মনের বাঘ – ২

দ্বিতীয় অংশ 

“দি ওল্ড ম্যান ওআজ লাইং অন হিজ বেড। হি ওআজ ডাইং।” রঙ্গচারী বলেছিল, “তিনি যে মরবেন, এ কথা আমরা জানতাম, আমার পাঁচ দাদা জানতেন, আমার মা জানতেন, এমন কি ওল্ড ম্যান নিজেও জানতেন। বাবা জানতেন, বাবার মৃত্যুকাল ঘনিয়ে এসেছে। তাঁকে যে তাঁর রক্ষিতার বিছানা থেকে সরিয়ে আনা হয়েছে, আনতে পারা গিয়েছে, এজন্যে আমার মাকে খুবই উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। বাবা যে মরছেন, মা’র সেজন্য একটুও দুঃখ হচ্ছিল না। মা বরং খুশি। মা যেন দশ বছর ধরে ক্রমাগত পরাজয় বরণ করার পর এই শেষ বছরে উইল্ডন টেনিসের টুর্নামেন্টে সিঙ্গল্সের বিজয়িনী হয়েছেন। তিনি তেমনি খুশি। ট্রফিটা তাঁর চরম প্রতিদ্বন্দ্বীর হাত-ছাড়া হয়েছে। এখন তাঁর হাতে এসেছে। তাঁর অধিকারে। ঐ যে, আমাদের পারিবারিক খাটে তা শুয়ে আছে। এ ভি এন কে রঙ্গচারী। ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, ছয় পুত্রের জনক, অসুস্থ, কোপনস্বভাবা ঈর্ষাকাতর এক নারীর স্বামী, প্রাক্তন এক দেবদাসীর জার। এ গ্যাপিং ডাইং ওল্ড ম্যান, এ ট্রফি।”

রঙ্গচারী বলেছিল, “আমার বয়স তখন মাত্র পনের। আই অ্যাম দি ইয়ংগেস্ট সন অব দি ফ্যামিলি। পনের বছর কেটে গিয়েছে তারপর। কিন্তু ঘটনাটা যেন কালকের, এমন তাজা— আমার চোখে, আমার মনে। কোনও ডিটেল্‌স্‌ই আমি মিস করিনি। আমার চোখ যেন মুভি ক্যামেরা। আমি যেন একখানা ডকুমেন্টারি তুলছি। আমি পুবের জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দক্ষিণের জানলার বাইরে সমুদ্র। সমুদ্র গর্জন করছিল। ঢেউগুলো বাহু বাড়িয়ে বাবাকে লুফে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। অ্যাণ্ড হি ওআজ লাইং স্টিল অন এ লার্জ বেড হোয়ার হি অফ্ রেড্ এ রিকেটি ক্যাট—মাই মাদার।” রঙ্গচারীর টলটলে চোখ সেই রাত্রে তার আত্মকাহিনীকে কেমন যেন এক সজীবতা দিয়েছিল। তার অনর্গল বাক্-ভঙ্গিতে জোরালো ছবি ফুটে উঠছিল। “দে নেভার লাভড্ ইচ আদার। প্রেম তাঁদের মধ্যে ছিল না। তবু সংগমে তাঁরা বিরতি দেননি। এবং প্রতিটি রাত্রি তাঁদের দিয়েছে তিক্ততা, অসন্তোষ আর ঘৃণা। যে বিছানার বিক্ষুব্ধ সংগ্রাম ছটি পুত্রের জন্ম দিয়েছে, পরিমাপহীন ঘৃণার জন্ম দিয়েছে, যে ঘৃণা কোনও ওজনেই মাপা যায় না, সেই শয্যার অনাবশ্যক বিপুল বিস্তারে আজ কত শান্তি। আমার কাঁধের উপর দিয়ে, চুলের উপর দিয়ে সূর্য থেকে নবীন রশ্মির অজস্র ধারা এসে বাবার মেদগ্রস্ত মুখে, মাথায়, গায়ে, কাঞ্চীপুরমে প্রস্তুত জরিদার অশ্লীল রেশমের আচ্ছাদনে, এক পাল গোঁয়ার ভেড়ার মত অব্যাহত গতিতে লাফিয়ে পড়ছিল। বাবার মুখখানাকে ঠিক যেন বিলাসী লম্পট কোনও রোমক নৃপতির মেক-আপ বলে মনে হচ্ছিল। হি ওআজ গ্যাপিং, হি ওআজ ওয়েটিং ভেরি পেশেন্টলি। তাঁর এই শান্ত প্রতীক্ষা তাঁকে অসাধারণ এক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল তখন। 

“চারিত্রে তিনি অস্থির তরঙ্গ। বরাবর তিনি চিতার মত ছটফটে। রাজনীতিতে, ব্যবসায়ে, আহারে, মৈথুনে তিনি কখনওই ধৈর্য রাখতে পারেননি। তিনি লোককে নিমন্ত্রণ করেছেন, অভ্যাগত আসতে দেরি করেছে, তিনি বিরক্ত হয়ে খেতে বসে গিয়েছেন। এই অস্থিরতা তাঁকে সাফল্য দিয়েছিল। তাঁর অনেক উচ্চাভিলাষ ব্যর্থ ও করে দিয়েছে। তিনি মুখ্যমন্ত্রী হতে পারেননি, পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভাপতিকে তিনি অপমান করেছিলেন। কিন্তু রাজ্যের সমগ্র রাজনীতি তিনি মুঠোর মধ্যে রেখেছিলেন। এ রাজ্যের তিন-চতুর্থাংশ শিল্পের উপর তিনি কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিলেন। তিনি ছিলেন ধূর্ত ব্রাহ্মণ। কট্টর আচারনিষ্ঠ (তাঁর রক্ষিতাটি ছিল শূদ্রাণী)। এখন, তিনি প্রশান্ত, অতিশয় শান্ত, নিস্তরঙ্গ চৌবাচ্চার জল। 

“হি ওআজ ওয়েটিং—মুদ্রিত-নেত্র, সমাহিত, প্রতীক্ষারত। সেই ঘরে এখন অপরিসীম ব্যস্ততা। আমার মা, দাদারা, ডাক্তার, অ্যাটর্নি, কুলপুরোহিত—সবাই ব্যস্ত। আমার মা, বিজয়িনীর দর্পে, চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বাবাকে তাঁর রক্ষিতার হাত থেকে ছিনিয়ে আপন কুক্ষিতে এনে ফেলেছেন। শূদ্রাণীর স্পর্শদোষ এখন ঘোচাতে হবে, পুরোহিতের সঙ্গে স্বস্ত্যয়নের পরামর্শ চলছে। বাবা তাঁর উইলে তাঁর রক্ষিতাকে সম্পত্তির অংশ দিয়েছিলেন—সে উইল বদলানো হয়েছে দাদাদের আর মা’র পরামর্শে এখন তাতে বাবার ‘সজ্ঞান স্বাক্ষর নিতে হবে। দাদারা অ্যাটর্নির সঙ্গে, ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শে ব্যস্ত। প্রত্যেকেই ভাবিত, ব্যস্ত, ষড়যন্ত্ররত। একমাত্র তিনিই শুধু নিশ্চিন্ত। এসবে তাঁরই একমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। তাঁরই কিছু যায়-আসে না। হি ওআজ ভেরি কাম, ভেরি ভেরি পেশেন্ট অ্যাণ্ড উইথ পয়েজ অ্যাণ্ড প্রোফাউণ্ড ডিগ্‌নিটি হি ওআজ লাইং, ডাইং অ্যাণ্ড ওয়েটিং, অ্যাণ্ড পাহাাপ্‌স্ এপেক্‌টিং… 

“কার জন্য, কিসের জন্য তাঁর এই প্রশান্ত প্রতীক্ষা? শেষ স্বাক্ষরের? শমনের? তাঁর রক্ষিতার? আমার এই কৌতূহল কোনওদিনই চরিতার্থ হবে না। হি লেফ্‌ট্ নো হিণ্ট। আমি এ খবরটা জানতাম যে, বাবার রক্ষিতাকে বাবারই তৈরি এই বাড়ির পবিত্র চৌহদ্দির মধ্যে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। হবে না। সে সদর ফটকে তখন মাথা ঠুকছিল। বাবাকে শেষবারের মত একবার দেখার জন্য সে দারোয়ানের পা ধরে অনুনয় করছিল। দারোয়ান তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিল। আমার মা’র নির্দেশ। আমার দাদারা দু’ দিন থেকে বাবাকে নিয়ে এত ব্যস্ত ছিল, এইরকম একটা ঘটনার সম্ভাবনা তাদের মনেই হয়নি। মা’র মনে ছিল। প্রখর দৃষ্টি ছিল মায়ের। উইলের কথাও মা-ই মনে করে দিয়েছিলেন। বাবার অন্তরঙ্গ বন্ধু, অ্যাটর্নিকে ডাকিয়ে এনে, কেঁদে, ভয় দেখিয়ে, এবং শেষ পর্যন্ত ব্ল্যাকমেল করে, উইলের খবর ফাঁস করে ফেলেছিলেন এবং মা’র জেদেই উইল বদলাবার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। মা চাণক্যের মতই প্রতিহিংসাপরায়ণ। এবং মাকে দেখেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে, কৌটিল্য চাণক্য আমার মাতৃকূলেরই কোনও পূর্বপুরুষ। 

“আমার বড়দাকে বাবা একবার ত্যাজ্যপুত্র করতে গিয়েছিলেন। উপায়ান্তর না দেখে এই ব্রাহ্মণকুলতিলক সেই শূদ্রাণীর পা ধরে কেঁদেছিল, মা বলে ডেকেছিল এবং সন্তানের কাঙাল সেই রমণীর পুত্র হবে বলে পৈতে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল। বাবা তাঁর রক্ষিতার অনুরোধ রেখেছিলেন। এবং দাদা, যতদিন বাবা খাড়া ছিলেন, মা’র আপত্তি সত্ত্বেও ‘নতুন মা’র পিছনে খুব ঘোরাঘুরি করেছে। এখন সে মা’র ক্ষমতার কাছে দাসখত লিখে দিয়েছে। এই দারোয়ান একবার টাকা চুরি করেছিল। মা একে তাড়িয়ে দিয়েছিল। বাবার এই রক্ষিতার পায়ে ধরে সে চাকরি ফিরে পেয়েছিল। মা সেই দারোয়ানকেই কাজে লাগিয়েছিলেন। অ্যাণ্ড ভেরি ফেলি হি ডিচার্জড্ হিজ ডিউটিস। 

“অ্যাণ্ড ডু ইউ নো, হোআট আই ডিড? দি ফানিয়েস্ট থিং ইন মাই লাইফ। আমি রাস্তা থেকে তার রক্তাক্ত দেহটি কুড়িয়ে নিই। তার কপালের গভীর ক্ষত থেকে একটা মোটা ঘন রক্তের ধারা গাল বেয়ে, থুতনি বেয়ে বুকের কাপড়ে টপটপ করে ঝরে পড়ছিল। ঠিক যেন একটা অসমাপ্ত ইরিগেশান ক্যানেল! খিড়কির দরজা দিয়ে অ্যাটাচ্‌ড্ বাথরুমের ভিতর দিয়ে তাকে বাবার কাছে পৌঁছে দিই। হোআট এ সিন, ম্যান, হোআট এ ক্লাইম্যাক্‌স্‌ অব দি হোল শো। মা, দাদারা, অ্যাটর্নি, ডাক্তার, কুল-পুরোহিত—সবাই যেন ভূত দেখল। মার বুক চিরে বিস্ময়, দাদাদের মুখ ফুটে বিমূঢ়তা, আর অন্যেরা যেন ক্লাউন। কোনও পেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রীর মুখে আমি এমন ভিভিড অভিব্যক্তি দেখিনি। ততক্ষণে সেই আহত রক্তাক্ত নারী বাবার বুকে গিয়ে নির্ভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার কপালের গালের রক্ত বাবার ফোলা ফোলা মুখের লালসাগ্রস্ত রোমক নৃপতির মেক-আপে সুন্দর এক পবিত্রতা মাখিয়ে দিল। অ্যাণ্ড হি ডায়েড উইথ এ ডিপ সাই। তাঁর বুকের উপর থেকে এই প্রথম শোকের ক্রন্দন আমাদের বাড়ির বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু ঘর ভরে যাবার আগেই সেই শোকের উৎসকে মার নির্দেশে দাদারা সবলে বাবার বুক থেকে উৎপাটিত করে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে এল—অ্যাজ দি বুচার্স রিমুভ দি লাংস্ অব এ ডেড গোট অ্যান্ড জাস্ট্ থ্রো ইট।”

*

“আমি যে মেয়েলোকের সংসর্গ সহ্য করতে পারি নে,” রঙ্গচারী বলেছিল, “তার কারণ আমার মাদার কমপ্লেক্‌স্। অ্যাণ্ড আই থিংক্, মাই ফাদার্স টু উইমেন- হ্যাড্ অ্যান ইকুয়াল হ্যাণ্ড অন ইট। ফর দি ফরমার, হুজ উম পার্সেড্ মি টু দিস ওআলড্‌, আই হ্যাড এ গ্রেট কনটেম্‌পট; ফর দি ল্যাটার, আই হ্যাড ওলি কম্‌প্যাশন।”

“কটে অ্যান্ড কম্প্যাশন”- রঙ্গচারী এক চিঠিতে লিখেছিল, “দিজ আর দি টু ব্রাভ্স অব দি মোস্ট এফেক্টিভ ইন্‌সেক্‌টিসাইস্‌, বোথ কিল দি জাস্ অব লাভ।”

রঙ্গচারীর আর একখানা চিঠির আরম্ভ : “মেয়েদের দেখলে হয় আমার ঘৃণা হয়, নয় মনে করুশা জাগে। মনের এই দুটো বৃত্তিই প্রেম বা প্যাশন-এর পক্ষে মারাত্মক। আমার জগৎ দুই মেরুতে বিভক্ত—ঘৃণা আর করুণা আমার জীবনে দুইটি মাত্ৰ ঋতু—ঘৃণা আর করুণা। আমার চোখে দুটো মাত্র রং- কালো আর ধূসর—ঘৃণা আর করুণা।”

“মাতৃস্নেহ কাকে বলে, আমি জানি না (রঙ্গচারী একদিন বলেছিল)— মাতৃভক্তি কী, তাও না। বোথ অব আস— মাই মাদার অ্যাণ্ড মাইসেলফ্—আর গিলটি অব পারজুরি। মনুষ্যধর্মের নামে হলফ করিতেছি, অদ্য হইতে আমার গর্ভজ শিশুটিকে স্তন্যদানে লালন করিব, পরম স্নেহে পালন করিব, ভালবাসিব। মনুষ্যধর্মের নামে হলফ করিতেছি, আমার গর্ভধারিণীকে ভক্তি করিব, স্বর্গাদপি গরীয়সী জ্ঞান করিব, ভালবাসিব। এ শপথ কেউ মানিনি। আমরা দুজনেই মিথ্যে হলফ নিয়েছিলাম। মা আমাকে স্তন্যদান করে লালন করেননি, বেবি-ফুড আর ফিডিং বলের নি চুষে আমি মানুষ। মা আমাকে কখনওই স্নেহ করেননি। তাঁর হৃদয়ে ছিল ঘৃণা—বাবার প্রতি, দাদাদের প্রতি, আমার প্রতি। বিশেষ করে আমার প্রতি, কারণ আমার অবয়বে বাবার পরিচয় অধিকতর স্পষ্ট। আমি কখনওই আমার মাকে ভক্তি করিনি, ভালবাসিনি। দুজনেই হলফ ভেঙেছি। বাবার মৃত্যুর পর মা’র প্রবল কর্তৃত্বের পায়ে আমার পাঁচ দাদা আত্মবিক্রয় করেছিল। বাবার রক্ষিতাকে সম্পত্তির অধিকারচ্যুত করার যে চক্রান্ত মা’র নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল, তার বিরুদ্ধে আমিই একা সংগ্রাম করেছিলাম। দ্যা হোআই মাই মাদার কিড্ মি আউট অব মাই ইনহেরিটেন্‌স্। আর সেজন্য তাঁর মনে কোন ক্ষোভও নেই। 

“আমার বাবার রক্ষিতা আমাকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে তার আশ্রয়ে নিয়ে যায়। আমাদের দুজনের মধ্যে অপার করুণার এক নিবিড় বন্ধন গড়ে ওঠে। নানা মিঅ্যাডভেঞ্চারে তার শেষ সম্বল আমি উড়িয়ে দিয়ে তাকে পথের ভিখারি করে ছেড়ে দিয়েছি। ইন রিটার্ন, হোআট শি ডিড? প্রশ্রয় দিয়ে, করুণা দিয়ে আমাকে একটি গল্পভুক্ত কপিখ করে দিয়েছে। আই ওআজ হার ক্যাপটিভ ফর টেন ইআস্ রঙ্গচারী, রঙ্গচারী, ইউ আর মাই সন, মাই সন, মাই সন। এক বন্ধ্যা মরুভূমি মেঘের ছায়া দিয়ে ওয়েসিস রচনা করতে চাইছে। ফানি, ইজ ইট? (“রঙ্গচারী, রঙ্গচারী, নী এন মহন, মহন, মহন।’ রঙ্গচারী তার মাতৃভাষায় আবৃত্তি করল, ‘মহন, মহন, মহন…মাই সন, মাই সন, মাই সন।) জাস্ট থিংক অব ইট, ম্যান। অ্যান্ড আই প্লেড হার সন ফর ইআর। দেন শি ডায়েড অ্যান্ড আই গট মাই ফ্রিডম, গট ব্যাক মাই ওন সেলফ্। নাও—” রঙ্গচারী তার গেলাসে চুমুক দিল। তার ভারী গলায় বেজে উঠল, “আই কেয়ার ফর নোবডি অ্যাণ্ড নোবডি কেয়ারস্ ফর মি। আমার হৃদয়ে আছে মাত্র করুণা আর ঘৃণা। আই ডোন্ট লাভ উইমেন, আই কান্ট।”

কিন্তু এই রঙ্গচারীই আমাকে দু’ মাস পরে চিঠি লিখেছিল : 

জাস্ট ইম্যাজিন হোয়ার আই অ্যাম? কোথায় থাকতে পারি, ধরমকোট ছাড়া। অকস্মাৎ আমি আবিষ্কার করেছি, পৃথিবীতে একটি মাত্র মেয়ে আছে, যাকে আমি সহজে গ্রহণ করতে পারি। সুশীলা—এই একটি মাত্র নাম, আমার কাছে যা সাত রাজার ধন। তুমি কি হাসছ? আমি কি খুব ভাবপ্রবণ হয়ে পড়ছি? দুত্তোর ছাই, লুকিয়ে লাভ নেই, আর পাঁয়তারা কষাই বা কেন? আমি ওকে ভালবেসেছি। সম্ভবত আমি মরেছি। আমার মনে, কবে তার সূত্রপাত জানিনে, এক নতুন অনুভূতির জন্ম হয়েছে, অ্যাজ ইফ এ নিউ টুথ ক্রপড্ আপ সেই নতুন দাঁতের শুলুনিতে অস্থির হয়ে উঠেছি। ছুটে এখানে চলে এসেছি কারণ আমার চলার গন্তব্য এইখানেই। অল রোড্‌স্ অব মাই ওআর্ড টার্মিনেট হিয়ার। সুশীলার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তাকে বলেছি, স্ট্রেট, আমি তাকে ভালবাসি। সে আমাকে বলেছে, স্ট্রেট, সে অন্য একজনকে ভালবাসে। আপাতত, প্রথম রাউণ্ডের এই খেলায় স্ট্রেট সেটে আমি হেরেছি এবং লাভ গেমে। বাট লাভ ইজ নট এ নক-আউট টুর্নামেন্ট! সো আমি অ্যাম নট ডিফিটেড। আই অ্যাম নট ফ্রাস্ট্রেটেড। কারণ, যদি হারিও, এ পরাজয়েও আনন্দ আছে। আই অ্যাম হ্যাপি, ম্যান—ভেরি হ্যাপি। আই হোপ আই উইল মেক ইট।…

রঙ্গচারীর আর একখানা চিঠি (এক সপ্তাহ পরে) : 

আশা করি আমার ঠিকানা পরিবর্তন লক্ষ করেছ। কী, অবাক হচ্ছ তো? এত তাড়াতাড়ি সুশীলার ‘কেয়ার অব-এ কী করে এলাম, সে কথা ভাবছ? এর মধ্যে কোনও রহস্য নেই। প্রকৃতপক্ষে মূল পরিবর্তনও কিছু হয়নি। সুশীলার কেয়ার অব-এ আমার পোস্টাল অ্যাড্রেসটাই আশ্রয় নিয়েছে। আর আমি? আই অ্যাম মেণ্টেনিং দি সেম ডিস্ট্যান্স। আমি আর সুশীলা অলিম্পিকের সুদীর্ঘ ম্যারাথন রেসে যেন নাম দিয়েছি। শি ইজ রানিং জাস্ট বিফোর মি। আমার প্রসারিত বাহুর নাগালের দু ইঞ্চি তফাতে মাত্র। কিন্তু সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও এই সামান্যতম ব্যবধান আমি ঘোচাতে পারছিনে। শি ইজ মেণ্টেনিং দি ডিস্ট্যান্স উইদাউট এনি স্ট্রেন। কী আশ্চর্য সাবলীলতায় সুশীলা এই ব্যবধান রক্ষা করে চলেছে! 

আমি আমার পোস্টাল অ্যাড্রেসকে এখন মাঝে মাঝে ঈর্ষা করতে শুরু করেছি। ওটা কত সহজে এগিয়ে যেতে পারে! এখানে ফিরে এসে সরকারি আতিথ্য বেসরকারিভাবে প্রথম দিন কতক পেয়েছিলাম। অল অব দেম রেড মাই স্টোরি- দ্যাট আন্‌মিটিগেটেড স্ক্যাণ্ডাল। আমার চিফের মতই এরা সেটা রেলিশ করেছে—অ্যাজ দি বার্মিজ রেলিশ ভাগ্নি। ওরা তাই আমার উপর খুব খুশি। বাই দি বাই, আমার চিফও ফর দি ফার্স্ট টাইম আমার উপর খুশি হয়ে উঠেছেন। দ্যাট বাগার আমায় একদিন কী বলল, জানো? বলল, “রঙ্গচারী, আই অলওয়েজ নিউ ইউ কুড ডু ওয়েল ইফ ইউ ওআটেড টু। তখন আমার কী মনে হয়েছিল, জানো? আই মোস্ট সিন্‌সিয়ারলি ফেল্ট ফর হিজ পুড়ল্। ও দ্যাট পুওর সোল, আই ডিপ্রাইভড্ হার অব হার ডিউ।”

অ্যাণ্ড দ্যাট আই ডিড অ্যাট দি কস্ট অব সুশীলা। জানো, এই প্রথম আই গেভ মাই হার্ট অ্যাণ্ড মাই সোল টু মাই কম্পোজিশন। আমার রচনার সঙ্গে আমি একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম। আসলে আমি সুশীলার সঙ্গেই একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম। আমার কলমের কালিতে (প্রথমে আমি টাইপ-রাইটারেই বসেছিলাম, কিন্তু ‘বাই আওআর স্টাফ রিপোর্টার’…’আওআর স্পেশ্যাল করেস্পন্ডেন্ট লেট্‌লি ইন-এর বেশি আর কিছুতেই এগুতে পারলাম না। দু-দুটো প্যাড নষ্ট করলাম, এক টিন সিগারেট, একটা দেশলাই..দেন আই গট দি স্টার্ট, দি মোমেন্ট আই পিক্‌ড় আপ মাই পেন) সুশীলার গায়ে কলঙ্ক ছুঁড়তে আমার এমন প্রেরণা এসে গেল যে, আমার রচনার মধ্যে আমি ডুবে গেলাম। আসলে, এখন মনে হচ্ছে, সুশীলার সত্তার মধ্যেই আমি ডুব দিয়েছিলাম। আর সেই মুহূর্তে আমি অনুভব করলাম, আমার সত্তার কত গভীরে সুশীলার অস্তিত্ব প্রোথিত হয়ে গিয়েছে। একটা প্রবল উল্লাস, এ নিউ এবিং, একটা আনকোরা সেনসেশন, অ্যান আননোন প্যাংগ্ অব জয় আমার নাভার্স স্টিম্যুলিকে নাড়া দিতে লাগল। অ্যাণ্ড মাই সেন্টেন্সেস বিগ্যান টু উজ স্পন্টেনিয়াসলি লাইক ব্লাড ফ্রম এ গেপিং উণ্ড। আই কুড্ আপ দি মোস্ট ডিলিসাস স্টোরি – দি ফডার ফর এ মোস্ট সেনসেশন্যাল হেডলাইন। এ ভিভিড স্পাইসি স্টোরি, এ সসি স্ক্যাণ্ডাল, হুইচ মাস্ট হ্যাভ বিন স্টিম্যুলেটেড দি ইরিটেশনস্ অব মাই চিফ্স্ ভাইটাল অর্গ্যান। তার বিনিময়ে দু মাসের ছুটি নিয়ে—ফর এ চেঞ্জ টু রিকুপ মাই হেলথ্—সুশীলার কাছে এসেছি। আই লাভ হার, ম্যান—আই থিংক্ আই লাভড় হার ফ্রম দি ভেরি বিগিনিং অব মাই লাইফ, ফ্রম দি ভেরি ভেরি বিগিনিং অব দি ক্রিয়েশন। অ্যাণ্ড গড ক্রিয়েটেড উত্তম্যান টু লাভ, টু বি লাভড় বাই হার। 

তাই আমি এখানে এসেছি। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বাহির দুয়ারেই বসে আছি। না, বসে নেই, ছুটছি, প্রাণপণে ছুটছি। সুশীলা ছুটছে আমার আগে আগে, সামান্য আগে, আমার নাগালের দু ইঞ্চি মাত্র ব্যবধানে; কিন্তু হায়, এই সামান্য ফাঁকটুকুর মধ্যেই বিরাজ করছে এক প্রশান্ত মহাসাগর। 

মর্ত্য ও অমৃতলোকের মধ্যে অতি অল্পই ব্যবধান (রঙ্গচারী লিখেছিল)—দু ইঞ্চি মাত্র। কিন্তু মানুষের মস্তিষ্ক আজ পর্যন্ত এমন কোনও যন্ত্র আবিষ্কার করতে পারেনি যা মর্ত্যলোকের সীমানা অতিক্রম করে অমৃতলোকের আঙিনায় প্রবেশ করতে পারে। যদি তা পারত তবে আই উড হ্যাভ বিন দি ফার্স্ট ভলেন্টিয়ার টু পাইলট দ্যাট মেশিন তবে আমার কাজ সহজ হত, দৌড়বাজির এই ইটারন্যাল প্রতিযোগিতার পরিসমাপ্তি ঘটত, আমি সুশীলার নাগাল পেতাম। আমার সব থেকে বড় হ্যাণ্ডিক্যাপ কী, জানো?—আই অ্যাম এ মটাল বিইং। আর সুশীলা? অ্যান ইম্‌টাল, অমৃতলোকবাসিনী। হাউ ক্যান আই রিচ হার, ম্যান? 

ভেবো না আমি ফিলসফি কপচাচ্ছি। এই অরণ্যে বুঁদ হয়ে ফিলসফির চর্চা যে করে করুক—অ্যাট লিস্ট ইউ নো, আই অ্যাম নট দ্যাট সর্ট। মুংরির বাড়ির গোয়ালের মাচায় আমি বাস করছি। এখানকার মশা-মাছির উৎপাতে সতত অতিষ্ঠ। নাউ আই অ্যাম এ প্রবলেম চাইন্ড টু এভরিবডি হিয়ার। অফিসারেরা এখন সদা সশঙ্ক। দে আর অ্যাফ্রেড অব মি। আমার মতলব তারা টের পাচ্ছে না, এই অরণ্যে একটা আদিবাসীর বাড়িতে আমি রট করছি কেন, তার কারণ তারা বের করতে পারছে না। তারা বিলক্ষণ ভাবিত হয়ে পড়েছে। সুশীলা আমার মতলব জানে। সেও তার উৎকণ্ঠা লুকিয়ে রাখতে পারছে না। সেও যেন ভাবিত। এ কথা তোমাকে জানালাম এই কথাই বোঝাতে যে, ফিলসফির ভূত আমার ঘাড়ে চাপেনি। 

যতই দিন যাচ্ছে, বুঝতে পারছি, সুশীলা ইজ নট এ রিয়েল এক্‌জিটেন্স। অন্তত আমার কাছে। শি ইজ রিয়েল টু হার লাভার, শি ইজ রিয়েল টু দোজ হু সাপ্লায়েড মি উইথ দি ফল্স্ মেটিরিয়াল এগেস্ট্ হার, হু গেভ মি এ রং অ্যাণ্ড প্রেজুডি ব্যাগ্রাউণ্ড। শি ইজ রিয়েল, ভেরি রিয়েল টু দেম। কিন্তু আমার কাছে সে এক অশরীরী অস্তিত্ব। টু মি শি বিলংস্ টু দি আদার ওআর্ড। আমার আর সুশীলার মাঝখানে তাই দুরতিক্রম্য এক ব্যবধান। মর্ত্য ও অমরার মধ্যে ব্যবধান অতি সামান্যই। তবু দ্যাট গ্যাপ ইজ ইরিমুভেল্। বিটুইন শি অ্যাণ্ড মি দেয়ার লাইজ দিস সলিড গ্যাপ, এ স্পেস, উইথ নো বাউণ্ডারি, দি টাইম দ্যাট নেভার স্টপ্‌স্। হাউ ক্যান আই রিচ হার, ম্যান? 

কিন্তু আমি হার মানব না। দৌড় থামাব না। সাফল্য অসম্ভব জেনেও দৌড় থামাচ্ছি না! কে আমাকে এই বিষম দ্বৈরথে প্রতিনিবৃত্ত করবে! 

“আই উইল নট রেস্ট, ম্যান,” রঙ্গচারী তার শেষ চিঠিতে লিখেছিল, “আই উইল নট রেস্ট।”

.

“রঙ্গচারীর প্রেম ছিল অশান্ত ঝঞ্জা। ধাক্কায় ধাক্কায় আমাকে গুঁড়িয়ে ফেলেছিল প্রায়।” রঙ্গচারীর ডেথ সার্টিফিকেটখানা ওর আত্মীয়স্বজনের কাছে পাঠাতে অনুরোধ করে সুশীলা চিঠি লিখেছিল আমাকে। জানিয়েছিল, “কিন্তু ও জানত না, পাহাড়কে টু মেরে টলানো যায় না। রঙ্গচারী নিজেকে নিঃশেষ করে আমাকে অধিকার করেছে। বলরাম জানে, রঙ্গচারীকে এখন আমি ভালবেসে ফেলেছি। আমরা দুজনে ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলাম। আমি আমার ডাক্তারি বিদ্যা দিয়ে, বলরাম তার সেবা দিয়ে। কিন্তু রঙ্গচারী নিজের বলতে কিছুই রাখেনি। মরার আগে রঙ্গচারী বলেছিল, “কিস মি, সুশীলা; আই ওআন্ট এ রিয়েল কিস, নট এ ফ্যান্টম।” আমি তার ইচ্ছে পুরিয়েছি। সে খুশি হয়ে বলেছিল, “অ্যাট লাস্ট আই হ্যাভ ক্রসড্ দি বেরিয়ার, সুশীলা—দি লাস্ট টু ইঞ্চেস অব মাই লাইফ। আমি তোমার কাছে পৌঁছেছি, সুশীলা। অ্যাই হ্যাভ মেড ইট।” এই তার শেষ কথা। ‘দু ইঞ্চির’ হেঁয়ালি আমি বুঝতে পারিনি। আমি, রঙ্গচারী আর বলরাম—এই তিনজনে মিলে এখন আমরা দুজন হয়েছি!” 

সুশীলা তার সার্টিফিকেটে লিখেছিল; কে ভি কে রঙ্গচারী, হিন্দু মেল অব থার্টি-ওআন, ডায়েড অব এন্টেরিক ফিভার। 

আমি পুড়ছি। রঙ্গচারী লিখেছিল : আমি এখন পুড়ছি। সত্য বটে আমার ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে, বাট ম্যান, আমার আত্মাও পুড়ছে। আগুনের ধর্মই এই, সে পোড়ায়! সে শুধু আবর্জনাই পোড়ায় না। ফায়ার বাস্ এভরিথিং। তাই আমার প্রেম আমাকে শুধুই পোড়াচ্ছে। 

হামজা বলেছিল, প্রেম কখনও পোড়ায় না। প্রেমের শিখা আছে, তাপ নেই। প্রেম উজ্জ্বল করে। প্রেম দহন করে না। ঈষাই পোড়ায়। আর প্রেম আর ঈর্ষা একই মুদ্রার দুটো পিঠ। 

রথীন সরখেল কোনও কিছুই বলত না। তবে অনেকদিন পরে আমার মনে হয়েছিল, সব কিছুই ও লক্ষ করত। আমার এমনও মনে হয়েছে, এ যেন এক অন্য রথীন। গুরুদশার কালে রধীনের একমুখ দাড়ি-গোঁফ রুক্ষ কেশভার তাকে এক পৃথক ব্যক্তিতে প্রতিষ্ঠা করেছিল। এখন সে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। তার মুণ্ডিত মস্তক, তার কামানো গাল যেন কুমোরটুলির অসমাপ্ত মাটির মুণ্ড। তার দাড়ি-গোঁফ-চুলের সঙ্গে সঙ্গে তার পুরনো পরিচিত সত্তাটিরও যেন বিসর্জন হয়েছে। তার বদলে যে সত্তাটি রোপিত হয়েছে তা যেন দু’ পাটি নতুন বাঁধানো দাঁত। এখনও রপ্ত হয়নি। 

আজকাল রথীন কী যেন ভাবে ক্ষণে ক্ষণে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। তার বউয়ের (তার নাম কী? তার নাম কী? কিছুতেই আমার মনে পড়ে না। ঘষা কাচের আবরণের অন্তরাল থেকে সে কিছুতেই আর স্বচ্ছতায় আসে না।) প্রতি হঠাৎ সে মনোযোগ দিতে শুরু করেছে। 

রথীন এখন আর আমাকে তার নাইট ডিউটির সময় তার বাড়িতে যেতে বলে না। কারণ, সে জানে, আমি যাবই। নিজের গরজেই যাব। সত্যি বলতে কী, এখন আমি রধীন বেরিয়ে যাবার আগেই সেখানে যাই। রধীনের সামনে আমি অনেক সহজ। আমি ওকে ওর বউয়ের চাইতেও ভালবাসি। তখন আমাদের মধ্যে আড্ডা জমে ওঠে। হাসি, ঠাট্টা, গল্প। হো হো হাসিতে কোআর্টার ফেটে পড়ে। এক উদ্দীপনা আমাদের তিনজনকে দীপ্ত করে তোলে। আমরা তিনজন তিনটি তারার উজ্জ্বল মোজাইকে গড়া একখণ্ড আকাশ হয়ে উঠি। আমাদের তিনটি সত্তার তিনটি জটিল কুটিল বক্ররেখা এখন অস্তিত্বের একটি বিন্দুতে এসে মিলিত হয়। সেখানে আমরা অনায়াসে আশ্রয় পাই। আমি রথীনের খুব কাছে সরে যাই, রথীন তার বউয়ের খুব কাছে সরে যায়, রথীনের বউ (তার নাম কী? তার নাম কী?) আমার ঘনিষ্ঠতায় নিবিড় হয়ে আসে, তিনটি পৃথক সত্তা, তিনটি বিন্দু একই বিন্দুতে মিলিত হয়। একই বিন্দুতে পরিণত হয়। 

এই আশ্চর্য পরিণতির ঘটক রথীন নিজেই। সেই আমাকে ওর বাড়িতে নিয়ে ওঠায়। ওর মাতৃবিয়োগের পরের রাতে দুটি অ্যাটম একটি মলিকিউলে পরিণত হয়। রথীন তখনও নিজস্ব কক্ষপথে প্রবল বেগে ঘুরছে। আমার মনে আছে পাপবোধের প্রবল তাড়নায় আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। আমার মনে আছে, আত্মহননের অনিবার্য গন্তব্য থেকে আমার জীবনের স্টিয়ারিং-এর মোড় ঘোরাতে নিজেকে একেবারে পর্যুদস্ত করে ফেলেছিলাম। আমার মনে আছে, ওআচ অ্যাণ্ড ওআর্ডের সেপাই-এর সঙ্গে কথা বলতে বলতে ইউনিয়ন-অফিসের দরজা খুলেছিলাম। তখন সকাল সাড়ে নটার বেশি হবে না। একটু আগেই আসাম মেল—আমার সম্ভাব্য আততায়ী—বেরিয়ে গিয়েছিল। আমার মনে আছে, ইউনিয়ন-অফিসের চিরন্তন অন্ধকার (ইউনিয়ন-অফিস সর্বত্রই এমন অন্ধকার ঘরে করা হয় কেন, কে জানে!) প্রাচীরপত্র প্রচার-পুস্তিকা আর পতাকা আর চিমসে গন্ধযুক্ত ফেস্টুনের গাদায় নিজের দেহটিকে অবিক্রীত পার্টি লিটারেচারের মত ছুঁড়ে ফেলেছিলাম, আর তৎক্ষণাৎ চৈতন্যের মেন সুইচ অফ করে দিয়ে গভীর ঘুমের অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছিলাম। 

আমার মনে আছে, রথীন পাকা ডুবুরির মত সেই ইউনিয়ন-ঘরের অন্ধকারে ডুব দিয়ে দিয়ে আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলেছিল। আমার দেহ আর মনের যেসব জোড় খুলে পড়েছিল, সেগুলো তাকে স্যালভেজ করতে হয়েছিল। তারপর পাকা মিস্ত্রির মত সেইসব অংশ জোড়া দিয়ে আবার আমাকে খাড়া করে তুলেছিল। 

“এই.. এই কী রে?” প্রাণপণে আমার শরীরটাকে ঝাঁকানি দিচ্ছিল। “নেশা করেছিস নাকি? ওঠ, ওঠ। এ কী ঘুম রে বাবা!” 

চোখ মেলে আমি রথীনকে দেখতে পাইনি। অন্ধকার ঘরে যে শুয়ে আছি, বুঝতে পারিনি। অন্ধকার। এই ঘরের প্রবেশ প্রস্থান কোথায়, বুঝতে পারিনি। অন্ধকার। আমার দেহের খুব কাছেই অন্ধকারের একটা জমাট পিণ্ডের উপস্থিতি। সে-ই রথীন। তার হাত দুটোর স্পর্শ অশরীরী। আমার গায়ে লাগছে। আমাকে ঝাঁকানি দিচ্ছে। আমি কত হাল্কা। মাধ্যাকর্ষণ আমার উপর ক্রিয়া করছে না। আমি কত হাল্কা। 

*

বুলা গদিটার ও পাশে, এ পাশে আমি। ওর কাছে উঠে যাব? বলব, বুলা, তোমার ঐ কুৎসিত অভিব্যক্তি সংবরণ করো? “অসভ্য বাঁদর, ফের যদি বাঁদরামি করার চেষ্টা করো, চেন টানব।” তোমার ভয় নেই, বুলা—চেন তোমায় টানতে হবে না। তুমি নিশ্চিন্ত হও। এখান থেকে ওঠবার ক্ষমতা আমার নেই। আমার দেহটা কত ভারী! কত যে ভারী, বুলা, তুমি বুঝতেও পারবে না। হিমালয়ের ওজন আমার ওপর চাপানো। আমি এখান থেকে উঠি, এমন সাধ্য নেই। ট্রেনখানা আমাকে আর বুলাকে নিয়ে প্রাণপণ গতিতে ছুটছিল। অন্ধকারের জরায়ু বিদীর্ণ করে উজ্জ্বল আলোকমণ্ডলে সে ভূমিষ্ঠ হতে চাইছিল। বুলা বাথরুমে চলে গেল। অনেকক্ষণ সেখানে কাটাল। সম্ভবত কাঁদছে। সম্ভবত বাথরুমে আয়নার কাছে তার মুখখানা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছে, আমার অতর্কিত চুম্বন তার মুখের ত্বককে চিরে ফেলেছে কি না। সম্ভবত কমোডে বসে হাল্কা হচ্ছে, নিজের বিপর্যন্ত স্নায়ুগুলোর জট ছাড়িয়ে ধাতস্থ হবার চেষ্টা করছে। কেমন হাল্কা পায়ে বুলা বাথরুমে ঢুকে গেল! আমারও বাথরুমে যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমি অনড়। অবশেষে ভোর হল, বেলা হল। গাড়ি ফেরিঘাটে গিয়ে ভিড়ল। অসংখ্য যাত্রী, অপরিচিত কুলির ভিড়ে দিশেহারা হয়ে বুলা ভাবতে লাগল, কী করবে, আমাকে এখানে থেকে বিদায় দেবে, না আমাকে দিয়ে ঝামেলাটা উদ্ধার করিয়ে নেবে। কুলিরা এসে মাল টানাটানি করছে। একজন একটা টানে তো অন্যজন আর একটা। একসময় তো মাল নিয়ে দুটো কুলি ফেরি স্টিমারের দিকে দৌড়ই দিল। তখন আমি বাকি কুলিদের নিয়ে সে দুটোর পিছনে ছুটলাম। বুলা পিছনে পিছনে এল। অবশেষে আমরা গঙ্গাও পার হলাম। আমি আর বাক্যব্যয় না করে ওকে ওপারের ছোট গাড়িতে তুলে দিলাম। এবার আর কুপে নয়, চার সিট-ওয়ালা কামরা। দরজায় কার্ড ঝুলছে, অধিকারীদের নাম- বুলার, আমার আর দুজন মিলিটারি অফিসারের। আমি স্টিমারেই বুলাকে বলেছিলাম, বুলার মুখের উপর আমার চোখ রেখে। রুক্ষ চুলের এক গোছা হাল্কা জুলপি বুলার গাল আলতোভাবে ছুঁয়ে আছে, আজ আর এ দৃশ্যে অসাধারণত্ব কিছু দেখলাম না। গঙ্গার বাতাসে বুলার আঁচল খসে খসে পড়ছে, বুলা তার আঁচল নিয়ে বরাবরই বিব্রত, ব্লাউজের নীচে দুটো স্তনের রেখা ভুস করে ভেসে ওঠা শুশুকের মত জেগে জেগে উঠছে। কিন্তু আজ এ ঘটনায় কোনও বিপর্যয় নেই। আমি মৃত, আমি শান্ত, কাল আমার মৃত্যু হয়েছে, বুলার জগতে সজ্ঞানে আমার গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটেছে। “মানুষ একবারই মরে,” হামজা বলেছিল, “এ কথা মিথ্যে।” হামজা বলেছিল, “আমরা প্রতি মুহূর্তে মরছি, প্রতি মুহূর্তে জন্মাচ্ছি। জন্ম আর মৃত্যু কনটিনিউআস প্রোসেস। স্মৃতিই এই ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। ইন এ সেস্‌, প্রত্যেক মানুষই জাতিস্মর।” আমি মৃত, তাই বুলার অস্তিত্ব এখন আর আমায় একটুও পীড়িত করছে না। আমার স্মৃতি জীবিত, তাই বুঝতে পারছি। এককালে আমি আমার কক্ষপথ থেকে বুলার প্রবল আকর্ষণে বিচ্যুত হয়ে পড়েছিলাম। তাই এক দুর্ঘটনা ঘটেছিল। তার ফলে আমার মৃত্যু ঘটেছে; বুলার মুখের উপর আমার মৃত, শান্ত—মৃত বলেই শান্ত—চোখ স্থাপন করে প্রশান্ত কণ্ঠে বলেছিলাম, “তোমাকে ট্রেনে বসিয়ে দিয়েই ফিরে যাব, বুলা।” বুলা তার অবাধ্য আঁচল শাসন করতে করতে, অন্য দিকে চেয়ে প্রবল আবেগের কণ্ঠরোধ করে, শুধু বলেছিল, “বেশ।”

আমি বুলার মালপত্র গোছগাছ করে দিয়ে অনায়াসে বললাম, “আমার ফিরে যাবার ভাড়া দাও, বুলা।” বুলার মুখের দিকে চেয়ে দেখি, আতঙ্কে, ভয়ে বুলার মুখ ব্লটিং কাগজের মত শুকিয়ে গিয়েছে। সে মুখে এক ফোঁটাও রক্ত নেই। ওর ভয়ের উৎস সন্ধানে চোখ ফেরাতেই দেখি, দুজন বিরাটদেহী পঞ্জাবি অফিসার সেই কামরায় ঢুকে পড়েছেন। আমাদের দিকে চেয়ে নিজেদের মাল গুছিয়ে ফেলতে লাগলেন তাঁরা। কী সাবলীল স্বাস্থ্য! দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর ভাস্কর্যের শক্তি ও সামর্থ্য যেন প্রাণ পেয়ে এখানে এসে গিয়েছে। আমি চকিতে মনে ঈর্ষার কামড় খেলাম। বুলা হতবাক। ওঁরা গোছগাছ শেষ করে নেমে গেলেন প্ল্যাটফর্মে। বুলা মুহূর্তে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমার হাত দুটো ধরে ফাঁসির আসামি যেন প্রাণভিক্ষা চাইছে, বুলা কাতরভাবে বলে উঠল, “না, না, না, আমি পারব না, আমি একা যেতে পারব না, আমি একা যেতে পারব না। তুমি চলো, তুমি চলো। আমাকে পৌঁছে দাও।”

*

“তুই যা, শিগগির আমার বাড়ি চলে যা।” রথীন আমার সমস্ত শরীরটাকে নিপুণ দক্ষতায় জোড় লাগিয়ে বলল। “খালি বাড়িতে ও একা থাকতে পারবে না, বুঝলি! ভয়েই দাঁতকপাটি লাগবে, বুঝলি! ওর বড় ভয়। তুই যা শিগগির। 

পাছে আবার ঘুমিয়ে পড়ি, আর ওর বউ খালি বাড়িতে ভয়ে মরে যায়, তাই রথীন কোনও ঝুঁকি নিল না। আমাকে টেনে-হিচড়ে ইউনিয়ন-অফিস থেকে বের করে আনল, ওভারব্রিজের গোড়ায় এনে ঠেলে দিল গভীর অন্ধকারে, নিয়তির খপ্পরে, এক ভীত আতঙ্কিত নারীর আলিঙ্গনে। 

আমরা তিনটি বিন্দু একই বিন্দুতে মিলিত হলাম। আমি প্রাণপণে বাধা দেবার চেষ্টা করেছিলাম। রথীন বুঝতে পারেনি, ওর বউ পেরেছিল। সম্ভবত সেও এক প্রলয়ংকর প্লাবন রোধ করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টায় কাঁচা মাটির বাঁধ নির্মাণ করে তুলছিল। কিন্তু সে তরঙ্গ রোধিবে কে? দুটো দেহ প্রবল স্রোতের টানে উল্টেপাল্টে, দুমড়ে প্রতি রাত্রে প্রবল নাকানি-চোবানি খেতে লাগল। আমি অসহায়, সে অসহায়। আমি আত্মরক্ষায় ব্যর্থ, সেও ব্যর্থ। আমাদের দুজনের এই ব্যর্থতা দুজনকে সমবেদনার এক সূত্রে গ্রথিত করে দিল। ক্রমাগত ফেল করা দুই ছাত্র হামদর্দির যে বাঁধনে বাঁধা পড়ে, আমরাও সেই বাঁধনে বাঁধা পড়লাম। প্রবল তাড়সে কাঁপতে কাঁপতে সে এক-একদিন আমার বুকে মুখ গুঁজে ভুল বকত, “আমাদের বাঘে ধরেছে, জানো, আর নিস্তার নেই। বনের বাঘেই খায় না, জানো,” সে বিড়বিড় করত, “মনের বাঘেও খায়।”

আমার চেষ্টায় রথীন ক’দিনের ছুটি পেল। এর জন্য ডি টি এস-এর কাছে আমাকে ক’দিন ধরে ক্রমাগত হাঁটাহাঁটি করতে হয়েছে। রথীন ছুটি পেয়ে খুশি হয়নি। তার ওভারটাইম কিছু মা’র গেল। মা’র কাজ করবে কীভাবে, তাই ভেবে সে অস্থির। সে এত আগে থেকে ছুটি নিতে চায়নি। প্রায়ই সে আমাকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করত। বলত, “দ্যাখ, ছুটি নিলেই তো হল না! এত বড় একটা কাজ, খরচপত্র চাই তো!” আমি তার কথায় বিরক্ত হতাম। “তুই কী জলপাইগুড়ির রাজার মত দানসাগর করবি নাকি? তোর যেমন হিম্মত তেমন করেই মা’র কাজ করিস। বুঝিসনে কেন, তোর এ সময় বাড়িতে থাকাই ভাল! তোর বউ আবার যে-রকম ভয়তরাসে!” ওর বউ আমার উপর খুব চটে উঠত। “তোমার এত মাথাব্যথা কিসের বলো দেখি! বলে, যার বিয়ে তার হুঁশ নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই।” রথীন বলত, “তুই তো রাতে থাকিস। তবে আর আমার বউয়ের ভয় কী?” যে কথাটা আমার বলবার ইচ্ছে ছিল না, যে কথা বলতেও চাইনি, সেই কথাই ইউনিয়ন-অফিসের নির্জনতায়, অন্ধকারে ওর কানে ঢেলে দিলাম : “তুই কী রে! আমি যদি রোজ রাত্রে তোর বাড়িতে শুই তো লোকে বদনাম দেবে না!” রথীন লাফিয়ে উঠল, “কোন শালা কী বলেছে তোকে, বল তো!” আমি বললাম, “কেউ কিছু বলেনি। কিন্তু বলতে কতক্ষণ!” রথীন নিশ্চিন্ত হল। “তাই বল, আমার বাড়িতে যা খুশি হোক না, তাতে কোন্ -এর কী বলার আছে? কেউ একবার উকি মেরে খবর নেয়?” তারপর বললে, “তোর গা থেকে ভদ্দরলোকের গন্ধ এখনও কাটেনি। কলঙ্ক, কেলেঙ্কারি – ওসব ভদ্দরলোকের এলাকায় থাকে। খেটে-খাওয়া মজুরের খোয়া যাবার কিছু নেই।”

“তুমি কী নিস্তার পেতে চাইছ?” রথীনের অনুপস্থিতির অবকাশে রথীনের এখন ছুটি, সে রাত্রে বাড়িতেই থাকে, একই ঘরে দুই শয্যায় তারা স্বামী-স্ত্রী শোয়, রথীনের অশৌচ- এক অন্ধকারে, প্রবল তাড়সে আচ্ছন্ন সেই নারী আমার দেহে টু মারতে মারতে জিজ্ঞাসা করেছিল, “তুমি কী নিস্তার পেতে চাইছ? নিস্তার কী পাবে? পাওয়া যায়? বলো না, পাবার কী কোনও রাস্তা আছে? বলো না, বলো না!” 

রথীন যে কথা বুঝতে পারে নি, ওর বউ সে কথা কেমন অনায়াসে বুঝে ফেলেছে। 

হোয়ার ইজ মাই একেপ, ম্যান? (রঙ্গচারী লিখেছিল) অজগর সাপের মত প্রবল নিশ্বাসে সে আমাকে টানছে। আঁকড়ে ধরে বাঁচি, এমন সম্বল আমার নেই। হোয়ার ইজ মাই একেপ? 

মাকড়সার জালে ধরা মাছির মতন আমি তার আঠালো সত্তায় ধরা পড়েছি। পাখার দুরন্ত ধাক্কায় ধাক্কায় উদ্ধার পাবার বৃথা চেষ্টা করে করে ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে পড়ছি। অবসাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছি। হোয়ার ইজ মাই এসকেপ, ম্যান? 

সন্দেহ নেই, আমিও নিস্তার পাবার চেষ্টা করছিলাম। রধীন সেটা বোঝেনি, রথীনের বউ বুঝেছিল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সেও আমার মত নিস্তার পাবার চেষ্টা করছিল। চেষ্টা করে করে ক্লান্ত হয়ে পড়ছিল। আমার মত, রঙ্গচারীর মত, লক্ষ কোটি মানুষের মত অবসন্ন হয়ে পড়ছিল। নিয়তির প্রবল নিশ্বাস আমাদের দুজনকে একই দিকে টানছিল। আমরা ছটফট করছিলাম; কারণ, দুজনেই একদিন আবিষ্কার করলাম, আবিষ্কার করে শিউরে উঠলাম, আমাদের আকর্ষণ আর মাত্র দেহের কেন্দ্রেই নিবন্ধ নেই, এর মূল গভীরে গভীরে, সত্তার অতলে নেমে গিয়েছে। “দেহের আকর্ষণ জলে ধুলেই চলে যায়,” হামজা বলেছিল। কিন্তু এ অন্তিম সর্বনাশ। এ যে ভালবাসা! এর হাত থেকে তো নিস্তার নেই! 

রথীনের বউ জানত, রথীন তার অস্তিত্বে এত অভ্যস্ত যে, তার প্রতি সে আকর্ষণ বোধ করে না। তাদের দশ বছরের বিবাহিত জীবনে আবেগের উৎপাত প্রথম দু বছরেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। রথীনের কাছে তার বউ তার তক্তাপোশ-বিছানার মতই এক সহজ আশ্রয়ে পরিণত হয়েছিল। তার কোনও ছাপ তার অন্তরে পড়েনি। চোখ বুজে যদি তাকে বউয়ের মুখ কল্পনা করতে বলা হত, তার চোখে ভেসে উঠত ইঞ্জিনের দাউদাউ বয়লারের ফুকরটা। যে বিছানায় সে শোয়, যে তক্তপোশে বিছানা পাতা হয়, সেটা দেখতে কেমন, রথীনকে সেটা ভেবে দেখতে বললে তার মগজে ইঞ্জিনের বয়লারের ফুকরটা দাউদাউ করে উঠত। তার বয়েস এ সময় বিয়াল্লিশ। আমার একুশ। তার বউয়ের বয়স কত ছিল, জানি না। (তার নাম কী? তার নাম কী? তার নাম কী? জানি না। বাড়িতে রথীনের বউয়ের নাম ধরে কেউ ডাকত না। রথীনের মা না, রথীন না। আমাদের ইউনিয়নের খাতায় নাম লেখাবার দায়ও তার ছিল না। রেল-ইস্কুলের গার্ল সেকশনের হেড মিস্ট্রেস মিসেস ক্যাথারিন মণ্ডল, অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার মিস শিউলি চাকি, মিস সুরেন্দ্রভামিনী দত্ত, নার্স মিসেস ভ্রমর টমাস আর ফতিমা ধাত্রীর নাম আমাদের ইউনিয়নের চাঁদার খাতায় ছিল। ডি টি এস সাহেবের ফিরিঙ্গি স্টেনো, যার কথা মনে পড়লেই কিউটিকিউরার প্রসাধন সামগ্রীর গন্ধ আজও নাকের ডগায় ভুরভুর করে, আর বোলতার মত সুগঠিত নিতম্বের ব্যস্ততা আর সুঠাম দুখানি অনাবৃত পা চোখে ভাসে, তার নাম মিস অ্যানাবেল ফিলে। “হ্যালো অ্যানা, আর ইউ ফ্রি দিস মর্নিং?” – ছোকরা এ টি এস চোখ মারে। “সরি, চার্লস্।” —টাইপ-রাইটারে মিস ফিনলের আঙুল চলে। “টুমরো দেন, অ্যানা?” “সরি, চার্লস্।” শর্টহ্যাণ্ড-খাতাটা নিয়ে মিস অ্যানা উঠে পড়ে। “ডে আফটার?” মিস অ্যানাবেল ফিলে সুর ছড়ায়, “প্লিজ, চার্লস্!” তারপর বড়সাহেবের ঘরে ঢুকে পড়ে। “ইজ হি বিজি, মিস ফিনলে?” মিস ফিনলে মধুর হেসে বলে, “ও, ইউ হ্যাভ কাম! হি ইজ এপেক্‌টিং ইউ, বাবু। গো ইন্‌সাইড।” আমাদের টিপ্‌ দেয়, “হি ইজ ইন গুড হিউমার।” রথীনের বউ এর কোনওটার মধ্যেই পড়ে না। তাই তার নাম জানতে পারিনি। প্রসবের সময় হাসপাতালে ছিল। সেই খাতায় নিশ্চয় নাম আছে। পেশেন্টের টিকিটেও নিশ্চয়ই নাম ছিল। আমি হাসপাতালে যাইনি। ডেথ সার্টিফিকেটেও নিশ্চয়ই নাম ছিল, আমি তা দেখিনি।) 

রথীনের কাছে রথীনের বউ তার বয়সের মতই একটা সহজ স্বাভাবিক অস্তিত্ব। এ নিয়ে সে কখনও মাথা ঘামায়নি। ঈর্ষা রথীনকে তার স্ত্রী সম্পর্কে সচেতন করে তুলল। তাকে তার স্ত্রীর প্রতি মনোযোগী করল। এতদিন পরে রথীন তার স্ত্রীর প্রেমে পড়ল। আমরা তিনটি বিন্দু এক বিন্দুতে এসে মিলিত হলাম। তবু আমি সুশীলার মত বলতে পারব না, “রঙ্গচারী, আমি, বলরাম—আমরা তিনজন দুজন হয়ে গেলাম। 

*

কোনও দেহই নতুন দেহ নয়, কোনও মনই নতুন মন নয়। রঙ্গচারী লিখেছিল, ওলি লাভ ইজ নিউ অ্যাণ্ড এড্‌রি কিস ইজ এ নিউ কিস। জগতে আর নতুন ডাঙা নেই, নতুন সমুদ্র নেই, ওলি দি ডুয়েলিংস্ আর নিউ। আকাশ নতুন নয়, বাতাস নতুন নয়, ওলি ব্রিদিং ইজ নিউ। দেয়ার ইজ নো নিউ ফায়ার, ওলি দি ফ্লেস্‌ আর নিউ। অ্যাণ্ড দি ফ্লেট্স্ অব ডিজায়ার আর অলওয়েজ নিউ। কামনার শিখাই প্রেমের জন্ম দেয়, আর প্রেম সৃষ্টি করে নতুন চুম্বনের। অ্যাণ্ড নিউ কিসেস ক্রিয়েট নিউ ব্রিদিংস্ অ্যাণ্ড নিউ ব্রিদিংস্ রিপেয়ার দি ওল্ড বডি অ্যাণ্ড রিপ্লেস দি ওল্ড মাইণ্ড। 

আই ওআজ ওল্ড, মাই বড়ি ওআজ অ্যাজ ওন্ড অ্যাজ জরথুস্ত্রস, মাই মাইণ্ড ওআজ অ্যাজ ওন্ড অ্যাজ দি ডিপ সাইস অব ব্যাবিলোনিয়ান ডেস্পেয়ার, বাট আই অ্যাম এ রি-মেক নাউ, এ রি-মেক, ম্যান—এ রি-মেক অব মাই ওন সেল্‌ফ্‌। 

.

রথীনের কথা বলতে গিয়ে রঙ্গচারীর কথাই ধার করতে হল। এতদিনে রথীনের মনে কামনার উদ্রেক হয়েছে। ঈর্ষার স্ফুলিঙ্গ ওর কামনাকে জাগ্রত করেছে। কামনা ওর স্ত্রীর প্রতি ওকে আকৃষ্ট করেছে। ওর স্ত্রীকে ও প্রবল বেগে আকর্ষণ করছে। তিনটি অণু একই ক্ষেত্রবৃত্তে তিনজনকে সমভাবে আকর্ষণ করছে। এতদিনে রথীনের দেহে, রথীনের মনে অস্থিরতা জেগে উঠেছে—যে অস্থিরতা আমাকে ভোগাচ্ছে, যে অস্থিরতা ওর স্ত্রীকে ভোগাচ্ছে, সেই অস্থিরতা। আমরা তিনজন এত অন্তরঙ্গ বোধ হয় আর কখনও হইনি। আমি রথীনের জন্য প্রাণ দিতে পারি, রথীন ওর স্ত্রীর জন্য প্রাণ দিতে পারে, ওর স্ত্রী আমার জন্য প্রাণ দিতে পারে। রথীন আমার জন্য প্রাণ দিতে পারে, আমি ওর স্ত্রীর জন্য প্রাণ দিতে পারি, রথীনের স্ত্রী রথীনের জন্য প্রাণ দিতে পারে। আমি রথীন আর ওর স্ত্রীর জন্য প্রাণ দিতে পারি, রথীন ওর স্ত্রীর আর আমার জন্য প্রাণ দিতে পারে, রথীনের স্ত্রী আমার আর রথীনের জন্য প্রাণ দিতে পারে। 

আমরা তিনজন যেন কোন গোপন উপাসক সম্প্রদায়ের তিন মন্ত্রশিষ্য। আমরা এখন পরস্পরের গা ঘেঁষে বসি, পরস্পরের শরীরের তাপের বিকিরণে নিজ নিজ দেহে তাপ সংগ্রহ করি। 

কিন্তু রথীন আগে যেমন ডিউটিতে যাবার আগে আমাকে ওর বাড়িতে যেতে বলত, এখন আর তা বলে না। এ যেন এক স্বতঃসিদ্ধ। এক স্ত্রীর অধিকারে রথীন যখন থাকবে না, আমি তখন থাকব; আমি যখন থাকব না, রথীন তখন থাকবে। যখন কাউকে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাসপ্রশ্বাস দিতে হয় তখনই তাকে জোরে জোরে নিশ্বাস টানার কথা বলতে হয়, প্রক্রিয়া স্বাভাবিক হয়ে এলে সে কথা আর বলতে হবে কেন? আমি ভাবতেই পারিনি, আমি আর ওর বাসায় না আসি, এই ও চায়। 

রথীন কখনও সে কথা আমায় বলেনি। আমি ওর সামনে ওর বউয়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকতাম। ওর বউয়ের হাত নিয়ে খেলা করতাম, রথীন হাসত। এই মুহূর্তগুলিই আমার সব থেকে আনন্দে কাটত। জ্বালাযন্ত্রণাহীন অপার আনন্দময় সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি। এই সময় পৃথিবীকে আমার আনন্দনিকেতন বলে মনে হত। হামজা বলেছিল, প্রেম পোড়ায় না। কথাটাকে এই মুহূর্তগুলির জন্য আমার সত্য বলে মনে করতে ইচ্ছা হয়। 

অনেক পরে জেনেছিলাম, রথীন আসলে হাসত না। ওর মনের জ্বলুনি হাসির মুখোশে লুকিয়ে রাখত। এ আমার আন্দাজ নয়, রথীনের স্বীকারোক্তি। ও সন্দেহের বিষে জ্বলতে শুরু করেছিল। ওর প্রেম সে সময় ছিল লাল কেরোসিনের আলো। আলোর চেয়ে ধোঁয়া বেশি। 

রথীন যে সন্দেহের বিষে জ্বলছে, সে কথা ওর বউ জানত; কিন্তু আশ্চর্য, আমাকে কখনই সে কথা বলেনি। সেদিন—

অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছিল। সন্ধে থেকে আমাদের আড্ডা বসেছিল। রথীনের ডিউটি পড়েছে। কল-বয় এসে জানিয়ে গিয়েছে। বৃষ্টি পড়ছে। দশটায় রথীনের ট্রেন ছাড়বে। ব্যালাস্ট ট্রেন। পরশু বিকেলে রথীনের ফিরে আসবার কথা। বৃষ্টি পড়ছে অঝোর ধারে। আমাদের আড্ডায় তিনজন নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় বসে আছি। এক উষ্ণতার ডিমে তিনজন বসে তা দিচ্ছি। বৃষ্টি পড়ছে। অন্ধকার। আমাদের ইউনিয়ন চাক্কা-বন্ধের প্রস্তুতিতে মেতেছে। কর্তৃপক্ষ সামান্যতম দাবিও মানতে রাজি নন। কমিউনিস্ট ইউনিয়নের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। কমিউনিস্টরা ধর্মঘটের প্রস্তুতিতে মেতে উঠেছে। তারা শ্রমিকদের হাতে রাখতে চায়। আমরা শ্রমিকদের হাতে রাখতে চাই। আমরা ধর্মঘটের প্রস্তুতিতে মেতে উঠেছি। কমিউনিস্টরা উপরওলার চরম নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা উপরের চরম নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছি। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। রথীনের বউ তেলের কুপিটাকে নিবিয়ে রেখেছে। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির বিচ্ছিন্ন ধারাগুলো একটা ঘন কালো স্লেট-গোটা স্লেটটাই গলে পড়ছে। আমরা বৃষ্টি দেখতে পাচ্ছি না। শব্দ শুনে বুঝছি, বৃষ্টি পড়ছে। আমরা আমাদের দেখতে পাচ্ছি না। অন্ধকার—অন্ধকার। অন্ধকার গলছে, ঝরে পড়ছে। আমরা গলছি, ঝরে পড়ছি। স্পর্শ পেয়ে বুঝছি, আমরা আছি। 

রথীন এতক্ষণ কথা বলছিল। এখন চুপ। ওর বউ মাঝে মাঝে দু-একটা প্রশ্ন ছাড়ছিল। চুপ। আমি সায় দিচ্ছিলাম। চুপ। বৃষ্টি পড়ছে। রেলের ইঞ্জিন হুইল্ দিল। চুপ। বৃষ্টি, বৃষ্টি, বৃষ্টি। মন কথা বলছিল। চুপ। আমাদের তিনটে শরীর ছোঁয়ায় ছোঁয়ায় ভাববিনিময় করছিল। চুপ। রথীন ডিউটিতে চলে যাবে। এই রাত্রি আমার হবে আমার, আমার, আমার… 

“চলো গো, খেয়ে নাও।” একটা কথার বুদ্বুদ গভীর স্তব্ধতার উপর ভেসে উঠল। ফেটে গেল। আবার সব চুপ। বৃষ্টি পড়ছে। 

“খাবে চলো, তোমার ডিউটির সময় হল না!” আর একটা বুদবুদ ভেসে উঠল। ফেটে গেল। বৃষ্টি পড়ছে। 

“আমার চাইতে তোর তাড়াই তো বেশি দেখছি!” বুদ্বুদ। খানিকক্ষণ থাকল। তারপর ফাটল। 

“না, আমার আবার কিসের তাড়া! তোমার দেরি না হলেই হল।” বুদ্বুদ ভেসে বেড়াতে লাগল। 

“আমার দেরির জন্যে তোর ভাবনা যে আজকাল বড় বাড়ছে দেখছি! একেবারে পাকা টাইমবাবু, হুঁ হুঁ!” বুদ্বুদ দ্রুত উঠল। ভাসতে লাগল। আগেরটার গায়ে ধাক্কা লেগে দুটোই ফেটে গেল। 

“বাঃ, বেশ কথা! আমি যেন তোমাকে ভাগাবার জন্য গায়ে চিমটি কাটছি! বলি ওগো, ও বাবু, বন্ধুর কথা শুনছ?” বুদ্বুদ ভেসে এল। 

“বাঃ, এই বৃষ্টিতে মানুষ বেরুতে পারে? আচ্ছা বউ তো তুমি!” বুদ্‌দ ভাসতে লাগল। দুটো বুদ্বুদ মিশে গেল। ফাটল না। 

“কী রে, হল? খুব তো সাক্ষী মানছিলি! হল তো?” বুদ্বুদ ভেসে এল। আগের দুটোর সঙ্গে মিশে গেল। একসঙ্গে সব ক’টা ফেটে গেল। 

“সব শেয়ালের এক রা।” রথীনের বউ চটে গেল। 

রথীন ডিউটিতে যাবে। এই রাত্রি আমার হবে, এই বৃষ্টি আমার হবে, অন্ধকার আমার হবে—আমার, আমার, আমার… 

“দে, দে, আর গোঁসা করিসনি। ভাত দে, চলে যাই। সত্যিই দেরি হলে বড় খারাপ হবে।”

“আসল কথা কী জানিস, তোদের আড্ডায় বসতে উঠতে বড় কষ্ট হয়। বড্ড একা লাগে।” খেতে খেতে রথীন বলল, “তাই উঠতে ইচ্ছে হয় না।” রথীন এক নতুন সুরে কথা বলছে এখন। রথীনের স্বর ভারী। রথীনের স্বরে বৃষ্টির বিষণ্ণতা। “মনে হয় কী জানিস, যেন আমি চলে গেলেই তোরা বাঁচিস।”

“শোনো কথা!” ওর বউ অবাক হয়ে চুপ করল। অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। 

*

আকাশ প্রায় দেখাই যাচ্ছিল না, এমন বৃষ্টি। সিসে-রং মেঘগুলো ঝুলে ঝুলে আছে—ট্রামের তারের উপর, টাওয়ার লজের উপর, শিয়ালদা স্টেশনের পাঁচিলে টাঙানো সিনেমা পোস্টারগুলোর উপর। বৃষ্টি পড়ছে অঝোর ধারে। এই সকালটা যেন ঘষা কাঁচের শার্সি। ও-পিঠ দিয়ে মোটা মোটা ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে। ঠনঠনেয়, চিৎপুরে, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ-এ, ফায়ার ব্রিগেডের সামনে, ভবানীপুরের জগুবাজারে এতক্ষণে জল দাঁড়িয়ে গিয়েছে। সকালের ট্রামগুলো যদি বেরিয়ে থাকে, মাঝপথে দাঁড়িয়ে গিয়ে অসহায় কাকের মত ভিজছে। আধা আধা ঘুম আর বিরক্তি সর্বাঙ্গে মেখে ট্রামের ড্রাইভার আর কণ্ডাক্টার আর দু-একটা প্যাসেঞ্জার অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছে এক অচল ভবিতব্যের হাতে। সমস্ত জানালাগুলো তুলে দিয়ে ভেজা ভেজা সিটে বসে হাই তুলছে, তুড়ি মারছে, হাই তুলছে, বিড়ি ফুঁকছে। বৃষ্টি ঝরছে, ভারী বৃষ্টি, নিঃশব্দে। এত নিঃশব্দে যে, লেট-রাইজার কলকাতার ঘুম যেন না ভাঙে। কয়েক বছর আগে, সুশীলা তখন মেডিকেল কলেজের থার্ড ইয়ারে পড়ে, বলেছিল, “বর্ষাকালটায় কলকাতাকে দেখলে মনে হয়, তার পেরিটোনাইটিস হয়েছে। ট্যাপ করে করে যতই জল বের করো, আবার তত জলই জমে যায়।”

শিয়ালদা স্টেশনের সামনের আশ্রয়ে ক্রমশ ভিড় বাড়ছে। স্কাইলাইটে কাঁচের গা বেয়ে অবিরাম বৃষ্টির ছায়া নামছে, যেন তাজা স্মৃতির ঢল। “আমরা আমাদের স্মৃতিতে বেঁচে থাকি। এই শহর, বাইরের মানুষ, আমরা, আমাদের জীবন স্মৃতিতেই বেঁচে থাকবে। আমাদের প্রেম-বিরহ, হাসি-কান্না স্মৃতিতে পরিণত হলে তবেই জীবন্ত, তবেই বাস্তব হয়ে উঠবে। মেমরি নেভার ডাইস।” রঙ্গচারী বলেছিল। “রিয়ালিটি হচ্ছে লাইনো মেশিনের কি-বোর্ডের স্ট্রোক। প্রতি স্ট্রোকে একটা অক্ষর ঝরে, ওলি এ লেটার অ্যাণ্ড নো মিনিং। তারপরে কতকগুলি অক্ষরের সমষ্টিতে এক বাক্যাংশ, এ লাইন। এ রো অব লেটারস্, সাটাইম্‌স্ ইট মে মিন সামুথিং বাট ডাজ নট কনভে এনিথিং—কখনও পুরো, কখনও বা ভাঙাচোরা অর্থ একটা সৃষ্টি হয়, যাতে কিছু বোঝা যায় না। তারপর লাইনগুলো সাজিয়ে সাজিয়ে ম্যাট্রিকসের উপর যখন ছাপ তোলে—দিজ ইমপ্রিন্ট্স আর নট দি লাইনো লেটার, দিজ আর দি মেমরিজ, দেন ইট কনভেস দি ফুল মিনিং, ইট বিকাস্ সিগনিফিক্যান্ট। রিয়ালিটি হ্যাজ অ্যান এক্‌জিটেন্স বাট নো সিগনিফিক্যান্‌স। বাস্তবের অস্তিত্বই শুধু আছে, তাৎপর্য নেই। স্মৃতিই তাৎপর্যময়।”

রঙ্গচারীর মৃত্যু হয়েছে, রথীনের স্ত্রীর দেহ আমি আর রথীন যার অংশীদার ছিলাম—লালমণিহাটের শ্মশানভস্মে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে, সুশীলা আর বলরাম সংসারের বন্দরে নোঙর বেঁধেছে, দুলু কোথায় হারিয়ে গিয়েছে, বুলা, বুলার স্বামী, বুলার সন্তান, বুলার সংসার ডুবো পাহাড়ে গুঁতো-খাওয়া জীর্ণ পোতের দীর্ণ পাটাতনের মত চারিদিকে ছিটকে পড়েছে। শিয়ালদা স্টেশনের আদল বদলে যাচ্ছে, কলকাতার চারিত্র বদলাচ্ছে, আছে শুধু স্মৃতি। অজর, অমর, অব্যয়, অক্ষয়, অবিনশ্বর। স্কাইলাইটের কাঁচের ওপর দিয়ে বৃষ্টিধারার ছায়ার মত স্মৃতির স্রোত অবিরাম বয়ে চলেছে। 

এই আমি এখানে, কেরোসিন কাঠের টেবিলে, শ্রাবণের বিরক্তিকর ঘামে, সাদা পাতলা ব্যাঙ্ক-কাগজের উপর ঘাড় গুঁজে অবাধ্য কলমকে শায়েস্তা করার পণ্ডশ্রম রত, এই আমি কলকাতায় আমার আমি-শূন্য বাসায়, যেখানে আমার স্ত্রী, আমার মা, ভাই-বন্ধুরা স্বল্প জলে লগি ঠেলে সংসারের অবাধ্য ভেলাটাকে কোনক্রমে পাড়ে ভেড়াতে ব্যস্ত, আমার ন্যাওটা মেয়েটা কয়েকটি কামরার অরণ্যে তার বাবাকে খুঁজতে সোনার হরিণের পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছে, এই আমি, এখন আমার স্মৃতির অজস্র অধ্যায়ে। 

কেউই মরেনি, কোনও কিছুই ক্ষয়নি। সব কিছুই আমাদের আগোছালো স্মৃতির গুদামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। “দি গোডাউন ইজ পাটুলি ডার্ক অ্যাণ্ড পাটুলি লিট। ভিতরে ঢোকো, হাতড়াও, অ্যাণ্ড ইউ উইল ফাইণ্ড এভরিথিং। দেয়ার এভৃি ডেড ইজ এ লিভিং বিং, এভরি করস্ হ্যাজ ওআর। গেট ইন্‌সাইড ম্যান, অ্যাণ্ড ইউ উইল সি দেয়ার এভরি ওর্ন-আউট ইজ ফ্রেশ অ্যাণ্ড নিউলি পেন্টেড।”  রঙ্গচারীর তাগিদ আমি স্বপনে অনুভব করি : গেট ইন্‌সাইড ম্যান, গেট ইন্‌সাইড। 

সেদিন সেই মুষলধারা বৃষ্টিতে আমার ভিজতে ইচ্ছে করছিল। যে ট্রেনখানা আমার নিঃসঙ্গ সত্তাকে শিয়ালদহ স্টেশনে নামিয়ে দিল,, বুলা তার কোথাও ছিল না। যে ট্রেনের কামরায় মিলিটারি সাহেব দেখে ভয়ে অস্থির বুলা আমাকে বাকি পথটুকু পৌঁছে দিতে বলেছিল—সেই ট্রেনেই আমি তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম— বুলা সে ট্রেনের কোথাও ছিল না। পিওন যে মন নিয়ে রেজিস্টার্ড পার্সেল মালিকের হাতে সমর্পণ করে, তেমনি কর্তব্যপরায়ণতার সঙ্গে আমি বুলার বাবার হাতে বুলাকে পৌঁছে দিয়েছিলাম। বুলার বাবা আমাদের সম্পর্কে জানতেন না, তাই বুলার অস্বস্তি তাঁর চোখে ধরা পড়েনি। বুলা স্পষ্টতই দোটানায় পড়েছিল। বাবার নিরাপদ আশ্রয়ে এসে পড়ায় দুটো স্মৃতিই তার মনে জেগে উঠেছিল। দুটোই তার মনে অপমানের জ্বালা নতুন করে ধরিয়ে দিয়েছিল। আমার গালে চড় মেরে সে তার সম্মান বাঁচিয়েছিল, সে তবু এক সান্ত্বনা। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে সে আত্মসম্মান খুইয়ে ওকে পৌঁছে দেবার জন্য আমাকে অনুরোধ করেছিল, তার কোনও উপশম সে খুঁজে পাচ্ছিল না। সে তাই প্রায় ছুটে গিয়েই তার বাড়ির বুইকে গিয়ে উঠল। গদিতে হেলান দিয়ে চোখ বুজে পড়ে রইল। বাবাকে বলল, “মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে।” এই কথা শুনে তার বাবা এত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন যে, আমার পক্ষে অনেক সহজে ওদের বাড়ি যাবার অনুরোধ এড়ানো সম্ভব হল। অনুরোধ ওর বাবাই করেছিলেন। বুলা একটা কথাও বলেনি। বুলার বাবা ব্যস্তভাবে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেলেন। আবার ফিরে এলেন। আমার ফেরার টাকা দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। পরে ক্ষমা-টমা চেয়ে অস্থির কাণ্ড করে অনেক বেশি টাকা আমার হাতে গুঁজে দিলেন। সেই প্রথম আমার মনে হল, বুলাদের দেদার টাকা আছে। পিওন যেভাবে বখশিশ নেয়, আমি সেইভাবেই তাঁর হাত থেকে টাকা নিলাম। হাজার হোক, একটা দামি পার্সেল আমি যথাযথভাবে ডেলিভারি দিয়েছি তো! 

আমার নিঃসঙ্গতা সেদিন আমাকে আদৌ পীড়িত করেনি। বরং পূর্ণই করে তুলেছিল। ফেরার পথে বুলার কথা প্রায় মনেই হয়নি। তার কারণ, আমাকে থার্ড ক্লাসের ভিড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফিরতে হয়েছিল। যদি ফার্স্ট ক্লাসেই আসতাম, তাতেও মনে পড়ত কি না সন্দেহ। সত্যি বলতে কি, বুলার চড় খাবার পর থেকেই আমার অস্থিরতার মৃত্যু হয়েছিল। বুলার থাপ্পড় খেয়ে আমি কিন্তু কোনওরকম আত্মগ্লানি বোধ করিনি। অঙ্ক ভুল করেছি, মাস্টারমশাই থাপ্পড় মেরেছেন— ঠিক এইরকমই মনে হয়েছিল। 

এখন আমার মনে হচ্ছে, এই এখানে, মুষলধার বৃষ্টির সামনে শেডের তলায় দাঁড়িয়ে, আমার মনে হতে লাগল, কোথায় যেন আমার একটা বাঁধন ছিল, সেটা কেটে গিয়েছে। আমি এখন মুক্ত। এই বৃষ্টির প্রবল ধারার মতই আমি যেন মুক্তি পেয়েছি। এই সিসে-রং সকালটা, বৃষ্টির আবরণে ঢাকা শহরটা, এই কাগজের বাণ্ডিল হাতে করা হকার, আটকে পড়া তিতবিরক্ত যাত্রী, ভেজা কাক, ভিখারি, সব আমার ভাল লাগছিল। “নুইসেন্‌স, এই বৃষ্টির কোনও মানে হয়! কলকাতা একটা নরককুণ্ড!” আমার হাত দুটো হঠাৎ রাগে মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এল, আচমকা কেউ মা তুলে গালাগালি দিলে যেমন হয়, রাগ চড়ে যায় মাথায়, আমার মাথায় তেমনি রাগ চড়ে গেল। ধাঁই করে সেই নেকটাই-এর বিরক্ত নাকে একটা ঘুষি ঝেড়ে দিলাম। তারপর সর্বশরীরে উল্লাসের ঢেউ তুলে বৃষ্টির উচ্ছ্বাসে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। 

ঠাণ্ডা জলধারা আমার চুল বেয়ে নোংরা পোশাকে পড়তে লাগল। রোমকূপে শীতল জলের স্পর্শ পেতে লাগলাম। ট্রামের লাইনের উপর দিয়ে, ফুটপাথ দিয়ে যদৃচ্ছ হাঁটতে লাগলাম। বুক-পকেটে অনেক টাকার ছাপ-মারা কাগজগুলো ভিজে ভিজে নেতিয়ে এল। ঘাড় বেয়ে চুঁইয়ে পড়া জলের শীতল ধারা ক্ষণে ক্ষণে রোমাঞ্চ সৃষ্টি করতে লাগল। ল্যাংটো শিশুকে স্নান করাতে বসলে শিশু যেমন শিহরিত হয়, মা যেমন পুলকিত হয়, এই সকালে আমাকে ধারাস্নান করিয়ে আমি অনুভব করতে লাগলাম, কলকাতা সেই পুলক গায়ে মাখছে। 

চেয়ে দেখলাম, লক্ষ পুত্রের জননী কলকাতা দারিদ্র্যের পীড়নে পিষ্ট, পুরনো বনেদিয়ানা ভেঙে পড়েছে তবু তারই স্মৃতি সম্বল, বুকে দুধ নেই, সংসারে তিলধারণের জায়গা নেই, কারও পুষ্টি নেই, পরনে লাল পেড়ে ছেঁড়া শাড়ি শাঁখা মাত্র সার—তবু কী অসাধারণ স্নেহ! কাউকে ফেরায় না, কাউকে তাড়ায় না। কাছে এগিয়ে গেলে সস্নেহে স্নান করায়… 

ভিজে ভিজে মেসে এসে উঠলাম যখন, তখন আঙুলের চামড়া চুপসে গিয়েছে, চোখে জ্বালা, গায়ে জ্বর…। “জ্বর, কামনার জ্বর,” হামজা বলত, ‘বীর্যকে জাগ্রত করে। জ্বর মাত্রেই কামনার বাহন।”

*

মাঝে মাঝে কলকাতায় মৌসুমি পাখির মত এমন দু-একটা দিন ছিটকে এসে পড়ে, যখন কোনও কিছুতেই আর মন লাগতে চায় না। এই সময়টা বড় মারাত্মক। কফি হাউসে, রেস্তরাঁয়, বারে—কোন আড্ডাতেই আঠা থাকে না। পলিটিক্‌স, সংগীত, সাহিত্য-আলোচনা, তর্কাতর্কি, এমন কী জুয়াতেও মন বসে না। এটা কলকাতার নিজস্ব আকর্ষণ। “কলকাতা গ্রিক পুরাণের সেই সাইরেন। তার আহ্বান কানে গেলে নিস্তার নেই।” (হামজা)। 

এমনি এক দিনে, আমার মনে আছে, কাগজপত্র বিছিয়ে নিয়ে বসে আছি— সমাজ উন্নয়ন পরিকল্পনার মুণ্ডপাত করতে হবে—একটা আঁচড়ও কাটিনি, কাটতে পারছিনে, এমন সময় হামজা এল। একেবারে আস্ত একটি ছন্নছাড়া। “এই, পঁচিশটে টাকা দাও তো।”

বললাম, “আমার পকেটে টাকা নেই।”

“তবে ধার করে নিয়ে এক্ষুনি চলে এসো, কফি হাউসে, হাউস অব লর্ডস্-এ। দশ মিনিটের মধ্যে এসো।” 

সেইখানেই হামজা মেয়েটার পরিচয় দিল, “এ মুকুল।”

তারপর আমি মুকুলকে দেখি একটা নতুন অফিসে—এক কন্‌ট্রাক্টারি ফার্ম- ভাল করে অফিস তখনও বসেনি। হামজা বলল, “আমি এখানে কাজ পেয়েছি সেক্রেটারি। মুকুল টাইপিস্ট।”

মুকুল ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “চাকরি থাকবে না।”

“কেন?” 

ঠোঁট উল্টো মুকুল বলল, “এ এস ডি এফ জি—টাইপ-রাইটিঙে এই আমার বিদ্যে।”

হামজা বলল, “আমি এক মাসে তোমাকে শিখিয়ে দেব।”

“সেই যা ভরসা।”

তারপর মুকুলকে দু’ দিন স্বপ্নে দেখলাম। এবং স্বপ্নেই আমি লক্ষ করলাম, সমস্ত অবয়বের মধ্যে ওর চোখ দুটোই প্রধান। তারপর একদিন আমি ওর অফিসে গেলাম। মিলিয়ে দেখলাম, ঠিকই। ডাগর দুটো চোখেই ওর অস্তিত্ব। তারপর থেকে একটি কবিতার লাইন—“ও দুটি চোখের তাৎক্ষণিকের পাব কী পরশ যৎসামান্য?” (অরুণকুমার সরকার) — মনে হঠাৎ হঠাৎ লাফিয়ে উঠতে লাগল। 

আমি ওর অফিসে গিয়েছি : “ও দুটি চোখের তাৎক্ষণিকের পাব কী পরশ যৎসামান্য?” 

কলকাতার বাইরে গিয়েছি : “ও দুটি চোখের তাৎক্ষণিকের পাব কী পরশ যৎসামান্য?” 

আমি ওকে ভালবাসিনি। ওর বড় দত্ত। ওর বড় গর্ব। ওর রোগা লিকলিকে শরীর। হাত দিতে ভয় করে। মট করে ভেঙে যাবে। ওর কিছু নেই, কিছু নেই। কিছু দেবার নেই। কিছু নেবার নেই। শুধু দুটি চোখ। (ও দুটি চোখের তাৎক্ষণিকের পাব কী পরশ যৎসামান্য?) এই কবিতাটা আসল না, ওর চোখ দুটো আসল? এই কবিতাটাই ওর সম্পর্কে আমাকে সচেতন করেছে, নাকি চোখ দুটোই কবিতাটিকে মনে পড়িয়ে দিয়েছে? জানি না। তবে একটাকে অন্যটার থেকে আলাদা করে ফেলা যায় না। 

অনেক—অনেক দিন পরে ও হারিয়ে গেল, হামজা হারিয়ে গেল। আমার যৌবনের অফুরন্ত শক্তির কাছে ওর প্রৌঢ়ত্ব পরাভূত হল। সেইদিন আমি ওর চোখে জল দেখেছিলাম। বেহালার এক দেশি মদের দোকানে ঢুকে মদ খেল। তারপর কাঁদল। কেঁদেই ফেলল। 

বলল, “আমি ওকে ভালবাসি না। তুমিও ওকে ভালবাসো না। ও আমাদের… কাউকে ভালবাসে না। ভালবাসার কোনও কথা নয়। আমার দুঃখ এই, আমার পাশে ট্যাক্সিতে বসে তুমি ওকে জড়িয়ে ধরলে, ওর মুখে চুমু খেলে, আমার অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করলে! আমি আমি হামজা একটা সাইফার বনে গেলাম! আমি কি তবে বুড়ো হয়ে গেছি? বুড়ো হয়ে গেছি? অতি অথর্ব এক ষাঁড়? এবার কী তবে পিজরাপোলে যেতে হবে?” 

অথচ এ কাজের জন্য আমি একটুও প্রস্তুত ছিলাম না। সেদিন যখন মুকুলের সঙ্গে দেখা হল, তখনও না। বরং ওর প্রতি আমি চটেই ছিলাম। ওর প্রতি একটা বিতৃষ্ণার ভাবই আমার জেগে উঠেছিল। একেবারে খেলো মেয়ে। হামজার উপরও আমার রাগ হচ্ছিল। একটা বুড়ো ছাগল, পাঁঠা কোথাকার! মেয়েমানুষ দেখলে কাণ্ডজ্ঞান থাকে না! রঙ্গচারী এ রোগের নাম দিয়েছিল “স্কার্টরাইটিস”। হামজাই আমাকে বলেছিল, মুকুল খুব অ্যাকম্‌প্লিড্ মেয়ে। সাহিত্যে, সংগীতে, চিত্রকলায় কলেজি পারদর্শিতা কিছু দেখিয়েছিল। ওর কপচানির চাকচিক্যকে আমি রুচি বলে ভুল করেছিলাম। তাই যখন হামজা এসে বলল, ও আমার লেখার অনুরাগিণী, তখন সত্যি বলতে কি, আমি বেশ উল্লসিত হয়ে উঠেছিলাম। সারা দিন পরিশ্রম করে, প্রকাশকদের তেলিয়ে আমার সব ক’খানা বই এনে ওকে উপহার দিয়েছিলাম। ক’দিন পরেই আমি বুঝলাম, মেয়েটির মধ্যে কিছু নেই। একখানা বইও সে পড়েনি। 

(কিছুদিন পরে, আমার এক বন্ধু ফুটপাথ থেকে ওর নাম লেখা—আমার হস্তাক্ষরে—আমার একখানা বই আমার বিয়ের সময় উপহার দিয়েছিল। খুব উচ্চশ্রেণীর রসিকতা সন্দেহ নেই। আমার স্ত্রী বইখানা পেয়ে খুব দুঃখিত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, “উপহারের যে মর্যাদা দেয় না, সে কেমন মানুষ! “) 

মুকুলের হৃদয় বলে কোনও বস্তু আছে কি না, আমার সন্দেহ হত। “সে আমাকেও ভালবাসেনি, তোমাকেও না।” হামজা বলেছিল, “সে ছিল আত্মকামী। নিজেকেই ভালবাসত।” কত যে ফটো তুলেছে, উগ্র, অভব্য সব পোজে, তার ইয়ত্তা নেই। প্রতি শনিবার ওকে নিয়ে আমি আর হামজা কোনও-না-কোনও নামকরা স্টুডিওতে হাজির হতাম। ও প্রসাধন করত, পোজ মারত, এইসব সময় আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। ওকে আমার স্থূল, দেহসর্বস্ব যে দেহে কিছু নেই, শতকরা পঞ্চাশ ভাগই যার রাত্রে শোবার সময় হুকে টাঙিয়ে রাখতে হয়—বলে মনে হত। ওর চোখ দুটো ছিল আসল। এ চোখ যার সে তো সসাগরা ধরণীর অধীশ্বরী হতে পারে। ওর চোখ দুটো যেন ভাসত। 

সেদিনও শনিবার। আমি ওর মনের চেহারা দেখে ফেলেছি। স্বার্থপর, আত্মসুখপরায়ণা, সে ছিল আত্মরতিতে মগ্ন। আমি বিরক্ত, বিতৃষ্ণ হয়ে উঠেছি। ওর সঙ্গ, হামজার সঙ্গ আমার একটুও ভাল লাগছে না। এবারে উঠব, পালাব। বেলা দুটো বেজে গিয়েছে। অফিস-পাড়ার মৌচাকগুলো ভেঙে গিয়েছে। মৌমাছিরা ছড়িয়ে পড়েছে। ফুটবলের চ্যারিটি ম্যাচ, রেস, সিনেমা-থিয়েটার, বাড়ি যাবার ট্রেন। কলকাতার হৃৎস্পন্দন অতি দ্রুত চলেছে। আমিও উঠেছি। “এই” 

“এই.” দুটো চোখ আমাকে ডাকল, “আমাকে পৌঁছে দেবে না, দিদির বাড়িতে!” 

“সে আবার কোথায়?” 

“বাঃ!” দুটো চোখ অবাক হল। “সেদিন কথা হল না!” 

মনে করতে পারলাম না। দুটো চোখ অভিমানে ভারী হয়ে এল। আমার মুখের উপর টলটল করে ভেসে বেড়াতে লাগল। সম্ভবত আমি জেগে নেই। সুখস্বপ্নে বিভোর। 

“হামজা, তুমিই তবে চলো। আমাকে টালিগঞ্জে পৌঁছে দিয়ে আসবে।”

এই প্রথম আমি হামজার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হলাম। এই প্রথম আমার মনে হল, হামজা আমার প্রতিদ্বন্দ্বী। আমার সভ্য পোশাকের নীচে প্রস্তরযুগের সেই পুরুষটি সহসা ঘুম ভেঙে জেগে উঠল। সন্দেহের কুটিল ছায়ায় তার বন্য চোখ কালো হয়ে এল। চাপা স্বরে গর্জন করে উঠল। সম্ভবত হামজার মনেও এই প্রস্তরযুগের হিংস্র মানবটি জাগ্রত হয়ে থাকবে। গর্জন করে থাকবে। এবং প্রতিদ্বন্দ্বীর সামর্থ্য পরিমাপ করে কিছুটা ত্রস্ত হয়ে থাকবে। কারণ, প্রথম দিকে সে দ্বন্দ্ব-যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চায়নি। সে এই নারীকে নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে চাইছিল। আমার পুরুষটি পথ আগলে দাঁড়াল। সেই নারী এই যুযুধান দুই পুরুষের মধ্যবর্তী হয়ে বেছে নিতে পারছিল না, কাকে ফেলে কাকে রাখবে। ছলনা শুরু করল। একবার আমার গা ওঁকে হামজাকে উত্তেজিত করল, পরমুহূর্তে হামজার গা শুঁকে আমাকে খেপিয়ে তুলল। আমরা পরস্পরের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে হিংস্র দাঁত বের করে গর্জন করে উঠলাম। 

[হামজা : তবে চলো, ট্রামেই যাই। বেশ ভালই লাগবে। 

মুকুল : বেশ, সেই ভাল। (হামজার দিকে চেয়ে হাসল।) 

আমি : দূর, এখন ট্রামে-বাসে অফিসের ভিড়। চলো ট্যাক্সি নিই।

মুকুল : ট্যাক্সি! হ্যাঁ, ট্যাক্সিই ভাল। (আমার দিকে চেয়ে হাসল।)]

আমি খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠলাম। 

[আমি : তবে চলো, আর দেরি নয়। বরং ময়দানে একটু ঘুরব।

মুকুল : বেশ, সেই ভাল। (হাসল।) 

হামজা : না, না—আগে স্টুডিওতে চলো। 

মুকুল : স্টুডিওতে, আগে স্টুডিওতে। (হাসল।)] 

হামজা খ্যাক খ্যাক করে হাসল। আমাদের দুজনের হাসিই দস্তুর। আমাদের দেহ লোমশ। আমাদের নখরগুলি তীক্ষ্ণধার। দুটি পুরুষই বুঝল, অস্তিম সময় সমাগত। গুহার সংকীর্ণ পরিসর ছেড়ে আমরা—দুই আদিম পুরুষ আর এক আদিম ছলনা— উন্মুক্ত প্রান্তরে গিয়ে নামলাম। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে তখন মানুষের স্রোত তীব্রগতিতে বয়ে চলেছে। 

ট্যাক্সিতে ওরা দুজনে কী কথা বলছিল, আমি খেয়াল করিনি। আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম। মাঝখানে ছিল মুকুল, ও-পাশে হামজা, এ-পাশে আমি। আমার সামনে বুড়ো শিখ ড্রাইভার। একটা ছোট্ট আয়না। পিছনের রাস্তা আয়নাটায় মাঝে মাঝে ঢুকে পড়ছে। দু-একটা লাইট-পোস্ট, ময়দানের ঘাস, গাছ, রেলিং, দু-একটা মোটরগাড়ি। মোটর সাইকেলের আরোহী ফিরিঙ্গি সাহেব, তার পিছনে মেম, ভুজাওলা, পথচারী, গোরু, কামরত কুকুর, রেসের ভিড় আয়নায় ঢুকছে, ছিটকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ওরা—মুকুল আর হামজা—কথা বলছে, হাসছে। আমার মধ্যে প্রস্তরযুগের লোমশ পুরুষটা গজরাচ্ছে, হামজাকে ঠেলে ট্যাক্সি থেকে ফেলে দিতে চাইছে। 

হঠাৎ আমি চমকে গেলাম। সচেতন হয়ে চেয়ে দেখি, আমার চোখের নীচে পৃথিবীর সুন্দরতম দুটো চোখ ভাসছে। পদ্মপত্রে মুক্তোর মত দু’ বিন্দু ডাগর নীর টলটল করছে। আমার মস্তিষ্কের সব থেকে সেন্সিটিভ স্নায়ুগুলোতে মৃদু স্পন্দন শুরু হল। ঠোঁট দুটো নড়তে লাগল। গুনগুন করে আবৃত্তি করলাম, “ও দুটি চোখের তাৎক্ষণিকের পাব কী পরশ যৎসামান্য?” 

মুহূর্তে আমার ভিতরে সেই বন্য পুরুষটি আমাকে, কবিতাকে এক ঝটকায় দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিল। রোমশ দুটো হাত বাড়িয়ে চিরকালের চতুরালিকে তীক্ষ্ণ থাবায় আঁকড়ে ধরল। আমি দেখলাম, তার এই আরণ্যক আক্রমণে, তার শৌর্যের এই ভয়ংকর আত্মপ্রকাশে তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ভয়ে জড়সড় হয়ে পড়েছে। গলিতনখদস্ত স্থবির সিংহ বিবরে মুখ লুকিয়েছে। কোথাও কোনও প্রতিরোধ নেই। সম্ভবত এই হঠাৎ আক্রমণে হতচকিত হয়েই এক তাল নরম ছলনা তার বুকে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমর্পণ করেছে। তার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন দূর থেকেও শোনা যায়। 

তার চুলের গন্ধ আমার নাকের ঘনিষ্ঠতায় আসা মাত্র আমি যেন ঘুম ভেঙে জেগে উঠলাম। আমার ওষ্ঠপুটে তখনও পর্যন্ত বহিরাগত একটা অনুভূতির স্পর্শ লেগে রয়েছে। আমি মুকুলের দিকে চাইলাম। সেই সুন্দর চোখ দুটো কোথায় অন্তর্হিত হয়েছে। তার বদলে সাধারণ, অতি থার্ড ক্লাস একটা মেয়ের চোখ বোজা একটা সাদামাটা মুখ আমার চোখে এসে ধাক্কা খেল। ওকে হামজার দিকে সরিয়ে দিলাম। 

.

“ওহে, ভাল কথা,” মানুষ ও সমাজের সম্পর্কের ভিত্তি বিষয়ক আলোচনা ক্ষণকালের জন্য মুলতুবি রেখে হামজা আচমকা আমাকে বলল, “তোমার সেই বান্ধবীটিকে এখানে ক’দিন ঘোরাঘুরি করতে দেখেছি—কদিন স্বামীর সঙ্গে, একদিন একা। ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে যেভাবে তার চোখ টেবিলগুলোর উপর দিয়ে চলে যেত, তারপর দরজার দিকে সারাক্ষণ নিবন্ধ হয়ে থাকত, তাতে মনে হয়, কারও সঙ্গে দেখা করার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে উঠেছেন।” পরমুহূর্তেই হামজার কণ্ঠস্বর মানুষ আর তার সামাজিক সত্তার জটিল সমস্যার মধ্যে বেমালুম লোপ পেয়ে গেল। বুলার (এ বুলা না হয়ে যায় না) চোখ দুটোর চেহারা কেমন, মনে করতে পারলাম না। আমার স্মৃতির গুদামে বুলার চোখ দুটো নেই, ওর সম্পূর্ণ মুখটাও নেই, আছে শুধু একটা প্রোফাইল, একটা ফোলা ফোলা গাল, পাতলা চুলের জুলপির আবরণে গালের খানিকটা আলতোভাবে ঢাকা। এইটুকু মাত্র উপকরণ দিয়ে আমি একদিন আমার কল্পনার বুলার একটা পূর্ণাবয়ব মূর্তি নির্মাণ করেছিলাম। রথীনের বউ অন্ধকারে ঢাকা। অনেক দিন পরে এক একজিবিশনে রবীন্দ্রনাথের আঁকা একখানি প্রতিকৃতি দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম। আমার রথীনের বউয়ের কথা মনে পড়েছিল। সেই থেকে আমার স্মৃতিতে রথীনের বউ রবীন্দ্রনাথের ছায়াচ্ছন্ন প্রতিকৃতির মধ্যে ঝুলে আছে। “স্মৃতি কখনও মরে না” – রঙ্গচারী বেঁচে আছে তার এইরকম অজস্র উক্তিতে। সুশীলা প্রশান্তিতে, দুলু বিষণ্ণতায়, সরস্বতী তার দেহের মাদকতায়, মুংরি স্বচ্ছতায়, বলরাম আরণ্যক স্বভাবে, মুকুল কবিতার একটি লাইনে। 

আর রথীন বেঁচে আছে তার অন্তর্দ্বন্দ্বের যন্ত্রণার মধ্যে, যে যন্ত্রণা আমার সৃষ্টি, যে যন্ত্রণার মূলাধার আমি। অথচ এই সাদা কথাটা বুঝতে আমার যথেষ্ট দেরি হয়েছিল। রথীন ক্রমশ আমার দিকে এগিয়ে আসছিল, ক্রমশ আমাকে আঁকড়ে ধরছিল, আমাকে আশ্রয় করে ও উঠে দাঁড়াতে চাইছিল—এগুলোই যে লক্ষণ, আমার তখনকার কাঁচা মন সেটা ধরতে পারেনি। আমি এটাও বুঝতে পারিনি, সুদক্ষ হাফ-ব্যাক যেমন চতুর ফরোআর্দ্রকে গার্ড দিয়ে রাখে, রথীন তার বন্ধুত্বের আন্তরিকতা দিয়ে সর্বক্ষণ আমাকে সেইভাবেই আগলে আগলে রাখছে। পেনাটি লাইনের মধ্যে সে আর আমাকে কিছুতেই ঢুকতে দিতে চায় না। আমি যে এ কথা বুঝতে পারিনি, তার আর একটা কারণও ছিল। তার কারণ রথীনের সঙ্গ—তার সাহচর্য যে অকপট তা আমি আজও বিশ্বাস করি—আমাকে আনন্দের একটা প্রবল উল্লাসে ডুবিয়ে রেখেছিল। আমি এই সময় রথীনের সান্নিধ্যেই বেশী সুখ পেতাম। আমি ওকে নিবিড়ভাবে ভালবাসতে শুরু করেছিলাম। আমার সখ্য পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। তবু কেন জানি না, রথীন যদি ওর স্ত্রীর প্রতি বেশি মনোযোগ দিত, আমি ঈর্ষিত হয়ে উঠতাম। আমার মনে হত, রথীনের স্ত্রী বুঝি রথীনকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। রথীনের স্ত্রী যদি রথীনের প্রতি বেশি নজর দিত, তবে আমি ঈর্ষার দংশন অনুভব করতাম। মনে হত, রথীন বুঝি আমার প্রাপ্য থেকে আমাকে বঞ্চিত করছে। আমি তখন বাচ্চা ছেলের মতন কখনও রথীনের দিকে, কখনও তার স্ত্রীর দিকে এগিয়ে যেতাম। দুজনেই অধিকার করতে চাইতাম। এ যে এক অসম্ভব প্রয়াস, সে কথা তখনও একবারও মনে হয়নি। এমন কি, এ কথাও মনে হয়নি, আমার পক্ষে যা স্বাভাবিক, রথীনের পক্ষেও সেটা স্বাভাবিক হতে পারে। 

এটা কি নিতান্তই দৈব নয়, রথীন আমার থেকে কয়েক বছর আগে জন্মেছে, কয়েক বছর আগে রথীনের সঙ্গে তার বউয়ের যোগাযোগ হয়েছে? ওদের বিয়ে হয়েছে? এই নিতান্ত একটি দৈব ঘটনার যে ব্যাপারে আমার কোনও ত্রুটি ছিল না—জন্য আমি কেন রথীনের সখ্য থেকে, ওর স্ত্রীর ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হব? 

কিন্তু সাধারণত এসব প্রশ্ন আমার মনে উঠত না, ঈর্ষা সব সময় আমাকে ছোবল মারত না। আমার সুখটাই রথীনের সান্নিধ্যের উষ্ণতায়, ওর স্ত্রীর সংসর্গের তাপে উথলে উথলে উঠত। 

আর এক কারণ, আমরা দুজনেই কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। ধর্মঘট ক্রমেই এগিয়ে আসছে। আমাদের শান্তিপূর্ণ পথে মীমাংসার সূত্রগুলি একের পর এক কর্তৃপক্ষের বাজে কাগজের ঝুড়িতে গিয়ে জমছে। কর্তৃপক্ষ ধারণা করে রেখেছিলেন, এ ধর্মঘট হবে না—আমরা করতে পারব না। তাঁরা জানতেন, শ্রমিকশক্তি দুই শিবিরে বিভক্ত। তাঁরা জানতেন, আমরা আর কমিউনিস্টরা যুদ্ধের দুই প্রবল সমর্থক- পরস্পরের প্রবল শত্রু। তাই আলাপ-আলোচনার নামে আমাদের আলাদা করে ডেকে দুজনের গালেই চুমু খেতেন। তাঁরা এও জানতেন, আমরা আখেরি সিদ্ধান্ত নেবার কেউ নই। আমরা একটা বড় যন্ত্রের ছোট একটা অংশ মাত্র। তাঁরা শুধু এটা জানতেন না, আমরা আমাদের প্রচারের ফলে সমস্ত পরিস্থিতিকে এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছি, সেখান থেকে ফিরবার পথ আমাদেরও নেই। তাঁরা এটাও জানতেন না, এখন আর আমরা ঘটনার চালক নই, ঘটনার দ্বারাই আমরা চালিত হচ্ছি। আমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছি, মনে মনে ঘাবড়ে গিয়েছি। আমার উপরওয়ালারা নিশ্চিত্ত মনে চুপ করে আছেন। কমিউনিস্টরা ঘটনাকে আমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেবার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে। ওরা উপর থেকে চতুর সব রণনীতিবিশারদ আমদানি করেছে। আমরা সেখানে মুষ্টিমেয় ক’জন। তার মধ্যে সব থেকে কর্মঠ রথীন। আমি সর্বতোভাবে রথীনকেই আঁকড়ে ধরেছি। রথীন আমাকে আশ্রয় করেছে। 

ইউনিয়ন অফিসে, বাড়িতে সর্বক্ষণ আমাদের আসন্ন সংগ্রামের আলোচনা, সব সময় তারই পরামর্শ। রথীনের বউ দিনকতক কৌতূহলবশত এই আলোচনায় যোগ দিয়েছিল। তারপর বিরক্ত হয়ে উঠল। “ধর্মঘট আর ধর্মঘট, এ ছাড়া তোমাদের মুখে আর রা নেই গা! রাতদিন এই কচকচি ভাল লাগে মানুষের!” শেষে এমন হল যে, এই প্রসঙ্গ ওঠা মাত্র সে মারমুখো হয়ে উঠত। আমরা হাসতাম। ওর বউ রাগ করে ঘরে উঠে যেত। আমরা আরও হাসতাম। রথীন হাসতে হাসতে ওর বউকে ডাকত। কোনও কোনও দিন ওর বউ ঠাণ্ডা হয়ে বেরিয়ে আসত। কখনও গুম মেরে শুয়ে থাকত। তখন রথীন আমাকে বলত, “যা, তুলে নিয়ে আয়।” আমি ওকে আচমকা পাঁজাকোলা করে তুলে আনতাম। রথীনের গায়ের উপর ফেলে দিতাম। হাসির দমকে আবহাওয়া হাল্কা হয়ে যেত। আমি একটুও সন্দেহ করিনি, রথীন এতে জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। 

রথীন জানত, ওর মনের কথার আঁচ পেলে আমি ভয়ানক কষ্ট পাব। আমাদের এই সম্পর্কের বুনিয়াদ তখনই ধসে পড়বে। এটা তার পক্ষে কল্পনাতীত ছিল। সে আমাকে তীব্রভাবে ভালবাসত। “আসলে তখন তোকে আমি আর একদম সহ্য করতে পারতাম না।” রথীন, রথীনের অনুশোচনা, আমাকে একদিন জানিয়েছিল। “সে সময় আমার মনে হত, তুই, তুই আমার শনি। এমনও মনে হয়েছে, তোকে আমি সরিয়ে দেব। পৃথিবী থেকে তোর নাম আমি মুছে ফেলব। কিন্তু তোকে দেখলে আর সে কথা মনে থাকত না। সব বিদ্বেষ জল হয়ে যেত।” মৃত স্ত্রীর শূন্য বিছানার দিকে চেয়ে এক দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে রথীন বলেছিল, “কার উপর আমার বেশি মায়া তোর না ওর ওপর—তা কখনও ভাল করে বুঝে উঠতে পারিনি।”

“আক্রোশে অস্থির হয়ে বউকে অনেক দিন ঠেঙিয়েছি। তোকে খুন করব বলে ছোরা পকেটে করে ঘুরেছি, তোর গায়ে আঁচড় কাটাতে পারিনি।” রথীনের শোকার্ত চোখ দিয়ে জলের মোটা ধারা গড়িয়ে পড়েছিল। “আমার বউ এসেছে আগে, তুই এসেছিলি পরে, অনেক পরে। কিন্তু তোকে ভালবেসেছি আগে, বউকে তার পরে, অনেক পরে। তুই না এলে, না থাকলে, বুঝতেই পারতাম না আমার বউ আছে, বউয়ের মায়া কী তাও জানতাম না।”

এখন আমি আগেকার একটা ঘটনার মানে বুঝতে পারলাম। রথীন, ডিউটিতে যাবে, ভিতরে জামা-কাপড় পরছে। আমি বাইরে প্রহর গুনছি। হঠাৎ রথীনের বউ আঁতকে উঠল, “আরে বাপ, এটা কী গো? ছো—” 

“চুপ!” আমার মনে হল, রথীন ওর বউয়ের মুখ চেপে ধরল। আমি আপন খেয়ালে প্রহর গুনছি : এই রাত আমার হবে, এই ঘর আমার হবে। এই অন্ধকার আমার হবে… 

রথীন ঝড়ের মত বেরিয়ে গেল। কোনওদিকে চাইল না। রাত্রে ওর বউ প্রবল তরাসে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ওক পকেটে ছোরা, ছোরা কেন? ছোরা কেন? আমার ভয় করছে। ভয় করছে।” 

“তোমার সব তাতেই ভয়! ভূতের ভয়, ছোরার ভয়!” ঠাট্টা করেছিলাম। “ভয়ের ঘায়ে মুর্ছাই যাও খালি!” 

‘তোমার ভয় করছে না?” 

“না।”

“তোমার পকেটেও ছোরা আছে নাকি?” 

“আমার আবার ছোরা দিয়ে কী হবে? এক বাড়িতে একটা ছোরাই যথেষ্ট।”

এ কথার পর দেখলাম ওর হৃৎস্পন্দন শান্ত হয়ে এল। রথীনের বউ তা হলে ঠিকই আন্দাজ করেছিল। ও অনেক কিছুই বুঝত।

আসলে রথীন আগাগোড়া অভিনয় করে গিয়েছে। ওর মনের ভাব আমাকে একবারও জানতে দেয়নি। রথীনের বউও আমাকে কিছু বুঝতে দেয়নি। সেও সুন্দর অভিনয় করেছে। 

“সত্যিকারের প্রেমিক যে, পাকা অভিনেতাও সে।” হামজা একদিন বলেছিল। 

আমি কি সত্যি সত্যিই কিছু বুঝতে পারিনি? আমিও কি না বোঝার অভিনয় করিনি? নাকি আমার ভালবাসায় খামতি ছিল? এতদিন পরে এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া কঠিন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *