। অবশ্য আমাদের অনেক লোক থাকে বলে ঘরে ঢুকতে সাহস পায়নি। কী সাহস দেখেছেন? পাত থেকে খেতে চায়—বেড়ালের এমন সাহস তো কখনও দেখিনি!’
রাত্রে শুয়ে কথাটা ভাবতে ভাবতেই অমরেশ ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ কী একটা শব্দে ওর ঘুম ভেঙে গেল। কৃষ্ণপক্ষের শেষ রাত্রির জ্যোৎস্না ঘরে এসে পড়েছে, তার অস্পষ্ট আলোতে অমরেশ দেখল সেই বেড়ালটা ওরই বিছানায় এসে বসেছে এবং ওর দিকে চেয়ে গলায় অদ্ভুত একটা শব্দ করে গর্জন করছে। ঝগড়া করার সময় যেমন শব্দ বার হয় ওদের গলায়—তেমনি।
দৃশ্যটা এমন অচিন্তিতপূর্ব, এমন অবাস্তব যে দেখামাত্র ভয়ে চিৎকার করে উঠল অমরেশ। সেই চিৎকারেই বোধ হয় ভয় পেয়ে বেড়ালটা পালাল। রাজু ঘুম ভেঙে লাফিয়ে উঠল, ‘কী—কী বাবু, কী হয়েছে?’
কিন্তু সে উত্তর অমরেশকে আর দিতে হল না—তার আগেই পাশের বাড়িতে নারী কন্ঠের একটা আর্ত চিৎকার! এরা ছুটে গিয়ে শুনলে, সেই বেড়ালটাই ঘুমের মধ্যে রুচিরাকে আঁচড়ে দিয়ে গেছে।
কোন্ এক মৃত্যু-পথ্যাত্ৰিনীর অদ্ভুত অন্তিম দৃষ্টি ভেসে উঠল অমরেশের মানসপটে। কপাল ঘামে ভরে গেল। হাত দিয়ে সে ঘাম মুছতে গিয়ে দেখল হাত কাঁপছে থরথর করে।
অমরেশ আর একদিনও রাজগীরে রইল না। শুভ্রাংশুকে জানাল, জরুরী কাজ পড়েছে একটা—টেলিগ্রাম এসেছে। ওকে যেতেই হবে। এই সকাল এগারোটার গাড়িতেই।
শুভ্রাংশু ব্যাকুল হয়ে বললে, ‘কিন্তু এমন অকস্মাৎ—এমনভাবে—অনেক কথা রয়ে গেল যে অমরেশবাবু। এধারের—’
‘গিয়েই চিঠি দেব আপনাকে। বিচলিত হবেন না। আবার হয়তো ঘুরে আসতে পারি। কিন্তু আজ আমার মন বড় বিক্ষিপ্ত। আজ আর কিছু বলতে পারছি না। মাপ করবেন।’
শুভ্রাংশু আর কিছু বলল না। শুধু তার স্ত্রী বললে, ‘আচ্ছা, টেলিগ্রাম এল কখন? ভদ্রলোক বেড়ালের ভয়েই পালাচ্ছেন নাকি?’
রুচিরা রাগ করে বলল, ‘বৌদি যেন কি? আমরা কি! আমরা কি সবাই পথের দিকে চেয়ে বসে আছি যে কখন কার টেলিগ্রাম আসছে খবর রাখব?’
বৌদি মুখ টিপে হেসে বললেন, ‘তা বটে ভাই—আমারই অন্যায় হয়েছে।’
ট্রেন যায় একেবারে ওদের বাংলোর সামনে দিয়ে। অমরেশ খুব নিরুৎসাহ বিষণ্ণমখে রুমাল। নাড়ল, রুচিরার ছল-ছল চোখ দূর থেকেও ওর দৃষ্টি এড়ায়নি। ট্রেনখানা চলে যেতে অপাঙ্গে ভগ্নীর মুখের দিকে চেয়ে শুভ্রাংশু বলল, ‘নাও, এ আবার এক ফ্যাসাদ বাধল দেখছি!’
কিন্তু কলকাতায় ফিরল না অমরেশ। গভীর রাত্রেই মধুপুরে নেমে পড়ল। কালীপুর টাউনে ওর এক বন্ধুর বাড়ি আছে। বহুবার অমরেশ এসে থেকে গেছে, মালী ওকে ভাল করেই চেনে—থাকবার অসুবিধা হবে না।
তাই বলে অত রাত্রে তো আর সেখানে যাওয়া যায় না। অবশিষ্ট রাতটুকু এখানেই কাটাতে হবে।
প্ল্যাটফর্মের এক প্রান্তে মালগুলো জড়ো করে রেখে তাইতে ঠেস্ দিয়ে রাজু ঘুমোতে লাগল, অমরেশের চোখে কিন্তু ঘুম এল না। সে সেই নিস্তব্ধ প্ল্যাটফর্মেই পায়চারি করতে লাগল।
কত ট্রেন এল, কত ট্রেন গেল। যখন ট্রেন আসে যাত্রীদের গোলমাল, কুলীদের বিবাদ, ভেণ্ডারদের উচ্চকণ্ঠ—সবটা মিলে যে কোলাহল হয়, স্টেশনে যে প্রাণলক্ষণ জাগে তাতে খানিকটা অন্যমনস্ক হয় অমরেশ, আবার স্টেশনের আলো স্তিমিত হয়ে আসে এক সময়ে—কোলাহল যায় স্তব্ধ হয়ে, ওর মনও ফিরে আসে নিজের দুর্ভাগ্যে।
কথাটা ভাবছে অমরেশ। সারাদিন ধরেই ভাবছে।
এ কী হল ওর! শুধু কি ওর ভাগ্যেই যত অঘটন ঘটে। আট বৎসরের বিবাহিত জীবনে একদিনের জন্যও শাস্তি দেয়নি সুহাসিনী, মরবার পরও নিষ্কৃতি দেবে না? এ কী বিদ্বেষ তার, কী। অসম্ভব ঈর্ষা!
কিন্তু পূর্ব দিগন্তে উষার স্বর্ণাভাস জাগার সঙ্গে সঙ্গেই যেন মনের মধ্যে আশ্বস পায় একটা। চিন্তাটা সেই শেষ রাত্রিতে প্রথম মাথায় এসেছিল—আর ওকে ত্যাগ করেনি। এতক্ষণ ধরে যা কিছু ভেবেছে, চিন্তাটাকে মনে মনে মেনে নিয়েই ভেবেছে। কিন্তু এখন এই প্রত্যুষে একটা সংশয়ও ক্রমে দেখা দিল—সবটাই কাকতালীয় নয় তো? ওটা হয়তো সাধারণ বেড়াল একটা, বুনো বেড়াল। অমরেশের উত্তপ্ত কল্পনাই তাকে সুহাসিনীর স্মৃতির সঙ্গে জড়িত করেছে!
না—কাজটা অন্যায় হয়ে গেছে।
সামান্য একটা বুনো বেড়ালের ভয়ে চলে এল সে। এই আধুনিক যুগের সভ্য মানুষ!
পায়চারি থামিয়ে জোর করে যেন নিজের মনে বল আনে অমরেশ। রাজুকে ডাকে, ‘এই রাজু ওঠ্, দ্যাখ দিকি, একটা এক্কা কিংবা রিক্সা! চল্ এবার বাড়ি যাই!’
কালীপুর টাউনে যখন পৌঁছল, তখন বেশ ফরসা হয়ে গেছে। মালী ওকে দেখে খুশি হয়েই সেলাম করলে, ফটক খুলে তাড়াতাড়ি মালটালগুলো নামিয়ে নিলে।
‘বাবু সেই ঘরে থাকবেন তো? পুবদিকের ঘরটায়? ওইটে তো আপনার ভারি পছন্দ!’
‘হ্যাঁ, বাপু, ওই ঘরটাই আমাকে খুলে দাও।’ বাগানে শিউলি ফুল ফুটে আছে অজস্র। তার সঙ্গে এখনও জড়িয়ে আছে অসংখ্য রজনীগন্ধার সুবাসের স্মৃতি। হিমেল ভোরাই হাওয়ার সঙ্গে সেই মিষ্টি গন্ধ মিশে রাত্রি-জাগরণ-ক্লান্ত চিন্তাক্লিষ্ট অমরেশের সর্বাঙ্গ জুড়িয়ে গেল।
‘আঃ।’ আপনার মনেই বলে উঠল ও।
মালী কোমর থেকে চাবির গোছাটা হাতে করে এগিয়ে যায় দোর খুলতে। পিছনেই অমরেশ, তার পিছনে বিছানা ও সুটকেশ নিয়ে রাজু। ঘরটা বন্ধ আছে…দোর জানলা সব বন্ধ। বোধহয় দীর্ঘকাল ধরেই বন্ধ রয়েছে এমনি, দোর জানলা খুলে দেবার পর খানিকটা বাইরের বাতাস ঢোকবার আগে আর ওর মধ্যে যাওয়া যাবে না…মনে মনে ভাবে অমরেশ। কিন্তু হঠাৎ ওর চমক ভেঙে যায় মালীর আতঙ্ক-কন্টকিত অস্ফুট আর্তনাদে। তীক্ষ্ণকণ্ঠে সে প্রশ্ন করে, ‘কী হল শিউভনোসা?’
সঙ্গে সঙ্গেই এগিয়ে আসে খানিকটা।
ও কি?
ওরও গলা থেকে একটা আর্তস্বর বেরোয়। ঘরের মধ্যে প্রকাণ্ড কালো কুকর…ঈষৎ শীর্ণ হয়তো, জিভ বার করে হাঁপাচ্ছে এবং কেমন এক রকম জ্বলন্ত দৃষ্টি মেলে ওদের দিকে চেয়ে আছে!
খানিকটা চেয়ে থাকার পর ওদের পাশ কাটিয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেল কুকুরটা।
মালীর চোখ দুটো বিস্ফারিত, ভয়ে হাত-পা কাঁপছে।
‘কোথা থেকে এল বাবু কুকুরটা? দোর-জানলা সব বন্ধ।’
অমরেশেরও বুকের মধ্যেটা হিম হয়ে এসেছিল। কিন্তু তবু সে কণ্ঠস্বরে জোর দিয়ে বলল, ওই যে-নর্দমা।’
খোলা নর্দমা একটা আছে ঠিকই—তবে তার মধ্যে দিয়ে অতবড় কুকুর আসা কি সম্ভব? মালী সংশয় প্রকাশ করে।
‘কবে খুলেছিলে ঘরটা শেষ? সেই সময় হয়তো ঢুকে বসেছিল।’
‘খুলেছিলুম? সে তো মাসখানেক আগে। তবে হ্যাঁ—পরশু দু’খানা কাগজের দরকার হয়েছিল তাই একবার খুলেছিলুম। ওই যে তাকের ওপর পুরোন খবরের কাগজগুলো আছে, সেই আপনি যখন ছিলেন সেই সময় থেকে কাগজগুলো পড়ে আছে ওখানে। কিন্তু সে তো এক মিনিট বাবু!’
‘সেই সময়ই কখন ঢুকে পড়েছে হয়তো, আর বেরোতে পারেনি।’
‘কিংবা নর্দমা দিয়েই ঢুকেছে। ঢোকে ওরা এক রকম করে—বেরোতে পারে না আর।’ বিজ্ঞভাবে বলে রাজু।
দুপুরে ক্লান্ত চোখ বুজে আসে, তবু ভাল করে ঘুম হয় না। রুচিরার ছলছল দুটি চোখের স্মৃতি, তার সঙ্গে আলো-আঁধারিতে একটা বন-বেড়ালের প্রকাণ্ড রুষ্ট মুখ, সুহাসিনীর ঈষাকুটিল ভ্রু-ভঙ্গি—সবটা যেন স্বপ্নের মধ্যেও তালগোল পাকায়।
অবশেষে বিকেলবেলা বাগানে বসে চা খেতে খেতে মন স্থির করে ফেলে অমরেশ।
ভাগ্যের সঙ্গে লড়েই দেখবে সে। সে তো কোন পাপ করেনি কোনদিন, তবে এ শাস্তি কেন তার? কেন সহ্য করবে সে এ পীড়ন? বিনা দোষে চরম কোন দণ্ড নিশ্চয়ই বিধাতা তাকে দেবেন না।
সে তখনই বসে শুভ্রাংশুকে একটা চিঠি লিখে দিলে, যদি কোন আপত্তি না থাকে, এবং রুচিরার মত হয় তো—এ বিবাহ সে সৌভাগ্য বলেই মনে করবে। আগামী অগ্রহায়ণেই তাহলে হতে পারবে শুভ কাজ। এখন এই কার্তিক মাসের কটা দিন অমরেশ মধুপুরে থাকবে। কলকাতার ঠিকানাও লিখে দিলে সে।
চিঠিখানা খামে এঁটে রাজুকে স্টেশনে পাঠিয়ে দিলে ওখানের ডাকবাক্সে ফেলে দিয়ে আসতে। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে একখানা বিলিতি নভেলে মন দিলে।
দিন তিনেক পরেই শুভ্রাংশুর চিঠি এল।
‘আপনার পত্র পেয়ে সত্যি খুশি হলুম, কিন্তু এধারে এক বিভ্রাট। রাজগীরে থাকা আর হল না। কাল সন্ধেবেলা বেড়িয়ে ফিরছি হঠাৎ অন্ধকারে রুচিরা বোধহয় ঘুমন্ত একটা কুকুরের গায়ে পা দেয়। সে উঠেই ওকে কাম্ড়ে দিয়েছে। এখানে তো একটিই মাত্র ডাক্তার, তিনি অবশ্য যা করবার সবই করেছেন কিন্তু তবু মনে হয় কলকাতায় নিয়ে গিয়ে ইঞ্জেকশন্গুলো সেরে ফেলাই ভালো। কারণ কুকুরটার আর কোন হদিস পাইনি। ক্ষ্যাপা কিনা কে জানে? মনে করছি কাল এখান থেকে বাস-এ গিয়ে টুয়ল্ভ্ ডাউন ধবর। কলকাতায় গিয়ে দেখা হবে। আপনি কবে আসবেন?’
দৃষ্টি কঠিন হয়ে এল অমরেশের। ভয় হচ্ছে ঠিকই—অজ্ঞাত একটা আতঙ্ক। মনে হচ্ছে যে তার এই দুর্ভাগ্যের সঙ্গে রুচিরাকে জড়ানো হয়তো ঠিক হচ্ছে না। বিনা দোষে তার যদি কোন ক্ষতি হয়—সত্যি-সত্যিই? আবার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হচ্ছে সে-ও তো বিনা দোষেই সইছে এত নির্যাতন। তবে সে কেন রুচিরার জন্য চিন্তা করবে? স্বার্থপরই হবে সে। এত দুঃখের পর এতখানি সৌভাগ্যের সুযোগ যদি বা এসেছে হাতের কাছে এগিয়ে—কোনমতেই তাকে সে ছাড়বে না। প্রাণ পণ করেই লড়বে অদৃষ্টের সঙ্গে—প্রয়োজন হলে প্রাণ রাখবে তার এবং রুচিরার—দুজনেরই প্রাণ। ক্ষতি কি?
গভীর রাত্রে টুয়েল্ভ্ ডাউন মধুপুরে এল। তবু ওদের খুঁজে বার করতে কষ্ট হল না। কোন অজ্ঞাত কারণে রুচির ঘুম ভেঙে গিয়েছিল এখানে এসেই—মুখ বাড়িয়ে সে অন্ধকার মধুপুর শহরের দিকে চেয়েছিল।
অমরেশ আসাতে বাকি সকলেও জেগে উঠল। বৌদি হেসে বললেন, ‘এত রাত্রে স্টেশনে এসেছেন ঠাকুরঝিকে দেখতে! একেই বলে টান।’
অপ্রতিভ হয়ে অমরেশ কতকগুলো জবাবদিহি করতে গেল…ফলে আরও অপ্রস্তুত হতে হল। রুচিরাও হয়ে উঠল লাল। তবে সকলেই যে খুশি হল তাতে সন্দেহ নেই।
শুভ্রাংশু বললে, ‘উঠে পড়ন না—একসঙ্গেই যাওয়া যাক।’
‘না—না, মালপত্র রয়েছে—তাছাড়া বাচ্চা চাকর, ভয় পাবে।’
গাড়ি চলে গেল। ছাড়ার আগে ওর ভেতরেই এক ফাঁকে রুচিরা হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, অমরেশ সেই দুর্লভ হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে ধরে চাপ দিয়েছে একটু। মনটা ভারি খুশি আছে। শিস দিতে দিতে ফিরল অমরেশ।
রিক্সা থেকে নেমে মালীকে ডাকতেই সে দোর খুলে দিল। রাজুকে ডেকে দিলে সে-ই। বালতিতে জল রাখা ছিল, বেশ করে হাত-পা ধুয়ে মুখে ঘাড়ে জল দিয়ে ঘরে এসে ঢুকল অমরেশ। রাজু আবার ঘুমিয়ে পড়েছে, হ্যারিকেন জ্বলছে মিটমিট করে—খুব কমাননা, তাতে আলোর একটা আভাস মাত্র পাওয়া যায়। রাজুর জন্যই এ আলোটা সারারাত জ্বলে, ওরও কেমন একটা ভয় হয়েছে, একেবারে অন্ধকারে মেঝেতে শুতে ভরসা করে না।
মাথা মুখ তোয়ালেতে মুছতে মুছতে বিছানায় এসে বসল অমরেশ। আর মাত্র ঘন্টা-দুই রাত আছে। এখন শুলে ঘুম আসতে আসতেই ভোর হয়ে যাবে। শোবে? না বই পড়বে। মনটা বহুদিন পরে বড় প্রফুল্ল….খুশির একটা জোয়ার এসেছে মনে। সেজন্য ঘুমের ইচ্ছা খুব নেই। রাত্রি জাগরণের কোন অবসাদও টের পাচ্ছে না।
কথাটা ভাবতে ভাবতেই চোখটা পড়েছে ওর মাথার বালিশের দিকে।
আবছায়া আলো…তবু, তবু মনে হচ্ছে বালিশের খাঁজের ছায়াটা যেন একটু বেশি গাঢ় নয়?
মুহূর্ত-মধ্যে সমস্ত চৈতন্য তীক্ষ, সজাগ হয়ে উঠল ওর। চমকে উঠল না, চেঁচামেচি করল না। নিঃশব্দেই ভাল করে তাকিয়ে দেখল। তারপর আলোটা বাড়িয়ে লণ্ঠনটা এনে ধরল। হ্যাঁ—ওই তো! বালিশের খাঁজে ছায়ার সঙ্গে মিলিয়ে রয়েছে কালো রঙের সরু লিকলিকে একটি সাপ।
অসহ্য ক্রোধে অমরেশ যেন দিগ্বিদিক-জ্ঞানশূন্য হয়ে উঠল নিমেষের মধ্যে। সে ক্রোধ তার অদৃষ্টের ওপর, সে ক্রোধ সুহাসিনীর ওপর—
এদিক ওদিক চাইতেই নজরে পড়ল মোটা একটা বাঁশের লাঠি কোণে ঠেসানো রয়েছে। সে আস্তে আস্তে গিয়ে সেই লাঠিটা তুলে নিল।
সাপটাও ততক্ষণে সজাগ হয়ে উঠেছে।
লাঠি নিয়ে অমরেশ কাছে আসতেই বিছানা থেকে সড়াৎ করে লাফিয়ে নিচে পড়েছে সে। নিচেই বেচারী রাজু শুয়ে আছে। কিন্তু অমরেশ কার্যক্ষেত্রে যথেষ্ট ক্ষিপ্র হতে পারে—এখনও। সে যেন বিদ্যুৎ বেগেই লাঠিটা বসিয়ে দিল সাপের মাথায়।
ছোট সরু সাপ…লাঠিটাও বেশ মোটা।
সাপের মাথাটা থেঁতলে চ্যাপটা হয়ে গেছে। মৃত্যু-যন্ত্রণায় ছটফট করছে সে, সমস্ত দেহটা অসহায় ভাবে বেঁকে চুরে উঠছে বারবার।
রাজু লাঠির শব্দে জেগে উঠে ওই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে উঠেছে। মালী এসেছে ছুটে। কিন্তু অমরেশের কোনদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে কেমন যেন স্তন্তিত হয়ে দাঁড়িয়ে সেই সাপটার মৃত্যু-যন্ত্রণা দেখছে। চোখ ফেরাতে পারছে না…এমনি একটা অমোঘ আকর্ষণে ওর দৃষ্টি তাতে নিবদ্ধ।
আনন্দ হয়েছে ওর? নিশ্চিন্ত হয়েছে?
তা অমরেশও জানে না। ওর অনুভূতিও যেন জড় হয়ে গেছে। প্রথমের সেই অসহ্য ক্রোধ আর নেই, বরং এই জিঘাংসার জন্য যেন নিজের কাছেই সে লজ্জিত;তবু তাকিয়েই আছে সে।
সাপটা ছটফট করতে করতে খানিকটা এগিয়েছে…দোরের দিকে। রাজু আর এক ঘা মারতে যাচ্ছিল…অমরেশ ইঙ্গিতে নিযেধ করল।
মুখ-হাত ধুয়ে যখন প্রথম ঘরের ভেতর পা দেয় অমরেশ, তার তখনকার সেই পায়ের সজল ছাপটা এখনও শুকোয়নি। একটু বেশি জলই হিল বোধহয় পায়ে…পরিপূর্ণ ছাপটা যথেষ্ট জল নিয়ে স্পষ্ট হয়ে আছে মেঝের ওপর।
মরণাহত সাপটা তার পিষ্ট দলিত মুখটাকে কোনমতে যেন বহন করে এনে সেই জলের ছাপের ওপর এসে স্থির হয়ে গেল। এইবার বোধহয় মারাই গেল সে।…
হয়তো মৃত্যু-যন্ত্রণার অসহ্য তৃষ্ণাই তাকে টেনে এনেছিল এই সামান্য জল-রেখার দিকে। হয়তো সবটাই আকস্মিক যোগাযোগ মাত্র, কিন্তু অমরেশের যেন মনে হল অন্তিম মুহূর্তে সরীসৃপটা তার পদচিহ্নে পৌঁছে সমস্ত অপরাধের জন্য চরম ক্ষমা প্রার্থনা করে গেল।
কে জানে কেন, আজ সে সুহাসিনীর জন্য দুঃখবোধ করল।
বেচারী! সে নিজেও তো কখনও শান্তি পায়নি।
সবার অলক্ষ্যে চোখের কোণ দুটো মুছে অমরেশ আবার বিছানাতে গিয়েই বসল। ‘বসবেন না, বসবেন না বাবু। ভাল করে দেখে নিই আগে। আর কোথাও কিছু আছে কিনা।…এই হিমে যখন সাপ বেরিয়েছে…’
‘নাঃ—আর ভয় নেই!’ অমরেশ বেশ জোর দিয়েই বলে।
এ জোর সে কোথায় পায়, কে জানে!