৬
কদিন পরেই খলিলুল্লা খাঁয়ের রহস্য আমার চোখের সামনে বীভৎসভাবে উদ্ঘাটিত হল। এভাবে না হলেই ভাল হত। বাদশাহ্ ঠিকই বলেছিলেন—বেশি বুদ্ধিমতী হলে দুঃখ পেতে হয়। দুঃখ আমি পেলাম—চূড়ান্ত দুঃখ। আবাল্য-পোষিত এক শ্রদ্ধার মিনার যেন মাটি ধসে একদিকে হেলে পড়ল। কবে তাকে আবার মনের সর্বশক্তি নিয়োগ করে সোজা করে তুলতে পারব জানি না।
সেদিনও অপরাহ্ণে দাঁড়িয়েছিলাম কিল্লার ওপরে যমুনা দেখার নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে। যমুনার কালো জল ধীরে ধীরে আরো কালো হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ নজরে পড়ে একটি শিবিকা, চারদিক ঢাকা তার, খিজরী-দ্বার দিয়ে প্রবেশ করে প্রাসাদে বিস্মিত হই আমি। জানি, হারেমের কেউ বাইরে যায়নি। কৌতূহল জাগে মনে। তাড়াতাড়ি নীচে নেমে আসি। চেয়ে দেখি শিবিকাটি দিশেহারা হয়ে প্রাঙ্গণের মধ্যে দিয়ে চলেছে। বুঝলাম ভেতরের কর্ত্রীর নির্দেশে বাহকেরা বয়ে নিয়ে চলেছে। প্রথমে নহবৎখানার সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর তাড়াতাড়ি মহতাববাগের পাশ দিয়ে দেওয়ান-ই-খাসের সামনে গিয়ে স্থির হয়। শেষে মতিমহল পার হয়ে রঙমহলের কাছাকাছি এসে শিবিকাটিকে মাটিতে নামানো হয়। বাহকেরা স্থানত্যাগ করে।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হই আমি। রঙমহলের দিকে এগিয়ে যেতে গেলে শিবিকাটি দৃষ্টির আড়ালে পড়বে। সেই মুহূর্তে যে নারী মাটিতে পা দেবে তাকে দেখতে পাবো না। তাই অপেক্ষা করি। শিবিকার পর্দা উঠিয়ে দুটি পা বাইরে বের হয় প্রথমে। তারপর দেহ। চিনতে পারি আমি। সত্যিই চিনতে পারি আমি। চেনার জন্যে মুখখানা স্পষ্ট দেখার প্রয়োজন হয় না। খুলিলুল্লা খাঁয়ের বেগম। কিন্তু কেন? বাদশাহের কাছে আমিরের হয়ে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য। তবে কি আমার কথা শুনে সত্যিই কৈফিয়ত তলব করেছেন বাদশাহ্। কিন্তু বাদশাহের সঙ্গে একজন আমিরের বেগম এই অদ্ভুত সময়ে কেন দেখা করতে আসবে? অন্য কোনও কারণে নয় তো? মানসিক দ্বন্দ্বে অস্থির হয়ে শেষে দ্রুতপদে অনেক কক্ষ পার হয়ে রঙমহলের দিকে যাই। নহরী-বেহেস্ত কলকল শব্দে বয়ে চলেছে। রঙমহলের প্রকোষ্ঠের ভেতর দিয়ে। বাইরে থেকে শব্দ পাই। গেল কোথায় সে? শেষে রঙহলের ভেতর চাইতেই চমকে উঠি। চেয়ে দেখি খলিলুল্লা খাঁয়ের পর্দানশীন বেগম খুব তাড়াতাড়ি তার দেহের প্রতিটি পরিচ্ছদ খুলে ফেলে নগ্ন হয়ে নহরী-বেহেস্ত-এর মধ্যে গিয়ে বসে। তারপর আঁজলা আঁজলা জল তুলে নিজের চোখ-মুখের ওপর ঢালতে থাকে। সে হাসছে—সব পাওয়ার পরিতৃপ্ত হাসি। মুখের ওপর জল ঢালতেই সুযোগ বুঝে আমি চট করে প্রকোষ্ঠের ভেতরে একটি আসবাবের আড়ালে গিয়ে আত্মগোপন করি। শেষ পর্যন্ত দেখতে হবে। জীবনে কখনো নহরী-বেহেস্ত-এ অবগাহনের সুযোগ হবে না দেখে চোরের মতো আকাঙ্ক্ষা মেটাতে এসেছে।
খলিলুল্লা খাঁয়ের বিবি সত্যিই সুন্দরী। তার নগ্ন দেহ-বল্লরী দেখে আমার মতো সুন্দরীরও ঈর্ষা হয়। অপেক্ষা করি, স্নান শেষের জন্যে। কিন্তু তার আগেই এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটল।
রঙমহলের একটি দ্বার দিয়ে স্বয়ং বাদশাহ্ প্রবেশ করেন। তাঁর সাদা চুল নানান্ বর্ণের আলোয় অপূর্ব দেখাচ্ছিল। দারুণ উত্তেজিত হই আমি। এই মুহূর্তে তিনি দেখে ফেলবেন খলিলুল্লার বেগমকে। তারপর যে কী ঘটবে ভাবতেও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
বাদশাহ্ বড় একটা এখানে আসেন না। তিনিও নিশ্চয় আমার মতো একে আসতে দেখেছেন।
বাদশাহ্ এগিয়ে আসছেন। খলিলুল্লা খাঁয়ের বেগম কিন্তু নির্বিকার। কোনওদিকে খেয়াল নেই তার। আগের মতোই জল নিয়ে খেলা করছে। বাদশাহ্ একেবারে কাছে দাঁড়ান। তাঁর মুখে যেন হাসির আভাস।
খলিলুল্লার বেগম তাঁকে দেখতে পেয়েই জল থেকে উঠে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলতে থাকে। সব স্পষ্ট হয়ে যায় আমার কাছে। বুকের ভেতরে হাতুড়ির আঘাত। চোখ মুখ কান লজ্জায় রাগে পুড়ে খাক্ হয়ে যায়।
বাদশাহ্ ধীরে ধীরে তাঁর পাদুকা খুলে জলের মধ্যে পা ডুবিয়ে বসেন। খলিলুল্লার বেগম নাচতে নাচতে তাঁর কোলের ওপর বসে।
শয়তানী হাসে। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে। বাদশাহের কোলের ভেতর তার দেহখানা সাপের মতো কিবিল্ করে। শেষে জলের মধ্যে শব্দ হয়। পোশাক-পরিচ্ছদ সমেত জলের মধ্যে নেমে পড়েন বাদশাহ্। অগভীর নহরী-বেহেস্ত।
এ সময়ে আল্লা যদি আমার চোখে ঘুম এনে দিতেন বড় ভাল হত। কিন্তু তা দিলেন না। নিজেরই দুই হাতের মধ্যে মাথা গুঁজে আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি।
মমতাজের প্রত্যক্ষ প্রভাব আর বাদশাহের ওপর নেই। আগ্রা ছেড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সে প্রভাব ফিকে হতে হতে একেবারে মিলিয়ে গিয়েছে। নইলে এ নোংরামির মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতেন না বাদশাহ্। নিজের নিজের বেগম রয়েছে তাঁর। তারা যত খরাপই হোক মানবী। মন ভোলাতে সাময়িকভাবে যেটুকু অভিনয়ের প্রয়োজন তারাও জানে। হয়তো খলিলুল্লার বেগমের চেয়ে ভালই জানে। কিন্তু বাদশা পরীক্ষা করে দেখেননি। তিনি চেষ্টাই করেননি। এই বয়সে নতুনত্বের মোহে ভুলেছেন। সর্বনাশ ডেকে আনছেন।
এই জন্যেই মা হয়তো শেষ চেষ্টা করেছিলেন আমাদের আগ্রায় ধরে রাখতে। পারেননি। মৃত্যুর পক্ষে পারা সম্ভব নয়। মা বুঝতে পেরেছিলেন আগ্রা ছাড়ার অর্থ হচ্ছে শাহজাহানের পতন। এ তো পতনই। এই পতন ধীরে ধীরে আরও কত সর্বনাশ ডেকে আনবে কে জানে। ইচ্ছে হচ্ছিল, মাথা তুলে একবার বাদশাহকে চিৎকার করে বলি,—দেখুন তো বাদশাহ, আপনার হাতে আপেলের গন্ধ আছে কিনা। খলিলুল্লার বেগমের ত্বকের গন্ধে আপেলের সুঘ্রাণ নষ্ট হয়েছে। আপনার হাত দুষিত। নহরী-বেহেস্ত-এর আতর মেশানো জলও আর আপনার হাত পরিষ্কার করতে পারবে না।
কিন্তু বলা সম্ভব নয়। আপন মনে বিড়বিড় করি। পাগলরা যেমন করে।
কতক্ষণ ওইভাবে ছিলাম জানি না। শেষে এক সময়ে মুখ তুলে দেখি রঙমহল নির্জন। চলে গিয়েছে ওরা। কখন গিয়েছে ওরা। কখন গিয়েছে বুঝতে পারিনি। বাইরে এসে দেখি শিবিকা নেই।
পরদিন সকালে বাদশাহের সামনে গিয়ে বলি,—এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি বাবা।
—স্বপ্ন?
—হ্যাঁ।
—সে তো অনেকেই দেখে। বলার কী কারণ ঘটল?
—স্বপ্নটা অদ্ভুত বলেই আপনাকে বলতে এলাম। অনেক স্বপ্ন নাকি আবার সত্যিই হয়। এটি সত্যি হলে সমূহ বিপদ।
—বলো শুনি।
অনেক চেষ্টায় তৈরি করা কল্পিত কাহিনি বলতে শুরু করি,—দেখলাম জুম্মা মসজিদে গিয়েছি আমি। নির্জন মসজিদে কেউ কোথাও নেই। একা ঘুরে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ কে যেন ডেকে উঠল, —জাহানারা। চমকে চেয়ে দেখি চারদিক নির্জন। গা ছম্ছম্ করে ওঠে। আবার শুনি,—ভয় নেই। আমি খোদাতাল্লা। শুনে পরম শান্তিতে আমার মন ভরে ওঠে। প্রার্থনার ভঙ্গিতে মাটিতে বসে পড়ি। তিনি বলেন,—নহরী-বেহেস্ত-এর জল দূষিত হয়েছে।
বাদশাহ্ আমাকে থামিয়ে ভীত কণ্ঠে বলেন—সে কী?
—আমি যা শুনলাম তাই বলছি বাবা। আল্লা বললেন,—মুঘল হারেমের বাইরের এক শয়তানী ওতে অবগাহন করেছে, পাপ করেছে।
বাদশাহ্ চিৎকারে করে ওঠেন—আর কী কী বললেন আল্লা?
শান্তভাবে বলি,—আমি আরও জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি বললেন, আর কিছু আপাতত তিনি বলবেন না। তাতে নাকি আমি দুঃখ পাব—আত্মহত্যা করব। আর আমি আত্মহত্যা করার পরদিন আপনার পতন।
বাদশাহ্ আমার হাত ধরে কাকুতি করেন,—জাহানারা, তুমি আত্মহত্যা কোরো না।
—না বাবা, আমি আত্মহত্যা করব না। তাছাড়া সব কথা তো আল্লা আমাকে বলেননি। তেমন সময় এলে বলবেন। সব শোনার জন্যেও বেঁচে থাকতে হবে আমাকে।
আমি আজই রঙমহলের চারদিকে কড়া পাহারার ব্যবস্থা করছি। বাইরের কেউ যাতে আর এদিকে না আসতে পারে।
—তাই করুন। আপনার আপেলের গন্ধ ঠিক আছে তো?
—দেখো তো, দেখো তো। তিনি সাগ্রহে হাত এগিয়ে দেন।
নাকের কাছে হাত এনে আড়ালে হাসি গোপন করি। তারপর বলি,–ঠিকই আছে। ঘরের বাইরে আসি। বাদশাহ্ স্থাণুর মতো বসে থাকেন। বুঝলাম আরও কিছুক্ষণ ওইভাবে বসে থাকবেন তিনি।
.
রাজা!
হ্যাঁ, কোনও ভুল নেই।
বুকের ভেতরটা লাফিয়ে ওঠে। দরবারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রাজা। কিন্তু এল কখন? কোনও সংবাদই তো পাইনি। হয়তো কয়েক দিন আগেই এসেছে–হয়তো আজই চলে যাবে। দারার ওপর অভিমান হয়। আজকাল সে কেমন যেন তফাতে সরে গিয়েছে। আগ্রার সেই স্নেহের বন্ধন অনেক আলগা হয়েছে।
রাজাকে কীভাবে সংবাদ দিই? আমি যে অনেক দূরে। কী করি? শেষে নাজীরকে ডাকি। সে এসে দাঁড়ায়। দারাকে খবর দিতে বলি। দরবারে যাবার আগে সে যেন আমার সঙ্গে দেখা করে যায়।
একটু পরে সে এসে বলে, দারা অনেক আগেই বাইরে চলে গিয়েছে। নাদিরা বলেছে, সে দরবারে যাবে না। জ্যেষ্ঠ পুত্রই বটে। আমি বাদশাহ্ হলে অমন ছেলেকে এক মুহূর্তে নাকচ করে দিতাম। আওরঙজেবের আর যাই হোক, সে কৌশলী, সে কর্মঠ, সে সংযত। মুরাদ যত নেশাই করুক, সে বীর, সে যোদ্ধা। সুজাও ভাল। দারার আলস্য আর খামখেয়ালিপনা তার পাণ্ডিত্যকেও হার মানিয়েছে। আজকাল সে সময়ে অসময়ে নগরীতে চলে যায়-জানি না কেন। নাদিরাকে প্রশ্ন করলে তার মুখ ম্লান হয়ে ওঠে। নির্বোধের মতো ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
নিজের কক্ষে গিয়ে বাদশাহকে চিঠি লিখি। মাত্র দুই ছত্রের চিঠি। সুরাটের শাসন ব্যাপারে আমি বৃন্দীরাজের সঙ্গে পরামর্শ করতে চাই। দরবার শেষে তিনি যেন আমার সঙ্গে ঝরোকার সামনে দেখা করেন
নাজীরের হাতে চিঠিখানা দিয়ে বলি, দরবারে পৌঁছে দিতে। সেই অবসরে আমিও গিয়ে ঝরোকার আড়ালে দাঁড়াই। আমার ভয় হয়, পাছে বাদশাহ সবার সামনে জোরে আমার চিঠিটি পাঠ করেন। নজরৎ শুনলে জ্বলে উঠবে।
চিঠিখানা বাদশাহের হাতে পৌঁছয়। তিনি একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েই সেটা তাঁর হাতের মধ্যে রেখে দেন। তাঁর মুখভাবের কোনও বৈলক্ষণ্য দেখলাম না।
রাগ হয় আমার। যদি তাঁর মুখে মৃদু হাসিও দেখতে পেতাম, মনকে সান্ত্বনা দেওয়া যেত। কিন্তু এ যেন চূড়ান্ত অবহেলা। উপাধি দিয়েছেন তিনি আমাকে ‘বাদশাহ্-বেগম’ অথচ আমার এই কাজ তাঁর কাছে যেন ছেলেমানুষি। আজই তাঁর সামনে উপাধি ত্যাগ করার মনস্থ করি। ওই তো বসে রয়েছে আমার রাজা। আর সবার রূপ ওর কাছে নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছে। ও যদি আমাকে ভালবাসে তাহলে বাদশাহ্-বেগম কেন শাহজাদীও থাকতে চাই না।
—বেবাদল খাঁ। বাদশাহের গুরুগম্ভীর উচ্চারণ শুনি।
বিস্মিত হই। মণি-মাণিক্য-জহরৎ-এর ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী বেবাদল খাঁ। বাদশাহের সমস্ত ঐশ্বর্য তার মুঠোর ভিতরে। সাধারণত কোনও বড় রকম যুদ্ধ ছাড়া বেবাদল খাঁ কিংবা তার স্থলাভিষিক্ত কারও ডাক পড়ে না। হ্যাঁ, ডাক পড়েছিল একবার। তাজমহল নির্মাণের সময়। কিন্তু আজ বেবাদল খাঁকে তলব কেন? কোনওরকম সংঘর্ষের সম্ভাবনা রয়েছে কি? কিন্তু বাদশাহ্ তো আমাকে জানাননি। এখানেও বোধহয় সেই অবহেলা। যত বুদ্ধিমতীই হই না কেন, আমি নারী। তাই যুদ্ধের ব্যাপারে আমার পরামর্শের প্রয়োজন হয়নি।
বেবাদল খাঁ কাছে এসে দাঁড়ায়।
—কত সোনা রয়েছে ভাণ্ডারে?
—কত আপনার প্রয়োজন বাদশাহ্?
—এক লক্ষ তোলা?
সমস্ত দরবারে একই সঙ্গে বিস্ময়-সূচক শব্দ ওঠে। আমিও অবাক্ হই। এত সোনার হঠাৎ এমনকী দরকার পড়ল?
—শুধু সোনা নয়, হীরা চুনীও লাগবে।
একজন আসন ছেড়ে উঠে বলে,—জাহাঁপনা।
বাদশাহ্ হাত তুলে ইশারায় তাকে বসতে বলেন—সব বলছি। দেশে যখন কোনও অশান্তি নেই তখন আর একটি অত্যাশ্চর্য জিনিস তৈরিতে আপত্তি আছে আপনাদের?
নজরৎ খাঁ বলে,—কী সেই অত্যাশ্চর্য জিনিস যার জন্যে এত সোনার প্রয়োজন?
—তক্ত-তাউস। আমার মনের মতো একটি তক্ত-তাউস।
—তার জন্য অত অপব্যয়!
বাদশাহ্ গম্ভীর হয়ে বলেন,—নজরৎ, এত দেখেও মুঘল-ঐশ্বর্য সম্বন্ধে তোমার কোনও ধারণা জন্মায়নি। বেবাদল খাঁ—
—জাহাঁপনা।
—কোষাগার কি একেবারে শূন্য হয়ে যাবে?
—না জাহাপনা। সামান্য একটা অংশও ব্যয় হবে না।
বাদশাহ্ হাসেন। বলেন—শুনলে নজরৎ খাঁ।
—আমায় মাফ করবেন জাহাঁপনা।
বেবাদল খাঁ, তোমারই ওপর ভার দিলাম। এটি ভারতবর্ষ। এ দেশের আসল পাখি হল ময়ূর। আমি হিন্দুদের মতো সিংহাসন চাই না—আমি চাই ময়ূরাসন।
—জো হুকুম।
—তোমাকে এবারে একটি ভাল জিনিস হাতছাড়া করতে হবে।
বেবাদল খাঁ জিজ্ঞাসুর দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।
—ইরানের শাহ্ বাদশাহ্ জাহাঙ্গীরকে যেটি দিয়েছিলেন।
বেবাদল খাঁ চোখ দুটো বড় বড় করে প্রশ্ন করে,—পদ্মরাগমণি? সেটি বাইরে আনবেন?
—হ্যাঁ। ভাল জিনিস সবাই যদি না দেখল, তবে থেকে লাভ কি? আল্লা ওটি মানুষের হাতে দিয়েছিলেন সবার চোখকে তৃপ্তি দেবার জন্যে।
হঠাৎ দেখি রাজা উঠে দাঁড়ায়। তার মুখে হাসি। আমার মনের ভেতরও হাসিতে ভরে যায়।
—ছত্রশালের বক্তব্যটি কী?
—জাহাঁপনা, পদ্মরাগমণি আপনার ময়ূরাসনকে অলঙ্কৃত করুক ক্ষতি নেই। কিন্তু চোখকে তৃপ্তি দেবার সঙ্গে সঙ্গে সে আর একটি জিনিসও জাগায় মানুষের মনে।
—কী সে জিনিস?
—হিংসা ও লোভ। পরিণামে অশান্তি।
—আশা করি দরবারের কারও মনে তেমন কিছু জাগবে না।
রাজা দুষ্টু হেসে বলেন—হলপ করে তা কি বলা যেতে পারে?
—তোমার মনে?
—আমার কথা আলাদা জাহাঁপনা। প্রাণহীন কোনও রত্ন মহামূল্যবান হলেও আমাকে চঞ্চল করতে পারবে না।
বুকের ভেতরে ছম্ করে ওঠে। রাজার এ কথার কি গভীর কোনও অর্থ আছে? নিশ্চয়ই আছে। সে ঝরোকার দিকে এভাবে চাইছে কেন? সে ঠিক বুঝতে পারছে না, আমি এখানে রয়েছি কি না।
নজরৎ হঠাৎ লাফিয়ে উঠে রাজার দিকে ঘুরে বলে,–এর অর্থ কী দাঁড়ায় ছত্রশাল? আপনি ছাড়া আমরা সবাই হিংসায় জ্বলে মরি?
—ছি ছি খাঁ সাহেব! নিজেকে অত ছোট ভাবেন কেন? আপনার দৃষ্টিও যে অনেক উঁচুতে, অন্তত আমি সেকথা জানি।
নজরৎ-এর চোখে সন্দেহের ছায়া নামে। সে রাজার দিকে বার বার আপাদমস্তক চেয়ে তার কথার অর্থ আবিষ্কারের চেষ্টা করে। সে আর যাই হোক, বোকা নয়। কিন্তু এখন চালাক হয়েও কিছু করার নেই। তাই মুখখানা যথাসম্ভব গম্ভীর করে সে তার আসনে বসে পড়ে।
দরবারের কাজ খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়। ময়ূরাসনই ছিল প্রধান আলোচ্য বিষয়। বাদশাহের অনুমতি নিয়ে এক সময়ে সবাই ধীরে ধীরে গাত্রোত্থান করে। বাদশাহ্ নিজেও আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। আমি রাজার দিকে চেয়ে থাকি। সে তার আসনে বসে রয়েছে তখনো। নজরৎ উঠে দাঁড়িয়ে রাজাকে দেখে আবার বসে পড়ে। গা জ্বালা করে আমার।
বাদশাহ্ সামনের দিকে চেয়ে তেমনি দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর হাতের মুঠোয় আমার চিঠিখানা। হয়তো ভুলে গিয়েছেন সেটির কথা। ওমরাহ্রা তাঁকে অপেক্ষা করতে দেখে ফিরে চাইতেই, ইশারায় তাদের চলে যেতে বলেন। শূন্য দরবার-কক্ষে শুধু দুজনা বসে থাকে। নজরৎ আর রাজা।
বাদশাহ তাদের বলেন,—বিশেষ কোনও প্রয়োজন আছে কি?
—না জাহাঁপনা! নজরৎ খাঁ জবাব দেয় প্রথমে।
—ছত্রশাল?
—শাহজাদা দারাশুকো অপেক্ষা করতে বলেছেন আমাকে : সঙ্গীতচর্চা হবে একটু।
—তবে তুমি অপেক্ষা করো। নজরৎ, তুমি যেতে পারো। কাল তোমার সঙ্গে একটু বিশেষ পরামর্শ আছে।
—পরামর্শটা যদি আজ—
—না, না। আজ আমি বড় পরিশ্রান্ত।
নজরৎ-এর মুখ লাল হয়ে ওঠে। সে ধীরে ধীরে বলে,—সঙ্গীত জিনিসটা শিখতেও চেষ্টা করলাম না কোনওদিন। বড় আফসোস হয়
বাদশাহ্ হো হো করে হেসে ওঠেন। রাগ ভুলে আমি নিজেও হেসে ফেলি। ভাগ্যিস শব্দ হয়নি।
হাসতে হাসতে বাদশাহ্ বলেন,—এখন আর আফশোস করে কী হবে নজরৎ। আমাকেও তাহলে আফশোস করতে হয়।
—একটু শুনে যেতে পারব না জাহাঁপনা?
—না। বেরসিক লোক উপস্থিত থাকলে, রসিকদের রসগ্রহণে ব্যাঘাত জন্মায়।
নজরৎ রাজার দিকে জ্বলন্ত-দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বাইরে চলে যায়।
বাদশাহ্ ডাকেন,—ছত্রশাল।
—জাহাঁপনা।
রাজা বাদশাহের সামনে এসে দাঁড়ায়। সে একটু অবাক হয়েছে।
হাতের মুঠো থেকে চিঠিখানা বার করে রাজার দিকে বাড়িয়ে দেন পিতা। আর সেই মুহূর্তে আমি নহরী-বেহেস্ত-এ খলিলুল্লা খাঁয়ের বেগমের সঙ্গে নোংরামির কথা একদম ভুলে যাই। ইচ্ছে হল শাহানশাহের দুই পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ি। নিজেকে বড় বেশি বুদ্ধিমতী বলে মনে করি আমি। শাহানশাহ্ নিজেই আমার মনে এ অহঙ্কার সৃষ্টিতে সহায়তা করেছেন। কিন্তু তিনি কতবড় কৌশলী, আজ তাঁর কার্যে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম। দেশে যুদ্ধ নেই, বড় রকমের অরাজকতা নেই। সারা ভারতের মোটামুটি শান্তি বিরাজ করছে। শান্তি সবাই চায়। তাই ভাল লাগে এ অবস্থা। কিন্তু আমার মনে হয়, এই নিশ্চিন্ততা শাহানশাহ্ শাহজাহানের বুদ্ধি আর প্রতিভার একটা বড় দিক নেপথ্যে রেখে দিয়ে গেল। শাহানশাহ্ নিজেও হয়তো বুঝেছেন একথা তাই ঐতিহাসিকরা যাতে তাঁর কথা দুই পৃষ্ঠায় শেষ করে না দিতে পারে সেজন্যেই ময়ূরাসন, কিল্লাই মুবারকও সেজন্যে, জুম্মা মসজিদ। তাজমহলকে এই পর্যায়ে টেনে আনতে মন সায় দেয় না।
পিতা চলে যান। যাবার সময় ঝরোকার দিকে একবার চেয়ে যান।
দরবারে একমাত্র ব্যক্তি আমার রাজা। তেমনি বসে রয়েছে। অনড় নিস্পন্দ।
আঃ বড় অদ্ভুত মানুষ তো? নড়ছে না কেন? একদিকে আসছে না কেন? মজা দেখছে নাকি? ঝরোকার পেছনে আমি ছট্ফট্ করছি—খুব ভাল লাগছে ওর।
পাথরের জালের গায়ে মুখ লাগিয়ে ডাকি,—রাজা।
নিজের স্বর নিজের কানেই বড় করুণ শোনায়। বড় মিষ্টি শোনায় যেন। এভাবে ডাকলে কি পুরুষ সাড়া না দিয়ে পারে?
কিন্তু তবু সে বসে রয়েছে। আমার ডাক তার কানে গিয়ে পৌঁছেছে বলে মনে হয় না।
—রাজা। চোখ দিয়ে আমার জল বের হয়। কিছুতেই সামলাতে পারি না। আসন ছেড়ে দ্রুত এগিয়ে আসেও। ভারী পায়ের শব্দে স্তব্ধ দরবারকক্ষ কম্পিত।
—শাহজাদী।
—রাজা।
—সুরাটের শাসন ব্যাপারে?
—না, না। বুঝতে পারো না?
—এখন বুঝলাম। আমার ধারণা ছিল শাহজাদীদের মন প্রতি মুহূর্তে বদলায়।
—অঙ্গুরিবাগে দেখা হবার পরেও?
—হ্যাঁ।
—তবে আর কিছু বলার নেই আমার।
শরীরের সমস্ত শক্তি যেন অন্তর্হিত হয়।
—রাগ করো না জাহানারা। আগ্রায় অঙ্গুরিবাগের সেই কয়েকদিনের সন্ধ্যা পার হয়েছে। ভেবেছিলাম মুঘল-হারেমে বাস করে সে-সন্ধ্যার স্মৃতি বুকের মধ্যে আঁকড়ে রাখা তোমার পক্ষে সম্ভব হবে না।
—ভুল ভেঙেছে রাজা?
—হ্যাঁ। অনুতাপ হচ্ছে এখন। তোমার কাছে কী ভাবে ক্ষমা চাইব ভেবে পাচ্ছি না। দুষ্টুবুদ্ধি জেগে ওঠে মনে। বলি,–যে ভাবে আমি বলব। রাজি?
—রাজি।
—বেশ, তবে মহতাব-বাগে যাও।
—সেখানে অন্য কেউ নেই?
—না? আর সবাই হায়াত-বক্স-বাগে।
—তুমি এখনি আসবে?
—একটু পরে।
রাজা চলে যায়।
নিজের কক্ষে গিয়ে ভাবতে বসি, কোন্ সাজে সাজব। এতদিনের গোপন প্রতীক্ষায় আমার স্নায়ুমণ্ডলের ওপর ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলছিল আজ তা নেই। স্নায়ুগুলি শিথিল যেন। রাজা মহতাব-বাগে বসে আছে জেনেও সাজ-সজ্জা করতে অবসাদ অনুভব করি। অথচ রাজার কাছে যাবার আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা বিন্দুমাত্র কমেনি। শেষে অতি সাধারণভাবে নিজেকে সাজিয়ে মহতাব-বাগে প্রবেশ করি।
আজ আর এক সন্ধ্যা। এ সন্ধ্যায় দূরে তাজমহল শীর্ষ দেখা যায় না। দিগন্তের চেহারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। চোখে পড়ে খোয়ারগাহ। মাঝখানে নহবৎখানা রিক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে শাহানশাহ্ শাহজাহানের জন্মদিনের অপেক্ষায়। সেদিন ওই নহবৎখানা থেকে ভেসে আসবে সুমধুর তান। সে তানের ঝংকার আজ আমার মনের মধ্যে। নহবৎখানার প্রয়োজন নেই।
তবু এমন একটি বিশেষ দিন আগ্রাতে হয়তো আরও ভালভাবে উপভোগ করতে পারতাম। সেখানে যে মমতাজ বেগম রয়েছেন, আর রয়েছেন বেগম নুরজাহান।
নির্জন মহতাব-বাগের নির্জনতম স্থানে রাজার সাক্ষাৎ পাই। সামনে দাঁড়াতেই সে একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে থাকে। নতুন করে ভুলে যাই—যৌবনের পথে আমি বহুদূর অগ্রসর হয়ে এসেছি। আমি যেন কিশোরী—যৌবন উঁকি দিচ্ছে আমার জীবনে। মুখ নিচু হয়ে যায়।
—শাহজাদীর এই বেশ?
—শাহজাদী নই আমি।
—তবে?
—আমি শুধু—
—কী?
ওর সামনে বসে, ওর উরুদেশে মুখ রেখে বলি,—জানিনে।
ধীরে ধীরে আমার একটি হাত সে তার নিজের হাতে তুলে নেয়! কী তীব্র সুখ! শুধু পুরুষের দেহের সংস্পর্শে কি এত সুখ সম্ভব? যদি সম্ভব হয়, তবে বুঝব রোশনারা ঠিক পথেই চলেছে। মুঘল-হারেমের কোনও শাহজাদীই তবে ভুল করেনি।
রাজার হাতের আঙুল আমার আঙুলগুলো জড়িয়ে ধরে। আমার শরীর যেন অবশ হয়ে যায়।
—এ কি বিরহের বেশ জাহানারা?
আমার দুই চোখে বন্যা আসে। তবু তার ঝাপসা মুখের দিকে চেয়ে বলি,—আর অভিনয় নয় রাজা।
রাজার মনের মুখোশ মুহূর্তে খুলে পড়ে। সে আগ্রহভরে আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে চেপে ধরে। মুখে কথা নেই। তারও নয়, আমারও নয়। সব কথা তখন শিরায় শিরায় —বুকের ওঠা-নামায়।
মুদ্রিত নয়নে রাজার ওষ্ঠের সহস্র স্পর্শ অনুভব করি আমার সর্বাঙ্গে। এই ঠক বেহেস্ত? গুলরুখবাঈকে রক্ষা করার চেষ্টায় যে আগুনের ছোঁয়াচ অনুভব করেছিলাম দেহের ওপরে, তার চেয়েও তীব্রতর আগুন আমার দেহের মধ্যে। কিছুতেই নিজেকে সংযত রাখতে পারিনে। এ কী হল! কী করব এখন? কোথায় যাব? আমি কি পাগল হয়ে গেলাম? নইলে এমনভাবে আমার নখের আঘাতে রাজার দেহ ক্ষতবিক্ষত করছি কেন?
ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। চিৎকার করে উঠি,—আমাকে বাঁচাও রাজা।
অবলীলাক্রমে রাজা আমাকে নরম ঘাসের ওপর শুইয়ে দেন। কানে আমার ঝঙ্কৃত হয় রাজার অসংলগ্ন অতি সুমিষ্ট কথা। নিমীলিত চোখে গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে রাজার অনুরূপ মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে; হে আল্লা, এই মুহূর্তে পৃথিবীকে ধ্বংস করে দাও—
স্বপ্নের ঘোরে নিজের কক্ষে ফিরি আমি অনেক রাতে।
নাজীর আমার রাতের খাবার আগলে নিয়ে বসে ছিল। তাকে বাইরে যেতে বলি। উজ্জ্বল আলোয় তার সামনে যেতে সংকোচ হয়। ওদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুই এড়ায় না। শাহজাদীদের পদস্খলন দেখাই যেন ওদের কাজ। কিন্তু আমি পৃথিবীর সামনে মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করতে পারি, এ আমার পদস্খলন নয়। এ যদি তাই হয়, তবে বাদশাহের সঙ্গে মমতাজ বেগমের সম্বন্ধও পদস্খলনের নজীর। তবু জগৎ বড় কঠিন ঠাঁই। শাহজাদী হয়ে শাস্তির ভয় না থাকলেও সমালোচনার ভয় আছে—যে সমালোচনা ধীরে ধীরে পক্ষ বিস্তার করে সমস্ত ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়তে পারে, অথচ যা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
.
কে যেন রটিয়েছে দিল্লিতে এসে বাদশাহের শরীর একেবারেই সুস্থ যাচ্ছে না। তারপরই আমার বিদেশের তিন ভাই-এর কর্মতৎপরতা দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠি। সুজা তার বিশ্বস্ত কর্মচারীদের দু-চারজনকে দিল্লিতে রেখে দিয়েছে। মুরাদও তারা লোক রেখেছে এখানে। আর আওরঙ্গজেব তার অনুচরকে নিয়মিতভাবে দরবারে আসন গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছে। রোশনারাকে কৌশলে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম মীরজুমলার ছেলে আমীর খাঁ দিল্লির নাগরিকদের সঙ্গে সম্বন্ধ রেখে চলেছে কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে। রাগে দুঃখে আমি অভিভূত হই।
মুঘল-বংশের সেই একই নাটক পুনরাভিনীত হবে সন্দেহ নেই। রক্ত! তক্ত-তাউসের জন্য রক্ত। কেউ ছাড়বে না। দাক্ষিণাত্যের ‘জীন্দাপীরেরও’ মনের রসনা থেকে লালা নিঃসৃত হচ্ছে। সেই লালা বিষাক্ত। তাতেই আমার সব চাইতে ভয়। দারা যদি একটুকু রাজনীতিজ্ঞ হত, কিংবা আমি যদি পুরুষ হতাম, তবে জীন্দাপীরের জন্যে বিন্দুমাত্র চিন্তিত হতাম না। কিন্তু আমি নারী হারেমের বাইরে আমার ক্ষমতা বেশিদূর বিস্তৃত হতে পারে না। পারত, যদি রাজা দিল্লিতে বরাবরের জন্যে থাকত। কিন্তু তাকে নিজের রাজ্য বুন্দী ছেড়ে এখানে থাকতে বলতে পারি না। তবু কোনও কোনও মনসবদারের পদোন্নতির ব্যবস্থা করে, কোনও কোনও সামন্তকে উচ্চ সম্মান দিয়ে, কয়েকজন বিদেশি রাজ্যের রাষ্ট্রদূতদের অযথা জাঁকজমকের সঙ্গে অভ্যর্থনা করে জীন্দাপীর আওরঙজেবের সুনিয়ন্ত্রিত পরিকল্পনার অনেক অংশ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিলাম। তাই কিছুদিনের মধ্যেই তার কাছ থেকে পত্র পেলাম : তোমাকে যদি আমি পরামর্শদাতা হিসাবে পেতাম তাহলে আমি পৃথিবী জয় করতে পারতাম। কিন্তু সহজে পাব না জানি। কারণ আমার প্রতি তোমার স্নেহের অংশ বড়ই কম। তাই আল্লার কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে তিনি তোমাকে নারী করে পাঠিয়েছেন।
আবহাওয়া যখন এই রকম ঠিক সেই সময়ে এক সন্ধ্যায় নাদিরা ছুটে আসে আমার কক্ষে তার চোখ-মুখের চেহারা দেখে আমি আতঙ্কিত হই। কিছু বলার আগেই সে পালঙ্কের ওপর আছড়ে পড়ে বুকভাঙা কান্নায় কেঁদে ওঠে।
চমকে উঠি আমি। দারা? সুলেমান? সিপার? জানি না কার কী হল।
—কী হয়েছে নাদিরা?
কথা বলে না সে। তেমনি কেঁদে চলে। শয্যার একটি অংশ একেবারে ভিজে যায়, তবু কথা বলে না সে। বার বার নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
উদ্বেগে আমি ছটফট করি। তাকে বলি,—এভাবে কেঁদে চললে তো কিছুই হবে না নাদিরা। কী হয়েছে বলো। যদি প্রতিকার করার থাকে করতে হবে তো?
সে হাত নাড়িয়ে জানিয়ে দেয়, কিছুই করার নেই।
এবারে সত্যি সত্যিই ভয় পাই আমি। তবে কি চূড়ান্ত কোনও দুর্ঘটনা ঘটে গেল? কী এমন দুর্ঘটনা যা শুধু নাদিরাই জানল।
কঠিন স্বরে বলে উঠি—চুপ করো নাদিরা। যদি শুধু কাঁদতেই চাও, নিজের ঘরে গিয়ে কাঁদো। আমি এসব পছন্দ করি না।
বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে চেয়ে আমার হাত জড়িয়ে ধরে বলে, আপনি ছাড়া যে আমার কেউ নেই।
আমার চোখ দুটো ভিজে ওঠে ওর কথার ধরনে। বিয়ের পরদিন থেকেই ওর প্রতি আমার দুর্বলতা। নিজের বোনদের ওপরও হয়তো অত টান নেই।
চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে স্নেহের স্বরে বলি,—বলতে চেষ্টা করো নাদিরা।
একটু চুপ করে থেকে শুধু বলে,—রানাদিল্।
—রানাদিল।
সে ঘাড় ঝাঁকায়।
—বাঈজি রানাদিল?
ঘাড় ঝাঁকিয়ে সে বলে,—হ্যাঁ।
—রাস্তার রানাদিল?
—হ্যাঁ।
—বাজারের রূপসী রানাদিল?
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলে, —হ্যাঁ।
—কী করেছে সে?
—দারাশুকো পাগল হয়েছে।
—কী বললে?
—সত্যি কথা। একটুও মিথ্যে নয়। প্রায়ই নগরে যেত। প্রথম প্রথম খেয়াল করিনি। পরে অস্বাভাবিক বলে মনে হল। শেষে সন্দেহ করতে শুরু করলাম। পেছনে লোক লাগাই। আজ সব পরিষ্কার হয়ে গেল।
—দারাশুকো রানাদিলের কাছে যায়। রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় যে রানাদি, তার কাছে যায় শাহজাদা দারাশুকো?
—হ্যাঁ। গান গেয়ে ঘুরে বেড়ায় রানাদিল। চারণ-কবির গান। সুন্দর গলা। দেখতে আরও চমৎকার। আমার চেয়েও। বয়স অনেক কম।
—বাজে কথা বোলো না নাদিরা। দারার এ রুচি হতে পারে না। সে তো শিল্পী—সে এলেমওয়ালা লোক।
—রানাদিও শিল্পী—সুগায়িকা। আমি কিছুই পারি না।
—আর কেউ জানে?
—সবাই জানে, শুধু আমরা ছাড়া। রানাদিল্ যে পথ দিয়ে হেঁটে যায় সে পথে গাড়ি-ঘোড়া যাতায়াত বন্ধ করে দেওয়া হয়। শাহজাদার হুকুম।
—এতদূর?
—রানাদিল্ বাজারের পথে গান গেয়ে চললে আগে সবার চোখে লোভের আগুন জ্বলে উঠত, এখন সেই অগুনতি চোখে জাগে বিস্ময়, জাগে সম্ভ্রম।
—পায়াভারী হয়েছে রানাদিলের, তাই না?
—না। একবিন্দুও পরিবর্তন হয়নি তার। ঠিক আগের মতোই রয়েছে। সবার সঙ্গে কথা বলে। হাসে। শুধু তার রূপ আরও ফুটে বের হয়েছে।
—দারার মতলব কী?
—জানি না। আপনি ডেকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন। আমার কথা বলার ইচ্ছে নেই। নাদিরা আর কিছুক্ষণ চোখের জল ফেলে ধীরে ধীরে উঠে যায়। পেছন থেকে তার দিকে চেয়ে কষ্ট হয় আমার। কত বিশ্বাস, কতখানি স্নেহ-ভালবাসা নিয়ে সে হারেমে থাকত। আজ থেকে তার সব শান্তি অন্তর্হিত। দিল্লির আবহাওয়ায় যখন বিপদের সংকেত, অন্য তিন ভাই যখন অতিমাত্রায় কর্মব্যস্ত, ঠিক সেই সময়ে শাহানশাহ্ শাহজাহানের জ্যেষ্ঠপুত্র বাজারের নর্তকীর প্রেমে হাবুডুবু। চমৎকার?
দারাকে ডাকালাম। সব কিছু খুলে বলে রাগলাম, কাঁদলাম, অভিমান করলাম। কোনও ফল হল না। নাদিরাকে সে ভালবাসে ঠিকই। কিন্তু রানাদিকে সে ছাড়তে পারবে না। নাদিরা এখন আর তার মনকে আগের মতো সতেজ করে তুলতে পারে না।
দারার মুখে এমন কথা শুনে দুঃখ হল খুবই। আরও দুঃখ পেলাম সে যখন কোর-আনের নির্দেশ তুলে ধরল। কোর-আনে রয়েছে একসঙ্গে চার বেগমকে রাখা যায়। তাতেও সন্তুষ্ট হল না সে। এ বিষয়ে আবু-বিন-লায়লার ব্যাখ্যাও শুনিয়ে ছাড়ল আমাকে। কোর-আনের নির্দেশ ব্যাখ্যা করে নিয়ে তিনি দেখিয়েছেন একসঙ্গে উনিশ-জন বেগমকে রাখা যায়। দারা হঠাৎ এমন খাঁটি মুসলমান হয়ে উঠবে স্বপ্নেও ভাবিনি। কোনওদিন যে কিতাব স্পর্শ করেনি সে-ও বোধ হয় নিজের শাদির ব্যাপারে কিতাবী-তত্ত্ব হাতড়ে বেড়ায় আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে।
শেষে নিরুপায় হয়ে বাদশাহের কাছে গিয়ে রানাদিল্ প্রসঙ্গ উত্থাপন করলাম। তিনি হেসে উঠলেন।
তীক্ষ্ণ স্বরে প্রশ্ন করি,—বাদশাহের হাসির কী কারণ ঘটল জানতে পারি কি?
রাগ হলে ‘পিতা’ সম্বোধন না করে এভাবে ঘুরিয়ে কথা বলা আমার অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে আজকাল।
বাদশাহ্ হেসে জবাব দেন—নিশ্চয় জানতে পার বাদশাহ বেগম। মুঘল বাদশাহের জ্যেষ্ঠ পুত্রের এমন দু-একটা তুচ্ছ কাজকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখার কোনও অর্থ হয় না।
—তাই বলে একজন সাধারণ নর্তকী?
—সবার চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায় বলেই সে সাধারণ। পোশাক-পরিচ্ছদ পরিয়ে হারেমে রাখলে সে সাধারণ থাকবে না। সে হয়ে উঠবে অসাধারণ।
—দারার বেগম হবে সে?
—বাইরের সমালোচনা বন্ধ করার জন্যে হবে বই কী।
—তৈমুর-বংশের বেগম?
—তৈমুর-বংশের এমন অনেক বেগমই ছিল। শোন বাদশাহ-বেগম। রানাদিল্ নামটা আমার অজানা নয়। সে সাধারণ নয় মোটেই। সে এক দুর্লভ রত্ন।
—আপনি জানেন?
—দারা ঘন ঘন দরবারে অনুপস্থিত হলে, তার কারণ অনুসন্ধানের গরজ যে আমার। স্তব্ধ হই। ভেবে পাই না, দারার প্রতি বাদশাহের এটি অন্ধ স্নেহ, না আর কিছু। নিজের দুর্বলতা ঢাকার জন্যেই কি রাতারাতি এমন উদার হয়ে উঠলেন তিনি? শুনতে পাই, শায়েস্তা খাঁয়ের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক সম্প্রতি আগের মতো নেই। কোনও এক বিশ্রী ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছেন।
নিজের কক্ষে এসে চোখের জল ফেলি। মায়ের কথা মনে পড়ে। বড় অসহায় বোধ হয় নিজেকে। আজ যদি মমতাজ বেগম বেঁচে থাকতেন।
নাদিরার অশ্রুসিক্ত চোখের সামনে একদিন রানাদিল্ এসে প্রবেশ করে হারেমে; দারার মুখে কী তৃপ্তির হাসি। নাদিরার দিকে চাইবার অবসরই পায় না সে। আমার বুক ভেঙে যায়। তবু এগিয়ে যাই। বাদশাহ-বেগম আমি। সংযতভাবে রানাদিকে অভ্যর্থনা করি। দেখে সত্যিই মুগ্ধ হই। কী নিষ্পাপ চাহনি। কোনও খেদ থাকে না। মনে মনে দারাকে তারিফ না করে পারি না। মুহূর্তের জন্যে নাদিরার দুঃখের কথাও ভুলে যাই।
রানাদিল্ ধীরে ধীরে নাদিরার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে। দারা অপ্রস্তুত। রানাদিল্ নাদিরার মুখের পানে চেয়ে দরদী কণ্ঠে বলে,—আপনাকে দেখেই চিনেছি। এ অবস্থাতেও আপনি সামনে রয়েছেন। অন্য কেউ হলে পারত না।
নাদিরা নীরব।
রানাদিল্ বলে,–আপনার অধিকার ছিনিয়ে নিতে আসিনি। আপনার অধিকার আপনারই রইল। আমি শুধু একপাশে পড়ে থাকব। এতে শাহজাদার সময় অনেক বাঁচবে। এতদিন শাহজাদা বাইরে যেতেন, দরবারে উপস্থিত হবার সময় পেতেন না। আপনার কাছেও আসতে পারতেন না।
নাদিরা ধীরে ধীরে বলে,–আল্লা তোমার মঙ্গল করুন। অধিকার কি কেউ নিজে থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে? সবই হচ্ছে আল্লার ইচ্ছে। আমি ব্যথা পেয়েছি খুবই। তাই বলে তোমাকে শত্রু বলে ভাবব না কখনো।
রানাদিলের মতো আমার মাথাও এই প্রথম নাদিরার প্রতি শ্রদ্ধায় আপনা হতে নত হয়।
বাদশাহ্-বেগম আমি। দারাকে ডেকে নিয়ে রানাদিলের কক্ষ দেখিয়ে দিই। তার মুখে বিস্ময়ের চিহ্ন। হারেমের একেবারে এক কোণে রানাদিলকে রাখার ব্যবস্থা করেছি বলে মনে মনে সে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। কিন্তু মুখে কিছু বলতে সাহস পায় না। অন্তঃপুরে আমার ওপর কথা বলার অধিকার স্বয়ং বাদশাহেরও নেই।
রানাদিল্ বেগম হল। রাস্তার মেয়ে হারেমের বিলাসিতার মধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত হল। আমিও যেন তৃপ্তি পেলাম। এক ঝলকেই বুঝতে পেরেছি দারার প্রতি মেয়েটির প্রেমে বিন্দুমাত্র ভেজাল নেই। এ প্রেম সে নিজের জীবন দিয়েও রক্ষা করবে! বাদশাহ ঠিকই বলেছিলেন—দুর্লভ রত্ন রানাদিল।
পরদিন দারাকে ঠিক সময়ে দরবারে উপস্থিত হতে দেখে বাদশাহ্ হাসলেন। নজরৎ খাঁয়ের মুখে বিদ্রূপের হাসি ফুটে উঠল। রাজা নেই। থাকলে কী করত জানি না। হয়তো হাসত। হাসি নেই শুধু নাদিরা আর রোশনারার মুখে। নাদিরার না হাসার কারণ রয়েছে। কিন্তু রোশনারার চোখ দুটো রাগে লাল হয়ে উঠল—যেমন হয়েছিল বহুদিন আগে আগ্রায় ‘দশ-পঁচিশী’ ঘর হাত-ছাড়া হবার সময়ে। নহরী-বেহেস্ত-এ রোশনারার কর্তৃত্ব প্রায় বিলুপ্ত। বেশিক্ষণ আর সেখানে থাকতে পারে না সে। এখন সেখানে দারার সঙ্গে রানাদিলের আধিপত্য।
ইচ্ছে করে এই সব বিলাসিতার মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চায় না রানাদিল। দু-চারদিন তার সঙ্গে মিশে আমি বুঝতে পেরেছি। খুব সাধারণভাবে থাকতে চায় সে। কিন্তু দারা নাছোড়বান্দা। সে চায় রানাদিকে অপ্সরীর মতো সব সময় সাজিয়ে রাখতে।
রোশনারা আমার ঘরে এসে ফেটে পড়ে,—যত সব ভিখিরির আস্তানা।
—কী হল আবার?
—আজ বাইরে বের হয়ে রাস্তায় যত ভিখিরি দেখব, সব এনে ভরে দেব দারার হারেমে।
—এত রাগ কেন?
ঝাঁঝিয়ে ওঠে সে,—তুই তো বাদশাহ্-বেগম। শুনি নাকি শাহানশাহের পরেই তোর ক্ষমতা।
—ঠিকই শুনিস।
—অতই যখন ক্ষমতা, তখন নহরী-বেহেস্ত-এ কুষ্ঠরোগীদের স্নানের ব্যবস্থা করে দে।
—সোজা কথা বল না রোশনারা।
—রানাদিল্ কি রঙমহলেই পাকাপোক্ত থাকার ব্যবস্থা করেছে?
—কেন?
—আর কেউ তো সেখানে যেতে পারে না। যখন যাই, দেখি গা চুবিয়ে বসে রয়েছে।
—তুই সামনে গেলে নিশ্চয়ই উঠে যেত।
—গা ঘিন ঘিন্ করে যেতে।
—কিন্তু ওর রূপ? অস্বীকার করতে পারিস?
রোশনারা চুপ করে থাকে।
—এই রূপের জন্যে মেহের-উন্নেসা নূরজাহান হয়েছিলেন। ওই রূপের জন্যে আরজমন্দ-বানু হয়েছিলেন মমতাজ বেগম।
—তাদের পিতৃপরিচয় ছিল—আধিপত্য ছিল।
—ওরও হয়তো রয়েছে। আমরা শুনতে চাইনি।
—আভিজাত্য থাকলে, মরে গেলেও রাস্তার নর্তকী হয় না।
—রোশনারা, কে কখন যে কী হয়, কিছুই বলা যায় না।
একটু সময় গুম হয়ে থেকে সে প্রশ্ন করে,—কী ব্যবস্থা করছ?
—কিছুই না।
—আর তাই মেনে নিতে হবে?
—নিশ্চয়ই।
—বেশ
রোশনারা যাবার জন্যে পা বাড়ায়, ঠিক সেই সময় আমার নাজীর এসে উপস্থিত হয়। সে উত্তেজিত।
—কোনও খবর আছে?
—হ্যাঁ, বাদশাহ্ বেগম। ময়ূরাসন নিয়ে এইমাত্র বেবাদল খাঁ দরবারে এলেন। তাজ্জব বনে গিয়েছে সবাই।
রোশনারার রাগ মুহূর্তে অন্তর্হিত হয়। সে ঝড়ের মতো বের হয়ে যায়।
আমি কিছুক্ষণ বসে থাকি! আজকাল সব কিছুই যেন অকস্মাৎ ঘটে চলেছে—আমি জানার আগেই। ময়ূরাসন আসবে আজ, সে খবরও বললেন না বাদশাহ্। হয়তো তিনি নিজেও জানতেন না। নিয়মহীন এই সৃষ্টিছাড়া অব্যবস্থা সুলক্ষণ নয় মোটেই।
দরবারে ঝরোকার পেছনে হারেম ভেঙে পড়েছে। শাহজাদী, বেগম, নাজীর কেউই বোধ হয় বাদ নেই। দরবারের সব কয়টি চোখ ময়ূরাসন ছেড়ে এখন ঝরোকার দিকে। একসঙ্গে একগাদা মেয়ের ভিড়ের স্বাভাবিক আওয়াজ তাদের কৌতূহলান্বিত করেছে।
রোশনারা ঝরোকায় মুখ লাগিয়ে রেখেছে! তার পিছনে রানাদিল্ বেগম। রোশনারা নিশ্চয়ই জানে না রানাদিলের উপস্থিতি। জানলে, ছিটকে বের হয়ে আসত।
রানাদিলের চোখ ময়ূরাসনের দিকে নয়। তার চোখ পাশের স্বর্ণসিংহাসনের দিকে। সবাই জানে ওটি তৈরি হয়েছে শাত্জাদা দারাশুকোর জন্যে—ময়ূরাসনের ভাবী উত্তরাধিকারী।
রোশনারা মুখ তোলে। রানাদিকে সরিয়ে সে আমার কাছে আসে। এতই অন্যমনস্ক সে যে দেখতেই পায় না রানাদিকে।
—কেমন দেখলি রোশনারা?
—অপূর্ব। তবে আওরঙজেব দেখলে হয়তো বলত বাজে খরচ।
—সে কী বলত, তাতে কিছু আসে যায় না।
—নিশ্চয়ই আসে যায়। তবে ওটির ওপর বসে কাজ চালাতে বোধ হয় আপত্তি হবে না তার।
চিৎকার করে উঠি,—কী বলতে চাস্ তুই?
—মাথা ঠাণ্ডা রাখো বাদশাহ্-বেগম! শাহানশাহ শাহজাহানের পরে ওটি অধিকার করার মতো শক্তি, সাহস আর বুদ্ধি কার রয়েছে সেকথা তোমার অজানা নয়।
হারেমের সব কয়টি নারীর ভীত-চকিত চোখ আমাদের উভয়ের দিকে। আমাকে সবাই ভয় পায়, সমীহ করে। তাই রোশনারার ঔদ্ধত্যে তারা বিস্মিত। তারা ভালভাবেই জানে ইচ্ছে করলে আমি রোশনারাকে বহিষ্কৃত করতে পারি—যদিও সে আমারই মতো শাহজাদী। শুধু হারেমে নয়, দরবারেরও অনেক সিদ্ধান্ত আমি উল্টে দিতে পারি, সে প্রমাণ তারা পেয়েছে।
কিন্তু আমি কিছুই করলাম না। রোশনারা শাহজাদী। সবার সামনে তাকে শাস্তি দেওয়া অবমাননা করা। গম্ভীর স্বরে বলি,—ভবিষ্যতে গুনে গুনে পা ফেলো রোশনারা। হয়তো আমার বাক্য, আচরণ কিংবা মুখমণ্ডলে বিস্ফোরণের পূর্বাভাস ছিল, যার ফলে রোশনারা কোনও কথা না বলে মুখ নিচু করে চলে যায়। হারেমের নারীদের মধ্যে সাংঘাতিক কিছু দেখতে না পাওয়ার হতাশা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারা নিঃশব্দে স্থান ত্যাগ করে। আমি একলা বসে থাকি ঝরোকার কাছে। কিছুই ভাল লাগে না। মনে হয়, অনেক ভুলই করেছি আমি স্বাভাবিক মমতাবশে। সব জমা হচ্ছে। একদিন তার ফল পেতেই হবে। তবু উপায় নেই। মনুষ্যত্বকে বলি দিতে পারি না। পারতাম হয়তো, যদি রাজা আমার জীবনে না আসত।
.