মনোরমা – চতুর্থ খণ্ড – মানবী না দানবী

চতুর্থ খণ্ড – মানবী না দানবী

Arb. What? thus suspected – with the sword slung o’er us.
But by single hair, and that still wavering,
To be blown down by his imperious breath
Which spared us-Why, I know not.

Bal. Seek not why.
But let us profit by the interval.

Byron- “Sardauapalus.”

প্রথম পরিচ্ছেদ – শ্যাটা

আনন্দ-কুটীরের পশ্চাদ্ভাগে অতি সঙ্কীর্ণ গলিপথে একখানি গাড়ি আসিয়া থামিল। তন্মধ্য হইতে দুইজন আরোহী অবতরণ করিল। বলা বাহুল্য, পিশাচ-চেতা নবীন ডাক্তার আর দানবী জুমেলিয়া ব্যতীত এ আরোহিদ্বয় আর কেহই নহে। পাঠক-পাঠিকাদিগকে আমরা পূর্ব্বেই জানাইয়াছি যে, আনন্দ-কুটীরের চতুৰ্দ্দিকে ফলোদ্যান ইষ্টক-প্রাচীরবেষ্টিত। যথায় গাড়ি থামিল, তথায় সেই প্রাচীর-গাত্রে একটা ছোট প্রদ্বার ছিল। জুমেলিয়া সেই গুপ্তদ্বারের একপার্শ্বস্থিত একটি লৌহকীলকের উপর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের অল্প চাপ দিল; ক্ষুদ্র দ্বার উন্মুক্ত হইল। ছদ্মবেশধারিণী জুমেলিয়া ও নবীন ডাক্তার সেই দ্বার-পথে উদ্যানমধ্যে প্রবেশ করিল।

দেবেন্দ্রবিজয় সেই গুপ্তদ্বার উদ্ঘাটনের কৌশল গোপনে দেখিয়াছিলেন; অতি সতর্কতার সহিত সেই গুপ্ত প্রক্রিয়ায় তিনি সেই গুপ্তদ্বার দিয়া ফলোদ্যানে প্রবেশিলেন। পায়ে জুতা ছিল, পাছে অনুসরণ করিতে ঈষন্মাত্র শব্দ উত্থিত হয়, এই ভয়ে জুতার তলে রবারের পত্জার আঁটিয়া দিলেন।

.

রজনী ঘোরান্ধকারময়ী। সুনিবিড় জলদমালায় আকাশতল সমাচ্ছন্ন। দেবেন্দ্রবিজয় যাহাদের অনুসরণ করিতেছিলেন, তাহারা সেই ঘোরান্ধকারে কোথায় যে বিলীন হইয়া গে’ল, দেখিতে পাইলেন না। অতি দূর হইতে পদধ্বনি মৃদু মৃদু শ্রুতিগোচর হইতেছিল তাহাই লক্ষ্য করিয়া চলিলেন। ক্রমে সে শব্দও বিলীন হইল। তিনি বুঝিলেন, যাহাদিগের তিনি অনুসরণ করিতেছেন, তাহারা অনেক দূরে চলিয়া গিয়াছে। নিরস্ত হইলেন না, পূর্ব্বাপেক্ষা সত্বরপদে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। এইরূপে কিছু সময় ব্যয় হইলে অনেক দূরে আনন্দ-কুটীরের প্রবেশ দ্বার সম্মুখে এক তীব্র আলোকজ্যোতি সেই অন্ধকারের ঘনীভূততার মধ্যে বিনির্গত হইয়া উঠিল। তাহাতে দেবেন্দ্রবিজয় দেখিলেন, নবীন ডাক্তার চুরুট ধরাইবার নিমিত্ত দিয়াশলাই জ্বালিল। তখন আর নবীন ও জুমেলিয়ার সে জাল-মূর্তি নাই; ইতোমধ্যে অন্ধকারে তাহারা নিষ্প্রয়োজনবোধে ছদ্মবেশ ত্যাগ করিয়াছিল।

মুহূর্ত্তের পর আবার সেই অন্ধকার। সেই ভীষণ অন্ধকারের মধ্যে নবীন ডাক্তারের মুখস্থিত চুরুট-সংলগ্ন এক কণা অগ্নি—কিছুই নহে। এমন সময়ে গুরুগম্ভীরস্বরে নবীন ডাক্তার ডাকিল, “শ্যাটান্, শ্যাটান্, শ্যাটান্!”

তখনই গৰ্জ্জন করিতে করিতে এক প্রকাণ্ড ব্যাঘ্রবৎ শিকারী কুকুর নবীন ডাক্তারের নিকটস্থ হইল। নবীন ডাক্তার তথায় সেই কুকুরটাকে ছাড়িয়া দিয়া জুমেলিয়াকে লইয়া, বাটীমধ্যে প্রবেশ করিয়া দ্বাররুদ্ধ করিয়া দিল।

.

দেবেন্দ্রবিজয় মনে মনে বলিলেন, “তোমাদের যা’ ইচ্ছা তাই কর—যত সাবধান হ’তে পার—হও, আজ দেবেন্দ্র যে কোন প্রকারে পারে, আনন্দ-কুটীরে প্রবেশলাভ করিবেই। তোমাদের কুকুরকে সে ভয় করে সে বাড়িতে ফিরে যাবে না। সে আজ স্বকার্য্য সাধনের জন্য তোমাদের কোন বিঘ্ন-ব্যাঘাত গ্রাহ্যই করবে না।“

এখন তাঁহার পত্নী ও মনোরমা শত্রুকবলে; দেবেন্দ্রবিজয় কি আর নিশ্চেষ্ট থাকিতে পারেন? হয় ত একঘণ্টার মধ্যে দুইটি নারীহত্যা সমাধা হইবে। শীঘ্র ও সাবধানে এখন কাজ করিতে হইবে, নতুবা বিপদুদ্ধারের অন্য উপায় নাই। এখন তাহাকে সে ভয়ঙ্কর কুকুরের হাত এড়াইয়া যাইতে হইবে; অথচ বিনা গোলযোগে—নিঃশব্দে।

পাঠক! ইহা বড় সহজ ব্যাপার নহে। দেবেন্দ্রবিজয়ের স্থানে আপনি আসুন; মনে করুন, আপনি এইরূপ অবস্থায় পড়িয়াছেন—গভীররাত্রে গাঢ় অন্ধকারে আপনি গোপনে যে বাড়িতে প্রবেশ করিতে যাইতেছেন, তাহা ব্যাঘ্রের ন্যায় একটা প্রকাণ্ড কুকুরের দ্বারা পরিরক্ষিত হইতেছে; অথচ আপনাকে সংগোপনে বাটীমধ্যে প্রবেশ করিতেই হইবে; তাহা হইলে আপনি দেবেন্দ্রবিজয়ের উপস্থিত সঙ্কটাবস্থা বিশেষরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিবেন।

তখন চিন্তা করিবার, নিশ্চেষ্ট থাকিবার, বৃথা বাক্যব্যয় করিবার মুহূর্ত্তমাত্র সময় নাই। যদি তিনি তাঁহার পত্নীকে ও সেই শরণাগতা মনোরমাকে তাহাদের আসন্ন বিপদ হইতে, মৃত্যুমুখ হইতে উদ্ধার করিতে চাহেন, অবিলম্বে তাঁহাকে অগ্রসর হইতে হইবে। কি করিবেন? ধীরপদবিক্ষেপে তিনি অগ্রসর হইতে লাগিলেন।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – সাক্ষাতে

সন্তর্পণে, অতি ধীরে ধীরে পদ সঞ্চালন করিয়া দেবেন্দ্রবিজয় অতি সতর্কে অগ্রসর হইয়া চলিলেন। প্রতি পদক্ষেপে তাঁহার মনে হইতে লাগিল, সেই ভয়ঙ্কর রক্তলোলুপ কুকুর তাঁহাকে এখনই আক্রমণ করিবে। তিনি অনেকদূর গেলেন, কোন শব্দ তাঁহার শ্রুতিগোচর হইল না। অনেকক্ষণ পরে অতি নিকটে—সম্মুখে সেই কুকুরের গোঁ গোঁ শব্দ শুনিতে পাইলেন।

এতক্ষণ যে শঙ্কা করিতেছিলেন, সেই শঙ্কা উপস্থিত। তিনি সেই দুর্ভেদ্য অন্ধকারের মধ্য দিয়া অতি অস্পষ্টভাবে দেখিতে পাইলেন, সেই প্রকাণ্ড কুকুর লাফাইতে লাফাইতে তাঁহার সমীপবৰ্ত্তী হইতেছে। দেবেন্দ্রবিজয়ের হাতে তখন কোন অস্ত্র ছিল না, যাহাতে তিনি তখন নিজের পরিত্রাণের কোন আশা করিতে পারেন। অস্ত্র বাহির করিবার সময়ও নাই। তিনি কিছুমাত্র ভাবিলেন না। ভাবিবার সময়ই বা কোথায়? ক্রমে সেই প্রকাণ্ড কুকুরের প্রকাণ্ড দেহ দেবেন্দ্রবিজয়ের পায়ের উপর আসিয়া পড়িল।

শ্যাটান্ যথার্থই সয়তান বটে!

যাহা অদৃষ্টে আছে ঘটিবে, এইরূপ বিবেচনায় দেবেন্দ্রবিজয় দুই বাহুতে সেই কুকুরের গলা সজোরে চাপিয়া ধরিলেন। দেবেন্দ্রবিজয় যদি তেমন ক্ষমতাশালী না হইতেন, তাহা হইলে এতক্ষণে তিনি সেই কুকুরের সুতীক্ষ্ণ দন্তনখরে ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ হইয়া মৃত্যুমুখে নিপতিত হইতেন; কিন্তু দেবেন্দ্রবিজয়ের শরীরে অসীম বল, সে বলের নিকটে সামান্য একটা কুকুর! তিনি এরূপ সজোরে দুই হাতে সেই কুকুরটার গলা টিপিয়া ধরিয়াছিলেন, তাহাতে কুকুরের গর্জ্জন করিবার শক্তি ছিল না; এমন কি গোঁ গোঁ শব্দমাত্রও করিতে পারিল না। দংশন করিতে যাইল—পারিল না; সেই গুরুপেষণে শ্যাটানের চোয়াল দু’খানা তখন দুফাঁক হইয়া গিয়াছিল। শ্যাটান্ তথাপি জোর করিতে লাগিল। সে যেদিকে যায়, দেবেন্দ্রবিজয় সেটাকে সেইরূপ অবস্থায় রাখিয়া সেইদিকেই সঙ্গে সঙ্গে যান। এইরূপে কিছুক্ষণ কাটিল। প্রথমেই শ্যাটানের শ্বাসরুদ্ধ হইল; ক্রমে সেটা জখম ও দুৰ্ব্বল হইয়া পড়িল; তথাপি দেবেন্দ্রবিজয় সেটাকে ছাড়িলেন না, গলাটা আরও জোরে জোরে চাপিতে লাগিলেন। পরে যখন বুঝিলেন, তিনি কৃতকাৰ্য্য হইয়াছেন, তখন বস্ত্রাভ্যন্তর হইতে একখানি শাণিত ছুরিকা বাহির করিলেন; সেই ছুরিকায় তিনি শ্যাটানের উদর দ্বিধা চিরিয়া ফেলিলেন। এইরূপে শ্যাটান্ মরিল।

******

দেবেন্দ্রবিজয় কুকুরটাকে টানিয়া, একটা নৰ্দ্দমার মধ্যে ফিলিয়া দিয়া আস্তাবলের দিকে অগ্রসর হইলেন; তথায় যে গৃহে শচীন্দ্র থাকিত, তাহা তিনি জানিতেন; সেই গৃহদ্বারে সঙ্কেতানুসারে শব্দ করায় তখনই দ্বার উন্মুক্ত হইল। দেবেন্দ্রবিজয় সেই অন্ধকারময় গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন, হাতলণ্ঠন বাহির করিয়া আবরণ উন্মোচন করিয়া দিলেন। তৎক্ষণাৎ তীক্ষ্ণ রশ্মিমালা নির্গত হইয়া গৃহমধ্যস্থিত ঘনীভূত অন্ধকার দূরীভূত করিল। সেই উজ্জ্বল আলোকে উভয়ে উভয়কে চিনিতে পারিলেন।

শচীন্দ্র বলিল, “আপনি কি ক’রে এলেন? শ্যাটানের হাত থেকে আপনি কি ক’রে অব্যাহতি পেলেন?”

দেবেন্দ্রবিজয় বলিলেন, “ সেটাকে একেবারে শেষ করে এসেছি।”

(সাশ্চয্যে) “বলেন কি!”

“হাঁ, শ্যাটান্ মরেছে।”

“আপনাকে কামড়ায় নি?”

“না, আমার গায়ে একটা আঁচড়ও বসাতে পারে নি।”

“আপনি কতক্ষণ এখানে এসেছেন? আমার এখানে আর একবার এসেছিলেন কি? আমি এতক্ষণ বাড়ির ভিতরে ছিলাম, এইমাত্র এসে দরজা বন্ধ করেছি, আপনি এসে ডাকলেন।”

“বাড়ির ভিতরে এখন কত লোক আছে?”

“সাত জন।”

“কে তা’রা? তুমি কি তাদের চেন?”

“নবীন ডাক্তার, জুমেলিয়া আর কুমুদিনী; কে যে জুমেলিয়া, কে যে কুমুদিনী— চেনা দায় তারা দুজনে ঠিক এক রকম দেখতে।”

“তাদের দু’জনকে তুমি স্বচক্ষে দেখেছ?”

“স্বচক্ষে।”

“একজনের নাম জুমেলিয়া। জুমেলিয়ার কথা মনে পড়ে কি?”

“মনে? না।”

“যখন ফুলসাহেব গ্রেপ্তার হয়, তখন এই জুমেলিয়াই একদিন আমাকে বড়ই বিপদগ্রস্ত করেছিল—সে বড় সহজ স্ত্রীলোক নয়।“

“এখন যাতে সহজে সেই শত্রুকে আমরা সহজ করতে পারি, সে চেষ্টা দেখব।”

“তাই চাই—তুমি তিনজনের নাম করলে; সাতজনের আর চারজন কে?”

“দু’জন চাকর, দু’জন ঝি।”

“তারা কি আমাদের কাজের কোন বিঘ্ন ঘটাতে পারে?”

“দুজন চাকর আর একটা ঝি তাদের বড় অনুগত—তা’রা পারে।”

“শচীন্দ্র, তা’রা আরও দু’জনকে এখানে বন্দী করে রেখেছে, সে সন্ধান কিছু রাখ?”

“না, আর দু’জন কে?”

(বিরক্তিভাবে) “কোথায় তোমার চোখ দুটা ছিল?”

“কুমুদিনী আমাকে আজ ভোরে কলকাতায় পাঠায়—আমি এখানে ছিলাম না। বোধ হয়, তারা তখন তাদের বন্দী দু’জনকে এখানে এনে থাকবে। কে তা’রা?”

“তোমার মামী আর মনোরমা।”

(সবিস্ময়ে) “অ্যা! বলেন কি! ভেঙে বলুন, ব্যাপার কি?” .

“সে সময় এখন নয়; শিবুর সঙ্গে দেখা হয়েছে?”

“শিবু? কই না।”

“ওঃ! তবে শিবুও কয়েদে পড়েছে; আমি যে তাকে তোমার সঙ্গে দেখা করতে পাঠিয়েছিলেম।”

“কই, আমি ত তাকে এখানে দেখি নি—আমার সঙ্গে তার দে’খা হয় নি।”

“নবীন ডাক্তার আর জুমেলিয়া এইমাত্র এখানে এসেছে কি?”

“হাঁ, এই কতক্ষণ তারা ফিরেছে।”

“আমি তা’ জানি। আমি তাদের অনুসরণ ক’রেই এখানে এসেছি, তা’রা আজ সেই দু’জন বন্দীকে হত্যা করতে মনস্থ করেছে।”

“মামী-মাকে? মনোরমাকে? বলেন কি!”

“এস, এখন। যদি তাদের অভীষ্ট ব্যর্থ করতে চাও, আর বিলম্ব ক’রো না।”

“বসুন, ব্যস্ত হবেন না, তারা এখন একঘণ্টা কিছু করবে না।”

“তুমি কি ক’রে জানলে? “

“আমি জানি, তাদের ভাব আমার বেশ জানা আছে।”

‘কোথায় তারা তাদের কয়েদ ক’রে রেখেছে, অনুমানে কিছু ঠিক করে বলতে পার?”

“খুব সম্ভব, বাড়ির নৈঋতকোণে—গুপ্তভাবে লোককে বন্দী ক’রে রাখবার মত একটা ঘর সেখানে আছে।”

“তুমি কি সেখানে যাবার পথ জান? এখন কেমন ক’রে সেখানে যাওয়া যায় বল দেখি?”

 “একটামাত্র পথ আছে—এই বাড়ির ভিতর দিয়েই সে পথ; যে ঘরে এখন সকলে জটলা ক’রে ব’সেছে, সেই ঘর দিয়েই যেতে হবে।”

“তাহলে এখন আমাদিগকে অপেক্ষা ক’রে থাকতে হয়। ইতিমধ্যে তুমি কোন বিষয়ের কোনরকম সন্ধান পেয়েছ কি?”

“কিছু কিছু—বড় বেশি কিছু করে উঠতে পারি নি।”

“নবীন ডাক্তার লোকটা কে?”

“হয় জুমেলিয়ার, নয় কুমুদিনীর স্বামী।”

“তবে কুমুদিনীর মৃত্যু মিথ্যা কল্পনা?”

“বোধ হয়, নবীন ডাক্তার কুমুদিনীকেই বিবাহ ক’রে থাকবে।”

“বোধ হয় কে’ন—তাই ঠিক; কিন্তু সে জুমেলিয়াকে ভালবাসে। জুমেলিয়াই এখন এই সকল ঘটনার মূল।”

“কুমুদিনী নিতান্ত ভাল মানুষ; এমন কি তেমন বোকা মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি; কিন্তু তারও সময় ফুরিয়ে এসেছে।”

“কেন এ কথা বলছ? কারণ কি?”

“কারণ জুমেলিয়া; জুমেলিয়া আর নবীন ডাক্তার সে আপদ শীঘ্রই দূর ক’রে নিজেদের পথ পরিষ্কার করবে। বোধ হয়, আজ রাত্রেই তা’রা তা’কে—”

“নিশ্চয়ই।”

“যদি না আজ আমরা এখানে উপস্থিত থাকতেম, নিশ্চয়ই আজ তাদের এই হত্যা-উৎসব নিৰ্ব্বিঘ্নে সমাধা হ’ত।”

“শচীন্দ্র, এখানে আমরা ত উপস্থিত আছি।”

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – উদ্যানমধ্যে

শচীন্দ্রের কানের নিকটে মুখ লইয়া দেবেন্দ্রবিজয় অতি মৃদুস্বরে বলিলেন, “শোন শচীন্দ্র।” তাহার পর কিছুক্ষণ স্থিরকর্ণে উভয়েই নীরব। তখনই বিদ্যুদগতিতে দেবেন্দ্রবিজয় গৃহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া বাহিরের নিবিড় তিমিরে নিমগ্ন হইলেন।

তখন কোন ব্যক্তির পদধ্বনি দেবেন্দ্রবিজয়ের শ্রুতিগোচর হইয়াছিল। কার পদধ্বনি, তিনি অনুমানে ঠিক বুঝিতে পারিয়াছিলেন। যেদিক হইতে সেই শব্দ আসিয়াছিল, সেইদিকে কিছুদূর অগ্রসর হইয়া এক প্রকাণ্ড আম্রবৃক্ষমূলপার্শ্বে লুকাইয়া রহিলেন। তিনি যেখানে লুক্কায়িত রহিলেন, তাহারই চারি-পাঁচ হাত ব্যবধানে অনেকটা স্থান আনন্দ-কুটীরের দ্বিতল কক্ষস্থ দীপালোক উন্মুক্ত বাতায়ন অতিক্রম করিয়া আলোকিত রাখিয়াছিল; তাহাতে তিনি পদশব্দকারীকে দেখিয়া সহজেই চিনিতে পারিবেন ভাবিয়া তথা হইতে আর অগ্রসর হইলেন না।

তখনই সেই স্থান দিয়া দুই ব্যক্তি দ্রুতপদে আনন্দ-কুটীরাভিমুখে চলিয়া গে’ল। দেবেন্দ্রবিজয় সেই দুই ব্যক্তিকে চিনিতে পারিলেন। পাঠক! আপনি চিনিলেন কি? ইহারা আপনার পরিচিত সেই উকিল তুলসীদাস ও কবিরাজ গোবিন্দপ্রসাদ। তাহারা উভয়েই ছদ্মবেশে। সেই ছদ্মবেশের পারিপাট্য কিছুই নাই, যে ব্যক্তি তাহাদিগকে পূর্ব্বে দেখিয়াছে, সে অক্লেশেই এক্ষণে চিনিতে পারে। তাহারা বৃথা সময় নষ্ট করে নাই, যথাসময়ে এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে; চেলার ঘাট পার হইয়া এখানে পৌঁছিতে যে সময় আবশ্যক করে, তাহাদের তাহাই ব্যয় হইয়াছে।

দেবেন্দ্রবিজয় মনে করিলেন, সাতজনের স্থলে নয়জন হইল; নয়জনের মধ্যে তিনজন বড় ভয়ানক গোঁয়ার-গোবিন্দ। তখন তিনি শচীন্দ্রের গৃহাভিমুখে আবার ফিরিলেন; কিছুদূরে গিয়াছেন, এমন সময়ে পুনশ্চ কাহার পদশব্দ শুনিতে পাইলেন। সে শব্দ নিতান্ত মৃদু—অনুচ্চ। শব্দ শুনিয়া স্থির হইয়া দাঁড়াইলেন। সেই শব্দ স্পষ্ট শুনিবার জন্যই স্থিরকর্ণে রহিলেন।

কিন্তু কই, সে শব্দ পুনরুত্থিত হইল না। দুই-তিন-মিনিট তিনি তথায় অপেক্ষা করিলেন; কোন শব্দ শুনিতে না পাইয়া আবার চলিতে লাগিলেন।

আবার! আবার সেই শব্দ! আবার তিনি সেই অনুচ্চ অতিমৃদু পদধ্বনি শুনিতে পাইলেন। সে ধ্বনি নিতান্ত অস্ফুট হইলেও তাহা তাঁহার নিকটে অধিকতর পরিস্ফুট বলিয়া বোধ হইল। তিনি তখনই বুঝিতে পারিলেন যে, কেহ তাঁহার অনুসরণ করিতেছে। অনুসরণকারী কে? যেই হ’ক, অন্ধকারে বিপদ ঘটাইতে পারে।

দেবেন্দ্রবিজয় আবার চলিতে আরম্ভ করিলেন; আবার পশ্চাতে সেই শব্দ; থামিলেন না, – শব্দও থামিল না। তিনি নিজের গতি ধীর করিলেন, শব্দ, পূর্ব্বাপেক্ষা কিছু নিকটবর্ত্তী হইল। তখন তিনি ফিরিলেন; যেদিক হইতে শব্দ আসিতেছিল, সেইদিকে তিনি সবেগে ছুটিলেন। শব্দকারী ধৃত হইল; পলায়ন করিবার নিমিত্ত প্রয়াস পাইল—পারিল না। দেবেন্দ্রবিজয় অনুভবে বুঝিলেন, তাঁহার ধৃত ব্যক্তি একটি বালকমাত্র। সহসা শ্রীশচন্দ্রের কথা তাঁহার মনে পড়িল। তিনি তাহাকে তুলসীদাস ও গোবিন্দপ্রসাদের অনুসরণ করিতে বলিয়াছিলেন। ঘোর অন্ধকার; তিনি ধৃত বালককে দেখিতে পাইলেন না; সুতরাং ছাড়িলেন না। সজোরে, যাহাতে সে পলায়ন করিতে না পারে, এমন দৃঢ়মুষ্টিতে তাহার হস্তদ্বয় ধরিয়া জিজ্ঞাসিলেন, “শ্রীশ, তুমি?”

এমনি মৃদুস্বরে উত্তর হইল, “হাঁ, আমি শ্রীশ।”

“এস—আমার সঙ্গে এস।”

“আপনি যেরূপে আমার গলা টিপে ধরেছিলেন, আর খানিক তেমন ভাবে থাকলে আমি অক্কা পেতুম।”

“সে কথা এখন থাক, এস তুমি।”

******

শ্রীশকে সঙ্গে লইয়া দেবেন্দ্রবিজয় শচীন্দ্রের নিকটে উপস্থিত হইলেন। শ্রীশকে দেখিয়া শচীন্দ্ৰ বিস্ময়াভিভূত হইল। দেবেন্দ্রবিজয় তদুভয়কে পরস্পরের পরিচয় করিয়া দিলেন। তৎপর শ্রীশকে জিজ্ঞাসিলেন, “শ্রীশ, কি ক’রে তুমি এখানে এলে?”

শ্রী। কেন আপনি যেমন ব’লে দিয়েছিলেন, তেমনি ভাবে লোক দু’টার পিছনে পিছনে এসেছি।

দে। কোথায় তাদের দেখা পেলে?

শ্রী। পথেই তাদের দেখতে পাই।

দে। কি ক’রে গঙ্গা পার হলে?

শ্রী। নৌকায়। তা’দিগে পথে দেখতে পেয়ে আমি অন্য পথ দিয়ে ছুটে তাদের আগে সেই পার হবার ঘাটে পৌঁছাই। সেখানে কেবল একখানা নৌকা ছিল; বুঝলুম, তারা সেই নৌকাখানাতেই পার হবে; দাঁড়ি-মাঝিরা নৌকার ওপাশে ব’সে গল্প করছিল, মাঝে নৌকার ঘর আড়াল ছিল, তারা আমাকে দেখতে পেলে না, আমি তখন চুপিসারে নৌকায় উঠে দাঁড়িদের বসবার জন্যে তক্তার যে পাড়ন ছিল, সেই পাড়নের নীচে লুকিয়ে থাকলুম; তার পর তারা এসে জুটল; আগেই ভাড়ার পয়সা ফেলে দিল; নৌকাও ওপারের দিকে চলল।

দে। খুব সাহস তোমার! তাদের নৌকায় তাদেরই সঙ্গে পার হ’য়ে এসেছ—জোর কপাল, তারা তোমাকে দেখতে পায় নি। যদি তোমাকে তারা দেখতে পেত, তা হ’লে তোমার কি দশা ঘটত, বুঝতে পেরেছ?

শ্রী। মাঝগঙ্গায় নিয়ে চুবিয়ে মারত।

দে। শুধু চুবিয়ে মারত না, আগে তাদের ছুরি তোমার বুকের রক্তে চুবিয়ে তারপর তোমাকে গঙ্গার জলে ডুবিয়ে মারত। যাই হ’ক, ভালই হয়েছে; কিন্তু শ্রীশ, তুমি ত আমার কথামত কাজ কর নি—আমার আদেশ ত ঠিক মত পালন কর নি।

শ্রী। আমি বুঝলুম, ফিরে যাওয়া মিথ্যা; আপনার সঙ্গে দেখা হবে না—আপনি তখন চ’লে গেছেন।

দে। কি ক’রে বুঝলে?

শ্রী। ঐ উকিল আর কবিরাজের কথার ভাবে। তারা বলাবলি করছিল, তাদের আর দুজন আলিপুরের পথ দিয়ে গেছে। তাতেই বুঝলুম, আপনি নিশ্চয়ই তাদের সঙ্গ নিয়েছেন—তখন আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের সম্ভাবনা নাই; তাই আমি ফিরলেম না, এদের সঙ্গে থাকা তখন ভাল বুঝে এদের সঙ্গেই এখানে এসেছি।

দে। ঠিক, এই ত চাই, খুব সাহসী ছোকরা তুমি।

শ্রী। আমি কারও তোয়াক্কা রাখি না-কারেও ভয় ক’রে চলি না।

দে। শ্রীশ, আজ রাত্রে আমাদিগকে এখানে একটা বড় ভয়ঙ্কর কাজে নামতে হবে।

শ্রী। তার মধ্যে আমি আছি কি? আমি কোন কাজে আসতে পারি কি?

দে। তা’ আমি জানি না—তোমার কাছে কোন অস্ত্র আছে?

শ্রী। না, একখানা চাকুছুরি আছে।

দে। থাক্, এই রিভলভারটাও কাছে রাখ।

শ্রী। আপনার কাছে আর আছে?

দে। আছে। (শচীন্দ্রের প্রতি) এস শচীন্দ্র।

শচী। একটু অপেক্ষা করুন, এখনও সময় আছে।

দে। তা’ থাকতে পারে; কিন্তু আর অপেক্ষা ক’রে থাকা যায় না। এরূপ মিথ্যা কাজে সময় নষ্ট করা অপেক্ষা একাকীই দশ-বারজন শত্রুর সম্মুখীন হওয়া আমি ভাল বিবেচনা করি। তুমি বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করবার পথ জান?

শচী। জানি।

দে। বাড়ির মধ্যে যেতে পারলে সহজেই নৈঋতকোণে যেতে পারবে কি? তুমি আমাদের গোপনে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যেতে পারবে? কার্য্যোদ্ধারের পূর্ব্বে কোন গোলযোগ ঘটবে না ত?

শ। যে পথে আমরা বাড়ির ভিতরে যাব, সেদিকে সে আশঙ্কা নাই।

দে। বেশ, তোমার পায়ের জুতাজোড়া খুলে ফে’ল। (শ্রীশচন্দ্রের প্রতি) শ্রীশ, তোমার জুতাজোড়া এখন খুলে ঘরের ঐ দিককার কোণে রেখে দাও। (শচীন্দ্রের প্রতি) তোমার কাছে যে আমি কয়েকটা পরচুল দিয়েছিলেম, সে সব এখানে আছে কি?

শচীন্দ্র কতকগুলি পরচুল বাহির করিল। দেবেন্দ্রবিজয় সে সকলের মধ্য হইতে আবশ্যকমত দুই-তিনটি বাছিয়া লইলেন। বলিলেন, “খুব সাবধান, যে’ন কোন শব্দ না হয়, যতক্ষণ কার্যোদ্ধার না হয়, ততক্ষণ খুব সাবধানে থাকবে, এমন কি নিঃশ্বাসও যেন জোরে জোরে না পড়ে। পাঁচজন ভয়ানক লোক এখানে আজ এক স্থানে জুটেছে। এমন কি সেই পাঁচজনের যে কোন লোক, যদি সুবিধা পায়, আমাদিগকে খুন করতে ইতস্তত করবে না। তাদের মধ্যে একজন স্ত্রীলোক, আর চারজন একদিকে—সে স্ত্রীলোক একা একদিকে, এ অপেক্ষাও তাকে বেশি ভয়; তা’র কার্য্যে— তা’র সাহসে—তা’র নির্ভীকতায়—তা’র পরাক্রমে—তা’র জঘন্যতায় সে মানবী না, দানবী। শচীন্দ্র, এখন আমাদের প্রাণের মমতা রেখে কাজ করলে চলবে না। প্রাণের আশা ছেড়ে দিয়ে সেই জুমেলিয়ার সঙ্গে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। প্রস্তুত আছ? আর তুমি শ্রীশ?”

উভয়ে মাথা নাড়িয়া সম্মতি জ্ঞাপন করিল। তখন দেবেন্দ্রবিজয় তাড়াতাড়ি পুলিসের কৃষ্ণবর্ণ পোষাক পরিধান করিলেন। অনন্তর দুই হাতে তাহাদের হাত ধরিয়া বলিলেন, “এস তবে—আর এখানে এক মিনিট চুপ ক’রে থাকা চলবে না।”

শচীন্দ্র, দেবেন্দ্রবিজয় ও শ্রীশচন্দ্রকে সঙ্গে লইয়া, নিবিড় নৈশান্ধকার ভেদ করিয়া অগ্রসর হইয়া চলিল। অগৌণে তাঁহারা সেই নিবিড়ান্ধ কারাচ্ছন্ন আনন্দ-কুটীরের পশ্চাদ্ভাগে উপস্থিত হইলেন; তথায় অট্টালিকার ভিত্তিগাত্রে শ্রেণিবদ্ধ বহুসংখ্যক গবাক্ষ। শচীন্দ্র সেই সকলের মধ্যে একটি গবাক্ষের সকল গরাদা বিনায়াসে খুলিয়া ফেলিল।

দেবেন্দ্রবিজয় অত্যস্ফুটস্বরে জিজ্ঞাসিলেন, “শচীন্দ্র, ব্যাপার কি?”

শচীন্দ্র সেইরূপ নিম্নকণ্ঠে বলিল, “সময়ে প্রয়োজন হবে মনে করে আমি এই জানালার গরাদা কয়েকটা খুলে, মানানের উপর কিছু ছোট করে কেটে আবার সাজিয়ে রেখেছিলেম।” আর কোন কথা না কহিয়া সকলে তন্মধ্য দিয়া বাটীমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ – মন্ত্রণা-গৃহে

অগ্রে শচীন্দ্র—তৎপশ্চাতে শ্রীশচন্দ্র, তৎপশ্চাদ্বর্ত্তী হইয়া দেবেন্দ্রবিজয় চলিলেন। শচীন্দ্ৰ ইতিমধ্যে কোন্ কোন্ কক্ষে কোন্ কোন্ পথ দিয়া যাইতে হয়, সে সন্ধান সাধ্যমত রাখিয়াছিল। তাঁহারা বাতায়ন দিয়া যে ঘরে পড়িলেন—সেটি ভাঁড়ার ঘর; তন্মধ্যে অনেক নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী রহিয়াছে। সেইটির পার্শ্বেই একটি কক্ষ শূন্য পড়িয়া আছে। ভাঁড়ার ঘর হইতে তাঁহারা সেই শূন্যকক্ষে প্রবেশ করিলেন। সেই শূন্যকক্ষ অতিক্রম করিয়া তাঁহারা যে স্থানে উপস্থিত হইলেন—সেটি রন্ধনশালা। রন্ধনশালার সম্মুখে এক প্রকাণ্ড দালান। দালানের উত্তর পার্শ্বে আর একটি শূন্যকক্ষ। তাঁহারা সেই দালান হইতে দেখিতে পাইলেন, তন্নিকটবর্ত্তী কোন আলোকিত কক্ষের আলোকরশ্মি সেই শূন্যকক্ষে প্রবিষ্ট হইয়া তাহা ঈষদালোকিত করিয়াছে। তাহা হইতে তাঁহারা জুমেলিয়ার সেই সুতরল সাংঘাতিক কলহাস্যধ্বনি সুস্পষ্ট শুনিতে পাইলেন।

দেবেন্দ্রবিজয় তখন আর পশ্চাদ্ভাগে না থাকিয়া শচীন্দ্রের সম্মুখে আসিলেন। তিনি তাহাদিগকে অপেক্ষা করিতে বলিয়া একাকী অগ্রসর হইলেন। পদাগ্রের উপর দেহভার বহন করিয়া অতি নিঃশব্দে দেবেন্দ্রবিজয় সেই ঈষদালোকিত শূন্যকক্ষ অতিক্রম করিলেন। তাহার পর আর একটি দালান, সেই দালানের দক্ষিণপার্শ্বে একটি কক্ষে দীপ জ্বলিতেছে। সেই অল্প-আলোকিত কক্ষের দালানের সম্মুখস্থ দ্বার ঈষন্মাত্র উন্মুক্ত আছে। দেবেন্দ্রবিজয় বুঝিলেন, তথায় আজ তাঁহার বিপক্ষপক্ষের ক্ষুদ্র রকমের একটি সভা বসিয়াছে। সে সভার কার্য্য বড় ভয়ঙ্কর—তাঁহারই বিপক্ষে কূট-মন্ত্ৰণা চলিতেছে।

দেবেন্দ্রবিজয় সেই অর্দ্ধোন্মুক্ত কবাটের পাশ দিয়া দেখিলেন, সেই ক্ষুদ্র সভার সম্মুখভাবে দুইটি রমণী উপবিষ্টা; তাঁহার তখন বোধ হইল, যেন তাঁহার নয়ন সম্মুখে দুইটি মনোরমা রহিয়াছে। সেই স্ত্রীলোক দুটি আকৃতিতে একই প্রকার—কিঞ্চিন্মাত্র পার্থক্য নাই। তাহাদিগের পার্শ্বস্থিত ব্যক্তিও তদুভয়ের কি দেহের, কি সৌন্দর্য্যের কিছুমাত্র ভিন্নতা নিরূপণ করিতে পারিবে না। কিছুই প্রভেদ নাই; ইহারও যেমন সুচঞ্চল দৃষ্টি—উহারও তদনুরূপ। এমন কি তাহাদিগের কণ্ঠস্বরও যেন একই রকম—ঠিক সেই মনোরমার মত। তাহাদিগের পরিহিত বসনালঙ্কার একই প্রকার। উভয়ের পরিধানে মুক্তাখচিত নীলরঙ্গের রেশমী সাড়ী; যিনি নৈশনিসর্গসুন্দরীর নক্ষত্রদামখচিত, নিৰ্ম্মেঘ নিৰ্ম্মলাকাশ দেখিয়াছেন, তিনি প্রাগুক্ত রমণী দুটির পরিহিত সাড়ীর মনোহারিত্ব উপলব্ধি করিতে সক্ষম হইবেন। উন্নতবক্ষে সবুজ সাটীনের কাঁচলী, নানাকারুকার্য্যবিশিষ্ট বহুমূল্য হরিদ্বর্ণের সূক্ষ্ম ওড়নার মধ্য দিয়া স্পষ্ট প্রকটিত হইতেছে; কর্ণে হীরকখচিত, বিদ্যুজ্জ্যোতিবিশিষ্ট কর্ণাভরণ, কর্ণপার্শ্ববর্তী বিরল কৃষ্ণালকদাম মধ্যে, দীপালোক পাইয়া জ্বলিতেছে, অল্প দুলিতেছে। কণ্ঠে সুগোল নিৰ্ম্মল বৃহন্মুক্তার একছড়া মালা কটিদেশ অবধি লম্বিত। প্রকোষ্ঠে হীরককঙ্কণবিদ্যুদ্বিভা বিকাশ করিতেছে। একে সুন্দরী—তাহার উপর আবার এই সুন্দর সজ্জা। সেদিকে চাহিতে সহসা কাহারও সাহস হয় না—পাছে সেই অসীম রূপের আলোকে চক্ষু ঝলসিয়া যায়! ইহাই বুঝি রূপের মোহকরী মনোহরতা! সেই জগচ্চাঞ্চল্যবিধায়িনী রমণীযুগলের কাঞ্চনকান্তির অত্যুজ্জ্বল প্রদীপ্তিতে দীপালোক যেন নিষ্প্রভ হইয়া পড়িয়াছে। নধর অধরপ্রান্তে কমলদলপ্রান্তে নিশির শিশির বিন্দুটির মত হাসিটি উছলিয়া পড়িয়া সত্যই নৈসর্গিক বিধুহাস্য বিকাশ করিতেছে। তার কাছে দীপালোক? কিছুই নহে!

এই দুইটি নবীনা সুন্দরীর একটির নাম জুমেলিয়া, অন্যটির নাম কুমুদিনী। কে কুমুদিনী, কে জুমেলিয়া তাহা আমরা আপাতত প্রিয় পাঠক মহাশয়দিগকে চিনাইয়া দিতে অক্ষম।

এই দুইটি যুবতী ব্যতীত তথায় আরও তিনজন পুরুষ উপস্থিত। কিছুক্ষণ পূৰ্ব্বে যে ব্যক্তিত্রয়ের সহিত দেবেন্দ্রবিজয়ের ক্ষুদ্র দাঙ্গা ঘটে——তাহারা। দেবেন্দ্রবিজয় তাহাদিগের পরামর্শ শুনিবার অভিপ্রায়ে সেই অর্দ্ধোন্মুক্ত দ্বার-সন্নিধানে দাঁড়াইলেন। প্রথমেই নবীন ডাক্তারের কণ্ঠস্বর তাঁহার শ্রুতিগোচর হইল। যাহা শুনিলেন, তাহা একটি বাক্যের শেষাংশ মাত্র।

“ঘটতে পারে—আমি বলছি, আমার কথা মেনে নাও। “

সেই রমণী দুটির একটি বলিল, “মাইরি সখা, প্রাণসখা আমার, বললে কি? বাঃ!”

দেবেন্দ্রবিজয় তাহার কথার ভাবে, তাহার হাসির ভাবে বুঝিতে পারিলেন সে আর কেহই নহে—সেই জুমেলিয়া। জুমেলিয়া বলিল, “বিপদ! কিসে তুমি বুঝলে, এতে বিপদের সম্ভাবনা?“

নবীন। দেবেন্দ্রবিজয় এখনও জীবিত আছে।

জুমে। তুমি কি মনে কর, সে এখান পর্য্যন্ত সন্ধান নিয়ে থাকবে?

নবী। মনে করা কি? নিশ্চয়ই

জু। কিসে তুমি এমন অনুমান করছ?

ন। সে ত আপাতত আমার অনুমানের একটা ফল দেখিয়েছে।

জু। তার চাকরকে এখানে পাঠিয়ে দিয়ে, কেমন কিনা?

ন। হাঁ।

জু। কি হয়েছে তা?

ন। যা’ হয়েছে—তাই যথেষ্ট।

জু। বাঃ! এ ত অনুমান মাত্র।

ন। হাঁ, স্বীকার করি—অনুমান; কিন্তু আমরা যে প্রমাণ করে ব’সে আছি।

জু। কিসে?

ন। তার চাকরকে কয়েদ ক’রে।

জু। তা’ ছাড়া তো আর কোন উপায় ছিল না।

ন। কিন্তু সেই উপায়ে এখন আমরা যে নিরুপায় হয়ে পড়ছি।

জু। কেন?

ন। শিবু ত আর ফিরবে না?

জু। না।

ন। তা’ হ’লে দেবেন্দ্রবিজয় সবই বুঝতে পারবে; কোথায় সে আটক আছে— কেন ফিরে এল না, সে সন্ধান না নিয়ে সে ছাড়বে কি?

জু। নাই-ই ছাড়ুক!

ন। যে সন্দেহটুকু ছিল, সেটি যে স্থির-বিশ্বাসে দাঁড়াবে।

জুমেলিয়া হাসিয়া উঠিল—বিভীষিকাপূর্ণ অমঙ্গলময় অট্টহাস্য জুমেলিয়ার বিম্বাধারে নৃত্য করিতে লাগিল।

নবীন জিজ্ঞাসিল, “কেন জুমেলা হাসছ কেন?—হাসলে বড় যে?”

“ছিঃ প্রাণসখা, তুমি এত তরল! এত ভীরু!”

“ভয়ের কাজে ভীরু থাকাই মঙ্গল।”

“প্রাণসখা, তুমি কি জান না, সহজেই আমি ঐ শিবুকে নূতন ছাঁচে গড়তে পারি?”

“সে আবার কিরূপে?”

“এক ফোঁটা ঔষধে। ডাক্তার বাবু, তোমরা কী ঔষধই-বা ব্যবহার কর! আমার একটা ঔষধ তোমাদের শতটা অপেক্ষা তেজস্কর। আমার এক ফোঁটা ঔষধ খাইয়ে স্বচ্ছন্দে তাকে মুক্তি দিব। তাতে হবে কি জান? তাতে তার স্মৃতিশক্তি একেবারে নষ্ট হ’য়ে যাবে; কোথায় সে কয়েদ ছিল—কোথায় কি ঘটেছে—কোথায় কি দেখেছে, তার কিছুই তার মনে থাকবে না; সহস্ৰ চেষ্টাতেও স্মরণ ক’রে কিছু বলতে পারবে না। দেবেন্দ্র গোয়েন্দা তা’ হ’লে তার পত্নীর কোথায় জীবনান্ত হয়েছে, সে সন্ধান কিছুতেই ঠিক ক’রে উঠতে পারবে না।”

“এতে তার আরও সন্দেহ হবে।”

“করুক সে সন্দেহ—ক্ষতি কি?”

“তা হ’লে সে আমাদের অনুসরণ না করে ছাড়বে না।”

“আমরাও তাকে তার স্ত্রীর অনুসরণে না পাঠিয়ে ছাড়ব না।”

“সে নিশ্চয়ই সন্ধান করে এখানে আসবে।”

“তাতে আমাদের লাভই হবে।”

“যদি সে আসে?”

“আসে? কষ্ট ক’রে আর তাকে ফিরে যেতে হবে না।”

“জুমেলিয়া, তুমি রমণীরত্ব!”

“হাঁ, আজও পর্য্যন্ত এ রমণীরত্ন অপরাজেয়!”

“তা’ আমি জানি। কিন্তু এখন কি করবে?”

“আজ রাত্রেই আমি নিজের পথ পরিষ্কার করব। আজ সকল বাধাবিঘ্ন দূর করব,” বলিয়া জুমেলিয়া তীব্রকটাক্ষে নবীনের মুখের দিকে একবার চাহিল। সে কটাক্ষ নিরর্থক নহে—সেই তীব্র কটাক্ষটিতে একটা দারুণ বিভীষিকা লুক্কায়িত ছিল।

সে বিভীষিকা নবীনচন্দ্র সহজে হৃদয়ঙ্গম করিল।

উকিল তুলসীদাস জিজ্ঞাসিল, “জুমেলা, কি প্রকারে তোমার পথ তুমি পরিষ্কার করবে, আমরা সে কথা জানতে পারি না কি?”

প্রশান্তস্বরে জুমেলিয়া উত্তর করিল, “এখনই হ’ক—কি কিছু পরে হ’ক, তারা মরবে!” তুলসী। কি উপায়ে তুমি তাদের দু’জনকে হত্যা করবে?

জু। ঔষধ—ঔষধ—একবিন্দু ঔষধ মাত্র।

তু। কি করে খাওয়াবে?

জু। সহজে—তাদের পানীয় জলের সঙ্গে।

তু। যদি তারা তোমার জল না খায়?

জু। এ অপেক্ষা আরও একটা সহজ উপায় আছে।

তু। কি?

জু। যতক্ষণ না আমি সে কাজ শেষ করতে পারি, ততক্ষণ সে কথায় দরকার কি?

তু। কতক্ষণে তুমি তোমার কাজ শেষ করবে?

জু। একঘণ্টা—একঘণ্টার মধ্যে নিশ্চয় মরবে।

তু। গোবিন্দপ্রসাদ আর আমি কোন সহায়তা করতে পারি কি?

জু। না, এখন থেকেই তোমরা উপরের ঘরে গিয়ে স্বচ্ছন্দচিত্তে তোফা ঘুম লাগাও গে; তার পর যখন ঘুম ভাঙবে—দেখবে জুমেলিয়া কেমন সুন্দরভাবে কাজ শেষ করেছে–

গো। বেশ—সেই-ই ভাল।

জু। নবীন ডাক্তার আর আমি দু’জনে মিলে আজ তোমাদের কাজ শেষ করব।

গো। আমাদের কাজ শেষ করবে—কথাটা কি রকম হ’ল?

জু। হাঁ, তোমাদের।

গো। কথার ভাবে বুঝায়—

জু। (বাধা দিয়া)~~যে, আমি তোমাদেরই নিকেশ করব, কেমন?

গো। হাঁ, কতকটা তাই বটে।

জু। (সহাস্যে) তাই করব—বিশ্বাস হয়?

তু। জুমেলা, আমরা বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, কোন্ কোন্ ঘরে আমরা কে কে শয়ন করব, বলে দাও—আমি আর বসতে পারছি না।

কু। সিঁড়ির সামনে যে ঘরটা, সেই ঘরে তুমি শয়ন করগে—সেই ঘরের পাশের ঘরটা (গোবিন্দপ্রসাদের প্রতি) তুমি নিতে পার।

নবীন। (কুমুদিনীর প্রতি) কুমুদ, আমাদের মন্ত্রণায় তোমার কি মত?

কুমু। জুমেলার মত যা’, আমারও তা’–এতে জিজ্ঞাসার কি আছে? যতদিন মনোরমা মুখপুড়ী না মরে, ততদিন আমার স্বস্তি নাই।

নবীন। বেশ, তুমিও তবে তোমার ঘরে শোও গিয়ে। কাজ শেষ ক’রে আমি তোমাদের সকলের সঙ্গে দেখা করব।

তুলসীদাস, গোবিন্দপ্রসাদ ও কুমদিনী সেই প্রকোষ্ঠ পরিত্যাগ করিল। তাহারা স্ব স্ব নিৰ্দ্দিষ্ট কক্ষে গিয়া শয়ন করিল।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ – উভয়ে

এখন সেখানে নবীনচন্দ্র ও জুমেলিয়া ব্যতীত আর কেহই রহিল না। পার্শ্ববর্ত্তীকক্ষে দেবেন্দ্রবিজয়। তিনি পূর্ব্বের ন্যায় স্থিরকর্ণে তাহাদের কথোপকথন শুনিতে লাগিলেন; এবং গুপ্তভাবে তাহাদের কার্য্যকলাপ দেখিতে লাগিলেন।

কিয়ৎপরে জুমেলিয়া নবীন ডাক্তারকে বসিতে বলিয়া তথা হইতে উঠিয়া গে’ল এবং অনতিবিলম্বে একটি ক্ষুদ্র বাক্স হস্তে ফিরিয়া আসিল।

নবীন ডাক্তার তাহাকে জিজ্ঞাসিল, “জুমেলা, সত্যই কি আজ তোমার সকল কাজ শেষ করবে? তুমি কি আজ সকলকে হত্যা করবে?”

“হাঁ, সকলেকই।”

“কুমুদিনীকেও?”

“কুমুদিনীকেও।”

“সে যে আমার স্ত্রী—তুমি তাকে আমার হাতে দিয়েছ।”

“হাঁ, সে তোমার স্ত্রী—আমিই তাকে তোমার হাতে দিয়েছি।”

“সে কথা কি এখন তুমি ভুলে যাচ্ছ, জুমেলা?”

“না, ভুলি নি। আজ কিন্তু তুমি বিপত্নীক হবে।”

“কেন জুমেলা—সে তোমার–”

(বাধা দিয়া) “আমার কিছুই করে নি—এ আমার ইচ্ছা—সাধ। আমি তাকে দিয়েছি, আমিই তাকে লইব; এর চেয়ে আর কথা কি আছে।”

“এ তোমার কি ভয়ানক সাধ, জুমেলা!“

জুমেলিয়া মৃদু-মধুর হাসি হাসিল। অনিচ্ছায় নবীন ডাক্তারও একটু হাসিল—সে হাসি জুমেলিয়ার মনরক্ষার্থ। জুমেলিয়া বলিল, “আমার সাধে তোমার সাধ নয় তবে?”

নবীন ডাক্তার উত্তর করিল, “এ সাধ ভাল বুঝতেম যদি— “

জু। (বাধা দিয়া) যদি কি?

ন। যদি আমাকে বেশিদিন গৃহশূন্য থাকতে না হয়।

জু। (হাসিয়া) বটে, এমন কথা! বেশ, আমি নিজে তোমার গৃহ আলো করব—তা’ হলে হবে না কি?

ন। হাঁ, জুমেলা, তাই বেশ হবে! তোমার সে প্রতিজ্ঞা স্মরণ আছে?

জু। আছে, যখন সে প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করবার সময় আসবে, যখন তুমি প্রস্তুত থাকবে, তখন আমার অভিপ্রায়ও পূর্ণ হবে।

ন। জুমেলা, যতই আমি তোমার এই সকল অসাধারণ, ভয়ঙ্কর, পৈশাচিক কাৰ্য্যকলাপ দেখছি, ততই আমার হৃদয় তোমাকে হৃদয়ে ধরবার জন্য ব্যাকুল হ’য়ে উঠছে—ততই আমার প্রাণের বাসনা বলবতী হচ্ছে—ততই আমি তোমাতে আসক্ত হচ্ছি।

জু। তুমি! সত্যি? এমন কথা! তবে দেখো, যেন তোমার বাসনা চরিতার্থ করতে ভুলে যেয়ো না।

ন। কে’ন? তা’ ভুলব কেন?

জু। তোমার স্ত্রীর উপরে আজ যে চাল চালব মনে করেছি, সেই চাল যদি তোমার উপরেও আমি চেলে বসি!

ন। ওঃ! সে ভয় আমি করি না।

জু। কে’ন—কে’ন কর না?

ন। যেহেতু তুমি আমাকে প্রাণের সহিত ভালবাস; বিশেষত আমাকে তোমার বিশেষ প্রয়োজনও আছে। আমি না হ’লে তোমার—

জু। (সহাস্যে বাধা দিয়া) ডাক্তার, তাই কি তুমি মনে কর?

ন। হাঁ, কিন্তু একটা বিষয়ে আমি বড় চিন্তিত আছি।

জু। কি?

ন। আজকার রাত কাটলেই কাল সকালে এক জায়গায় পাঁচটা মড়া জড়’ হবে। শিবুকে টেনে নিলে ছয়টা।

জু। হাঁ, নিশ্চয় ছয়টা মড়া।

ন। সে ছয়টা মড়া কি কৌশলে তুমি গোপনে রাখবে? কি করবে?

জু। কিছু না।

ন। কিছুই না?

জু। নিশ্চয়ই—কিছুই না।

ন। কিন্তু জুমেলা—

জু। কী ডাক্তার?

ন। ভেবে দেখ, ব্যাপারটা সহজ নয়—ছয়টা মড়া! রাত্রির মধ্যে ছয়টা মড়া একস্থানে পুঁতে ফেলবার মত গর্ভ কাটে, এমন ক্ষমতা একজন লোকের হতে পারে না। গঙ্গার জলে ভাসিয়ে আসাও একজন লোকের কর্ম্ম নয়। একজন লোকে—

জু। (বাধা দিয়া) একজনের যে সাধ্য নয়, তা’ আমি জানি।

ন। তবে কি করবে?

জু। এইখানেই সব পড়ে থাকবে।

ন। তা’ হ’লে আমাদের উপায় কি?

জু। আমাদের উপায়—এখান থেকে স’রে যাওয়া।

ন। কোথায় যাবে?

জু। একেবারে অন্তর্দ্ধান।

ন। হয় ত আমরা ধরা পড়তে পারি।

জু। তুমি পার—কিন্তু আমি পারি না।

ন। কেন—তুমি যে ধরা পড়বে না, তার কারণ কি?

জু। সকলেই জানবে, আমি ম’রে গেছি—আমার মৃত্যু হয়েছে।

ন। কি ক’রে তা’ হবে?

জু। বোকা তুমি! এটুকু আর বুঝতে পার না? সকলেই জানে কুমুদিনীর অনেকদিন মৃত্যু হয়েছে। আমি যে তাকে লুকিয়ে রেখে, সময়ে নিজের পথ পরিষ্কার করবার জন্য যে আগে থেকেই তার মৃত্যু রটনা ক’রে দিয়েছি—এ কথা কেউ জানে না। তারপর কাল সকালে একই চেহারার কুমুদিনী আর মনোরমার মৃতদেহ সকলে দেখতে পাবে। তা’ হ’লেই সেই দুইটি মৃতদেহের মধ্যে একটি যে আমার, সকলের মনে সেই ধারণা নিশ্চয়ই হবে।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – ভীষণ-প্রক্রিয়া

যখন পাপিষ্ঠ নবীন ডাক্তার, পাপিনী জুমেলিয়ার কথার ভাবার্থ বুঝিতে পারিল, তখন তাহার মস্তিষ্কে কালফণীর সবিষাদংশনের তীব্রজ্বালা অনুভূত হইল। সর্ব্বাঙ্গ বারেক কাঁপিয়া উঠিল; বলিল, “ওঃ! এতক্ষণে বুঝেছি।”

“বুঝেছ? বেশ ভাল করে বুঝেছ কি? কেমন সহজ কৌশল বল ত দেখি!”

“কিন্তু আমি যে, জীবিত আছি—আমি যে পলায়ন করেছি, এটা যে সকলেই বেশ সহজে বুঝতে পারবে।”

“হাঁ, তা পারবে বৈকি, তা’ না হলে আর মজা কী!”

“তা’ হ’লে আমি—”

“হাঁ, তুমি—তোমাকে তা’ হ’লে, তুমি যে রমণীকে ভালবাস, তার চির-অনুগত থাকতে হবে—আরও তোমাকে তার বেশি বশীভূত হ’তে হবে—তাই ত আমি চাই। আমার চির-সেবক থাক তুমি, সেই সাধই ত আমার বেশি বেশি।”

“জুমেলা, তুমি কি আমায় এতই ভালবাস?”

“তুমি কি সন্দেহ কর, ডাক্তার?” এই বলিয়া জুমেলিয়া নবীন ডাক্তারের ওষ্ঠাধরে নিজ অধরপুট সংযোজনে বরাত্রয় সশব্দে চুম্বন করিল। কদাচারী নবীন প্রতিদান করিতে কুণ্ঠিত হইল না। জুমেলিয়াকে বাহুবেষ্টিত করিয়া সে গাঢ় আলিঙ্গন করিল। মন্ত্রমুগ্ধ, মুগ্ধচিত্ত নবীন ডাক্তার নরকের মধ্যে এই ক্ষণিক স্বর্গসুখ অনুভব করিল। তমালাবলম্বিত মাধবিকার ন্যায় জুমেলিয়ার রূপময়ী সৌন্দর্য্যময়ী দেহলতা নবীন ডাক্তারের বক্ষে অনেকক্ষণ লগ্ন রহিল।

“জুমেলা, যখন আমাকেই খুনী স্থির ক’রে পুলিসের লোক আমার অনুসরণ করবে, তখন কি হবে?”

“তখন? এখনকার চেয়ে আমি তোমাকে বেশি বেশি ভালবাসব।”

“আর একটি কথা, টাকার বিষয় কি করেছ?”

“তুমি কি মনে কর, তাতে আমি অবহেলা করেছি।”

“না।”

“তবে জেনো, তা’ করি নি।”

“কি করেছ তবে?”

“নগদ যত টাকা সংগ্রহ হ’তে পারে, তা’ আমি করেছি।”

“তা—কত হবে?”

“প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা।”

“সব কি নগদ?”

“সব নগদ। আরও প্রায় ত্রিশ হাজার টাকার জড়োয়া গহনা।”

“অ্যা, বল কি! এইখানে কি সব আছে?”

“হ্যাঁ।”

“এই বাড়িতেই?”

“এই বাড়িতেই।”

“তোমার কাছে?”

“নবীন, আমাকে কি নির্ব্বোধের ন্যায় দেখায়?”

“না।”

“নির্ব্বোধের ন্যায় কখনও কোন কাজ করেছি কি?”

“না।”

“তবে আমাকে এ কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন? এখন যদি আমি সে সকল টাকা আর গহনার সন্ধান তোমাকে ব’লে দিই, তা’ হ’লে আমার সে কাজটা নিতান্ত নির্ব্বোধের মত হবে না কি?”

“কেন—কে’ন জুমেলা, এমন কথা বলছ কেন?”

“তা’ হলে তুমি এই স্বর্ণ-সুযোগ ছেড়ে দিতে পার কি?”

“তোমার মনের কথা কি খুলে বল? কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“যদি তুমি টাকাগুলো এখন হস্তগত করতে পার, তা’ হ’লে তুমি অন্য মৃতদেহগুলির সঙ্গে আমার দেহটা এখানে ফেলে রেখে পলায়ন করতে তখন কুণ্ঠিত হবে কি?”

“ওঃ, জুমেলা! আমাকে তুমি এতখানি অবিশ্বাস কর?”

“নবীন, জীবনাধিক, নির্ব্বোধ হ’য়ো না।”

“কিন্তু ভেবে দেখ—”

“ভেবো না—মাইরী ভেবো না; কাজ—কাজ—কাজ আগে সমাধা কর।”

“কি করব, বল?”

“বেশি কিছু না, আমার কাজে যতটুকু পার সহায় হও।”

“সেজন্য সর্ব্বদা প্রস্তুত আছি।”

“যখন কাজ শেষ হবে, দুজনে মিলে—তুমি আর আমি একদিকে চ’লে যাব। যেখানেই হ’ক, দুজনে রাজার হালে থাকব।”

এই বলিয়া জুমেলা হস্তস্থিত বাক্স হইতে একটা ছোট শিশি বাহির করিল। শিশির মধ্যে একপ্রকার রক্তবর্ণ তরল পদার্থ ছিল। জুমেলিয়া অতি সতর্কতার সহিত ছিপি খুলিয়া যেন গন্ধানুভব করিবার অভিপ্রায়ে সেই উন্মুক্ত শিশিটি নিজের নাসারন্ধ্রে ধরিল। ধরিল মাত্র।

নবীন ডাক্তার পূর্ব্বাপেক্ষা আরও তাহার নিকটস্থ হইল। সবিস্ময়ে ও পলকহীননেত্রে জুমেলিয়ার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। জুমেলিয়া নাসারন্ধ্র হইতে শিশিটি নামাইয়া লইল; ক্ষণেক নীরবে কি ভাবিল। ভাবিয়া আবার নাসারন্ধ্রে তুলিল। নাসিকা কুঞ্চিত করিয়া বলিল, “আঃ, পোড়া কপাল! সর্দিতে নাকটা যে একেবারে বুজে গেছে, কিছুই গন্ধ পাচ্ছি না।”

“কি হবে তবে?”

“তাই ত বটে! যা’ই হ’ক, এই শিশিটাই ঠিক হবে! দেখ দেখি, শেফালিকা ফুলের মত এটার গন্ধ কি না? আমার ত সর্দিতে নাক একেবারে বন্ধ হ’য়ে গেছে, কিছুই গন্ধ পাচ্ছি না। “

“তা’ আমি ঠিক বলতে পারব।”

“বলতে পারব নয়, এখনই বল? এই নাও, শিশিটি ধর—খুব সাবধান; দেখো—দেখো যেন হাতে এক ফোঁটা না লাগে।”

“হাতে লাগলে ক্ষতি কি?”

“গলিত লৌহ অপেক্ষাও এ ভয়ঙ্কর।”

“জুমেলা, তুমি যেমন ভয়ঙ্করী, তোমার ঔষধগুলিও কী তেমনি ভয়ঙ্করী! এ সকল দ্রব্যগুণ অসাধারণ।”

“এ সব দ্রব্যগুণঘটিত ঔষধ আমি ডাক্তার ফুলসাহেবের কাছে পেয়েছি।”

“সে-ও তবে বড় ভয়ঙ্কর লোক ছিল?”

“হাঁ, তেমন সাহসী—তেমন বুদ্ধিমান—তেমন চতুর লোক অতি বিরল—আমি ত আর দেখলাম না।”

“এ ঔষধটার গন্ধ কি ঠিক শেফালিকার ফুলের মত? আঘ্রাণে কোন আশঙ্কা নাই ত?”

“না—না, কিছুই না; তা’ হ’লে আর তোমার হাতে দিই?”

নবীন ডাক্তার নাসিকারন্ধ্রে সেই শিশিটি তুলিয়া ভাল করিয়া আঘ্রাণ করিল। তখনই সে বিকট আর্তনাদ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল—দুই পদ পশ্চাতে হটিয়া গিয়া শিশিটি সেখানে ফেলিয়া দিল। জুমেলিয়া তখনই শিশিটি তুলিয়া লইয়া ছিপিবন্ধ করিয়া ফেলিল। সে শিশিতে কোন একটা মারাত্মক পদার্থ ছিল। নবীন ডাক্তার গৃহের চতুর্দিকে অন্ধের ন্যায় ছুটিতে লাগিল; চিৎকার করিতে গে’ল—পারিল না। অল্পক্ষণ মধ্যে তাহার শরীর অবসন্ন হইয়া আসিল। মাতালের মত টলিতে টলিতে দুই হাতে মাথা চাপিয়া ধরিয়া নবীন ডাক্তার জুমেলিয়ার সম্মুখে বসিয়া পড়িল; তাহার পর আর দুই-তিন মিনিট—ভূম্যবলুণ্ঠিত হইয়া ছট্‌ফট্ করিতে লাগিল।

জুমেলিয়া হাসিল—সে হাসি বড়ই অমঙ্গলসূচক, বড়ই ভয়ানক, বড়ই সাংঘাতিক, পৈশাচিক—নারকীয়—অতি তীব্র। যতক্ষণ নবীন ডাক্তার ছট্‌ফট্ করিতে লাগিল, ততক্ষণ জুমেলিয়া সেই পৈশাচিক হাসি হাসিতে হাসিতে তাহার দিকে নির্নিমেষনেত্রে চাহিয়া রহিল।

নবীন ডাক্তার অগৌণে মৃত্যুমুখে পড়িল।

“একজন হ’লো।” সেই হৃদয়হীনা রমণী সেই পৈশাচিক হাসি হাসিতে হাসিতে বলিল।

তাহার পর সে অবনত হইয়া ক্ষণেক নিষ্পলকনেত্রে মৃত নবীন ডাক্তারের দিকে চাহিয়া রহিল। মৃদুগুঞ্জনে বলিল, “কী মজা, যখন দেবেন্দ্রবিজয় এখানে আসবে, তখন সে কী মজার দৃশ্যটাই দেখবে! প্রত্যেকের—এ বাড়ির প্রত্যেকের আজ এই দশা হবে—এমন কি চাকরগুলার অবধি—কেউ পার পাবে না। জুমেলার হাত থেকে আজ কেউ পার পাবে না। কেমন মজার দ্রব্যগুণ! কেউ জানতে পারবে না, লোকগুলার কিসে মৃত্যু হয়েছে। কুমুদিনী কি মনোরমাকে দেখে সকলে ভাববে, আমিও মরেছি—বাহবা কি বাহবা! মনোরমার দেবেন্দ্রবিজয়ও খুব জব্দ হবে। আমি না হ’লে তাকে আর জব্দ করে কে? আমি না হলে তাকে আর পরাজিত করে কে? আজ তার স্ত্রীরও মৃত্যু হবে। সে এসে দেখবে যে, তার স্ত্রীও মরেছে, তার অনুসন্ধানও বন্ধ হবে। কার অনুসন্ধান করবে! নবীন—তুলসী—গোবিন্দ—সব শব। আমি—আমিও; তার কাছে কুমুদিনীর দেহ আমার মৃত্যুর প্রমাণ দেবে। চেষ্টা করলে দেবেন্দ্রবিজয়কেও আমি নবীনের অনুসরণে শীঘ্রই পাঠাতে পারি; তা’ আমার ইচ্ছা নয়। জীবিত থাক সে—সারাজীবন বুকফাটা যাতনা ভোগ করুক। তার উপরে এ আমার কেমন বিদ্বেষ! কেমন ঘৃণা! হতভাগা নবীন! তোমার জন্য আমি বাস্তবিক দুঃখিত—কী করব, উপায় নাই; তোমাকে জীবিত রেখে আমি আমার বিপদ সজাগ রাখতে পারি না। দেবেন্দ্র! তোমাকে বহুদিন হ’ল, একবার মৃত্যুর অর্দ্ধপথে পাঠিয়েছিলেম, সেদিন মর নাই, ভালই হয়েছে, তা’ না হ’লে আজ তোমার প্রিয়তমা পত্নীর এমন অপমৃত্যু দেখতে হত না। তোমার ওস্তাদ অরিন্দম আর তুমি, আমার সুখ-সাধে বাদ সেধেছ— আমার প্রাণাধিক ফুলসাহেবকে আমার হৃদয় থেকে কেড়ে নিয়েছ; সে শোক এখনও আমার হৃদয়ে সজাগ আছে। প্রতিহিংসা ভুলি নি—ভুলবও না। কত সময়—আর কত সময় এখন আছে? দেখি—” নিকটে ঘড়ি ছিল, বাহির করিয়া দেখিল। দেখিয়া বলিল, “আছে, যথেষ্ট সময়।”

সপ্তম পরিচ্ছেদ – হত্যা-উৎসব-প্রারম্ভে

প্রকোষ্ঠমধ্যে ভিত্তি-সংলগ্ন একখানি স্বচ্ছ বৃহদ্দর্পণের সম্মুখে জুমেলিয়া বসিল। সেই বৃহন্মুকুরে তাহার বিভীষিকাময়ী প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হইল। জুমেলিয়া তন্মধ্যে নিজের রূপচ্ছায়ায় নিজের ভীষণ সৌন্দর্য্য দেখিয়া উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল। নিজের প্রতিবিম্বকে লক্ষ্য করিয়া বলিতে লাগিল, “জুমেলিয়া, এমন দিন আর পাবি না। আজ তোর মহোৎসব! খুন—খুন——খুন! কেবল খুন; মনের সাধে খুনের সাধ আজ মিটিয়ে নে। এক—হয়েছে; দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, ‘নয়’ খুন। সবই শেষ হয়েছে—কিছু বাকী আছে। এক নবীন—নিকেশ করেছি; দুই কুমুদিনী, তিন তুলসীদাস, চার গোবিন্দ, যদি না আমার কোন ভুল হ’য়ে থাকে—কাজটা যদি ঠিক হ’য়ে থাকে, এতক্ষণ তারা নিশ্চয়ই কৃষ্ণকে জবাব দিয়েছে। বাকী রেবতী, মনোরমা আর চাকরগুলো; কতক্ষণ তারা আর—কতক্ষণ? যমরাজ! আজ জুমেলা তোমার অনুচরী—কিঙ্করী; তোমার নরক- রাজ্যের প্রজাবৃদ্ধি করতে ব্যস্ত, আজ জুমেলার হত্যা-উৎসব।”

জুমেলার মুখে সেই হত্যাবিবরণী শুনিয়া দেবেন্দ্রবিজয়ের আপাদমস্তক কাঁপিয়া উঠিল। জুমেলিয়ার কথায় তিনি বুঝিয়া দেখিলেন, সে পাপিষ্ঠা ইতঃপূৰ্ব্বেই নিজের অব্যর্থ বিষ কুমুদিনী, তুলসীদাস ও গোবিন্দ প্রসাদের প্রতি প্রয়োগ করিয়াছে। তাহারা স্ব স্ব শয়ন-গৃহে উপস্থিত হইয়া স্ব স্ব মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিয়াছে।

যদি দেবেন্দ্রবিজয় এই সকল হত্যা নিবারণ করিবার কোন উপায় পাইতেন, করিতেন। এখন আর উপায় কি? এখন কেবল জুমেলিয়াকে পর্যবেক্ষণ করা, যাহাতে সে আর কোন অনিষ্টোৎপাদন করিতে না পারে, সেই চেষ্টা করা যুক্তিসিদ্ধ। প্রথমে ভাবিলেন, তন্মুহূর্ত্তেই সেই গৃহে প্রবেশ করিয়া পিশাচীকে ধৃত করেন; কিন্তু দ্বিতীয় চিন্তা তাঁহাকে তদ্বিষয়ে এক্ষণে নিরস্ত করিয়া অপেক্ষা করিতে অনুজ্ঞা করিল।

ঘরের একপার্শ্বে একটা টেবিল ছিল, সেই টেবিলের নিম্নে একটি মদের বোতল ছিল, জুমেলিয়া সেটা বাহির করিল। তখনই বোতালের মুখে মুখ দিয়া সেই পূর্ণবোতল এক নিঃশ্বাসে নিঃশেষ করিল।

জুমেলিয়া মনের আনন্দে মুলতান গাহিতে লাগিল;—

“কাহে মুসে প্রীতিয়া লাগায়া পরদেশীয়া।
উঠত বঠত মোরে সালেলা কলোজোয়া,
যব্‌ দেখা শূনা চারপাইয়া।”

যে ব্যক্তি এই কয়েক মুহূর্ত্ত পূর্ব্বে তাহার কাছে নিজের ভালবাসা জানাইতেছিল, সেই নবীনের মৃতদেহের উপরে তখন একেবারে জুমেলিয়ার দৃষ্টি পড়িল। তাহাতে তাহার স্ফূর্ত্তির কিছু যেন ব্যাঘাত জন্মিল। জানালা হইতে একখানা পৰ্দ্দা খুলিয়া, “এখন এটা চোখের সামনে না থাকাই ভাল,” বলিয়া সেই পৰ্দ্দাতে নবীনের মৃতদেহ সম্পূর্ণরূপে আবৃত করিল। তাহার পর ঠুংরী গাইল

“শ্যামল সুরতিয়া, মোহন মূরতিয়া
সুরতিমে মূরতি লাগাও পরদেশীয়া।
চার দিনন্ মোকে গলাসে লাগাও লে,
আব্ কাহে কৈলে জুদাগি পরদেশীয়া।’

বুঝি তাহা ভাল লাগিল না—তাহাই টোড়ী গাইল–

“দেখিয়ে ছুটে মোহবৎ মেরা দিল পর বনে।
কারে আরও বুখানে কা
বন্ না বিগাড় না দেখিয়ে;
কিসি কি খাম্ বিয়ান—ছুঁই আউর কিসি কি ঘর বনে।”

পুনরায় মদ্য পান করিয়া উচ্চকণ্ঠে গাইল–

“তাব্ উকি দেখনে কি নালায় চলা গ্যয়।
ক্যা ক্যা বড়া জোয়ান থে আয়ে চল্লা গ্যয়।।
আদম্ রহা কই
পেগাম্বর রহা কই,
সব বে জমীন মে আয়ে চলা গ্যয়।
দারা রহা নিজাম সা,
সিকন্দর সা পাত্সা,
তব্‌ সে জমীন সে আয়ে চলা গায়।”

জুমেলিয়া গান শেষ করিয়া বলিল, “কই, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না— নেশা জম্‌তে চায় না, জ’মেও জমছে না; কিন্তু আজ জুমেলা ছাড়বে না?”

আবার একটা বোতল মদ বাহির করিল, পাত্রের পর পাত্র পূর্ণ করিয়া তীব্র সুরা উদরস্থ করিতে করিতে গাইল–

“বিনা রে খেওয়াইয়া নইয়া ক্যায়সে লাগে পার।
গাহিরি নদীয়া নাও পুরাণিরে,
খেওয়া না হোয় মাতোয়ার।“

অষ্টম পরিচ্ছেদ – হত্যা-উৎসবোদ্যোগ

কি ভাবিয়া জুমেলিয়া চকিতে গান থামাইল।

গৃহের একপার্শ্বে একটা লোহার দেরাজ ছিল, জুমেলিয়া সেটি উন্মুক্ত করিয়া একটি টীনের বাক্স বাহির করিল; বাক্সটি হীরকালঙ্কারে পূর্ণ—একপার্শ্বে একতাড়া নোট লাল ফিতা দিয়া বাঁধা। হাসিতে হাসিতে জুমেলিয়া বলিল, “এই আমার পরিশ্রমের ফল। পরিশ্রমই বা কি—কেবল কৌশল, কেবল কৌশলেই আজ এ ধনরত্ন আমারই হাতে। জুমেলা, আচ্ছা মেয়ে তুই, বড়ই বাহাদুর মেয়ে তুই, আমার মনের মত মেয়ে তুই! বাহাদুরী আছে তোর! যদি তুই বোকা, ভয়- তরাসে মেয়ে হ’তিস—আমি তোকে খিদিরপুরে মাঝ-গঙ্গায় ডুবিয়ে মারতেম। এগুলি নিয়ে আমি এখনই সরে যেতে পারি, তাতে সুখ হবে কি? আমার এ হত্যাব্রত না বিধিমতে উদ্যাপন ক’রে শুধু এই অর্থ নিয়ে কি আমার মন সন্তুষ্ট হতে পারবে? কখনই না—হত্যা যে আমার মহোৎসব। এ যে আমার সাধের হোরিখেলা-লোকে আবিরে হোরি খেলে, এ আমার রক্তে রক্তে হোরিখেলা—লালে লাল! খুন—খুন যে আমার প্রাণের আনন্দ; এ কি তুচ্ছ করতে পারি? আগে খুন—খুন; প্রাণের সাধ আজ মিটিয়ে নিই;তার পর এগুলি নিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা করব। ওঃ ছাই! নেশার ঘোরে আর একটা কথা যে ভুলে যাচ্ছি। ‘১৭–ক’ চিহ্নিত পুলিন্দাটাও সামনে রেখে দিই, পাছে পরে ভুলে যাই।”

দেরাজ হইতে ‘১৭–ক’ চিহ্নিত পুলিন্দা বাহির করিয়া বলিল, “এটা আগে খুলে দেখলেই ভাল ছিল, এটার মধ্যে রামগোলামের প্রমাণ-পত্রাদি থাকতে পারে। আরও কিছু মূল্যবান সামগ্ৰী থাকতে পারে। যাক—এখন সময় নাই; এরপর তখন দেখব। রামগোলামটা মনে করেছিল যে, যেমন জায়গায় সে এটা লুকিয়ে রেখেছিল, সেখান থেকে কেউ আর খুঁজে বার করতে পারবে না। আমাকে সে জানত না—চিনত না; “১৭–ক” মানে কি? কিছুই না; এর আবার মানে কি, একটি চিহ্ন দেওয়া মাত্র। বেশ, এটা এখন এখানেই থাক; আগে আমার এদিককার কাজ শেষ ক’রে নিই। যাবার সময় এটাও নিয়ে যাব; অবকাশে ‘১৭–ক’ পুলিন্দার রহস্যভেদ করব। “

জুমেলিয়া সেই দেরাজে পুলিন্দাটি রাখিয়া দিল; আর একটা ক্ষুদ্র শিশি বাহির করিল। যেমন ব্যাঘ্রী তাহার ক্রীড়া-ব্যস্ত শাবকের প্রতি সতৃষ্ণনয়নে চাহিয়া থাকে, তেমনিভাবে আগ্রহপূর্ণনেত্রে জুমেলিয়া ক্ষণেক সেই শিশিটির দিকে চাহিয়া রহিল। তাহার পর সে তাহার সেই চিরাভ্যস্ত অট্টহাস্য করিল; সেই হাস্য—সেই অমঙ্গলসূচক—সেই তীব্র—ভীতিপ্রদ—বিভীষিকাময় — অট্টহাস্য। সেই হাস্যের ‘হা হা হা’ ধ্বনি দেবেন্দ্রবিজয়ের সবল হৃদয়ও চমকিত করিয়া তুলিল।

জুমেলিয়া সেই শিশিটি দুই-একবার নাড়িয়া বলিল, “এই আমার প্রধান অস্ত্র।” টলিতে টলিতে উঠিল। যে দ্বারপার্শ্বে দেবেন্দ্রবিজয় দাঁড়াইয়া ছিলেন, সেই দ্বার দিয়া বহির্গমন করিল। নেশার ঝোঁকে মনের অস্থিরতায় দেবেন্দ্রবিজয়কে দেখিয়াও দেখিতে পাইল না। দেবেন্দ্রবিজয় তখনই তাহাকে গ্রেপ্তার করিতে পারিতেন, করিলেন না। তিনি নিজের সামর্থ্যের পরিমাণ অনুভব করিয়া এবং সেই পিশাচীর কুচক্র-রহস্য অধিকতর উত্তমরূপে পর্যবেক্ষণ করিবার অভিপ্রায়ে তখন নিরস্ত হইলেন। আপাতত তাহাকে তাহার গন্তব্য পথে যাইতে দিয়া যথামুহূর্ত্তে তাহাকে পরাজিত করিবেন, স্থির করিলেন। উকিল তুলসীদাস, গোবিন্দপ্রসাদ ও কুমুদিনী এতক্ষণে মৃত্যুমুখে নিপতিত হইয়াছে; এখন তাহাদিগকে রক্ষা করা তাঁহার ক্ষমতাতীত; সুতরাং এখন যাহাতে তিনি রেবতী, মনোরমা ও শিবুর জীবন রক্ষা করিতে পারেন, সেজন্য চেষ্টিত হইলেন।

“বিদেশী সেইঞা দিয়া বহুত গিয়াভি।”

গাইতে গাইতে—মরুদ্বক্ষে ঝিঁঝিট রাগিণী ঢালিতে ঢালিতে—টলিতে টলিতে জুমেলিয়া অন্ধকারময় প্রাঙ্গণ অতিক্রম করিয়া দ্রুতপদে সোপানারোহণ করিতে লাগিল।

দেবেন্দ্রবিজয় তাহার অনুসরণ করিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *