মনে ভয় আছে
কফির কাপে প্রথম চুমুকটা দিয়ে বিনু বলে উঠল, তোদের আজ একটা অদ্ভুত গল্প শোনাব।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেয়ার দিকে তাকিয়ে মুখের একটা ভঙ্গি করলাম–যার অর্থ হল, তোমাকে বলেছিলাম না! এবার শোনো বিনুর গল্প!
বিনু আমার অনেকদিনের বন্ধু। কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা হয় এলোমেলোভাবে, কয়েক বছর পরপর। ও ফোন করে, নয়তো চিঠি দেয়, কিন্তু সবই একতরফা। কারণ ওর ঠিকানার কোনও ঠিক নেই। সুতরাং ইচ্ছে হলেও ওকে ফোন করার বা চিঠি দেওয়ার কোনও উপায় নেই।
এবারও হঠাৎই ওর চিঠি পেয়েছিলাম। খুব ছোট্ট চিঠিঃ
বিয়ে করেছি। বউ নিয়ে সাতদিনের জন্যে কলকাতা যাচ্ছি। ২৭ তারিখ কলকাতা ছাড়ব। ২৬ তারিখ, শনিবার, কেয়াকে নিয়ে চলে আয়। চায়ের নেমন্তন্ন রইল। আর খুব মজার গল্প শোনাব।
চিঠির শেষে ওর কলকাতার আস্তানার ঠিকানা এবং কীভাবে সেখানে পৌঁছোতে হবে তার নির্দেশ।
বিনুর ব্যাপারটাই এইরকম। ছন্নছাড়া, খামখেয়ালি। আর যত উদ্ভট বিষয় নিয়ে চর্চা। ওর সবকিছুই রহস্যময়।
বিনুর বউয়ের নাম সুচরিতা। রাজস্থানের কোথায় গিয়ে যেন আলাপ, তারপর দিল্লিতে বিয়ে। বিনুর ব্যাপারে যদি এরপর কাশ্মীরে গিয়ে বউভাত হয়ে থাকে, তা হলেও আমি অবাক হব না।
কেয়াকে বিনুর অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপারের কথা বলেছিলাম। বিনুকে ও আগে দেখেনি। আমার কাছে ওর কথা শুনেছে, আর দু-একবার ফোনে কথা বলেছে।
ওর নতুন বউয়ের জন্যে একটা শাড়ি কিনে অনেক অলিগলি পেরিয়ে অবশেষে বিনুর আস্তানার পৌঁছোলাম। জরাজীর্ণ তিনতলা বাড়ির ফ্ল্যাট। যদিও ফ্ল্যাট শব্দটা এই বাড়ির সঙ্গে মোটেই খাপ খায় না। এ-বাড়ির কথা ও আগে কখনও আমাকে বলেনি।
আমাকে দেখতে পেয়েই বিনু একেবারে জড়িয়ে ধরল। বউদের আলাপ করিয়ে দিল। বেশ খানিকক্ষণ ধরে হইহই করল সবাইকে নিয়ে। স্কুলজীবনের কয়েকটা সত্যি-মিথ্যে ঘটনা বলে সুচরিতা আর কেয়ার সামনে আমাকে সে হেনস্থা করল। তারপর চায়ের নেমন্তন্ন উপলক্ষ্যে সুচরিতা কফি, সিঙাড়া, কাজুবাদাম আর পাঁপড়ভাজা নিয়ে এসে সাজিয়ে দিল সামনে।
কফির কাপে প্রথম চুমুক দিয়ে বিনু যে কথাটা বলল তারই জের টেনে মন্তব্য করল, আমাদের প্রত্যেকের মনেই ভয় আছে।
সুচরিতা বেশ কথাটথা বলতে পারে। ওর মিষ্টি মুখের মধ্যে কোথায় যেন একটা সপ্রতিভ জেদি ভাব রয়েছে! ও সঙ্গে-সঙ্গে পালটা প্রশ্ন করল বিনুকে, কীসের ভয়?
বিনু নির্বিকারভাবে সিঙাড়ায় একটা কামড় দিয়ে বলল, মৃত্যুভয়। তারপর কফির কাপে শব্দ করে পরপর দুটো চুমুক দিয়ে আরও বলল, অনেক সময়, ধরো, আমরা জানি যে, আমাদের কোনও ক্ষতি হবে না, তা সত্ত্বেও আমরা ভয় পাই। মানুষের মনের এ এক অদ্ভুত ব্যাপার।
আমি দিব্যি তৃপ্তি করে কাজুবাদাম খাচ্ছিলাম, বিনুর কথায় থেমে গেলাম। ও কী বলতে চাইছে? এ যেন অনেকটা সোনার পাথরবাটির মতো শোনাচ্ছে! তো হেসে সেই কথাটাই বললাম ওকে।
ও একটা হাত নাড়ল শূন্যে। বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল, দাঁড়া, একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছি। ছোটবেলায় আমরা একটা খেলা খেলতাম মনে আছে, প্রশ্ন-উত্তরের খেলা? একজন বন্ধু আর-একজনকে জিগ্যেস করত, আমার সঙ্গে জঙ্গলে যাবি? তখন দ্বিতীয়জন জানতে চাইত, কী করতে? উত্তরে প্রথমজন বলত, বাঘ মারতে। দ্বিতীয় বন্ধু তো রাজি, হ্যাঁ যাব। সেটা শুনে প্রথমজন সতর্ক করে দেওয়ার ভঙ্গিতে জিগ্যেস করত, ভয় পাবি না তো? দ্বিতীয়জন বুক ফুলিয়ে বলত, না। আর তক্ষুনি প্রথমজন দ্বিতীয়জনের চোখের সামনে আচমকা হাত নেড়ে ভয় দেখাত, এবং নির্ভীক সাহসী বন্ধুটির চোখের পাতা পড়ে যেত। তুই তো জানিস, ব্যাপারটা স্রেফ রিফ্লেক্স মানে, প্রতিবর্তী ক্রিয়া। সাহসী বন্ধুটি বেশ ভালো করেই জানে যে, বন্ধু কিছুতেই তার চোখে মারবে না কিন্তু সব জেনেশুনেও তার চোখের পাতা পড়ে যায় আত্মরক্ষার তাগিদে। এ ব্যাপারটাকে তুই কী বলবি?
প্রশ্নটা বিনু আমাকে লক্ষ্য করে করলেও উত্তর দিল কেয়া। বলল, বিনুদা, আপনি ঠিকই বলেছেন। তবে একেবারে অকারণে কি কেউ ভয় পায়?
বিনু পাঁপড়ভাজা আর কফি আরাম করে শেষ করল, তারপর বলল, আচ্ছা, ওই দরজাটার কথাই ধরা যাক।
আঙুল তুলে ঘরের পশ্চিমের দেওয়ালের ঠিক মাঝখানে লাগানো একটা বন্ধ দরজার দিকে দেখিয়েছে বিনু। দেখেই বোঝা যায়, দরজাটা বহু বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। যে-ই ওটা বন্ধ করে থাকুন না কেন, সে ওটা বরাবরের মতো বন্ধ করার ব্যবস্থা করেছে। খিল-ছিটকিনি ছাড়াও আড়াআড়ি দুটো কাঠ পেরেক ঠুকে আটকে দেওয়া রয়েছে বন্ধ পাল্লার ওপরে। আর তার সামনে দুটো ট্রাঙ্ক আর সুটকেস ওপর-ওপর সাজানো।
বিনুর ঘরটা মাপে বেশ বড় এবং বেশ পুরোনো। দেওয়ালের হালকা নীল রঙের ওপরে ড্যাম্প আর সময়ের ছাপ পড়েছে। সিলিং-এ কাঠের কড়ি। সেখান থেকে ঝুলছে মান্ধাতার আমলের ডি. সি. পাখা। তা থেকে কিচকিচ আওয়াজ বেরোচ্ছে। ঘরের উত্তরের দেওয়ালে একটাই জানলা। সেটা দিয়ে প্রথম শীতের মোলায়েম ঠান্ডা বাতাস ঢুকে পড়ছে ঘরে।
একটা টিউব লাইটের আলোয় ঘরটা তেমন স্পষ্ট ফুটে ওঠেনি। বিনু আর কেয়া বসেছিল বিছানার ওপরে। আমি টিভির সামনে একটা চেয়ারে, আর সুচরিতা অন্দরে যাওয়ার দরজার সামনে একটা মোড়ায় বসে।
বিনু বলল, এই বাড়িটা প্রায় সত্তর বছরের পুরোনো। ওই দরজাটার ওপাশে কী আছে। আমি জানি না। এখন মনে করো, রাতের অন্ধকারে ওই দরজায় যদি কেউ নক করে তখন আমার অবস্থাটা কী হবে! আমি ভয় পাব। অথচ আমাদের সদর দরজায় কেউ নক করলে আমরা দিব্যি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিই–মোটেই ভয় পাই না। তো বহুদিন ধরে বন্ধ ওই দরজাটার যদি রাতের অন্ধকারে ঠকঠক করে কেউ শব্দ করে তখন আমরা ভয় পাই কেন?
সুচরিতা বোগাস! বলে খালি কাপ-প্লেটগুলো গুছিয়ে নিয়ে চলে গেল অন্দরের দিকে।
আমি কেয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম, বুঝলে, এই হল বিনু।
আর কথাটা শেষ হতে না হতেই ওই বন্ধ দরজার ওপিঠে কেউ বেশ জোরে নক করল।
কেয়ার ঠোঁট চিরে অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে এল। ওর চোখ বড় হল। একবার আমার দিকে, একবার বিনুর দিকে, আর একবার দরজাটার দিকে দেখতে লাগল ও। বিনুও দেখলাম অবাক হয়ে বন্ধ দরজাটার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমি থেমে-থেমে বললাম, কী রে, কী ব্যাপার?
বিনু কিছু বলে ওঠার আগেই আবার ঠকঠক শব্দ। তারপর আরও জোরে আবার। বারবার। যেন কেউ পাগল হয়ে নক করে চলেছে দরজার ওপাশে।
বিনু বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বিড়বিড় করে বলল, দাঁড়া, দরজাটা খুলে দেখি–। তার পর এগোল সেই রহস্যময় দরজার দিকে।
কেয়া এবার তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে উঠল–ভয় পাওয়া চিৎকার।
আমি উঠে একলাফে চলে গেলাম কেয়ার পাশে। ওকে জড়িয়ে ধরলাম। বিনু ফিরে তাকাল আমাদের দিকে। নক করার শব্দ তখন থেমে গেছে।
আর ঠিক তখনই সুচরিতা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এসে ঢুকল। অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, কী হয়েছে।
কেয়া হাঁপাতে হাঁপাতে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই বিনু ওকে লক্ষ্য করে হেসে বলল, সুচরিতা, তুমি ওদের দরজার সিক্রেটটা বলে দাও।
সুচরিতা কেয়ার কাছে এসে ওর দুধে হাত রেখে বলল, মিছিমিছি ভয় পেয়েছ, ভাই। ও-দরজাটার ওপাশে আমাদের বাথরুম। আমিই গিয়ে ওখানে নক করছিলাম–তোমাদের সঙ্গে মজা করার জন্যে। ও আমাকে আগে থাকতেই শিখিয়ে রেখেছিল।
আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেছি। কেয়ার চিৎকারে দোতলা তিনতলা থেকে কেউ যে নেমে আসেনি এই রক্ষে। তবে মনে পড়ল, বাড়িতে ঢোকার সময়ে দোতলা বা তিনতলার জানলায় আলো জ্বলতে দেখিনি।
কেয়া রুমালে চোখ মুছছিল, মুখ মুছছিল। বিনুর এই রসিকতা আমার মোটেই ভালো লাগেনি। সুচরিতা হাসি-ঠাট্টা করে ব্যাপারটা হালকা করতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা পুরোপুরি সহজ হতে পারছিলাম না। কোথায় যেন তাল কেটে গেল।
বিনু বিছানায় গিয়ে বসল আবার। বেডকভারে কয়েকবার আঁচড় কেটে বলল, এইজন্যেই আমি বলেছিলাম, আমাদের সবার মনেই ভয় আছে। সেটা যে সবসময় ঠিক মৃত্যুভয় তা নয়– তবে ভয়।
সুচরিতা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বলল, না মশাই, সবাই এত সহজে ভয় পায় না। দরজার আওয়াজ করাতে কেয়া হয়তো ভয় পেয়েছে, কিন্তু তোমার বন্ধু অত কাবু হয়নি। আর আমার কথা তো বাদই দাও। আমার বাবা জঙ্গলে, পাহাড়ে, মরুভূমিতে সার্ভের কাজ করতেন। আমি ছোটবেলা থেকেই বেপরোয়া নানা খানাখন্দে, পোড়ো জায়গায় রাতবিরেতে ঘুরে বেড়িয়েছি। ভূত-টুতে কোনও আস্থা নেই আমার।
বিনু সুচরিতাকে দেখল একবার। তারপর আমাকে লক্ষ করে বলল, সুচরিতাকে এই সহজ ব্যাপারটা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারলাম না যে, ভূত নেই, কিন্তু ভয় আছে। সুস্থ মানুষ তো বটেই–এমনকী পাগল পর্যন্ত ভয় পায়। আচ্ছা বলো তো, বিছানার ওপাশটায় ওটা কী?
আমি বিছানার খুব কাছেই দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু বিনু বলার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ব্যাপারটা খেয়াল করিনি।
বিছানার কালো আর গোলাপি ফুলকাটা একটা চাদর ঢাকা ছিল। লক্ষ করলাম, বালিশের কাছটায় চাদরের নীচে লম্বা দড়ির মতো কী একটা এঁকেবেঁকে পড়ে আছে। তার ওপরে চাদর থাকা সত্ত্বেও জিনিসটা সড়সড় করে অল্প-অল্প এগোচ্ছে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমার মুখ দিয়ে আতঙ্কের চিৎকার বেরিয়ে এল, সাপ সাপ!
ততক্ষণে সুচরিতা আর কেয়াও বস্তুটি দেখতে পেয়েছে। কেয়া হোঁচট খাওয়া এক আর্তনাদ করে উঠল। কিন্তু সুচরিতা শক্ত ধাতের মেয়ে। ও দরজার পাশে দাঁড় করানো কাঠের খিলটা তুলে নিয়ে সপাটে বসিয়ে দিল চলমান সরীসৃপটির ওপরে। ওই সঙ্কটের মধ্যেও লক্ষ করলাম, সুচরিতার চোখেমুখে আতঙ্কের ছায়া।
কিন্তু সরীসৃপটি তখনও দিব্যি নড়ছে চাদরের তলায়। সুচরিতার প্রথম আঘাত তাকে বিন্দুমাত্রও কাবু করতে পারেনি। সুচরিতা উত্তেজিত হয়ে দ্বিতীয়বার আঘাত করল। কিন্তু তাতেও লাভ হল ন।
এইরকম একটা বিপন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমি যখন কিছু একটা করার কথা ভাবছিা, ঠিক তখনই বিনু হো-হো করে হেসে উঠল। তারপর একটানে বেডকভারটা সরিয়ে দিল একপাশে।
সবুজ রঙের একটা মোটা নাইলনের দড়ি এঁকেবেঁকে পড়ে আছে বিছানায়। তার একপ্রান্ত থেকে একটা সরু সুতো চলে গেছে বিনুর কাছে। ওটায় টান মেরেই বিনু রজ্জুতে সর্পভ্রমের ব্যবস্থা করেছিল। সবটাই বিনুর চালাকি আর হাতের কাজ।
সুচরিতার মুখ দেখে বোঝা গেল, এই সাপের ভয় দেখানোর ব্যাপারটা ওর আগে থেকে জানা ছিল না। ও কিছুক্ষণ চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল।
বিনু তখনও হাসছে। কোনওরকমে হাসি থামিয়ে ও বলল, ঝাসির রানি, এবার কাষ্ঠদণ্ডটিকে যথাস্থানে রেখে দাও।
সুচরিতা কেমন বোকার মতো দাঁড়িয়েছিল। বিনুর কথায় ও যেন সংবিৎ ফিরে পেল। খিলটা রেখে দিয়ে এল দরজার পাশে।
আমার বেশ রাগ হচ্ছিল বিনুর ওপর। ওর নতুন বিয়ে করা বউয়ের সামনে এ-ধরনের বদ-রসিকতা না করলেই কি চলছিল না!
বিনু সুচরিতাকে উদ্দেশ করে বলল, ডার্লিং, এইবার তো মানবে যে, আমার বন্ধুটি সাপের ভয়ে কাবু হয়েছে। তুমিও কিন্তু বেশ ভয় পেয়েছিলে। যদি তুমি আগে থেকে দড়ি আর সুতোর ব্যাপারটা জানতে তা হলে মোটেই ভয় পেতে না। এটাই হচ্ছে ভয় পাওয়ার মজা। একই ঘটনায় কেউ ভয় পায়, আবার কেউ পায় না। তা ছাড়া ভয় পাওয়ার মধ্যে কেমন বেশ একটা থ্রিল আছে। এই যেমন ধরো, বড় নাগরদোলা, কিংবা নিক্কো পার্কের ওয়াটার শুট বা রোলার কোস্টার। এসব খেলাতে ভয় করলেও আমরা চড়ে মজা পাই। কেন জানো? কারণ, আগে থেকেই আমাদের জানা আছে, ভয়টা মিথ্যে সত্যিকারের কোনও বিপদ আমাদের হবে না। এটাই হচ্ছে ভয় পাওয়ার মজা…।
কেয়া আমার হাতে ছোট্ট করে চিমটি কাটছিল? অর্থাৎ, এবার মানে-মানে বাড়ি চলো। আমারও কেমন অস্বস্তি লাগছিল। সুতরাং বিনুকে বলে উঠতে যাব, তখনই সুচরিতা পাথরের মতো গলায় বলে উঠল, আমি কিন্তু ভয় পাইনি।
বিনু হাসল আবার। বলল, তোমারও মনে ভয় আছে, সুচরিতা–সে তুমি স্বীকার করো আর না-ই করো। যেমন ধরো, ওই আলমারির লকারটা–ওটার কথা তোমাকে একটু বলি…।
ওঃ, বিনুর রসিকতা কি আর শেষ হবে না! ও তখন আঙুল তুলে দেখিয়েছে ঘরের এক কোণে দাঁড় করানো একটা সাড়ে ছফুট স্টিলের আলমারির দিকে। আলমারিটা একটু পুরোনো, রং ময়লা হয়ে গেছে। এ ছাড়া ওটার আর কোনও বিশেষত্ব নেই।
বিনু আমাদের মুখের ওপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে নেশা ধরানো গলায় নাটকীয়ভাবে বলে চলল, ঘটাং করে শব্দ করে স্টিলের আলমারির দরজা খুলি আমরা, তারপর ছোট মাপের একটা চাবি দিয়ে লকার খুলি। সাধারণত আমাদের যা হাইট তাতে লকারের ভিতর পর্যন্ত সরাসরি নজর যায় না–পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে দেখতে হয়। কী সুচরিতা, এরকম করেই তো লকার ব্যবহার করো তুমি?
সুচরিতা কোনও জবাব দিল না। কিন্তু ওর চোখের নজর আর চোয়ালের রেখায় জেদের ছোঁয়া টের পেতে কষ্ট হল না আমার। এ ছাড়া একটা অদ্ভুত সতর্ক ভাবও লক্ষ করলাম। যেন বুঝতে চাইছে, বিনু ঠিক কোন পথ ধরে কোন লক্ষ্যে পৌঁছোতে চাইছে।
পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে মাথা উঁচিয়ে যখন আমরা লকারের ভিতরে নজর চালাই তখনও। ভিতর পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পাই না। কারণ, ঘরের আলোটা সবসময় তেরছাভাবে এসে পড়ে, আর লকারটাও সুড়ঙ্গের মতো গভীর। সুতরাং, কোনও জিনিস–মানে, গয়নাগাটি বা অন্য কিছু খুঁজতে গিয়ে আমরা হাত ঢুকিয়ে দিই ওই সুড়ঙ্গের অন্ধকার গহ্বরে। তারপর অন্ধকারেই হাতড়াতে থাকি।
একটু থেমে বিনু মাথার চুলে হাত বোলাল। সুচরিতাকে লক্ষ করে হেসে বলল, ডার্লিং, এইবার আসল মজা। ধরো তুমি প্রায় কাঁধ পর্যন্ত হাত ঢুকিয়ে দিয়ে অন্ধকারে লকারের ভিতরটা হাতড়াচ্ছ, এমন সময় একটা হাত খপ করে তোমার হাতটা চেপে ধরল। তুমি প্রথমেই একটা মানসিক ধাক্কা খাবে, তার পর ভয়ে চিৎকার করে উঠে তোমার হাতটা টেনে বের করে নিতে চেষ্টা করবে। তুমি বেশ টের পাচ্ছ, হাতটা ঠান্ডা, পিছল, আর তার শক্তিও অনেক। সুতরাং তোমাদের টানাটানি চলছে। তুমি হয়তো বেশ খানিকটা টেনে নিতে পারলে তোমার হাত। তারপর আতঙ্কে উঁকি মারলে লকারের ভিতরে। তখন তোমার হাত লকারের অন্ধকার জায়গা থেকে খানিকটা আলোর দিকে চলে এসেছে। ফলে লকারের ভিতরের হাতটাকে তুমি দেখতে পেলে। তোমার ফরসা হাত আঁকড়ে ধরে আছে আলকাতরার মতো কালো চকচকে একটা হাত। তার ওপরে ছাতা ধরার দাগ। তুমি একটা পুরোনো ভ্যাপসা গন্ধও পেলে নাকে। আর অবাক হয়ে দেখলে, সাপের মতো সাতটা আঙুল প্রাণপণে তোমার ফরসা হাতটা আঁকড়ে ধরেছে। আঙুলগুলো অল্প-অল্প নড়ছে। হাতের বাকি অংশটা মিলিয়ে গেছে অন্ধকারে…। থামল বিনু। মুখে অদ্ভুত একটা শব্দ করে সুচরিতাকে বলল, এইরকম যদি হয়, তা হলে আমার ধারণা, তখন তুমি ভয়ে দিশেহারা হয়ে পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকবে। আর তার ওপর ঠিক তক্ষুনি যদি লোডশেডিং হয়ে যায়, তা হলে তো আর–।
বিনু, আজ আমরা উঠি। আমি উঠে দাঁড়ালাম। ঢের রসিকতা সহ্য করা গেছে।
দেখাদেখি কেয়াও উঠে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুচি ঠিকঠাক করতে লাগল। ও বিনুর দিকে তাকিয়ে কষ্ট করে হেসে বলল, চলি, বিনুদা। সুচরিতাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে একদিন আসবেন কিন্তু।
বিনু কেমন বিচিত্র দৃষ্টিতে তাকাল আমাদের দিকে, বলল, তোমরা কি ভয় পেয়ে চলে যাচ্ছ নাকি? সবে তো নটা বাজে।
সুচরিতা হঠাৎ কেমন শক্ত গলায় বলে উঠল, আপনারা যাবেন না, বসুন। আমি এখনই ওই আলমারিটা খুলে ওর লকারের ভিতরে হাত ঢোকাব। দেখি, আমি ভয় পাই কি না।
আমি আর কেয়া অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কী করব বুঝতে পারছিলাম না।
বিনু সুচরিতাকে বলল, কী পাগলামো করছ, সুচরিতা! ওই লকারে তোমার হাত ঢোকানোর দরকার নেই। আলমারিটা পনেরো বছর ধরে বন্ধ আছে, বন্ধই থাক। পনেরো বছর ধরে আমরা কেউ ওটা খুলিনি। এখন ডিসটার্ব করার কী দরকার?
আমি অবাক হলাম। পনেরো বছর ধরে আলমারিটা খোলা হয়নি কেন? আর কাকেই বা ডিসটার্ব করার কথা বলছে বিনু?
সুচরিতা খিলখিল করে হাসল, বলল, পনেরো বছর ধরে আলমারিটা কেউ খোলেনি, আজ আমি খুলব বলে। তারপর চোয়াল শক্ত করে হনহন করে এগিয়ে গেল আলমারিটার কাছে। তার পাশেই দাঁড় করানো একটা টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা চাবি বের করে নিয়ে ঘটাং শব্দ করে খুলে ফেলল স্টিলের আলমারির দরজা।
আলমারির ভিতর থেকে ধুলো উড়ল কি না বোঝা গেল না, তবে একটা বিশ্রী পুরোনো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল ঘরে।
বিনু একটু জোরেই বলে উঠল, সুচরিতা, লকার খুলো না বলছি! প্লিজ, আমার কথাটা শোনো, সুচরিতা, প্লিজ…লকার খুলো না!
কিন্তু সুচরিতা কোনও কথাই শুনল না।
আলমারির একটা পাল্লা ওকে অনেকটা আড়াল করে দিয়েছে। টিউব লাইটের আলোও আড়াল হয়ে গেছে সেইসঙ্গে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সুচরিতার নড়াচড়া দেখে আমরা বেশ আঁচ করতে পারছিলাম ও কী করছে।
আলমারির লকার খুলে তার ভিতরে প্রায় কাঁধ পর্যন্ত হাত ঢুকিয়ে পাল্লার পাশ থেকে আমাদের দিকে তাকাল সুচরিতা। হেসে বলল, এর ভিতরে কোনও কালো হাত নেই।
আমি আর কেয়া ঠিক বুঝতে পারছিলাম না এটা নতুন কোনও খেলা কি না। বিনু কি আগে থেকেই বউয়ের সঙ্গে যোগসাজশ করে রেখে আমাকে আর কেয়াকে ভয় দেখাতে চাইছে?
কিন্তু আর কিছু ভেবে ওঠার আগেই সুচরিতা এক ভয়ংকর চিৎকার করে উঠল। সে-চিৎকারে বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে। এক ঝটকায় কেউ ওকে টেনে ধরল লকারের দিকে, কারণ ওর মুখটা বিশ্রী শব্দে আলমারির দরজার পাল্লায় বাড়ি খেয়ে চলে গেল আড়ালে। তারপর শুরু হল প্রাণান্তকর টানা-হ্যাঁচড়ার লড়াই।
বিনু তখনও নির্বিকারভাবে বসে আপনমনে বলে চলেছে, এত করে বারণ করলাম, তবুও তুমি শুনলে না। এত জেদ তোমার! সাহসের এত অহঙ্কার! তোমাকে বারবার করে বললাম, প্রত্যেক মানুষের মনেই ভয় আছে, কিন্তু তুমি আমার কথায় আমল দিলে না। এখন তো আর কিছু করার নেই….।
আমি আর কেয়া পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছি। সারা শরীর ভয়ে কাঠ, নড়বার এতটুকু ক্ষমতা নেই। আর আলমারির কাছ থেকে সুচরিতা পাগলের মতো চিৎকার করে চলেছে। ওর মুখ বিকৃত, চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে, গাল কেটে রক্ত পড়ছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে লোডশেডিং হয়ে ঘর অন্ধকার হয়ে গেল।
কিন্তু তখনও সুচরিতার কানফাটানো আর্ত চিৎকার থামেনি।