মনোজ সান্যালের গল্প
মনোজ সান্যালের সঙ্গে আর কোনওকালে দেখা হবে এমন মনে হয় না, তাই ভরসা করে এই গল্প লেখা সম্ভব হল। এই গল্পের মা নেই, বাবা নেই, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়াপ্রতিবেশী, সহপাঠী-সহযাত্রী-সহকর্মী কেউ নেই–শুধু মনোজ সান্যাল আছেন এবং বলাই বাহুল্য এই গল্পটি মনোজ সান্যালের পক্ষে যথেষ্ট সম্মানজনক নয়।
প্রথমেই বলা উচিত মনোজ সান্যালের চেহারা ভাল ছিল না। অবশ্য যাঁরা মনোজবাবুকে কখনও দেখেছেন তারা বলবেন চেহারা ভাল ছিল না এরকম বললে মনোজবাবু সম্পর্কে কিছুই বলা হয় না। আসলে তার চেহারা ছিল ভয়ংকর অথবা বলা যায় সাংঘাতিক। নবীনা জননীরা অনেক সময় মনোজ সান্যালের ভয় দেখিয়ে শিশুদের ঘুম পাড়াতেন, বহু শিশু ঘুমের মধ্যে মনোজ মনোজকরে কেঁদে উঠত।
একটু বর্ণনা করা এরপর অবশ্যই প্রয়োজন। অনেকের মাথার চুল কোঁকড়া থাকে, মনোজবাবুরও তাই ছিল, একটু বেশি কোঁকড়া, সেই সঙ্গে দুই পাশে দুটো কানও কোকড়ানো। ওইরকম গোলাপ ফুলের মতো কান কখনও দেখা যায় না। সেই সঙ্গে শিমূলের মতো নাক আছে কি নেই বোঝা যায় না, কারণ সেটা ঢাকা পড়ে গেছে দুই সদাসর্বদা রক্তাক্ত বিশাল চোখের নীচে। পুরু ঠোঁট অথচ সব। মিলে অতিকায় ছোট একটি মাথা, অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় মাথা এবং তার নীচেই একটি বিশাল ধড়। তার মধ্যে বিশালতম ডান পা–একটি মারাত্মক জাতের ফাঁইলেরিয়া আক্রমণের পর থেকে।
মনোজ সান্যাল একটি সওদাগরি ফার্মে ক্যাশিয়ারের কাজ করতেন। প্রথম দিন চাকরিতে যোগদান করার পর তিনি যখন ম্যানেজিং ডিরেকটরের সঙ্গে দেখা করতে যান, ম্যানেজিং ডিরেক্টর তাকে দেখে আঁতকে ওঠেন, তার সুন্দরী লিপি-লেখিকা হাফ মেমসায়েব সত্যি সত্যিই স্ক্রিম–খাঁটি ইংরেজিতে স্ক্রিম করে ওঠেন।
মনোজবাবু দেখা করে ফিরে যাওয়ার মুহূর্তের মধ্যে বড়সাহেব মানে ম্যানেজিং ডিরেক্টর বাহাদুর ম্যানেজার সাহেবকে ডেকে পাঠালেন।
ম্যানেজার সাহেব ছুটে এলেন, হুজুর!
ম্যানেজিং ডিরেক্টর বললেন, তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?
ম্যানেজার সাহেব আবার বললেন, হুজুর!
এই দুর্দান্ত লোকটাকে কোন জেলখানা থেকে জোগাড় করলে? এই রকম সাংঘাতিক চেহারার লোককে কেউ ক্যাশিয়ার রাখে নাকি? যাও এখনই তাড়িয়ে দাও। দেখে তো মনে হচ্ছে এই বেলাই তহবিল নিয়ে ভেঙ্গে পড়বে। এক নিশ্বাসে ম্যানেজিং ডিরেক্টর বাহাদুর তার নির্দেশ দিয়ে দিলেন।
ম্যানেজার সাহেব তখনও হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন, আবার বললেন, হুজুর!
ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবার খেপে গেলেন, কী দাঁড়িয়ে হুজুর-হুঁজুর করছো যাও! তাড়াতাড়ি বদমাইশটাকে তাড়িয়ে দাও।
এবার ম্যানেজার বললেন, স্যার, আমার কথাটা শুনুন। অনেক বিবেচনা করেই আমি ওই কুৎসিত লোকটাকে ক্যাশিয়ার করেছি।
ম্যানেজিং ডিরেক্টর গর্জে উঠলেন, কীসের বিবেচনা?
ম্যানেজার বললেন, স্যার, একবার ভেবে দেখুন ক্যাশিয়ার এই রকম চেহারার নেওয়াই ভাল। তহবিল তছরূপ করে ও পালাতে পারবে না।
ম্যানেজিং ডিরেক্টরের এই বক্তব্য বোধগম্য হল না। জিজ্ঞেস করলেন, কেন পালাতে পারবে, খোঁড়া নাকি?
সরাসরি প্রশ্নের উত্তরে না গিয়ে ম্যানেজার বললেন, ও কী করে পালাবে, ওই চেহারা নিয়ে কোথায় আত্মগোপন করবে? ওই দোমড়ানো কান, ওই মোটা ঠোঁট, ফোলা পা, ভাটার মতো চোখ–ওকে পাঁচমিনিটের মধ্যে পুলিশে ধরে ফেলবে।
ম্যানেজারের বুদ্ধি দেখে ম্যানেজিং ডিরেক্টর অভিভূত। সেই দিন মনোজ সান্যাল বহাল হলেন।
তারপর ত্রিশ বছর ক্যাশিয়ারি করছেন সান্যাল মশায়। অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে। শুধু চেহারার ব্যাপারেই প্রতারণা করেননি ঈশ্বর তাকে, তিনি অসামান্য কৃপণতা দিয়েছিলেন তাঁর চরিত্রে। একটি পয়সা তিনি কখনও এদিক ওদিক হতে দেননি। একটা সইয়ের ব্যাপার থাকলে তিনি চারপাশে চারটা সই করিয়ে নিয়েছেন। পারিবারিক জীবনেও তাঁর কৃপণতা বিপজ্জনক হয়েছিল। ম্যানেজারসাহেব মধ্যে মধ্যে ডেকে জিজ্ঞাসা করতেন, কেমন আছেন, মনোজবাবু?
সান্যাল মশায় বলতেন, আপনার অফিসে সারাদিন খালি কাজ আর কাজ, আর ক্লান্ত হয়ে যেই বাড়ি ফিরি বাড়িতে বউ খালি টাকা আর টাকা! এই বলে একটাকা দাও, এই পাঁচ টাকা চায়–এই সাড়ে তিন টাকা।
ম্যানেজার অবাক হয়ে যান, এত টাকা দিয়ে আপনার স্ত্রী কী করে?
সান্যাল মশায় বলেন, কী করবে, ভগবান জানে। আমি জানি না, জানার ইচ্ছেও নেই, আমি কখনও তাকে একটা টাকাও দিইনি।
মনোজ সান্যাল সম্পর্কিত এই কাহিনি আরও দীর্ঘ, আরও বিস্তারিত করা সম্ভব। কুৎসিত চেহারার কৃপণ লোকের অভাব নেই সংসারে, তাদের সম্পর্কে গল্পেরও অভাব নেই।
কিন্তু মনোজ সান্যাল সম্পর্কে শেষ গল্পটি নির্ভরযোগ্য এবং অভাবিত।
সসম্মানে কাজ থেকে রিটায়ার করেছিলেন সান্যাল মশায়। বিদায়সভায় তার গলায় একটি মালা দেওয়া হয়েছিল। সেই মালাটিকে ফেরার পথে নিউ মার্কেটে সিকি দামে বেচে বাড়ি ফিরে দায়মুক্ত হলেন মনোজ সান্যাল। এরপর দুর্মূল্যের বাজারে আর কলকাতায় থাকা নয়। অফিসেই যখন যেতে হচ্ছে না, কলকাতায় থাকার আর মানে হয় না।
আগে থেকেই সম্পূর্ণ প্ল্যান করা ছিল, টিকিট কাটাও ছিল। বৃন্দাবনে খরচা কম, জিনিসপত্রের দাম সস্তা, মাছমাংস নিষিদ্ধ। রিটায়ার করার দিন রাত্রেই তিনি সপরিবারে বৃন্দাবন যাত্রা করলেন।
ভালভাবেই গেলেন প্রায় পুরোটা পথ। মথুরা পর্যন্ত টিকিট কাটা ছিল সান্যাল মশায়ের, কিন্তু মথুরা পৌঁছানোর কিছু আগে ট্রেন থেকে পড়ে গেলেন সান্যাল মশায়ের স্ত্রী, চেন টেনে ট্রেন থামিয়ে যখন তাকে পাওয়া গেল তখন তিনি মৃতা।
এই ব্যাপারে কতটা শোকাচ্ছন্ন হয়েছিলেন সান্যাল মশাই তা জানা নেই, কিন্তু তিনি এখনও মথুরাতেই আছেন। তাঁর স্ত্রীর মথুরা পর্যন্ত টিকিট কাটা ছিল, মথুরা পৌঁছানোর আগেই তিনি মারা গেছেন। সুতরাং যেটুকু পথ তিনি যাননি, তার ভাড়া ফেরত পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই। বহুদিন ক্যাশিয়ারি করেছেন মনোজ সান্যাল এসব ব্যাপার বেশ ভাল বোঝেন।
মথুরাতেই আছেন। মথুরাতেই টাকা ফেরানোর তদ্বির করছেন। আশা করি সুদূর মথুরাতে এ গল্প তার নজর পড়বে না, সেই ভরসাতেই এই গল্প।