গৌড়ানন্দ কবি ভনে

মন্ত্রিগণের নিদারুণ অগ্নিপরীক্ষা

মন্ত্রিগণের নিদারুণ অগ্নিপরীক্ষা

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীসিদ্ধার্থশংকর রায় তাঁর নিজের মন্ত্রিসভার কতিপয় সদস্যের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য নিজেই এক কমিশন নিয়োগের ঘোষণা করায় দেশব্যাপী তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে। আরও অগণিত লোকের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, কংগ্রেস সভাপতি শ্রীশংকরদয়াল শর্মা, কলকাতা-দিল্লি ট্রাঙ্ক বিমান রুটের বোয়িং ৭২৭-এর কাপ্তান গগনবিহারী, বায়ু-বিবি মিস চমক চান্দিনী, লোডার রাম ভরোসা এবং এম পি শ্রীমতী মায়া রায় মুখ্যমন্ত্রীর এই প্রকার সৎসাহসকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কাজটি এতই অভিনব এবং অসমসাহসিক যে মুখ্যমন্ত্রী ও উত্তেজনার মাথায় নিজেকে অভিনন্দন জানিয়ে এক বার্তা পাঠাতে উদ্যত হয়েছিলেন বলে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মহল থেকে শোনা গিয়েছে। উত্তেজনা কিঞ্চিৎ প্রশমিত হবার পর সেটি আর প্রেসে পাঠাননি। এদিকে গৌড়ানন্দ কবির টেবিলে চিঠিপত্রের পাহাড় জমে যায়। মুখ্যমন্ত্রী ঘোষিত দুর্নীতি তদন্ত কমিশন পাঠক মহলে কী পরিমাণ উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে, চিঠির পাহাড়ই তার প্রমাণ।

নানাজনে নানা প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তার কিছু এবং তৎসহ গৌড়ানন্দের উত্তর এখানে তুলে ধরা হল:

প্রশ্ন : আমাদের লোকপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী শ্রীসিদ্ধার্থশংকর রায় পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে তদন্তের জন্য তদন্ত কমিশন নিয়োগের ঘোষণা করেছেন। এ এক অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত। অনুরূপ দৃষ্টান্ত আর কে কবে কোথায় রেখেছেন, বলতে পারেন?

উত্তর : ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। তবে আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর এই অত্যাশ্চর্য সৎসাহসের কথা মনে পড়লে মাত্র আর এক বেচারার নামই মনে পড়ে। তিনি শ্রীরামচন্দ্র। প্রজানুরঞ্জন অর্থাৎ ভাবমূর্তি অমলিন রাখার জন্য শ্রীরামচন্দ্র প্রাণপ্রিয় পত্নী সীতার অগ্নিপরীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন ত্রেতা যুগে, লংকার গড়ের মাঠে।

প্রশ্ন : তদন্ত কমিশন নিয়োগের ঘোষণা করে মুখ্যমন্ত্রী কি এইটাই প্রমাণ করে দিলেন যে এই রাজ্যে একমাত্র তিনিই সাচ্চা গণতন্ত্রবাদী?

উত্তর : অবশ্যই। অভিযোগ যখন মন্ত্রিসভার কতিপয় সদস্যের বিরুদ্ধে তখন মুখ্যমন্ত্ৰী কোন্ মুখেই বা কেবিনেটের বৈঠকে তদন্ত কমিশন গঠনের প্রস্তাব রাখবেন। আর প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকমণ্ডলী বা প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সঙ্গেও এত বড় একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে পরামর্শ করার ঝুঁকি নেওয়া যায় না। তাহলে মুখ্যমন্ত্রীর ঐতিহাসিক ঘোষণার আগেই তা আর কারও দ্বারা প্রেসে ফাঁস হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। আর এই তদন্তের উদ্দেশ্যই যখন গণতাকে খুশি করা, তখন মুখ্যমন্ত্রী অপেক্ষা এই রাজ্যে সাচ্চা গণতন্ত্রী আর কে আছেন?

প্রশ্ন : আমার তো মনে হয়, এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে রাজ্যের মন্ত্রিসভা এবং প্রদেশ কংগ্রেসের অনুমোদন অবশ্যই নেওয়া উচিত ছিল। আপনি কি আমার সঙ্গে একমত?

উত্তর : আজ্ঞে না, দুঃখিত। তার কারণ আপনি সঠিক খবরটি রাখেন না। আমাদের গণপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী এত বড় একটা সিদ্ধান্ত সাংবাদিকদের কাছে ঘোষণা করার আগে টেলিফোনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন। কারণ এ যুগে ভারতে ইন্দিরাতন্ত্রই গণতন্ত্র। তিনিই মন্ত্রিসভা, লোকসভা, শোকসভা, তিনিই পার্টি, তিনিই সংবিধান। কাজেই তাঁর অনুমোদন পাওয়া মানেই, সকলের অনুমোদন পাওয়া। মুখ্যমন্ত্রী গণতন্ত্রে যে অটল বিশ্বাসী, এর পরেও কি তা বুঝতে অসুবিধে হয়?

প্রশ্ন : মুখ্যমন্ত্রীর দুর্নীতি তদন্ত কমিশন গঠন বিষয়ক ঘোষণাই নিন্দুকদের রসনাকে সংযত করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এবং আমি দৃঢ়ভাবে এও বিশ্বাস করি যে আমাদের মুখ্যমন্ত্রীর মন্ত্রিসভার একজন মন্ত্রীও দুর্নীতিপরায়ণ নয়। আমার এই দৃঢ় বিশ্বাসের কারণ কী, বলতে পারেন?

উত্তর : কেন পারব না। আপনি বিশ্বাসে মিলায় কৃষ্ণ ‘তর্কে বহু দূর’– এই নীতিবাক্যে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী। তাছাড়া আপনার শরীরের প্রাত্যহিক নিকাশী ব্যবস্থাও খুব ভাল। তাই না?

প্রশ্ন : আচ্ছা, অভিযুক্ত মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে যে তদন্ত শুরু হবে, তা সারা হতে কতদিন লাগতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

উত্তর : অবসরপ্রাপ্ত জজরা যখন তদন্ত কমিশনে বসেন, তখন ঘরে ক্যালেন্ডার রাখতে তাঁরা ভালোবাসেন না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, দ্বিতীয় হাওড়া সেতু, পাতাল রেল, সি এম ডি এর নগর উন্নয়ন কাজ এবং মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে তদন্তের কাজ প্রায় একই সঙ্গে শেষ হবে।

প্রশ্ন : আচ্ছা এই তদন্ত কমিশনের উদ্দেশ্য কী?

উত্তর : রাজস্থানে পরমাণু বিস্ফোরণের উদ্দেশ্য যা, মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিশন নিয়োগের উদ্দেশ্যও তাই। ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা।

প্রশ্ন : নিজ মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিশন নিয়োগের উদ্দেশ্য যদি প্রশাসনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করাই হয়, তবে আমার তো মনে হয়, মুখ্যমন্ত্রীর বলিষ্ঠ ঘোষণাতেই সে উদ্দেশ্য যথেষ্ট সিদ্ধ হয়েছে। নিজের সহকর্মীদের বিরুদ্ধেই মুখ্যমন্ত্রী তদন্ত কমিশন নিয়োগ করছেন, তাঁর এই ঘোষণাই আজ তাঁর ভাবমূর্তি চকচকে করে তুলেছে। সেক্ষেত্রে সত্যি-সত্যিই কি আর তদন্ত কমিশন নিয়োগের ঝামেলা করার দরকার আছে? আপনার মত কী?

উত্তর : সত্যি বলতে কি, আপনার এই লাইনটা আগে আমার মাথায় আসেইনি। একটি মাত্র ঘোষণার দ্বারাই যখন মুখ্যমন্ত্রী এই চরম নিউজপ্রিন্ট সংকটের দিনেও পর পর এত বড় বড় হেড লাইন পেয়ে যাচ্ছেন, তখন এই ইয়ে আপনার মতো আমিও মনে করি, ঝামেলা আর না বাড়ানোই ভাল। তাছাড়া সামনে বর্ষা। কলকাতার জলনিকাশী ব্যবস্থা এমনই যে তার উপর ভরসা রাখা যায় না। বলা তো যায় না, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়?

১২ জুন ১৯৭৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *