মন্ত্র
ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ তোমাকে কি দিলেন? গাড়ি, ঘোড়া! সোনাদানা!
কিস্যু না?
তাহলে কিসের এত ভক্তি, এত গুণগান!
কি দিলেন, সেটা বোঝানো যাবে না। ওটা যার যার তার তার। ওটা বোঝা যায়, বোঝানো যায় না। তবে এইভাবে বলা যায়, একটা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট দিয়েছেন। অদৃশ্য একটা বন্দুক দিয়েছেন শমন দমনের জন্য। আরেকটা ভয়ঙ্কর ক্ষতি করেছেন।
সেটা কি?
চোখ দুটো নষ্ট করে দিয়েছেন। প্রসঙ্গমাত্রেই চোখে জল আসে।
তার মানে শ্রীরামকৃষ্ণ তোমার কাছে শীতল বাতাস?
অবশ্যই! আমি যখন আমার দোতলার পশ্চিমের বারান্দায় গভীর রাতে দাঁড়াই তখন উত্তরে দক্ষিণেশ্বরের দিক থেকে বয়ে আসে মৃদু মৃদু রামকৃষ্ণ- বাতাস। এক আকাশ তারার নিচে কথা বলা গঙ্গা। ওপারে বেলুড় মঠের চূড়ায় বিবেকানন্দ-নক্ষত্র। আলুলায়িত অন্ধকার জননী সারদার কেশদাম। ছড়িয়ে থাকা নক্ষত্ররা তাঁর অন্তরঙ্গ পার্ষদের দল। বিশাল এক শিরীষ গাছের দিকে তাকিয়ে আমি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকি।
তাতে তোমার কি লাভ হয়? গতির জগৎ, যন্ত্রের জগৎ, প্রতিযোগিতার জগৎ, অর্থ আর বিত্তের জগৎ সাঁই সাঁই করে ছুটছে আর তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কবিতা করছ!
উপায় নেই, আমার সেরিব্রামে রামকৃষ্ণ-অ্যাটাক হয়েছে। বিষয়ের নাড়ি অবশ হয়ে গেছে। মাথাটাও বিগড়ে গেছে। রামকৃষ্ণরূপী গোখরো সাপের ছোবল খেয়েছি। বলে, বিষস্য বিষমৌষধি। রামকৃষ্ণ-বিষে বিষয়-বিষ মরে গেছে।
সর্বনাশ হয়ে গেছে তো!
একেবারে সাড়ে সর্বনাশ!
তোমার কি হবে গো—বলে ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছে করে।
তুমি কাঁদ, আমি ততক্ষণ প্রাণ খুলে হেসে নিই। একটু পরেই এই গঙ্গা দিয়ে কেশবের স্টীমার যাবে। দেখতে পাব, কেবিনঘরে বসে আছেন শ্রীরামকৃষ্ণ, ভক্তসঙ্গে ঠাসাঠাসি। আমি শুনতে পাচ্ছি তাঁর সেই অমোঘ কথা—বুঝলে কেশব! মন নিয়েই সব। মনেতেই বদ্ধ, মনেতেই মুক্ত! আমি মুক্তপুরুষ, সংসারেই থাকি বা অরণ্যেই থাকি, আমার বন্ধন কি? আমি ঈশ্বরের সন্তান; রাজাধিরাজের ছেলে; আমায় আবার বাঁধে কে? যদি সাপে কামড়ায়, ‘বিষ নাই’ জোর করে বললে বিষ ছেড়ে যায়! তেমনি ‘আমি বদ্ধ নই, আমি মুক্ত’–এই কথাটি রোখ করে বলতে বলতে তাই হয়ে যায়। মুক্তই হয়ে যায়।
তুমি এখনো কেশব সেনের জাহাজ দেখ! শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখ! তাঁর কণ্ঠস্বর শোন!
কেন শুনব না! আমি যে রামকৃষ্ণ-জাহাজের চিরযাত্রী। তিনি যে আমার বোধের সীমা ভেঙে দিয়েছেন। সময়ের এই সীমা তিনি ছাড়াতে পারলেও অনন্তের সীমা তো ছাড়াতে পারেননি। টি. এস. এলিয়টের মতো আমিও বলব-
“Time present and time past
Are both perhaps present in time future.
And time future contained in time past.”
-–বর্তমান আর অতীত ভবিষ্যতেরই অঙ্কশায়ী, আর ভবিষ্যৎ তো অতীতেই আছে। আমি যদি তাঁর ভাব ধরে থাকতে পারি, তাঁর দেহ যেখানেই থাক না আমার কাঁচকলা। তাঁর আনন্দের ধারায়, তাঁর আশ্বাস ও সুরক্ষার ছত্রতলে প্রতিনিয়ত আমার বিকাশ।
রোগ, শোক, জরা, মৃত্যু, ব্যাধি, অর্থাভাব, লাঞ্ছনা, অপমান, মিনিটের সুখ, ঘণ্টার দুঃখ, আশা আর আশাভঙ্গ, প্রত্যাশা আর হতাশা চারপাশে ছুটছে ঝাঁক ঝাঁক বুলেটের মতো। ঠাকুর আমাকে একটি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিয়ে দিয়েছেন। সেই জ্যাকেটের নাম স্বামী বিবেকানন্দ। ইস্পাতসম রামকৃষ্ণ-ভাব- তন্তু দ্বারা নরেন্দ্রনাথ নির্মিত সেই আবরণী। “এ-জগতে জানিবার কিছুই নাই। অতএব যদি এই relative-এর (মায়িক জগতের, ‘সন্নাপি, ভিন্নাপি, অভিন্নাপি’) পরে কিছু থাকে—যাকে শ্রীবুদ্ধ ‘প্রজ্ঞাপারম্’ বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন—যদি থাকে তাহাই চাই। তাহাতে দুঃখ আসে বা সুখ আসে I do not care ।
এই মন্ত্র জপের প্রথম মন্ত্র – I do not care. “নাচুক তাহাতে শ্যামা।” “যেখানে বেদ শেষ হইয়াছে, সেই বেদান্তের পথে সঞ্চরণ করিতেছেন।” কে? শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। তিনি আকাশ—মায়ের ইচ্ছায় পরিচালিত বালক। কখনো উলঙ্গ, কখনো উত্তম বস্ত্রধারী, কখনো প্রাণমাত্রই আচ্ছাদন, কখনো বালকবৎ, কখনো উন্মাদবৎ, কখনো পিশাচবৎ ব্যবহার।
“দিগম্বরো বাপি চ সাম্বরো বা
ত্বগম্বরো বাপি চিদম্বরস্থঃ।
উন্মত্তবদ্বাপি চ বালবদ্বা
পিশাচবদ্বাপি চরত্যবন্যাম্।” (বিবেকচূড়ামণি, ৫৪০)
দ্বিতীয় মন্ত্র—জীবাত্মার বাসভূমি এই শরীর কর্মের সাধনস্বরূপ—ইহাকে যিনি নরককুণ্ড করেন, তিনি অপরাধী এবং যিনি অযত্ন করেন, তিনিও দোষী।
“নাভিনন্দেত মরণং নাভিনন্দেত জীবিতম্।
কালমেব প্রতীক্ষেত নির্দেশং ভূতকো যথা।।”
সাধ্য যতটা ততটাই সাধন। মৃত্যু তো আসবেই। জীবন যতদিন থাকে। শুধু ভৃত্যের ন্যায় শ্রীরামকৃষ্ণের আজ্ঞার প্রতীক্ষা। মহানিশার সুগম্ভীর নির্জনতায় স্তব্ধ প্রতীক্ষা—কি আদেশ তোমার?
নরেন্দ্রনাথ আমার ‘মাউথপিস’। শোন কি আদেশ ভেসে আসে বিকলাঙ্গ এই সভ্যতার উদ্ভ্রান্ত মানুষের কাছে!
“ধর্মের রহস্য তত্ত্বকথায় নয়-আচরণে। সৎ হওয়া এবং সৎ কাজ করা— তার মধ্যেই সমস্ত ধর্ম। সে শুধু ‘প্রভু প্রভু’ বলে চিৎকার করে সে নয়, যে ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করে সেই ঠিক ঠিক ধার্মিক।”
ঠাকুর শ্রীমকে বলেছিলেন : “তোমার ঘর, তুমি কে, তোমার অন্তর বাহির, তোমার আগেকার কথা, তোমার পরে কি হবে—এসব তো আমি জানি। আমারটাও তিনি জানেন। সে জানাটা কেমন আমি জানতে চাই না; কারণ, আমি জানি আমি কেমন। দুর্বল, অস্থিরমতি, মানভিখারি, ফাঁকিবাজ, অলস, উদ্যমহীন, সন্দেহজনক চরিত্রের এক প্রাণী।
না, হলো না। তোমার ওপর আমার নরেন্দ্র রেগে যাবে। ইতিবাচক চিন্তায় নক্ষত্রখচিত আকাশের মতো ঝলমলে হয়ে ওঠ। তুমি তো মহাবোকা! আকাশ যত অন্ধকার হয়, তারা তত ঝলমল করে। ভয় অন্ধকারকে নয়, ভয় নেতিবাচক ভ্রান্তচিন্তার মেঘকে, বাতাসহীন জড়তাকে। আসল মন্ত্র নরেন্দ্রনাথ—
“সৎ চিন্তার স্রোতে গা ঢেলে দাও, নিজের মনকে সর্বদা বল ‘আমি সেই, আমিই সেই’। তোমার মনে দিনরাত্রি এই চিন্তা সঙ্গীতের মতো বাজতে থাকুক; আর মৃত্যু যখন আসবে তখনো ‘সোহহং সোহহং’ বলে দেহত্যাগ কর। সত্য এইটিই… জগতের অনন্ত শক্তি তোমার ভিতরে।”
কেশব সেনের জাহাজ চলেছে, কেবিনে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণের আনন্দের হাট। তিনি বলছেন : “বালিশ ও তার খোলটা।” দেহী ও দেহ। মানুষের হৃদয়ের ভগবানকে পুজো কর। আমি শ্রীরামকৃষ্ণ, তোমাকে এই আদেশ করছি। সারদা-চন্দ্রোদয়ে তোমার অন্তরের অন্ধকার রূপালী আলোয় উদ্ভাসিত হোক। জ্ঞানের শুকপাখি তোমাকে অন্তবেদের সারকথা কয়ে যাক-
“নিজের ওপর বিশ্বাস না এলে ঈশ্বরে বিশ্বাস আসে না”
প্রতিষ্ঠা কোথায়? সত্যে। বিত্ত ভগবান নয়, ভগবানই বিত্ত!