তৃতীয় খণ্ড (স্নেহের চুমকিকে)
3 of 6

ময়দানে মহাদেব

ময়দানে মহাদেব

মহাদেবের সঙ্গে কথা হয়ে গেল হঠাৎ। অবাক কাণ্ড। স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব ময়দানে হাওয়া খাচ্ছেন। প্রথমে ভেবেছিলুম, মডেল। হয় তো স্টুডিও থেকে হঠাৎ বেরিয়ে এসেছেন। পরনে বাঘছাল। গলায় একটা জ্যান্ত সাপ। হাতে ত্রিশুল। আমাকে বললেন :

মহাদেব : কী দেখছ? ভাবছ নকল। আমি আসল মহাদেব।

আমি : কেমন করে বুঝব, আপনি আসল।

মহাদেব : কেন আমার ড্রেস। ক্যালেন্ডারে আমার পোট্রেট দ্যাখো? সিনেমায় আমাকে দ্যাখো?

আমি : ড্রেস কোনও প্রমাণ নয়, কলকাতার লোকের ড্রেস দেখেছেন? ছেলে-মেয়েরা কী পোশাক পরে ঘোরে দ্যাখেননি। দুপায়ে দুটো সিমেন্টের বস্তা ফিট করে বেরিয়ে পড়ল। বললে ব্যাগি। জামার মাপ দেহের মাপের চারগুণ। বললে ব্যাগি। মেয়েরা একটা পাল পরে নেচে-নেচে চলেছে। বললে ম্যাকসি। ব্লাউজের হাতা কাটতে-কাটতে স্যান্ডো গেঞ্জি। কখনও টপলেস, কখনও বটমলেস।

মহাদেব : বেশ, তোমার কথা মানলুম। আমার গলায় সাপের নেকলেস। কোনও সাধারণ মানুষ পারবে?

আমি : কলকাতার মানুষ সব পারে। আজই পোস্টার দেখলুম সার্কাসের-সুন্দরী রমণী শুয়ে আছে বাঘের সঙ্গে। মধ্যমগ্রামে এমন একজন আছেন, যার পকেটে গোখরো সাপ থাকে। দক্ষিণী-সিনেমায় লাস্যময়ী নায়িকা সাপের মুখে চুমু খায়। ছাতাওয়ালা গলিতে পাকা নেশাডুরা জিভে সাপের ছোবল খায়। ওসব আমাদের কাছে তুচ্ছ। আমাদের কবি অনেক আগেই লিখে গেছেন—আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই। তা ছাড়া, সাপের ছোবলে আমাদের কিছু হবে না। আমরা বিষ হজম করার ক্ষমতা রাখি। আমাদের বাতাসে বিষ, জলে আর্সেনিক, তেলে মোবিল, সবজিতে ইনসেকটিসাইড, পোস্টিসাইড। রাস্তায় জঞ্জালের পাহাড়, ধুলো, ধোঁয়া, ড্রেনের পাঁক। বিষ আমরা মধুর মতো চেটেচেটে খাই। মরি না। আমরা সব নীলকণ্ঠের বাচ্চা।

মহাদেব : তার মানে আমার বাচ্চা। আমিই তো নীলকণ্ঠ। আমি তো জানতুম, তোমাদের মানব সভ্যতার সেই দিন আসছে; যখন বিষ খেয়ে হজম করতে হবে। আচ্ছা, তোমাদের সব ফলই কি এখন কার্বাইডে পাকে?

আমি : হ্যাঁ, বিলকুল কার্বাইড। পেঁপে থেকে পেয়ারা, কলা থেকে কমলা সব কার্বাইড। তা ছাড়া কিছু কাল আগে ভূপালে কার্বাইড কেলেঙ্কারি হয়ে গেল। সে কার্বাইড অবশ্য ইউনিয়ান কার্বাইড। গ্যাস লিক করে হাজার হাজার মানুষ মরে গেল। এখনও বহু মানুষ ভুগছে।

মহাদেব : কার্বাইডেও ইউনিয়ান। আমি তো জানতুম তোমাদের শিল্পেই শুরু হয়েছিল ইউনিয়ান, এখন ইউনিয়ান আছে শিল্প নেই।

আমি : সে-কার্বাইড এ কার্বাইড নয়। এ বেশ বড়সড় কার্বাইড।

মহাদেব : কী সব গোলমাল করে ফেলছ। এ কার্বাইড, সে-কার্বাইড করে। আগে নিজে একটু ঠিকঠাক হয়ে নাও। তোমাদের ছেলেমেয়েরাও বয়সের তুলনায় ভীষণ পাকা, সে-ও কি কার্বাইডে পাকা?

আমি : পরিবেশই তাদের পাকাচ্ছে। পরিবেশই কার্বাইডের কাজ করছে। টিভি, সিনেমা, বিজ্ঞাপন? বিজ্ঞাপনে তো বাকি নেই কিছু।

মহাদেব : আচ্ছা ওটা কী বলো তো, একা মাঝবয়সি লোক একটা মোটরগাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে জাঙিয়া খুলে দেখাচ্ছে আর একটা ডবকা মেয়ে হাত ধরে টানছে।

আমি : জাঙিয়ার বিজ্ঞাপন।

মহাদেব : জাঙিয়ার বিজ্ঞাপন? বলো কী? এ যে দেখি ল্যাঙটের বুকপকেট। তাহলে ওটা কী? এক যুবতী গলা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আর এক যুবক সেই গলায় নাক ঘষছে!

আমি : ওখানে আর আপনার নাক গলাবেন না, ওর মধ্যে একেবারেই আদিরস। যদি সত্যিই আপনি দেবতা হন, ওটা আপনার লাইন নয়।

মহাদেব : না, তা বোলো না, সব লাইনই আমার লাইন। ভৈরবী, তন্ত্র, হটযোগ, কারণবারি।

আমি : সে তো ধর্ম! ধর্মের মধ্যে একটু এদিক সেদিক, যেমন সন্দেশে পেস্তার কুঁচি, আইসক্রিমে ফলের টুকেরা, আপনার কাছেই যাবে তবে একটু টাল খেতে-খেতে, হড়কাতে-হড়কাতে, পেছলাতে-পেছলাতে । ওটা তা নয়—একটা ছেলে একটা মেয়েতে লেবড়ে আছে। জড়াজড়ি ব্যাপার। তার জন্যে সব কায়দা-কারখানা বেরিয়েছে। যত দূরই যাও —ট্যাঁ ভ্যাঁ আসবে না। একে বলে সেফ-সেকস! দেবাদিদেব মহাদেব হয়ে আপনি এই ময়দানে কী কারণে মরতে এলেন! সন্ধে হয়ে আসছে। জায়গাটা মোটেই সুবিধের নয়।

মহাদেব : আরে, আমি তো আমার জায়গাতেই যেতে চেয়েছিলুম।

আমি : কোথায়? কৈলাসে?

মহাদেব : কৈলাস থেকে তো নেমে এলুম, একসপিডিসানের ঠেলায়। দলে-দলে দল আসছে, মাউন্টেনিয়ারস, ক্লাইম্বার্স। মালপত্তর লোকলস্কর, পাহাড় যেন মেছো হাটা। পিকনিক স্পট। যাও না পাহাড়ের মাথায়, দেখবে খালি কৌটো, তেরপল, জুতো, মোজা, মল-মূত্র যেন তোমাদের ধাপা। যেতে চেয়েছিলুম শ্মশানে। আশ্চর্য! কোথায় শ্মশান! চিতা কোথায়! শেয়াল নেই শকুন নেই। পাকুড়ের তলায় নেই কল্কেধারী সন্ন্যাসী। ঝলমলে আলো। পাকাপোক্ত ঘর। মড়ারা সব লাইন মেরেছে। কেঁধোরা রোলকাইন্টারে গুলতানি মারছে। হিন্দি গান বাজছে। সবাই বললে পাগলা! মড়া আজকাল আর চিতায় ওঠে না। মানুষের টাইম কম, তাই ইলেকট্রিক উনুনে ঢুকিয়ে দেয়, এক ঘণ্টায় ছাই। তোমরা আমার শ্মশানও লোপাট করে দিলে!

আমি : ভোলেবাবা, শ্মশান আমরা মডার্নাইজ করে, দেশের বাকি অংশটুকুকে বিরাট এক শ্মশান করে ফেলেছি। চিতা এখন আমাদের বুকে জ্বলছে। আর গাঁজা! প্রভু গাঁজার যুগ খতম। এখন ড্রাগস। পাড়ায়, পাড়ায়, স্কুলে, স্কুলে, কলেজে, হাসপাতালে। যুবশক্তি খতম। পারেন তো সরে পড়ুন। অ্যান্টি ড্রাগ আন্দোলন চলছে—আপনাকে ড্রাগ মাফিয়া বলে চালান না দেয়!

ফট করে টায়ার ফাটার মতো শব্দ হল। সব ধোঁয়া। ধোঁয়া কেটে যাওয়ার পর দেখি ময়দানে পড়ে আছি ফ্ল্যাট। জুতো আর পকেটের টাকা হাওয়া।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *