মন্মথ রায় -কে
কার্যালয়
৪০বি, মেছুয়াবাজার স্ট্রিট
কলিকাতা ৪.৭.২৭
– নওরোজ –
সচিত্র মাসিক পত্র
জয়যুক্তেষু,
আপনার স্নিগ্ধ চিঠি না-চাওয়ার পথ দিয়ে এসে আমায় যত না বিস্মিত করেছে তার চেয়ে আনন্দ দিয়েছে ঢের বেশি।
আমি এতটা আশা করতে পারিনি যে, আমার প্রশংসা আপনার ললাটের প্রদীপ্ত প্রতিভা-শিখাকে উজ্জ্বলতর করবে – বা সোজা কথায়, আমার প্রশংসায় আপনার মতো অসীম শক্তিশালী দুরন্ত সাহসী লেখকের কিছু ‘এসে যায়’।
আমার মনের চেয়ে চোখের স্মরণশক্তি একটু বেশি। দেখলে তাকে হয়তো গ্রহান্তরেও চিনতে পারি – কিন্তু শুনলে তাকে পথান্তরেও চিনতে বেগ পেতে হয়। কাজেই নন্দ চৌধুরি লেনের দেখা আপনাকে কাব্যের নন্দন-কাননের রাজপথে দেখেও চিনতে আমার এতটুকু দেরি হয়নি। নন্দ চৌধুরি লেনের সেই সুশ্রী ছিপছিপে তরুণের চোখে অপ্রকাশ প্রতিভার যে আয়োজন দেখেছিলাম তার পরিপূর্ণ বিকাশের সমারোহ আজ আমাকে শুধু বিস্মিত করেনি – পূজারি করে তুলেছে। এক বুক কাদা ভেঙে পথ চলে এক দিঘি পদ্ম দেখলে দু-চোখে আনন্দ যেমন ধরে না, তেমনি আনন্দ দু-চোখ পুরে পান করেছি আপনার লেখায় – এ বললে আপনি কী মনে করবেন জানিনে, তবে আমার প্রাণের আনন্দ এর চেয়ে ভালো করে প্রকাশ করার শক্তি আমার নেই বলে লজ্জা অনুভব করছি।
নন্দ চৌধুরি লেনের আপনার ‘লোমহর্ষণ’ নাটকটা শুনেছিলাম কিনা মনে নেই, যখন মনে নেই – তখন ওটাতে হয়তো ‘লোহমহর্ষণ’ই হয়েছিল, ‘প্রাণহর্ষণ’ হয়নি; হলে নিশ্চয় মনে থাকত। তার জন্যে দুঃখ করিনে, কারণ আপনাকে তো মনে আছে। শুধু সুশ্রী আপনাকে দেখেছিলাম সেদিন, আজ সুন্দর তোমায় দেখছি।
পবিত্রের মারফত আপনার প্রথম লেখা পড়ি – মুক্তির ডাক । পড়ে আমার কেমন লাগে পবিত্র লিখতে বলেছিল। ইচ্ছে করেই লিখিনি। সূর্যকে অভিবাদন করতে পারি – কিন্তু তাকে উজ্জ্বলতর করে দেখানোর মতো আলো ও অভিমান আমার নেই। আজও আপনার শক্তিকে অন্তর দিয়ে নমস্কার জানাচ্ছি মাত্র, তাকে প্রশংসা করিনি। আপনাকে প্রশংসা করার শক্তি আমার নেই।
আপনার মুক্তির ডাক-এর পর আমি ‘অজগর মণি’ ও ‘কাজল লেখা’ পড়ি। পড়ে মুগ্ধ হই, কিন্তু মুগ্ধ হয়েই ক্ষান্ত থাকিনি, যাকে পেয়েছি তাকেই পড়িয়েছি। কিছুদিন আগে নোয়াখালি যাই, সেখান থেকে লক্ষ্মীপুরে গিয়ে সুধাংশু বলে একটি ছেলের সঙ্গে পরিচয় হয়। বোধ হয় আপনিও চেনেন তাকে। তাকে ধন্যবাদ, সে-ই আমায় তিনখানা ‘বাসন্তিকা’ দেখায়। তাতেই আপনার অমর সৃষ্টি, ‘সেমিরিমিস’ , ‘ইলা’ , ও ‘স্মৃতিছায়া’ , কি ‘ছাপ’ পড়ি। ‘সেমিরিমিস’ পড়ে কী যে আনন্দ পেয়েচি তা বলে উঠতে পারিছিনে। যতবার পড়ি, ততবারই নূতন মনে হয়। আজ ইউরোপে জন্মালে আপনার প্রশংসায় দশদিক মুখরিত হয়ে উঠত। এ ঈর্ষার এবং ততোধিক ঈর্ষাতুর সাহিত্যিকের দেশে আপনার যোগ্য আদর হয়নি দেখে বিস্মিত হইনি একটুও – দুঃখিত যতই হই।
‘ইলা’ ও আমার বুকে কম দোলা দেয়নি – কিন্তু ‘সেমিরিমিস’-এ আমি যেন তলিয়ে গেছি। এত বড়ো সৃষ্টি! – দুঃসাহসের দিক থেকে বলছিনে – এর সৃষ্টির সার্থকতার ও পরিপূর্ণতার দিক দিয়েই বলছি – আমায় আর কারুর কোনো লেখা এত বিচলিত করেনি।…
আপনার লেখার একটা ফিরিস্তি দেখেছি ‘বাসন্তিকা’য় আপনার শেষ চিঠিতে, কিন্তু তার সবগুলি পড়ে উঠবার সুযোগ-সুবিধে পাইনি বলে নিজেকে দুর্ভাগ্য মনে করছি।
আমার ভয় হয়, উকিল মন্মথ ‘সেমিরিমিস’-এর মন্মথকে ভস্ম না করে ফেলে! ‘ল’ আর অঙ্কাতঙ্ক আমার ছেলেবেলা থেকে।
আমি ইঙ্গিত দিতে কি পারব আপনার মতো শিল্পীকে আপনার সৃষ্টি বিষয়ে? আমার মনে হয়, ‘তাজমহল’ সৃষ্টির কল্পনাকে কেন্দ্র করে লেখা আপনার হাত দিয়ে যা বেরুবে, তা সত্যিকার তাজমহলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে – ‘সেমিরিমিস’-এর স্রষ্টাকে এ লিখতে এতটুকু কুঙ্ঠা আমার নেই। – আপনার মত জানলে খুশি হব।
‘নওরোজ’ বেরিয়েছে – ওতে আমার এক মিতে লেখককে দেখবেন, তবে তিনি ‘নাজিরুল’, নজরুল নন – আ-কার ই-কারের দন্তধারণ করে নিজের বিশিষ্টতা রক্ষা করেছেন। তাঁর ভালো লেখা পড়ে, তাঁর প্রাপ্য নজরুলকে দেবেন না যেন।
সত্যই অনেক বকলাম – আপনার অনুরোধই রক্ষা করা গেল। তবে বকাটা বড্ড তাড়াতাড়ি হল – তাই এ বকাটা বোকার মতোই মনে হবে।
P.S. আপনার নৃপেনদার সহযোগে আমিও অনুরোধ জানাচ্ছি নওরোজের হাটে সওদা করতে আসার জন্য। দেরি করলে চলবে না। কখন লেখা পাঠাচ্ছেন জানাবেন।
আমার আন্তরিক শ্রদ্ধাপ্রীতি গ্রহন করুণ। ইতি –
নবনাটিকা-দর্শনাকাঙ্ক্ষী
নজরুল ইসলাম