মনোভূমি
১. হীরামণ-মাণিক্য তারা গো তলইয়ে শুকায়
এমনিতেই গোটা শহরটার উপর শীতের একটা অস্বচ্ছ মিহি স্তর পড়েছিল। সীমান্তের খোলা মাঠের উপর দিয়ে ধুলার মতো উড়ে আসা কেমন একটা দূরাগত আবর্জনা বছরের পর বছর ধরে এখানে শুপ-শুপ করে — প্রায় নিঃশব্দে — পড়েছে।
“আজকে আবার দিদিরে দেখতি আসবে। পরীক্ষা শেষ কইরে পশ্চিমপাড়ার দিকে যাব। রজনিগন্ধা কোল্ড স্টোরেজটা থুয়ে। এইসব ঝুটঝামেলা…।”
বাতাস আধপাগলার মতো মাটির কাছ দিয়ে খড়কুটা উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। রুবেলের আরও কিছু মেয়েলি ভেজালের কথা মনে পড়ল। দশম শ্রেণির বিদায়- সংবর্ধনায় কার যেন ‘মেয়েদের হাতব্যাগ’ হারিয়ে গেছে আর তারপর আবার পাওয়া গেছে। দপ্তরি নাকি ক্লাসঘরে নোটিশ-খাতা নিয়ে এসে জানিয়ে গেছে, আর বলেছে ‘যথাযথ প্রমাণসহ’ ব্যাগটা ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে। রুবেল বলল, ‘যথাযৎ’; তরুও তাই ভেবে নিল যথাযৎ। তো সেই ব্যাগে নাকি ‘গুটি’ পাওয়া গেছে; মেয়েরাও নেশা করে আজকাল, হ। এমনকি তরুও ওর বহিরাগতর বুঝ দিয়ে জানত যে, ব্যাগে নেশার জিনিস থাকার ব্যাপারটাই তো যথাযৎ না। এর প্রমাণ আর কী করে যথাযৎ হয়, আর কেই বা যথাযৎ প্রমাণ দিয়ে এই ব্যাগ ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে?
“লিপিদিকে দেখতে কারা আসবে?”
“গোবরডাঙা পাট্টি।”
“ও।”
রুবেল পকেট হাতড়াল যেন ওরও ব্যাগ বা এমন কিছু হারিয়ে গেছে। ওর সাইডের পকেট থেকে একটা দুমড়ানো সিগারেট আর পাছার পকেট থেকে এক টুকরা সিরিশ কাগজ বের হলো। “নিবি? নে”, বলে ও তরুকে দুটোই গছিয়ে দিলো।
“সরস্বতীরে তোমার… তোর… কেমন লাগে?” গত পরশু কি তার আগের দিন থেকে রুবেল তরুকে তুই করে ডাকার অনুগ্রহ পেয়েছে।
প্রশ্নটা করতে করতে রুবেল একটা হাতের পাতা দিয়ে নারীশরীরের আদলে একটা ঢেউ আঁকল বাতাসে। অস্বস্তিতে তরু হাবার মতো হাসল, তারপর মাটির দিকে তাকাল, যেন ইঙ্গিতটা দেখে নাই এমন ভান করলেই ভালো হতো। সরস্বতীকে কখনো খেয়াল করে দেখে নাই ও; ভালো লাগলে নিশ্চয়ই দেখত। তরু বরং খেয়াল করে দেখেছে লক্ষ্মীকে। লক্ষ্মী-সরস্বতী যমজ বোন; তরু আগে কখনো দুইরকম দেখতে দুই যমজ ভাই বা বোন দেখে নাই। লক্ষ্মী ছিল ট্যারা; প্রায় কুঁজা, শীর্ণ শরীর; পাট- পাট ভাঁজ করা সুতির ওড়নার দুই বাহু দুই কাঁধ থেকে কোনাকুনি নেমে গিয়ে পেটের নিম্নবিন্দুতে গিয়ে মিশত; মাথার পাতলা, তেলা চুলগুলিকে এমন নিখুঁত মধ্যসিঁথি করে টেনে বাঁধত ও, একটা স্ফীতশিরা শুকনা পাতা আলগোছে মাটি ঘেঁষে উড়ে গেলে কেউ যেমন খেয়াল করে না, তেমন ছিল লক্ষ্মী। শুধু ও যখন পূর্ণচোখে চাইত, তখন অস্বস্তির মতন চাপা কালোয় জ্বলত ওর ট্যারা দুই চোখের মণি আর আলোয় চিকচিক করতো ওর তেলা নাকের ডগা। নাকটা দেখতে মনে হতো, অন্ধকার জলের নিচে চিত হয়ে শুয়ে থাকা একটা মাছের মুখ ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসছে আর নাকটা ছাড়া অন্য কিছুই কোনোদিন দৃশ্যমান হবে না। রুবেল-রনিদের অপরিষ্কার দাওয়ার সিঁড়িতে তরু বসেছিল, লক্ষ্মী-সরস্বতীদের ঘরের দিকে মুখ করে। পাশে রুবেল কাঁসার বাটিতে গুড়-মুড়ি খাচ্ছিল। আজকে নাকি ওর ইস্কুলে পরীক্ষা, যদিও ওর খাওয়ার মধ্যে কোনো তাড়াহুড়া দেখা গেল না।
খালি গায়ে কারা যেন বারোয়ারি উঠানের একপাশে কাঠগুলাচি গাছের শুকনা কাঠ ডাঁই করে রাখছিল; শলিপাঁচেক মতন লাকড়ি হবে তাই দিয়ে। পলিথিন আর আইসক্রিমের র্যাপারে উঠানভরতি। কিন্তু সরস্বতীদের ঘরের বাইরের দেয়ালে পরিচ্ছন্নভাবে ঘুঁটে দেওয়া। ছয় ঘর ভাড়াটিয়া থাকে তরুর মামাদের নিচে; বেজাতের কাউকে এখানে দেখে নাই তরু; শহরের দপ্তরও হয়তো তেমন নয়। তরু বড়ো শহরের ছেলে; তরুর মামারা কখনো শহরের নাম বলে না; বলে রাজধানী শহর। রাজধানী- শহরে এক দালানের ভিতরেই সব জাত; ওইখানে বিল্ডিংবাসীদের জাতপাতের ভাগ- যোগ এত মিহি খোপ খোপ খোপ খোপ যে, খালি চোখে মনে হয়, একটা অখণ্ড সমান জমিন বুঝি; কোনো ভাগ-যোগই বুঝি নাই। তরু মনে মনে হিসাব করল, এইখানে ছয় ঘর ভাড়াটিয়া —একটা উঠানের ছত্রিশ শরিক; আর ওর মামাদের উঠান সুপরিসর আলাদা; কুঞ্জলতায় ছাওয়া বেড়ার গেট পেরিয়ে তুলসিতলার ধারে মামাদের ঠাকুরঘর, যে ঠাকুরঘরে লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক-গণেশ, ঠাকুরঘরটা লক্ষ্মী-সরস্বতীদের ঘুঁটে দেওয়া বসতঘরের সমানই হবে। উঠান থেকে বামে পুষ্কর্নির পারে এক চিলতে জমি, গোয়ালঘরের পাশে মানুষ-গরু-ছাগলের পদভারে মাটির সাথে মিশে শুকিয়ে আছে খড়ের মণ্ড; তার আগে লেবুগাছ, যার গোড়ায় সন্ধ্যারাতে মুততে বারণ নাই। “এটাই তুমার ভাতরুম”, বলেছিল রুবেল। “বড়ো শহরে তো তুমরা ঘরের ভিতরেই খাও, ঘরের ভিতরেই ঘুমাও, ঘরের ভিতরেই হাগো”। রুবেলরা ছয় জন এক ঘরেই ঘুমায়; রুবেলের বাপ-মা-নতুন ভাই পার্টিশনের ওই পারে আর লিপি-রনি-রুবেল অর্থাৎ তিন ভাইবোন পার্টিশনের এই পারে। তরুর চোখে লাগলে কী হবে? রুবেলদের স্বাভাবিক শোয়া এমনই সকলের এক ঘরে শোয়া। ওই এক ঘরে ওরা হাগছে তো আর না। মুতছেও না। বেজায়গার কাজ বলতে আছে কেবল লেবু গাছে মোতা।
সরস্বতীকে নিয়ে রগড় করার আনন্দে রুবেল মুখ ঢেকে হাসল-রুবেলের সামনের দুই দাঁতের মাঝে ফাঁক, দাঁতগুলি উঁচুও আর তারপর পাটালি গুড়ের বাটিচাকতিতে কামড় দিলো। অন্যসময় হলে ও ঠোঁট দিয়ে দাঁত ঢেকে হাসত আর হাসিতে টানটান ওর ঠোঁটের চামড়াটা অদ্ভুতভাবে উঁচু হয়ে থাকত। ভাড়াটিয়াদের বারোয়ারি রান্নাঘর থেকে ফুটন্ত তেলে কিছু ছাড়ার শব্দ আসলো। ভোর থেকে বাতাসে ঝুলে ছিল দুধপোড়া মিঠা গন্ধ। পিছনে রুবেলদের ঘরে ওর ছোটো ভাইটা কাঁদছিল। ওদের মা বাচ্চার কান্না থামাতে ‘ও, ও’ করে যাচ্ছিল। এই উঠান ঘিরে প্রত্যেকটা ঘর শিশুদের প্রাত্যহিক কান্নায় মুখর। বাঁশের চাটাই আর টিনে ছাওয়া বিস্ফোরক গার্হস্থ্যের সারি সারি ঘরগুলি—তপ্ত ঝোলের বাটিতে ঢাকনা দিয়ে রাখা হয়েছে যেন, যদিও এমন সকালে এক নজর দেখলে সেসব বোঝার উপায় নাই।
জানলা দিয়ে একটা শাঁখা-লোহা পরা হাত হঠাৎ বের হতে দেখে রুবেল একটু অপ্রতিভ হয়ে নড়েচড়ে বসল। রুবেলদের মা চিনু। ঘরের ভিতর বিছানায় বসে চিনু জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বাচ্চার দুধের বোতল ঝাঁকিয়ে উঠানে দুই ফোঁটা ফেলল। তারপর আর কপাট বন্ধ করল না। বাচ্চার কান্না থামল। রুবেলদের মা ওদের নতুন ভাইকে দুধ খাওয়ানোর সময় খুব রাখঢাক রাখত না। বুক উদাম করে রাখত, যতক্ষণ নতুন বাবুর দরকার হয়। তারপর সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়েই বহু পরিহিত সুতির ব্লাউজের বোতাম লাগাত; তাতেও পুরাটা ঢাকত না। ক্ষয়ে যাওয়া বোতামঘরের মধ্যকার ফাঁকগুলি দ্বিতীয় বন্ধনীর মতো হাঁ করে থাকত আর তাতে চিনুর উত্তরগর্ভকালীন সুপরিসর বুকের মাঝখানের ফরসা চামড়া দেখা যেতে থাকত। চিনুর চেয়ে চিনুর বড়ো মেয়ে লিপি যেন ইহসংসারের পাপবুদ্ধিতে বেশি দড় ছিল; তাড়াহুড়া করে মায়ের গায়ের কাপড় ঠিক করে দিত সে, নয়তো চক্ষে শাসাত মাকে ঘরের কোণে রাখা সুইচওলা চুল্লির পাশ থেকে। মেয়ে লিপি আর মা চিনু পালা করে নতুন ভাইকে সামলাত, উঠানে স্নান করিয়ে নিয়ে গিয়ে কপালে কাজল আর কাজলের উপর পুরু করে ‘পাউটারের’ প্রলেপ দিত। ঘরের ভিতর ঘর— মশারি দিয়ে তৈরি অশৌচঘরে—ওদের নতুন ভাইয়ের তখনো নামকরণ হয় নাই; কেন দেরি হচ্ছিল, কে জানে! লিপি, রুবেল, রনি—তিন ভাইবোন ওদের নতুন ভাইকে শুধু ‘ভাই’ বলে ডাকত। তরু কী ডাকবে, বুঝতে না-পেরে চেষ্টা করতো নতুন ভাইয়ের বিষয়ে বা নতুন ভাইকে উল্লেখ করে কোনো কথা না-বলতে। তরু চিনুকে দেখেছে নতুন ভাইকে আধো-আধো গলায় ‘এই গরু’. ‘এই ছাগল’ বলে ডাকতে। শিশুটিও খলবল করে হাত-পা নেড়ে মায়ের ডাকের জবাব দিত, যেন এই সুরে পৃথিবীতে কেউ তাকে ছাড়া আর কাউকে ডাকে না।
রুবেল কালো প্লাস্টিকের ব্যাগে বইখাতা মুড়িয়ে চলে গেল। তরুর ডাক পড়ল। রান্নার ঘরে পাত পড়েছে—তরুর দিদিমা ছোটোখাটো বুড়ি; লুচি আর সাথে নাকি বুরিন্দা আছে। তরুর মামারা হাসাহাসি করল; গোবরডাঙা পার্টির সামনে নাকি বোঁদে বলতে হবে, নইলে ভাড়াটিয়ার মেয়ে লিপির বিয়ের সম্বন্ধ কেঁচে যাবে। গোবরডাঙারা ওপারের লোক; বাঙাল রেফিউজি হলে কী হবে? প্রতিবছর ডিসেম্বরের ছুটিতে এসে তরুর মনে হয়, রান্নাঘরটা আগের চেয়ে আরও ছোটো হয়ে গেছে আর মামারা হয়ে গেছে শুকনা কাঠের মতো নিদারুণ। এই রান্নাঘরে তরু ভয়ে ভয়ে যায়। মাটির লেপা মেঝে আর স্যাঁতসেঁতে রান্নাঘর; মাটির চুলার অনুভূমিক গর্ত বরাবর তাকালে দেখা যায়, উজ্জ্বল শিখা দাউদাউ করে কাঠ খাচ্ছে। দিদিমার তো বটেই, মাসিদেরও শুচিবাতিক ছিল। এঁটো হাতের ছোঁয়া যদি বা ভাতের বা তরকারির বাসনে পড়ত, তাহলে সেই কাঠখেকো লাল চুলাকে পিছে রেখে উলুধ্বনির মতো সমস্বরে হায়-হায় করে উঠত ওরা। তরুর সেজো মামার বিড়ালটা রান্নাঘরের চৌকাঠ থেকে চোখ ছোটো- ছোটো করে তরুকে দেখতে থাকত। তরু বড়ো গ্লাসে সরওলা দুধ খেত; গ্লাসটা এতই বড়ো যে, ওটার তলার ভিতর দিয়ে তরুর বহুবক্র মুখের পুরোটা দেখত বিড়ালটা ঘাড় নুইয়ে। বিরাট আঁশবঁটিতে মহিলাদের ক্ষিপ্র হাত চলত; ওদের নখ ভোঁতা করে কাটা, সবজির কষে কালো হয়ে যাওয়া নখের ডগায় আঙুলের শাদা মাংশল পেট ফুলে থাকত। ঘ্যাস-ঘ্যাস শব্দ করে প্রাণহীন আনাজের টুকরা, ফলের খোসা, মাছের শরীর ঝরে পড়ত জলের গামলায় কি ছাইয়ের উপর; তারপর যমদূতের হাঁড়ির মতো দেখতে বড়ো বাসনে ঢেলে ওগুলিকে তুলে দেওয়া হতো ওই চুলার উপর। সাঁড়াশি দিয়ে গরম ডেকচি-কড়াইয়ের কানা ধরে এমনভাবে ওই বলবল করতে থাকা ঝোলকে হেলাত মহিলারা, মনে হতো শুধু অন্ধকার রান্নাঘরটাতে নয়, সমগ্র দেশে ধূমায়িত ত্রাসের রাজত্ব নেমে এসেছে।
একটা বেলুনবাঁশির তীক্ষ্ণ আওয়াজ বক্ররেখার মতো ওই উঠান থেকে এই উঠান পর্যন্ত আসে। রনি আবার সীমানা ভুলে চলে এসেছে, লিপির পরের ভাই রুবেল আর রুবেলের পরের ভাই রনি, যে আবার ছিল হাবাগোবা, আর ওর পিছে-পিছে গানের দলের মতো দেখতে একটা সশব্দ জটলা বেড়ার ফাঁক দিয়ে প্রায় গলে এসে উঠানের উপর হল্লা করতে থাকে। প্রত্যেক বছর পৌষের শুরুতে ওরা আসে—নিজেদেরকে টেলিভিশনে এঁটে যাওয়া কার্টুনের চরিত্রের মতো ছোটো করে। খ্রিস্টানদের বড়োদিনের শিরনির উপাদান কালেকশন করতে ওরা ঘরে ঘরে যায়। টিনের কৌটায় ধাতব ডান্ডা দিয়ে আঘাত দিয়ে দিয়ে ওরা গৃহস্থ মাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়; এসে যেন পুরো শহরের অতীত সম্প্রীতির ক্ষতকণ্ডুয়নের বাসনাকে সারা বছরের জন্য জাগিয়ে দিয়ে যায়। পর্তুগিজরা জগদানন্দ গির্জা রেখে গেছে; গম্বুজে আগে নাকি সোনালি আস্তর ছিল, এখন প্লাস্টার অভ প্যারিসের মতো পাখির গু শুকিয়ে পাকাপাকিভাবে ইতিহাস-ঐতিহ্য সেঁটে গেছে এর সাথে।
রনির গায়ে জামা নাই। উঠানময় সে ডিগবাজি খাচ্ছিল আর ওদের ডান্ডাবাড়ির তালে তালে মুখে বুড়বুড়ি তুলে ‘টাঙ্গানাকা, টাঙ্গানাকা’ বলে যাচ্ছিল — বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশুটি যেন ওদের দলেরই একজন। রনির ওই রকম মধ্যস্থতার কারণে মহিলাদের পক্ষে আঙিনায় এসে দাঁড়ানো সহজ হলো। তরুর দিদিমা-বুড়ি মাথা নিচু করে রান্নাঘরের চৌকাঠ পার হলো, তারপর দুই কদম এগিয়ে যেন টেলিভিশনের পর্দার ভিতরে ঢুকে গেল আর তারপর রনিকে ধমক দিয়ে সরিয়ে বিড়বিড় করে বলল, এই দলের দুইটা ছেলেকে নাকি সে অষ্টসখীর লীলাকীর্তনের দলে দেখেছে। “খ্রিস্টানরা তো আসলে হিন্দুই”, ভূয়োদার্শনিকের মতো বলল তরুর সেজো মাসি। সাম্য-সম্প্রীতি যখন ভাবের রাজ্য থেকে ইহলৌকিক বস্তুর রাজ্যে চলে আসে, তখন তা বৈচিত্র্য- বিভিন্নতার দূষণমুক্ত হয়ে যায় এখানে।
ওদের নামগুলো এই যেমন হয় দাস। তারপর বিশ্বাস। ওদের মন্দিরগুলোর নাম হয় জগদানন্দ চার্জ, সচ্চিদানন্দ চার্জ, ইরাম।” তরুর সেজো মাসি একটু এগিয়ে ওদের কাছ থেকে জেনে নিল যে, এইবারের বড়োদিনের শিরনিতে দুধ-চিতই হবে। “পাটালি গুড় আর আতপ চাল আছে, মা?”, নাটুকেভাবে জিজ্ঞেস করল ওদের একজন। “আতপ চান না। পোনাওর চান”, রনি বলে উঠল। একই কথা সে আরও দুইবার বলল। রনি প্রায়ই নিজের কথা পুনরাবৃত্তি করে; ক্লান্ত, ঘুমে বিবশ বা অন্যমনা হয়ে যাওয়ার আগপর্যন্ত পুনরাবৃত্তি করতেই থাকে। রুবেল আশেপাশে থাকলে বিরক্ত হয়ে দুই-চার ঘা বসিয়ে দেয়।
তরুর সেজো মাসি অ্যালুমিনামের ‘বল’ ভরতি করে চাল আনে; উঠানে নামিয়ে রাখা ধামাতে ঢালতে থাকে। ভাড়াটিয়া প্রতিবেশিনীরা শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা কিম্বা কাঁধ ঢেকে এসে দাঁড়ায়, নতুন কোনো গৌর দেবতার আগমনে মেয়েলোকে যেমন একাধারে কৌতূহলী এবং গলবস্ত্র হয়ে পড়ে, তেমন। শিরনির উপকরণ কালেকশন দলের যে লোকটা ছিল নেতাগোছের, সে একটা সুরেলা কবিতা বলার মতো করে কার যেন একটা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিল। লোকটার পাটের পাকানো রশির মতো চুল, খালি গা, কিন্তু গলায় উড়নি প্যাচানো আর হাতে একটা কাঁচা বাঁশের লাঠি। হাতের লাঠিটা দিয়ে উঠানের মাটি ঠুকতে ঠুকতে লোকটা বলছিল, “এখন সাপ শীতনিদ্ৰায়, তাতে কী? ওরে তো সব ঋতুই কাটাতি হয় বুকি হেঁটে। এমনকি ঘুমের মধ্যে, স্বপ্নের মধ্যেও সে বুকি হাঁটে।” লোকটা এই বলে ‘ঠিক কি না? ঠিক কি না?’ গোছের চেহারা করে তার রক্তিম চোখজোড়া ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আশেপাশে জড়ো হয়ে থাকা দর্শকদের দিকে হাসিহাসি মুখে তাকাল। সাপের কথা কীভাবে উঠল, কে জানে, কিন্তু শিনশিন শব্দ করে একটা সরু ধারায় ধামার ভিতরে তখনো আতপ চাল ঝরছিল। লোকটা সকলের দিকে মাখোমাখো তুষ্টচোখে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ তরুর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। বলে উঠল, “আরে, আরে! ইডা কে গো, মা? ই দেখি সাক্ষাৎ সীতার দেওর। সুমিত্রাতনয়!” আর তারপর কেমন আধা কথা, আধা গান গেয়ে উঠল,
বনফুলে-মনফুলে পূজিব দেবায়,
ভিক্ষা মাগিতে এসে দেরি হয়ে যায়।
গণ্ডি আঁকি দিয়া গেছে সুমিত্ৰাতনয়?
অতিথির অভিশাপ পড়িবে নিশ্চয়
ভিক্ষা না-দিলে মাগো, আমি যে কাঙাল,
প্রভু মম শিবশম্ভু, দরিদ্রের হাল।
দণ্ড-কমণ্ডলু দেখ, অঙ্গে দেখ ছাই,
অধিক চাহি না, শুধু খাদ্য কিছু চাই।
উঠানসুদ্ধ মহিলাদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল; ওরা সবাই এই গান জানে, টেলিভিশনে রামায়ণ মেগাসিরিজ চলছিল প্রায় এক বছর ধরে। একজন দুঃসাহসিকা আবার গানের সাথে আবহসঙ্গীতের মতো ‘ওম-ভোম’ করে উঠল। লোকটা এতে উৎসাহ পেয়ে রাবণের মতো হো-হো অট্টহাসি দিতে দিতে আর তরুর হাত ধরে টানাটানি করতে করতে সীতাহরণের অভিনয় করতে থাকল। তাতে তরুর দিদিমা, মাসিমা আর বাকিরা আবারও বহুবিধ নিনাদে হেসে উঠল। ধামার ভিতরে চাল পড়া থেমে গেল। লোকটা হঠাৎ হাত টানাটানি থামিয়ে বলে উঠল, “ই কী করিছি, মা গো? এ তো সীতা নয়। সাক্ষাৎ লক্ষ্মণ! দেকো দেকো!” উঠানসুদ্ধ সকলে অকস্মাৎ মেগাসিরিজের লক্ষ্মণের সাথে তরুর চেহারার মূল খুঁজে পেল। তাই তো! সেই রকম কাঁচা সোনার মতো রঙ, মুখে মেয়েমানুষের মুখের মতো লালিত্য, ‘এখনো গজিয়ে-সারেনি’ গোঁফের একটা ছায়া রাম-সীতার ছায়াসঙ্গীকে যেন পরিমিতভাবে উনপুরুষের থেকে সামান্য বেশি পুরুষ করে রেখেছে, একটা গেরুয়া কৌপীন আর একটা জটাজুটওয়ালা পরচুলাই শুধু নাই। এতগুলি লোকের আহ্লাদে আর্দ্র মনোযোগ পড়ায় তরুর কেমন লজ্জা-লজ্জা করতে লাগল। বহিরাগতকে মনোযোগ পেতে দেখে রনি অস্থির হয়ে উঠল। বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো একে-তাকে কোমরের কাছ থেকে ধাক্কা দিতে দিতে রনি বলতে লাগল, “লশমন! লশমন!” জলের শব্দ বা হাওয়ার শব্দ বা আগুনে কাঠপোড়ার শব্দ যেমন মন দিয়ে কেউ শোনে না, রনির কথাও তেমন শুনল না কেউ। এতক্ষণ যা হয় নাই—কুশলাদি বিনিময়, স্থানীয় খবর আদান-প্রদান, তা শুরু হলো। রামায়ণ মেগাসিরিজ দেখতে দেয় নাই বলে শ্যামদাসীর পুতের বউ ভরা জলে ডুবে মরেছে; কুলোকে বলছে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। মন্দোদরীর পার্ট যে মেয়েলোকটি করতো, সুন্দরকাণ্ডে এসে সে মেগাসিরিজ ছেড়ে চলে গেছে। দিনতিনেক আগে তার সাক্ষাৎকার দেখেছে কারা কোন এক কৌতুকের অনুষ্ঠানে। মেয়েলোকটি লঙ্কার রানির মেকআপ ছাড়া দেখতে একদমই ভালো নয়। সে বলেছে, সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ায় তার পক্ষে আর সিরিজে অভিনয় চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। মেয়েলোকটি আরও বলেছে, দেবী মন্দোদরীর কিরদার নিভাতে গিয়ে সে যে সম্মান পেয়েছে—এই সমাজে কয়টা নায়িকাকে পর্দায় দেখে লোকে সিটি মারার বদলে ভক্তিগদগদ হয়ে নমঃ করে?— সেই সম্মান এনে দেওয়ার কারণে রামায়ণ মেগাসিরিজের কাছে সে জোড়হস্তে কৃতজ্ঞতা জানায়। তাই শুনে কৌতুকের অনুষ্ঠানের লঘুত্ব ভুলে গিয়ে সকলে দাঁড়িয়ে তালি দিয়েছে—জোড়হস্তে। উঁচু করে টিভির ‘এন্টিনা’ টানাতে গিয়ে মারা গেছে বাপ- ছেলে—সোনা মিয়া আর তার ছেলে ইমারত; দুইজনই ছিল রামায়ণ মেগাসিরিজের পোকা, দুইজনেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছে। কে যেন বলল, অপঘাতে মৃত্যু ওদের বাড়ির পিছু ছাড়ে না। ইমারতের চাচা নাকি মরেছিল রহস্যজনকভাবে গলায় ফাঁস দিয়ে, যদিও কথিত আছে যে ওই লোকের ছেলে মানে ইমারতের চাচাতো ভাই বরকত নেশার টাকা না পেয়ে বাপকে খুন করেছে। পরে বরকত পাগল হয়ে গেছিল। বাপ-দাদার ব্যবসায় সত্যি সত্যি লালবাতি জ্বালিয়েছিল সে। পৈতৃক আটামিলের গুদামঘরে আগুন জ্বালিয়ে, পরে ওই আগুনে ঠোঁট এগিয়ে দিয়ে জোড়া সিগারেট জ্বালিয়েছিল- এমনই জনশ্রুতি। মাটিতে বসে রনি দেখল, এইসব কথা বলার সময় কালেকশন দলের নেতা লোকটা আঙুল দিয়ে টিনের ওইপারের এক চিত্র-বিচিত্র রাজ্যের দিকে নির্দেশ করতে থাকে, যে রাজ্যকে টেলিভিশনে প্রত্যক্ষ করে থাকে সকলে। রনি যেখান থেকে দেখছিল, সেখান থেকে দোচালা টিনের ঘরটাকে পাহাড়ের মতো লাগছিল। ছাউনির উপরে একটা শাদা মুরগি উঠে বসেছিল, টিনের চালে কুলার উপর কালচে হতে থাকা কমলা বরই শুকাচ্ছিল, পাখিতে ঠোকরানো কয়েকটা বরই মাটিতে গড়াচ্ছিল—ওই টিনের ছাউনির ওইপারে যেন অতি সুন্দর কিছু একটা আছে। ওই সুন্দরের বিপুল তরঙ্গ এসে কালেভদ্রে ধাক্কা মারে টিনের ছাউনিগুলির উপরে আর অ্যান্টেনাগুলি অশরীরী কম্পনে মৃদু কেঁপে ওঠে।
২. পাঁচগাছি সইলতা পাকায় গো ধবল উরুতে
টেলিভিশনের রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠান দেখে দেখে লিপি কয়েকটা গান তুলেছিল। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হওয়ার দিনকতক পরে লিপি ওর কদমফুল-পাতানো পাড়াতুতো বান্ধবীর বিয়ের ক্রিয়াকাণ্ডে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল; অধিবাসের রাত্রেই সকলে লিপির প্রতিভার বিষয়ে জানতে পারল। “দেইখেন, মাঐমা, টেলিভিশনের সুবর্ণ ‘রজন্তী’ অনুষ্ঠানে আমারে ডাকবে”, শিলনোড়া থুয়ে হাতের পৃষ্ঠা দিয়ে ঠোঁটের উপর থেকে ঘাম মুছে উজ্জ্বল ফরসা চেহারা রানির মতো বোকা-বোকা করে কদমফুলের শাশুড়িকে বলেছিল লিপি।
“বাচ্চার মুতের মতন পিনপিন কইরে গান গাচ্চিস যে? গলা খুইলে গা!” তরুর দিদিমা বারান্দায় বসে ইট দিয়ে উঁচু করে রাখা চৌকির উপর থেকে আদেশ দিলো; মানে খরেদজ্জাল গলায় প্রশংসাই করল। হাঁটুর উপরের মাংশ-চামড়া অনাবৃত করে তরুর দিদিমা পাতলা কাপড়ের ফালি পাকাচ্ছিল— ঠাকুরঘরে তেলের বাতি জ্বালাতে লাগবে। ধমক খেয়ে লিপি একবার ঘাড় চুলকাল, তারপর উৎসাহে গানের দ্বিতীয় কলি গেয়ে উঠল, “গিরাম বেড়ে অগাধ পানি, নাই কিনারা, নাই তরণি…” তারপর আলতো করে গাইলো “পাড়ে…।” এক দমে পুরো লাইনটা গেয়ে অন্তিম শব্দটা কেমন আলগোছে রেখে দিলো শেষে। কোত্থেকে এইসব টেকনিক কায়েম করেছে লিপি, কে জানে! বিয়েটাই শুধু টাইমে হচ্ছে না; মেহেরালি সরদারের ছেলের এক দোস্তর সাথে কেলেঙ্কারির ঘটনার পর লিপির গতিবিধি কড়া নিয়ন্ত্রণের নিচে চলে আসে। এরকম কাটে একটা বছর বা তারও কিছু বেশি। অবরোধের পর লিপির যদি- বা কিছু শিক্ষা হয়েছিল, রটনা আজও পুরোপুরি লুপ্ত হয় নাই। ছেলেছোকরাগুলির উৎপাত কবে আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, কে বলতে পারে? দিনকয়েক আগেই উকিল সাহেবের বড়ো বউ বলেছিল বাউন্ডারি দেয়ালের ওইপার থেকে গলা উঁচু করে— সরদার সাহেবের বড়ো পোলার রজনিগন্ধা চালানের ট্রাকে নেশার চালান পাওয়া গেছে—তরুর দিদিমা কি পত্রিকা পড়ে না? বর্ডারের ওইপার থেকে আসে নাকি ওইসব। লড়াইঘাটের দিকে গুলি চলেছে—এইবার আর রাখাল বা গরুর ব্যাপারী না, সরদার সাহেবদের গুন্ডাপান্ডা মরেছে কয়েকটা। উকিলের বউ আজকাল খরখরে পাটভাঙা ছাপা শাড়ি পরে, সেটাও বর্ডারের ওইপার থেকেই আসে; বাড়িতে বাড়িতে দিয়ে যায় পেটফুলে ঢোল মহিলারা—পেটের ভিতর থেকে শাড়ির বোঝা নামিয়ে হালকা হয়ে, পান খেয়ে, গল্প করে ফিরে যায়। তরুর মামারা এই মহিলাদেরকে ডাকত পেট-কাটা মধ্যিনাষ্য। তরুর দিদিমা থান না-পরলেও ছাপা শাড়ি ছুঁয়ে দেখে নাই জীবনে। লিপির মা চিনু পরতো ওইসব। ভাড়াটিয়াদের মধ্যে লিপিরা যুগির বামুন, অর্থাৎ রুদ্রজ—ঠিকঠাক কৌলীন্য নাই, তবু তো তরুর মামাদের চেয়ে জাতে উচ্চ, রং-ও পরিষ্কার ওদের। পারিবারিকভাবে লিপির বাপের সাথে তরুর মামাদের নিবিড় সম্পর্ক ছিল—মালিক-ভাড়াটিয়ার সম্পর্কের চেয়ে বহু উষ্ণতর। তার তো ব্যবসায়িক কারণও ছিল। লিপিদের বাবা ধীরাবাবু, অর্থাৎ ধীরেন ছিল ফ্যামিলি প্ল্যানিং অফিসের গার্ড; বছর তিনেকের মধ্যে ধীরাবাবুর যোগাযোগে তরুর ছোটোমামার ইলেকট্রিক মালামাল সাপ্লাই ব্যবসার সরকারি খরিদ্দার জুটে যায়। সেইভাবে ভাবলে ধীরাবাবু যা সয়সম্পত্তি করেছে, তরুর মামাদের ভাড়াটিয়া হয়ে থাকার তেমন কোনো কারণ নাই তার; তবু পরিবেশ একটা বড়ো ব্যাপার; বিশেষত উঠতি বয়সের দুই ছেলেমেয়ে কখন জানি নষ্ট হয়ে যায় আর একটা প্রতিবন্ধী আর একটা নবজাতক শিশু আর একটা ফরসা সুন্দরী বউ—তিরিশের কোঠার এয়োস্ত্রী— বিশ্বাস কীসের—এই সবাইকে নিয়ে সুগ্রন্থিত এই মহাপরিবার থুয়ে ধীরাবাবু কোথায় যাবে—এই কথা ধীরাবাবু বলে থাকে। এদিকে লিপি আর রুবেল–দুইজনই তাদের স্কুলজীবন কাটিয়েছে তরুর আইবুড়া সেজো মাসির চড়চাপড় খেয়ে; সন্ধ্যা হলেই দুইজন বইখাতা বুকে নিয়ে উঠে আসত তরুর মামাদের দালানঘরে—উঠানের এই ধার আর ওই ধার, যেন পাঁকের থেকে জলহস্তীশিশু উঠে আসত; তরুর সেজো মাসি ঠাকুরঘরে সন্ধ্যাবাতি দিয়ে এসে তারপর ওদের পড়তে বসাত, পড়াতে পড়াতে উঠানের কোণে রাখা দায়ের একখানা রাবণকোপে নারকেলের শক্ত ছোবড়া আলগা করে ফেলত আর টুকরাগুলি গুঁজে দিত জ্বলতে থাকা ধুপচির কানায় আর সুগন্ধী ধোঁয়ায় তার সমস্ত মুখ দপদপিয়ে জ্বলত; ত্রিভুবনের নিঃসন্তান কর্ত্রীর মতো ওদেরকে সুদকষার অঙ্ক করতে বসিয়ে দিয়ে চপ্পলের চটাশ-চটাশ শব্দ করে ডালে সম্ভার দিতে যেত সেই আসুরিক রান্নাঘরে। “লিপি আমাদেরই মেয়ে”—–তরুর আইবুড়া সেজো মাসি ইস্কুলের শিক্ষয়িত্রী ছিল; লিপিকে পাত্রস্থ করার চাপ যখন ধীরাবাবুর উপর পড়ল, তখন তরুর মামা-মাসিরা দায়িত্ব নিয়ে লিপিকে মাধ্যমিক ক্লাস থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কাজটা সেরেছিল। আজ চৌকির উপর বসা তরুর দিদিমা সলতে পাকাতে পাকাতে লিপির চোখ এড়িয়ে একবার লিপির শরীরটার দিকে দয়ালু পরীক্ষকের মতো চাইল। “ঠাকুর ও! গোবরডাঙা পাট্টির সাথে কথা আগায় যানি।” পার্টি না আবার শেষমেশ পিছিয়ে যায়, ফেউ দিয়ে বিয়ে ভাঙচি দেওয়ার লোকের তো অভাব নাই শহরে। চৌকির উপর তরুর দিদিমার ব্যস্ত হাত এইসব ভাবনায় শ্লথ হয়ে পড়ল; লিপির পূর্বকলঙ্কের কথা আরেকবার মনে পড়ায় দিদিমা-বুড়ি নিজের উরুর উপর কাপড়টা একটু টেনে যথাসম্ভব ঢেকেঢুকে বসল, সাথে নিজের এবং মেয়েছেলেদের নানান বয়সের ভুলের স্মৃতিগুলিকে মনের হাত দিয়ে মাছির মতো তাড়াল।
তরুর দিদিমার সাথে লিপির সখ্য পুরানো। বুড়ি ত্যক্ত হবে জেনেও সকলের সামনে আহ্লাদ করে লিপি জিজ্ঞেস করতো, “আচ্ছা ঠাকুরমা, চালভাজা খায় বুঝি আলিক্ষি? সাঁজবাতির সুমায় খুলা চুলি থাকলি কী হয়? গরুর দাস্ত হলে জ্যান্ত পোকা খাওয়াতি হয়, সিডা বুঝি ঠিকোই?” সারা সংসারে এক লিপি ছাড়া আর কে-ই বা তরুর দিদিমার সাথে মিথবদ্ধ জীবন-অভিনয়ের ভিতরে মিলিত হয়? আজকে যেমন লিপি স্বপ্নের ব্যাখ্যা চেয়ে বসল; কার যেন বিয়ে হবে, লিপি সেই কন্যার লালরঙের গাছকৌটায় তেল মালিশ করছিল— এই স্বপ্নের মানে কী হতে পারে? তরুর দিদিমার কাছে এই প্রশ্ন অশ্লীল লাগল না, তরুর সেজো মাসির কাছে লাগতো নিশ্চয়ই; আইবুড়া মেয়েলোকের যদি বহির্জগৎ বলে কিছু থাকে, যেখানে জাত-বেজাত, আপন-পর মিলে-মিশে ভেঙে জুড়ে যায়, তাহলে সে লাজ-বেলাজ ছাড়া আর কীসের বাছবিচার করবে গো? বুড়ির মনে পড়ল, তার কাকাতো দিদির বিয়ে হয়েছিল কৃষ্ণরূপ গোবর্ধন শিলার সাথে; স্বপ্নে গোষ্ঠে লীলারত শ্রীকৃষ্ণকে দেখার পর দিদিটিকে দীক্ষা দিতে বৃন্দাবন থেকে গুরু এসেছিলেন — নাম রমণীমোহন দাস বাবাজি, তখনো এপার-ওপার ভাগ হয় নাই, এখন তো বর্ডার বুড়ির হাতের আয়ুরেখার চেয়ে গাঢ়। বুড়ি এখনো শাদাচোখে দেখতে পেল—ষাটোর্ধ্ব বাবাজি একটা কালো পাথরের উপর মেঘের মতো কুচকুচে একটা পরচুলা বসালেন—শিখিপুচ্ছ মানে ময়ূরের পেখম বসানো—আর ওই পাথরের গায়ে একটা বাঁশি হেলান দিয়ে ঠেকিয়ে রেখে দিদিটিকে বললেন, “প্রাণের স্বামী ভেবে এই বাঁশির উপর কৃষ্ণের পূজা-অর্চনা-শিঙার করবে। এই বাঁশিই তোমার বংশীধারী শ্যামসুন্দর কৃষ্ণ। তোমার জাগ্রত স্বামী।” সেই দিদিটি বারকয়েক রাতের দুঃস্বপ্নের মধ্যে জেগে উঠে “পারব না, বাবাজি; পারব না, বাবাজি” বলে পাখির ছানার মতো কঁকিয়ে উঠেছিল, এইসব আবছা মনে পড়ত তরুর দিদিমাদের। দিদিটির কথা মনে হয়ে তরুর দিদিমার চোখ কেঁপে উঠল, কিন্তু দিদিটির চেহারা পুরাটুক আর মনে করতে পারল না বুড়ি—চোখটুকু মনে হলে ঠোঁট হারিয়ে গেল; গালটুকু মনে হলে চুল; ভুরুটুকু মনে হলে কার যেন কামড়ে ছিঁড়ে-নেওয়া কানের লতি। লিপিকে ভুলেও এইসব কথা বলল না তরুর দিদিমা। লিপির বিয়ে বাঁশির সাথে হবে না—সময়ের এতটুক ধাক্কা তরুর দিদিমাদের জীবনজাহাজে লেগেছে বহুদিন হলো, হক কথা। তবে আজ লিপির বিয়ে গোবরডাঙা পাট্টির সাথে ঠিক হওয়া চাই-ই চাই।
*
ভাড়াটিয়াদের বাড়িতে তরু কখনো অতিথি আসতে দেখে নাই। আজকে তরু দেখল যে, কোনো গুরুত্বপূর্ণ অতিথি এলে তাদেরকে তরুর মামাদের দালানঘরে নিয়ে এসে বসানো হতো। মামাদের দালানঘরটা দেখলে তরুর মনে হতো পুরাতনকে ধাপে-ধাপে সংস্কার করার একটা স্থায়ী, অসম্পূর্ণ চক্রের মধ্যে ঘরটা ঢুকে গেছে। লিপিকে যারা দেখতে আসবে, ওই দালানঘরের বৈঠকখানাতেই বসবে তারা। ওরা আসার আগে কী হলো—তরুর সেজো মাসি ন্যাকড়া দিয়ে ঘর ঝাড়পৌঁছ করার সময় চুপচাপ একটা বাঁধানো ছবি উল্টে রাখল, মাতা মেরি বুক অনাবৃত করে জিশুকে দুধ খাওয়াচ্ছিল সেখানে, দুজনের মাথার চারদিকে ডামা-ডামা পিরিচের মতো শাদা জ্যোতির্বলয় ছিল। চিনামাটির ফুলদানিতে, যা আবার বট কি অশ্বত্থ গাছের আদলে বানানো আর সেই মতো রং করা, বারবার ফুল রাখছিল সেজো মাসি আর ফুলের ভারে ফুলদানিটা মূর্ছা যাচ্ছিল বারবার। তাই দেখে রনি বারবার হেসে উঠছিল। তরু আর রনি মিলে তরুর সেজো মাসির সাথে হাতে-হাতে ঘর গুছিয়ে দিচ্ছিল। এক পর্যায়ে রনি পড়ার টেবিলটার উপর থেকে একটা রুলটানা খাতা টেনে নিল, খাতার মধ্যে একটা সেলাইয়ের জোড়া খুঁজে বের করে একজোড়া পাতা টেনে ছিঁড়ে নিল আর তারপর পাখনা মেলে ধরল দুই প্রান্তের—কাগজের পাখিটার মাঝখানে হাঁ করে চেরা। খুশিতে রনি “পাখি, পাখি, পাখি” বলে উঠল। কাগজটা মেঝেতে ফেলে রনি আরেক জোড়া কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে আবারও “পাখি, পাখি” করতে থাকল। এতে খাতার সেলাইটা ঢিলা হয়ে যাওয়ায় তরুর সেজো মাসি রনিকে শাস্তি দিলো আর তরুকে ঘর থেকে বের করে দিলো। তরু জানালা দিয়ে দেখল, কান ধরে উল্লম্ব দোলকের মতন ধ্রুব বিরতিতে রনি উঠছিল-নামছিল পুরাদস্তুর হাসিমুখে। তরুর সেজো মাসিকে রুবেলদের মা চিনু ডাকত ঠাকুরঝি। লিপি আজকে তরুর সেজো মাসির শাড়ি পরবে আর একহাত ঘোমটা দিয়ে গান করবে। আসুরিক রান্নাঘরে পায়েসের বাটিতে শীর্ণ কিশমিশগুলি ফুলে ঢোল হচ্ছিল। পাত্র ওইপারের স্থায়ী নিবাসী। পাত্রদের আদিবাড়ি এইপারেই—দূরে। “সংগ্রামের সময় বর্ডার পার হইয়া ত্রিপুরা পলায়া গেছিলাম। সেইখান থেকে গোহাটি। আসামে আর কী। ওইখানে ছিল আমার বড়ো ননাসের বাড়ি। সংগ্রামের পরে গেলাম আমার ভাইয়ের বাড়ি গোবরডাঙা, ওইখানে বাবু জমি কিনলেন”, পাত্রর মা বলবেন পরে।
সন্ধ্যা হই-হই করছিল যখন, তখন রুবেল ঘরে ফিরল। লিপি বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে হাসতে হাসতে রুবেলকে জানালো যে, “সব গান থেমে যায়, সব ফুল ঝরে যায়” – এই গানটা নাকি পাত্রর আগে থেকেই শোনা আছে। ওইপারে নাকি এইসব গান ঠিকই যায়। রুবেল ধীরাবাবুর দিকে তাকাল, ধীরাবাবু ছেলেকে পাত্তা দিলো না; উলটা তরুর মামাদের দালানঘরের অতিথি-আপ্যায়নের পর বেঁচে যাওয়া চা- জলখাবার টেলিভিশন-সমেত গিলতে লাগল। চায়ের কাপের উপর সর জমেছিল, তাতে একটা আলোর পোকা। বর্ডারের ওইপারের ভক্তিমূলক অনুষ্ঠান দেখা যাচ্ছিল টেলিভিশনে, একটা শকটের পিছে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের ছবি আঁকা।
“বাবু, কিরাম বুইজতিছ?” রুবেল জিজ্ঞেস করল।
“হুঁ”, ধীরা টেলিভিশনের পরমাত্মার মাঝে প্রায় বিলীন হয়ে গিয়েছিল। একটা ডালের বড়া বা আলুর চপ কামড়ে তার ভিতর রাঁধুনীর চুল পেল ধীরাবাবু, বহুত লম্বা চুল। মনোযোগে বিভ্রাট হওয়ায় বিরক্ত হয়ে নীরবে মুখের ভিতরে আঙুল পুরে চুলের এক প্রান্ত টেনে বের করে অপর প্রান্ত থু-থু করে বের করে দিলো। পাত্রপক্ষ বিদায় নেওয়ার পর ধীরাবাবু প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গির মতো করে ধুতি পরে নিয়েছিল। কুমোরের একতাল কাদামাটির মতো অর্ধসমাপ্ত ধীরাবাবুর মুখ। বিশেষ বিশেষ দিনগুলিতে ধীরাবাবু গলার মাজা সোনার চেইন শার্টের বাইরে বের করে রাখত। সেইদিনও তাই করেছিল।
লিপি রনির জন্য গ্লাসে দুধ বানাতে বানাতে রুবেলকে দালানঘরে পড়তে যেতে বলল। দালানঘরে গিয়ে রুবেল উঁ-উঁ করে পড়তে থাকবে আর রনি পাশে বসে অশিক্ষিত বিড়ালের মতো চোখে চশমা দিয়ে এবিসিডি বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকবে। ওই মুহূর্তে পড়তে যেতে অনিচ্ছুক রনি ঘরের ওইপারে বসে চোখ বুজে দুধ নাড়ার আওয়াজ পেল। গ্লাসের তলায় চামচ ছেঁচড়ে যাচ্ছিল চিনি গুলতে গিয়ে। “ভাই, ভাই, মিঠে দুদু খাইবে”, রনি বলল। আচমকা বাপের সামনেই রুবেলের বিচ্যুতি ঘটল। “চুপ কইরে থাক, মাগি!” বলে লিপিকে মুখ-খিঁচড়ে গাল দিলো রুবেল। ধীরাবাবু টেলিভিশন থেকে চোখ সরাল না। লিপি চুপচাপ দুধ গুলতে থাকল। খাটের উপর থেকে ওদের মা চিনু অসহায় চেহারা করে ছেলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল।
ডুমুর গাছটার পাশে বেজি দৌড়ে যাচ্ছিল মুখে একটা ইঁদুর নিয়ে। অন্ধকারে তরুকে ডেকে নিয়ে এসেছিল রুবেল। বাউন্ডারি দেওয়ালের ওইপাশে রিকশার টুংটাং শোনা যাচ্ছিল, রিকশাগুলির তলায় হারিকেন ঝোলানো। রুবেল একটা সিগারেট ধরাল। রুবেলের হাত থেকে সন্তর্পণে একটা কাগজের পুরিয়া নিল তরু; পুরিয়াটা খুলে একটা গোলাপি বড়ি নিয়ে মুখে পুরল। নৌকার পালের মতো ফুলে-ফুলে উঠল ওর বুকের ভিতরটা, কিন্তু সেইসব বাইরে অদৃশ্যই থাকল। শরীরের সমস্ত স্নায়ু ঝংকার দিয়ে উঠল ওর, কেউ যেন আচমকা একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়েছে ওর গাল বরাবর আর তারপর ছাতির উপর বসে এলোপাতাড়ি মারছে। ঘরে গিয়ে বালিশে পাশ ফিরে শুয়ে তরু কানের ভিতর কেমন দ্রিমদ্রিম কুচকাওয়াজের শব্দ শুনতে থাকল। বালিশের চাপে কান বুজে আসায় ওর ভিতর থেকে বুকটা লেফট-রাইট করতে করতে বেরিয়ে আসতে চাইছিল বুঝি। তরুর দুনিয়ায় একটা উজ্জ্বল লাল গালিচা অস্বাভাবিক দ্রুত ছড়িয়ে যাচ্ছিল, অশরীরী কেউ বাতাসের বেগে সেই গালিচা খুলে দিচ্ছিল। সেই সময়ে রুবেলদের মা ওদের নতুন ভাইকে গান গেয়ে ঘুম পাড়াচ্ছিল। ওদের ঘর থেকে গানের প্রত্যেকটা ধ্বনি ফুল ভলিউমে টেলিভিশনের মতো বর্ধিত শক্তিতে তরুর কানে আসতে লাগল—
কীসের লেখা, কীসের পড়া গো, দাইমা? কিছুই ভালো লাগে না।
বারো দিনের শিশুর সনে গো জাদু, ক্যামনে হইবে বিয়া?
আমার জাদু, জাদু গো।
৩. যে ভাঙিবে কামের ধনু গো, শূর্পণখা তারই
শূর্পণখার করুণ পরিণাম, অর্থাৎ রাম-রাবণ যুদ্ধের অজুহাত দেখার জন্য সকলে দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছিল। এমন তো নয় যে, শহরে কারও জানা নাই যে, শূর্পণখার নাক-কান কাটা যাবে ওই আর্য যুবরাজের হাতে। সকলেই বুঝতে পেরেছিল যে, প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ভিনদেশ থেকে বনবাসে আসা রাজপুত্ররা জঙ্গলের নিয়ম জানলেও বনের নিয়ম জানত না। আর এত দুর্বিনীত, উগ্র কেন ওরা? উগ্রতায় ওরা রাতে ঘুমাতে পর্যন্ত পারতো না, পাতায় শিশির পড়ার শব্দে হাত বাড়িয়ে বাণাধার টেনে নিত শয্যার কাছে। সিরিয়ালের এক-এক দৃশ্যে যতবার ওরা আসত, ততবার শাঁই-শাঁই অসিচালনার রক্ত জল-করা শব্দ আর হায়েনার অশুভ ডাকওলা আবহসংগীত বাজানো হতো। শূর্পণখাকে দর্শকদের ভালো লেগে গিয়েছিল। ওর সাথে অন্যায় হয়েছিল গো। এলাকার সকলে ওকে সুপোরনাখা নামে ডাকত; ওর আসল নাম ছিল মীনাক্ষী, মাছের মতন সুন্দর বড়ো-বড়ো চোখ যার; আহা, কালোর মধ্যে মেয়েটা কী মিষ্টি! দশরথের রাজত্বে না-হয় মেয়েরা মাথায় একহাত ঘোমটা দিয়ে, নজর নিচু করে জলকে যেত, কিন্তু রাবণের রাজত্বে তো মেয়েদের নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে ছেলেদের পাণিপ্রার্থনা করার রীতি ছিল। কেউ কেউ বলল, “আহা, উড়া ভুল বুজাবুজি” — যেই দেশে মহলের মেয়েছেলে আর চাষের জমি আর গোহালের গরু আর অশ্বশালার ঘোড়া তুল্যমূল্য—এমন তো নয় যে, সেই দেশ কল্পনা করে নেওয়া খুব কঠিন—সেই দেশের রাজপুত্র ওই রকম অচেনা অনার্য চেহারার একটা মেয়েছেলেকে হাসতে হাসতে বরমালা নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে ভয় পাবে, এই তো স্বাভাবিক। বাকিরা ওদের থামিয়ে দিলো, “আরে, রাখো দিনি!” তরুর মামা দোকান বন্ধ করে রোববারদিন আগে-আগে ফিরলেন। তরুর দিদিমা আর মাসিরা দুপুরের ভাতঘুম থেকে উঠে পাটভাঙা শাড়ি পরলেন; লিপিদের বাড়ির নতুন টেলিভিশনে রামায়ণ দেখতে দলে-দলে প্রতিবেশীরা আসবে, তাই। রুবেল আর রনি ওদের ঘরের ময়লা মেঝেতে বসে জল দিয়ে গিলে- গিলে ভাত খাচ্ছিল; তরু চেয়ারের উপর ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে ছিল ওদের খাওয়া শেষ হওয়া পর্যন্ত। নতুন ভাই বিছানায় ওর ছোট্ট কোলবালিশের ব্যারিকেডের ওপারে ঘুমাচ্ছিল; ঝিনুকের খোলার মতো শক্ত করে খুঁজে ছিল ওর হাতের তালু। “ই কিরাম কইরে খাইচিস?”, লিপি রনির পাতের আধখাওয়া আলুর টুকরাগুলিকে সরিয়ে এঁটো বাসনগুলি তুলে ঘাটের দিকে গেল। কাকে উড়ে এসে সাবান নিয়ে গেছে, তাই ছাই দিয়েই মাজতে হবে; নখের বারোটা বাজবে তাতে, বয়স্ক মেয়েলোকের মতো গজগজ করতে করতে লিপি থালা হাতে ঘর থেকে নেমে গেল। জনপদের নিশ্ছিদ্র সাজ-সাজের ভিতর দিয়ে গলে বের হয়ে গেল তরু, রুবেল আর রনি। সবাই রামায়ণ দেখবে বলে মধ্যদুপুর পার হতেই পথঘাট সব সুনসান হয়ে পড়েছিল।
ফুলের কোল্ড স্টোরেজটা ডাইনে ফেলে চৌরাস্তা, বেশিরভাগ দোকানের ঝাঁপ ফেলা; রাস্তার অস্থায়ী দোকানগুলিতে সার-সার শূন্য ঝাঁকা আর তাতে মরা সাপের মতো দড়ি আর গামছা ফেলা। আনন্দবাজারের পরে আবাসিক এলাকা— পুরানো ও অভিজাত, সেখানে রনির ডান পা ড্রেনের ভিতর ঢুকে গেল। আবাসিক এলাকার কালচে সবুজ পিত্তরস থেকে পা তুলল রনি, ছেঁড়া স্যান্ডেলটা তখনো একটা আধমরা কালো বিড়ালের মতো ওর পায়ের বুড়া আঙুল থেকে ঝুলছিল। “পাও, পাও, পাও”, বলে ঘ্যানঘ্যান করতে থাকল রনি; রুবেল বিরক্ত হয়ে ওর মাথা ঠুকে দিলো। এই এলাকায় টিপকল আর খোলা পায়খানা নাই, বাঁধানো নর্দমা আর তিন-চারতলা বাড়ির গায়ে অনেকগুলি ধাতব সরলরৈখিক শিরা। রুবেল বলল যে, একটা সময়ের পরে এই বাড়িঘরের ছোটো মানুষগুলি বড়ো হয় আর তারপর রাজধানী শহরে গিয়ে থাকে, এখন যেখানে তরুদের বাসা।
“আমরা স্বরূপা দিদির বাসায় যাচ্ছি এখন।”
“দূরে?”
“বাসে উঠব। এখেনেই থামে বাস। দাঁড়া এখেনে।”
“একা একা বাসে উঠব?”
একা কই? তিনজন আছি। আচ্ছা, রনিরে হিসাব করলি আড়াই জন”, রনি রাস্তার পাশে নিচু বাউন্ডারি-ঘেরা এক টুকরা জমিতে উঠে গিয়ে খোঁটায় বাঁধা দুইটা বাছুরকে ‘শিয়াল, শিয়াল’ বলে ঘুরে-ঘুরে ত্যক্ত করছিল। জমিসংলগ্ন সেলুন আর বাসাবাড়ি থেকে গমগম করে রামায়ণের আওয়াজ ভেসে আসছিল। শূর্পণখার অঙ্গহানির পর্ব শেষ, কিন্তু আরও ঘণ্টাখানেক চলবে সিরিয়াল।
“দেরি হয়ে গিলি?”
“আরও দেড় ঘণ্টা সবাই টেলিভিশন দ্যাকবে নে।”
জনাকীর্ণ সেলুনের একটা ঝাঁপ আধখানা নামিয়ে রাখা। সেই ফাঁক দিয়ে তখনো এক-দুইজন করে লোক ঢুকছিল, চুল-দাড়ি কাটতে না অবশ্যই; ফুল-ভলিউমে সিরিয়ালের গান শুনতে। উঁচু গ্রামে বেহালা বেজে উঠল সেলুনের ভিতর থেকে। প্ৰাক-সংগীত শেষ হতেই নারীকণ্ঠে গান শুরু হলো—
“মীনাক্ষী, মীনাক্ষী” বলি কান্দে লঙ্কারাজ,
“কে করিল, কে করিল দুর্মতির কাজ?
বলহ ভগিনী, মোরে বল গো খুলিয়া।”
“দেবতা দেখিনু এক নয়ন তুলিয়া।
হাতে ধনু, শিরে জটা, কমললোচন,
ভালোবাসি তারে গো, নাম তার লক্ষ্মণ।”
“হতভাগী, বল তুই গিয়াছিলি কোথা?
কী হেতুতে ক্রুদ্ধ হলো সেই সে দেবতা?”
“শুন শুন দাদা মোর প্রেমে আছে দোষ,
প্রেমেরই কারণে প্রিয়তম করে রোষ।
ভালোবাসিয়াছি তাই কাটা গেল নাক,
ছিন্ন হউক মোর অঙ্গ, সে আনন্দে থাক।”
“ভণিতা ছাড়িয়া শীঘ্র নাম কহ তার।”
“সাজা দিও না গো তারে-মাথা খাও আমার।
পঞ্চবটী বনে আছে দুই রাজভ্রাতা;
আরও আছে নারী এক, নাম নাকি সীতা।”
“কী বলিলি! সীতা? মানে জনকনন্দিনী?”
“তুমি তারে চিন! তবে আমিও কি চিনি?”
“কী বলিব তোরে আর অতীতের কথা!
একদা এ রাবণেরই কন্যা ছিল সীতা।
গণক বলিল তারে ফেলি দিতে জলে,
না-ফেলিলে লঙ্কা নাকি পুড়িবে অনলে।”
গানের শেষ কলি শেষ হতে না-হতেই ঢোল-করতাল-খোল-ডমরুর ঐকতান শুরু হলো আর মুহুর্মুহু বাজ পড়ার শব্দের সাথে যন্ত্রসঙ্গীতের লয় দ্রুততর হতে লাগল, যেন টেলিভিশনের ভিতর থেকে ভূত-প্রেত-ডাকিনী-পিশাচ সবে একত্রে সেলুনের চারটা দেয়ালের ভিতরে নেমে আসছে আর ওদের সর্বাঙ্গ বেয়ে নর্দমার গাঢ় আঠালো কালচে তরল পড়ছে আর নাপিতের ক্ষুরের এক পোঁচে ভুলক্রমে কেটে যাওয়া কারও পুরাতন নাকের ভূত কবরের অন্ধকার থেকে জ্যান্ত হয়ে উঠে এসে ওদের সাথে যোগ দিয়েছে। সেলুনের ভিতর হই-হই পড়ে গেল; দর্শকরা বিমূঢ় হয়ে কেউ আর্তনাদ, কেউ ফোঁসফোঁস আর কেউবা চেয়ার ঠেলে ঠেলে ফেলে দিতে শুরু করল। “কইয়েছিলাম কি না? কইয়েছিলাম? ওই সীতা মাগি রাবণেরই মেইয়ে!” আহা গো, কত দুঃখে বুকে পাথর বেঁধে রাবণ আর মন্দোদরী দম্পতি ছোটো ডিমের মতো ছোটো মেয়েটাকে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিয়েছিল গো! রাজগণকের কি পাষাণের মন গো? এখন রাবণ কী করে! কী করে সে! আদর্শ ভাই হয়ে বোনের নাক-কাটার প্রতিশোধ নিতে আর্য যুবরাজদের খুন করে? নিজের কন্যাকে অকালে বিধবা করে? নাকি আদর্শ পিতার মতো ভিখারির ভেক ধরে পঞ্চবটী বনে গিয়ে বর্বর স্বামী আর দেবরের হাত থেকে নিজের মেয়েকে উদ্ধার করে? সকলেই অবশ্য ভালোমতো জানে, এর পরে কী হয়; সীতাহরণের কাহিনি সিরিয়ালের আগের পর্বেই দেখিয়ে ফেলা হয়েছে কি না, শূর্পণখার নাক-কাটার কাহিনি আজ দেখানো হচ্ছিল ফ্ল্যাশব্যাকে, অথচ সকলের উত্তেজনা দেখে মনে হচ্ছিল আগের পর্বের সমস্ত গল্প ওরা ভুলে গেছে; আজকের এই নতুন উৎকণ্ঠার কাছে আগের পর্বের স্মৃতি ম্লান হতে-হতে নাই হয়ে গেছে। জনপদের সকল লোক এই মুহূর্তটির কারণে সকল ইতিহাস ভুলে গেছে।
এইসবের মধ্যে অনাহুত রাক্ষসের মতো বাস এসে গেল। রনি সকলের আগে পায়ে-পায়ে বাসে উঠে গেল, একদম সামনের সিটে বসে দুইহাত ভর দিয়ে অনবরত লাফাতে লাগল আর বলতে লাগল, “শিয়াল, শিয়াল, শিয়ালঙ্কা, শিয়াল, শিয়াল- শিয়ালঙ্কা”। রুবেলের পিছে-পিছে বাসে উঠে তরু দেখল বাসের দুই সারির মাঝখানে ছেঁড়া জামাপরা একটা লোক হাতে হাতকড়া পরে দাঁড়িয়ে আছে, লোকটার ঠোঁটের কোণে রক্ত শুকিয়ে আছে, গায়ের ধুলামলিন শার্টটা মনে হয় কারও পিটুনি আর টানাটানিতে ছিঁড়ে গেছে। লোকটা সিটের হাতলের সাথে হাতকড়ায় আবদ্ধ। তাকে দাঁড় করিয়ে রেখে দুইজন পুলিশলোক দুই সিট অধিকার করে বসেছিল। কন্ডাক্টর কাছে আসলে তরু আর রুবেল টিকেট কাটল, রনির টিকেট মাফ। কন্ডাক্টর হাসতে হাসতে হাতকড়া-পরা লোকটার দিকে ইঙ্গিত করে বলল যে, বাড়ির বউ-ঝি-গৃহস্থদের সিরিয়াল-আসক্তির সুযোগ নিয়ে ছিঁচকে চুরি করতে লোকটা ঢুকেছিল নাকি কার বাড়িতে। রুবেল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “গাঁজারু না?” তাতে কন্ডাক্টর ছিক্ করে হেসে বলল, “গাঁজা খাতিই তো চুরিচামারি কইরে চলতি অয়।” তরুর দিকে চোখ পড়ায় কন্ডাক্টর আরও চওড়া করে হেসে বলল, “ওরেব্বাপ! লক্ষ্মণের মুখটো একেবারে কাইড়ে নিয়েচে। সুপোরনাখার নাক কাইটে এয়েছে য্যান মাত্রই।” পুলিশলোক দুইজন নিরাসক্ত চোখে তাকানোতে তরুর মুখ থেকে ভদ্রতার হাসি মিলিয়ে গেল। তাই দেখে, নাকি তরুর মুখের সাথে সিরিয়ালের লক্ষ্মণের মুখের সাদৃশ্য আবিষ্কার করে, পুলিশ দুইজন পরিচিত মানুষ দেখার মতো করে মৃদু হেসে উঠল। তরুর ভয়-ভয় করল, তাই সে চোখ সরিয়ে নিল। ধুলায় ঢাকা বাসের জানালার ভিতর দিয়ে সে বাইরে তাকাল। বাস একটা ভাঙা রাস্তায় নেমে গেছে, যেরকম রাস্তা দীর্ঘদিন অর্ধনির্মিত হয়ে পড়ে থাকে। রাস্তার একধারে ইট, সুড়কি, বালুর স্তূপ। আরেকধারে আবর্জনা আর পলিথিনে প্রায় খুঁজে যাওয়া একটা পুকুর, তার চারধারে পত্রহীন কয়েকটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। গতবছর গরমের ছুটিতে এসে তরু বান্দরলাঠি ফুলকে কৃষ্ণচূড়া বলেছিল; তাই শুনে তাচ্ছিল্য করে লিপিদি গাল টিপে দিয়েছিল।
কয়েক স্টপ পরে ওরা নেমে গেল। কন্ডাক্টর, হাতকড়া-পরা লোকটা আর নিরাসক্ত চেহারার পুলিশলোক দুইজন একযোগে তরুর দিকে চেয়ে রইল। তরু ওই মুহূর্তে রুবেলের একটা ছায়া হয়ে ওঠা ছাড়া নিজের অন্য কোনো রূপ আকাঙ্ক্ষা করছিল না; আসলে তরু যে চোখে রুবেলকে দেখুক বলে রুবেল চাইত, তরু তারই একটা প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছিল; রুবেল সত্যি-সত্যি যেমন, ততটা তেমন তো তরু নয়। রুবেলের নেতৃত্ব মেনে নেওয়ার খাঁটি সদিচ্ছা থাকায় তরুর মুখ প্রায় সর্বক্ষণ জিজ্ঞাসু হয়ে থাকত। এদিকে কন্ডাক্টরের মুখে লক্ষ্মণ শোনার পর থেকে রনি ‘লশমন, লশমন’ করে যাচ্ছিল সমানে। রুবেল আর তরুর পিছে পিছে একটা পোষমানা প্রাণীর মতো রনি হাঁটছিল খালি পায়ে, ছেঁড়া আর আস্ত স্যান্ডেল দুইটা ওর প্যান্টের পিছপকেটে গোঁজা। হাঁটতে হাঁটতে রনির পায়ে যখনই সুড়কি বিঁধছিল, ও খালি পায়ে বারবার ওই সুড়কিগুলিকে পিষছিল, যেন পদাঘাতে সাপ মারছে। ঠিক সামনে তাকিয়ে রনি দেখতে পাচ্ছিল ঘন জঙ্গলের ভিতর, যেমন দণ্ডকারণ্য, দুই ভাই হেঁটে যাচ্ছিল ওর আগে আগে। দুইজন শিক্ষানবিশ ব্যাধ।
“ যে মাল সাপ্লাই দেবে নে”, আতাগাছের নামে নাম ছিল তার, “ওর নাম শরীফা”। ‘স্বরূপা দিদি’ বলত রুবেলরা; স্কুলের বাদবাকি স্বজাতি ছেলেরাও তাই ডাকত, মানে যারা এই লাইনে কমবেশি ছিল। শরীফা জিজ্ঞেস করে, “কী নিবি? গুটি না ঝাক্কি?”। বিজয় দিবসের সাপ্লাই; মিলিয়ে মিশিয়ে নিতে হবে। শরীফার ভাই রিপন আর সরদারের বড়ো ছেলে আবার ছিল হরিহরাত্মা। লিপির উপর চোখ ছিল রিপনের। লিপিরও হয়তো ওকে ভালোই লাগতো।
“তুর বুনরে বে দিচ্চিস? চালানের টেনিং দিতি পারতো রিপইন্না ওরে। “
“কী আর করবে তুমরা? লিপির বে ভেঙে দিতি পারো কি না দেখো। ইন্ডিয়ার জামাইবাবুকে তো আর উঠোয় নিয়ে যাতি পারবা না। হাত-পা ভাইঙ্গে লুলা কইরে দেওয়া তো সম্ভব না”, রুবেল নিজের বুক হাতাতে হাতাতে মৃদু হেসে বলল, যেন নির্বিষ বাস্তুসাপের লেজ নিয়ে খেলছে। শরীফা তার গোলাপি ওড়না বুকের উপর নতুন করে বিছিয়ে তারপর চেয়ারের উপর ওর ভারী শরীরটা গুছিয়ে বসল। ওদের বাড়ির ভিতর-সীমানায় ঢেউটিনের গায়ে অসংখ্য পোস্টার সাঁটানো। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন বুঝি সামনেই। একই প্রার্থীর মুখ আর তার একই প্রতীকের অজস্র ছবি পাশাপাশি উপর-নিচে, সামনে-পিছে; তরুর চোখে ধাঁধা লাগছিল। রনি এগিয়ে গিয়ে হাতের নাগালে একটা পোস্টার বেছে নিল আর প্রার্থীর মুখের ছবি থেকে চোখের জায়গা দুইটা খুঁটে তুলে নিল। রনি যেহেতু হাবাগোবা, ও বরাবর যে-কোনো ছবির একেবারে কেন্দ্রে মন দিত, ছবির আশেপাশের কোনো উপাদান দেখতে পেত না। শরীফা ওর দিকে চেয়ে প্রশ্রয়ের হাসি হাসল।
“আইচিস তা ভালো। কী খাবি ক। কুটুম নিইয়ে আইচিস আবার। রিপইন্না গেছে তালুকদার-বাড়ি টেলিবিশন দেখতি। আব্বা বাড়ি টেলিবিশন রাকতি চায় না রে…”
“সুমায় নেই। আরেকদিন হবে নে খাওয়া-দাওয়া। আইটেম দিলি পর এখন ওটব।” শরীফা ওড়নার আড়াল থেকে একটা ঠোঙা বের করে একটা স্নেহসূচক ত্রস্ততায় তরুর জ্যাকেটের ভিতরের কম্পার্টমেন্টে সেটা গুঁজে দিলো। তরু চোখ একটু বড়ো করে রুবেলের দিকে তাকাল, রুবেলের দৃষ্টিতে ভগবানের মতো অভয় ঝরে পড়ছিল। কথা বলতে বলতে শরীফা প্রদীপবাবু নামে সদরের একজন বড়ো নেতার মৃত্যু নিয়ে শোকপ্রকাশ করল। তবে নেতা নাকি নায়কোচিত ভাবেই গেছেন–নিজের লাগানো চন্দন গাছের কাঠ দিয়ে দাহ করা হয়েছে নেতাকে; সাথে দেওয়া হয়েছে ঘি ইত্যাদি; উনার ছেলেমেয়েকে আল্লাহ্ নেক হায়াত দান করুন। “রনি, ইদিকায়”, বলে রুবেল উঠে গেল। পরদিন শহরে রিপন ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ হবে, বাকি দেনাপাওনার হিসাব তখনই হবে—এইসব নিষ্পত্তিমূলক কথা সেরে রুবেল তরুকে নিয়ে উঠানের উপর নেমে গেল। শরীফার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল ওর আরও কিছু বলার ছিল। রুবেল বুঝল তরু উপস্থিত থাকায় শরীফা কিন্তু-কিন্তু করছিল।
“ও আমার ভাইয়ের মতন। কী?”, রুবেল বলল।
“রিপন টেলিবিশন দেখতি যায়নি কো। তোদের পাড়ায় গেইচে। লক্ষ্মীর খবর নিস বাড়ি গিইয়ে”, শরীফা এইবার রুবেলকে ভয় পাইয়ে দিতে সক্ষম হলো।
‘লক্ষ্মী মানে আমাদের ভাড়াটিয়াদের মেয়ে লক্ষ্মী?” তরু নিচু স্বরে জানতে চাইল। “স্বরসত্যির বুন লক্ষ্মী। ওরা তো যমক। পুশকুন্নির উই পাড় থেইকে নাকি রিপইন্নার চেলা উজ্জ্বলরে স্যান্ডেল দেকাইচে ওই মেইয়ে। তা উজ্জইল্লা এসে রিপনরে ডাক দিয়ে নিয়ে গেল…”
স্যান্ডেল—শুনে আবারও রনি ‘পাও, পাও, পাও’ বলা শুরু করল। রুবেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রনি স্বাভাবিক স্বীকৃতি চাইছিল; রনি দেখল রুবেলের মুখ ভয়ে- সন্ত্রস্ততায় হিংস্র হয়ে উঠেছে। রুবেলকে রনি মাঝেমাঝে প্রচণ্ড ভয় পেত, রুবেল ওকে বারদুয়েক বেল্ট দিয়ে মেরেছিলও, কিন্তু ওর মন এই রকম দুর্ঘটনা আগে থেকে আঁচ করতে পারতো না। প্রতিবন্ধী শিশুটি এই রকম নিষ্ঠুরতাকে ভবিষ্যদ্বাণী দিয়ে বাঁধতে শেখে নাই। রনি দেখল স্বরূপা দিদি জামার ভিতর থেকে একটা চিঠি বের করে ভাইকে দেখাল, বারকয়েক লিপিদির নাম বলল, বারকয়েক বলল ‘রিপন’। চিঠি দেখে ভাইয়ের মুখমণ্ডল শাদা হয়ে গেল। ভাইয়ের চেহারা দেখে রনি বলে উঠল, “ভাই, ভাই। মা উইঠে পড়িছে। মা উইঠে পড়িছে। নতুন ভাই দুদু খাবে। মা খোজবে কিন্তুক। মারবে কিন্তুক।” রনি দেখল লশমন ভাইটাও রুবেলকে কনুইয়ের কাছ থেকে টেনে ধরে চলে আসার তাড়া দিচ্ছে। চিঠি স্বরূপাদির হাতে ফেরত দিয়ে রুবেল অবশেষে হনহন করে বাসস্টপের দিকে হাঁটা ধরল। লশমন ভাইটা ওর জাম্পারের ডানা আঁকড়ে ধরে বুকের ভিতর স্বরূপা দিদির ঠোঙাটা আগলে রাখছিল। সূর্য পশ্চিম দিকে দ্রুত রওনা হচ্ছিল—প্রাপ্তবয়স্ক রেশমপোকা গুটি কেটে বের হয়ে যায় আর নষ্ট তন্তু পড়ে রয়। মিহি কুয়াশায় রনির চোখে অশোকবন যেন স্বর্গ; হাঁড়ি-ঝোলানো খেজুরগাছগুলিকে ঢ্যাঙা পোয়াতি মেয়েদের মতো লাগছিল কুয়াশায়। “ভাই, ভাই। গুড়ের ঠিলে! বাদুড় মোতবে…” বাকিসব সহিংস সবুজ। ময়লা জলার মধ্যে আলোর আস্ফালন, নাকি মাছের আফালি? তাণ্ডব নাচের মতো উঠে সাথে-সাথে শান্ত হয়ে ভেঙে যাচ্ছিল। যেন স্বর্গের রাস্তা দিয়ে এই জগতে ঢুকে যাচ্ছিল ওরা।
৪. সাগরের জলে পড়ে গো রাইক্ষসের ছায়া
ত্রিমূর্তি ঘরে ফেরার আগেই সারা পাড়া খবর ছড়িয়ে গেল—লক্ষ্মীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। লক্ষ্মী-সরস্বতীর মা অঘ্রাণ-অমাবস্যার ব্রত রাখলেও টেলিভিশন দেখতে আর সকলের মতো লিপিদের বাড়ি গিয়েছিল——রামায়ণ দেখায় তো চিত্তশুদ্ধিও ঘটে; ফিরে এসে দেখে মেয়ে নাই। নাই তো নাই। তরুর মামারা এখনই থানাপুলিশ না-করে আরও ভালো করে খোঁজ করার উপদেশ দিলো। ভাড়াটিয়াদের আঙিনা লোকে লোকারণ্য। কেউ দেখে নাই লক্ষ্মীকে গো। হুঁশজ্ঞানলুপ্ত হয়ে টেলিভিশন দেখার জন্য লক্ষ্মী-সরস্বতীর মাকে কেউ দুষল না; আঙিনাস্থ সকলের জীবন যথেষ্ট মলিন, কদর্য। টেলিভিশনের সগুণ রাম-লক্ষ্মণের পিছনে তারা নির্গুণ পরমানন্দকে দেখেছিল, অর্থাৎ ধ্রুব সুন্দর মেগাসিরিজ রামায়ণকে, কিম্বা আরও ভালো হয় বললে যে, মেগাসিরিজই ওদেরকে দেখেছিল।
রুবেল আর তরু রুবেলদের বিছানায় হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইল। রনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতের গুলি ফোলানোর চেষ্টা করছিল, যেন ও মাছের মতো, যেন ওর কোনো বহিঃকর্ণ নাই, তাই ও আঙিনার হইচই, বায়ুবাহিত কোনো শব্দ গ্রহণ করতে পারছে না। লিপির শিয়রের কাছে একটা জানালা, বড়ো রাস্তার দিকে মুখ করে থাকায় সেটা পেরেক দিয়ে পাকাপাকিভাবে বন্ধ করে দেওয়া। সেই জানালাটাকে কুলুঙ্গির মতো ব্যবহার করতো লিপি। সেখানে জবাকুসুম তেলের শিশি, তেলা কাগজে মোড়ানো চন্দন সাবান, রক্তপদ্ম-মার্কা আলতা, আর ট্যালকম পাউডারের একটা ঢ্যাঙা বোতল—বর্ডারের ওইপার থেকে আসত এইসব। এইসব রাজধানীতে পাওয়া যায় না, গেলেও চড়া দাম। খুঁটিতে বাংলা ক্যালেন্ডার ঝুলছিল, সেখানে পিশাচসিদ্ধ এক কাপালিকের ছবি—সিঁদুরলিপ্ত নীলাভ চেহারা, কোপ দিতে প্রস্তুত এক শাদা শাড়ি, লাল পাড় মহিলাকে। মহিলা মাটির উপর অনুভূমিকভাবে পড়ে আছেন, যেন একটা ভ্রুণ। মহিলার চুলগুলি মেঘের মতো, যেন আঙুলের ছাপ বসিয়ে আঁকা হয়েছে কিম্বা বুড়া আঙুল কালচে রঙের রক্তে ডুবিয়ে কাগজের উপর মোবিয়ান মোচড় দিয়েছে কেউ। “দিদিরে ওই চিঠির কথা কবো?” রুবেল তর্জনীর মাথা দিয়ে বুড়া আঙুলের নখ ঘষতে ঘষতে বলে।
“কী ছিল চিঠিতে?”
“অঘ্রানমাসে গানের দল পাড়ায় আসলে, যেন রিপইন্নাও আসে। তারপর প্রেমের কথা লিখছে। দিদির হাতের লেখা তো আমি চিনি। ‘ল’–গুলি ‘ন’-এর মতো। সেজো পিসির হাতে কত্ত মাইর খায়েছে!”
“লক্ষ্মীকে রিপন-উজ্জ্বল ওরা তুলে নিছে, সেইটা আবার ওই স্বরূপা জানতও!” একদিনে এত অভিজ্ঞতা; ওইসবের চাপে তরু নড়বড় করছিল।
“কী জানি!” রুবেল লক্ষ্মীর বিষয়ে আর আগ্রহী নয়। “কাইলকে শহরে যাব। দিদির ব্যাপারটা নিয়া রিপনরে ঠাণ্ডা করতি হবে।”
“আজকের ঘটনার পর কালকে ওরা শহরে ঘুরে বেড়াবে?”
“বিজয় দিবস পশশুদিন। পোগ্রাম আছে। থাকবে নে ঠিকই।’
বাইরে রাত হচ্ছিল। লক্ষ্মী-সরস্বতীর মায়ের সুরেলা কান্না ছাড়া আর সব শব্দ আস্তে-আস্তে হারিয়ে গেল। লিপি বারোয়ারি রান্নাঘর থেকে ঘরে ফিরে নিঃশব্দে তরু, রুবেল আর রনির জন্য ভাত বাড়তে লাগল। ধীরাবাবু তখনো ফেরে নাই, “সার্চ পাট্টি ফিরতে এট্টু রাতই হবে।” মেয়েরা পরে খাবে। তরু কখনো এদের বাড়িতে খায় নাই। কিন্তু-কিন্তু চেহারা করে তরুর জন্য মাটিতে চাটাই পাতলো লিপি। তিনজনে থালার সামনে বসে পড়ল। রুবেল ঘ্যানঘ্যান করে বলল, “শাক নাই?” আর লিপি জবাব দিলো, “রাত্তির বেলা শাক?”। রনির হাত লেগে হঠাৎ জলের গ্লাস মেঝের উপর উলটে গড়াগড়ি খেতে লাগল, রুবেলের থালার সবটুকু ভাত ভিজে গেল, তরুর চাটাইও ভিজে সপসপে হয়ে গেল। এই পর্যায়ে রুবেল আর থাকতে পারল না; এঁটো হাতে রনির ঘাড়ের কাছে দুই-ঘা বসিয়ে দিলো। লিপি আর চিনু “ইকী, ইকী!” করে উঠল। রনি আর তরু অপরাধীর মতো চেহারা করে বসে রইল। রুবেল আচমকা নিজের মাটিতে বসা শরীরটাকে হিঁচড়ে চিনুর খাটের কাছে নিয়ে গিয়ে খাটের পায়ার গায়ে মাথা ঠুকতে ঠুকতে বলতে লাগল, “মা রে, মা রে! আর পারি না রে, মা!” আস্তে আস্তে রুবেলের গলা ভেঙে যেতে লাগল। চিনু একবার ‘এঁটো হাত’, ‘অশৌচঘর’–এইসব কী কী যেন বলল কয়েকবার খানিক জোরে, কিয়েকবার বিড়বিড়িয়ে; তারপর ছেলের বগলের নিচে নিজের দুই হাত ঢুকিয়ে নিজের কাছে টেনে নিল। রুবেল চিৎকার করছিল না, শুধু নিরুপায়ের মতো চাপা বিলাপ করছিল। এত রাতে কোথায় যেন কাক ডেকে উঠল গো। একে অমাবস্যা, তায় দিনটার শুভাশুভ কিছু ঠিক নাই। লক্ষ্মী-সরস্বতীর মায়ের কান্না তখনো গানের রেশের মতো বাজছিল। “রুবেল, তুই ইসব যা খাইচিস এতদিন, সব ছাড়ান দে”, ন্যাকড়া দিয়ে মেঝের জল মুছতে-মুছতে লিপি বলল।
বাইরে বাতাসের প্রলাপ। পুষ্কর্নির থেকে অচেনা আবর্জনার গন্ধ ভেসে আসছিল। ওই বাতাস জলে দ্রবীভূত হয় না গো। তরু আর রুবেলকে মাঝ-আঙিনায় আটকাল তরুর সেজো মাসি। চুল বিস্রস্ত, এঁটো বাসন কলতলায় রেখে ফিরছিল। তরুর হৃৎকম্প হলো, সিগারেট খেয়েছে ওরা; সেজো মাসি নিশ্চয়ই গন্ধ পাচ্ছিল।
“তুমি ভাড়াটিয়াদের ঘরে ভাত খাইছ?” সেজো মাসি খরখরে গলায় জিজ্ঞেস করল। তরু চুপ করে রইল।
“তুমি জানো না, আমরা ভাড়াটিয়াদের ঘরে এক গ্লাস জলও খাই না?”
দপ করে আগুন জ্বলে উঠল রুবেলের মুখে। দুরন্ত রাগে ঘাড় ঘুরিয়ে নিল ও। ওর মুখে থেকে কে যেন ছোঁ দিয়ে দয়ার ভাবটুকু নিয়ে চলে গেছে।
“রুবেইল্লা, চুপ ক্যান? ধীরাদা ফেরেনি?”
তরু দেখল রুবেল থুতনি দিয়ে এমনভাবে নিজের বুক খুঁড়ছে, যেন চোখ তুলে তাকালেই পৃথিবীর সমস্ত জিঘাংসা নিয়ে সেজো মাসির উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
“ছেলেটা আর মেয়েটা—দুইটাই নষ্ট হইচে। লিপির তো বুকে কাপড়ই থাকে না। বিয়ার কোনো ইচ্ছা মনে হয় নেই। সেজদার সামনে দেখি ওইদিন পাছা দুলাইতে দুলাইতে—লক্ষ্মীর মতো উঠাই নিয়া গেলে ভালো হবে?”
দুই মূর্তিমানকে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একদিক থেকে তরুর সেজো মামা তার বিড়াল আর টর্চবাতি হাতে হেঁটে আসলো। শীত পড়েছে; তরুর সেজো মামা পুরানো চপ্পল দ্রুত চপত-চপত করতে করতে, চাদরের হাওয়ায় বল- বল শব্দ করে, উলটা দীর্ঘশ্বাসের মতো জোরে জোরে নাক টানতে টানতে এগিয়ে আসলো। মুখে টর্চবাতির আলো পড়ায় রুবেলের অর্ধেকটা মুখ শক্ত চোয়াল নিয়ে জ্বলে উঠে তারপর নিভে শান্ত হয়ে গেল। আঙিনার আরেকদিক থেকে নেমে আসলো লিপি। তরুর সেজো মামার টর্চবাতির আলো যে ক্ষণেকের জন্য লিপির বুকের উপর স্থির হয়ে পড়ে রইল, তা কারও দৃষ্টি এড়াল না।
“সেজো পিসি, আমার ভুল হয়েছে। রাত হয়ে গিছিল, তাই ভাবলাম ভাত….”
“কথা কম, লিপি। ঘরে যা
*
রাত্রির তৃতীয় ভাগে রুবেলদের টিনমোড়ানো ঘরটার উপর কিছু একটা ভর করতো; লিপি ছাড়া ঘরের ভিতরকার আর সবাইকে বোবা বানিয়ে দেওয়ার আছর পড়ত একরকম। মা চিনুর কোলে ওদের নতুন ভাইও ঘুম ভুলে বোবা হয়ে ড্যাবড্যাব করে চেয়েছিল। তরুর দিদিমার কাছ থেকে শেখা পালাগান[১] গাইছিল লিপি—
ননদিনী কইল, ‘সীতা, মোর বাক্য ধর।
কিরূপে রহিলা তুমি রাবণের ঘরো?
দেখি নাই রাইক্ষসরে গো শুইন্যা কাঁপে হিয়া।
দশ মুণ্ড রাবণ নাকি দেখাও গো, আঁকিয়া।’
সীতা বলে, ‘আমি তো না দেইখ্যাছি নয়ানে,
কিমতে আঁকিবাম আমি পাপিষ্ঠ রাবণে?’
যত কইর্যা বুঝায় সীতা কুকুয়া না ছাড়ে,
হাসিমুখে সীতারে গো শুধায় বারে বারে।
বিষলতার বিষফল গো বিষগাছের গোটা,
অন্তরে বিষের হাসি বাধাইল লেঠা।
সীতা বলে, ‘দেইখ্যাছি গো ছায়ার আকারে।
তুলিয়া যখন দুষ্ট লয়্যা যায় মোরে,
সাগরের জলেতে পড়ে রাইক্ষসের ছায়া,
দশ মুণ্ড বিশ হস্ত রাইক্ষসের কায়া।’
বইস্যা ছিল ননদিনী শুইল পালঙ্কতে,
আবার সীতারে কয় গো রাবণ আঁকিতে।
এড়াইতে না-পারে সীতা, পাঙ্খার উপরে
আঁকিলেন দশ মুণ্ড গো রাজা লঙ্কেশ্বরে।
শ্রমেতে কাতর সীতা নিদ্রায় গো ঢলিল,
কুকুয়া তালের পাঙ্খা বক্ষে তুইলে দিল।
[১ সূত্র: ময়মনসিংহ গীতিকা//চন্দ্রাবতীর রামায়ণ।]
সীতার ননদিনি কুকুয়া নাকি ছিল কৈকেয়ীর এক কন্যা। লঙ্কাবিজয়ের পর অযোধ্যায় ফিরলে সীতাকে দিয়ে সে তালপাতার পাখার উপর রাবণের ছবি আঁকাল আর তারপর ঘুমন্ত সীতার বুকের উপর রাখা সেই পাখা দেখিয়ে রামকে বলল, দেখ গো দাদা, তোমার সীতা এখনো রাবণকে ভুলতে পারে নাই। এইসব তো আর টেলিভিশনে দেখাবে না, টেলিভিশনের সিরিয়ালে তো বলেই দিলো যে, সীতা রাবণের মেয়ে। পালাগানের কুকুয়াকে মনে-মনে সংগীতের মতন দীর্ঘ অভিসম্পাত দিয়ে চিনু দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ঠাকুর ও, মেইয়্যেছেলে…”। রুবেল তন্দ্রার ভিতর স্থির হয়ে ভাসতে ভাসতে ঠিক করল যে, লিপির সামনে স্বরূপার কাছে দেখা চিঠির প্রসঙ্গ সে কখনো তুলবে না।
৫. কাটিলে না-কাটে মুণ্ডু গো, আগুনে না-পুড়ে
ইস্কুলের ইউনিফর্ম পরলে রুবেলকে বয়সের থেকে ছোটো দেখা যায়। সকালে গুড়-মুড়ি খাচ্ছিল রুবেল; লিপি জল ছিটিয়ে বারোয়ারি উঠান ঝাঁট দিচ্ছিল; আর সেই সময়ই তরু এসে মুখ কালো করে দাঁড়াল। আগের রাতের ঘটনার পর লিপি তরুকে না-দেখার ভাব করল। কাজ করতে করতে লিপি একটা সেদ্ধ জলপাইয়ের বিচি জিভ দিয়ে বাম গাল থেকে সরিয়ে ডান চোয়ালের মাড়ির পিছে গুঁজে দিলো। রুবেল বলল, “দিদি, কী খাস?” “জলপই”-শুনে তরুর জিভে জল আসলো।
লক্ষ্মীর লাশ পাওয়া গেছে। ক্ষীরসায়র নামে এক জলার ধারে কারা ওকে মেরে আর লাশ টুকরা-টুকরা করে থুয়ে চলে গেছে। উঠান থেকে ঠোঙা কুড়াতে কুড়াতে লিপি একমনে লক্ষ্মীর কল্পিত ধর্ষণ ও হত্যাদৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছিল। ওরা নাকি লক্ষ্মীর নাক আর বুক কেটে নিয়েছে গো। “বুকের কিসমিসগুলিরে গাছের ডগায় ঝুলায় রাখিছি”–লিপির একটুও গলা কাঁপল না, বরং ছিক করে একটু হেসেই ফেলল যেন। লক্ষ্মী খারাপ মেয়ে দেখেই ঔদ্ধত্যের সাজা ভোগ করল আর ভালো মেয়ে দেখেই লিপি আজ বেঁচে গেল।
ঝাঁটা উঠানের কোণে খাড়া করে রেখে লিপি ঘরের ভিতরে চলে গেল আর তারপর হুড়মুড় করে একটা কম্বল নিয়ে বের হলো। “ইস, ইন্দুর গো!” বলে মাটির উপর স্তূপাকারে কম্বলটাকে ফেলল। শীত পড়েছে আর তাই কম্বল রোদে দেবে বলে নামিয়েছে লিপি; নামিয়ে দেখল পৌনে এক ডজন বাচ্চা ইঁদুর কম্বল কেটে তার ভিতর একটা গর্ত বানিয়ে জবুথবু হয়ে আছে, হয়তো শীতেই গো—আহা রে! ইঁদুরগুলির চোখও ফোটে নাই। কম্বল বাঁচিয়ে কাপড়ে মুড়ে পুঁটলি পাকিয়ে ইঁদুরগুলিকে চোখের পলকে আগুনে পুড়িয়ে মারল লিপি। রুবেল তরুকে আড়াল করে দাঁড়াল, এইজন্য নয় যে, অবোলা প্রাণীর উপর অন্তিম জুলুম হচ্ছিল, বরং এই নিম্নতর জুলুম রাজধানীর ছেলেটাকে দেখাতে রুবেলের রীতিমতো লজ্জা লাগছিল। তরু রুবেলের পিছন থেকে ওই দাহকার্য ঠিকই দেখল চোখে একবারও পলক না ফেলে। লিপি আজকে বাস্তবিকই নিষ্ঠুর, এমনকি রুবেলকে বলল, শিশুইঁদুর নিয়ে মন খারাপ না-করতে; নির্ঘাত স্বর্গে যাবে ওরা।
“কোনো ঝক্কি-ঝামেলা দেখলি বাড়ি যাবি না। তামাখালির বাসে উইঠে যাবি। লাস্ট স্টপে নামবি, ওকে?” রুবেলের নির্দেশ শুনে তরু মাথা নাড়ল। চৌরাস্তাটার কাছে এসে রুবেল সানগ্লাস পরে নিল। এতে তরু ওর দিকে সরাসরি তাকাতে পারল না; কথা বলার সময় অনির্দেশ্যভাবে গাছপালা-দোকানপাটের দিকে তাকিয়ে থাকল। আসন্ন বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে উচ্চগ্রামে দেশাত্মবোধক গান বাজছে। ময়লা পার্কের পাশে সবুজ ভ্যানের গায়ে ইউপি ইলেকশনের পোস্টার সাঁটা। সদর স্কুলের ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থীদের বিদায় উপলক্ষ্যে দোয়া মাহফিলের পুরানো বান্টিং ঝুলছে আর ঝুলছে মাদকবিরোধী জাতীয় বিতর্ক-উৎসবের ব্যানার মাথার উপরে ছেঁড়া গেঞ্জির মতো। ‘ভোরের পাখি সংঘ’ একরাতের মধ্যে শোলা আর কাগজ দিয়ে বিরাট এক আর্য রাজপুত্রের কুশপুত্তলিকা বানিয়ে ফেলেছে। বিরাট শোভাযাত্রা হতে যাচ্ছে; সিরিয়ালের শূর্পণখার নাক-কান কর্তনের পর জনউন্মত্ততা চরমে। বর্বর রাজপুত্রের আজ প্রতীকী মৃত্যু হবে। ব্যান্ডপার্টি বিপুল উদ্যমে রাস্তা অধিকার করে রামায়ণের থিম সং বাজাচ্ছে। কী বিরাট আয়োজন গো! আর আধঘণ্টাখানেক পর লক্ষ্মণের কুশপুত্তলিকা দাহ হবে। রনি আবার সোৎসাহে “লশমন, লশমন” করতে লাগল, কিন্তু ব্যান্ডপার্টির দামামায় ওর গলা কেউ শুনতে পেল না। তরুর বামচোখের পাতার উপর একটা ঘোড়ামাছি নাকি ডাঁশ — ভনভন করছিল। রনি আর তরুকে একটা ভ্যানের পাশে দাঁড়াতে বলে রুবেল এগিয়ে গেল। আরেকটা ভ্যানের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সরদারের দুই পোলা আর রিপন; মুহুর্মুহু সিগারেট টানছিল ওরা; রুবেলকেও একটা ধরিয়ে দিলো। পাঁচদিন গোসল না-করা সুন্দর চেহারা সরদারের বড়োপোলার। “আরে মামলা কী জিনিস ইডাই আমার ডিকশনারিতে নেই। পুলিশ- টুলিশ আমি ভয় পাই নাকি রে নোমুর পো?” শোনা যেত সরদারদের বড়ো পোলা জামিন নিয়ে বাইরে আছে। তরু একটু দূরে নীরবে রনির হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। ভিড় বাড়ছিলই আর বাড়ছিল লাউডস্পিকারে দেশাত্মবোধক গানের খারাপ রেন্ডারিং করা রেকর্ডের অ্যাকাবেঁকা খরখরে আওয়াজ, ব্যান্ডপার্টির অক্লান্ত বাজনা আর এই সবকিছুর সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল জনতার ভিড়। ফুটপাথের উপর ফেরিওলারা কাস্টমার জমিয়েছে। মাথায় কয়েক প্যাচের রঙিন হিজাব পরে মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে তোড়া-তোড়া বেলুনের মতো আর নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি করছে। এরা সবাই লক্ষ্মণনিধন দেখতে এসেছিল।
হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন তীব্র চিৎকার করে উঠল, “ধর, ধর, লক্ষ্মণ! ওই দ্যাখ দিনি কিডা!” তিন থেকে চার সেকেন্ড লাগল তরুর ব্যাপারটা বুঝতে, ওর মাথায় খেলে গেল কেন এতক্ষণ ভিড়ের মধ্যে অনেকেই ওর চেহারার দিকে একটা সন্দেহ নিয়ে তাকাচ্ছিল আর বারবার ফিরে ফিরে চাইছিল আর ওদের সন্দেহের চোখ কেন অশ্রদ্ধায় ধীরে হিংস্র হয়ে উঠছিল; ও অকস্মাৎ দেখতে পেল ভিড়ের কোষটা ওকে কেন্দ্র করে শিমবিচির মতো ছোটো হয়ে আসছে, ওদের অনেকের হাতেই লাঠি। মুখে একটা বড়ো মেচেতাওলা, শার্টের কলার উলটে পরা এক ছেলে তরুর কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল। “তুই লক্ষ্মণ না?”
“না। সরেন।”
“লক্ষ্মণ তুই। আবার মিছে কথা…”
একটা অসীম সাগরের তলে খোলস উদাম করে বসে থাকা এক লক্ষ শুক্তির ঠিক মাঝখানে তরু একখানা মুক্তা গো।
“আরে। আমার নাম তরু। তালুকদার বাড়ির ভাগিনা। রাজধানী শহরে বাসা। “ ছেলেটা যেন ওর গলা শুনতে পায়, তাই তরুকে গলা উঁচাতে হলো, তাতে ছেলেটার বুঝি মনে হলো বেয়াদবি। তরুর শার্টের হাতা খামচে ধরল ছেলেটা। ওর পিছে আরও দুইটা ছেলে—একজনের হাতে লাঠি, আরেকজনের হাতে পতাকা। সামনের জনের চোখেমুখে হঠাৎ যকের ধন খুঁজে পাওয়া উদ্ভ্রান্ত উত্তরপুরুষের ভাব, যেন আরেকটু এগোতে পারলেই হাতের পতাকাটাকে রামদায়ের মতো তুলে ধরে সে বাতাসে কোপ দেবে। “এইস্যে তালুকদার বাড়ি চোদাচ্ছ… মানে…”
“দৌড় দে, তরু!” কোনো এক অন্য ছায়াপথ থেকে রুবেলের গলা ভেসে আসলো। নিমেষে তরু রনির হাত ছেড়ে ভিড়ের মধ্যবিন্দুতে ডুবে গেল। তারপর প্রায়-হামা দিয়ে ঝড়ের কেন্দ্রচ্যুত বস্তুকণার মতো ভিড় কেটে বের হলো; তারপর নর্দমা, ফুটপাথ, ফেরিওলাদের টুকরি আর রাস্তার পাশের ডাবের খোলা, ছেঁড়া পলিথিন, মড়া বিড়াল, তরমুজের ডোঙা ইত্যাকার আবর্জনার স্তূপ ডিঙিয়ে দৌড় শুরু করল; বাতাসের আগে ভাগতে থাকল। তরুর পিছে মানুষের দল হইহই করে এগিয়ে গেল। দৌড়াতে গিয়ে তরু টের পেল ওর দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে শিরশির করে গরম ধারায় কিছু যেন বের হয়ে যাচ্ছে। তরুর পক্ষে ওই মুহূর্তে বেগ চেপে রাখা সম্ভব হয় নাই। বেগ ছেড়ে দেওয়ার কারণেই কি না কে জানে, চোখের সামনে দ্রুত খুলতে থাকা নিরেট শহরটার গায়ে হঠাৎ যেন চিপা গলির একটা গভীর ফাটল দেখা গেল। সেই ফাটল গলে তরু বেরিয়ে গেল। জনতরঙ্গ সেই সময় উত্তাল অবস্থা থেকে স্তিমিত হয়ে সরলরৈখিকতায় পর্যবসিত হলো, মৃত্যুশয্যায় শুয়ে থাকা একটা বিশাল জন্তুর হৃৎপিণ্ড ধুকধুক করতে করতে ধীরে থেমে গেল। তরু এ-ও বুঝল যে রনি ওর পিছু ছাড়ে নাই; হয়তো রনির মতো একটা হাবাগোবা দাস্যভাব শিশু ওর পিছে দৌড়াচ্ছিল বলেই জনতার মনে কিছু দয়া আর কিছু কারুণ্যের উদ্রেক হয়েছিল। এই প্রতিবন্ধী ছেলেটাই কি তবে আজ ওকে প্রাণে বাঁচালো গো?
তামাখালির বাসে উঠে তরু মুখে রুমাল চাপল, আরেক হাতে রনিকে শক্ত করে ধরে রাখল। চারিদিকে অসহ্য ডিজেলপোড়া গন্ধ। বাস যখন ছাড়ি ছাড়ি করছে, ওদের জানালার উপর এক চাপড় পড়ল। তরুর রক্ত হিম হয়ে যেতে পারতো। না, রুবেল।
*
বর্ডারের দিকে ক্রমে এগিয়ে যাচ্ছিল ওদের বাস। “বিশ মাইলেরও কম”, বলল রুবেল। পুরানো শ্মশান আর মন্দির পেরিয়ে গেল বাস – পনেরোশ-ষোলোশ সালের হবে বুঝি। “খ্রিস্টপূর্ব?” এরপর শুরু হলো বিঘা-বিঘা ফুলের জমি। রুবেল বাস-স্টপে কলা কিনেছিল একহালি, তরুর বিশ্বাস হচ্ছিল না ওই মৃত্যুমুখী গণঅভিজ্ঞতার মাঝে কলা কেনার সময় কিম্বা অবস্থা ছিল রুবেলের। রনিকে একটা কলা খেতে দিয়ে রুবেল দেখল, তরুর নখের আঘাতে রনির কবজির চামড়া ছড়ে গেছে। রনি ওর লালচে ক্ষতর উপর কলার খোসার উলটাপিঠ ঘষতে থাকল আর বলতে থাকল, “কালা, কালা, কালা”। পারলে সমস্ত শরীর ঘষত বুঝি রনি কলাগাছের গায়ে।
কমর আলি সরদারের রজনিগন্ধার ক্ষেতের কাছে বাস ওদের নামিয়ে দিলো। গাছগুলি সব ডাঁটো হয়েছে, শাদা শাদা ফুল ধরে আছে প্রান্তর জুড়ে। গত বছর নাকি কমর আলি সরদার একাই এক হেক্টর জমি থেকে চার লাখ ডাঁটি ফুল তুলেছে—দুই টাকা করে যদি দাম পড়ে পাইকারি বাজারে, আর রাজধানীর বাজারে যদি পড়ে বিশ টাকা, তাহলে রজনিগন্ধার ব্যবসায় কত্ত লাভ! ক্ষেতের আইলের ভিতর দিয়ে তিনজন হেঁটে যেতে-যেতে মনে-মনে এইসব অঙ্ক করল।
তামাখালি হাই স্কুলের মূল ফটক বন্ধ হলেও কেঁচি-গেট খোলা ছিল। ওরা গেট গলে ঢুকে গেল।
রুবেল বলল, “সাথে আছে”; তারপর ওর স্কুল ইউনিফর্মের বুকপকেটের বোতামটা হাসতে হাসতে চুনট করল।
স্কুলঘরের পিছনের বারান্দায় বিশাল চাতাল আর সামনের বারান্দার ধারে বিরাট মাঠ। আগামীকাল এই মাঠে বিজয় দিবসের কুচকাওয়াজ হবে, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আসবেন; রোদের মধ্যে বদমাশ ছোটো ছেলেরা আর চিকন গলার ছোটো মেয়েরা অভ্যর্থনার নিশান হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে; মাঠের উপর চকগুঁড়া দিয়ে লাইন টানা হবে; ইউপি চেয়ারম্যান সাহেব বেলুন আর কবুতর ওড়াবেন; ঠিকঠাক প্ৰস্তুতি থাকলে ছেলেমেয়েরা শারীরিক কসরত দেখাবে, পিরামিডের আকারে একে অন্যের ঘাড়ে দাঁড়াবে।
ওরা পিছনের বারান্দায় টিনের চালের ছায়ায় বসল। চাতালে চট বিছিয়ে রজনিগন্ধার কন্দ শুকাতে দেওয়া হয়েছে। হেমন্তকালে কন্দগুলি মাটির নিচে লুকিয়ে থাকে, শীতের শেষে মাটিতে লাগানোর উপযোগী হয়। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে গাছ যখন আর বাড়ে না, তখন কন্দগুলি মাটির তলা থেকে তুলে এনে পরিষ্কার করে চাতালে ছড়িয়ে রাখা হয়।
রুবেল পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঝুরা তামাকপাতাগুলি ফেলে সিগারেটের খোলসটা খালি করতে লাগল এত যত্নে আর ধীরে, যেন ফুলের পরাগধানীর ভিতর থেকে কেশর খুলে ফেলছে। শাদা খোলসটার ভিতর শুকনা গাঁজাপাতা ভরে তিনজন গোল হয়ে বসে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুখটান দিতে থাকল। চড়া রোদের দিনে যজ্ঞের অদৃশ্য আগুন আকাশে ধিকিধিকি জ্বলছিল। পিছনের মাঠ থেকে ছেলেদের গলার আওয়াজ ভেসে আসলো। আগামীকালের কুচকাওয়াজের মহড়া দিতে ওরা এসে পড়েছে।
“দিদির বিয়েটা ঠিকঠাক হইয়ে যাবে নে। সদ্দারের বড়ো ছাওয়াল নিজে দায়িত্ব নিছে। কথা দিলো।”
“আচ্ছা।”
“বিজয় দিবসের সাপ্লাইটা ঠিকঠাক হাতে পৌঁছাই দিতি হবে, ইডাই ব্যাপার।”
“আচ্ছা।”
“ইস্কুলে অনেক আগে এক গাঁজারুর কাছে এক পুরিয়া চাইলাম। কইয়োছিলাম পঞ্চাশ টাকা দিবা নে। দিলো না শালা। তার কয়দিন পর শালা নারকেল গাছ বাইয়ে উঠতি গিয়ে পা ফসকায় মইরে গেল।”
“আচ্ছা।”
তরু নেশা করার পর চোখের সামনে দেখছিল কতগুলি কঙ্কাল সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে দলবদ্ধ কোরিওগ্রাফিতে একটা অদ্ভুত মুদ্রায় নাচছে; একটু ফোকাস করেই আবার দেখতে পেল যে, কঙ্কালগুলি আসলে একটা টানা ডেস্কের উপর রাখা কয়েকটা টাইপরাইটারের চাবি টিপছে। এদিকে স্কুলের মাঠে মহড়া শুরু হয়ে গেছে। “সমাবেশ, তালে তালে—ডান-বাম-ডান-বাম-ডান-বাম-ডান।”
হাতে গোলাপি ট্যাবলেট নিয়ে বাড়িয়ে ধরল রুবেল।
তরু কন্ধকাটা ভূত; মাটির দিকে ঝুলন্ত মাথা ফেলে দিয়ে বলল, “না।”
“ক্যান? খা!”
“না।”
“খা বলতিছি।”
“না।”
“ক্যান রে হারামজাদা? আমার হাত থেইকে খাবি না, না? তোর মাসি মারব? হারামজাদির তলায় অনেক তেল জমছে, না রে?”
তরু অবাক হয়ে রুবেলের চোখের দিকে তাকাল। তারপর হঠাৎ গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে, রুবেলকে সপাটে একটা চড় কষিয়ে দিলো।
রনি দেখল, রুবেল পকেট থেকে মানুষের কাটা আঙুলের মতো দেখতে একটা ছুরি বের করল। আরও ছোটো থাকতে রনি দেখেছিল, তরুর মামার মর্দা বিড়ালটাকে আকাম করতে গো। উকিল সাহেবের ভাড়াটিয়ার বাড়ির বিড়ালনির সঙ্গে তিনটা বাচ্চা জন্ম দিয়েছিল সে; ডুমুর গাছের তলে বেজিটাকে খেদিয়ে যে বাচ্চাগুলিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল মর্দাটা, সেই বাচ্চাগুলিকেই কী খেলায় একদিন একে-একে মেরে ফেলেছিল।
ধ্বস্তাধস্তি শুরুই হতে পারল না। পলকে একটা অঘটন ঘটে গেল।
রনি স্কুলঘরের পিছন থেকে মুখ বের করে মহড়ার ছেলেদের উদ্দেশে চিৎকার করে উঠল, “লশমন, বাঁচাও লশমন বাঁচাও।”
মহড়ার দুইটা ছেলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ওদের পায়ে ওড়া ধুলায় সমস্ত দিগন্ত ঝাপসা হয়েছিল। মাথার উপরে লক্ষ্যহীন তবু সুশৃঙ্খল ছাইরঙা মেঘ উড়ছিল। ডান-বাম-ডান-বাম-ডান-বাম-ডান
“কারে ডাকতিছে রে?”
“দুরো! ছেলেছোকরারা খালি ওই রামায়ণ সিরিয়ালের ডায়ালগ দেয় আজকাল। রাবণের চামচা কিড়া না? আরে ওই যে, মায়াহরিণ সাইজ্যে রামের গুলি খাইল….”