আমি দুর্বলতা ও ক্লান্তিতে আক্রান্ত। একদিকে জরা ও অপরদিকে যৌবন-সুলভ কর্ম এ দুইয়ে মিলে আমাকে ক্লান্ত করে ফেলেছে। এ সভার উদ্যোক্তারা যখন আমাকে সভাপতি করবার প্রস্তাব নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন তখন আমি তাতে দ্বিধা বোধ করেছিলাম। কিন্তু কয়েকটি বিশেষ কারণে আজ আমি এখানে এসেছি। প্রথমত, কবি মনোমোহন ঘোষের মাতামহকে আমি আমার পরম আত্মীয় বলে জানতুম। শৈশবকালে তাঁর কাছ থেকেই প্রথম আমি ইংরেজি সাহিত্যের ব্যাখ্যান শুনেছিলাম। ইংরেজ কবিদের মধ্যে কে কোন্ শ্রেণীতে আসন পান, তাহা তিনিই আমাকে প্রথম বুঝিয়েছিলেন। যদিও আমাদের বয়সের যথেষ্ট অনৈক্য ছিল তথাপি তার পর অনেকদিন পর্যন্ত দুজনের মধ্যে একটা সম্বন্ধ ছিল। এক-এক সময়ে তাঁর যৌবনের তেজ দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি।
মনোমোহন, অরবিন্দ ও ভাইদের সকলকে নিয়ে তাঁদের মা যখন ইংলণ্ডে পৌঁছলেন, তখন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলুম। শিশুবয়সেই তাঁদের আমি দেখেছি। ইংলণ্ডে দুঃসহ দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃতিত্বলাভ করেছেন। সে কথা আপনারা সবাই জানেন। মনোমোহন যখন দেশে ফিরে এলেন তখন তাঁর সঙ্গে পুনরায় পরিচয় হয়– সে পরিচয় আমার কাব্যসূত্রে। সেইদিন সেইক্ষণ আমার মনে পড়ে। জোড়াসাঁকোয় আমাদের বাড়ির দক্ষিণের বারান্দায় “সোনার তরী’ পড়ছিলুম। মনোমোহন তখন সেই কাব্যের ছন্দ ও ভাব নিয়ে অতি সুন্দর আলোচনা করেছিলেন। বাংলা ভাষার সঙ্গে তাঁর পরিচয় না থাকা সত্ত্বেও শুধু বোধশক্তি দ্বারা তিনি কাব্যের অন্তর্নিহিত ভাবটুকু গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। আজকে তাঁর স্মৃতিসভায় আমরা যারা সমবেত হয়েছি, তাদের মধ্যে অধিকাংশই তাঁর যথার্থ স্বরূপ যেখানে– তাঁর মধ্যে যা চিরকাল স্মরণযোগ্য– সে জায়গায় তাঁকে হয়তো দেখেন নি। এ সভায় তাঁর অনেক ছাত্র উপস্থিত আছেন। তিনি সুদীর্ঘকাল ঢাকা কলেজে, কলিকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন। ছাত্র হিসাবে যে-কেহ তাঁর সংস্পর্শে এসেছেন তাঁর মধ্যেই তিনি সাহিত্যের রস সঞ্চার করেছিলেন। অধ্যাপনাকে অনেকে শব্দতত্ত্বের আলোচনা বলে ভ্রম করেন– তাঁরা অধ্যাপনার প্রকৃত অধিকারী নন। মনোমোহন ঘোষ তাঁর অসাধারণ কবিত্ব ও কল্পনাশক্তির প্রভাবে সাহিত্যের নিগূঢ় মর্ম ও রসের ভাণ্ডারে ছাত্রদের চিত্তকে আমন্ত্রণ করেছিলেন। যে শিক্ষা এক চিত্ত হতে আর-এক চিত্তে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বালিয়ে দেয়, ছাত্রদের চিত্তে আনন্দ সঞ্চার করে, তাহাই যথার্থ শিক্ষা। সাধারণ শিক্ষার চেয়ে এ ঢের বড়ো জিনিস। যে শক্তি নিয়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন সে শক্তি ছিল গান গা’বার জন্যে। অধ্যাপনার মধ্যে যে তিনি আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন তাতে নিঃসন্দেহে তাঁর গভীর ক্ষতি হয়েছিল। আমি যখন ঢাকায় কনফারেন্সে গিয়েছিলুম তখন তাঁর নিজের মুখে এ কথা শুনেছি। অধ্যাপনা যদি সত্য সত্যই এমন হত যে ছাত্রদের চিত্তের সঙ্গে অধ্যাপকের চিত্তের যথার্থ আনন্দ বিনিময় হতে পারে, তবে অধ্যাপনায় ক্লান্তিবোধ হত না। কিন্তু আমাদের দেশে যথার্থভাবে অধ্যাপনার সুযোগ কেউ পান না। যে অধ্যাপক সাহিত্যের যথার্থ মর্ম উদ্ঘাটন ও ছাত্রদের চিত্তবৃত্তির উদ্বোধন করতে চেষ্টা করেন, তেমন অধ্যাপক উৎসাহ পান না। ছাত্রেরাই তাঁর অধ্যাপনার প্রণালীর বিরুদ্ধে নালিশ করে। তারা বলে, “আমরা পাস করবার জন্যে এসেছি। নীল পেন্সিল দিয়ে দাগ দিয়ে আমাদের এমনতর ধারা দেখিয়ে দিতে হবে যাতে আমরা পাস করবার গহ্বরে গিয়ে পড়তে পারি।’ এইজন্যই অধ্যাপনা করতে গিয়ে ভালো অধ্যাপকেরা ব্যথিত হন। ফলে নিষ্ঠুর শিক্ষা দিতে গিয়ে তাদের মন কলের মতো হয়ে যায়, তাদের রসও শুকিয়ে যায়। আমাদের দেশে পড়ানোটা বড়ো নীরস। এজন্য মনোমোহন বড়ো পীড়া অনুভব করতেন। এই অধ্যাপনার কাজে তাঁকে অত্যন্ত ক্ষতিস্বীকার করতে হয়েছিল।
অনেক স্থলে ত্যাগস্বীকারের একটা মহিমা আছে। বড়োর জন্য ছোটোকে ত্যাগ করা, ভাবের জন্য অর্থ ত্যাগ করা, ও আত্মার জন্য দেহকে ত্যাগ করার মধ্যে একটা গৌরব আছে। কিন্তু যেখানে যার জন্যে আমরা মূল্য দিই তার চেয়ে মূল্যটা অনেক বেশি, সেখানে ত্যাগ দুঃখময়। এই কবি– বিধাতা যাঁর হাতে বাঁশি দিয়ে পাঠিয়েছিলেন– তিনি যখন অধ্যাপনার কাজে বদ্ধ হলেন তখন তা তাঁকে কোনো সাহায্য করে নি। আমি তাঁর সেই বেদনা অনুভব করেছি। আজকের দিনে তাঁর স্মৃতিসভায় আমি সেই বেদনার কথা নিয়ে এসেছি। যে পাখিকে বিধাতা বনে পাঠিয়েছিলেন তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের খাঁচায় বন্ধ করা হয়েছিল, বিধাতার অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে। আজ আমাদের সেই বেদনার অনুশোচনা করবার দিন। তাঁর কন্যা লতিকা যা বললেন সে কথা সত্য। তিনি নিভৃতে কাব্য রচনা করে গিয়েছেন, প্রকাশ করবার জন্যে কোনোদিন ব্যগ্রতা অনুভব করেন নি, নিজেকে সর্বদাই প্রচ্ছন্ন রেখেছেন। একদিকে এটা খুব বড়ো কথা। এই যে নিজের ভিতরে নিজের সৃষ্টির আনন্দ উপলব্ধিতে নিমগ্ন থাকা, নিঃস্বার্থভাবে প্রতিপত্তির আকাঙক্ষা দূরে রাখা, সৃষ্টিকে বিশুদ্ধ রাখা– এ খুবই বড়ো কথা। তিনি কর্মকাণ্ডের ভিতরে যোগ দেন নি। সংসারের রঙ্গভূমিতে তিনি দর্শক থাকবেন, তাতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন না এই ছিল তাঁর আদর্শ। কেননা, দূর থেকেই যথার্থ বিচার করা যায় ও ভালো করে বলা যায়। কর্মের জালে জড়িত হলে তাঁর যে কাজ– বিশ্বরঙ্গভূমির অভিনয় দেখে আনন্দের গান গেয়ে যাওয়া– তাতে ব্যাঘাত হত। যেমন কোনো পাখি নীড় ত্যাগ করে যত ঊর্দ্ধে উঠে ততই তার কণ্ঠ থেকে সুরের ধারা উৎসারিত হতে থাকে, তেমনি কবি সংসার থেকে যত ঊর্দ্ধে যান ততই বিশুদ্ধ রস ভোগ করতে পারেন ও কাব্যের ভিতর দিয়ে তা প্রকাশ করতে পারেন। মনোমোহন ছিলেন সেই শ্রেণীর কবি। তিনি কর্মজাল থেকে নিজেকে নির্মুক্ত রেখে আপনার অন্তরের আনন্দালোকে একলা গান করেছিলেন। কিন্তু এ কথা আমি বলব যে, যদিও সাধারণত সংসাররঙ্গভূমির সমস্ত কোলাহলে আবদ্ধ হওয়া কবির পক্ষে শ্রেয়ঃ নয়, তথাপি কাব্যের ভিতর দিয়ে সকলের সঙ্গে নিজের সংযোগ স্থাপন না হলে একটা অভাব থেকে যায়। যদিচ জনতার বাণী মহাকাল সব সময়ে সমর্থন করেন না, তা হলেও খ্যাতি-অখ্যাতির তরঙ্গদোলায় দোলায়মান জনসাধারণের চিত্তসমুদ্র যে কবির বিহারক্ষেত্র এ কথা অস্বীকার করা যায় না। একান্ত নিভৃত যে কাব্য তাতে একটা সঙ্গহীনতার বেদনা আছে। মনোমোহন যে তাঁর কাব্য প্রকাশ করতে ব্যগ্র হন নি তার কারণ এই যে, তিনি যে ভাষায় তাঁর কাব্য রচনা করেছিলেন, সেই ইংরেজি ভাষায় তাঁর এত সূক্ষ্ম অধিকার ছিল যে আমাদের দেশে আমরা, যারা ইংরেজি ঘনিষ্ঠভাবে জানি নে, ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে অন্তরঙ্গ পরিচয় নেই, আমাদের পক্ষে তাঁর কাব্যের সূক্ষ্ম উৎকর্ষ উপভোগ করা দুরূহ। তিনি জানতেন যে এ দেশে তাঁর সঙ্গ সম্পূর্ণভাবে জুটতে পারে না। যে কোনো বিদেশী ভাষা খুব ভালো জানে না তার পক্ষে সেই ভাষার সাহিত্যের মধ্যে একটা অন্তরাল থেকে যায়। যেমন কঠিন জেনানা যাঁরা রক্ষা করেন তাঁদের পক্ষে অন্তঃপুরিকাদের নাড়ী দেখানো কঠিন হয়, পর্দার আড়াল থেকে একজন নাড়ী দেখে ডাক্তারকে বলে দিতে হয়, আমাদের পক্ষে ইংরেজি সাহিত্যও তাই। অন্তঃপুরবাসিনী সাহিত্যলক্ষ্মী আমাদের কাছে সম্পূর্ণ দেখা দেন না, আমরা শুধু তাঁর কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। মুখের ভঙ্গিমা– যাতে অর্থ সুস্পষ্ট বোঝা যায় সেগুলি আমরা দেখতে পাই না। আমি যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থান পাই নি তথাপি ইংরেজি সাহিত্য কিছু কিছু পড়েছি। আমি যখন শেলি ইত্যাদি পড়ি তখন কোনো কোনো জায়গায় রসটি ঠিক না বুঝলেও মনে করি মেনে নেওয়াই ভালো। এ ছাড়া গতি নেই, বিশেষত যখন তা না করলে পাস করা অসম্ভব। ইংরেজিতে মনোমোহন ঘোষের অসাধারণ কৃতিত্ব ছিল। তিনি ইংলণ্ডে মানুষ হয়েছিলেন ও অক্সফোর্ডের গুণীদের সংসর্গ লাভ করেছিলেন। কাজেই সে দেশের ভাষার সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট পরিচয় ছিল। কিন্তু যে ভাষায় তিনি কাব্য রচনা করেছিলেন তার সম্পূর্ণ মিল এ দেশবাসীর পক্ষে অসম্ভব। এই বেদনা ছিল তাঁর জীবনে। তিনি কবি থেকে ইস্কুল মাস্টার হয়েছিলেন। আবার অসামান্য অধিকার নিয়ে যে ভাষায় তিনি তাঁর বাঁশি বাজিয়েছিলেন সে ভাষার দেশ এ দেশ নয়। তিনি বুঝেছিলেন কবির দিক থেকে তার ঠিক সঙ্গ আমাদের দেশে পাওয়া কঠিন। তিনি যদি চিরদিন ইংলণ্ডে থাকতেন তবে যে-সব কবির সঙ্গ বাল্যে পেয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে থেকে তিনি এত একলা হয়ে পড়তেন না। পরস্পরের সঙ্গে তাঁর রসবিনিময় হতে পারত। এই রসবিনিময়ের প্রয়োজন যে নাই, এ কথা কখনো স্বীকার করা যায় না। মানুষের সহিত মানুষের সঙ্গের ভিতর দিয়াই প্রাণশক্তির উদ্বোধন হয়। মানুষের চিত্ত অন্য চিত্তের অপেক্ষা রাখে। কেউ অহংকার বলতে পারেন না, আমি কবি হিসাবে অন্যের অপেক্ষা রাখি নে। কিন্তু এই সঙ্গ না পেয়েও মনোমোহন ঘোষ হাল ছাড়েন নি। আপনার ভিতরে সমাহিত হয়ে তিনি কাব্যের আরাধনা করে গেছেন। সে কাব্যের জয়জয়কার হউক। মানুষের সঙ্গে চিত্তের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করবার মধ্যে একটা গৌরব আছে। বিশ্বজগতের মানুষের সঙ্গে, একটা সত্যকার যোগ হবে, আমাদের অন্তরের মধ্যে সে ইচ্ছা কি নেই? যখন সে সঙ্গ না পাই তখন অভিমানে বলি, কাউকে আমার চাই নে। মানুষের সঙ্গে যোগস্থাপনের মানুষের সে স্বাভাবিক ইচ্ছা যখন ব্যর্থ হয় তখনই আমরা অভিমান করে বলি, আমি কারো সঙ্গ চাই নে।
কবি মনোমোহনের কাব্যের যখন প্রকাশ হবে তখন সমস্ত পাশ্চাত্য দেশের কাছে বাংলা দেশের আলোক কি উজ্জ্বল হবে না? তারা কি বলবে না, এদের সৃষ্টির আশ্চর্য শক্তি আছে? প্রকাশ মানেই হচ্ছে বিশ্বজগতের সর্বত্র প্রকাশ। যে জ্যোতিষ্কের আলো আছে, তার কেবল এপারে প্রকাশ, ওপারে নয়, এ তো হয় না। “সাহিত্য’ শব্দের ধাতুগত অর্থ আমি জানি নে। একবার আমি বলেছিলাম, “সহিত’ অর্থাৎ সকলের সঙ্গে যে সঙ্গলাভ। কালিদাস, বেদব্যাস প্রভৃতি সকল মহাকবি সমস্ত পৃথিবীর মানুষের কাছে ভারতের চিত্তজ্যোতিষ্ককে প্রকাশ করেছেন। সকলেই বলেছেন, এ কবি আমাদেরও কবি। যে-সমস্ত ঐশ্বর্য দ্বারা বিশ্ব ধনী হয়, সে সমস্ত ঐশ্বর্যদ্বারাই সমকক্ষতার যোগ স্থাপিত হয়। সাহিত্য মানে সমকক্ষতার যোগ। এই কবি মনোমোহন নিগূঢ় নিকেতন থেকে যা বের করেছেন তা আজও ঢাকা রয়েছে। এ যখন প্রকাশ পাবে তখন বাংলা দেশের একটি মহিমা সর্বত্র প্রকাশিত হবে। আমরা যদিও একটু বঞ্চিত হয়েছি, কিন্তু তাতে তাঁর দোষ নেই। আর কবি তো কেবল ইংরেজও নয়, কেবল বাঙালিও নয়– কবি সকল দেশেরই কবি। এই কবির কাব্য প্রকাশ হলে পর সকলেই আনন্দের সঙ্গে তাকে অভ্যর্থনা করবে। আজ তাঁর স্মৃতিতে আমি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। তাঁর কাব্যের সঙ্গে আমার কিছু পরিচয় ছিল; তিনি প্রায়ই তাঁর কাব্য আমাকে শুনাতেন। আমি শুনে মুগ্ধ হতেম। তাঁর প্রত্যেক শব্দচয়নের মধ্যে একটা বিশেষ সৌন্দর্য ছিল– আশ্চর্য নৈপুণ্যের সহিত তিনি তাঁর কাব্যের রূপ দিয়েছিলেন। আমার আশা আছে এ-সকল কাব্য হতে সকল দেশের লোক আনন্দ পাবে– কেবল “গৌড়জন’ নহে– সমস্ত বিশ্বজন “তাহে আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি’।
প্রেসিডেন্সি কলেজ ম্যাগাজিন, মার্চ, ১৯২৪