মন পাখিরে কৃষ্ণকথা বল
মনে একটা পাখি বসে আছে। একটা নয় দুটো পাখি। একটা অতি ছটফটে সদা চঞ্চল। অন্যটি স্থির। মাঝেমধ্যে চঞ্চল পাখিটিকে বলে, অত ছটফটানি কীসের গো? একটু স্থির হয়ে দাঁড়ে বোসো। কৃষ্ণকথা বলো। সারাজীবন তো অনেক কপচালে। অনেক জ্ঞানের ঢ্যালা ছুঁড়লে অনেকের দিকে। নিজে কী পেলে? গুটিকয় লাল ধানি লঙ্কা! সাধুর নিমকাঠের কমণ্ডলু সাতধাম ঘুরে এল। স্বভাব কিন্তু পালটাল না। যে তেঁতো সেই তেঁতো।
সৎ শিক্ষার তো অভাব ছিল না। অজস্র সৎ গ্রন্থ। কিছু কিছু পড়াও হল। প্রতি যুগেই একাধিক মহাপুরুষ এলেন। সেই মহাপুরুষদের ঘিরে গড়ে উঠল সৎসঙ্গ। মঠ, মিশন, মন্দির, বিদ্যালয়, কলেজ, ধর্মশালা। হিন্দুধর্মটাই তো এক স্তবক আচরণবিধি, নিজেকে যত পরিস্রুত করা যাবে, ততই খাঁটি বিন্দু হওয়া যাবে। দেব-দেবী, কোশাকুশি, ধুনো গঙ্গাজল ধর্ম নয়। মনের প্রস্তুতি। হিন্দুধর্ম হল দেহের বাইরে যে বিশাল সত্তা, সেই সত্তায় নিজেকে বিসর্জন। সসীম থেকে অসীমে, ক্ষুদ্র থেকে বিশালে উত্তরণ। জৈব নীচতা থেকে দৈব উত্তুঙ্গতায় আরোহন। হিন্দুধর্ম হল মানবধর্ম।
সেই হিন্দু আমির কী অবস্থা! ‘মন আমার। /পাগলা ঘোড়ারে কই থেকে কই লইয়া যায়। /মন হইল ঘোড়া রে, বাতাস হইল জিন! / এমন যে গোয়াইরা বেটা রাতদিন দৌড়ায়।।’ ধর্মটর্ম ছেড়ে মন মাছির মতো কখনও বিষ্ঠায় কখনও রসগোল্লায়।
একটি লুঙ্গি আর কাঁধকাটা গেঞ্জি হল গৃহের ভূষণ। সকালে এক কাপ চা মেরে, দিন শুরু। কী দিন, কেমন দিন! রাতে দিনের হিসেব নিতে বসে চক্ষুস্থির। সারাদিন কী করলে বাপু বেদান্তের ছারপোকা? আচ্ছা, সৎচিন্তা কী করেছ?
প্রথমেই কলে জল নেই দেখে, দোতলায় বাড়িওয়ালার বারান্দার দিকে তাকিয়ে যমরাজকে স্মরণ। ফুলো চোখো, পেটমোটা, কুচুটে মানুষটাকে হে রাজাধিরাজ, পত্রপাঠ গ্রাস করো। বুড়ো প্রতিমাসেই তাল ঠুকছে ভাড়া বাড়াও, আর এক একটি সুবিধের মূলোচ্ছেদ করছে।
তারপর কী করলে?
তারপর বাড়ির বাইরে পা রেখেই চোখে পড়ল প্রতিবেশী দুর্গাবাবুর বড় ছেলে বিশাল এক ব্যাগ বাজার হাতে হেলেদুলে বাড়ি ফিরছে। প্রমাণ সাইজের একটি মাছের ন্যাজা অনুচ্চারিত অহঙ্কারের মতো ব্যাগের পাশ দিয়ে বাতাসে সোচ্চার। ঠোঁটে একটি সিগারেট ঝুলছে। আমার দিকে আবার আড়চোখে তাকানো হল। মন অমনি তরফদার সেতারের মতো বেজে উঠল, ও: খুব চলছে! কেন চলবে না বাছাধন, দু-নম্বরী পয়সা। বাড়িতে কালার টিভি। মারুতি বুক করেছে। বাড়ির বাইরে চড়াপরদার রং। জানলায় জানলায় বাহারী পরদা। টবে টবে ফুলগাছ। অমন এক পুরুষে বড়লোক অনেক দেখেছি। যেদিন ইনকাম ট্যাক্স কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাবে, সেদিন বেলুন তোমার চুপসে যাবে মানিক।
ও মন তুই কৃষ্ণকথা বল। ঈর্ষা অতি বদ জিনিস। বাঙালি ব্যাবসা করে দু-পয়সা করেছে, কেন তোমার চোখ টাটাচ্ছে! কেন টাটাবে না! দুশো গ্রাম মাছ, একটা কপি, গোটা ছয় কড়াইশুঁটি কিনতে যাকে দশবার পাঁয়তারা কষতে হয়, কেন তার ঈর্ষা হবে না! এর নাম সাম্যবাদ! আমার হাজার টাকা রোজগার হলে, ওর ন’শো টাকা হওয়া উচিত। আমার পাঁচশো হলে ওর চারশো। আমি সুখে থাকব, সবাই দু:খে। আমি দূর থেকে দেখব আর চুকচুক করব। জগতের এই তো নিয়ম হওয়া উচিত? হায় উলটো বুঝলি রাম।!
তারপর কী করলে?
তারপর আমার প্রবাসী বড় ভাই আমাদের কমান মায়ের সেবার জন্যে তিন মাস কোনও টাকা পাঠায়নি বলে, দাড়ি কামাতে কামাতে তার পিণ্ডি চটকানো হল। বাবুর বড় মেয়ের অসুখ। মায়ের ওষুধ আর দুধের খরচের ভার সে নিয়েছিল। টাকাটায় ফ্যামিলির অনেক সাহায্য হত। ন’মাসে, ছ’মাসে এক পুরিয়া হোমিওপ্যাথি, সামান্য টোটকাটুটকি, লোহা ছ্যাকা দিয়ে এক আঁটি থানকুনির রস, কী গাঁদাল পাতার ঝোল, আর এক শিশি দুধে তিন শিশি জল, মন্দ চলছিল না, বাবুর মেয়ের অসুখ। লায়ায়। যেসব ছেলে মায়ের সেবা করে না, তারা যত শিক্ষিতই হোক কুলাঙ্গার। এই বিয়ের মাসে টাকা ক’টা এলে তোফা হত। আমার মধ্যম শ্যালকের বিয়ে। মোটা টাকার ধাক্কা। শেষ পর্যন্ত বউয়ের পরামর্শই না শুনতে হয়। মাকে প্যাক করে জব্বলপুর দিয়ে এসো। সপ্তাহে তিন কেজি চাল, চোদ্দো কাপ চা আর দেড় কেজি গম বাঁচা মানে সেভিংস। মেয়ে বড় হচ্ছে, এখন থেকেই টাকা না জমালে বাবাজীবন কি কাঁচকলায় মেয়ের গলায় মালা দেবে। পরামর্শটা মন্দ নয়, কিন্তু সংসারে কাজের লোক কমে যাবে। কুটনো কোটা, বাটনাবাটা, ছেলেমেয়ে ধরা। সস্ত্রীক ফুর্তি করতে গেলে রাত জেগে বাড়ি পাহারা দেওয়া। এত কম খরচে কাজের লোক পাওয়া যায়! যা বাজার পড়েছে! কুপুত্র যদি বা হয় কুমাতা কখনও নয়। কতকালের কথা। এখনও সমান সত্য। ওরে মনপাখি, তুই কৃষ্ণকথা বল।
তারপর কী করলে?
তারপর আমাদের পুত্র, যাকে সহস্রাধিক সদুপদেশের বন্যায় সবসময় প্লাবিত রাখা হয়, তার একটি থেকে স্খলিত হাওয়ায়, আমরা স্বামী, স্ত্রী দুজনে মিলে, দুদিক থেকে দুটো কান ধরে মনের আনন্দে টানাটানি। কী সেই অপরাধ? মায়ের আঁচল থেকে একটি আধুলি ঝেড়ে ডালমুট খেয়ে বেমালুম অস্বীকার। না বলিয়া পরের দ্রব্য লওয়াকে বলে চুরি। বুঝেছ বালক? বালক বলিল, মা আবার কবে পর হইল, পিত:? তোমরাই তো বলিয়াছিলে মাতার চেয়ে আপনার পৃথিবীতে আর কেহ নাই। তাহার এমত ধড়িবাজ-উক্তি শুনিয়া আমরা উভয়ে অগ্নির মতো, আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলিয়া, ফাটিয়া পড়িলাম। হারামজাদা, উল্লুক। দধিমন্থনের দণ্ডের মতো ওই শাখামৃগটিকে আমরা উভয়ে ঘুরাইয়া পেঁচাইয়া চরিত্রের নবনীত বাহির করিবার প্রয়াস চালাইলাম কিয়ৎক্ষণ। তৎপরে ক্লান্ত হইয়া এক পেয়ালা চা পান করিতে ভাবিতে লাগিলাম, হায়! সুকুমারমতি বালককে কী বুঝাইব, মাতা, কি সত্যই আপনার! না দেশমাতা, না গর্ভধারিণী। আমার বৃদ্ধমাতা উপেক্ষিত, অবহেলিত, দাসীসদৃশ্য। আর দেশমাতা! আমাদেরই দ্বারা ধর্ষিতা? বালক, আমাদেরই শোণিত তোমার ধমনীতে প্রবাহিত, তুমি মহাপুরুষ কেমন করিয়া হইবে। তুমি ছিঁচকে চোর হইলেই জন্ম সার্থক।
ওরে মনপাখি, তুই কৃষ্ণকথা বল। পাখি যে কথা বলিতে চায় তাহা না শুনাই ভালো।
তারপর কী করলে?
ঘটা করে চান। বাথরুমে গুনগুন গান। ঘাড়ে পাউডার লেপন। ভুঁড়ির তলায় কষি নামিয়ে, শব্দ করে চর্ব্যচুষ্য আহার। ঢেউঢেউ উদগার। তারপর একটা দোচোঙা, আর আধুনিক ফতুয়া (বুশশার্ট) পরে দেশোদ্ধারে গমন। সেখানে ভূমিকা!
কূর্মাকৃতি এই ধর্মভূমিতে আমরা রাজনৈতিক ক্রিমির মতো কিলির বিলির করিতেছি। আমাদের মহাপুরুষ সকলের প্রতিকৃতি প্রকোষ্ঠোর দেয়ালে কোনওটি দক্ষিণ পার্শ্বে কোনওটি বামপার্শ্বে হেলিয়া ত্রিভঙ্গ মুরারি। আমাদের শ্রদ্ধা-ভক্তির, আমাদের কৃতজ্ঞতার ইহাই নমুনা। জনৈক অস্পষ্ট পুরুষ শুষ্ক-মাল্যভূষিত, মাকড়সার তন্তশোভিত। বোধ করি, ওই পুরুষই আমার পিতৃদেব। মাতাকে গঙ্গাযাত্রা করাইতে পারিলেই অপার শান্তি। পত্নীসোহাগে কতিপয় দিবস ধরাধামে কাটাইয়া অনুরূপভাবে আমাদের দেয়ালে বক্র-শ্যাম হইতে হইবে, সে সত্য ভুলিয়া গিয়াছি! আমাদের কর্মকাণ্ড দেখিয়া উত্তরপুরুষ অবশ্যই আরও শেয়ানা হইবে। মৃত্যুকালে মুখে এক বিন্দু গঙ্গোদক পাইব কি না সন্দেহ! বালক যদি প্রশ্ন করে, পিত: কি করিয়া বেড়াইতেছ? মস্তক কণ্ডূয়ন করিয়া বলিতে হইবে, বৎস! আমরা রাজনীতি, সমাজনীতি পুরাদমে উদোম হইয়া পালন করিতেছি। সূচ্যগ্র বংশদন্ড এ উহার গ্রাম্য অংশে, ও ইহার গ্রাম্য অংশে সাঁদ করাইতেছে। আমারটি খুলিয়া উহাতে উহারটি খুলিয়া তাহাতে। চক্রাকারে বংশ-গোঁজন উৎসবে আমরা মাতিয়া উঠিয়াছি। সকলেই তারস্বরে চিৎকার করিয়া বলিতেছি—শ্যালক, আমি যাহা করিতেছি, তাহাই ঠিক। মহাপুরুষগণ মুখ চুন করিয়া দেয়ালে বাঁকিয়া আছেন। বিদেশিগণ আসিয়া রাস্তাঘাটে মাল্যদান করিতেছেন। কিছু নামাঙ্কিত জরদগব-প্রতিমূর্তি দেশনামক ভাগাড়ের এখানে ওখানে বায়সবিষ্ঠা চর্চিত হইয়া আকাশের নীলিমায় ভরসা খুঁজিতেছেন। সেই প্রস্তর প্রতিমায় বৎসরান্তে সরকারি মালা ঝুলাইয়া আমরা নৃত্য করিতেছি—লাগ ভেলকি লাগ, আজ আমাদের ঘাটকামানো, কাল বৃষোৎসর্গ। বঙ্গ আমার জননী আমার খননেই স্বার্থ।
ওরে ও মন পাখি, তুই কৃষ্ণকথা বল।
ভাষা ভাবপ্রকাশের মাধ্যম। সেই ভাষা আমরা অতিশয় রপ্ত করিয়াছি। যিনিই আসনে তিনি জ্বালামুখী। ভুরিভুরি বাক্যস্রোতে, জ্ঞানপ্রবাহে দারিদ্র ভাসিয়া গিয়াছে, নিরাকার সাকার হইয়াছে, অশিক্ষিত হইয়াছে, ভূমিহীন ভূমি পাইয়াছে, দেশ শস্যশ্যামলা হইয়াছে, পল্লি বিদেশভূমির ন্যায় উদ্যানশোভিত, তপোবনের ন্যায় প্রশান্ত, জাপানের ন্যায় মনোরম হইয়াছে। প্রাতে পৌরপিতাগণ স্মিত হাস্যে, স্বীয় কৃতকর্মের উপর দিয়া জয় রাম করিতে করিতে বিশুদ্ধ বায়ুসেবনে বাহির হন। পল্লিবাসিগণ তখন সেই দেশহিতব্রতীগণকে পাত্র পাত্র সরকারি সুপেয়, সুলভ দুগ্ধ সেবন করাইয়া মিলিত কণ্ঠে গাহিতে থাকেন—আহা যে ভালো করেচ মাইরি। আর ভালোতে কাজ নেই। এবার মানে মানে সরে পড়, আমরা বেঁচে যাই। অত:পর গুপীযন্ত্র সহযোগে একতাবদ্ধ, সুউন্নত, মহাবুদ্ধিমান জাতি তারস্বরে নগর (ভাগাড়) সংকীতনে বাহির হয়ঃ
এ দেশেতে এই সুখ হল আবার কোথা যাই না জানি। / পেয়েছি এক ভাঙা নৌকো জনম গেল ছেঁচতে পানি। /কার বা আমি কে বা আমার / আসল বস্তু ঠিক নাহি তার / বৈদিক মেঘে ঘোর অন্ধকার। /উদয় হয় না দিনমণি।
অত:পর কী হইবে?
অশ্বডিম্ব হইবে। সভাসমিতি হইবে। ঝাণ্ডার আস্ফালন হইবে। নিদ্রিত রাজকুলের চোখের সামনে দেশ শ্মশান হইবে। একটিও বাঁশ-ঝাড় অবশিষ্ট থাকিবে না। অশ্বডিম্ব ঘোটক প্রসব করিবে। সেই ঘোটকে স্বদেশি শক, হূণ, পাঠান দল, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে মুক্ত অসিহস্তে খ্যাচাখাঁই করিবে। আর উত্তরপুরুষ বীর দেহে খড় পুরিয়া যাদুঘর বানাইবে। তাহার পর খড়ায়িত বীরগণের পদপ্রান্তে বসিয়া অক্ষক্রীড়া করিবে, দারু সেবন করিবে, গুরুগুরু শব্দে যতপ্রকার কেলোর কীর্তি আছে তাহা করিবে। অবশেষে গাহিতে থাকিবে—আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া কাল আমাদের দোল। পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে। বোল হরি বোল।