মনে মনে

মনে মনে

দ্বিজেনের কথা

আজ অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে বড্ড দেরি হয়ে গেল।

মীনা দেরি হওয়া ভালবাসে না—তার মুখ একটু ভার হয়, চোখে গাম্ভীর্য ঘনিয়ে ওঠে। কিন্তু মুখ ফুটে তো কিছু বলবে না—কেবল ভেতরে ভেতরে জট পাকাবে। আশ্চর্য মেয়েমানুষের স্বভাব। এই পাঁচ বছর বিয়ে হয়েছে, এর মধ্যে একদিনও মীনা ঝগড়া করলে না; রাগ হলেই মুখ টিপে থাকে, শুধু আকারে ইঙ্গিতে জানিয়ে দেয় যে, রাগ হয়েছে। কোপো যত্র ভ্রূকুটিরচনা বিগ্রহো যত্র মৌনম্‌—

কিন্তু আজ আর রাগ হতে দিচ্ছি না। দেরি হবার কারণটা পকেট থেকে বার করে অন্যমনস্কভাবে টেবিলের ওপর রাখলেই রাগ গলে জল হয়ে যাবে।

আজ অফিসে মাইনে পেলুম। পথে আসতে আসতে ভাবলুম, টাকা বাড়ি নিয়ে গেলে তো কিছুই থাকবে না, তার চেয়ে এই বেলা মীনার জন্যে একটা কিছু সৌখীন জিনিস কিনে নিয়ে যাই। সামনেই হীরালাল মতিলালের দোকানটা পড়ল—সেখানেই ঢুকে পড়লুম। বেশী কিনিনি, সামান্য ১৫ টাকা দামের একটি ব্রুচ—কিন্তু ভারি সুন্দর দেখতে। মীনা খুশি হবে।

বাড়িতে ঢুকে দেখলুম, মীনা একটা ডেক-চেয়ারে বসে নভেল পড়ছে। আমাকে দেখে ঘড়ির দিকে তীক্ষ্ণভাবে একবার তাকিয়ে বই নামিয়ে রেখে বললে, “এলে?”

এই ধরনের কথা আমার ভাল লাগে না। এলে? তার মানে কী? আমার আসাটা কি অভূতপূর্ব ব্যাপার, না আমার আজ ফেরবার কথাই ছিল না? আসলে খোঁচা দিয়ে কথা কওয়া মীনার একটা স্বভাব। আর দেরি হয়েছে তো হয়েছে কি? ঠিক সাড়ে পাঁচটার সময় বাড়ি ফিরব এমন লেখাপড়া তো কিছু করিনি।

একটা কোঁচানো কাপড় হাতের কাছে রেখে—‘কাপড় ছাড়ো’—বলে মীনা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

অর্থাৎ আমার ওপর ভীষণ বিরক্ত হয়েছেন সেটা জানিয়ে দিয়ে যাওয়া হল। বেশ, বিরক্ত হয়েছেন তার আর কি করব! তাই বলে আমি তো ঘড়ির কাঁটার মতো চলতে পারি না। কলের পুতুল তো নই!

জামা-কাপড় ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে বসেছি, মীনা খাবার আর চা নিয়ে এসে সামনে রাখলে। আজ দেখছি আবার মোহনভোগ তৈরি হয়েছে। মনে আছে তা হলে। যাক, ক্ষিদেটাও খুব পেয়েছে…

ও—তাই বলি। খাবার ঠাণ্ডা হয়ে একেবারে শক্ত হয়ে গেছে। বোধ হয় দুপুরবেলা কোনও সময় অবসর মতো তৈরি করে রাখা হয়েছিল। তা তো হবেই, আমি মুটে-মজুর লোক, খেটে-খুটে এসে ঠাণ্ডা বাসী যা পাব তাই দিয়ে পেটের গর্ত বুজিয়ে ফেলব, খাবার একটা কিছু পেলেই হল, এর বেশী-প্রত্যাশা করাই অন্যায়……যাক্‌, তবু চা’টা একটু গরম আছে। কি দরকার ছিল? ওটাও দুপুরবেলা তৈরি করে রাখলেই হত।

“আজ তোমার মাইনে পাবার দিন না?’

হুঁ—সে কথাটি ঠিক মনে আছে। পকেট থেকে টাকা বার করে দিয়ে বললুম, “এই নাও।”

টাকা গুনে ভুরু তুলে বললে, “পনেরো টাকা কম যে?”

কৈফিয়ৎ চাই! নিজের টাকা যদি খরচ করি, তাও পাই-পয়সার হিসেব দিতে হবে। দূর ছাই, সংসার করাই একটা ঝকমারি।

বললুম, “খরচ করেছি।”

সপ্রশ্নভাবে মুখের দিকে চেয়ে রইল—অর্থাৎ এখনও কৈফিয়ৎ সন্তোষজনক হয়নি; কিসে খরচ করেছি, তা বলতে হবে! মীনার কি বিশ্বাস, আমি মদ খেয়ে টাকা উড়িয়ে দিয়েছি! না তার চেয়েও সাংঘাতিক আরও কিছু!

উঃ! মেয়েমানুষের মতো সন্দিগ্ধ মন পৃথিবীতে আর নেই। না, আমি বলব না, কিছুতেই বলব না,—দেখি, ও মুখ ফুটে জিজ্ঞাসা করে কি না। যদিও জানি, তা কখনই করবে না; মনে মনে গেরো দেওয়া যে ওর স্বভাব।

জিজ্ঞাসা করলে কি অপমান হত, না আমি মিথ্যে কথা বলুতম! জিজ্ঞাসা করলেই তো আমায় বলতে হত যে, তোমার জন্যে গহনা কিনেছি। —বেশ, ভালই হল। কাল ঐ লক্ষ্মীছাড়া ব্রুচটা ফেরত দিয়ে আসব—বলব, পছন্দ হল না। মন্দ কি, ক’টা টাকা বেঁচে গেল।

টাকা নিয়ে দুপ্‌ দুপ্‌ করে সিঁড়ি দেয়ে ওপরে উঠে গেল। দমাস করে আলমারির দরজা বন্ধ করা হল; মানে, আমি কি রকম চটেছি, তুমি দেখ!

ফিরে এসে আবার দূরের একটা চেয়ারে বসল। মুখে কথা নেই, আমাকে দেখেই বোধ হয় সব কথা ফুরিয়ে গেছে। পাঁচ মিনিট দু’জনে চুপচাপ আছি। ওঁর বোধ হয় আশা যে আমিই আগে কথা কইব। কিন্তু—কেন কইব? আমাকেই চিরদিন আগে কথা কইতে হবে, তার কি মানে?

অনেকক্ষণ পরে কথা কইলেন, “খবরের কাগজ পড়বে?”

হুঁ—খবরের কাগজ পড়ব। সোজা কথায় বললেই হয়, তোমার সংসর্গ আমার ভাল লাগছে না, তুমি যা হয় কর, আমি উঠে যাই। সমস্ত দিনের পর বাড়ি আসার কি চমৎকার সংবর্ধনা! বোধ হয় নভেলটা শেষ হয়নি, তাই প্রাণ ছট্‌ফট্‌ করছে। তা আমি তো ধরে রাখিনি; ‘ওগো, তুমি আমায় ছেড়ে কোথাও যেও না’, বলে কাঁদিও নি। গেলেই পারেন, ছুতো খোঁজবার দরকার কি?

মেয়েমানুষ জাতটার মতো এমন কপট আর—; দূর হোক গে, এই জন্যেই লোকে সাধু সন্ন্যাসী হয়ে যায়। আমারও আর ভাল লাগছে না, অরুচি ধরে গেছে।

যাই, খানিকটা বেড়িয়ে আসি। বাড়ি তো নয়—সাহারা। এরই জন্যে মানুষ পাগল!

উঠে জামা পরতে পরতে বললুম, “বেড়াতে যাচ্ছি।”

কোনও জবাব নেই। বহুত আচ্ছা, তাই সই। যখন জুতো পরে ছড়ি নিয়ে বেরুতে যাচ্ছি, তখন—“বামুন ঠাকুরের আজ দুপুর থেকে জ্বর—”

বামুন ঠাকুরের জ্বর, তা আমি কি করব? আমি ধন্বন্তরি না কি? আসলে তা নয়, কথার তাৎপর্যটা গভীর—অনেক দূর থেকে এসেছে। কোনও কোনও দিন বেড়িয়ে বাড়ি ফিরতে রাত্রি ন’টা বেজে যায়—আড্ডায় বসলে সহজে ওঠা যায় না—তাই চেতিয়ে দেওয়া হল। আজ উনি নিজে রাঁধবেন, আজ যেন ফিরতে দেরি না করি। আমার যেন নারী-শাসন তন্ত্রে বাস হয়েছে—সব সময় কড়া শাসন। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মেশবারও হুকুম নেই। বেশ, তাই হবে। সন্ধ্যে থেকেই ঘরের মধ্যে ঢুকে বসে থাকব।

‘বুঝেছি’ বলে বেরিয়ে পড়লুম।

ঠিক ন’টার সময় বাড়ি ফিরলুম। দেখি, গিন্নী রান্নাবান্না শেষ করে বসে আছেন। তখনই খেতে বসে গেলুম। কি জানি, যদি দেরি করি, আবার গোসা হতে কতক্ষণ!

না, গিন্নীটি আমার রাঁধেন ভাল। এই রান্নাই তো বামুন ঠাকুর রাঁধে,—কিন্তু সে যেন যাচ্ছেতাই।

আমি তো কারুর সঙ্গে ঝগড়া করতে চাই না, তবে মীনা একটুতেই অমন মুখ অন্ধকার করে কেন? যেন কত বকেছি। আচ্ছা, আমারই না হয় ঘাট হয়েছে, আমিই যেচে ভাব করছি।

খেয়ে উঠে মীনার হাত থেকে পান নিতে নিতে বললুম, “উঃ—আজ কি গরম। রাত্রে ঘুম হলে হয়।”

মীনা মুখ টিপে বললে, “বেশ, আমি না হয় মেঝেয় মাদুর পেতে শোব।”

কি কথার কি উত্তর!

নাঃ—এদের মনের মধ্যে জিলিপির প্যাঁচ—এরা সোজা কথা বলতে জানে না। উনি আমার পাশে শোন্‌, তাই আমার গরম লাগে, অতএব মেঝেয় মাদুর পেতে শোবেন! এত দিন যেন—কিন্তু কুছ পরোয়া নেই, সেই ভাল। একলা শুতে চান, আমার আপত্তি কি? আমিই না হয় নীচে বসবার ঘরে তক্তপোশের ওপর শোব। কারুর কোনও অসুবিধে নেই—সব দিক দিয়েই ভাল। উনি সমস্ত ওপরতলাটা নিয়ে থাকুন।

বললুম, “আমিই নীচে তক্তপোশে শোব। তোমার কষ্ট করবার দরকার নেই।”

তক্তপোশের ওপর নিজেই চাদর পেতে শুয়ে পড়লুম—কারুর সাহায্যের তোয়াক্কা রাখি না। উনি দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন, তারপর একটা নিশ্বাস ফেলবার ভান করে ওপরে চলে গেলেন।

দুনিয়াটাই ফাঁকি। এই যে দশটা-পাঁচটা অফিস করি,—কিসের জন্য? এই ঘর-দোর বন্ধু-বান্ধব, স্ত্রী-পরিবার—সব মিথ্যে! মায়া! বেদান্ত ঠিক বলেছে—মায়া—

ঘুম আসছে, রাত্রি এগারোটা বেজে গেল। ঘুমুই—দুত্তোর, কি হবে ওকথা ভেবে! যত সব……

অ্যাঁ!—কে—!

মিনতির কথা

সত্যি বাপু, এত দেরিই বা হয় কেন? পাঁচটার সময় তো অফিসের ছুটি হয়, তবে এতক্ষণ কি করেন? সারা দিনের পর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে ইচ্ছেও হয় না?

আমরাই শুধু ভেবে মরি। মেয়েমানুষ কিনা! পুরুষমানুষের ভাবনাও নেই, চিন্তাও নেই। আমি যে সারা দিন একলা পড়ে থাকি, সেদিকে ভ্রুক্ষেপও নেই। থাকবে কেন? দাসীবাঁদীকে কে কবে ভ্রূক্ষেপ করে!

আচ্ছা, এতক্ষণ কি করেন? রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান? বিশ্বাস হয় না। তবে? কি জানি, বুঝতেও পারি না; ভাবতেও ভাল লাগে না।

আজ সকাল সকাল খাবার তৈরি করে চায়ের জল চড়িয়ে রেখেছি—ঠাণ্ডা খাবার খেতে পারেন না, আবার খাবার দিতে দেরি হলেও বিরক্ত হন—কিন্তু বুঝে বুঝে আজই দেরি করছেন। জানি তো ওঁকে—মাথার টনক নড়ে। আজ আমি ঠিক পাঁচটার সময় গরম খাবার তৈরি করে রেখেছি কিনা—আজ বোধ হয় ছ’টার আগে বাড়ি ঢোকাই হবে না।

কিছু বলতেও ভয় করে—এমন মুখ ভারী করে থাকবেন, যেন কি ভয়ানক অন্যায় কথাই বলেছি। কিচ্ছুটি বলবার জো নেই, অমনি পুরুষমানুষের পৌরুষে ঘা লাগবে। মুখ এতখানি হয়ে উঠবে। ও রকম মুখ অন্ধকার করে থাকার চেয়ে বকাও ভাল। কেন বকেন না। বকলেই পারেন, ও রকম মুখ বুজে শাস্তি দেওয়া আমি সইতে পারি না।

ছ’টা বাজল, এখনও দেখা নেই। খাবারগুলো জুড়িয়ে জল হয়ে গেল। কেন যে এত করে মরি, তাও জানি না। স্ত্রীকে কষ্ট দেওয়া, মনে দুঃখ দেওয়া ওদের স্বভাব। যাই, খাবারগুলো ফেলে দিয়ে আবার নতুন করে তৈরি করি গে। ও পান্তাভাত খেতে পারবেন কেন?

না, আজ সত্যি বকব। কেন উনি এত দেরি করবেন? আমি কি কেউ নই? সমস্ত দিন পরে বাড়ি আসবেন, তাও দু’ঘণ্টা দেরি করে? কেন, বাড়িতে বাঘ আছে না ভাল্লুক আছে? দিনান্তেও দেখতে ইচ্ছে করে না? আমার তো—, না পুরুষমানুষের সে সব বালাই নেই। সে শুধু এই পোড়া মেয়েমানুষের।

এই পাঁচ বছর হল বিয়ে হয়েছে, এক দিনের জন্যে কখনও বাপের বাড়ি যেতে ইচ্ছেও হয়নি। আর উনি? বোধ হয় আমি বাপের বাড়ি গেলেই খুশি হন। বেশ, তাই যাব। আমাকে যখন ভালই লাগে না, তখন থেকেই কি আর না থেকেই কি?

ঐ যে আসা হচ্ছে! মুখ হাসি-হাসি। তা তো হবেই—কত ঘুরে ফিরে বেড়িয়ে-চেড়িয়ে আসা হল—মুখ হাসি-হাসি হবে না? আমাকে দেখলেই আবার মুখ গম্ভীর হয়ে যাবে।

না, মনের ভাব প্রকাশ করব না, প্রকাশ করেই বা লাভ কি? আমার রাগ-অভিমান কে গ্রাহ্য করে? তার চেয়ে একখানা বই নিয়ে বসি—যেন কিছুই হয়নি।

উনি এসে বাড়ি ঢুকলেন। মুখে অনুতাপ বা লজ্জার চিহ্নমাত্র নেই, যেন দেরি করে এসে ভারি বাহাদুরি করেছেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, সওয়া ছ’টা। বই মুড়ে রেখে খুব ঠাণ্ডা ভাবেই জিজ্ঞাসা করলুম, “এলে?”

অমনি মুখ অন্ধকার হয়ে গেল, যেন কে সুইচ্‌ টিপে বিদ্যুতের আলো নিভিয়ে দিলে।

কি বলেছি আমি? ‘এলে’ বলাতেই এত দোষ হল? তা ছাড়া আর কি বলতুম? যদি বলতুম ‘এত দেরি করে এলে কেন’, তা হলেই কি ভাল হত? তা নয়—আমাকে দেখেই মুখ অমন হয়ে গেল। আমি বাড়িতে না থাকলেই বোধ হয় খুশি হতেন।

কিন্তু তাই বলে তো আমি চুপ করে থাকতে পারি না। তাড়াতাড়ি কাপড় দিয়ে খাবার আনতে গেলুম। খাবার তো যা হবার তা হয়ে আছে, চায়ের জলও উনুন নিভে ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। আমার যেমন কপাল, তেমনই তো হবে।

তাই এনে মুখের সামনে ধরে দিলুম। চোখ ফেটে জল আসতে লাগল। কি করব? এখন তো আর নতুন তৈরি করে দেবারও সময় নেই। খাবার মুখে দিয়ে একপাশে সরিয়ে রেখে দিলেন। আমি কি করব—ওগো, আমি কি করব? কেন তুমি এত দেরি করে এলে? আমারই খালি দোষ?

আচ্ছা, আমারি দোষ, ঘাট হয়েছে। কিন্তু বক্‌ছ না কেন? অমন মুখ বুজে শাস্তি দেবার কি দরকার?

যাক, তবু চা’টা একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে যায়নি। এবার অন্য কথা বলি, তবু যদি মনটা অন্য দিকে যায়।

জিজ্ঞাসা করলুম, “আজ তোমার মাইনে পাবার দিন না?”

কথার জবাব দিলেন না, উঠে গিয়ে পকেট থেকে টাকা বার করে হাতে দেওয়া হল। যেন টাকার জন্যেই আমি মরে যাচ্ছিলুম, আমি খালি টাকাই চিনি। এ তো অপমান করা! টাকাগুলো জানালা গলিয়ে দূর করে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে। উঃ—আমার মরণও হয় না!

টাকা গুনে দেখলুম—পনেরো টাকা কম। এই এক ঘণ্টার মধ্যে পনেরো টাকা কি করলেন? হাতে টাকা এলে আর রক্ষে নেই, অমনি নয়-ছয় করবেন। না বাপু, আমি আর পারি না। হয়তো কতকগুলো বই কিনে বসে আছেন কিংবা কোনও বন্ধুকে ধার দেওয়া হয়েছে! বন্ধুকে ধার দেওয়া মানেই—

বললুম, “পনেরো টাকা কম যে?”

উত্তর হল, “খরচ করেছি!”

আমি যেন তা জানি না। খরচ না করলে টাকাগুলো কি পকেট থেকে ডানা মেলে উড়ে যাবে? মানে, কিসে খরচ করেছেন তা বলা হবে না। সত্যিই তো, আমাকে বলতে যাবেন কেন? ওঁর নিজের টাকা নিজে খরচ করেছেন—আমাকে তার হিসেব দিলে যে অপমান হবে। আমি তো ওঁর কেউ নেই—জানবার অধিকারও নেই?

যাই, টাকাগুলো ওপরে বন্ধ করে রেখে আসি, নইলে এখনই হয়তো মনে করবেন—কি মনে করবেন উনিই জানেন। মনের মধ্যে গিঁট দেওয়া স্বভাব তো।

ফিরে এসে বসলুম। তবু মুখে কথা নেই। আচ্ছা, চুপ করে দু’জন মুখোমুখি কতক্ষণ বসে থাকা যায়? আমার ওপর বিরক্ত হয়েছেন বললেই তো পারেন। আর, কথা কইতে ইচ্ছে না হয়, তাও খুলে বললেই হয়। না বাপু, মিছিমিছি অমন মুখ ভার করে থাকা আমার ভাল লাগে না।

খবরের কাগজটা টেবিলের ওপর রাখা রয়েছে—বোধ হয় ঐটে পড়বার জন্যেই মন ছটফট করছে। তা পড়লেই তো পারেন। হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবারই কি দরকার?

বললুম, “খবরের কাগজ পড়বে?”

মুখখানা আরও অন্ধকার হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে উঠে পড়লেন—কাপড়-জামা পরতে লাগলেন। তারপর মুখ কালো করে বললেন, “বেড়াতে যাচ্ছি।”

আবার কি অপরাধ করলুম?

বেশ, বেড়াতে যাচ্ছেন যান—আমার সঙ্গ এক মিনিটও ভাল লাগে না, সে তো আমি জানি—কিন্তু এদিকে যে বামুন ঠাকুরটা দুপুর থেকে জ্বরে পড়েছে, কখন উনি এসে একফোঁটা ওষুধ দেবেন, এই পিত্যেশ করে রয়েছে। উনি ওষুধ না দিলে এ বাড়ির কারুর সারেও না অসুখ। এখন কি করি? উনি তো আড্ডায় চললেন,—সেই সাড়ে ন’টার সময় ফেরা হবে। ততক্ষণ বামুনটা এক ফোঁটা ওষুধ পাবে না?

ভয়ে ভয়ে বললুম, “বামুন ঠাকুরের আজ দুপুর থেকে জ্বর—”

‘বুঝেছি’ বলে বেরিয়ে গেলেন।

বুঝেছি মানে কি? বামুন ঠাকুরের জ্বর হয়েছে, এতে বোঝাবুঝির কি আছে? সব কথাই যেন হেঁয়ালি। পাঁচ বছর ঘর করছি-বয়সও কম হল না কিন্তু তবু মনের অন্ত পেলুম না। না—আমার আর ভাল লাগে না, ইচ্ছে করে, কোথাও চলে যাই।

কিন্তু যাবার কি উপায় আছে? চিরদিন ঘরে বন্ধ থাকবার জন্যে জন্মেছি, শেষ পর্যন্ত ঘরেই বন্ধ থাকব। বাইরের সমস্ত পৃথিবী ওঁদের, ঘরটি খালি আমাদের! তা আমি তো ঘরের বার হতে চাই না, কিন্তু উনি কেন একদণ্ড ঘরে থাকবেন না? উনি থাকলে তো আমার আর কিছু দরকার হয় না!

বেশ, যেখানে ইচ্ছে থাকুন, যেখানে ভাল লাগে থাকুন। আমি একলাটি মন গুম্‌রে থাকলে ওঁর কি? পুরুষমানুষ যে—পাথর দিয়ে তৈরি।

না, আর ভাবব না। যাই কাপড় ছেড়ে রান্না চড়াই গে। আচ্ছা, সারা দিন একলাটি থাকি—একটু দয়াও হয় না?

সেই ন’টা বাজল, তবে ফিরলেন। এক মিনিট আগে হবার যো নেই। সেখানে যে প্রাণের বন্ধুরা আছেন!

এসেই খেতে বসলেন—কথাবার্তা কিছু নেই। তবু দেখতে পাই, বাইরে থেকে ফিরলেই মুখখানা প্রফুল্ল হয়। হবেই তো। বাইরে কত মজা—কত বন্ধু, হবে না? আমার সঙ্গে হেসে কথা কইতেই মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। বেশ, আমিও কথা কইব না, শুনতে যখন ভালবাসেন না, তখন কাজ কি!

পান নিতে নিতে প্রথম কথা কইলেন, “উঃ! আজ কি গরম! রাত্রে ঘুম হলে হয়।”

এ কথার মানে আমি আর বুঝতে পারি না? গরম এমন কিছু নয়—আমি পাশে শুই বলে ঘুম হয় না! বেশ, তাই সই। আমি না হয় আলাদাই শোব—তাতে কি? এক বিছানায় শুতে যখন কষ্ট হয়, তখন আমি মেঝেতেই শোব।

বললুম, “বেশ, আমি না হয় মেঝেয় মাদুর পেতে শোব।”

না, তাও হবে না। আমার সঙ্গে একঘরে শুতেও কষ্ট হবে। বললেন, “আমিই নীচে তক্তপোশে শোব। তোমার কষ্ট করবার দরকার নেই।”

নিজে বিছানা পেতে শোয়া হল। বেশ! বেশ!

আমার চোখের জল না দেখলে ওঁর যে প্রাণে শান্তি হয় না। একলা ঘরময় ঘুরে বেড়াই-আর কি করব! ঘুম তো কিছুতেই চোখে আসবে না।

শোব? উনি নীচে তক্তপোশে পড়ে রইলেন…আমি আমি—

এগারটা বাজল; এতক্ষণে বোধ হয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। সারা দিন খেটে—

না, আমি পারব না-পারব না। কেন আমি দূরে দূরে থাকব? এই পাঁচ বছরের মধ্যে একদিনও আলাদা শুয়েছি?…যাই, দেখি—

ঘুমিয়ে পড়েছেন। তক্তপোশের বিছানা-একটা তোশকও নেই, শুধু সতরঞ্চি আর চাদর। শক্ত কাঠ গায়ে ফুটছে, তবু ঘুমিয়ে পড়েছেন। আচ্ছা, এ কেন? আমার ওপর রাগ করে নিজেকে শাস্তি দেওয়া—কি জন্যে?

পাশে শুতেই “অ্যাঁ, কে?”—বলে চমকে উঠলেন। তারপর তন্দ্রার ঘোরেই জড়িয়ে ধরে বললেন, “মীনা।”

এই তো রাগের বহর—ঘুমুলেই ভুলে যান!

আমি বললুম, “চল, ঘরে শোবে চল।”

এইবার ভাল করে ঘুম ভাঙ্গল, বললেন, “না, আজ এইখানেই শুই এস। আর ওপরে উঠতে পারি না।”

সেই ভাল।

কিন্তু একটি বৈ মাথার বালিশ যে নেই? তা—

আমার কিছু কষ্ট হবে না।

২১ আষাঢ় ১৩৪০

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *