মরণজয়ী বীর – যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত

মরণজয়ী বীর – যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত

‘কাহার সাহস আছে, এসো, অগ্রসর হও, আমার সঙ্গে যুদ্ধ করো৷ এই আমি একা তোমাদের কাছে দাঁড়াইয়াছি৷’ বীরের গর্বিত কন্ঠের এইরূপ হুংকার শুনিয়া সকলে মন্ত্রমুগ্ধবৎ স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, কেহ এক পাও অগ্রসর হইতে সাহসী হইল না-সকলের হাতের তরবারি হাতেই রহিয়া গেল-সর্দার হরিসিংহ অক্ষত দেহে বাড়ি ফিরিয়া গেলেন!

এই হরিসিংহ কে ছিলেন জানো? তোমরা যদি পঞ্জাবে বেড়াইতে যাও, তাহা হইলে সেখানকার গ্রামে গ্রামে বাড়ি বাড়ি তাঁহার নাম শুনিতে পাইবে৷ পঞ্জাবের চেয়েও তাঁহার নাম উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে বেশি পরিচিত৷ তাঁহার জীবনে কত ঝড়ঝঞ্ঝা আসিয়াছে, কত বিপদের কালো মেঘ বজ্রবিদ্যুৎ বুকে করিয়া ঝলসিয়া উঠিয়াছে,-তবু কোনোদিন সর্দার হরিসিংহকে ভীত কম্পিত বা বিচলিত করিতে পারে নাই৷ তাঁহার বীরত্বের ও নির্ভীকতার সম্বন্ধে কত যে গল্প আছে তাহার অবধি নাই৷ আমরা প্রথমে যে গল্পটির আভাস দিয়াছি, এইবার সেই গল্পটি শোনো৷

একবার একজন সীমান্ত-সর্দার হরিসিংহকে একটা ভোজে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন৷ সর্দার হরিসিংহকে বলিয়া পাঠাইয়াছিলেন-‘আপনি নিশ্চিন্ত মনে আমার বাড়ি আসিবেন, সঙ্গে বেশি দেহরক্ষী আনিবার কোনো প্রয়োজন নাই৷ চার-পাঁচজন লোক সঙ্গে আনিলেই যথেষ্ট হইবে৷ বেশি লোকজন আনিলে তাহাদের সকলকে খাওয়াইবার মতো সংগতি আমার নাই বলিয়াই এই অনুরোধ করিতেছি৷’

সর্দার হরিসিংহ নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিলেন এবং নিঃসন্দিগ্ধচিত্তে সীমান্ত-সর্দারের বাড়ি আসিলেন৷

সর্দার কিন্তু লোকটি ভালো ছিলেন না৷ তিনি যেমনটি বলিয়াছিলেন, তেমন কিন্তু কিছুই করিলেন না৷ সর্দার বহুসংখ্যক দস্যুর দল বাড়ির নানা স্থানে আনিয়া লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন৷ সীমান্ত-সর্দার তাহাদিগকে বলিয়াছিলেন, ‘সর্দার হরিসিংহ যেমন আসিবেন, অমনি তাঁহাকে আক্রমণ করিবার জন্য প্রস্তুত হইবে৷ কখন আক্রমণ করিবে শোনো, ‘যখন তিনি ভোজনে বসিবেন৷’ এইভাবে চাহিয়াছিলেন তাঁহার শত্রুকে দমন করিতে!

সর্দার হরিসিংহ সীমান্ত-সর্দারের বাড়ি আসিলে পর সীমান্ত-সর্দার প্রথমটায় তাঁহাকে খুব আদরযত্ন ও অভ্যর্থনা করিলেন, তারপর তাঁহার সুর বদলাইয়া গেল৷ তিনি কহিলেন, ‘সর্দার হরিসিংহ! মরণের জন্য প্রস্তুত হও৷’ সে স্বরে বিদ্রূপ ও প্রতিহিংসা মিশ্রিত ছিল৷ হরিসিংহ কিন্তু এতটুকু বিচলিত হইলেন না, তাঁহার মস্তকের একটি কেশও কম্পিত হইল না-তিনি ভীম-ভৈরব কন্ঠে যে উত্তর দিয়াছিলেন, সে কথা তোমাদের পূর্বেই বলিয়াছি৷ তিনি বলিলেন, ‘এসো, আমার সঙ্গে যুদ্ধ করো৷’ হরিসিংহের কন্ঠে এমন কিছু ছিল, যেজন্য কেহই তাঁহাকে আঘাত করিতে সাহসী হয় নাই৷

সর্দার হরিসিংহ ছিলেন মহারাজ রণজিৎসিংহের একজন প্রধান সেনাপতি৷ মহারাজা রণজিৎ বলিতেন, ‘প্রাসাদের স্তম্ভ যেমন তাহার অবলম্বন, স্তম্ভ ব্যতীত যেমন প্রাসাদ খাড়া থাকিতে পারে না-তেমনি হরিসিংহ হইতেছেন আমার রাজ্যের স্তম্ভ৷ রাজ্যরূপ রাজপ্রাসাদটি হরিসিংহরূপী স্তম্ভই দাঁড় করিয়া রাখিয়াছে৷’ এ এতটুকু অত্যুক্তি নহে৷ কোনো বিদ্রোহী সর্দারকে দমন করিতে-কোনো বিদ্রোহী সৈন্যদলকে বশীভূত করিবার প্রয়োজন হইলে,-সর্দার হরিসিংহ ব্যতীত অন্য কাহারও তাহা দমন করিবার শক্তি ছিল না৷ প্রত্যেকটি কার্যের ভারই ছিল হরিসিংহের উপর৷

শিয়ালকোটের রাজা জীবনসিংহ পণ করিলেন তিনি কোনোরূপই মহারাজা রণজিৎসিংহের অধীনতা মানিবেন না, ইহাতে যদি তাঁহার মৃত্যু হয়, তাহাও দেশের স্বাধীনতা হারাইবার অপেক্ষা সহস্রগুণে শ্রেয়৷

যুদ্ধ আরম্ভ হইল৷ একপক্ষে পঞ্জাব-কেশরী রণজিৎসিংহ, অন্যদিকে শিয়ালকোটের রাজা জীবনসিংহ৷ স্বয়ং মহারাজা রণজিৎসিংহ সৈন্য পরিচালনা করিতে লাগিলেন৷ শিয়ালকোট দুর্গ অবরুদ্ধ হইল৷ মহারাজা আট দিন পর্যন্ত অসাধারণ পরাক্রমের সহিত আক্রমণ করিয়াও শিয়ালকোটের অবরুদ্ধ দুর্গ অধিকার করিতে পারিলেন না৷ মন্ত্রীসভার পরামর্শ গ্রহণ করিলেন, কিন্তু কেহই কোনো সুপরামর্শ দিতে পারিলেন না৷ সকলের শেষে হরিসিংহকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সর্দার, তুমি কী বলো?’ হরিসিংহ মহারাজার সম্মুখীন হইয়া বলিলেন, ‘মহারাজ! যদি আমার উপর যুদ্ধের ভার সম্পূর্ণরূপে ছাড়িয়া দেন, তাহা হইলে এই দুর্গ জয় করিব!’

মহারাজা, সেদিন সেই মুহূর্তেই সর্দারের উপর সৈন্যপরিচালনার ভার দিয়া রাজধানীতে ফিরিয়া আসিলেন৷ সর্দার হরিসিংহ কিন্তু অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই দুর্গ জয় করিলেন৷ তিনি মৃত্যুকে তুচ্ছ করিয়া প্রাকারের উপর আরোহণ করিয়া দুর্গের মধ্যেই প্রবেশ করিলেন৷ সৈন্যদলেরাও তাঁহার অনুবর্তী হইল৷ তাঁহার এই সাহস ও নির্ভীকতার কাছে শিয়ালকোটের রাজার মাথা নত করিতে হইল৷ মহারাজা রণজিৎসিংহ শিয়ালকোটের বিজয়-সংবাদে প্রীতিলাভ করিয়া সর্দারকে মূল্যবান পুরস্কার দিয়া অভিনন্দিত করিলেন৷

একবার মানকিরার রাজা বিদ্রোহ করিলেন৷ মানকিরার রাজার সৈন্যসংখ্যা ছিল পঁচিশ হাজারের উপর, আর সর্দারজির ছিল মাত্র দুই হাজার৷ ফল কী হইতে পারে বুঝিয়া লও,-সর্দারের সৈন্যেরা পরাজিত হইল, তাহারা চাহিল পলায়ন করিতে৷ তখন নির্ভীক সর্দার সেই অল্পসংখ্যক সৈন্য লইয়া শত্রুপক্ষের মধ্যে ঝাঁপাইয়া পড়িলেন৷ এই আক্রমণের আশ্চর্য ফল হইল-শত্রুপক্ষেরা পরাজিত হইয়া সন্ধি করিল৷ এইভাবে তিনি যুদ্ধের পর যুদ্ধ করিয়া আপনার অসাধারণ সাহসিকতা ও বীরত্বের পরিচয় দিয়াছিলেন৷ কিন্তু সকলের চেয়ে জামরুলদের রণ-বিজয় কাহিনিই ইতিহাসের পৃষ্ঠায় সব চেয়ে বড়ো হইয়া বাঁচিয়া রহিয়াছে৷ ওই যুদ্ধে তিনি পাঠানের ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া শত্রুশিবিরে প্রবেশ করিয়াছিলেন৷ প্রথমে তিনি মহাবীর শেরখাঁর শিবিরে গিয়াছিলেন৷ এই শেরখাঁ সর্দার হরিসিংহের সহিত সম্মুখ সমরে পরাজিত ও নিহত হইয়াছিলেন৷ শেরখাঁয়ের মৃত্যুর পরে পাঠানেরা দলে দলে আসিয়া আক্রমণ করিতে থাকে৷ সর্দার হরিসিংহকে লক্ষ করিয়া শত্রুপক্ষ হইতে যে গুলি নিক্ষিপ্ত হইয়াছিল, সেই গুলির ঘায়ে তাঁহার অশ্ব প্রাণ হারাইলে পর তিনি তৎক্ষণাৎ অপর একটি অশ্বে আরোহণ করিয়া যুদ্ধ করিতেছিলেন, কিন্তু আর একটি গুলি আসিয়া তাঁহার গায় লাগায় তিনি গুরুতররূপে আহত হইয়া অশ্ব হইতে পড়িয়া গেলেন-তাঁহাকে ধরাধরি করিয়া দুর্গে লইয়া যাইবার সময়ও সৈন্যগণকে বলিয়া গেলেন-‘লাহোর হইতে নূতন সৈন্যদল আসিয়া না পৌঁছানো পর্যন্ত প্রাণপণে যুদ্ধ করো, আমি যদি মরি, সে সংবাদও গোপন রাখিয়ো৷ মনে রাখিয়ো শিখের গৌরব ও মান, মহারাজার খ্যাতি ও প্রতিপত্তি তোমাদের হাতে! আমি আমার কর্তব্য করিয়াছি!’-এই কথা কয়টি বলিবার সঙ্গেসঙ্গেই তাঁহার মৃত্যু হইল৷ মরণজয়ী বীর রণক্ষেত্রে মরণকে পরাজয় করিয়া দিব্যধামে চলিয়া গেলেন৷

সর্দার হরিসিংহ কি শুধু রণবিজয়ী বীর ছিলেন? তাহা নহে৷ তিনি ছিলেন বিচক্ষণ রাজনৈতিক ও দৌত্যকার্যে সুনিপুণ ব্যক্তি৷ ইংরাজের সহিত যখন মহারাজা রণজিৎসিংহের সন্ধি হয়, তখন ফকির আজিজদিন সাহেবের সহিত হরিসিংহও ইংরাজ রাজদরবারে প্রেরিত হইয়াছিলেন৷ স্থপতির কার্যেও তাঁহার অসাধারণ অনুরাগ ছিল৷ জামরুদের প্রসিদ্ধ দুর্গটি সর্দার হরিসিংহের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হইয়াছিল৷

সকলের উপরে হরিসিংহ ছিলেন সাধু ও সজ্জন৷ অতি বড়ো শত্রুও তাঁহার চরিত্রের উপর দোষারোপ করিতে পারে নাই৷ তবে কথাটা কি জানো, পৃথিবীতে যাঁহারা বড়ো হন, তাঁহাদের শত্রুও থাকে অনেক! হরিসিংহেরও শত্রুর কোনো অভাব ছিল না৷ একবার তাঁহার একজন বিপক্ষের লোক-মহারাজা রণজিৎসিংহের নিকট যাইয়া অভিযোগ করিল যে, ‘মহারাজ! সর্দারের অধীনে মাত্র চারিশত সৈন্য আছে, কিন্তু তিনি বরাবর দুই হাজার সৈন্যের বেতন লইতেছেন৷ অথচ বেশির ভাগ সৈন্যই তো বিদায় লইয়া বাড়ি চলিয়া গিয়াছে, কাজেই উহার নিকট রাজসরকারের দুই লক্ষ টাকা পাওনা আছে৷’ মহারাজা কোনোরূপ অনুসন্ধান না করিয়াই এই অভিযোগ বিশ্বাস করিয়া সর্দারের নিকট দুই লক্ষ টাকার দাবি করিলেন৷

এই অবিচারে সর্দারের মন ভাঙিয়া গেল৷ তিনি রাজদরবারের সহিত সকল সংস্রব পরিত্যাগ করিয়া সাধারণ গ্রাম্য ভদ্রলোকের বেশে নিভৃত স্থানে যাইয়া ধ্যান ধারণায় জীবন যাপন করিতে লাগিলেন৷

একদিন সত্য প্রকাশ পাইল৷ রণজিৎসিংহ নিজে হিসাব ইত্যাদি পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন সর্দারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হইয়াছে তাহা সম্পূর্ণ অমূলক৷ তখন তিনি স্বয়ং রাজহস্তীর পৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া চলিলেন সেই নিভৃত পল্লির দিকে যেখানে সর্দার হরিসিংহ গ্রন্থসাহেব পাঠে নিরত ছিলেন৷ সৈন্যদলের গর্বিত পদসঞ্চালনে, লোকজনের কোলাহলে আর ‘অলখ নিরঞ্জন’ ধ্বনিতে সেই স্থান প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল! গুণগ্রাহী মহারাজা রণজিৎসিংহ সর্দারের কুটিরে যাইয়া তাঁহার সহিত দেখা করিয়া বলিলেন, ‘বন্ধু, আমি আমার ভুল বুঝিয়াছি৷ তোমার কাছে যে অন্যায় অপরাধ করিয়াছিলাম সেজন্য ক্ষমা চাইতে আসিয়াছি৷ আমি তোমাকে চাই, আমার সৈন্য দলের কর্তৃত্ব ভার আবার তোমাকে গ্রহণ করিতে হইবে৷’ সর্দার হরিসিংহের অভিমান দূর হইল৷ দুইজনের আবার মিলন হইল৷

সর্দার হরিসিংহ পঞ্জাবের গুজরনওয়ালা নামক স্থানে ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন৷ তাঁহার বয়স যখন মাত্র বারো বৎসর, সেই সময়ে পিতা গুরুদয়াল সিংহের মৃত্যু হয়৷ গুরুদয়াল সিংহও রণজিতের অধীনে কার্য করিতেন৷ মৃত্যুর সময়ে গুরুদয়াল, শিশুপুত্র হরিসিংহকে মহারাজার হস্তে সমর্পণ করিতে যাইয়া বলিয়াছিলেন, ‘মহারাজ! বাঘের বাচ্চা কমই হয়, আপনি ইহাকে সৈন্যদলে ভরতি করিয়া নিন৷’ মহারাজা সে অনুরোধ রক্ষা করিয়াছিলেন, এবং সত্য সত্যই পিতার ভবিষ্যদ্বাণী সার্থক করিয়া সর্দার হরিসিংহ বীরের মতো বীর, মানুষের মতো মানুষ হইয়াছিলেন৷

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *