মন্দ লোক
অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার, নীতিবাগীশ বৃদ্ধ ও স্তন্যপায়ী শিশুর জন্য এ কাহিনী লিখিত হয় নাই। তাঁহারা অনুগ্রহপূর্বক পাতা উল্টাইয়া যাইবেন। কারণ, অযথা রিপুর উত্তেজনা সৃষ্টি করা আমার উদ্দেশ্য নয়।
কুড়ি বৎসর আগে আমার বয়স কুড়ি বৎসর ছিল। হিসাবে বর্তমান বয়সের যে অঙ্কটা পাওয়া যাইতেছে, তাহা ছ্যাবলামির পক্ষে অনুকূল নয়। সিদ্ধার্থ এ বয়সে পৌঁছিবার পূর্বেই বুদ্ধত্ব লাভ করিয়াছেন; নেপোলিয়ন এ বয়সে অর্ধেক য়ুরোপের অধীশ্বর; আলেকজাণ্ডার এতদূর অগ্রসর হইতেই পারেন নাই, তৎপূর্বেই পৃথিবী জয় শেষ করিয়া ফৌৎ হইয়াছেন। সুতরাং যাহা বলিতেছি তাহা বালসুলভ চপলতা নয়। কেহ দন্ত বাহির করিয়া হাসিবেন না।
কুড়ি বৎসর বয়সেই আমি হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারিতে পসার জমাইয়া ফেলিয়াছিলাম। অ্যালোপ্যাথ ডাক্তারগণ হয়তো রাগ করিতেছেন, কিন্তু আমি জানি ভাগ্যই সর্বত্র বলবান—পসার এবং পত্নী পূর্বজন্মার্জিত; পৌরুষ বা বিদ্যার বলে তাহাদের সংগ্রহ করা যায় না। যদি যাইত, পি সি ও বি সি রায় অদ্যাপি অনূঢ় কেন?
আরম্ভে অনেকগুলি বড় বড় লোকের নাম করিয়া গল্পটাকে শোধন করিয়া লইলাম, সঙ্কোচও অনেকটা কাটিয়াছে। অতএব এবার শুরু করিতে পারি।
ছোট একটি শহরে ব্যবসা আরম্ভ করিয়াছিলাম। তখনও বিবাহ করি নাই; ছোট একটি বাসায় একাকী থাকিতাম, স্বপাক আহার করিতাম এবং ‘বিষস্য বিষমৌষধম্’ এই তত্ত্ব ফলত সার্থক করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিতাম। সকাল বিকাল আমার ছোট ঘরটি নানা জাতীয় রোগীতে ভরিয়া যাইত; অধিকাংশই গরিব, রোগের লক্ষণ বলিয়া অল্প মূল্যে ঔষধ কিনিয়া লইয়া যাইত। কদাচিৎ দুই-একটি সম্পন্ন ব্যক্তির বাড়ি হইতে ডাক পাইতাম। মোটের উপর ভালভাবেই চলিতেছিল; টাকা যত না হউক সুনাম অর্জন করিয়াছিলাম।
একদিন সকালবেলা রোগীর ভিড় হাল্কা হইয়া গেলে লক্ষ্য করিলাম, ঘরের কোণে একটি স্ত্রীলোক একখানা ময়লা চাদর মুড়ি দিয়া বসিয়া আছে। ঘর যখন একেবারে খালি হইয়া গেল তখন সে আস্তে আস্তে উঠিয়া জোড়হাতে আমার চেয়ারের পাশে দাঁড়াইল।
সপ্রশ্ন চক্ষে তাহার পানে চাহিলাম। অধিকাংশ রোগীই আমার পরিচিত, কিন্তু ইহাকে পূর্বে দেখি নাই। বয়স বোধ করি বছর চল্লিশ, থলথলে মোটা গড়ন; মুখের বর্ণ এককালে ফরসা ছিল, এখন মেছেতা পড়িয়া বিশ্রী হইয়া গিয়াছে। চিবুকের উপর অস্পষ্ট উল্কির দাগ, একটা কানের গহনা পরিবার ছিদ্র ছিঁড়িয়া দুইফাঁক হইয়া আছে। চোখে অসহায় উৎকণ্ঠার চাপা ব্যগ্র দৃষ্টি।
ও দৃষ্টি আমি চিনি। ঘরে যখন তিল-তিল করিয়া প্রিয়জনের মৃত্যু হইতেছে অথচ হাতে হোমিওপ্যাথিক ঔষধ কিনিবারও পয়সা নাই, তখন মানুষের চোখে ওই দৃষ্টি ফুটিয়া উঠে।
জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কি হয়েছে?’
স্ত্রীলোকটি পাতিহাঁসের মতো ভাঙা গলায় বলিল, ‘বাবু, আমি মন্দ লোক।’ তাহার দুই চোখে বিনীত দীনতা প্রকাশ পাইল।
একটু অবাক হইয়া গেলাম। নিজের সম্বন্ধে এতটা স্পষ্টবাদিতা তো সচরাচর দেখা যায় না। সত্যকাম ও জবালার কথা মনে পড়িয়া গেল।
আমি বুঝিতে পারি নাই দেখিয়া স্ত্রীলোকটি আমার চেয়ারের পাশে মেঝেয় বসিয়া পড়িয়া হেঁটমুখে জড়াইয়া জড়াইয়া নিজের যে পরিচয় দিল তাহাতে সমস্ত দেহ সঙ্কুচিত হইয়া উঠিলেও বুঝিতে বাকি রহিল না—জবালাই বটে।
সঙ্কোচ ও সংস্কার কাটাইয়া উঠা সহজ কথা নয়, এ জাতীয় রোগিণী আমার নাতিদীর্ঘ ডাক্তার-জীবনে এই প্রথম। তবু আমি ডাক্তার, নিজের দায়িত্বকে ছোট করিয়া দেখিলে ডাক্তারের চলে না। গলার স্বর ঈষৎ কড়া হইয়া গেলেও শান্তভাবেই জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘কি চাও?’
স্ত্রীলোকটি তখন উৎসাহ পাইয়া ভাঙা গলায় একগঙ্গা কথা বলিয়া গেল। উৎকণ্ঠা ও ব্যর্থতার আতিশয্যে অনেক আবোল-তাবোল বকিল। তাহার কথার নির্যাস এই—
পাপ-ব্যবসায়ের একমাত্র মুনাফা একটি কন্যা লইয়া সে যৌবনের প্রান্তে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। টাকাকড়ি কিছু রাখিতে পারে নাই, দুই-চারিখানা গহনা যাহা ছিল তাহারই সাহায্যে কন্যার যৌবনপ্রাপ্তি পর্যন্ত কষ্টেসৃষ্টে কাটাইয়া দিবে ভাবিয়াছিল। কিন্তু মা মঙ্গলচণ্ডী তাহাতে বাদ সাধিয়াছেন। কন্যাটির বয়ঃক্রম এখন ত্রয়োদশ বৎসর; গত এক বৎসর ধরিয়া সে কোনও দুশ্চিকিৎিস্য রোগে ভুগিতেছে। শহরের সকল ডাক্তারই একে একে চিকিৎসা করিয়া দেখিয়াছেন, কিন্তু কিছুই করিতে পারেন নাই। স্ত্রীলোকটির গহনা সব ফুরাইয়া গিয়াছে, ডাক্তারেরা হাল ছাড়িয়া দিয়াছেন। এখন আমি ভরসা।
বিবৃতির শেষে স্ত্রীলোকটি ব্যাকুলভাবে বলিল, ‘বাবু, আমার আর কিছু নেই। নিজে দেখতে পাই না, সে যাক—কিন্তু রোগা মেয়েটাকে খেতে দিতে পারি না। আমরা মন্দ লোক, কেউ আমাদের পানে মুখ তুলে চায় না। আপনি দয়া করুন, ভগবান আপনার ভাল করবেন।’ বলিয়া অসহায়ভাবে কাঁদিতে লাগিল।
ভগবানের ভাল করিবার ক্ষমতা সম্বন্ধে যদিও আমার খুব উচ্চ ধারণা নাই, তবু কেন জানি না, এই ঘৃণিতা নারীটার প্রতি দয়া হইল। বিশেষত যে রোগীকে শহরসুদ্ধ ডাক্তার জবাব দিয়াছে তাহাকে যদি বাঁচাইয়া তুলিতে পারি—
নিজের কৃতিত্ব দেখাইবার প্রলোভন ছোট বড় অনেক নৈতিক ও লৌকিক বাধা উল্লঙ্ঘন করিয়া যায়। আমি বিনা পারিশ্রমিকে মেয়েটার চিকিৎসা করিতে সম্মত হইলাম। এমন কি, গাঁটের কড়ি খরচ করিয়া ভাড়াটে গাড়ি ডাকাইয়া তাহাকে দেখিয়া আসিলাম।
কুৎসিৎ পল্লীর কুৎসিৎতম প্রান্তে একটা খোলার ঘর। দৈন্য যে চরম সীমায় পৌঁছিয়াছে তাহা একবার দৃষ্টিপাত করিলে আর সন্দেহ থাকে না। কতকগুলা ছেঁড়া কাঁথা ও চটের মধ্যে মেয়েটা পড়িয়া আছে; কাঠির মতো সরু হাত পা, গলাটি নখে ছিঁড়িয়া আনা যায়। গায়ের চামড়া কুঁচকাইয়া চামচিকার মতো হইয়া গিয়াছে—চমাবৃত কঙ্কাল বলিলেই হয়। যথার্থ বয়স জানা না থাকিলে নয়-দশ বছরের মেয়ে বলিয়া ভ্রম হইত।
পরীক্ষা করিয়া দেখিলাম, কঠিন রোগ—ম্যারাস্মাস, তাহার উপর পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব। যেরূপ অবস্থায় পৌঁছিয়াছে তাহাতে বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। আমার মুখে চোখে বোধ হয় মনের ভাব প্রকাশ পাইয়াছিল, মেয়েটা রোগ-বিষাক্ত অচঞ্চল সর্পচক্ষু মেলিয়া আমার পানে চাহিয়া রহিল।
ঔষধ ব্যবস্থা করিয়া ও পথ্যের জন্য একটা টাকা স্ত্রীলোকটির হাতে দিয়া ফিরিয়া আসিলাম। মনে হইতে লাগিল টাকা ও পরিশ্রম জলে পড়িল।
অতঃপর স্ত্রীলোকটি রোজ আসে। কখনও ঔষধ, কখনও নির্গুণ বড়ি দিই; মাঝে মাঝে দুই-একটা টাকাও দিতে হয়। স্ত্রীলোকটি মুখ কাঁচুমাচু করিয়া দীনভাবে গ্রহণ করে; ভাল করিয়া কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করিতে পারে না, ভাঙা গদ্গদ স্বরে বলে, ‘বাবা, ভগবান আপনাকে রাজা করুন।’
এক মাস যখন মেয়েটা টিকিয়া গেল, তখন আমি নিজেই আশ্চর্য হইয়া গেলাম। স্ত্রীলোকটি হাত জোড় করিয়া বলিল, ‘বলতে সাহস করি না বাবা, কিন্তু আর একবার যদি পায়ের ধুলো দেন। আজ মঙ্গলবার, খুঁড়ব না, কিন্তু আপনার ওষুধে কাজ হয়েছে। ঋতুরাণী আমার বাঁচবে।’
দেখিয়া আসিয়া আমিও বুঝিলাম, ঋতু বাঁচিবে। একটা মানুষকে—যতই ঘৃণ্য হউক—যমের মুখ হইতে ফিরাইয়া আনিয়াছি ভাবিয়া বড় আনন্দ হইল। নিজের শক্তির উপর শ্রদ্ধাও বাড়িয়া গেল।
মাস ছয়-সাত পরে কোনও এক পর্ব উপলক্ষে গঙ্গাস্নান করিতে গিয়াছি, ঘাটের উপর একটি মেয়ে হেঁট হইয়া আমাকে প্রণাম করিল। নিটোল স্বাস্থ্যবতী কিশোরী, গায়ের রং বেশ ফরসা, মুখখানিও মন্দ নয়—সদ্য স্নান করিয়া ভিজা চুলে আমার বিস্মিত চোখের সম্মুখে দাঁড়াইল। চিনিতে পারিলাম না। সে একটু ঘাড় বাঁকাইয়া লজ্জিত চক্ষু নত করিয়া মৃদুস্বরে বলিল, ‘আমি ঋতু।’
নিজের কৃতিত্বের জাজ্বল্যমান প্রমাণ চোখের উপর দেখিয়া প্রচুর আনন্দ হইবার কথা, কিন্তু আমার মনটা হঠাৎ খারাপ হইয়া গেল। সমস্ত দিন ধরিয়া তাহার গৃহস্থকন্যার মতো সলজ্জ কোমল মুর্তিটি চোখের সামনে ভাসিতে লাগিল, আর মনে হইতে লাগিল, তাহাকে না বাঁচাইলে বোধ হয় ভাল হইত।
গল্প এইখানেই শেষ হওয়া উচিত; কিন্তু আর একটু আছে। সেটুকু বলিতেই হইবে, সঙ্কোচ করিলে চলিবে না।
সেইদিন সন্ধ্যাবেলা ঋতুর মা অনেকদিন পরে আমার কাছে আসিল। মনটা খারাপ হইয়াই ছিল, তাহার উপর সে যে প্রস্তাব করিল তাহাতে ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত আগুন জ্বলিয়া উঠিল। ইহাদেরও নাকি নানাপ্রকার শাস্ত্রীয় বিধি-বিধান আছে, ঘটা করিয়া কার্যারম্ভ করিতে হয়। ঋতুর শুভ বলিদান কার্যটা আমার মতো সৎ পাত্রের দ্বারাই ঋতুর মাতা সম্পন্ন করাইতে চায়।
অজস্র গালাগালি দিয়া অকৃতজ্ঞ পতিতা স্ত্রীলোকটাকে তাড়াইয়া দিলাম। সে ভীত নির্বোধের মতো মুখ লইয়া ধীরে ধীরে চলিয়া গেল, আমার অসংযত উম্মার কারণটা যেন বুঝিতে পারিল না।
তারপর কুড়ি বৎসর কাটিয়া গিয়াছে; আমার বয়স এখন চল্লিশ। সেদিনের কথা স্মরণ হইলে মনে হয়, ঋতুর মা ‘মন্দ লোক’ ছিল বটে, কিন্তু বোধ হয় অকৃতজ্ঞ ছিল না। আদর্শের মাপকাঠি সকলের সমান নয়; বৈষ্ণবের কাছে যাহা মহাপাপ, শাক্তের কাছে তাহা পুণ্য। মানুষের অন্তর-গহনে যাঁহার অবাধ প্রবেশাধিকার তিনি হয়তো বুঝিয়াছিলেন, ঋতুর মাতা আমাকে পাপপথে প্রলুব্ধ করিতে আসে নাই, বরং তাহার পরিপূর্ণ প্রীতি ও কৃতজ্ঞতার অর্ঘ লইয়া আসিয়াছিল—তাহার দীন জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দান পূজারিণীর মতো আমার পদপ্রান্তে রাখিয়াছিল।
১ পৌষ ১৩৪৪