মনোমোহন দত্তের গান

মনোমোহন দত্তের গান

অখণ্ড ব্ৰহ্মাণ্ড জোড়া, পরমাত্মা যদি হয়
খণ্ড ভেবে কিসে লবে বলো তারই পরিচয় ॥

সাকারে কি নিরাকারে অখণ্ড ভাবে বিচরে খণ্ড
করে কভু তারে ভাবনা উচিত নয় ॥

হয়ে খণ্ড ভেবে খণ্ড হতেছ খণ্ড বিখণ্ড
হাতে নিয়ে ব্রহ্মদণ্ড, দেখরে ব্রহ্মাণ্ডময় ॥

খণ্ডে খণ্ডে সে অখণ্ড, লীলাতে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড
লীলার খণ্ড হলে পশু, অখণ্ড কেবল রয় ॥

যত খণ্ড সব অখণ্ড এমনি তার কৌশল কাণ্ড
মনোমোহন কয়, ব্রহ্ম অণ্ড, এক ভিন্ন দ্বিতীয় নয় ॥

অরূপ পানে আর যাইও না মন
স্বরূপ পানে আকুল মনে চেয়ে থাকো অনুক্ষণ।

ধরতে গেলে না দেয় যে ধরা, তাঁরে ধরতে যেও না মন সে তো অধরা
ধরায় যেমন ধরা দিয়েছে, ধরো যেয়ে তাঁর চরণ ॥

প্রাণে প্রাণে পৃথিবী ঘোরা পরখ করে দেখো না আপন তুই কি প্রাণহারা
দেখবি যদি প্রাণের মানুষ স্বরূপে করো দরশন ॥

অরূপের রূপ স্বরূপে গড়া, চেয়ে দেখো না রূপেই ভাসে রূপের চেহারা
কোন রূপে তুই ভুলে রইলি চোখ থুয়ে অন্ধ নয়ন ॥

ধরায় ধরে যাও না সেরে অধরার কি প্ৰয়োজন

বলি রে মন খেলাতে বেহুঁশ ধরতে গিয়ে ঠকিস না তুই অধর পুরুষ
রাইরূপে তাঁর অঙ্গ ঢাকো অরূপ স্বরূপই একজন ॥

লাগাইয়া প্রেমের ডুরি, ধরায় ধরে শোনো কেবল মোহন বাঁশরী
কিশোরী পাসরি হরি, থাকতে না রে একইক্ষণ ॥

শ্রীহরি কিশোরী খেলা খেলা রে মন করে যতন হয়ে বিভোল।
তাতেই আছে নিত্যলীলা লীলাতীত নিরঞ্জন ॥

যোগে যোগে পাবি না মন তাঁরে অনুরাগে কেনা শুধু ব্যক্ত সংসারে
ভক্তি ভরে ডাকলে পরে মনেই পাব মনোমোহন ॥

আগে যদি জানতে তুমি, কান্দতে হবে কান্দালে
অসময়ে বাজায়ে বাঁশি, কেন এ প্রাণ জাগাইলে ॥

জাগায়ে জাগিলে হরি, কেমনে থাকি পাশরি
মধুর মধু মাধুরী, হৃদয়ে মাখিয়ে দিলে ॥

ধরা দিয়ে দাও না ধরা, তাইতে কেন্দে হলেম সারা
লুকোচুরি খেলা করা, স্বভাব না যায় কোন কালে ॥

কান্দাইতে ভালোবাসা, কান্দায়ে আড়ালে হাসো,
কান্দাইলে কাঁদিতে হবে, কি হবে আর লুকালে ॥

পরশে সরস মন, চায় তোমায় অনুক্ষণ,
মুগ্ধ মনোমোহন, বান্ধা আছে পদতলে ॥

আজ একটি রঙের কথা বলতে এলেম,
শুনতে যদি ভালো লাগে।
গাঙ পার হয়ে বলব আমি
ভয় আমি আমার বুক ঠুকে।
পড়ছি আমি এ.বি.সি.ডি, হাতে দিছি সোনার আংটি,
চেহারাখান পরিপাটি,      চেইন ঘড়ি ঝুলিছে বুকে।
চোখ থুয়ে হয়েছি কানা,      চশমা চোখে বাবুয়ানা,
স্ত্রীর গায়ে সোনার গয়না,       ছেঁড়া তেনা দেই মাকে।
মনে মনে করি বিচার,       জ্ঞান ছিল না বাপ-দাদার,
শব্দ শুনলে শঙ্খ ঘণ্টার,       অমনি ফেলি কান ঢেকে।
দেখলে পরে বাউলের দল,       হেঁট মুখ করি বাকি কেবল,
সাহেব বিবির চরণ কমল,        পাই যদি হায় রাখি বুকে।
বেদ-বেদান্ত চাষার গান,        অলীক, সাহেব দেয় প্ৰমাণ,
হায় বিবিজান, হায় মেহেরজান,      রায়বাহাদুর কয় লোকে।
হেয়ালি প্রবন্ধে কই,        বলো দেখি আমি কে হই,
মনোমোহন কয় হবে ঠিকই,       অসুরের মতো লাগে।

আজ কেন রে এমন লাগে, বুক খালি বুক খালি।
কি ছিল কি নাই হয়েছে, কি ছিল তাই কেমনে বলি।
দেখিয়ে কার চন্দ্রমুখ, ভরা ভরা ছিল বুক।
ছিল আশা ভালোবাসা, হাসাহাসি কোলাকোলি।
নয়ন ছিল রূপের পানে, মন ছিল নয়নের সনে,
দুজনে দুজনে মিলে গলাগলি ঢলাঢলি।
কান ছিল তার মিষ্ট বাক্য, প্রাণ ছিল তার প্রাণের পক্ষে,
পূর্ণিমার চাঁদ ছিল বক্ষে, জোসনা পড়িত ঢলি।
ঘুমের ঘোরে একলা ঘরে পালিয়ে গেছে ফেলে মোরে,
কে ধরিয়ে দিবে তারে, তারি লাগি অশ্রু ঢালি।
 কোন সোহাগী রাখছে ধরে, ছেড়ে দিক সে আমায় তারে
নইলে তারে মেরে ধরে ফাঁসিকাষ্ঠে রবো ঝুলি।
মনোমোহন কয় রে ভ্রান্ত মন ঘরে আছে পরম রতন,
যত্ন করলে পাবে সে ধন, অযতনে সব খোয়ালি।

আজব দুনিয়া ভাই বড়ো তামাশা,
এই দেখি এই নাই হয়ে যায় সকল ভরসা।
আসমানে বানায়ে ঘর তার ভিতরে বাসা,
যার লাগিয়ে খেটে মরো সেই কর্মনাশা।
ভুলাইতে কামিনীর মন দিছো ভালোবাসা,
আসবে শমন বাঁধবে যখন, বুঝবি মেয়ের নেশা।
একদিন যে তোর লইতে হবে গাঙের কূলে বাসা,
হরদমে জাগাইও দিলে আর হবে না আসা।
দীনহীন মনোমোহন কয়, করিয়ে খোলসা,
দুই চক্ষু বুঝিয়া গেলে, সম্পর্ক নাই রতিমাসা।

আদম্ খোদা মইত্‌ কহজি
নুরুছে আদম বানায়া, একদম জুদা নাহি ॥

আল্লা আছে আলেপে
সাবুদ করো কালেপে
ধ্যানে দিদার ধুন্দে ফকির, দইরাপ্ত করো দিমেজি ॥

ধরবে যদি মাসকে
ডুরী লাগাও আসকে
হলে দীল, দেওয়ানা, ফানাফিল্লা রাজি হবে আল্লাজি ॥

তিন তিন রোয়ে যিস্ পায়া
হাসি খেলনো মিলে পিয়া
মনোমোহন কয় দিল দরিয়া সিচলে পাবি সাঁই দরদি ॥

আমি কি তোমার ভজন জানি
অভজনে আছে কি মা, ভেবে মরি দিন রজনী ॥

ভজনে ভজন ছাড়া, অভাজনে দয়া করা
আছে নি তোর আইনের ধারা, সুধারা করো আপনি ॥

কি বিধি তোমার বিধি, ভেবে পাই না নিরবধি
বেদবেদান্ত পুরাণাদি, যার যার ভাবে করে মাইনি ॥

কর্মাকর্ম নাহি জ্ঞান, অকর্মে কর্ম বিধান করো
হে করুণা নিদান, করুণাময় নাম শুনি ॥

তুমি নিত্য সত্য সৎ, দেখাইয়ে রাজপথ
সারথী হইয়ে রথ, চালাও নইলে পাগল বনি ॥

চরণে দাসত্বখত, লিখে দিনু জন্মের মতো
করে লও না দস্তখত, করো না বিপথগামী

প্রলোভনে মুগ্ধ মন, ঘুরে বেড়ায় অনুক্ষণ
কি করে মনোমোহন, যা করে তা অনুমানি ॥

আমি কেমন করে বাধ্য করি মন-মত্ত-করি রে।
ভাবের ঘরে আনতে তারে, অভাবে সংগ্রামে করে ॥
যোগমায়া শরজালে, বন্দি নানা ছলে,
আপনি আপন খেলে, কৌতূহলে ফন্দি করে।
ধরতে গেলে না দেয় ধরা, কখন হাতি কখন ঘোড়া;
কখন শূন্যে করে ওড়া, উম্মত্ত আঁধার ঘরে।
 কখন আগুন কখন পানি, কামে মত্ত দিন-রজনী;
কুলুর বলদ টানে ঘানি, চক্ষে ঠুলি চক্রে ঘোরে।
 ভূতে ভূতে পেতে খেলা, ভেঙে দিল সাধের মেলা;
মনোমোহনের কাঁধে ঝোলা, আর জানি কি আছে পরে ॥

১০

আমি ঘুমিয়ে ছিলেম, কে আমাকে জাগালি ডেকে।
 সুখ-স্বপন ভেঙে দিলি, জ্বলে-পুড়ে মলেম দুঃখে।
 ঘুমের ঘোরে সুস্বপনে, বসে ছিলাম সিংহাসনে,
কে আমায় নামালি টেনে, তৃণশয্যা দেখি জেগে।
 অষ্টপ্রহর দিবারাতি, জাগ্রত স্বপ্ন সুযুপ্তি,
কি আশ্চর্য গতাগতি, কত চিত্র দেখি চোখে।
 জেগে স্বার্থ চিন্তা করি, দালান-কোঠা কতই গড়ি,
জমিজমা বসতবাড়ি, নারী চুরি ঘর থেকে।
 ঘুমাইলে কিছু নাই, সর্বস্ব ভুলিয়া যাই,
স্বপনে আবার দেখি, কেন্দে মরি পুত্র শোকে।
 হায় রে হায় মানুষ কুলে, ব্রহ্মাণ্ড খেলিয়ে চলে,
আমি করি ভাবছি বলে, চিনতে নারি আপনাকে।
 কে খেলায় কেন বা খেলি, কে ভুলায় কেন বা ভুলি,
মনোমোহন কয় তাই তো বলি, তারে চিনতে হয় আগে ॥

১১

আমি বিদেশীর বেশে,
এসে কি ভেসে যাব তোদের দেশে?
ভালো নয় দেশের ধারা, আপন-পর ভাবে তারা
দেখে যদি পথহারা, গাল ভরা হাসে।
প্রেয়সীর প্রেমে বাঁধা, পৃষ্ঠে বোঝা যেমন গাধা,
ভূতের বেগার খাটে সদা, মরি আফসোসে।
গরু বাছুর থাল ঘটি, জমি জমা বসতবাটী,
করে তারে পরিপাটি, মাটি হয় শেষে।
দেখিয়ে দেশের ধরন, ভেবে কয় মনোমোহন,
বিদেশী যেন কখন হেথা না আসে।

১২

আমাতে কি আর আমি আছি?
যার প্রাণ তারে দিয়ে নীরব হয়েছি।
 শুধু তাহারই লাগি সারাটি নিশি জাগি ডাকি
ডাকি থাকি থাকি কত কেন্দেছি।
ধরিতে না পেরে তারে চলিয়া এসেছি ফিরে,
অভিমানে রাগ করে ফেরে পড়েছি।
 প্রাণের লাগি প্রাণ, উদাসী গায় হে গান
নিঝুমে পাতিয়ে কান, থাকতে তারে দেখেছি।
 তাহারই আকুলতা, সহে না এত ব্যথা,
গাহিয়া প্রাণের গাথা প্ৰাণে প্রাণে সঁপিয়াছি ॥

১৩

আমার কথা শোনে না সে, তার কথা শুনি না আমি
এক ঘরেতে দুই জনাতে, ঘর করতেছি আমি তুমি ॥

সে কেমন জানি না কিছু, চলিতেছি তার পিছুপিছু
কথায় কথায় ঝগড়া বাধে, বিবাদে অপূর্ণ কামী

ঘুমের ঘোরে পড়ি লুটি, অমনি আবার জেগে উঠি
কে জাগায় তারে না দেখি, ছোটাছুটি দিবাযামী ॥

এমন হইলে থাকা দায়, এক ঘরেতে দুজনায়
ক্ষান্ত হয়ে শান্ত করো, বন্ধু ভাবে আমি তুমি
মনোমোহনের কাঁধে ঝোলা, আর জানি কি আছে পরে ॥

১৪

আমার মন ভুলান ধন,
আমার প্রাণ ভুলান ধন,
উদাসী হয়েছি আমি তোমারই কারণ।
দেওয়ানা হয়েছি আমি তোমারই কারণ।
হৃদয় মাঝে উদয় হয়ে দাও আমারে দরশন ॥
বাজায়ে কৃপা বাঁশরী,        মন ধেনুকে বশ করি,
এসো হরি বসো হরি ভক্তের বাঞ্ছিত ধন।
রাঙা পায়ে নূপুর দিয়ে,       রুনুঝুনু বাজাইয়ে,
বামে চূড়া হেলাইয়ে খেলায়ে মনোমোহন।
এ প্রাণ হউক ব্রজাঙ্গনা,      অশ্রুজলে হউক যমুনা
এই দেহ হউক ব্রজের মাটি, তাতে করো গোচারণ।
আশা পথ চেয়ে চেয়ে,       রয়েছি পাগল হয়ে,
আয় রে গোপাল আয় রে ধেয়ে, লইয়ে রাখালগণ।
মনোচোরা শ্যামের বেশে,        দাঁড়াও এসে হেসে হেসে,
অনায়াসে ভক্তি পাশে, বেঁধে রাখি রাঙা চরণ।
মনোমোহন আয় আয়!      মনোমোহন তোরে চায়,
হৃদয়ে হৃদয় দিয়া করিবারে আলিঙ্গন।
প্রাণে প্রাণ মিশামিশি করি দুজনে দুজন ॥

১৫

আমার মনপাখি মিশিতে চায়, যেয়ে ওই সব পাখির দলে
যে সব পাখি ফাঁকি দিয়ে ঘুরে বেড়ায় বন জঙ্গলে ॥

কত করে করিয়ে মানা, পাখিরে বাসা ছেড়ো না
সে আমার কথা শুনে না, তার সনে পারি না বলে ॥

শিকলি কেটে ময়না টিয়া, অই সব পাখির দলে গিয়া
আবোল-তাবোল বোল বলিয়া, হারা হতে চায় মূলে ॥

হারে রে জঙ্গলা পাখি, আর তুমি দিও না ফাঁকি
মনোমোহনের মন আঁখি, কেমনে রাখি উল্টা চলে ॥

১৬

আয় না সখা,      নয়ন বাঁকা,
শিখি পাখা হেলায়ে কানাই।
করে ধরি বেনু,     সঙ্গে নিয়ে ধেনু,
রুনু ঝুনু ঝুনু নূপুর দিয়ে পায়।
পড়ে পীতধরা,      বেঁধে মোহন চূড়া,
আয় না আমরা, আয় গোষ্ঠে যাই।
হাম্বা রবে,      ডাকে ধেনু সবে,
বৃষভ আরাবে উর্দ্ধ মুখে চায়।
তমালের তলে,      যমুনার কূলে,
শুক সারি মিলে তব নাম গায়।
আয় রে গোপাল,      সকাল সকাল,
ও মাখনলাল বেলা হয়ে যায়।
যত রাখাল নিয়া,       গোধন লইয়া,
দ্বারে দাঁড়াইয়া প্রেমানন্দে তায়।
গালাগালিচ্ছলে,      রে কানু বলে,
পাচনি বগলে কৃষ্ণগুণ গায়।
চুপিচুপি হাসি,      কানু বলে আসি
মায়েরে সম্ভাষি দেরি হচ্ছে ভাই।
চল রে শ্রীদাম,      চল রে সুদাম,
দাদা বলরাম চল চল যাই।
রাখালিয়া প্রেমে,      বদ্ধ বজ্ৰধামে,
হলে যদি শ্যাম, হবে কি উপায়।
দীন মনোমোহন,      ও রাঙা চরণ,
নয়ন ভরে সদা দেখিবারে চায় ॥

১৭

আয় রে বাতাস বেগে ছুটিয়া।
আমার হৃদয় চাঁদের মুখখানা—
রেখেছে মেঘে আবরিয়া।
প্রাণশশীর মুখে হাসি,
বড়োই মধুর ভালোবাসি,
আয় রে সকলে আসি, দে রে মেঘ সরাইয়া।
হাসিতে হাসিতে মাখিয়া হাসি,
অফুরন্ত হাসাহাসি—
করে প্রাণে প্রাণে মিশামিশি হাসিতে পড়ি মিশিয়া।
আনন্দ হৃদয়ে রাখি
সতত আনন্দে থাকি
মনোমোহন বড়ো দুঃখী যেও না তারে পাশরিয়া ॥

১৮

ইহাই এখন মন ঠিক বুঝে রাখো।
ভূত ভাবী ছেড়ে দিয়ে বর্তমানে থাকো।
তার ইচ্ছাতে জেনো ভবে,
যা হয়, হতেছে, হবে,
ভেবে ভেবে কেন তবে,
বসে নানা চিত্র আঁকো।
যা যখন আছে সম্মুখে,
তাতেই মন থাকো সুখে,
মনো কয় ইহলোকে
ভাবিলে সকলই ফাঁক।

১৯

এ পার থেকে জানতে চায় মন, ও পারের খবর,
কি ছিলাম কি হব শেষে, মরণের পর।
 যাদেরে আদর্শ মানে, বাইবেলে বেদে কোরানে,
যার যার ভাবে তারা টানে, না মানে একে অপর।
 পুরাণে কয় জন্মমৃত্যু, কর্মই তাহার হেতু,
কর্মফলে সঙ্গে চলে, নাহি পায় অবসর।
 বাইবেলে কোরানে তার, এক দিনে করে বিচার।
বেহেস্ত দোজখ যেতে হবে, কেয়ামতের পর।
 কৃষ্ণভক্ত ব্রজবাসী, শিবভক্ত কৈলাস কাশী,
হরিনামে বৈকুণ্ঠধাম, বৌদ্ধ পরাৎপর।
যোগী কয় যোগেতে বসি, তারি সঙ্গে যাব মিশি,
দ্বৈতবাদী বলে হাসি, হব তারি অনুচর।
 কেহ বা ভাবে গোলক, চন্দ্ৰ সূর্য গ্রহলোক,
দেবলোক ভেবে শোক, নিবা রে কার অন্তর।
কেহ কয় জন্ম একবার, কেহ লক্ষ কোটি কয় বার।
আসা-যাওয়া ভ্রমিতে হয়, নানা যোনী নিরন্তর—
লিঙ্গদেহ মুক্তি তরে, কেহ পিণ্ড দান করে,
মনোমোহন কয় ভেবে দেখো, নহে অগোচর।
এক যদি সবার গোড়ে, সবাই যদি স্বীকার করে,
আদিঅন্ত একই তবে, নাহি হবে স্বতস্তর।
মাটি দিয়ে কুম্ভকারে, ঘট আদি যত গড়ে,
এক হয়ে যায় ভাঙলে পরে, নয়ন গোচর।
অখণ্ড মণ্ডলাকারে, যে নিত্য সে লীলা করে,
লীলা নিত্য এক করে, সাধক হয় অমর।

২০

এসে আমি ছিলাম ভালো, এখন বড়ো লাগে ভয়।
যারা আদর করে কোলে নিত, তারা কেন কুকথা কয়।
লেখাপড়া শিক্ষা করে, বিদ্যা আমার গেছে বেড়ে
বুদ্ধির জোরে কৌশল করে যারে তারে করছি জয়।
একথা-সেকথা বলি, যারে-তারে দিচ্ছি গালি,
দীনহীনকে পদে দলি মুখে বলি সদাশয়।
ছেলের বিয়ে বড়োঘরে, মিথ্যার জোরে মামলা করে
দালান দিছি কুঁড়েঘরে, আমার মতো কেহ নয়।
 গরিব বেটা খেতে পায় না, তবু বলি সুদ দেয় না,
ডিক্রি জারীর পরওয়ানা তার বাড়িতে জারী হয়।
 বেড়ে গেছে বড়ো পশার, রায়চৌধুরী খেতাব আমার,
তার মুখে মারি পয়জার, সে মোরে বুদ্ধিমান কয়।
 থাকলে বুদ্ধি দেখতাম চেয়ে, শিশুর মতো থাকতাম হয়ে,
মনো কয় ভাই বুদ্ধি খেয়ে, একালে বুদ্ধিমান হয়।

২১

ও মন যাবে যদি ভবপারে
ভুলো না তাঁরে, যে জন সৃজন লয় করে।
 যাঁহার করুণা বলে, দেখো রে জগতী তলে,
রবি শশী গ্রহতারা, সকলে আলো বিতরে।
 অনন্ত জগতজন, পূজিবে যার চরণ,
লহ রে তাঁর শরণ, যাবে দূরে।
ভুলে গিয়ে যত সব, তাহারিও পদ ভাব,
সকলই হবে সম্ভব, ভাসিবে সুখসাগরে।
 যিনি তাঁহারই চরণ, নাহি অন্য রত্ন ধন,
বলি রে মনোমোহন, রাখো সদা অন্তরে।

২২

ওগো চিন্তে, আমি থাকতে তুই যাবি কই,
আমি তোরে সঙ্গে নিব, যেদিন হব চিতা সই।
 তুই চিন্তে সতত চিতে, দিন রেতে খেতে শুতে,
তোর জ্বালা পারি না সইতে, কার কাছে তোর কথা কই,
তুই বড়ো হাবাতে মেয়ে, খেলা করিস আমার লয়ে,
তোর স্বভাবে স্বভাব দিয়ে, কখন দেখি রাজা হই।
 কখন দেখি কুঁড়েঘরে, ভাত জোটে না উদর ভরে,
তোমারে জড়ায়ে ধরে, অভাবে ভাব নিয়ে রই,
জনম গেল ভাবতে ভাবতে, কূল পাইলাম না খাটতে খাটতে,
পারলেম না তোর মন যোগাতে, এমন মেয়ে আছে কই,
মৃত্যুকন্যা এলে রঙ্গে, সই পাতাব তাহার সঙ্গে,
মনোমোহন কয় লীলা ভঙ্গে কদিন যদি সুখে রই।

২৩

ওরে মন মাঝি রে–
লাগাও তরি শ্রীগুরুর ঘাটে।

যদি সুখে রবি, সুখ পাইবি, পাড় হবি ভবসংকটে।
 ঘাটে আছে এক বাজার, সাধুসঙ্গ নাম তার,
কত হীরে মাণিক বিনামূল্যে, বিকাইছে সেই হাটে।
 হাল দিয়া কাণ্ডারির হাতে, দাঁড় টান ভাই বসে বসে,
ভাব বুঝে সে দিবে শলা, যখন যেমন খাটে।
 ভয় করো না ঝড়-তুফানে, চালাও তরি প্রাণপণে,
দেখবে তরি নামের গুণে, আপনি লাগাবে ঘাটে।

২৪

ওহে আমার প্রাণের হরি-
এই করে দাও আমারে।
হৃদয়ে তোমারে দেখি, হরিষত হয়ে থাকি,
হয়ে গিয়ে মাখামাখি, আনন্দ ভরে।
তুমি আমার প্রাণে প্রাণ, মিশে যাও শুদ্ধ মিলনে,
কাজ নাই আমার তুচ্ছ ধনে, পাইলে তোমারে।
 সবখানা মন কুড়াইয়ে, তোমার শ্রীপদে দিয়ে,
মনোমোহন নিশ্চিন্ত হয়ে, থাকুক অন্তরে।

২৫

কও দেখি মন আমার কাছে, তুমি হিন্দু না মুসলমান।
আল্লা না হরি তোর ঠাকুর বটে রে,
তুই কে তোর মনিব কে রে কররে ইনসান
তুমি-আমি আদি যত কায়া আছে,
কে বিরাজে বলো এসব কায়ার মাঝে,
প্রাণে প্রাণে টানে টানে জাত বিচার নাই দেখি প্রমাণ।
আওরতে মরদে তামাম দুনিয়া, আলেক সাঁই গুরু পয়দিস করিয়া,
দিলের মাঝে আছে নিজে লুকাইয়া, করিয়া দেখো সন্ধান।
জাতে ভাতে তাতে নাহি ঠেলাঠেলি,
প্রাণে প্রাণে করে প্রেমের কোলাকোলি,
কেও বা হরি বলি কেও বা আল্লা বলি,
বোলে বোলে র’ল মূলেতে হয়রান।
যদি একে আরে না টানি তো কভু,
ভোদাভেদ করে বেছে নিতাম প্ৰভু
ভেবে দেখো দীলে, যোগ দিলে সব মিলে,
মনোমোহন কেন হলি পেরেসান।
জনমে মউতে আওরতে মরদে,
এক ডুরিতে বাঁধা আসমানে জমিতে,
আপ্তাবদ্দিন কয়, হতে পারলে হয়,
জ্ঞানী দেখে সত্য ফুটলে আত্মজ্ঞান।

২৬

করো বা না করো কাম, নাম সত্য জেনে রেখো,
জন্ম-মরণ আছে যখন আমোক্তারী দিয়ে রাখো।
পড়লে পরে ফেরে ফারে, ডাকতেই যখন হয় তাঁরে,
তবে কেন বারেবারে, তারে না রে করে থাকো।
ভাবের গুরু ব্রহ্মময়, জীবের ভাগ্যে দয়াময়,
দয়াকে করি আশ্রয় ভক্তি করি প্রাণে মাখো।
মনের মতন হয় না কর্ম, ইথে কি বোঝো না মৰ্ম,
সত্যই রয়েছে ধর্ম মনো কয় বুঝিয়ে দেখো।

২৭

করিব তোমার পূজা বাসনা অন্তরে।
মনপ্রাণ লয়ে মাগো ডাকিব কাতরে।
দিব ভক্তি পুষ্পাঞ্জলি হাতে হাতে করতালি,
বিশ্বাস চন্দন গন্ধ মাখিব আদরে।
প্রেম বিল্ব পত্র দলে পূজিব গো কৌতূহলে,
জপিব অজপা যোগে নাম প্রাণ ভরে।
ইচ্ছাময়ী তারা তুমি, ইচ্ছাতেই ইচ্ছি আমি,
তোষো মা, মনোমোহনে ইচ্ছাপূর্ণ করে।

২৮

কার ভরসা কররে ভাই—
ও সাধু বেপারী।
মন তো আপনা নয়, করে ঝাঁকা জোড়ি
গুরু তো আপনা নয়,
না কয় তত্ত্বকথা,
স্ত্রী তো আপন নয়
না মেয় মর্ম ব্যথা,
কুটুম্ব তো আপন নয়, চার টাকা কড়ি,
বাড়ি তো আপনা নয়,
পড়ে রবে ছাড়া,
পুত্র তো আপনা নয়,
নাহি দিবে সাড়া,
দেহ তো আপনা নয়, কিসের বাহাদুরি
ধন তো আপনা নয়
সঙ্গে নাহি যাবে,
বন্ধু তো আপনা নয়,
কথা নাহি কবে,
দিন থাকিতে মনোমোহন কয়, চিনো আসন বাড়ি ॥

২৯

কি আর-
চাহিব নাথ তোমারে ছাড়ি,
জীবনের—
আশা তুমি, তৃষিতের পয়-বারি।
এই করো বিশ্বপতি
তোমাতেই থাকে মতি,
বাঁধা রহে মনপ্রাণ—
চরণে তুঁহারি।
তব রূপ ভাবনায়,
জগত ভুলিয়া যাই,
মহাপ্রেমে ডুবে থাকি—
দিবস শর্বরী।

৩০

কি চিন্তা করবে মন, নিশ্চিন্তে বসিয়া থাকো।
 গুরু ব্রহ্ম জগৎ জোড়া, প্রাণ ভরিয়া তারে ডাকো।
 আছে হৃদয় মধ্যে বিন্দু, আকর্ষিয়ে প্রেমসিন্ধু,
চিদাকাশে ফুটায় ইন্দু, নয়ন ভরিয়া দেখো।
 করে আত্মসমর্পণ, ভালো-মন্দ করো বর্জন,
যা করে তিনি যখন, তাতেই আনন্দ রাখো।
 সিদ্ধাসিদ্ধ এক করি, বসিয়া দিবা শর্বরী,
দেহ প্রাণ উৎসর্গ করি, পদধূলি গায়ে মাখো।
 তাহারে নির্ভর করো, অলীক বিষয় তুচ্ছ করো।
 হৃদয়ে হৃদয় ধরো, তা বিনে সকলই ফাঁক।

৩১

কুঞ্জবনে রাধা সনে শ্যামরায়।
 দেখবি যদি যুগল মিলন আয় গো সখি চলে আয়।
 মোহন বাঁশি করে ধরা, হেলায়ে বেঁধেছে চূড়া,
পীত বসন পীত ধড়া, নূপুর বাজে রাঙা পায়।
 নব জলধর রূপে, বনমালা গলে শোভে সখি
সঙ্গে মনোরঙ্গে বামে রাধা শোভা পায়।
 রাইয়ের মাথায় ফুল বেণী, মেঘে সৌদামিনী,
দেখবি যদি আয় সজনি, যুগল দেখে প্রাণ জুড়াই ॥

৩২

কে জানে তাঁর রূপের অন্ত কতই রূপ সে ধরে।
 অনন্ত স্বরূপে ব্যাপ্ত ব্যক্ত চরাচরে।
অনন্তে অনন্তময়, না আছে তাঁর রূপের নির্ণয়,
সকল রূপে এক রূপ হয়, অরূপের ঘরে।
পশু পক্ষী কৃমি কীট তরুলতা উদ্ভিদ,
আর কত বহুবিধ বিবিধ রূপে বিহরে।
এক রূপে সব রূপ, দয়াময় নাম সুধা কূপ,
হেরিতে চিত্ত লোলুপ মনোমোহনের চিত্ত তারে।

৩৩

কে তুমি কি কাজ করতে, এসেছ এই মর্ত্যভূমে
দেখো নাকি বাজে কাজে, দিন কেটে যায় বেহুঁশ ঘুমে ॥

ঘুমের ঘোরে দেখে স্বপ্ন, সদাই তুমি ভুলছ আপন
বিপণিতে বাজার করে হিসাবে তোর মূলধন কমে ॥

আগে চিনো আপনারে, তারপরে যেও বাজারে
নইলে পড়বে বিষম ফেরে, বিদেশীর সমাগমে ॥

রাখিতে সে কুলমান, হারায়েছ তত্ত্বজ্ঞান
দিক্-বেদিক্ ভাবনাশূন্য, মাতিয়া খেলার ধুমে ॥

আপনা মঙ্গল খোঁজো, বারেক তলায়ে বোঝো
নেশার ঝোঁকে খেলা ছেড়ে, মজো রে দয়াল নামে ॥

৩৪

খোদে খোদা আল্লা রাধা দোস্ত মুহম্মদ।
অজুদে মজুতসাই, দোমে কেয়ামত।
কোরানে কয় নমাজ রোজা, বেহেস্তে যাওয়ার রাস্তা সোজা,
হজরতে কয় লামাও বোঝা করে খেজ মত।
 শরিয়তে করে সন্ধি, তরিকতে বোঝো ফন্দি,
হকিকতে ইমান বান্ধি, করো এবাদত।
 আদমি আদমের জাত, হর দমে করো ইয়াদ
লা সরিলা মৌজুত আল্লা, ফতে মারফত।
 মনোমোহন পেরেসান, খুঁজে হিন্দু-মুসলমান।
 করিম কৃষ্ণ, রহিম রাম, শিব হজরত।
 বিসমেল্লাতে বিষ্ণু হয়, কিদগারে দয়াময়,
ফতেহা করিমকালী, আলেক হুম তৎসৎ।
 ইয়াহু পরম হংস, সত্যের নাই কোন ধ্বংস,
আব পানি, জলের বংশ, একে হরেক মত।

৩৫

গাঙের তলায় পাখির বাসা, গাছের মাথায় জল।
 আসমানেতে ফুল ফুটেছে, পাতালেতে ফল।
 ডিম্ব আছে বাচ্চা সাই ডাকে মধুর সুরে,
হাতির মাথায় মশা মাহুত মার্গে আধার করে।
 রাঙ দিয়ে তোর সোনার ছড়া কেড়ে নিছে সে,
বট পাতাতে নাম লিখিয়া উড়াইল বাতাসে।
 যা হতে চায় দে তা চুপ তরে থাক ঘরে,
আপনা ধন পরকে দিয়ে, ঠকিস না তুই ফেরে
বুঝলে পরে সোজা হইবি, মাথায় বোঝা তোর
নেমে যাবে নামের গুণে, গুরুর চরণ ধর ॥

৩৬

গায়েবি আওয়াজে কয়, শোনো রে মুসলমান
আখের দুনিয়া ফানা, রাখবে ইমান।
চুরি করা মিছা কওয়া, বেসরা বেপরদা হওয়া,
পরহেজ সবুরে মেওয়া, কোরানে ফরমান।
 জরু লারকা দুনিয়ার, সমঝে দেখো ফক্কিকার,
মত্ত তো আজাবে তার, হইবে ইনসান।
 দীলের গরবি ছাড়ো, হাদিসের কথা ধরো,
কেয়ামত এয়াদ করো, হাসরের ময়দান।
 হরদমে আল্লার নাম, ফুকার দুনিয়ার কাম,
ভুকে অন্ন পিয়াসে পানি, এতিমেরে দিও দান।
 ভাবিয়ে মনোমোহন কয়, আল করিম দয়াময়,
জাতে ভাতে জোদা নয়, জমিন আসমান।
 একই হরফে জোড়া, ভাবে যারা বোঝে তারা,
আপ্তবদ্দি দিশেহারা, বড়ো পেরেশান।

৩৭

গুরু কল্পতরু মূলে—
আশ্রয় নিয়ে বসে থাকো, ও মন আমার কৌতূহলে ॥

গুরু নিত্য গুরু সত্য হয় পরম তত্ত্ব
শ্রীপদে মজায়ে চিত্ত, ভাবো নিত্য প্রাণ খুলে ॥

মায়াতে মানুষ দেহ, করো না কোনো সন্দেহ
গুরু কৃপা বিনা কেহ, পায় না মুক্তি কোন কালে ॥

জীবনের মধ্যবিন্দু, হৃদাকাশে গুরু ইন্দু
পার হইতে ভবসিন্ধু, বন্ধু নাই আর ভূমণ্ডলে ॥

যা দেখো ব্রহ্মাণ্ডময়, গুরু ভিন্ন আর কেহ নয়
হলে গুরু পরিচয়, আঁধারে আলোক জ্বলে ॥

মনোমোহন আত্মহারা, অহংকারে মাতোয়ারা
গুরুপদ সেবা করা, হলো না তারি কপালে ॥

৩৮

গুরু সত্য, ব্রহ্মময়।
যে ভাবেতে ভাব, সে ভাব উদয় ॥
অনন্ত এই বিশ্ব, দ্রষ্টা, দৃক, দৃশ্য,
ত্রিগুণে নির্গুণে লীলা নিত্যময় ॥
নিত্য নিরাকার, রহস্য সাকার,
অনন্ত স্বভাবে ভাবের পরিচয় ॥
করে খণ্ড খণ্ড, ভাবরে অখণ্ড,
স্বরূপে অরূপে ব্ৰহ্ম দয়াময় ॥
স্বভাব করো সিদ্ধি, হবে ভূত শুদ্ধি,
হয়ে জ্ঞান-বুদ্ধি বিদ্যার উদয় ॥
পরাৎপরা বিদ্যা, নাশিবে অবিদ্যা,
হলে যুক্ত বিদ্যা সিদ্ধ মৃত্যুঞ্জয় ॥
কালে দিয়ে ফাঁকি, পাবে দিবা আঁখি,
দেখিবে ব্রহ্মাণ্ড শুধু আত্মময় ॥
শক্তি আর চৈতন্য, দেখিবে অভিন্ন,
জড় বস্তু জ্ঞান হয়ে যাবে লয় ॥
বাসনা, কামনা, কিছু রহিবে না,
ভাবে ভাব যুক্ত হইবে হৃদয় ॥
আশা-পথ চেয়ে, গাছতলাতে শুয়ে,
আছে মনোমোহন, হয় কি না হয় ॥

৩৯

ছনের ছানি টিনের ঘরে বিবাদ করে নিরালা।
 পাড়ার লোক একত্র জুটে শুনতে এল দুপুর বেলা।
 হলো তাতে দুই পক্ষ, ধনী-গরিব দিল সাক্ষ্য,
জবাববন্দি মুখ্য মুখ্য, রুক্ষ কথা কি জ্বালা।
 ছন বলে অতিশয় রোষে, টিনের ঘর তুই সর্বনেশে,
বাতব্যাধি আনলি দেশে মাথা ঘোরা বুক জ্বালা।
 অল্প বয়সে পাকে চুল, কথায় কথায় লাগে ভুল,
রোদের সময় না কুল বাসা নেয় গাছের তলা।
 টিনে বলে তাই অভিমানে, বুঝবি কি তুই আমার মানে,
 শক্ত আমি ঝড়-তুফানে মহাজনে বাঁধে গোলা।
 আসল কথা তোরে শুনাই, আগুনে তুই ভস্ম আর ছাই,
সেই আশংকা আমাতে নাই, তাতে হই আমি উজালা।
 ছন বলে তা বটেরে বটে, দেখেছি গঞ্জের হাটে,
ছুটেছে আগুনের চোটে জ্বলে-পুড়ে মুখ কালা।
 মনো কয় ভালো রে ভালো, এখনে রায় দিতে হলো,
টিনের ঘরে কাজ নাই আমার, বাঁধ ছনের একচালা।

৪০

ছবকি ধামালে আমার কান করে ঝালাপালা।
 এখনে বাজাইয়ে দাও ঢিমে একতালা।
 মধ্যমানে মধ্যমান, আটকাইয়া ধরো প্রাণ,
মুলতানে উজান গেয়ে, ধেয়ে যাক উপরতলা।
 চৌতালে হয়ে চৈতাল, বেতালেতে দিচ্ছে তাল,
খেমটা খেয়াল তাল দিও না, থাকতে দাও নিরালা।
 সুর তান লয় জ্ঞান, জানি না অতি অজ্ঞান,
মনোমোহন কয় ধরা দে, প্রাণ, প্রাণের তানে এই বেলা ॥

৪১

জানো না কি মনের কথা
গান গেয়ে জানাতে হবে,
আপনি আপন হাসি কান্দি
পাগল সেজেছি ভবে।
 লোকের সঙ্গে কথোপকথন
মানুষ পাই না মনের মতন,
লিখে রাখি দুই-চার কলম
যা জাগে তাই ভাবে ভাবে।
যে সকল ভাব জাগে মনে
বিবিধ ছন্দ বন্ধনে,
ঢেলে দেই মা তোর চরণে
আশা আছে সকল দিবে।
যখনে যা শুনাই আমি
মনে করি শোনো তুমি,
আসার আশে থাকি চেয়ে
এ জ্বালা কবে জুড়াবে।
 জাগ্রতে না দেখে পাশে
থাকি গো স্বপনের আশে,
তুমি কেবল ছদ্মবেশে
কৌশলে ঘুরায়ে রবে।
ছাড়ো মায়া করো দয়া
পিতার প্রেমে দেহ কায়া,
মনোমোহন তোমায় লইয়া
আনন্দ কত করিবে।

৪২

টাকার থলি ভিক্ষার ঝুলি দুজনাতে ভারী গোল।
 কেহ কারে নাহি ছাড়ে, বলে কড়া কড়া বোল।
 ক্রোধে অতি হয়ে অন্ধ, থলি কয় ঝোলারে মন্দ,
বলে আমার কতই ছন্দ, বাজাই আমি ঢাক-ঢোল।
 তুই বেটা হাবাতে এসে, কাছে বসলি কোন সাহসে,
সবাই কাঁপে আমার ত্রাসে, কানাকড়ি তোমার মূল।
 ঝুলি কয় কাঙালের মতো, শোন রে থলি বুদ্ধি হতো,
কি সাধ্য তোর আমার মতো, আমি দেই অকূলে কূল।
 থলির মেজাজ গরম ভারী, বলে রাখ তুই সাধুগিরি,
রাজা-উজির আমি করি, হীরার বালা সোনার ফুল।
 ঝুলি কয় রাখো বাহাদুরি, জাঁকজমক তোর দণ্ড চারি,
আমি যারে কৃপা করি, তারে দেই সংসারে মূল।
 ভেবে কয় মনোমোহন, সাক্ষী আছে রূপ সনাতন,
গৌর নিতাই তারা দুভাই মুখে হরি হরি বোল।

৪৩

ডাক দেখি রে ডাকার মতো।
 ডাকতে জানলে ডাক ফুরাবে
প্রাণ জুড়াবে হলে রত।
 ডাকিস না তায় ফাঁকা স্বরে,
ডাক দেখি রে প্রাণ ভরে,
রইতে কি সে পারবে দূরে,
দেখবি রে তাঁর দয়া কত।
 প্রাণেতে মিশায়ে প্রাণ,
কাতরে করো আহ্বান,
উদয় হবে চৈতন্য চাঁদ,
মনোমোহন তাঁর অনুগত ॥

৪৪

তরি বাইয়া যা রে নাইয়া, জুমারি জুমারি,
হাল দিয়ে কাণ্ডারির হাতে, দাঁড় টান ভাই তাড়াতাড়ি।
 পাড়ি দিতে অকূল নদী আসমানে করেছে আঁখি,
ভয় করো না নিরবধি, গেয়ে চলো নামের সারি।
 পালের দড়ি কুবাতাসে, হাত রেখো পাছায় বসে,
আড়ি ধরে টান কষে, সুবাতাসে দিও ছাড়ি।
 ভ্রান্ত হলে পান্থের কাছে, সুধাইও পথ মাঝে মাঝে,
সে পথ যাদের জানা আছে, অজানা বিষম বৈরী।
 পড়লে নায়ের হট্টগোলে, ওই কাণ্ডারির চরণতলে,
পড়ে থেকো বিপৎকালে, সামলিয়ে দিবে তরি।
 মনো কয় যার মাঝি সুজন, ভাগ্যবান নাই তারি মতন,
মাঝির গুণে অধঃপতন, হলেম এবার মরি মরি।

৪৫

তাই বলি মন,
এই নিবেদন,
ভাবো বসি অকপটে।
বয়ে যাক না যুগ-যুগান্ত,
হয়ে যাক না প্রাণ অন্ত,
তথাপি হইও না ক্ষান্ত,
ভাবের তরি ধরো এঁটে।
 থাকলে পরে ভাবীর ভাবে,
আজ না হয় একদিন হবে,
ফুটলে আলো আঁধার যাবে,
কর্মডুরী সকল কেটে।
 ভাবাভাবে ভাবলে পরে,
কখন যেতে হয় না ফিরে,
মনোমোহন কয় পায়ে ধরে,
ভাবের ঘরে আছে বটে।

৪৬

তার নাম শুনে উদাসী হয়ে গেছে দুনয়ন,
ভয় করি না লোকনিন্দা, গুরুজনার গর্জন।
 মনে রে বুঝায়ে রাখি, বুঝে না তাই করি বা কি,
মনের সনে পাগল হয়ে গেছে দুনয়ন।
 নয়ন মন বিবাদী, কে হবে তার ফরিয়াদী,
পারে না তাই নিরবধি, মিথ্যা সাক্ষী দেয় মনোমোহন।
 সাধিতে সত্য জীবনে, বিপক্ষ বিবাদীগণে,
কি করিবে পাগল মনে, বিধির বিধি করে লঙ্ঘন।

৪৭

তারে কাছে ডেকে আন
তারে কাছে ডেকে আন ॥
যারে দেখলে জুড়ায় পোড়া আঁখি, ডাকলে জুড়ায় প্রাণ।
ভক্তি ভরে মধুর সুরে তারে কাছে ডেকে আন।
 ডাক দে ডাক দে তারে মমতা মাখিয়া সুরে।
 শিশুর মতো মা মা করে যে সুরে হয় প্রাণ জুড়ান।
 নয়ন রেখে রূপের পানে টেনে জাগাইয়া তোলো প্ৰাণ।
 চাঁদে চাঁদে মিশামিশি ক্ষণেক কান্না ক্ষণেক হাসি
মনোমোহন কয় ভালোবাসি, যে হাসির আর নাই ফুরান।

৪৮

তারে ডাকতে জানলে দিত দেখা, কইত কথা আমার সনে।
সে যে ডাক শুনে না, কয় না কথা, বুঝলাম আমি ডাক জানিনে।
 ডাকার মতন ডাকছে যারা, হয় না কভু তাঁরে হারা;
যে তারে দিয়েছে ধরা, যে ডেকেছে আকুল প্ৰাণে।
 শিশু যেমন মাকে ডাকে, জানে না আর অন্য কাকে;
সুখে-দুঃখে মা, মা, মা, মা, দেখে না আর মা বিনে।
 জলদে ডাকে চাতকে, ঝড়-তুফান করকে;
প্রাণ গেলেও তাকে ডাকে না সে, সে বিনে।
 বৃন্দাবনে ব্রজগোপী, রয়েছে যে ভাবে ডুবি;
সে ভাবে স্বভাব নিতে, হলো না আর আমা হতে।
 কামিনী কাঞ্চনে পথে, গোল বাজাইল হেঁচকা টানে।
 ডাকার মতো ডাকলে পরে, রইতে কি সে পারত দূরে;
দেখা দিত সে আমারে, কইতাম কথা প্রাণে প্রাণে।
 ডাকার মতো ডাক জানিনে, তাই তো তার দেখা পাইনে;
শিশুর কাছে ডাক শিখে নে, মনোমোহন কয় ভেবে মনে।

৪৯

তুমি কাছে ডেকে নিলে, আমি কি আর দূরে যাই
তোমারে পাইলে তবে, আর কিছু কি পেতে চাই ॥

খেলার ঘরে পেতে খেলা, খেল দিতেছ সারা বেলা
কখন জিতি কখন হারি, কি করি বুঝি না তাই ॥

হাসি কান্দি নাচি গাই, ঘুরালে ঘুরে বেড়াই
পেট ভরে দুবেলা খেয়ে, কখন শুয়ে নিদ্রা যাই ॥

কখন বাঁধি বাড়িঘর, কখন ভাবি আপন-পর
কখন বা করি নির্ভর, অকূল যখন দেখতে পাই ॥

কখন কখন স্বপ্ন দেখি, তুমি আমি মাখামাখি
কখন বা ঝরে দু আঁখি, কি জানি কি পেতে চাই ॥

কখন বা কার আশায় থাকি, চঞ্চল হয় প্রাণপাখি
আবার যেন কি ভেবে কি, লুকি দিয়ে থাকে তাই ॥

জন্ম-মরণ আগে পাছে, খেলোয়াড়ে খেল দিতেছে
মনোমোহনের মন ছুটেছে, খেল ভেঙ্গে কূল পেতে চাই ॥

৫০

তুমি তোমার আমি আমার, এই কথাতে জগৎ‍ চলে,
তুমি আমার আমি তোমার এই কথা পাগলে বলে।
 বুঝবি কি পাগলের বুলি, আমি কয়ে সব হারালি,
ঠকাইলি না ঠকে গেলি, জ্ঞানের বাতি দেখো না জ্বেলে।
 ছিলি বা কই এলি বা কই আছিস বা কই ভাবছিস তা কই,
আমি আমার কোন বুঝে হই, দেখলি তা কই বুদ্ধি বলে।
 ওই যে এক বেটা কানে কানে, কয়ে গেছে বুঝো সন্ধানে,
খুঁজলে পরে বুঝবি মানে আগে পাছে মিল করিলে।
 ছেড়ে আসল ঘড়ির কাঁটা, ভাবলি কেবল নয়টা-দশটা,
বাজনা বাজে হৃদয় মাঝে শব্দ ফুটে কোন কলে।
 কে বাজায় কোথায় বসে, আয় যাবি তার উদ্দেশে,
মনো কয় চল মন দেশে, বিদেশে বিপাকে মলে।

৫১

তুমি না জানাইলে তোমারে কে জানে।
ষড় দরশনে না পায় দরশন, অন্ত নাহি পায় বেদ পুরাণে।
 অবধি হইতে, পর্যন্ত পর্যন্ত, তব মহিমার নাহি আছে অন্ত;
অনাদি অনন্ত, সর্ব পরিব্যাপ্ত, জুড়িয়ে রয়েছ, ক্ষিতি বিমানে।
 বহুরূপী ভাবে, স্বভাব তোমার ভাবিয়ে কে পাবে অকূলে কিনার
তুমি হবে যার, হৃদয়ে তাহার, জানাইয়ে দাও আপনি আপনে।
 কঠোর তপস্যা, বেদ অধ্যয়ন, শ্বাস অবরোধ, কিংবা অনশন,
যাগ যজ্ঞ যোগ নিবৃত্তি শাসন, দ্বৈত জ্ঞান করি ভাবে সাধারণে
অদ্বৈত বিশিষ্ট অদ্বৈত, তোমারে কে জানে করে মতদ্বৈত,
যা আছে জগতে বৈধ কি অবৈধ, কর্তাকর্ম তুমি তোমারই বিধানে
চন্দ্র সূর্য গ্রহ ঘুরে অনিবার, ষড় ঋতু সঙ্গে, সঙ্গে সঙ্গে তার,
বিশান ক্ষিতি যোগে, হয়ে একাকার, এক বিনে দুই, নাই ভুবনে।
 অখণ্ড অসীম, পরম অব্যয়, খণ্ড জ্ঞানে, লণ্ডভণ্ড সমুদয়,
একেরই কাণ্ড বিশ্ব ব্রহ্ম অণ্ড, প্রকাণ্ডেতে খণ্ড ভাবে ক্ষুদ্র জ্ঞানে।
 ভাবিতে ভাবিতে হলে ব্রহ্ম ভাব, খণ্ড জীবে ফুটে প্রকাণ্ড স্বভাব,
স্থুল সূক্ষ্মাময়, ব্রহ্ম দয়াময়, কৃপাহি কেবল, সত্য এ ভুবনে।
 কারণের গতি, কর্মেতে বিকাশ, কর্মই কারণ, নিত্য চিদাভাস,
সৎ সত্য, সৎ স্বতঃস্বপ্রকাশ, বিনাশ নাহি আর মনোমোহন ভাবে মনে।

৫২

তুমি হে সকলের আদি, অনাদি পুরুষ প্রধান।
 সদা শিব নাথ তুমি, করো সতত কল্যাণ।
 নাশ হে অশান্তি রাশি, দাও শান্তি অবিনাশী,
তব প্রেম অভিলাষী, বিলাসী ক্ষিতি বিমান।
 প্রকাশিয়ে কোমলতা, দাও পূর্ণ কর্মঠতা,
মাখিয়ে স্নেহ মমতা, প্রেম সুধা করো দান।
 জীবনে সমরে তুমি, হও নাথ অনুগামী,
সারথী বিহনে আমি, শক্তিহীন যায় প্রাণ।
 মনে পূর্ণ বল দিয়ে, আত্মভাব প্রকাশিয়ে,
 সততা আমার হয়ে, করো কার্য সমাধান।

৫৩

থাকি যেন আনন্দ ভিখারি।
 আর কিছু ধন যেন কখন, কামনা না-করি।
 আনন্দে আনন্দ লয়ে, থাকি যে আনন্দ হয়ে;
কেবল আনন্দময়ে, আনন্দে হৃদয় ধরি।
 জগতে যা কিছু দ্বন্দ্ব, পাইতে শুধু আনন্দ;
ঐশ্বর্যতে ভালো-মন্দ, মাধুর্যে পূর্ণ মাধুরী।
 দয়াময় দয়াময়, দীনে যদি দয়া হয়,
আনন্দ করো উদয়, নিরানন্দ অপসারি।
 সে আনন্দে লাগে দ্বন্দ্ব, চাহি না সেই আনন্দ,
নিত্যানন্দ প্রেমানন্দ, পূর্ণানন্দ প্রাণে ভরি।
 পুলকে আপনহারা, হতে চাই পাগলপারা,
বহায়ে আনন্দধারা, হৃদিসিংহাসনোপরি।
 আনন্দে বসিয়া থাকো, আনন্দে আনন্দ মাখো,
রূপে প্রাণ ভরে রাখো, সেবক দাস তোমারই
মনোমোহনের কাঁধে ঝোলা, আর জানি কি আছে পরে।

৫৪

দীনবন্ধু বলে আমি ডাকিব না তোমায় আর,
গুছাইয়া কাছে ভঙ্গ দিয়েছো তুমি আমার।
দীনবন্ধু যদি হতে দিনের পানে ফিরে চেতে,
কান্দলে কোলে তুলে নিতে মুছাইতে অশ্রুধার।
হলে তুমি দয়াময় কাঙালের ছিল না ভয়,
ভয় পেলে পেত অভয় দূরে যেত দুঃখভার।
করুণাময় হলে পরে নিরানন্দ যেত দূরে,
পড়ে আছি অন্ধকারে কর্মডোরে বাঁধা সংসার ॥

৫৫

দয়াল নাম সুধা করে ভিতরে অমৃত কিরণ,
আয় রে জগতবাসী, লভিতে পরম ধন।
পাপী তাপী দুঃখী নর, হও সবে অগ্রসর,
জুড়াতে ত্রিতাপ জ্বালা, চরণে লও শরণ।
এমনি নামের গুণ, যেন বাতাস আর আগুন,
ঠেলে উঠে ফুটে ব্রহ্ম, সচ্চিদানন্দ ঘন।
সবে অবারিত দ্বার, ছোটো-বড়ো নাই বিচার,
দেখবি যদি আয় সকলে, ডাকিছে মনোমোহন।

৫৬

দরদি, কয়ে দে তার নিগম কথা তারে পাবো কই।
যারে ডাকলে হৃদয় শীতল হয় গো, দেখলে আপনহারা হই।
 যার লাগিয়ে হৃদয় মন, ঘুরে বেড়ায় অনুক্ষণ,
যার মধুর নামটি শুনলে পরে, ভবজ্বালা ভুলে রই।
 মনোচোরে মন নিয়ে, কোথা গেছে লুকাইয়ে,
কেন্দে মরি ধরতে নারি ধরি ধরি আর না পাই।
 যার সনে মন মাখা জোখা, তারে বিনে যায় কি থাকা,
মনোমোহন বলে আমি, কেমনে বা একা রই ॥

৫৭

ধীর গম্ভীর মনে—
ব্রহ্মনাম গাও রে।
সকলে সমপ্রাণে,
চরণ পানে ধাও রে।
এ জীবন মন—করো সমর্পণ,
সকলই তাঁরে দাও রে।
দিতে পরিত্রাণ, করুণা নিধান  
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রয়েছে এই চাও রে।
এই শুভ দিনে, নীরব কখনে,
থেকো না থেকো না, সকলে মিলে আও রে ॥

৫৮

নামে রূপে দুজনাতে লাগল ঘোর বচসা।
 শুনে সব সাধু গুরু দেখতে এল তামাসা।
 নামে কয় রূপের মন্দ নামে রূপে দোঁহে দ্বন্দ্ব,
শুনিতে বড়ো আনন্দ, জবানবন্দি দেয় খোলাসা।
 নাম বলে আমি কাণ্ডারি, সাজাইয়া ভাবের তরি,
সাধুজনায় পার করি, যে করেছে আশা।
 রূপ বলে ক্রুব্ধ হয়ে, আমি দেই চক্ষু ফুটায়ে,
অন্ধকারে আলো দিয়ে, তবে হয় রাস্তা খোলাসা।
 নাম বলে আমি আগে, জাগাইয়া দেই ডেকে ডেকে,
সতত হৃদয়ে থেকে বাড়াই ভালোবাসা
রূপ বলে তুই বেটা অন্ধ, কেন করিস মিছে দ্বন্দ্ব,
আমি ঘুচাই সকল সন্দ, ছুটাইয়া দেই কুয়াশা।
 দুজনায় দেখে বিকল, মনোমোহন হাসে খলখল,
বিবাদভঞ্জন করে বলে, প্রভেদ নাই তার রতি মাসা।

৫৯

নয়ন টানে, টানে গো এই রূপের পানে
আমার মন মিশেছে যাহার সনে
যার পরশে হয় সরস হৃদয়
দর্শনে যার হর্ষের উদয়
সেই মনের মতন মানুষ রতন বেঁধে রাখি কোন সন্ধানে
জাগরণে তারে না দেখিতে পেয়ে
ঘুমের আড়ালে থাকি নয়ন দিয়ে
যদি স্বপ্নের ঘোরে দেখা দেয় যে মোরে, বাঁধিয়া রাখিব স্বপনে
এত ভালোবাসি এত যারে চাই
সে কি আমার কথা ভাবে না রে ভাই
যেন আকুল পিয়াসা ব্যাকুল আবেগে তাহার আনিবে ডেনে
নয়নে নয়নে রাখিব বান্ধিয়া
কাঙালের পাখি যাবি কই ছুটিয়া
বলে মনোমোহন মন ভুলান মন, বাঁচি না তোমারে বিনে!

৬০

নালতা আর ধানে একদিন লাগল ঘোর বচসা,
শুনে সব গ্রামের লোক, দেখতে এল তামাসা।
 নালতায় কয় ধানেরে মন্দ, সকল জমি করলে বন্ধ,
তোমার লাগি পালেম না আমি একা হতে বাদশা।
 আমি যারে কৃপা করি লোহার সিন্দুক টিনের বাড়ি
নাম খুলায়ে দেই বেপারি, নারায়ণগঞ্জে যাওয়া-আসা।
 চলতি হয় তার রাজ্য ছাড়া, কথা কইতে দেয় হাত নাড়া,
যত ছোটো মানুষ বড়ো করা, আমার কার্য হামেসা।
 নানা রঙের ধুতী শাড়ি, আনি দেই গৃহস্থনারী
পড়ে বেড়ায় কুটুমবাড়ি, কি সুন্দর খাসা।
ধান বলে রাখো বাহাদুরি, কার জোরে হয় দৌড়াদৌড়ি,
আমি যদি জগৎ ছাড়ি হবে কি দশা।
শোন বলি তোরে জঘন্য, ক্ষুধায় যদি না পায় অন্ন,
সকল হয়রে ছিন্নভিন্ন, মান্যগণ্য সব মিছা
মনোমোহন কয় সত্য বটে ধান থাক মোর শিরে উঠে,
হা ভাত এল নালতার ঠোঁটে, করো না রে গোসা।

৬১

পথ দেখায়ে দাও আমারে
কেমনে যাব তোমার কাছে।
তুমি নইলে কে দেখাবে,
তোমার মতন আর কে আছে।
ছিলাম আছি তোমার কোলে, খেলাতে দিয়েছো ঠেলে,
খেলায় ভুল পথ ভুলেছি, অন্ধকার ঘেরিছে পাছে।
 দৌড়াদৌড়ি করে সরে পড়ে গেছি অনেক দূরে
এখন আবার তোমার ধারে যেতে প্রাণ কেঁদে উঠেছে।
 পথ দেখি না কেমন করে যাব বলো তোমার দ্বারে,
আমার পথে একা আমি, যার যার পথে সব চলেছে।
 পথভ্রান্ত পান্থ আমি অভ্রান্ত নাবিক তুমি
সকাল সকাল দেও না বেয়ে, বেলা তো বাড়িয়া গেছে।
 পাথেয় যা ছিল সঙ্গে, খরচ করে নানা রঙ্গে
আতঙ্কে মরি তরঙ্গে, ওপার যাওয়া দায় হয়েছে।
প্রভু আমায় দয়া করে, অনুকূল বাতাসের জোরে
টেনে লও হে তোমার দ্বারে মনোমোহন নইলে ঠেকেছে।
 শুনেছি আমি লোকের মুখে তোমার নামে কেউ না ঠেকে
যত পাপী-তাপী পাড় করিতে, তোমায় তারা দেখেছে।
 পথহারা হয়ে পথে পড়িয়ে ঘোর বিপদে
শুনছি আমি দিয়েছো পথ যে তোমায় একবার ডেকেছে।

৬২

পাগলা রে মন-
যে তোরে করেছে সৃষ্টি ভাবো তাহারে।
তুচ্ছ করো লোক-নিন্দা,
মান-অপমান দেও ছেড়ে।
 ছিলে বা কই, এলে বা কই,
ভাবো বসে যাবো বা কই,
আমি তুমি কার বা কে হই-
কার চাকরি কেবা করে।
জন্ম-মরণ আছে লেখা,
পাবি না তুই কারো দেখা,
যেমন চিত্রপটের চিত্র আঁকা—
ধর গে সেই চিত্র করে।
 খেলার ঘরে হয়ে গুটি,
আসল কাজে দেখি ত্রুটি,
মনোমোহন কয় মোটামুটি—
উজান চলো ভাটি ছেড়ে।

৬৩

পান-তামাকে দুইজনাতে বিবাদ হয়।
দেখে সব রাজা প্রজা, শুনতে এল সমুদয়।
 পানে কয় তামাকের পোয়া, তুই তো কেবল ধুঁয়া ধুঁয়া,
আমি আসল তুমি জুয়া, বৃথা করিস অর্থ ব্যয়।
 আছে তোমার যত ভক্ত, কাশতে কাশতে চক্ষু রক্ত,
আমাতে যে অনুরক্ত ঠোঁট দুখানা লাল হয়।
 কাছে ছিল গাঁজায় কল্কি, ভারি রাগ তার শুনে কয় কি-
মুখ সামলায়ে বলিস সখি, করব নইলে বিপর্যয়।
 তামাকে কয় বটেলা চোটে, মানুষগুলো খেটে খেটে,
ভ্রান্ত হলে ধুলার চোটে, শান্তি লভে সে সময়।
 গাঁজা কয় আমি তো মজা, লোকের বুদ্ধি করি তাজা,
পানে কয় পশ্চাতে সাজা, রক্তস্রাবে মৃত্যু হয়।
 আমি পান সকলের মনে, ফূর্তি দেই রাত্রদিনে,
দেবতারাও আমায় মানে, ইতিহাসে ডেকে কয়।
 পান-তামাকের দেখে দ্বন্দ্ব, মনোমোহন কয় করো বন্ধ,
কলির জীবে দুইই সমান, গাঁজা কিন্তু ভালো নয়।

৬৪

পারলেম না রে স্বভাব বানাতে।
 সন্ধ্যা পূজায় কি হবে তায়,
না থাকলে মন আপন জোতে।
 কি করব আর বলো আমি,
অন্তরেতে অই রাম রামী,
কিছুতে না যায় ফইছকামী,
সুখী হয় সে খোসনামীতে।
 সোনার খাঁচায় পালতেছি কাক,
যায় না তার স্বভাবের ডাক,
দুধ-কলাতে মন ওঠে না,
তুষ্ট বিষ্ঠা ভক্ষণেতে।
 নিজে হয়ে বেদম বেহুঁশ,
খুঁজে বেড়ায় পরেরই দোষ,
কথায় কথায় করতেছে রোষ,
অবিচারে যাতে তাতে।
 পাজী মন কথা শুনে না,
চোখ থুয়ে হয়েছে কানা ঘু
রেফিরে তা না না না,
আনাগোনা দিনে রাতে।
 স্বভাব হয় সাধনের মূল,
স্বভাবেই ফোটে ফুল,
এ কূল সে কূল গেল দুকূল,
পারলাম না স্বভাব নিতে।

৬৫

প্রভু, তোমার কয়টি নাম পেয়েছি সুন্দর।
 যারে শুনলে পরে সুশীতল হয় তাপিত অন্তর। 
তুমি অভাবের ভাব,      ভাবীর স্বভাব,
অন্ধকারে সুধাকার।
তুমি জীবন সফল,      দরিদ্রের বল,
মহাপাপীর পাপ হর।
তুমি ভবতারণ,       আদি কারণ
পতিতপাবন পরাৎপর।
তুমি দয়ার নিধি,       প্ৰেম জলধি
শান্তি সুধা সরোবর।
তুমি হৃদয় রঞ্জন,       বিপদ ভঞ্জন,
শ্বেতবরণ কলেবর।
তুমি সদয় নিদয়,       আনন্দময়
হও দয়াময় নাম ধরো।
তোমার নামে আছি      জীবন ধরি
দীনভিখারী যাচে বর।
নামে পূর্ণ করো মন,       মনোমোহন,
মজে থাকুক নিরন্তর।

৬৬

প্রাণ দিলে কি ভোলা যায়, যে দিয়াছে সে জানে।
 শয়নে স্বপনে জাগে আপনা হইতে টানে।
 মনে করি ভুলি ভুলি আবার বলি কেমনে—
ভুলিতে আপনা ভুলি তাহারে হইলে মনে।
 ভালোবাসা মহামন্ত্রে হইয়াছে দীক্ষা যার,
সে জনে বলিতে পারে কেমনে মহিমা তাঁর।
 অপ্রেমিকে বুঝাইতে নিষ্ফল সাধনা হায়
বালকে রমণ সুখ যেমতি বুঝান দায়।
 ধীরে ধীরে আকর্ষণ কি মধুর আস্বাদন
তুচ্ছ হয় তার কাছে ধন-মান এ জীবন।
 তাই সে প্রেমিক কবি নিশিদিন জেগে থেকে
ভাবুক আকুল প্রাণে সুখে-দুঃখে থাকে সুখে।

৬৭

প্রেম কি কখন গাছে ধরে।
 আম কাঁঠাল নয় পেড়ে খাবি
ঝাঁকা দিলে নাহি পড়ে।
প্রেম কি লো সামান্য বটে, প্রেম কি সবার ভাগ্যে ঘটে
প্রেমের কথা ঘাটে-মাঠে, রটে কেবল মূর্খ নরে।
 প্রেম পাহাড়ে আছে খনি, জ্বলতেছে তায় পরশমণি
পথে কালভুজঙ্গিনী নিঃশ্বাসে তার প্রাণ হরে।
 কাম ক্রোধ লোভ হিংসা চারিদিকে বাঘের বাসা
ঘৃণা লজ্জা ভয় ইত্যাদি, খেঁকশিয়ালে খেউ খেউ করে।
 শুদ্ধরাগ মন বৈরাগী, যে জন হইছে সৰ্ব্বত্যাগী
ভয় নাই কিছু তারি লাগি, পলায় শত্রু হুংকারে।
 প্রবেশিয়া প্রেমপুরীতে, বিচ্ছেদের বিষ পায় দেখিতে
বিষপানে হয় বিশ্বম্ভর সে, যদি হজম করতে পারে।
 মনোমোহন সে বিষের জ্বালায় ছটফট করে ঘুরে বেড়ায়
নুনের ছিটা দেয় কাটা ঘায়, দরদী নাই এ সংসারে ॥

৬৮

প্রেমবাজারে পরশমণি
বিনামূল্যে বিকিয়ে যায়।
 তোদের মরিচা ধরা লোহা তামা
যার যা আছে নিয়ে আয়।
 শিয়ালের শিং সাপের পাঁচ পা
আকাশকুসুম আয় দেখে যা
শুকনা ডালা হয়ে তাজা
ফুল ফুটিয়ে গন্ধ বিলায়।
 সিংহদরজায় নাই দারোয়ান
নাইকো কারো কৈতব গুমান
হাড়ি মুচী সবাই সমান
প্রেমানন্দে নাচে গায়।
 মনোমোহন কর্ম দোষে
ইহা-উহা ভাবছে বসে
দিন কাটাইলাম রঙ্গরসে
যমদূতে যে চোখ পাকায় ॥

৬৯

প্রেমবাজারে হরির নামে লুট বিলায়।
 নামে প্রেমে লুটালুটি
সাধ থাকে যার নিবি আয়
প্রেমবাজারে হরির নামে লুট বিলায়।
 
প্রেমবাজারে বিকিকিনি
নামের সন্দেশ নামের চিনি
আর কি থাকে ভুখার ক্ষুধা
সেই মিঠাতে মিঠা পায়।
প্রেমবাজারে হরির নামে লুট বিলায়।
 
মণ্ডা-মিঠাই মুখের মিঠা
গুরুর নামে হৃদয় মিঠা
যে পেয়েছে প্রাণের মিঠা
মুখের মিঠা সে কি চায়?
প্রেমবাজারে হরির নামে লুট বিলায়।
 
যে মিঠাতে নারদ ঋষি
বীণা বাজায় দিবানিশি
যে মিঠাতে গৌর নিতাই
ধুলায় গড়াগড়ি যায়।
প্রেমবাজারে হরির নামে লুট বিলায়।
 
মনোমোহন কয়, মিঠার লোভে
তিতা খেয়ে আছি ডুবে
পাইলাম না ওই সুধা মিঠা
যে মিঠাতে প্রাণ জুড়ায়।
 প্রেমবাজারে হরির নামে লুট বিলায়।

৭০

বসিয়াছি তব দ্বারে,
কোথাও যাব না ফিরে।
ভালো-মন্দ যাহা দাও
নিব অবনত শিরে।
 বিশ্বরাজ্যে তুমি রাজা,
আমি দীনহীন প্রজা,
পড়ে আছি এক কোণে,
একখানা কুঁড়েঘরে।
 একচ্ছত্র অধিকার,
সংসারে শুধু তোমার,
লঙ্ঘিবারে সাধ্য কার,
তব আজ্ঞা জোর করে।
যখন যা ঘটে,
সাধ্য কি যে যাব কেটে,
তাই বসেছি অকপটে,
মুক্ত হস্তে তব দ্বারে।
 করাও যদি করব হেসে
না করাও তো রবো বসে,
উপবাসী রাখলে রবো,
দিলে খাব পেট ভরে,
সুখে-দুঃখে সমভাবে,
থাকতে যেন পারি ভবে,
মনোমোহন কয় তবেই হবে,
গুরু যদি কৃপা করে।

৭১

বুঝে বুঝলি না তুই মন রে কানা
বাজে খরচ করে কেবল হারাইলি ষোল আনা ॥

যা ছিল তা নিল টেনে, কামকামিনী মদন বাণে
আরও যা ছিল বিষয় গুণে, টানতেছে বিপর্যয় টানা ॥

শোন বলি ও আমার মন, ঠিক থাকে না তোমার ওজন
কামিনী আর পেয়ে কাঞ্চন, আহ্লাদে হলি আটখানা ॥

চল্লিশ সেরে ঠিক হয় কাঠা, বুঝিস না তুই পাগলা বেটা
ঘুচায়ে দে সকল লেঠা, ওজন হয়ে ষোল আনা ॥

মনের গুণে মনোমোহন, পেল না রে গুরুর চরণ
গুরু দত্ত অমূল্য ধন, হল কেবল কানে শোনা ॥

৭২

বেলা গেল সন্ধ্যা হলো,
আমায় ডেকে নে মা কোলে,
এমন সময় বলো দেখি মা,
কে কার ছেলে থাকে ভুলে।
 
খেলতে দিলে হলো খেলা,
খেলার নেশায় গেল বেলা,
হাত বাড়ায়ে আছি বসে
কোলে যাবার সময় বলে।
 
সারাদিন পথে পথে,
খেলছি তাদের সাথে,
ধূলারাশি লেগেছে গায়
ঝেড়ে নে মা আঁচলে।
 
খেলত যারা সঙ্গে জুটে,
যে যার মায়ের কোলে উঠে,
গেল তারা পথহারা
আমি কান্দি মা মা বলে।

৭৩

ভবের বাজার হাসপাতালে
রোগীর আর্তনাদে হৃদয় কম্প,
কান ফেটে যায় কোলাহলে।
 
যত দেখো সুখী ভোগী,
কেউ ভালো নয় সবাই রোগী
চিন্তা জ্বরে জ্বলে মরে,
এ জ্বালা জুড়ায় না জলে।
 
পুত্র কিম্বা পতি-শোকে
যা হয়েছে কারো বুকে,
জল ঝরিছে সবার চোখে,
ঔষধি তার নাহি মিলে।
 
দীনহীন কি ধনী মানী,
ঠিক নাই কারো মনের
মণি ঘুমে মরে দিন রজনী,
হৃদয় জ্বলে দাবানলে।
 
কাম-কামিনী রাজযক্ষ্মা,
এ রোগে নাই কারো রক্ষা,
ধন্বন্তরী দিচ্ছে ব্যাখ্যা,
অসাধ্য নিদানের বলে।
 
যদি হয় অসাধ্য ব্যাধি-
হুরির নামই মহৌষধি
মহাজনে দিচ্ছে বিধি,
বেদ বিধি কোরানে বলে।
 
মনোমোহনের মনোরথ,
ভাই ভেবে না পেয়ে পথ,
গাছতলাতে করছে বসত,
যা হবার কপালে।

৭৪

ভাবান্তরে কেন ভাবাও।
জাগিয়ে ঘুমিয়ে থাকো, ফিরে নাহি চাও।
 কেন্দে কেন্দে সারা, দিবে নাহি তুমি ধরা
সত্য যদি আসিবে না, কেন বা কান্দাও।
 কাঙাল হয়ে এসে দ্বারে, নিরাশ হয়ে যাব
ফিরে দয়াময় নাম কেমন করে রবে তা জানাও।
 এ দীনে সদয় হয়ে গোপীর ভাবে ভাব ধরায়ে
রাখো তোমার পায় জড়াবে দূরে না সরাও।
 হা-হুতাশে দূরে থেকে, মরি সদায় তোমায় ডেকে
আমি বা কে তুমি বা কে, কেন রে ভুলাও।
 ভক্তহীন মনোমোহন, তাই তার এত হয় বিড়ম্বন
আর পারি না হৃদয়ের ধন হৃদয়ে জাগাও ॥

৭৫

ভালোবাসি বলে রে শ্যাম এত দাগা সয়ে থাকি।
 নইলে কি আর সইত এত, ভাঙতে খাঁচা উড়ত পাখি।
 তোমার আমার ভালোবাসা, যেমন মহাজনের সুদক্ষা
কম হইলে তার রতি, মাষা, উল্টিয়ে থাকো আঁখি।
 ভেবে কয় মনোমোহন, ম্যাদের সংখ্যা নাই নিরূপণ
ঋণ ফুরায় না জন্ম-মরণ, সুদের সুদ তার থাকে বাকি
কয়বার বাকি, কয়বার টান, এ বাকির আর নাই ফুরান
জমা খরচ করে সমান, চোখ মুদিলে সব ফাঁকি।

৭৬

ভুল বলে তুই, হারাস নে রে মূল।
যে জন আছে বিশ্ব জুড়ে, নাই বলবি কেমন করে,
হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে, ডুব দিয়ে তুই রত্ন তোল।
 সাড়ে তিন পেঁচ বেড়ার মাঝে, পৈত্রিক ধনের গোলা আছে;
সাপিনী তার চৌকি দিছে, যে ধরেছে পাইছে মূল।
 কুলকুণ্ডলিনীর কূলে গেলে ভক্তিবলে,
বোঁটা ছাড়া ফোটা আছে, দেখতে পাবি দুটি ফুল।
 
হরির নাম লম্ফ দিয়ে, মদ খেয়ে মাতাল হয়ে,
এমনি ধন কি যাবে লয়ে, করে মিছা গণ্ডগোল।
 না হইলে আত্মবোধ, হয় কি জীবন্ত রোধ,
ভুল বুঝে কি জগৎ আছে বেদ বেদান্ত সবাই ভুল?

ঈসা-মুসা শ্রীচৈতন্য, সেই প্রেমেতে অচৈতন্য
ভেবে শূন্য হলি শূন্য, শূন্য পায় সে হইলে ভুল।
 পুরুষ নির্গুণ ব্রহ্ম, লীলাতে স্বগুণ কর্ম,
বুঝে দেখ না সূক্ষ্ম মর্ম, অবতীর্ণ সূক্ষ্ম স্কুল।
 
এ মায়াপ্রপঞ্চে ভুলে, আত্মতত্ত্ব আছো ভুলে,
ভুল তোমারই ভুলের মূলে, কভু নয় সে নামটি ভুল।
 নামে চলে বাতাস হয় রে প্রকাশ,
যে পেয়েছে নামের মর্ম, ছেড়ে দিছে মালের কোল।
 
ভেবে বলে মনোমোহন, সত্য আছে মহাজন,
করে দেখ রে ওজন মাধ্যাকর্ষণ মূল।
 
তুই মনে ভেবে দিগ, হারাইলি রে দিক
আসলেতে ঠিক থাকিলে, অকূলেতে পাইতি কূল।

৭৭

মৎস্য-মাংস নিরামিষে দ্বন্দ্ব হলো ঘোরতর।
 দেখে সব জগতের লোক হলো আসি একাত্তর।
 মৎস্য-মাংস কয় সরোষে, দুর্বল করে নিরামিষে,
বলীর বল বাড়াইতে মোরা নিত্যই আছি অগ্রসর।
 হিন্দু নারীর স্বামী মইলে, নিরামিষ খায় দুঃখে জ্বলে,
হয়ে শক্তিহারা কপাল পোড়া যৌবনে হয় জড়সড়।
 যতসব অভাগার ছেলে, তারা মোদেরে মন্দ বলে,
তন্ত্র শাস্ত্র দেখ খুলে, বিধি আছে বহুতর।
 না হইলে শক্তি বৃদ্ধি হয় না কখন শক্তি সিদ্ধি,
তাই রয়েছে শিবের উক্তি, পঞ্চমকার করো নর।
 তা শুনে নিরামিষে কয়, ওসব কথা রাখো মহাশয়,
মিলে যত সব দুরাশয়, জীব হিংসা করে মর।
 সর্বদা মাংস ভক্ষণে, হিংসা বৃত্তি বাড়ে মনে,
কাম ক্রোধ লোভ মোহ, সবাই বাড়ে খরতর।
 নিষ্কামী বৈষ্ণবের প্রাণে, আমি দেই বৈরাগ্য এনে,
শুদ্ধ ভক্তির আকর্ষণে, পবিত্র হয় অন্তর।
 তুই বেটা জোর জবরে, দ্বন্দ্ব লাগাস ঘরে ঘরে,
আমি যত পরস্পরে, টেনে আনি একত্তর।
 করে দেই চিত্তশুদ্ধি, প্রাণে দেই শ্রদ্ধা ভক্তি,
মনোমোহন কয় ভালো উক্তি যার যা রুচি তাই কর।
 না পাইলে ভাবের সঞ্চয়, নিরামিষে কিছু না হয়,
স্বভাবে যার আছে সত্য কাজ নাই তার বিধি বিধানে।

৭৮

মন ঠিক করো-
মন ঠিক করো।
হইল মাচাতে আসন ধরে
শক্ত করে বৈঠা ধরো।
পাল্লাতে করো ওজন,
ষোল আনার কম পড়িলে,
হইবে ফাঁফর।
 নিক্তির কাঁটা ঠিক হইলে,
আপনি তরি উজান চলে,
পাড়ি মেরে অবহেলে,
ভেদ থাকে না আপন-পর ॥

৭৯

মন তুমি আছো কোন তালে?
দিন থাকতে লও হরিনাম, কাঁদবি রে দিন গেলে।
 কার বা বাড়ি কার বা ঘর, কে হয় আপন কেবা পর
কোনদিন জানি টান দিয়ে লয় তোরে কোলে।
 কোথায় রবে রঙ্গ-তামাসা, কোথায় যাবে মনের আশা
দালান কোঠা, ভাঙবে বাসা, ভস্ম হবি গাঙের কূলে।
 চক্ষু কর্ণ নাকে মুখে, সাফ করিছ সাবান মেখে
পুড়ে যাবে আগুন লেগে কিম্বা কাকে খাবে খুলে।
 মাটির দেহ হবে মাটি, হওয়ার আগে হও না খাঁটি
ছেড়ে দাও সব পরিপাটি, লাঠি-শোঠা রাখো তুলে।
 শোনো রে মানুষ বলি তোরে, স্বপন দেখিস নেশার ঘোরে
ভাঙলে নেশা পাবি দিশা হিসাব দিতে লাভে-মূলে।
 মনোমোহন কয় বিনয় করে, ধান্দাবাজি বুঝে নে রে
আন্ধার মতো ঘুরিস না রে ডাকো রে হরিবল বলে।

৮০

মনে মুখে আলাপ করে,
অতি গোপনে।
পাড়ার লোকে শুনলে পাছে,
লজ্জা দুজনে।
 
মুখে কয় হরি হরি,
মনে চায় বাবুগিরি,
বাক্স ভরা টাকাকড়ি,
জমিদারি কিনে।
 
মুখে কয় সন্ধ্যা নমাজ,
মনে কয় সহে না ব্যাজ,
কত কাজ ধরি ব্যাজ,
ভাবে সন্ধানে।
 
মুখে সত্য সরলতা
মনেতে কপট গাঁথা
ভিতরে কালী উপরে সাদা,
দেখি নয়নে।
 
প্রকাশিয়ে গৃহ ছিদ্ৰ
মনোমোহন হয় অভদ্র,
মন মুখে হয় একত্ৰ,
তত্র হরি দেখো ধ্যানে।

৮১

মানুষে যা মন্দ বলে, তাই আমার কর্তব্য করণ
ভালোর দিকে যেয়ে দেখছি স্মরণ হয় না জন্ম-মরণ ॥
দেখেছি গৃহস্থের বাটী, ঝাঁটা দিয়ে সকলি ঝাঁটি
পদ পচ্‌লা বিষ্ঠামাটি, এক জায়গাতে করে রক্ষণ ॥

কদিন পরে সার ভাবিয়ে, নেয় তারে মাথে তুলিয়ে
ফসল গাছের গোড়ায় দিয়ে আনন্দিত চাষার মন ॥

সার পেয়ে তার জোরের চোটে, ফল ধরে তায় ফুলও ফোটে
মনোমোহন কয় অমনি বটে, ও মন তোমার সাধন-ভজন ॥

৮২

যতই দূরে সরবে তুমি,
ততই আমি যাব ছুটে,
যতই তুমি নিরশ করবে,
ততই আশা রাঁধব এঁটে।
যতই সাধরে ঘুমের লেগে,
ততই আমি উঠব জেগে,
যতই তুমি ছুটতে চাবে,
ততই ধরব শক্ত মুঠে।
 যতই তুমি দিবে মন্দ,
যতই তুমি করবে দ্বন্দ্ব,
ততই আমার ঘুচবে সন্দ,
অন্ধ আঁখি উঠবে ফুটে।
 যতই তুমি অভাব দিবে,
ততই প্রাণ আকুল হবে।
যতই তুমি ফেলবে নিচে,
ততই যাব উপরে উঠে।
যতই আড়ি ধরবে তুমি,
ততই সোজা আমি.
মনোমোহন কয় নিদয় সদয়
সকলই দয়া বটে।
হৃদয় স্বামী নিদয় তোমার দয়া বটে ॥

৮৩

যাব না সজনী আর সে দেশে
যে দেশের মানুষের সনে মন না মিশে ॥

স্বদেশে পড়িয়ে রব, বিদেশে আর নাহি যাব
অনিমেষে চেয়ে রব বাঁশি বাজায় কে এসে ॥

আকাশে পাতিয়ে কান, শুনিব বাঁশির তান
সঁপে দিব মনপ্রাণ চরণ উদ্দেশে ॥

অকৈতব প্রেমচ্ছটা, কৈতব হয় ঘোর
ঘটা একা আমি সঙ্গে ছয়টা চালায় তরি বেহুঁশে ॥

প্রাণের মানুষ প্রাণে লয়ে, আড়ালে রব লুকায়ে
নিরবিলা কথা কব দুজনে বসে ॥

প্রাণেতে মিশায়ে প্রাণ, গাহিব প্রাণেরই গান
আকাশেতে উঠিবে তান, মানুষের তালাসে ॥

মানুষে মিশায়ে মন, করো মন আরাধন
কহিছে মনোমোহন, আছে সে মানুষে ॥

৮৪

যাবি যদি মন ফকির হাটা,
মুর্শিদাবাদ গিয়ে তবে, পরওয়ানা লও মোহর আটা।
 ধরিয়ে পিরের কদম খেজমতে করো নরম,
যতক্ষণ থাকে দম, ভুল না সেই এক কথাটা।
 ইমাম করে বসে থাকো, সবুর পরহেজ রাখো,
হুজুরি দীলেতে ডাকো, শক্ত করে বুকের পাটা।
 সেই হাটের দোকানী যারা, জেতা নয় কেও সবাই মরা,
মরতে পারলে দিবে ধরা, জেতা মরা শক্ত লেঠা।
লইলে কলঙ্কের ডালি, সইতে পারলে গালাগালি,  
পুড়তে পুড়তে হলে ছালি, ধূলাবালির খেয়ে ইটা।
 সার করিয়ে জঙ্গলা ঝোপ দিল দরিয়ায় মারলে ডুব।
 মনোমোহন কয় ছাড়লে লোভ কিঞ্চিৎ পাওয়া যায়।

৮৫

যেয়ে গোচারণে,        ধেনু দিয়া বনে,
প্রেমানন্দে মনে যত রাখালে।
করে করে ধরি,      নাচে ধীরি ধীরি,
একে আর বেড়ি তমালে।
লতা পত্র যত,      পুষ্পভারে নত,
নববধূর মতো হাসে আড়ালে।
লীলারসে মন,      করিয়ে মগন,
নাচে বা কখন দুবাহু তুলে।
যমুনার জল,      করে ছলছল,
সুন্দর শ্যামল হরি হেরি কূলে।
প্ৰফুল্ল কমল,      হেসে ঢলঢল,
লুটে পরিমল মধুপ দলে।
কেহ নামে জলে,       কেহ উপকূলে,    
কেহ বৃক্ষমূলে বনমালা গলে।
কেহ ভাঙে ডাল,       কেহ মারে ফাল
কেহ দেয় গাল কালো কোকিলে।
কেহ কাছে আসি,      টেনে ধরে বাঁশি,
কেহ হাসি হাসি নাচে তালে তালে।
যোগারাধ্য ধনে,       সে রাখালগণে,
নিয়ে গোচারণে অতি কৌতূহলে।
কেহ কাঁধে চড়ে,      কেহ ধরে মারে
কেহ এসে তারে বেড়ে ধরে গলে।
কেহ কহে ভাই,       বিনে কথা নাই,
বলিহারি যাই মনোমোহন বলে।
হেন লীলারসে,        মন নাহি মিশে,
পাষাণ হতে সে সুকঠিন বলে ॥

৮৬

যার জন্যে তুই ঘুরে বেড়াস সে দেখি তোর হৃদয় মাঝে।
 মনকে লয়ে নীরব ঘরে বস যেয়ে তুই আপন কাজে।
 আপন ধরে ঘরের কোণে, আলাপ করো মনের সনে,
তারে বাধ্য করো তত্ত্বজ্ঞানে, গরলাংশ ফেলাও বেছে।
 সরল ভাবে লয়ে ভক্তি, বিবেক পুত্রের শুনে যুক্তি,
বৃদ্ধি করো মনের রতি, শ্রীপদ সরোজে মজে।
 মিষ্ট কথা আলাপনে, সদর রাখো টেনেটুনে,
মুক্ত হলে প্রাণে প্রাণে, মিলবে রতন খুব সহজ।

৮৭

যার মন উদাসী হয়েছে-
পাগলা রে।
হিন্দু-মুসলমান কে হয়
চিনি না তারে।
 বুঝতে নারি ছোটো-বড়ো
চিনতে নারি আপন পর,
ব্রহ্মাণ্ড বাঁধিয়া রাখছে, দেখি এক তারে।
বাগদি হাড়ি, চাঁড়াল, মুচী,
কোনটা শুচি হয় অশুচি,
দেখি সকাল ভোজের বাজি, রাজি নয় সে ভেদ বিচারে,
অখণ্ড মণ্ডলাকার
ব্যাপ্ত বিশ্ব চরাচরে,
যা দেখি সব একের খেলা এক বিনা আর নাই সংসারে।
 মনোমোহনের মন বাবাজি,
ভাঙা তরি, বেহুঁশ মাঝি,
লোচ্চার লোচ্চা,
পাজির পাজি, কেবল বকাবকি করে ॥

৮৮

যার সনে যার মন বাঁধা
নয়ন বাঁধা যার রূপে,
সে কি তারে ভুলতে পারে,
একেবারে যে গেছে ডুবে।
 
চণ্ডীদাস আর রজকিনী,
বিল্বমঙ্গল চিন্তামণি,
তারা প্রেমের শিরোমণি,
মিশে গেছে ভাবে ভাবে।
 
এক রশিতে দুজন বাঁধা,
কখন হাসা কখন কান্দা,
মনোমোহন হলো আঁধা,
পিঁপড়ায় খাইল গুড়ের লাভে।

৮৯

যারে দেখতে আকুল, দেখবি যদি, শোন বলি সন্ধান তার,
দ্বিদলেতে দিল ধরিয়ে, মিল করিয়ে, চেয়ে থাক মন আমার।
 অরূপ, স্বরূপ, একরূপ হইয়ে প্রেম লোলুপ,
ভাব রে আরোপের রূপ, ছুটিবে আঁধার।
 ফুটবে কলিদীপশিখা, যা আছে সব যাবে দেখা,
তার ভিতরে বাঁকা সখা, দেখা পেতে পাব তাঁর।
 তারে তারে মিশালে তার, জগৎজোড়া একটি তার।
 সাবধানে মন হুঁশ নিয়ে, বক বিড়ালের খাপ দেখিয়ে,
চোখ মুদিয়ে ধ্যান ধরিয়ে, মন নিয়ে মন বসো আমার।
 শুন বলি কই তোরে ক্ষেপা, ভাবিস না রে সোনা রূপা,
বশ করিয়ে বসো অজপা, কৃপা হবে সেই অকৃপার।
 মন তোমার নাই চিত্তশুদ্ধি, গেল না তোর ছেলে বুদ্ধি,
কিসে হবে সাধন সিদ্ধি, মনোমোহনের নাই বেপার।

৯০

শিখায়ে দে তুই আমারে, কেমন করে তোরে ডাকি।
এক ডাকে ফুরায়ে দেই রে, জনম ভরার ডাকাডাকি ॥
যেমন করে ডাকলে পরে শুনতে পাস তুই
হঠাৎ করে হাসি দিস আমার অন্তরে, প্রাণ ভরে যায় রয় না বাকি ॥
ডাক দিয়ে তুই ডাক শিখায়ে,
ফাঁক না দিয়ে আয় না ধেয়ে
খেলাই আমি তোরে লয়ে, তোর প্রাণে মোর প্রাণ মাখি।
 যে রূপে তোর নয়ন ধারা, সে রূপে ধরে নয়ন ধারা,
বারণ করে হও না ছাড়া, চেয়ে থাক দুই পাগলা আঁখি।
 মনোমোহন বেহাসুর মন, কমতি পরে নাই তার ওজন,
আপনি কয় তারে শোধন, হৃদয়ে জাগ্ৰত থাকি ॥

৯১

শুধু তোমারই কথা শুধু তোমারই গাঁথা
কহিব গাহিব যতদিন দেহে রহে প্রাণ।
 তোমারই লাগি, হইয়ে উদাসী
আড়ালে থাকি যে পাতিয়া কান।
 মোহন বাঁশরী, আপনা পাশরি,
কি রবে নীরবে ধরিছে তান।
 তাই শুনিব জীবন ভরিয়া
তাহারই লাগি সঁপেছি পরাণ ॥

৯২

শুনলো সজনী, অই যে বাজে বাঁশি
কেমন কেমন করে প্রাণ, হয়ে উদাসী ॥

বাঁশিতে কি এতই মধু, পাগল কইল কুলবধূ
ঘৃণা লজ্জা ভয় মান, গিয়াছে ভাসি ॥

যে শুনেছে বংশী ধ্বনি, হারাইয়া গেছে প্রাণই
আপনা প্রাণ পরকে দিয়ে, গলে দিছে ফাঁসি ॥

মনোচোর সে বংশী ধরে, মনোমোহন ধরতে না রে
আপ্তাবদ্দির বাঁশির স্বরে মন করে খুশি ॥

৯৩

শেষ কথা বলতে এলেম
                    বাউল সেজে তোমার কাছে।
আপনি আপন চিন্তা করো,
                    তা বিনে সকলই মিছে।
অবশ্য হবে মরণ      কে করে তার নিবারণ,
এত দ্বন্দ্ব কি কারণ      ভেবে দেখো আগে পাছে।
করি স্বার্থ পরিহার       করো পর উপকার,
জগতেই বন্ধু তোমার      খাটো জগতের কাজে।
তুচ্ছ করি ভব মায়া      সত্য সরলতা দয়া,
সঙ্গে লয়ে ঢাল কায়া      বিনয়ের ছাঁচে।
মনো কয় মানুষ কর্ম      রাখতে সত্যের ধর্ম
ধন্য হয় তাহার জন্ম      এমত যে হইয়াছে ॥

৯৪

শোন তোরে কই মনোমোহন
তুই তিক্ত রসে লিপ্ত হলি, ভুলে সুধার আস্বাদন ॥

জন্মাবধি করে এত, শিখলি না তুই শিক্ষার মতো
মন হলি না মনের মতো, আর কত ঘুরাবি মন ॥

সামান্য ধন পাবার আশে, ঘুরলি কেবল হুঁশ-বেহুঁশে
নিধনকালে, সে ধন কি তোর, ধনের কাম দিবে রে কখন ॥

সাধ করে পেতে বিছানা, পুষেছো এক বাঘের ছানা
সে যে রক্ত খেয়ে শক্ত হোয়ে, নিল ত্যক্ত সিংহাসন ॥

ফচ্‌কা বাঁধের হেঁচকা টানে, মন আমার ঠেকেছ প্ৰাণে
বুঝলি না তুই দিন যে গোণে, দিন দুনিয়ার মহাজন ॥

মন তোমারই স্বভাব দোষে, আমি আমার মন মানুষে
পারলেম না রে রাখতে হুঁশে, করতে পূজা মনের মতন ॥

কই আমি মন তোমার কাছে, এখনও তোর সময় আছে
ঠিক থাকিস তুই আগে পাছে, ঠিক রাখিস গুরুর চরণ
মনোমোহনের কাঁধে ঝোলা, আর জানি কি আছে পরে ॥

৯৫

শোন বলি পাগলের চেলা
পাগল হওয়া নয় সামান্য, দেবের মান্য পাগল ভোলা ॥

এক পাগল হয় নারদ ঋষি, বীণা বাজায় দিবানিশি
আর এক পাগল বাজায় বাঁশি, বাসা করে কদমতলা ॥

আর এক পাগল হয় হনুমান, রামরূপ ধরেছে ধ্যান
বক্ষ চিড়ে দেখাইল নাম, ছিঁড়িল মুক্তার মালা ॥

আর এক পাগল গৌরহরি, ডোর কৌপিন ধারণ করি
হরি হয়ে বলছে হরি, স্কন্ধে নিয়ে ভিক্ষার ঝোলা ॥

যদি পাগল হাওয়া ভালো লাগে, মন পাগলা রে ধর গে আগে
ওই পাগল তার সঙ্গে থাকে, সব পাগলামি যাহার খেলা ॥

কামিনী কাঞ্চন হাতে, লাগাইল পাগলের তালা
মনোমোহনের কাঁঝে ঝোলা, আর জানি কি আছে পরে ॥

৯৬

সাধুসঙ্গে প্রেম তরঙ্গে, প্রেমতীর্থে মোড়ায়ে মাথা
গুরু কল্পতরু জড়িয়ে ধরো, ওগো আমার ভক্তিলতা ॥

বিশ্বাসের আকড়া দিয়ে, পাকড়াইয়ে ধরো তারে
কুবাতাসের ঝাঁকড়া পড়ে, ভাঙে না যে লতার মাথা ॥

চৌদিকে দাও সত্য বেড়া, ফিরবে তাতে ছাগল ভেড়া
জল ঢাল তায় ঘড়া ঘড়া, ফুটিয়ে ফুল, মেলবে পাতা ॥

ফুলের গন্ধে মন-অলি মত্ত হলে শোনো রে মালী
নয়ন ভরে তুমি খালি, সেই ফুলে দেখিও রাধা।
 
রাধা-পদ্ম ফুটলে পরে, বাজায় বাঁশি গুনগুন স্বরে
কালা ভ্রমর আসবেই উড়ে, কালো নয় সে উজ্জ্বল সাদা ॥

মনোমোহন কয় নিচের মাটি হয় না আমার পরিপাটি
মিছামিছি কান্দাকাটি, শুকনা মাটি হয় কি কাঁদা ॥

৯৭

সুরে-তালে দুজনাতে হলো রেষারেষি,
শুনিয়া দুনিয়ার ওস্তাদ জমা হইল আসি।
 সুরে কয় তুই বেটা তাল, আমারে করলি নাকাল,
চলতে নারি স্বাধীন চাল, কেবল করো ঘুসাঘুসি।
 তালে কয় সুরের মন্দ, আমি করি ছন্দো বন্ধ,
তাহে হও তুমি পছন্দ, লোকের মনে হয় খুশি।
 সুর বলে তুই বড়ো মূর্খ, শুনতে লাগে অতিরুক্ষ,
আমি কেমন সূক্ষ্ম, সূক্ষ্ম মিষ্টি মিষ্টি দেই হাসি,
তাল বলে হাসির ছটা, আমি নইলে দেখ তো কেটা,
মেজে ঘষে রূপের ছটা, ফুটাই দিবানিশি।
মনোমোহন কয় একি বলাই, ক্ষান্ত হও আবশ্যক নাই
তোমরা দুজন ভগ্নী আর ভাই ক্ষান্ত দাও এখানে আসি।

৯৮

হরি তোমার জানতে গিয়ে পড়েছি এক বিষম গোলে।
 আসল কথায় ঠিক পাই না তার শুনি কেবল যে যা বলে।
 পুরাণে কয় এরূপ সেরূপ কে জানে তার বিনা কোন রূপ,
বেদান্তে কয় অপরূপ স্বরূপ ঘটে পটে সর্বস্থলে।
 বাইবেলে কয় ঈসার পিতা আর যত হয় সবই মিথ্যা,
ঠিক পাই না তার কোন কথা কোন কথা রয়েছে মূলে।
 কোরাণে কয় ঠিক দুরন্ত বটে মোহাম্মদের দোস্ত,
হলে গেলাম হেস্তনেস্ত পড়ে মস্ত কথার ভুলে।
 গৌরাঙ্গে কয় কৃষ্ণরাধা বৌদ্ধে বলে বুদ্ধের কথা
নাস্তিকে কয় ঈশ্বর মিথ্যা আপনা আপনি জগৎ চলে।
 ঋক যজু সাম অথৰ্ব্ব ইঞ্জিল তৌরিত ফুরকান জব্বর,
যার যার ভাবে সেই জব্বর ধান্দা দিচ্ছে কথার ছলে।
 সাংখ্যে কয় ঈশ্বরসিদ্ধে ভাবুকে কয় হৃদয়মধ্যে,
হয় না কিন্তু কারো সাধ্যে ধরতে তাঁরে কোন কালে।
 জ্ঞানী বলে জ্ঞান হয় বড়ো ভক্তে বলে ভক্তি ধরো,
যোগী বলে কুম্ভক করো চেপে ধরো দোমের কলে।
 কেহ কয় জপো ওঁকার কেহ কয় হংস আকার,
ঠিক পাই না তার কোন কথার কেহ কয় সহজে মিলে।
 কেহ কয় ভজন সম্বল কেহ কয় কৃপাহি কেবল,
তাঁর ইচ্ছাতে হচ্ছে সকল ফল নাই কিছু কর্মফলে।
 যে যা বলে সবারই মূল এক ব্রহ্ম সূক্ষ্ম স্থুল,
লীলাতে ঘটাইছে গোল দীনহীন মনোমোহন বলে।
কৃপা হলে পাবে কৃপা স্ববশ হবে অজপা,
তুচ্ছ হয়ে সোনা রূপা রূপে যাবে নয়ন ভুলে।

৯৯

হাওয়াতে উড়ছে ঘুড়ি, জোত দড়ি তার তোর হাতে।
 দিবানিশি এদিক ঘুরছ কেবল শূন্য পথে।
হাওয়ার জোরে উপরে ধেয়ে, স্বভাব দোষে কান্না খেয়ে।
 ঠিক হইছ আবার যেয়ে, হাতের দড়ি টান দিতে।
 কখন কখন পাক বাতাসে, ঘুরতে ঘুরতে নামায় এসে,
পড়তে যেয়ে উড়তে হইছে, সাধ্য কি তোর সুত ছিঁড়তে।
 কুবাতাসে গোত্তা খেয়ে, পড়লে আবার দেয় উড়ায়ে,
কিছু উঠলে হাওয়ায় যেয়ে, জোর দিয়ে ঠিক করে তাতে।
 আপন হাতে রেখে নাটাই, খেইল খেলতেছে আলেকসাঁই,
অহংকারের নাই বড়াই, যা হতেছে তার ইচ্ছাতে।
 গ্রামের ভিতর নিচের হাওয়া, সমান নাই চাই মাঠে যাওয়া,
উড়লে ঘুড়ি উপরে সমান, বসলে যেয়ে সমান যোতে।
 মনোমোহনের পতং ঘুরি, অল্প সুতায় ঘোরাফিরি,
কি করি, যা করায় করি, দিন গেল ভাই ঘুরতে ঘুরতে।

১০০

হাত-পা উদরে একদিন লাগলে ঘোর দ্বন্দ্ব
যতসব কুঁড়ে মানুষ শুনে খুব আনন্দ ॥

পদে কয় কি অপরাধে ঘুরব আমি দিনেরাতে
আহার তুলে দিবে হাতে, তাতে কয় মন্দ ॥

উদর কেবল বসে, পূর্ণ হবে নানা রসে
তা বলে দুজনা শেষে, কাজ করে বন্ধ ॥

খাদ্যাভাবে দিনের দিন, হস্তপদ হইল ক্ষীণ
ভাবনা অতি কঠিন, লাগিল বিষম সন্দ ॥

ভেবে দেখে একে আরে, কেহ কারে নাহি ছাড়ে
সকলে সকলের তরে, প্রয়োজনে আছে বন্ধ ॥

মনোমোহন ভাবিয়া কয়, কেহ কার পর নয়
সকলই সকলের হয় দেখে না যে অন্ধ ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *