মনের বাঘ – ৩

তৃতীয় অংশ 

হামজার চোখ টলটল করছিল। খানিকটা মদের প্রভাবে, খানিকটা আবেগের প্রাবল্যে। হামজাও অভিনেতা। ও যে আবেগের দাস, সেটা এতদিন একটা নৈর্ব্যক্তিক ভাবের তলায় দিব্যি লুকিয়ে রেখেছিল। একটা নিরাসক্ত বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায় সহস্ৰ সাফল্যমণ্ডিত রজনী সে দিব্যি হাততালি কুড়িয়ে এসেছে। এইমাত্র সে যেন তার মেক-আপ তুলে আসল রূপে বেরিয়ে এল। অথবা, এটাই কি তার আসল রূপ? 

ছোট্ট অপরিসর সেই দেশী মদের দোকানটার ধুলো-ঢাকা বা ভেদ করে যেটুকু আলো বেরিয়ে আসছিল, তাতে হামজাকে একটা বৃদ্ধ গৃধিনীর মত দেখাচ্ছিল। বেঞ্চিতে বসে মদের গ্লাসের দিকে সে ঝুঁকে রয়েছে—একটা গৃধিনীই যেন ডালের উপর মাথা ঝুঁকিয়ে বসে আছে। 

“ভালবাসার জন্য নয়”; সামনের রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম হয়েছে বাসের তীব্র হর্ন, ট্রামের ঠংঠং হামজার স্বরকে যেন শ্বাসরুদ্ধ করে দিল, …“আমি মুকুলকে ঠিক ভালবাসিনি।” …ট্যাক্সি এসে একটা ঠেলাকে ধাক্কা মেরেছে। তুমুল ঝগড়া। “শালা, যত্তো জোটে আমারই কপালে, শান্তিতে মালও টানতে দেবে না!”- ও-পাশের মাতালটা ককিয়ে উঠল। … “না, ভালবাসা নয়।” হামজা আবৃত্তি করল। … ট্রাকের জোরালো হর্নে পৃথিবী চিরে গেল। “আমার ইয়ে খাও, শালা!” —মাতালটা অভিসম্পাত দিল। …“আমি খতম।” হামজা বিড়বিড় করল, “আমার বয়েস হয়েছে, এখন যৌবনের কাছে ভিটে বিকিয়ে আমাকে কেটে পড়তে হবে। আমি হেরে গেলাম। জীবনে এই প্রথম আমি হার মানলাম।”

বললাম, “কাতরাচ্ছ কেন?” বাস ট্রাক ট্যাক্সির হর্ন একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল। মাতাল খিস্তি ছুড়তে লাগল। বললাম, “আমি মুকুলকে ভালবাসি না। তুমি ওকে নিতে পারো।” হামজা বলে উঠল, “মুকুলকে কে ভালবাসে? ভালবাসার কথা কে বলছে? আমি বলছি আমার হারের কথা। যে জোরে তুমি আজকের বাজি জিতেছ, আমি তার কথাই বলতে চাইছি। সেই জোরই আমার নেই। সেই যৌবনই আমার নেই। আমি—আমি (যান্ত্রিক গোঙানিতে ওর স্বর ডুবে গেল) জরাগ্রস্ত। তুমি যে মার (“মার, মার। শালাদের ধরে ধরে পোঁদে গঙ্গাজল ভরে দে। মাতাল ক্ষেপে গিয়ে লাফাতে লাগল।) দিয়েছ, সে মার যৌবনের মার। আমি খতম।”

“ভালবাসা জীবনে সর্বক্ষণ গুরুত্ব অধিকার করে থাকে না। সব সময় কেউ ভালবাসায় ডুবে থাকতে পারে না। আমি তা জানি। আমি সেজন্য গোঙাচ্ছি না, ইডিয়ট। আমার কাতরানি আমার পরাজয়ের জন্য। এমন অসহায় আমি আর কখনও বোধ করিনি।”

“দ্যাখো,” হামজা একদিন কফি হাউসের চেয়ার থেকে বলেছিল, “এই জীবনে সবচেয়ে বড় জিনিস কী, বলা মুশকিল। সম্ভবত কিছু নেই। সম্ভবত আছে। সময় এবং ক্ষেত্র বিশেষে এক-একটা জিনিস বড় হয়ে ওঠে। ব্যক্তিভেদে জীবনের গুরুত্বভেদ ঘটে। অধ্যাপক সত্যেন বোসের জীবনে রিলেটিভিটি তত্ত্ব অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ, অতুল্য ঘোষের জীবনে পলিটিক্স্, রামকিঙ্করের জীবনে শিল্প-সাধনা, স্যর বীরেনের জীবনে ইন্ডাস্ট্রি, তেমনি এমন লোকও আছে, আমাদের বন্ধুবান্ধবের মধ্যেই আছে, যার জীবনে কোষ্ঠকাঠিন্যই সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ। 

তা ছাড়া জীবন কথাটার মধ্যেই এমন ফাঁক আছে যে, শুধুমাত্র এই শব্দটার উপর নির্ভর করে কোনও সিদ্ধান্তেও পৌঁছানো যায় না। (আমাকে লিখিত হামজার চিঠি। তরজমা আমার।) কোনও কোনও ব্যক্তির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে সময়-সীমা, এইটেকেই যদি জীবন ধরি, তা হলেও কোনও সিদ্ধান্ত নির্ভুল হবে না। কারণ, এই সময়সীমা একটিমাত্র জীবন নয়, অসংখ্য জীবনের সমষ্টি। সময় যেমন অসংখ্য মুহূর্তের সৃষ্টি। এই মুহূর্তগুলো ব্যক্তির অস্তিত্বকে মুহুর্মুহু নানা ছাঁচে ঢালাই করছে, সঙ্গে সঙ্গে তার রঙ বদলাচ্ছে, ঢঙ বদলাচ্ছে। কাজেই, আমরা যেমন কেউ একটা মুহূর্তকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে পারিনে, তেমনি একটা তত্ত্ব, একটা সত্য, একটা সিদ্ধান্ত সম্বল করেও বাঁচতে পারিনে। আদালতের ‘হাঁ’ কি ‘না’ জীবনে প্রয়োগ করা প্রচণ্ড মূর্খামি। 

“জগৎ অসংখ্য অণুর, সময় অসংখ্য মুহূর্তের, জীবন অসংখ্য অনুভবের সমষ্টিমাত্র।” (হামজা আর একদিন বলেছিল।) “আমরা কিন্তু এই আণবিক সংজ্ঞায় বাস করিনে। আমরা বাস করি এই তিনের সৃষ্ট একটা প্যাটার্নের মধ্যে। যে প্যাটার্নকে একেপিস্ট্ ফিলসফারা বলেছেন স্বপ্ন অথবা মায়া অথবা বিভ্ৰম। এই মায়া আর কিছুই নয়— আমার মতে, আমাদের সিদ্ধান্তের গুরুত্বভেদ, অভিজ্ঞতার মূল্যভেদ। 

“১৯৩০ সালে আমি ভেবেছিলাম, সন্ত্রাস সৃষ্টি করে আমি ব্রিটিশদের তাড়াতে পারব। এখন আমার কাছে তা মতিভ্রম। কিন্তু ১৯৩০এ, সেই সতেরো বছরের আমির কাছে—সেই অগ্নিগর্ভ রাজবন্দির কাছে সেদিনের সিদ্ধান্ত ছিল তোমার-আমার অস্তিত্বের মতই সত্য। হিজলির কারান্তরালে বসে যেদিন শুনলাম, আমাদের এই অতর্কিত গ্রেপ্তারের পিছনে আমার বাবার হাত আছে, আমার বাবা ঘৃণ্য এক ইনফরমার, সেদিনকার আমি ক্রোধে, ঘৃণায়, প্রতিহিংসা গ্রহণের সংকরে আর-পাঁচজনের মতই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলাম। আমার বাবার বিচারকরা আমার সামনে বসে যখন তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিল, তখন তার সমর্থনে আমি আমার অকম্পিত হাত তুলে ধরেছিলাম। এই সিদ্ধান্ত বাইরে পাঠাবার দায়িত্ব আমার উপরেই পড়েছিল—সম্ভবত আমি তাঁর, এক বিশ্বাসঘাতক চরের, এক দেশদ্রোহীর ঔরসজাত ছিলাম বলে। আমি আমাদের দায়িত্ব পালনে কুণ্ঠিত হইনি। সেদিন আমার কাছে সব চাইতে বড় ছিল ‘দেশত। যে বাবা নিজে না খেয়ে আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, ওভারটাইম খেটে আমার পড়ার খরচ জুগিয়েছিলেন, আমার কঠিন অসুখে চিকিৎসার খরচ যোগাবার জন্য ফতুর হয়ে গিয়েছিলেন (আমার রোগজর্জর দেহের উপর সেই ক্ষুধিত স্নেহ এখনও ভাসে : “বাপজান, তুই ভাল হয়ে ওঠ। তুই বাঁচলে আমার সব বাঁচবে। “)—এইসব ঘটনা তখন আমার কাছে তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। তখন আমার চোখে এগুলো ছিল মায়া। এখানকার আমি এই কারণে খুশি যে, আমাদের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা যায়নি। এখন আমার আমাদের সেই আগেকার সিদ্ধান্তই মতিভ্রম বলে মনে হয়।” (হামজার একদিনের উক্তি) 

“১৯৩৯ সালে ভেবেছিলাম, হিটলার ঘাতক, (হামজার আর একদিনের উক্তি) ১৯৫০ সালে ভেবেছিলাম, স্তালিন সভ্যতার শত্রু। এখন সবই মায়া বলে মনে হয়। যেমন বর্তমান কংগ্রেসি শাসকদের কাছে গান্ধী-দর্শন মতিভ্রম মাত্র। মানুষের দুনিয়ায় সবই সম্ভব। এখানে যেমন ভয়ানক উৎফুল্ল হবার কিছু নেই, তেমনি নিদারুণ হতাশ হবার কোন চিহ্নও খুঁজে পাইনে। অতীত যদি আমাদের কিছু দিয়ে থাকে, তবে ভবিষ্যৎও কিছু দিতে পারে। তবে তার সঙ্গে তোমার-আমার ষোল আনা মতের মিল হয়তো—হয়তো কেন, একেবারে নিশ্চিত—নাও হতে পারে।”

“ভবিষ্যৎ” অবনী মাদ্রাজি কফিখানার টেবিল থাবড়ে বলে উঠেছিল, “ভবিষ্যৎ আমাদের আর একটা যুদ্ধ দেবে। আর দেবে ঘোড়ার ডিম।”

হামজা বলেছিল, “ঘোড়ার ডিম দেবে কি না, নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে যুদ্ধই যে দেবে, এ কথা ভাবছ কেন?” 

“বাঃ!” অবনী বিরক্ত হল, “তুমি কি অন্ধ? দেওয়ালের লিখন পড়তে পাও না? বার্লিন নিয়ে কমিউনিস্টরা কী কাণ্ড করছে, দেখতে পাচ্ছ না? ওরা একটা যুদ্ধ বাধিয়ে ছাড়বে।”

“কমিউনিস্টরাই শুধু যুদ্ধ বাধাবার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে, এ কথাই বা ভাবছ কেন?” 

“ওরাই তো এখন মারমুখী।” 

“তুমিও কি মারমুখো নও?” 

“নিশ্চয়ই,” অবনী বলল, “নিশ্চয়ই আমি মারমুখো। কমিউনিস্টদের সর্বগ্রাসী আধিপত্য থেকে বাঁচতে গেলে মারমুখো হতে হবে না?” 

“কী বাঁচাতে চাও?” 

‘ডেমোক্রেসি, ফ্রিডম, অস্তিত্ব।”

“লড়াই করে অস্তিত্ব রাখবে?” 

‘শেষ পর্যন্ত লড়াই ছাড়া আর কী উপায় আছে, বলো?” 

“তবে কমিউনিস্টদের ঘাড়ে যুদ্ধের সব দায়িত্ব চাপাচ্ছ কেন?” 

“ওরা যে অ্যাগ্রেসিভ! স্পুটনিক, গাগারিন—এসব মহড়া দেখেও বুঝতে পারছ না, কী কাণ্ড ঘটাতে যাচ্ছে ওরা?” 

“জর্জ স্টিফেন্‌সন যখন লোকোমোটিভ তৈরি করেন তখন কী তিনি সৈন্য আর সমরসম্ভার পরিবহণের জন্যই তা করেছিলেন?” 

অবনী এই কথায় চটে গিয়েছিল। বলেছিল, “জর্জ স্টিফেনসন কমিউনিস্ট ছিলেন না।”

হামজা আর একদিন বলেছিলে, “দ্যাখো, আমি কমিউনিস্ট নই। ১৯৪০-এ ফ্রান্সের পতন ঘটাল নাৎসি সৈন্য, স্তালিন তখনও হিটলারের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ। এই ঘটনাই আমার কমিউনিস্ট রাষ্ট্র সম্পর্কে আমার মোহমুক্তি ঘটিয়েছে। তারপর থেকে নানা ঘটনা দেখেছি সাদা চোখে; বুঝেছি, কমিউনিস্ট রাষ্ট্রও চালবাজিকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। ওদের ফৌজও মুক্তি-ফৌজ নয়। কিন্তু তাই বলে ওরা মানুষ নয়, রক্তপিপাসু রাক্ষস, এ কথা ভাবতে পারিনে। মানুষ যদি মূলত বিবেচনাশীল হয়, তবে কমিউনিস্টরাই বা বিবেচনাশীল হবে না কেন? সে রহস্য আমি আজ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি।”

“কমিউনিস্ট সত্তা, ফাসিস্ত সত্তা, হিন্দু সত্তা, খ্রিস্টিয়ান সত্তা বলে কোনও সত্তার অস্তিত্ব আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।” হামজা আর একদিন বলেছিল। 

“ধর্মীয় গোঁড়ামির কোনও একটা শাসনে সসাগরা পৃথিবী সর্বকালে শাসিত হবে, এ একটা অবাস্তব কল্পনা।” – হামজার আর একদিনের উক্তি। “হিন্দু পারেনি, বৌদ্ধ পারেনি, খ্রীস্টিয়ান পারেনি, মুসলমান পারেনি, ফাসিও পারেনি, নাৎসি পারেনি। কমিউনিস্টই এর ব্যতিক্রম হবে?” 

“ভবিষ্যৎকে এত গুরুত্ব দেবার কোনও মানেও হয় না। অনেক বাক্যব্যয় করার পর হামজা প্রশান্তভাবে বলেছিল (আর একদিন, অন্য পরিবেশে), “আমার মৃত্যুর পরও যে জগৎ থাকবে, সে সম্পর্কে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। আমি প্রাত্যহিক অস্তিত্বে বিশ্বাসী; কারণ, সেটা আমার ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে। 

 *

হামজার এখনকার পীড়িত মুখে সৌম্যতার লেশপাত্র নেই। এই ঘুপচি মদের দোকানটার হতশ্রী চেহারার সঙ্গে হামজার এই ছন্নছাড়া মূর্তিটা বেশ খাপ খেয়ে গিয়েছে। বাস ট্রাম ট্যাক্সি ট্রাক রিকশা ঠেলা একটা বিশৃঙ্খল হট্টগোল সৃষ্টি করেছে। সবাই আগে যাবার চেষ্টা করেছিল, এখন কেউই যেতে পারছে না। “ঝাঁটা মারি শালা ব্যায়লার মুখে। সেই বাগবাজার থেকে নিরিবিলিতে দু’ ঢোঁক মাল খাব বলে শালা এখানে এলাম, তা দ্যাখো কাণ্ড। পোমা – পোমা – পোমা” অর্থহীন গোটা কতক শব্দ ছুড়ে দিল মাতালটা। এতক্ষণে ট্রাফিক পুলিস এল। 

হাজমা তরল চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ স্থিরভাবে চেয়ে থেকে বলল, “ঘা-টা লেগেছে আমার অহং-এ। বড় রকমের ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। আমাকে এখন অনেক দিন ধরে এই ক্ষত চাটতে হবে।”

আমার হঠাৎ মুকুলের কথা মনে পড়ল। তাকে নিয়েই এত কাণ্ড, আর সে এখন কোথায়। তার দিদির বাড়িতে? নির্জনে শুয়ে আজকের, কয়েক ঘণ্টা আগের সেই অতর্কিত আক্রমণের কথা ভাবছে? নাকি অন্য একটা ছোকরার সঙ্গে (একদিন ঝমঝম বৃষ্টিতে আমি দেখেছি, একটা ছোকরা ছাতার আড়ালে মুকুলকে বাস স্টপ থেকে জড়িয়ে ধরে অফিসে পৌঁছে দিচ্ছে। সে ছোকরা কে, কোথায় থাকে, কী করে, কিছুই জানিনে। দরকারই বা কী?) ফষ্টিনষ্টি করছে, নাকি এতদিনকার তোলা ফটোর মধ্যে নিজেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছে? 

যা খুশি করুক মুকুল, আমাদের আর তাতে যায় আসে না। দুটি পুরুষের অস্তিম সংগ্রামের ফলাফল আজ ঘোষিত হয়েছে। একটি অহং জিতেছে। একটি অহং বসে বসে পরাজয়ের ক্ষত চাটছে জিভ দিয়ে আর মাঝে মাঝে গোঙাচ্ছে। আমাদের আজকের অস্তিত্বে এইটেই সব থেকে বড় ঘটনা। আর সব তুচ্ছ। 

*

“তুমি তো আমাকে দেখেছ কলেজে পড়ার সময়!” সুশীলা বলেছিল, “কীরকম লাজুক ছিলাম! কারও দিকে চোখ তুলে চাইতে পারতাম না। সব সময় মনে হত, সবাই বুঝি আমার দিকে চেয়ে আছে। চেয়ে আছে আমার এই শরীরটার দিকে। কেন যে এ কথা মনে হত আমার, বলতে পারিনে। সম্ভবত মানসিক ব্যাধি। তার প্রধান কারণ, খুব বাচ্চা বয়েস থেকেই আমার শরীরটা সুতোয় ঢাকা ছিল। বুলাকে আমি অনেক দিন পর্যন্ত খালি গায়ে থাকতে দেখেছি। সেইজন্যই সম্ভবত ছোটবেলায় ওর স্বাস্থ্য এত ভাল ছিল। 

“আমার ধারণা, শরীর সম্পর্কে সচেতনতা আমার চাইতে বুলার অনেক কম ছিল। এই কারণেই আমি সুবোধের ব্যাপারে ওরকম আপসেট হয়ে পড়েছিলাম। সম্ভবত বুলাও তোমার ব্যবহারে আমার মতই আপ-সেট হয়ে পড়ে থাকবে। তোমরা বুঝতে পারবে না, আমাদের দেশের মেয়েদের কাছে শরীরটা কেমন একটা অদ্ভুত বস্তু। 

“এখন আমার কোনও শুচিবাই নেই। আমার সেই অধ্যাপক মশাই আমার এই দেহ-দেহ রোগ সারিয়ে দিয়েছেন। না, তাঁর প্রতি এখন আর আমার রাগ-বিদ্বেষ কিছু নেই। তবে মাঝে মাঝে দেখা হলে তিনি যখন ‘মা, মা’ বলে গায়ে ঢলে পড়েন, সেই সময় গা-টা কেমন যেন ঘিনঘিন করে ওঠে। ঠিক ঐরকম একজন অফিসার এখানে আছেন। কথায় কথায় ‘তুমি তো আমার মেয়ের বয়িসি’ বলে গায়ে একটু হাত বুলিয়ে দেন।”

সুশীলার বলার ধরনে আমি হেসে উঠেছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম, ও কার কথা বলতে চাইছে। রঙ্গচারীকে উনিই উসকে দিয়েছিলেন তা আমি জানি। সুশীলাকে আমি সাবধান করে দিতেই এসেছিলাম। সুশীলা শুধু হেসেছিল। 

“তা হলে শোনো,” হাসতে হাসতে ও আবার শুরু করল, “ওঁর কথা কিছু বলি। আমি এখানে আসার পর উনি আমার গার্জেন বনে গেলেন। প্রথম কথাই বললেন, ‘বেশ, মা–বেশ! এইটুকু বয়েসে একা এত দূর এসেছ, তোমার সাহস আছে। তুমি আমার মেয়ের বয়িসিই হবে। কিছু সংকোচ কোরো না। এখানে একা থাকতে ভয় করলে আমার কোআর্টারেও চলে আসতে পারো।’ এই ‘মা, মা’ শুনেই আমার সঙ্গে-সঙ্গে অধ্যাপক মশাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। আমি শুধু হেসে বললাম, অসুবিধে হলেই জানাব। সেই সূত্রপাত। তা তোমাকে বলব কী, আমাদের যুবক অফিসারবৃন্দও কম যান না! পটাপট সম্বন্ধ পাতাতে লাগল। কেউ বোন, কেউ দিদি। একেবারে রাখিবন্ধনের ধুম পড়ে গেল। যারা মুখে কিছু বলতে পারল না, বুঝতে পারলাম, তারা অস্বস্তিতে ভুগছে। আমার সঙ্গে তাদের কোন্ সম্বন্ধ হওয়া উচিত তা ঠিক করতে পারছে না বলে আমাকে এড়িয়ে যেতে লাগল। কয়েকজন মাদ্রাজি আর পাঞ্জাবি অফিসার ছিল, তারা ‘মিস নাগ’, ‘হ্যালো ডক ইত্যাদি বলে মানিয়ে নিল। ওরা কিন্তু অনেক সহজ। বিপদ হল বাঙালি কয়েকজনকে নিয়ে। আমি বাঙালি, ওরাও বাঙালি, আমার উপর ওদের যেন পৈতৃক দাবি। অথচ আমাকে সহজে গ্রহণ করতেও পারছে না। এক অদ্ভুত পরিস্থিতি।”

সুশীলাকে আমার ভাল লাগার প্রধান কারণ ওর এই অকপট বলিষ্ঠতা। সুশীলার সঙ্গে যতটা সময় কাটিয়েছি, একবারও মনে হয়নি, সে মেয়ে। তার কথায়, কাজে, আচরণে একটা আশ্চর্য স্বচ্ছতা। ওর নামে এত বদনাম, কিন্তু ওকে ঘিরে এমন একটা মর্যাদা, যা গোটা প্রশাসনে আমি আর কারও মধ্যে দেখিনি। 

“তারপর শোনো, মাসখানেকের মধ্যেই আমার সেই ‘কাকাবাবু’ আমার জীবন প্রায় অতিষ্ঠ হয়ে তুললেন। প্রথমে দিন কতক তাঁর স্টেশন ওআগনে করে সমস্ত প্রোজেক্ট দেখিয়ে নিয়ে বেড়ালেন। তখনও আমি ধরমকোটে ট্রান্সফার হইনি। হেড কোআর্টারেই আছি। আমার ‘দাদারা’ আর ‘ভাইয়েরা এসে আমাকে ফিসফিস করে বলল, ঐ বুড়োর সঙ্গে এতটা ঘনিষ্ঠতা যেন না করি। লোকটার ক্যারেক্টার ভাল নয়। কলকাতায় অনেক কেচ্ছাকাণ্ড করেছে। এখানেও দু-একটা রিফিউজি মেয়েকে ইত্যাদি। আমি ওদের বললাম, তবে তো ভালই হল—উদ্বাস্তু মেয়েরা এখন দিন কতক স্বস্তিতে থাকবে। এ কথার ফল কী হল, শুনবে? আমার ‘কাকাবাবু’ একদিন খুব গম্ভীরভাবে বললেন, আমি নাকি তাঁর চরিত্রে সন্দেহ প্রকাশ করেছি। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম! সে কী কথা! স্পষ্টই জানালাম, আমার নষ্ট করার মত সময়ের বড় অভাব। 

“আর একদিন কাকাবাবু এসে বললেন, ‘দ্যাখো মা, একটা কথা বলি, কিছু মনে কোরো না। এখানে অনেক রকম লোক আছে। সকলের সঙ্গে আড্ডা, রসিকতা করা ঠিক শোভন হয় না। তা ছাড়া, ওরা সব, মানে সবাই যে খুব গুড ব্রিডের, এটাও তো—মানে, তুমি আমার মেয়ের মত তাই বলছি।’ বললাম, ‘ওঁরা সবাই আসেন- এলে কি মুখের উপর না করা যায়, বলুন?’ তার পরদিনই খবর পেলাম, আমি নাকি কাকাবাবুকে বলেছি, আমার ‘দাদা’ আর ‘ভাইয়েরা এসে আমাকে খুব জ্বালাতন করে, তাই কাকাবাবুর কাছে নালিশ করেছি। আমি তো অবাক। বিরক্তও হলাম। আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ফুটবল খেলা শুরু হল। আমার নামে উপরে উড়ো চিঠিও গেল, আমি নাকি এখানকার অফিসারদের সঙ্গে খুব ফ্লার্ট করে বেড়াচ্ছি। তখন ধরমকোটের কাজ শুরু হয়েছে। কাকাবাবু আমাকে নিয়ে কাজ দেখতে বের হলেন। হাসপাতালের কাজ শুরু হয়েছে। সেটা বর্ষাকাল। ধরমকোট শহর থেকে দু’ মাইল দূরে কাজ হচ্ছে। আমাদের গাড়ি কাঁচা রাস্তায় এমন বসে গেল যে, আর ওঠানো গেল না। হেড কোআর্টারে খবর দিয়ে গাড়ি আনতে হবে, দেড় দিনের ধাক্কা। 

“আমরা দুজনে কোনওক্রমে ধরমকোট পৌঁছলাম সন্ধ্যার মুখোমুখি। খুঁজে খুঁজে বলরামের হোটেলে গিয়ে উঠলাম। কাকাবাবু বড় সরকারি অফিসারের মেজাজে হাঁক-ডাক শুরু করলেন। ডাকবাংলো আছে কি না, জিজ্ঞাসা করলেন। না, ডাকবাংলো নেই। থাকবার কোনও জায়গা? না, তাও নেই। তবে বলরাম বলল, হিন্দিতে, কারণ কাকাবাবু হিন্দিতেই কথা বলেছিলেন- সাহেব যদি মনে করেন, সে এই হোটেলেই একটা থাকবার ব্যবস্থা করে দিতে পারে। 

হোটেল বলতে কলকাতায় যা বোঝায়, এ কিন্তু তা নয়। পাঞ্জাবিদের খাবারের দোকান যেমন হয়, তেমনি। সেদিন আমি বুঝতেই পারিনি, বলরাম বাঙালি। ওর চেহারা, কথাবার্তা, চালচলনে বাঙালিত্বের কোনও লক্ষণ আমি তখন দেখতে পাইনি। ধরমকোটে ট্রাক ড্রাইভারদের একটা বড় আড্ডা। দিনে-রাত্রে শ খানেক ট্রাক তো যায়ই। এখন আরও বেড়েছে। শিখ পাঞ্জাবি সব ড্রাইভার। বলরামের দোকান ওদের খাবার, বিশ্রাম নেবার প্রধান জায়গা (“এই কোম্পানি, খানা লাগাও।”—এই ওদের বুলি)। আমি বলরামকে ওদেরই একজন প্রথমে ভেবেছিলাম। 

“বলরাম যে কাউকে গ্রাহ্য করে না, খাতির করে না, সে আমি প্রথম থেকেই টের পেয়েছিলাম। তখন মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছিল। ওর দোকানে অনেক খদ্দের। সে নিজেই রুটি সেঁকছে, খদ্দেরকে খেতে দিচ্ছে, অর্ডার মত চা বানাচ্ছে, লস্যি বানাচ্ছে। নানা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে। হাফ-প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে, কোমরে একটা তোয়ালে। বলরামের হাতের, বুকের, পায়ের পেশীর দিকেই আমার দৃষ্টি আগে পড়েছিল। এত সুগঠিত পেশী, এত সুন্দর একটা দেহ আমি আর কখনও দেখিনি। আমি আমার অ্যাকাডেমিক নজর দিয়েই ওকে দেখছিলাম। যেন আমাদের অ্যানাটমির ক্লাসে মানবদেহের একটি মডেল নিরীক্ষণ করছি। 

“তারপরে পরিচয় পেলাম ওর ব্যক্তিত্বের। একটা জিনিস আমি অবাক হয়ে লক্ষ করছিলাম, কাজ ও কত পারিপাটি করে সম্পন্ন করে যাচ্ছে। ওর তৎপরতা আছে, ব্যস্ততা নেই। আমরা ওর দোকানে বা হোটেলে যাই বলো না কেন—ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ও এগিয়ে এল। টেবিল মুছে, চেয়ার এগিয়ে দিল। একটা ছোকরাকে ডেকে উনুনের তরকারিটা নাড়তে বলল। একজন খদ্দেরের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, তাকে বলল, চৌদ্দ আনা, কাকাবাবুর প্রশ্নের উত্তরে বললে, এখানে ডাকবাংলো নেই। ভাল হোটেল? থাকবার জায়গা? না, নেই। তবে সাহেব ইচ্ছে করলে আজ রাতটা কোনওরকমে এখানে কাটিয়ে দিতে পারেন। সে পিছনের ঘরে দুটো বিছানার ব্যবস্থা করে দিতে পারে। 

“যে স্বরে সে অন্য পাঁচটা লোকের সঙ্গে কথা বলছিল, কাকাবাবুর সঙ্গেও সেইভাবে কথা বলছিল। কাকাবাবুকে ইতস্তত করতে দেখে সে বললে, খুব বেশি অসুবিধা হবে না। সাহেব ইচ্ছে করলে ঘরখানা দেখতে পারেন। আজকাল মাঝে মাঝে দু-একজন সাহেব আওরাত নিয়ে এসে পড়েন। গাড়ি খারাপ হয়ে যায়, রাত্রে থাকতে চান, আমি তাই একটা ব্যবস্থা করে রেখেছি। বলরামের এই উক্তিতে কাকাবাবু প্রথমে হতচকিত, পরে বিব্রত এবং শেষে এমন রাগত হয়ে উঠলেন যে, আমার ওঁর অবস্থা দেখে হাসি পেল। আমার মুখে-চোখে হয়তো হাসির রেখা ফুটে উঠে থাকবে। তাতে কাকাবাবু আরও রেগে গেলেন। বললেন, ‘রাস্কেল্টার কথা শুনেছ! কী ভেবেছে আমাদের, অ্যাঁ!’ আমি বললাম, ‘এমন খারাপ কথা তো কিছু বলেনি। আপনি চটছেন কেন?” কাকাবাবু বললেন, ‘বলো কী তুমি? কদর্য ইঙ্গিতটা ধরতে পারলে না! মাঝে মাঝে দু-একজন সাহেব আওরাত নিয়ে রাত্রে এখানে আসেন এর মানে কী?’ আমি বললাম, ‘এই যে, আপনি আমাকে নিয়ে এখানে এসে উঠলেন, এর কি কিছু মানে আছে?’ কাকাবাবুর মুখখানা যদি একবার তখন দেখতে! আমার হাসি পাচ্ছিল বেদম। অতি কষ্টে গাম্ভীর্য বজায় রেখেছিলাম। আমার মনে হল, বলরাম যেন বিস্মিত হয়েই আমার দিকে একটুক্ষণ চাইল। ওর ঠোঁটের ফাঁকেও এক টুকরো হাসি উঁকি-ঝুঁকি মারতে দেখলাম। বলরাম কাকাবাবুকে বলল, ‘কিছু দেব? কাকাবাবু খেঁকি কুকুরের মত খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠলেন, ‘যাও, যাও—আপনা কামমে যাও। যব জরুরত পড়েগা তব বোলায়গা।” আমি ওঁকে এক গ্লাস জল দিতে বললাম। ওর ছোকরাটা আমাকে জল দিয়ে গেল। বলরাম আমাদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ওর অন্যান্য খদ্দেরদের দিকে মন দিল। 

“কাকাবাবু গজগজ করতে লাগলেন। এইসব লোক ক্রিমিন্যাল টাইপের। বুঝেছ! এইসব ডেনগুলো বদমায়েশির আড্ডা। পুলিসে রিপোর্ট করা উচিত। আমি বললাম, ‘তা হলে আমরা থাকব কোথায় আজ?’ কাকাবাবু বললেন, ‘এইখানেই থাকতে হবে—বাধ্য হয়ে! এমনই হতচ্ছাড়া জায়গা যে, একটা ডাকবাংলো পর্যন্ত নেই। ডাকবাংলো অনেক সেফ, বুঝলে না!’ বললাম, ‘এইখানেই যদি থাকতে হয়, তা হলে জায়গাটা দেখা যাক। কী বলেন? কাকাবাবু বললেম, অগত্যা।’ বলেই ডাক দিলেন, ‘এই হোটেলওয়ালা, ইধর শুনো।” বলরাম তেমনি সুরেই হাঁক পাড়লে, ‘এই ছোকরা, যাও, শুনো সাব কেয়া বোলতা হ্যায়। ‘ 

“কাকাবাবু আরও চটে গেলেন। ‘কীরকম ইম্পার্টিন্যান্‌স, দেখেছ! ছোকরা এল। বললাম, ‘আমাকে ভিতরে নিয়ে চলো।’ আমি আর কাকাবাবু ভিতরে ঢুকে সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম। আরামে থাকার কোনও ত্রুটিই নেই। ব্যাটারি সেট রেডিও, ড্রেসিং টেবিল অবধি সেখানে আছে। দুটো খাট। মশারি। এক পাশে বাথরুম। দুটো খাটের মাঝখানে একটা পুরু পর্দা, টেনে দিলে আলাদা ব্যবস্থা হয়ে যায়। ছোকরা ড্রেসিং টেবিলের দেরাজ থেকে কাচানো বিছানার চাদর, বালিশের ওয়াড় বের করে দিল। বাথরুমে জল দিল। নতুন সাবান বের করে দিল। 

“কাকাবাবুর মেজাজটা ভাল হয়ে এল। ‘না, ব্যবস্থা ভাল। পাকা ব্যবসাদার, সন্দেহ নেই।’ তিনি ছেলেমানুষের মত এটা-সেটা নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগলেন। ‘দেখেছ, দেখেছ!’ কাকাবাবুর গলার আওয়াজ চড়ে গেল, ‘আমি বলিনি সুশীলা, এটা একটা বদমায়েশির আড্ডা! এই দ্যাখো প্রমাণ।’ কাকাবাবু দেরাজের ভিতর থেকে একটা হুইস্কির বোতল বের করলেন। ‘আমি জানি, আন-লাইসেন্সড্ কারবার। বে-আইনি ব্যবসা।’ উল্লাসে কাকাবাবুর চোখ চকচক করতে লাগল। ‘এই ছোকরা,’ তিনি সরকারি আওয়াজে হাঁক ছাড়লেন, ‘এই ছোকরা, উস বদমায়েশকো বোলাও। আভি বোলাও।’ ছোকরা মুহূর্তের মধ্যে বলরামকে ডেকে নিয়ে এল। ‘এসব কী? অ্যাঁ, এসব কী? গোপনে গোপনে এসব ব্যবসাও চলে? পুলিসে ধরিয়ে দেব, হারামজাদা, রাস্কেল! 

“বলরাম একটুও বিচলিত হল না। ভ্রুক্ষেপও করল না। বলল, ‘দ্যাখো সাহেব, তুমি কে আমি জানি না, জানতেও চাই না। তোমার মতন সাহেব ঢের দেখেছি। তুমি যদি আমার এখানে থাকতে চাও, থাকো। না হলে বেরিয়ে যেতে পারো। তোমার খুশি। তবে ভাল চাও যদি, অর্থাৎ ঘাড়-গর্দান আস্ত রাখতে চাও যদি, গালমন্দ কি চিল্লাচিল্লি কোরো না। মনে রেখো, এই হোটেলের মালিক আমি।’ সে আর দাঁড়াল না। নিজের কাজে চলে গেল। কাকাবাবু বোতলটা হাতে করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। ভয়ে মুখ দিয়ে টু শব্দটি বের হল না। বাইরে বৃষ্টি ঝরছে। আমি বাথরুমে ঢুকে পড়লাম। বলরামের দৃঢ় ভারী গম্ভীর শব্দটি—‘মনে রেখো, এ হোটেলের মালিক আমি’—ঠাণ্ডা জলের সঙ্গে আমার শরীরে রোমাঞ্চ সৃষ্টি করতে লাগল। ‘মালিক আমি’ কথাটা তো কত বার কত লোকের মুখে শুনেছি। কিন্তু তার মানেটা যেন এই জানলাম। দ্যাখো, কথা বললেই হয় না, বলতে পারা চাই ঠিকমত করে; বলার যোগ্যতাও থাকা চাই, তবে সে কথা মনে দাগ কাটে। কাকাবাবু যে আর ট্যাঁ-ফোঁ করলেন না, ঝানু এক গেজেটেড অফিসার কেঁচোর মত নেতিয়ে গেলেন, তার কারণ ঐ ‘মালিক আমি। সম্রাটের কণ্ঠস্বর ঐ কথা দুটোর মধ্যে বেজে উঠেছিল। 

“এই কাকাবাবুটিকে আমার কেঁচো ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি। সেদিন অনেক রাত্রে আমার ঘুম ভেঙে যেতেই টের পেলাম, আমার কাপড়-চোপড়ের মধ্যে একটা কেঁচোই যেন কিলবিল করে ঘুরছে। আমি একটুও ভয় পাইনি, অপ্রস্তুতও হইনি, এমন কী রাগও করিনি। পরম শাস্তভাবে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কি কাকাবাবু, ভয় করছে নাকি?’ কাকাবাবু যেন মুহূর্তে অহল্যা হয়ে গেলেন। তারপর দাঁত-খোলা গলায় আমতা আমতা করলেন, “সুশীলা, তুমি জেগে আছ? এই ইয়ে, আমার কেমন ঘুম আসছে না।’ বললাম, ‘অপরিচিত জায়গায় কারও কারও অমন হয়। আমার তো বেশ ভালই ঘুম হচ্ছে। তা আপনি এক কাজ করুন না—আমার পাশে শুয়ে পড়ুন, আপনার টাকে আমি হাত বুলিয়ে দিই। নাক-টাক ডাকে না তো আপনার?’ কাকাবাবু এই কথা শুনে নিজের বিছানায় চলে গেলেন। আর কখনও বিরক্ত করেননি। 

ওর কথার ধরনে আমি হেসে ফেলেছিলাম। বলেছিলাম, “রঙ্গচারীকে বলেছিলে নাকি এই গল্প?” 

সুশীলা বলল, “রঙ্গচারীকে কেন বলব? আর একটা মুখরোচক কেলেঙ্কারি চাউর করতে? দ্যাখো, কেলেঙ্কারি ছড়ানোয় আমার প্রবৃত্তি নেই। আর তা ছাড়া, কাকাবাবু অফিসার সত্যিই ভাল! অনেক যুবকের চাইতে এঁর উদ্যম, উৎসাহ বেশি। তবে দুর্বলতা তো সব মানুষেরই থাকে! সেইটাই তো আর সব নয়!” 

“তুমি এই ঘটনার দ্বারা কী বোঝাতে চাইছ, সুশীলা?” ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। “শরীরটার কোন মূল্যই তুমি দাও না, এই কি?” 

“ঠিক তা নয়। বরং বলতে পারো, অতিরিক্ত কোনও মূল্য ওতে আরোপ করি না। দ্যাখো,” সুশীলা বলল, “শরীরের নানা ব্যবহার আছে। যৌন ব্যবহার তার মধ্যে একটা। আমার কথা হচ্ছে, এই একটা কাজের উপর আমরা অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করি কেন? এতে কি আমাদের অস্তিত্বের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় না? 

“দ্যাখো, আমাদের ছেলেমেয়েরা যে কোনও বলিষ্ঠ জীবনে প্রতিষ্ঠ হতে পারছে না, তার অন্যতম কারণই হচ্ছে দেহ সম্পর্কে অতিরিক্ত সচেতনতা। এটা এক মানসিক বিকারের পর্যায়ে গিয়ে পড়েছে। আমার কথাই ধরো না! শরীর সম্পর্কে আমার যদি পারিবারিক ছুতমার্গ বজায় থাকত, তা হলে কি আমি এই অরণ্যরাজ্যে আসার কথা কখনও ভাবতে পারতাম? এমন নিঃশঙ্ক চিত্তে এদের মধ্যে কাজ করতে পারতাম? চিরকালই আমাকে লেডিজ সিট্‌টি সম্বল করে জড়সড় হয়ে কাটাতে হত। চেস্টিটি রক্ষা করতে গিয়ে আমাদের পুরুষদের পৌরুষ গিয়েছে, মেয়েরা হারিয়েছে মনুষ্যত্ব। আমাদের কাছে শুধু এক নপুংসক উত্তরাধিকার। ফলে, আমরা পৃথিবীর অধিকার, জীবনের অধিকার, কর্মের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছি। শুধু কাঁদছি, আর কাতরাচ্ছি, আর হা-হুতাশ করছি : আমাদের সব গেল, সব গেল! সব রাখতে গেলে সব দিকে নজর দিতে হবে। 

“ভাগ্যিস এখানে এসেছিলাম, চেস্টিটির বালাইটি ঘুচেছিল, তাই আমি সব পেয়েছি। মনের মত জীবন, মনের মতন কাজ, মনের মত মানুষ, পুরুষের মত পুরুষ। সব—সব -সব পেয়েছি।”

*

“এখানে আমি ভালবাসা পেয়েছি,” সুশীলার মুখ চকচক করে উঠেছিল, “এখানে আমি ভালবাসতে পেরেছি।”

“রবীন্দ্রনাথ বিধাতার কাছে আমাদের কাছ থেকে ওকালতনামা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, নারীকে আপন ভাগ্য জয় করার অধিকার কেন দেওয়া হবে না?” সুশীলা একদিন বলেছিল। “আমি আমার সহপাঠী অনেক মেয়েকেই বেশ আবেগ দিয়েই কবিতাটি আবৃত্তি করতে দেখেছি। কেন নাহি দিবে অধিকার—এইটুকু নাকি সুরে বলেই যেন তাদের কর্তব্য শেষ হয়ে যায়। আর যেন তাদের কিছু করার নেই। এর পর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে শুধু মেদ বাড়াও। আর সর্বক্ষণ শাড়ির ব্যাণ্ডেজে নিজেকে আবৃত করে রাখো। যেন এই পৃথিবীর সুখ-দুঃখ আমাদের নয়, পরিবর্তন, উত্থানপতন আমাদের জন্য নয়, এই বিরাট কর্মোদ্যোগে আমাদের অংশ নেবার কথা নয়। আমরা শুধু গলগ্রহ হয়ে থাকব। সেইজন্যই আমরা জন্মেছি। এই দ্যাখো না, এখানে এত বড় একটা উদ্যোগ হচ্ছে, এর পরিণাম যাই হোক না কেন, কাজ তো আছে প্রচুর! আমার দুঃসাহসিনী বন্ধুদের অনেককে চিঠি লিখেছিলাম, এখানে কাজ নিয়ে আসার জন্য, তা ভয়েই মরে গেল সব, কেউ এল না। ছেলেরাই আসতে চায় না, তা মেয়েরা! 

“একজন বড় মজার চিঠি লিখেছিল, জানো! লিখেছিল, তোমার কীর্তিকলাপ এখানে জানতে আর কারও বাকি নেই। সমাজের শাসনের বাইরে গিয়ে খুব মজা লুটছ। নিজের লেজ কেটেছ বলে এখন সবার লেজ কাটতে চাইছ। না খেয়ে মরব তাও ভাল, কিন্তু ভগবান যেন তোমার মত দুর্বুদ্ধি না দেন। অত লোকের সঙ্গে ঢলাঢলি না করে একজনকে বরং গেঁথে ফ্যালো।” সুশীলা হাসল। “এই মেয়ে পলিটিক্‌স্ করত। রুখু রুখু চুল ফাঁপিয়ে কমরেডদের সঙ্গে রাস্তায় রাস্তায় প্রোসেশন করে বেড়াত। এখন গরিব বাপের ঘাড় ভেঙে খায় আর শাঁসালো বর পাকড়াবার আশায় সেজেগুজে পাত্রপক্ষের সামনে দুরুদুরু বুকে পরীক্ষা দিতে বসে। নিজের বরটা জুটিয়ে নেবে, এমন ক্ষমতাও নেই। 

“অথচ এই মেয়েই একদিন দুর্গমের দুর্গ হতে সাধনার ধন প্রাণ করি পণ কেন আহরণ করবে না, এ কথা কলেজ সোস্যালে জোর গলায় ঘোষণা করত। আমার মা’রও নাকি এই কবিতাটি বড় প্রিয় ছিল। এক বন্ধুর বাড়িতে মা’র মুখে—‘যাব না বাসরকক্ষে বধূবেশে বাজায়ে কিঙ্কিণী’—– আবৃত্তি শুনে বাবা এমনই গলে গিয়েছিলেন যে, ঘটক পাঠিয়ে তার পরের লগ্নেই মাকে বাসরকক্ষে এনে ফেলেছিলেন। আমার জ্ঞান হওয়া অবধি মাকে দেখছি এক তাল কাদার দলা। আমাদের ঝি ক্ষান্তমাসির মধ্যেও ঢের আগুন আছে। আমরা জন্মে ইস্তক কখনও মা’র মুখে কোনওদিন রবীন্দ্রনাথের নাম শুনিনি। একটা বাঁধানো ফটো ছিল আমাদের বাড়িতে, আমার বোন খুকু ঐ দাড়ি-বুড়োর ছবি দেখে ছোটবেলায় খুব ভয় পেত, সেই দাড়ি-বুড়োর ভয় দেখিয়ে খুকুকে ঘুম পাড়ানো হত আর মা গলবস্ত্র হয়ে দু-বেলা প্রণাম করত সেটাকে। আর তারই পাশে মাথায় শেলেট, গায়ে ভাড়া-করা গাউন পরা মা’র একখানা ফটো ছিল। বাবা গর্ব করে তাঁর বন্ধুদের দেখাতেন—বেথুনের মেয়ে। কনভোকেশনের পর মা যেমন গাউনটা ফেরত দিয়ে এসেছিল, তেমনি ভাড়া-করা শিক্ষাটাও যেন ফেরত দিয়ে এসেছিল। মা’র সারা দিনের কর্ম ছিল আমাদের গা ঢেকে রাখা আর ছাতে না যাই সেটা দেখা। 

“আমি এখানে এসে যত না পরিশ্রম করছি, তার ঢের বেশি শক্তিক্ষয় করতে হয়েছে এখানকার চাকরি নেবার সময় বাড়ির সঙ্গে লড়াই করতে। আমাকে ওরা মেডিকেল কলেজে পড়তেও দিতে চায়নি। অথচ আমাদের পরিবারের কলঙ্ক ছিলেন আমার ছোটকাকা। ছোটকাকা বাড়িতে এলে বাড়ি যেন রসাতলে যাবে, সবাই এমন ভাব দেখাত। কারণ, ছোটকাকা মদ খেতেন, কোন এক থিয়েটারের মেয়ে নিয়ে দিন কতক ছিলেন। ব্যাস। অথচ এই লোকটার মতন উদার, সাহসী, উজ্জ্বল জীবন্ত লোক আমি খুব কম দেখেছি। আমার ছোট বয়সের ভালবাসা তাঁকে উজাড় করে দিয়েছিলাম। আমার আত্মহত্যা করতে যাবার কারণের কথা সব প্রথমে অকপটে তাঁকেই বলেছিলাম। কাকা প্রথম কথাই বলেছিলেন, তোর শারীরিক ক্ষতি যদি কিছু হয়ে থাকে বল, ডাক্তার দেখাই। যেন পড়ে গিয়ে আমার হাঁটু ছড়ে গিয়েছে, আয়োডিন লাগাতে হবে কি না কাকা জিজ্ঞেস করছেন। 

“কাকা বলতেন, মনুষ্যত্ব গেলেই সব গেল। যেমন তোর অধ্যাপক। ও তার মনুষ্যত্বকেই ধর্ষণ করেছে, তোকে নয়। ক্ষতি তোর থেকে তারই বেশি হয়েছে; কারণ, তুই তো তাকে আর কখনওই মানুষ বলে জ্ঞান করতে পারবিনে! এখন ভেবে দ্যাখ, তোর যদি নষ্ট করার মত যথেষ্ট সময় থাকে তো ওকে সাজা দেবার জন্য আইনের দ্বারস্থ হই। এই হচ্ছে আমার কাকার অ্যাপ্রোচ। আর আমার বাবা খবরটা শোনা মাত্র বললেন, তোমাকে কলেজে পাঠানোই আমার অন্যায় হয়েছে। কলেজটি ছাড়ো। ঐ জন্যেই জাত-ধর্ম খুইয়েছ। ঐ জন্যেই আমি তোমাকে আগে থেকে বারণ করেছিলাম। আদালত? খবরের কাগজ? ওরে বাবা! কেলেঙ্কারির আর বাকি থাকবে না কিছু! গোটা পরিবারের আর মুখ দেখাবার জো থাকবে না। মা বললেন, এই বেলা ওর বিয়ে দিয়ে দাও। আমাকে শুচি করবার জন্য মা অনেক টোটকার ব্যবস্থা করেছিলেন। মা-বাবার শুরু এক গ্র্যাজুয়েটানন্দ ব্রহ্মচারী আমার শুদ্ধির জন্য আমাকে তাঁর আশ্রমবাসিনী হতে বললেন। তাঁর কাছে আত্মনিবেদনের দ্বারা পরিশুদ্ধ হতে উপদেশ দিতে লাগলেন। সব থেকে মজার কথা, আমার মা আর বাবা আমাকে জোর করেই আমার দীর্ণ দেহটির রিপুকর্মের ভার সেই সাবালক, সেই মোহনীয় ওস্তাগরের হাতে তুলে দিয়েছিলেন প্রায়। আমার নাস্তিক কাকাই আমাকে উদ্ধার করেন। 

“বলরাম সম্পর্কে আমার মনোভাব কাকাকে জানিয়েছিলাম। কাকা খুশি হয়ে লিখেছিলেন, ‘মর্ত্যে বা ত্রিদিবে একমাত্র তুমিই আমার’–এর চাইতে জোরালো মন্ত্র আমার জানা নেই। তার আশ্রয় যখন পেয়েছিস তখন আর বলার কী থাকতে পারে? 

“মা আমার চিঠির জবাব দেন নি। সুষি—আমার ছোট বোন, ইকনমিক্‌সে এম এ—লিখেছিল, এত কাণ্ডের পর এক হোটেলওয়ালা! রুচির প্রশংসা করতে পারলাম না, সেজদি! তোর বন্ধুরা জিজ্ঞেস করছিল, হলধরটি কি কলম ধরতেও জানেন? ওকে লিখেছিলাম, কলম ধরতে শেখেনি, সে ফুরসত পায়নি। তবে সুন্দরভাবে হাতা ধরতে জানে। কুড়ি বছর ধরে ওটা রপ্ত করেছে। এখানে কাছাকাছি একটা বিরাট ইস্পাত কারখানা তৈরি হচ্ছে। ও সেখানে জমি কিনেছে। একটা এয়ার-কণ্ডিশন্ত্ হোটেল খুলবে।”

এবার আমিও অবাক হলাম। সুশীলাকে জিজ্ঞেস করলাম, “সত্যি নাকি?” 

সুশীলা হাসল। “ওর ইচ্ছে তো তাই। বলরামের স্বভাবটাই এমন, ও ছোট গণ্ডির মধ্যে থাকতে পারে না। ক্রমশ‍ই নিজেকে বদলাচ্ছে। দু’ বছর আগে কাকাবাবুর সঙ্গে যেদিন প্রথম ওর হোটেলে যাই, তখনকার হোটেল আর এখনকার হোটেল একেবারে চেনা যায় না।”

“কুড়ি বছর আগে সহায়সম্বলহীন বলরাম এখানে এসে একটা চায়ের দোকান খুলেছিল।” সুশীলা যেন বিরাট কোনও প্রোজেক্টের এক পি আর ও, সাংবাদিকদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্ল্যান্ট দেখাচ্ছে। “ঐ যে ঐ গাছতলায়। কোনওদিন খেত, কোনওদিন খাওয়া জুটত না। কুড়ি বছর এইভাবে লড়াই করে তবে দাঁড়িয়েছে।” 

বলরামের ছোকরাটি এসে চা দিয়ে গেল। বলরাম যথারীতি ক্ষিপ্রতার সঙ্গে খদ্দের সামলে যাচ্ছে। হাফ-প্যান্ট পরনে, স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে। এক জোয়ান খদ্দের পয়সা-কড়ি নিয়ে ঝগড়া করছে ওর সঙ্গে। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওকে দেখতে লাগলাম। তুমুল ঝগড়া বেধে উঠল। শেষ পর্যন্ত মারামারি। বলরাম ওকে ধরে বেধড়ক ঠ্যাঙালে। তারপর হাত মুছতে মুছতে আমাদের কাছে এল। 

সুশীলার দিকে চেয়ে হাসল। “আরে, সেই রিপোর্টার এসেছিল। রঙ্গচারী। অনেক কথা জিজ্ঞেস করল। তুমি মাঝে মাঝে এখানে আসো, রাত্রে থাকো—এ কথা সত্যি নাকি?” 

আমি সুশীলার দিকে চাইলাম। সুশীলা হেসে ফেলল। বলরামকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তা তুমি কী বললে?” 

“মিথ্যে কথা বলি নাকি আমি!” বলরাম বলল, “সত্যি কথাই বললাম। ওরা দুজনেই হেসে উঠল। 

আমি বললাম, “রঙ্গচারীর খোরাক জুটে গেল।”

ওরা দুজনে দেখলাম ব্যাপারটা আমলই দিল না। হাসল শুধু। 

“রঙ্গচারী আমাকেও অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে তোমাদের কথা।” বললাম।

“তা তুমি কী বলেছ?” 

“আমি—” সুশীলার প্রশ্নের উত্তরে আমি বললাম, “আমি কী বলব? বলেছি তোমাকে জিজ্ঞেস করতে।”

“আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল।” সুশীলা বলেছিল। “যাই বলো, রঙ্গচারীকে আমার ভালই লেগেছে কিন্তু। কপটতা নেই। স্পষ্টবাদী। মুংরিদের গ্রামে সেদিন রাত্রে একটা পোয়াতি খালাস করতে গিয়েছিলাম। তখন অনেক রাত। সেই গ্রামে রঙ্গচারী দেখি এক বাড়িতে বসে খুব মদ খাচ্ছে। যখন কাজ শেষ করে বেরিয়েছি তখন দেখি, রঙ্গচারী আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। বললে, “গুড মর্নিং, ডক!’ ওকে আমিও ‘গুড মর্নিং’ জানালাম। তখন অন্ধকার প্রায় ফিকে হয়ে এসেছে। আমায় বললে, ‘চলো তোমাকে এগিয়ে দিই।’ বলে আদিবাসী লোকটার হাত থেকে আমার ব্যাগটা নিয়ে নিল। বলল, ‘ও বেচারিকে আর কষ্ট দেবে কেন, ওকে থাকতে বলো। আমরা দুজনেই যাই।’ বললাম, ‘চলো।’ যেতে যেতে আমাকে জিজ্ঞেস করলে, ‘দ্যাখো, আমি তোমার সম্পর্কে অনেক কেলেঙ্কারির কথা শুনেছি। তুমি কিছু মনে কোরো না, এটা আমার প্রোফেসন্যাল কোয়ারি। তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব, সাফ জবাব দেবে?’ বললাম, ‘বলব।’ রঙ্গচারী বলল, ‘সত্য হোক মিথ্যা হোক, আমার তাতে মাথাব্যথা নেই, তুমি যা বলবে, আমি তাই কাগজে ছাপব; তবে এমন কিছু বোলো না, যা পরে আবার নিজেই অস্বীকার করবে। আই হেট টু বি কন্‌ট্রাডিকটেড! 

“বললাম, ‘ভণিতার দরকার কী? যা জানতে চাও, বলো না! জানা থাকলে নিশ্চয় বলব।’ রঙ্গচারী বলল, ‘ধরমকোটের এক হোটেলওয়ালার সঙ্গে তোমার গোপন সম্পর্ক কিছু আছে?’ বুঝলাম পুরনো নালিশ নতুন লোকের কানে উঠল, এবার লক্ষ চোখে ভাসবে। আমার গুরুত্ব আমার সহকর্মীদের কাছে যে কতখানি, তা বুঝতে পারলাম। আমি ছাড়া ওদের কাছে আর দ্বিতীয় কোনও অস্তিত্ব নেই। আমার হাসিই পেল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব চার্জ গিয়েছে তার কপি পেয়েছ?’ রঙ্গচারী বললে, ‘হ্যাঁ। তবে তোমাকে বলছি, যদি এর মধ্যে ট্রুথ কিছু থাকে তবেই ছাপব, নইলে আই কেয়ার এ ড্যাম ফিগ ফর ইট। তাই তো তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, তোমার সঙ্গে ধরমকোটের এক হোটেলওয়ালার কোনও গোপন সম্পর্ক আছে কি না?’ বললাম, ‘এটাকে তুমি গোপন বলবে কি না, তুমিই জানো— হ্যাঁ, ওখানকার এক হোটেলওয়ালার সঙ্গে সম্পর্ক আছে। ‘ ‘তুমি কখনও কখনও ওখানে রাত কাটাও? ‘হ্যাঁ, কাটাই।’ ‘ওর সঙ্গে রাত কাটাও?’ ‘হ্যাঁ।’ ‘থ্যাংক ইউ। আই লাইকড্ ইওর আসার ভেরি মাচ, সুশীলা! ( এই প্রথম রঙ্গচারী আমার নাম ধরে ডাকল।) তোমার মত মেয়ের অস্তিত্ব আমার কল্পনার বাইরে ছিল। তোমার মত পরিণত মন আমি দেখিইনি। তা, তুমি তোমার ঐ অপোগণ্ড সহকর্মীদের কপালে হাম-টাম খেয়ে চুপ করিয়ে রাখতে পারো না? আই নো, হোআট ইজ বাইটিং দোজ অফুল বাগার্স্।”

সুশীলা হেসে ফেলল। “যাই বলো, আমার কিন্তু ওকে ভালই লেগেছে। আমিই ওকে বলরামের কাছে আসতে বলেছিলাম। বলরাম সম্পর্কে ওর প্রবল আগ্রহ দেখলাম। ‘হু ইজ হি, সুশীলা? ওর মুখে খালি এই কথা। ‘তোমার মত মেয়ে রাত কাটাবার জন্য সাধারণ একটা হোটেলওয়ালার কাছে যাচ্ছে—আমি মরে গেলেও বিশ্বাস করি না। সাম বাগার্স্ সে, হি ইজ এ কমিউনিস্ট, এই প্রোজেক্ট বানচাল করে দেবার জন্য ওকে এখানে পাঠানো হয়েছে। ইজ ইট ট্রু? ইজ হি এ কমিউনিস্ট, সুশীলা? আর ইউ এ কমিউনিস্ট, সুশীলা? আর ইউ এ কমিউনিস্ট?’ বললাম, ‘দ্যাখো রঙ্গচারী, আমি কমিউনিস্ট নই, আই হেট পলিটিক্‌স্। বলরাম কমিউনিস্ট কি না, আমি জানি না, আমি জিজ্ঞেসও করিনি, জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও বোধ করিনি। তবে কোনও কমিউনিস্ট কুড়ি বছর ধরে একটা হোটেল গড়ে তুলেছে, এমন উদাহরণ আমি পাইনি।”

বলরাম উঠে যাচ্ছিল। খদ্দের সামলাচ্ছিল। কখনও এসে আমাদের সামনে বসছিল আবার উঠে যাচ্ছিল। 

সুশীলা বলল, “রঙ্গচারী বারবার জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘বলবাম কী কমিউনিস্ট?’ কেন, বলতে পারো? রাজনীতির রং কী এতই পাকা হয়, সে রং ছাড়া মানুষকে কল্পনা করা যায় না?” 

বললাম, “এ যুগে রাজনীতিই মানুষের প্রভু। একে তো আমরা এড়াতে পারিনে! তা ছাড়া মানুষকে শনাক্ত করার জন্য বিভিন্ন সময়ে মানুষ বিভিন্ন রং ব্যবহার করেছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল ধর্ম, এখন হয়েছে রাজনীতি।”

সুশীলা চুপ করে গেল সেদিন। শুধু বলল, “তা হবে হয়তো। আর একদিন হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, “আচ্ছা, বলরাম যদি অন্য ধর্মের কী অন্য দেশের লোক হত, তা হলে শুধুমাত্র সেই কারণেই কী আমার মনোভাবের পরিবর্তন হত বলতে চাও?” 

সুশীলা কী বলতে চাইছে, ঠিক বুঝতে পারলাম না। সুশীলা কোনও উত্তর না পেয়ে আমার দিকে চাইল। “বোঝাতে পারছিনে, না?” খানিকক্ষণ ভাবল। “ধরো—একটা সাধারণ উদাহরণ দিয়েই বলি—বলরাম যদি মুসলমান হত, তা হলে এখন যেমন ওর দেহের সান্নিধ্যে আসার জন্য আমার রক্ত মাতাল হয়ে ওঠে, তখন কী তা হত না? ও যদি কমিউনিস্ট হত আর আমি ঘোরতর কমিউনিস্ট-বিরোধী, তা হলে ওর আলিঙ্গন এখন যেমন আমার অস্তিত্বকে সার্থক করে তোলে, তা কী তুলত না?” 

এর উত্তর আমার জানা নেই। “এইসব যদি-যদি দিয়ে জীবনের কোনও সত্যে পৌঁছনো যায় বলে আমি বিশ্বাস করিনে।” আমি ঐ প্রসঙ্গ একেবারে শিকেয় তুলে দিলাম। 

*

“দ্যাখো, পলিটিকসে আজ আমার কোনও আগ্রহ নেই,” হামজা একদিন বলেছিল, “কিন্তু শত চেষ্টা করেও আমরা পলিটিক্সের প্রভাব এড়াতে পারি না। কখনও কখনও পলিটিকসের ছাঁচে আমাদের জীবন, আমি চাই আর না চাই, ঢালাই হয়ে যায়। ঈশ্বরে বিশ্বাস, ভূতের ভয় যেমন কোনও কোনও সময় জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। কথাটা আজগুবি শোনাতে পারে, কিন্তু এটা ফ্যাক্‌ট্। 

“মেটিয়াবুরুজের ষড়যন্ত্র আমার বাবার জন্য ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম, বোমা দিয়ে, ডিনামাইট দিয়ে ডক উড়িয়ে দেব। আমার বাবা পুলিশকে খবর দিয়ে এই ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেন। সম্ভবত মোটা পুরস্কার পেয়েছিলেন। সব থেকে বড় পুরস্কার, আমার জীবন তিনি বাঁচাতে পেরেছিলেন। টাকার জন্য অথবা একমাত্র বংশধরের জীবন রক্ষার জন্য তিনি এই কাজ করেছিলেন কি না তা আমি জানিনে। এই ঘটনার প্রভাব আমার জীবনে কীভাবে পড়েছিল, আমি সেই কথাই বলতে যাচ্ছি। 

“আমি যেদিন জানতে পারলাম, আমি এক গুপ্তচরের সন্তান, সেইদিন আমার মনে হল, আমার দেহ মন অশুচি, অশুচি। মনে হল, এক বেশ্যার গর্ভে যদি আমার জন্ম হত, তা হলেও যেন ভাল হত। কিন্তু এ কী, এক ইনফরমারের ছেলে আমি! আমাদের দলের যারা বাইরে ছিল, তারা বাবার প্রাণ নেবার জন্য দু-দুবার চেষ্টা করে যখন ব্যর্থ হল, তখন এই ব্যর্থতায় আমিও অন্যান্যদের মত খেপে গিয়েছিলাম। পুলিসের সঙ্গে আমাদের লড়াই হয়েছিল। আমার দুজন কমরেড ঘটনাস্থলে মারা যায়। একজনের ফাঁসি হয়। আমাদের দলের নেতার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল। কালাপানি যাবার সময় তাঁর কাছে রক্ত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এর প্রতিশোধ আমি নেব। 

“দু বছর বাদে আমি জেল থেকে বের হলাম। আমার বাবা জেলের গেটে ছিলেন। দু’ বছর তাঁর সঙ্গে দেখা করিনি। আমি বাইরে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে বাবা ছুটে এলেন। কিছু বলবার আগেই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তাঁর হাত দুটো লোহার সাঁড়াশির মত গনগনে গরম। (“বাপজান, বাপজান, চোখে আর নজর নাই ভাল দেখতে পাই না। লেকিন ইয়ে কেয়া হুয়া তেরা হালত?”) ইচ্ছে হচ্ছিল, এক ধাক্কায় বুড়োটাকে ছিটকে ফেলে দিই। মনে মনে তীব্র ঘৃণায় জ্বলে উঠলাম। মনে মনে গর্জে উঠলাম, হঠ যাও, গাদ্দার কাঁহেকা। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারলাম না। সেই বুড়োটার জীর্ণ শীর্ণ শরীরে জ্বরের প্রচণ্ড তাপ, চোখ দুটো যেন লাল ভাঁটা, শরীরে জ্বরো গন্ধ। ঠেলে ফেলতে মায়া হল। বলতে চাইলাম, আমি তোমার ছেলে ন‍ই, দুশমন। পারলাম না। ভেবো না, আমার মনে সেদিন পিতৃভক্তি জেগে উঠেছিল। আদপেই নয়। সেই মুহূর্তে আমি পুরোপুরি পলিটিক্যাল বিয়িং-ই ছিলাম। বাবার প্রতিও আমার ঘৃণা প্রচণ্ড ছিল। যেটা বদল হয়েছিল, সেটা আমার পলিটিক্যাল চরিত্র। জেলে সন্ত্রাসবাদী হয়ে ঢুকেছিলাম, মার্কসবাদী হয়ে বের হলাম। খুচরো প্রতিশোধ গ্রহণের চেষ্টায় শক্তির অপব্যয় না করে বিপ্লব সংগঠনে আত্মনিয়োগ তখন শ্রেয় বলে জেনেছি। পিতৃহত্যায় আত্মগ্লানি মোচন অপেক্ষা শহিদ হবার সার্থকতা কাম্য বলে মনে হয়েছে। বাবাকে আস্তে সরিয়ে দিয়ে, তাঁর সঙ্গে একটিও কথা না বলে দলের গাড়িতে গিয়ে উঠে পড়লাম। একটা বুক-ফাটা আর্ত চিৎকারে সেই বিকালের আবহাওয়া হা হা করে উঠল। ভুগুক বুড়ো! বিশ্বাসঘাতক! মীরজাফর! মনে একটা উল্লাস লাফ-ঝাঁপ দিতে লাগল। ‘তোমার ছেলে নেই, তোমার ছেলে মরেছে।’ ঘোড়ার গাড়ির বাইরে মুখ বাড়িয়ে বললাম। (শহিদ, শহিদ, আমি শহিদ।) দলের বন্ধুরা হাততালি দিল, ‘সাবাস, কমরেড!’ 

“আরও পাঁচ বছর পরের কথা বলছি। আমি তখন প্রেমে পড়েছি। পার্টিরই একটা মেয়ের সঙ্গে। আমি ডক শ্রমিক সংগঠনে মেতেছি। সে ছাত্র সংগঠনে। সে ছিল উচ্চ মধবিত্ত সচ্ছল পরিবারের মেয়ে। হিন্দু। বাবা ব্যারিস্টার। হ্যারি পলিটের সাক্ষাৎ শিষ্য। প্রেসিডেন্সি কলেজের মেয়ে। সর্বহারার বন্ধনমুক্তির জন্য তার চোখে আগুন ঝরত। সত্যিকারের আগুন। (‘কমরেড, তোমার চোখের আগুনে সর্বহারার দুনিয়া আলোকিত হবে। ‘) আমার বুকের ভিতরে যে আগুন জ্বলত, তার পরিচয় সে পেয়েছিল। (‘কমরেড, কমরেড, তোমার বুকের আগুনে শোষণ, অত্যাচার পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। ‘) আমরা দুজনেই ‘মুক্তি, শান্তি, প্রগতি’র মন্ত্রে বাঁধা পড়েছিলাম। 

“তিন বছর কোথা দিয়ে কেটে গেল। শ্রমিক সংগঠন, জেল, আর তার চোখে চোখ রেখে। ইতিমধ্যে সে পার্টির প্রথম র‍্যাঙ্কে চলে গিয়েছে। যুদ্ধ এসে হানা দিয়েছে। পার্টির ভিতরে নীতিগত ফাটল দেখা দিয়েছে। একসময় চেয়ে দেখি, আমরা ফাটলের দু’ ধারে দুজন দাঁড়িয়ে আছি। তখনও পর্যন্ত আমাদের মূল লক্ষ্য এক। সংগ্রামের পদ্ধতি নিয়ে শুধু বিরোধ। আমি তার চোখে ‘আল্ট্রা, সে আমার চোখে “ইন্‌ফ্ৰা’। 

“তারপর দুজনের পথ ক্রমশ বেঁকে যেতে লাগল। শুধুমাত্র ভালবাসা দিয়ে দুটো অস্তিত্বকে এক ঠাঁই বেঁধে রাখা গেল না।” হামজা হেসেছিল। “জীবনের বাস্তব ঘটনার রকমই এই। কাল্পনিক কোন ছবির সঙ্গেই মিল হয় না। 

“তোমাদের এই প্রেম সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না।”

হামজা বলল, “তবে কিসের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল?” 

আমি জবাব দিয়েছিলাম, “ঠুনকো রাজনীতির উপর।”

“রাজনীতি ঠুনকো হতে পারে, কিন্তু তা সত্য নয় কেন?”

“কারণ, রাজনীতি জীবনের লক্ষ্য নয়, উপলক্ষ মাত্র।”

“তোমাদের মুশকিল কী, জানো?” হামজা বলেছিল, “কতকগুলো ফাঁকা বুলি ছাড়া আর কিছু আওড়াতে পারো না। শব্দে শব্দে বাজিমাত করার প্রবণতা তোমাদের ছদ্মবুদ্ধিজীবীদের প্রধান ব্যাধি। তার কারণ, বাস্তব জীবনের কোনও চরম সমস্যারই মুখোমুখি তোমাদের দাঁড়াতে হয়নি কখনও।”

আশ্চর্য, অনেকটা এইরকম কথা সুশীলাও বলেছিল। “দ্যাখো, অনেক জিনিসের অর্থ কল্পনায় যেরকম মনে হয়, বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে দেখলে তার চেহারাই বদলে যায়।”

*

হামজা ঠিক কথা বলেনি। এটা ঠিক, আমি ওর মত বুদ্ধিমান নই। ওর মত বিদ্যের জোরও আমার নেই। ও যতটা পরিষ্কার মাথায় সমস্যার গভীরে প্রবেশ করতে পারে, যত সহজে বুঝতে পারে, আমি তা পারিনে। মাঝে মাঝে মূর্খের মত কথাবার্তা বলি, তাতেও সন্দেহ নেই। তবে আমি জীবনের সঙ্গে মোকাবিলা করিনি বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়াইনি, এ কথা ঠিক নয়। 

বহুবার আমাকে বহু সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। সেদিনও আমি দাঁড়িয়েছিলাম আমার নিয়তির মুখোমুখি। সেই গভীর রাত্রে, দরজার খোলা কপাটের ফাঁক দিয়ে যে প্রলম্বিত ছায়াটিকে মেঘ সরে যাওয়া চাঁদের আলো আমার পিঠের কাছে ঠেলে দিয়েছিল, সেই ছায়াই আমার নিয়তি। 

আমার কোলে তখন রথীনের বউয়ের মাথা। তার গায়ে প্রবল জ্বর। আমি বসে বসে তার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছিলাম। একটু আগেই মালগাড়ির ইঞ্জিনের আলোটা ঘরের ভিতর গোয়েন্দাগিরি করে গেল। জানালার ফাঁক দিয়ে তার কালো অন্ধকার দেহ নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সিগন্যাল পায়নি। অসহিষ্ণু ইঞ্জিন বারবার চিৎকার করছিল। রথীনের বউ অচৈতন্য, তাড়সে গোঙাচ্ছে। পাঁচিলের উপর থেকে ঝপ করে একটা ভারী দেহ উঠোনে পড়ল। ধীরে ধীরে তার ছায়া বারান্দায়, বারান্দা থেকে খোলা দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়াল। থামল। আর এগুচ্ছে না। থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ও কী কিছু ভাবছে? দরজা তো খোলা? দু’ পা এগোলেই ভিতরে আসতে পারে! আটকাচ্ছে কোথায়? “কী ভাবছ তুমি?” ছায়াটাকে প্রশ্ন করলাম মনে মনে। “দ্বিধা কেন তোমার?” আমি কী ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম, ও চোর নয়? এই ছায়ার যে মালিক তার হৃদয় পুড়ছে, আমি কী তা বুঝতে পেরেছিলাম? ছায়াটা অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। অনড়। মাঝে মাঝে অন্ধকার এসে তাকে মিলিয়ে দিতে লাগল। গর্ভবতী মেঘ চাঁদের আলো আড়াল করে দিচ্ছে। ছায়াটাকে সুযোগ দিচ্ছে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে ভিতরে এসে ঢুকতে। ছায়াটা তবুও নড়ছে না। তবে কী ও ভয় পেয়েছে? কিসের ভয়? তবে কী ও কিছু সন্দেহ করছে? কিসের সন্দেহ? ও কী ভাবছে, আর মাত্র দুটো পা এগিয়ে গেলেই চিরদিনের মত একটা রহস্যের কিনারা হয়ে যাবে? এক নির্মম সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে? যে রহস্যের আড়ালে এখনও পর্যন্ত এক চরম প্রশ্ন অমীমাংসিত হয়ে পড়ে আছে, যার উত্তর ওর জানা নেই, ও কী তা জানতে চায় না? 

রথীনের বউ ককিয়ে উঠল। “বড় ব্যথা। একটু জল খাব।” রথীনের বউয়ের মুখে জল ঢেলে দিলাম। সে আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। মেঘ এসে আলো ঢেকে দিল। “আমার ভয় করছে, ভয় করছে। আমার কাছে সরে এসো না!” বললাম, “ভয় কী, আমি জেগে আছি তুমি ঘুমোও, ঘুমিয়ে পড়ো। আমার সাড়া পেয়ে ও ব্যাকুলভাবে আমার হাত দুটো চেপে ধরল। অবুঝের মত আমাকে টানতে লাগল। “ভয় করছে, আমার বড্ড ভয় করছে। আমার কাছে সরে এসো না!” আমি দরজার দিকে চাইলাম। সেখানে অন্ধকার, জমাট অন্ধকার। “এসো না, আমার কাছে সরে এসো না! আমি একটুও নড়তে পারছিনে। বড় ব্যথা! আমার সারা গায়ে ব্যথা। 

ট্রেনখানা সিগন্যাল পেয়েছে। কেমন এক রকম শব্দ করতে করতে ভূতের মত এগিয়ে চলেছে। যেন অনিচ্ছুক গাড়িগুলোকে ইঞ্জিনখানা হ্যাঁচকা টান মারতে মারতে নিয়ে চলেছে। মেঘ সরে গেল। ছায়াটা মিলিয়ে গিয়েছে অথবা চুপিসাড়ে এসে ঘরের অন্ধকার গা ঢাকা দিয়েছে। রথীনের বউয়ের ভ্রূক্ষেপও নেই। সে সমানে ককিয়ে চলেছে, “এসো না, আমার কাছে সরে এসো না!” আমারই বা এত ভাবনা-চিন্তার দরকার কী? আমি ওর পাশে শুয়ে পড়লাম। ওকে আমার দিকে পাশ ফিরিয়ে শোয়ালাম। একটু ককিয়ে উঠল। ওর জ্বরতপ্ত নিশ্বাস আমার মুখে জ্বালা ধরাতে লাগল। ওর পিঠের কাপড় সরিয়ে সন্তর্পণে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। ও শিউরে শিউরে উঠতে লাগল। বেতের বাড়িতে পিঠে অনেক দাগ কেটে বসেছে। রথীন ওকে আজ মেরেছে। কিছুদিন যাবৎ মারছে। রথীনের বউ আমাকে কিছুই জানায়নি। আজও না। আজ মাত্রা বেশি হয়ে গিয়েছে, তাই আমি টের পেলাম। 

রথীনের মেজাজ ক্রমশ অনিশ্চিত হয়ে উঠছিল। আগে ও সকলের সঙ্গে মানিয়ে চলত। কোনও সিদ্ধান্ত নেবার আগে সকলের বক্তব্য শুনত। প্রত্যেকের কথা বুঝতে চেষ্টা করত। লালঝাণ্ডারা যে বিশেষ সুবিধে করতে পারত না, সে শুধু রথীনের শান্ত স্বভাবের জন্য। রথীনের উপর রেল-শ্রমিকদের প্রচণ্ড ভরসা ছিল। স্থানীয় কর্তৃপক্ষও রথীনকে সমীহ করতেন ওর শান্ত দৃঢ় স্বভাবের জন্য। কিন্তু এখন রথীনের স্বভাব ক্রমশ উগ্র হয়ে উঠছে। দেখতে লাগলাম, রথীনের বিরুদ্ধে ক্রমশ সকলের বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠছে। ইতিমধ্যে শ্রমিকেরা ধর্মঘটের ব্যাপারে ক্রমশ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠছে, এই ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়ে কর্তৃপক্ষ উপরওয়ালার নির্দেশে এক শ্রমকল্যাণ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করলেন। শ্রমিকদের মূল দাবি-দাওয়ার ফয়সালা এই কমিটির এক্তিয়ারের বাইরে রাখা হলেও ছোটখাট অনেক সমস্যার সমাধানের ভার এই কমিটির হাতে দেওয়া হবে, কর্তৃপক্ষ সে আশ্বাস দিলেন। কমিউনিস্ট ইউনিয়ন প্রকাশ্যত এই কমিটি গঠন এক বিরাট ধাপ্পা বলে প্রচার করতে শুরু করল এবং গোপনে “কয়েকটি শর্তে” এই কমিটিতে যোগ দিতে পারে বলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে লাগল। রথীন সরাসরি এই কমিটির বিরোধিতা করবে বলে জেদ ধরল। এই বিষয়ে আমাদের ইউনিয়নের কার্যনির্বাহক সমিতির সঙ্গে ওর প্রচণ্ড মতবিরোধ হল। আমার পক্ষে রথীনের মত সমর্থন করা অসম্ভব হয়ে উঠল। আমরা কর্তৃপক্ষের এই প্রস্তাব প্রকাশ্যত সমর্থন করলে কমিউনিস্টদের দু-মুখো নীতি বানচাল করে দিতে পারতাম। সমগ্র কমিটির শ্রমিক-শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব আমরাই করতে পারতাম। যুদ্ধ সমর্থন নীতি অটুট রাখতে পারতাম। আমাদের নীতি ও কাজে পরস্পর-বিরোধিতার অবসান ঘটত। এবং শ্রমিকদের কিছু কিছু কল্যাণসাধনের মধ্য দিয়ে ওদের উপর আমাদের প্রভাব বিস্তার করতে পারতাম। রথীনের মাথা এত পরিষ্কার হওয়া সত্ত্বেও সে এ কথা বুঝতে চাইছে না বলেই বুঝছে না। আমি ওকে বোঝাতে অনেক চেষ্টা করলাম। কার্যনির্বাহক সমিতির বৈঠকে রথীন আমাকে চরম বেইজ্জত করে বসল। আমাদের পাঁচ বছরের নিবিড় সম্পর্কে এই প্রথম ও অতর্কিতে ফাটল সৃষ্টি করে দিল। আমার বিরুদ্ধে হিংস্রভাবে সে বিষোদ্‌গার করল। 

আমি অবাক। অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। রথীনের কপালের শিরা ফুলে উঠেছে। ওর চোখ দিয়ে আগুন ঝরছে। মুখের রেখায় রেখায় ঘৃণা ফুটে উঠছে। এই রথীন! রথীন! আমি যার অন্তরঙ্গেরও অন্তরঙ্গ! যার প্রায় অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ! আমি চুপ করে শুনে গেলাম। আমার মুখ দিয়ে একটি কথাও বের হল না। ওর কোনও মন্তব্যেরই জবাব দিলাম না। শুধু দেখতে পেলাম, ওর বাড়ির দরজা আমার মুখের উপর বন্ধ হয়ে গেল। সে দরজা আর কখনও খুলবে না। কখনও না। 

অনেক দিন পরে আমি আবার ইউনিয়ন অফিসের আশ্রয়ে ফিরে এলাম। একা থাকতে চাইছিলাম। রথীন এক ধাক্কায় আমাকে গভীর জলে ঠেলে দিয়েছে। সাঁতরে ডাঙায় উঠতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সে অবকাশ পাওয়া গেল না। আমাদের ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট (যখন শুধুমাত্র এটা এমপ্লয়িজদের সংগঠন ছিল, তখন ইনিই বরাবরকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। এখন প্রেসিডেন্ট রথীন।) রসময়বাবু এলেন। আমার অদূরদর্শিতার প্রভূত নিন্দা করলেন। (আমিই এটার মধ্যে শ্রমিক এনে ঢুকিয়েছি।) এবং রথীন যে তলে তলে কমিউনিস্টদের হয়ে কাজ করছে, সেটা আমাকে জানালেন। অবিলম্বে রথীনকে হঠানো আবশ্যক, সে কথা বারবার আমাকে জানিয়ে গেলেন। আমার ইচ্ছে করছিল, রসময়ের মাথাটা ভেঙে দিই। যাবার সময় বলে গেলেন, “রথীনের বউয়ের সঙ্গে তোমার নাকি খুব মাখামাখি?” রসময়বাবুর কথাটাকে খুব অশ্লীল বলে মনে হল। আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল। “তার মানে? কী বলতে চাইছেন? রসময়বাবু বলে উঠলেন, “দ্যাখো ভাই, আমার আর বলার কী আছে! যা বলবার, রথীনই একদিন বলবে। আমি তোমাকে একটু সতর্ক করে দিলাম মাত্র। ফ্যাক ফ্যাক করে হাসতে হাসতে তিনি বেরিয়ে গেলেন।”

রসময়বাবুর কথায় আমার চোখের সামনে থেকে অন্ধকারের পদাটা খানিক যেন সরে গেল। আমি, রথীন আর তার স্ত্রী আর একটি বিন্দুতে মিলিত হয়ে নেই। আমি আর তার স্ত্রী এখন পৃথক বিন্দু। একেবারে আলাদা। এখন তাই রথীন আর আমার মধ্যে সংঘর্ষ বাধছে। ভবিষ্যতেও বাধবে। কেন? রথীনের স্ত্রী রথীনের অধিকারে। সে এখন আর নারী নয়। একটি বিশেষ সম্পত্তি, তার স্ত্রী। তাই পাছে তার সম্পত্তি, তার স্ত্রী অন্যের অধিকারগত হয়, রথীন সেই কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। শুধুমাত্র ভালবাসা পেয়েই রথীন আর সন্তুষ্ট থাকছে না। সে এখন তার স্ত্রীর উপর একচ্ছত্র অধিকার চায়। তাই রথীনের চিত্ত এখন সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। তাই সে আমাকে এখন ঘৃণা করছে। মাত্র ক’দিনের মধ্যে সমগ্র পরিস্থিতি কেমন ওলটপালট হয়ে গেল। যতদিন আমাদের ভালবাসায় ভরসা ছিল, ততদিন কোনও গোলমাল বাধেনি। আজ আর রথীন ভালবাসায় ভরসা রাখতে পারছে না, অধিকারকেই সে ভরসা করছে। রথীন ভালবাসার ভাগ দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি। অধিকারের সূচ্যগ্র ভাগও সে কাউকে দিতে চায় না। ভালবাসার চাইতে অধিকারের মূল্যই কি বেশি? 

এখন তবে আমার কর্তব্য কী? রথীনের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছেদ করব? ভালবাসার? আমি কি ওকে আর ভালবাসি না? বাসি বই কী! অতএব এ সম্পর্ক ছেদ করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তবে কি কর্মক্ষেত্রের সম্পর্ক ছেদ করব? পাগল! রসময়বাবুরা যা-ই বলুন, শুধুমাত্র অফিসের বাবুদের নিয়ে ইউনিয়ন গড়া যায় না। তাতে একটি প্রধান শক্তিকে—শ্রমিক-শক্তিকে ডাইনের হাতে তুলে দিতে হয়। সেটা ক্ষতিকর। শ্রমিক-শক্তিকে ধরে রাখবার প্রধান অবলম্বন রথীন—এখনও রথীনই। ওকে ছাড়ার কোনও প্রশ্ন ওঠে না। তবে আর কোন সম্পর্ক ছেদ করব? রথীনের স্ত্রীর সম্পর্ক? আমার তো সেখানে কোনও অধিকারের প্রশ্ন নেই! আমার সম্পর্ক ভালবাসার। এটা ছেদ করা মানে নিজের হৃৎপিণ্ডকেই ছিঁড়ে ফেলা। মিথ্যে প্রতিজ্ঞায় লাভ নেই। পারব না। 

তবে কী করতে পারি? রথীনের অশান্তি, তার মনের জ্বালা আর বাড়াতে না পারি। সেটা আমার হাতেই আছে। এখন থেকে আর রথীনের বাড়িতে যাব না (যাব না? কখনওই যাব না? রথীন যখন বাড়ি থাকবে না, তখনও না? ওর বউ যদি ডাকে, তবুও না?)—না, কখনও যাব না। যদি অজ্ঞাতসারে ও বাড়ির দিকে পা দুটো এগিয়ে যেতে চায়? টের পাওয়া মাত্র পা দুটো টেনে নেব। যদি কখনও ও পথে যেতে চোখ দুটো ও বাসার দিকে ঘুরে যায়? চোখ বন্ধ করে ফেলব। যদি কখনও ও বাসার থেকে পরিচিত আহ্বান ছুটে আসে? “শোনো, শুনে যাও, একবারটি এসো না!” – শুনব না, শুনব না, কানে হাত চাপা দিয়ে বেরিয়ে যাব। যদি মনে বাজে? মনে—মনকে—তা হলে আমি নাচার, নাচার, নাচার! ঘরের মধ্যে নিজেকে আটকে রেখে শুধু ছটফট করব। 

এই যে এখন নিজেকে বন্দি করে রেখেছি। যাচ্ছি কি? না, যাচ্ছি না—তবে সবই . তো দেখছি! রথীনের বাসা, উঠোন, ঘর, আসবাব, রথীনের স্ত্রী, তার অবয়ব, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক- সব আমার পরিচিত—সবই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। রথীন, রথীনের ছায়া- 

দরজায় ছায়া পড়ল। চমকে উঠলাম। “কে?” 

“আমি। রথীন।”

রথীন! রথীন কেন? অন্ধকার এগিয়ে এল। 

“তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।” রথীন আমার পাশে এসে বসল। এই প্রথম রথীনের সঙ্গ পেয়ে আমার অস্বস্তি বোধ হতে লাগল। রথীন একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল। “দ্যাখো,” রথীন আবার কাশল, “আমি তোমার সঙ্গে আজ খুব খারাপ ব্যবহার করেছি।” (সে তুমি এখনও করছ, রথীন! তুমি হয়তো ভুলে গেছ, ‘তুমি’ কখনও বলতে না। তোমার মনে আছে কি-না জানিনে, আমি তোমাকে ‘আপনি’ বলেছিলাম। তুমি তখনই হেসে আমার কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়েছিলে, বলেছিলে, “আপনি কী রে? একসঙ্গে কাজ করতে হবে আমাদের, কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়াই করতে হবে, ওসব আপনি-আজ্ঞে চলবে না। আমরা মজুর। সর্বহারা। প্রোলেটারিয়েট। মধ্যবিত্তের নকল গন্ধ মুছে ফেলতে হবে। রথীন বলবি আমাকে, রথীন। তোমার আমার বয়েসের তফাত অনেক ছিল রথীন, তুমি এক ঝাপটায় তা ঘুচিয়ে দিয়েছিলে। আমি তোমাকে তুই কখনও বলতে পারিনি, তবে রথীন না বলে পারি নি। তুমি তুই থেকে এখন তুমিতে চলে গেছ। এটা কি তোমার সুব্যবহার?) “আমি,” আবার কাশল রথীন, “ক্ষমা চাইছি, মাফ চাইতেই এসেছি।” (তুমি আবার ভদ্রতা করতে এসেছ, রথীন। কেন, তা আমি জানি। তুমি জানতে, তুমি জানো, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক এত ঘনিষ্ঠ, এত অন্তরঙ্গ, আমাদের বন্ধুত্ব এত পাকা, ভালবাসা, হ্যাঁ রথীন, আমাদের ভালবাসা এত গভীর যে, এক দিনের বৈঠকি তকরারে তা মিটে যাওয়া শক্ত। তুমি জানো, তা মিটে যাবে না; তাই নিজে এগিয়ে এসেছ নিজ হাতে তা মিটিয়ে দিতে। তাই ভদ্র সম্বোধনের দ্বারস্থ হয়েছ, তুই ছেড়ে তুমি বলছ। তাই ভদ্র ব্যবহার আশ্রয় করছ। ঘটা করে ক্ষমা চাইছ। কিন্তু তুমি যা চাইছ রথীন, তা হবে না। আমাদের সম্পর্ক ঘোচাতে তুমি পারবে না, তা সে যত চেষ্টাই করো। কী তুমি ঘোচাবে, রথীন? আমি তো তোমার পুত্র নই যে, ত্যাজ্যপুত্তুর করবে—তোমার অন্নে প্রতিপালিত ভাই নই যে, আশ্রয়চ্যুত করবে—তোমার মহাজন নই যে, দেনা শোধ করে সম্পর্ক ঘুচিয়ে দেবে। তোমার আমার সম্পর্ক ভালবাসায় গড়া। আর ভালবাসায় ত্যাগ করার স্থান নেই, গ্রহণ ছাড়া আর কিছু করা যায় না। তুমি ভালবাসা চাও না, অধিকার চাও। অধিকারে আমার রুচি নেই। ভালবাসাই আমার ভরসা।) “আমি জানি, আমি বুঝতে পেরেছি,” রথীন ইতস্তত করতে লাগল, “কাজটা ঘোরতর অন্যায় হয়েছে। এবারের মত আমায় মাফ করো। (রথীনের স্বরে পুরনো উষ্ণতা ফিরে আসছে। আমি জানি, তা আসবে, আসতেই হবে।) দেখিস (অনুতাপ ঝরে পড়ল), দেখে নিস, আর কখনও হবে না! 

“কেন যে মাথাটা তখন গরম হয়ে গেল, বোকার মত তোকে গালমন্দ করলাম! তোর মনে খুব লেগেছে, আমি জানি। আমাকে এইবারের মত তুই মাফ করে দে।” রথীন ব্যগ্রভাবে আমার হাত চেপে ধরল। “আমি অনেকক্ষণ এসেছি। রসময়বাবু ছিল তাই আসতে পারিনি। (রসময়বাবুর কথা তা হলে তোমার কানে গিয়েছে, রথীন!) বাসায় এতক্ষণ তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। (কোথায় অপেক্ষা করছিলে বললে? তোমার বাসায়?) তুই যখন এলি না, তখন আমার ভয় হল। বউকে সব কথা খুলে বললাম। বউ বলল, তা হলে ওকে নিয়ে এসো গিয়ে, নইলে ও কিছুতেই আসবে না। (তোমার বউ ঠিকই ধরেছে রথীন, তোমার বাসায় আমি আর যাব না, যাওয়া উচিত হবে না।) শোন—চল, বাসায় চল। আমার এগারোটায় ডিউটি। বেরোতে হবে আমাকে। 

“শোনো রথীন, তোমার সঙ্গে আমারও কিছু কথা আছে।”

“বেশ তো, বাসায় গিয়েই বলিস!” আমি যেন অবুঝ বালক, নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলাম, খবর পেয়ে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে—ওর ভাবখানা এই আমার হাসি পেল। 

“এসব কথা বাসায় বসে আলোচনা করা যাবে না। এখানেই ভাল।”

“বেশ তো, তবে কালই বলিস!” রথীন অসহিষ্ণু হয়ে উঠল, “তুই কি চাস, ডিউটি ফেল করে আমি চার্জশিট খাই!” 

“না, নিশ্চয়ই তা চাই না, তবে 

“আবার তবে কী?” রথীন এতক্ষণে হেসে উঠল, হাল্কা গলায় বলল, “তবে এখন চল। আমার হাতে আর সময় বেশি নেই। ‘ 

আমি মরিয়া হয়ে বলে উঠলাম, “তোমার সংসারে আমি আর অশান্তির সৃষ্টি করতে চাইনে, রথীন—ওখানে আমার না যাওয়াই ভাল!” 

রথীন উঠে দাঁড়িয়েছিল। এবার ধপাস করে বসে পড়ল। অবাক হয়ে বলল, “কী বললি, তুই গেলে আমার সংসারে অশান্তি হবে!” 

বললাম, “রসময়বাবু কী বলে গেলেন, শুনেছ?” 

রথীন আবার খেপে গেল। “শুনেছি। কী বলতে চাস, তাও বুঝেছি। তুই আজকাল দেখছি রসময়ের কথায় বড্ড বেশি কান দিচ্ছিস! মিটিং-এও দেখলাম, এখনও দেখছি। শুধু বুঝতে পারছিনে, সব ব্যাপারে রসময়বাবু নাক গলাচ্ছেন কেন? আমাদেরই বা রসময়বাবুর কথায় উঠতে-বসতে হবে কেন? আমরা ওর বাপের খাই, না পরি?” একটু থেমে রথীন বলল, “রসময়বাবুর মতলব ভাল নয়। আমাদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে উনি রস চুষতে চাইছেন। ইউনিয়নে ফাটল ধরাতে চাইছেন। তোর-আমার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইছেন। ওএফেয়ার কমিটির চেয়ারম্যানের পদটি ওঁকে দেবার প্রতিশ্রুতি পেলে উনি কমিউনিস্টদের সঙ্গে হাত মেলাতেও রাজি আছেন। এ সবই আমি জানি। যাক, এসব ব্যাপারে আর একদিন আলোচনা করা যাবে। এখন আমার সময় নেই। আচ্ছা, তোকে এখন একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, পরিষ্কার জবাব দিবি?” 

রথীন আমার উত্তরের আশায় চুপ করে প্রতীক্ষা করতে লাগল। 

“দেব।”

রথীন বলল, “তুই আমার বউকে ভালবাসিস?” 

“বাসি।”

“এমন কাজ তুই কখনও করবি কি, যাতে আমার বউয়ের নজরে তুই ছোট হয়ে যাস?” 

“না।” 

“আমার বউকে আমিও ভালবাসি। আমিও চাইনে, আমার বউ আমাকে ছোট নজরে দেখুক।” রথীন আন্তরিকভাবে বলল, “তোকে না নিয়ে যেতে পারলে আমি বউয়ের কাছে চিরকালের মত ছোট হয়ে যাব। কারণ, আমার সন্দেহ, বউও এইরকম একটা কিছু ধরে নিয়েছে। তুই কি চাস, আমি ওর কাছে ছোট হয়ে যাই?” এ যেন অন্তিম আবেদন! আমি অমান্য করতে পারলাম না বটে, তবে রথীনের কাছ থেকে কথা আদায় করে নিলাম, এ বিষয়ে পরদিনই একটা বোঝাপড়া করে নিতে হবে। অশান্তি হবে না—এ কথা ও মুখে যত জোরেই বলুক, ওর কাজে তার উল্টো পরিচয়ই পাওয়া যাবে কেন? (কেন তুমি বউকে মারো? সেদিন রাত্রে চোরের মত কী দেখতে এসেছিলে? কেন সে রাতে ঘরের ভিতরে ঢোকোনি?) কেন তার মেজাজ এমন বিগড়ে যাচ্ছে? এর পরিষ্কার জবাব আমাকে পেতে হবে। ওর মুখোমুখি আমাকে দাঁড়াতে হবে। 

রাত্রে রথীনের বউকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “আচ্ছা, তুমি কাকে বেশি ভালবাসো? আমাকে, না রথীনকে?” 

“কেন বলো তো?” ও একটু অবাক হল। “সেদিন ও-ও এ কথা জিজ্ঞাসা করছিল।”

আমি হেসে ফেললাম। “তা তুমি ওকে কী বললে?” 

“বললাম, ওকেই বেশি ভালবাসি।” ও হাসল। 

“এখন কী বলবে?” 

“বলব, তোমাকেই বেশি ভালবাসি। 

“কিন্তু আসলে কাকে বেশি ভালবাসো?” 

“তোমরা বড় বোকা! কিচ্ছু বঝতে পারো না!” 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *