মনের বাঘ – ১

প্রথম অংশ 

এই বন অন্ধকার, এই মন অন্ধকার, এই বন ভয়ংকর, এই মন ভয়ংকর, এই বনে বাঘ আছে, এই মনে বাঘ আছে… “বনের বাঘেই শুধু খায় না, জানো, মনের বাঘেও খায়।” আমাকে শক্ত হাতে তার দেহের অনাবৃত অভ্যন্তরে টানতে টানতে, কাঁপা-কাঁপা স্বরে সে বলেছিল। সে কাঁপছিল। আমিও। আমার দেহের রক্ত মাংস মজ্জা অণু পরমাণু ভাঙা থার্মোমিটারের পারদের মত তীব্র গতিতে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে চাইছিল। আমি প্রাণপণ চেষ্টায় এই অনিবার্য ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঠেকাতে চাইছিলাম। বাঁচতে চাইছিলাম, বাঁচতে চাইছিলাম। আমার শরীরী অস্তিত্বের জোড়গুলো যাতে খুলে খুলে না পড়ে, তার জন্য আমার সচেতন প্রয়াসের অন্ত ছিল না। তার শরীরে প্রচণ্ড আক্ষেপ, ভয়াবহ থরথরানি। এক প্রচণ্ড বিপ্লবের (এক নিথর তক্তপোশে, নিষ্প্রাণ বিছানায় নগ্ন দুটো অস্তিত্বের একান্ত সংস্পর্শে কী প্রলয়ংকর বিপ্লবই না সংঘটিত হতে পারে!) মুখোমুখি হয়ে সেও বুঝি নিশ্চিহ্ন হতে বসেছিল। সেও তাকে বাঁচাতে চাইছিল। সে অসহায়। আমিও অসহায়। সে তার নিষ্ঠুর নিয়তির হিংস্র থাবার গ্রাসে বন্দি হয়ে কবুতরের মত ছটফট করছিল। আমিও। আমিও। তাই, সেই বিপর্যয়ে, আমার দেহটাকে একমাত্র অবলম্বন জেনে সে কঠিনভাবে আঁকড়ে ধরেছিল। ক্রমশ তার আলিঙ্গন কঠিনতর হচ্ছিল। আমারও বুঝি সেই মুহূর্তে সে ছাড়া আর দ্বিতীয় অবলম্বন ছিল না। আমি তার দেহে সান্ত্বনা খুঁজছিলাম। শান্তি শান্তি শান্তি। 

“তুমি একটা গাড়োল!” হামজা আমাকে ধমক দিয়েছিল। “তুমি একটি বোকা-বোকা পাঁঠা। এ জগতে শান্তি কোথায়? কোন্ সৎ লোক শাস্তি চায়? ধাপ্পাবাজ, মতলবি লোকদের পলিটিক্যাল শ্লোগান ছাড়া শান্তির অস্তিত্ব আর কোথায় আছে? হ্যাঁ, আর আছে শ্মশানে কবরে — সেই হল শান্তির আলয়। তার জন্য কার মাথাব্যথা! অশান্তি বিশ্বের জনক, জীবনের নিয়ামক। সত্যদ্রষ্টা মাত্রেই এ কথা জানে।” ছোট ব্রিস্টলের বেয়ারা মদের বিল বের করে দাঁড়াতেই হামজা বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। “এখন মাসের শেষে এত পয়সা কোথায় পাব?” পকেট ঝেড়ে সে যা বের করল তাতে সিকি দেনাও মেটানো যায় না। “বাকিটা তুমি দিয়ে দাও।” বলে কালক্ষেপ না করে, তার হিলহিলে লম্বা দেহটা সটান বেরিয়ে চলে গেল। 

হামজার কথা মনে পড়লেই আমার চোখে এরকম অনেক দৃশ্য ভেসে ওঠে। পরিষ্কার ছায়াছবি। সমস্ত খুঁটিনাটি আমি মনে করে রেখেছি। অথচ কী আশ্চর্য, তার কথা প্রায় কিছুই মনে করতে পারিনে। অথচ সে-ই আমাকে প্রথম নারীদেহ সফর করার ছাড়পত্রে মঞ্জুরি-মোহর দিয়েছিল। আর সে-ই এখন আমার মনে এত আবছা হয়ে গেছে তার আর আমার জগতের মধ্যে একখানা ঘষা কাঁচের দেওয়াল দাঁড়িয়ে গিয়েছে। তাকে দেখতে পাচ্ছিনে, তা নয়। দেখছি পুরু ঘষা কাঁচের মধ্য দিয়ে। সে আছে ও-পিঠে, নড়ছে-চড়ছে ঘুরছে-ফিরছে। ক্বচিৎ মনে পড়ছে বুঝি সে-ই। এই যেমন উপরের ঘটনাটা মনে পড়ল। তার সংলাপটা মনে পড়ল : “বনের বাঘেই শুধু খায় না, জানো, মনের বাঘেও খায়।”

‘মনের বাঘ’ কথাটা যে তার মুখেই প্রথম শুনি, তা মনে আছে। তার স্বামী, তার শ্বাশুড়ির কথা কিছু কিছু মনে আছে। সব থেকে বেশি মনে আছে তার ঝুমরোচুলো ছোট্ট বিলিতি কুকুরটার কথা—জিমি। নামটাও মনে আছে। “জিমি, জিমি, এই খবরদার—” জিমি যখন আমার হাত কামড়ে রক্ত বের করে দিয়েছিল, তখন তাকে ধমক মেরেছিল সে। সে কথা আমার মনে আছে। তার ঘরে আয়োডিন ছিল না, ডেটলের জন্ম সে যুগে হয়নি। তাই আমার হাতটা সে খপ করে তার মুখে পুরে চুষেছিল। তার মুখের লালার প্রলেপ দিয়ে আমার ক্ষতের জ্বালার উপশম করেছিল। “জিমি, জিমি, অসভ্য জানোয়ার কোথাকার!” 

জিমির নাম আমার মনে আছে। অথচ, আশ্চর্য, তার মালিকের নাম একেবারে ভুলে গিয়েছি। অথচ হামজার নাম, তার স্মৃতি কত স্পষ্ট, কত উজ্জ্বল! আমি কি তবে সমকামী? 

.

হামজা বলেছিল, বাঙালিরা স্বভাবত সমকামী, হোমোসেক্সুয়াল। বয়ঃপ্রাপ্ত হবার পরও পুরুষরা পুরুষের ন্যাওটো আর মেয়েরা মেয়েদের ন্যাওটো ছাড়াতে চায় না। “তোমাদের যৌনজীবন সুস্থ সহজ নয়, অস্বাভাবিক।” এই উক্তির পর আমার মনে আছে, হামজার পেয়ারের অনেক বন্ধুই তার মুখদর্শন করে না। কলকাতার সমাজে সে ধোপা-নাপিত-বন্ধ-প্রায়। কিন্তু আমার মনে হয়, কথাটা ভাল করে বিচার করে দেখা উচিত। সত্যি, কলকাতায় সারা দিনে, কি কর্মক্ষেত্রে, কি অবসরে, আমরা কতটুকু মেয়েদের সান্নিধ্যে আসি? ক’টা মেয়ের পুরুষবন্ধু আছে? আমার স্ত্রী গ্রামের মেয়ে, স্বল্পশিক্ষিত—এটা তার ধারণার বাইরে। আমার বোন এম এ পাস—এটা তারও ধারণার বাইরে। আমার ক’জন বান্ধবী? কলকাতার স্বল্পবিত্ত শিক্ষিত বাঙালি সমাজ—দু’ শো বছরে যে এক পা-ও এগোয় নি, এ কথা কেউ আমাদের বলছে না। তাই পুরুষরা পুরুষের কাঁধ ঘষে আর মেয়েরা মেয়েদের কাঁধ ঘষে এখানে সময় কাটায়। আমি অনেকবার আমাদের ক্লাবে পারিবারিক মেলামেশা ঘটাবার চেষ্টা করেছি। দেখেছি মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত জনতা দু’ ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে—গ্রামীণ সংস্কারই প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। প্রগতিয়ানা উপরের কাঁচা পালিশ মাত্র। আমার ধেড়ে ধেড়ে সহকর্মীরা যখন আমার স্ত্রীকে হাত তুলে নমস্কার করে “এই যে বউদি, ভাল আছেন” বলত, তখন বিরক্তিতে আমার গা জ্বলে যেত। লোকগুলোর এই নাড়ুগোপাল-নাড়ুগোপাল ভাব অসহ্য লাগত আমার। “দেখ, তোমাদের কলকাতার সমাজে যত মা-মাসি-দিদি-বউদি-তন্ত্র, এমন আর কোথাও নেই।” হামজা বলেছিল। “এই বউদি-তন্ত্র যে তোমাদের বিকারগ্রস্ত মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন, এটার সম্পর্কেও তোমরা সচেতন নও। তোমাদের মেয়েরা দাদা ভজনা করে, তোমরা দিদি বউদি ভজনা করো।” হামজা এর নাম দিয়েছিল ‘বউদিকা’। সেদিন যে ওর মাথায় বোতল ভাঙেনি, সে এই কারণে যে, অন্য লোকের তখন আর বোতল তোলবার ক্ষমতা ছিল না। 

যে চটে চটুক, আমি স্বীকার করতে বাধ্য, হামজার দেখবার চোখ আছে। এবং তার নিরীক্ষণলব্ধ উক্তির মধ্যে অনেকখানি সত্য বস্তু আছে। আচ্ছা, আমি তাকে কী বলতাম? বউদি? এখন ঠিক মনে পড়ছে না। তবে স্বীকার করা ভাল যে, আমিও এই সংস্কারেই মানুষ। 

*

হামজার পূর্বপুরুষ কাফ্রি ছিল সন্দেহ নেই। ওর ঘন কৃষ্ণবর্ণ গায়ের রং, ওর ঈষৎ পুরু ঠোঁট, কোঁকড়া চুল ওর নিগ্রোবটুত্বকে প্রকট করে তুলেছে। “আমরা কলকাতার আদি বাসিন্দা। আমার পূর্বপুরুষ ১৭৬৩ সালে ওলন্দাজ জাহাজের দাঁড় টেনে ভাগীরথীর মোহানায় ঢুকেছিল। ইংরেজদের জাহাজকে সুতানুটির ঘাটে ভিড়তে সাহায্য করেছিল। সেই থেকে আমরা কলকাতার বাসিন্দা। মেটেবুরুজে আমাদের পরিবারের কবর আছে। সেখানে বহু হামজার হাড় কয়েক শতাব্দী ধরে মাটিতে জান্তব ফসফেট উৎপন্ন করছে।” পরিষ্কার টনটনে স্বরে হামজা যখন এই কথা বলত, তখন আমার মনে হত, যেন কলেজের ক্লাস-ঘরে ইতিহাসের অধ্যাপকের লেকচার শুনছি। “তবু,” তার হতাশ স্বর আমি বহুদিন শুনেছি, “এই কলকাতায়, নিজ দেশে আমি পরবাসী। আমার থেকেও তোমরা, কতকগুলো আপস্টার্টরা, কলকাতার উপর কায়েমি স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করে বসে আছ। তোমাদের সমাজে আমাকে প্রবেশাধিকার দিলে না, আমার হাত থেকেও কলকাতাকে কেড়ে নিলে।” সিংহের দাঁতে ধার, সিংহের নখে ধার, চোখে তার মৃত্যুর রোশনাই, হে ই ডি হা ই ডি হা ই—হামজাকে এই সময় দেখলে আমার কেন জানিনে প্রেমেন মিত্রের এই কবিতাটা মনে পড়ে। হামজার ভিতর কোথাও একটা ধারালো সিংহ লুকিয়ে আছে। ও যেন এক গভীর অরণ্যের রহস্য। 

এখন গভীর রাত্রি। অমাবস্যার তামস আবরণে আবৃত মধ্যপ্রদেশের এই রুক্ষ অরণ্য—আমরা এখন যেখানে আছি। আমি কলকাতা থেকে, রঙ্গচারী দিল্লি থেকে—আমি আর রঙ্গচারী দুজনেই খবরের কাগজ থেকে। আমি এসেছি এই অরণ্যে উদ্বাস্তু বসত কেন হচ্ছে না, সরকারের কোথায় গাফিলতি, সে সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে; রঙ্গচারী এসেছে উদ্বাস্তু বসতের সুযোগ করে দিতে এই অরণ্যের আদিম অধিবাসীদের কীভাবে উৎখাত করা হচ্ছে, সে তথ্য সংগ্রহ করতে। আমার আর রঙ্গচারীর লক্ষ্য এক—ব্যানার হেডিং-এর খোরাক সংগ্রহ করা; আমার নিয়োগকর্তা আর রঙ্গচারীর নিয়োগকর্তার স্বার্থ এক—পাঠককে খুশি করা। আমার আর রঙ্গচারীর মধ্যে কোনও বিরোধ নেই একই জায়গায়, একই সঙ্গে আছি, একই হ্যাণ্ড-আউট দুজনে সংগ্রহ করেছি—আমাদের বৃত্তির কাঁচামাল এই সরকারি হ্যাণ্ড-আউট, রিটায়ার্ড আই সি এস-এর পাটোয়ারি মস্তিষ্কের কণ্ডূয়নে প্রস্তুত—আমাদের হাতের ছোঁয়াচ লেগে ফিনিশড্ প্রোডাক্ট হিসাবে এটা যে-চেহারা নিয়ে বাজারে বের হবে, তাতে আমি জানি, কলকাতার একটা সকাল সরগরম হবে, রঙ্গচারী জানে, দিল্লির একটা সকাল সরগরম হবে; আর, পি আই বি-র ক্লিপিং নানা ফাইল ঘুরে যখন রিটায়ার্ড আই সি এস-এর হাতে এসে পড়বে, তখন তাঁর চক্ষু চড়কগাছে উঠবে। আমার আর রঙ্গচারীর মধ্যে কোনও বিরোধ নেই—আমরা একসঙ্গে ঘুরছি, এক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছি, যেন একে অন্যের প্রতিধ্বনি। এখন রঙ্গচারী নেই—সে নিরামিষভোজী, মাছ মাংস ডিম খায় না, মদ খায়, স্ত্রীলোকে তার আসক্তি নেই—তার মদ ফুরিয়েছে, স্থানীয় এক লোকের সঙ্গে একটু দূরে গিয়েছে, গ্রামে, স্থানীয় আদিবাসীদের মৌরি পচিয়ে তৈরি ঝাঁঝালো মদ আনতে, আর যদি পারে, সে বলে গিয়েছে, বাকি ক’টা রাতের জন্য ভাল দেখে একটা ছোকরাও আনবে। দিল্লি ছেড়ে এসে বড় কষ্ট পাচ্ছে রঙ্গচারী, দিল্লিতে ওর ভাল একটা ছোকরা আছে, জনৈক প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর খাস ছোকরা। আমি একা বসে আছি, চলমান এক ‘ক্যারাভানে’, জনৈক প্রাক্তন অধিকর্তা (অভ্যন্তরীণ চক্রান্তের ফলে তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়েছে) এটা অনেক টাকা খরচ করিয়ে কিনিয়ে এনেছিলেন। আমার এক সহকর্মী বছর খানেক আগে এখানে এসে এই সম্পর্কে এমন কড়া করে লিখেছিলেন যে, কোনও অফিসার আর এটা ব্যবহার করতে সাহস পাননি—আমরা এখন দুজনে সেটা ভোগ করছি, আপাতত আমি একা, আমি আর এক রাত্রি আর নিশ্ছিদ্র অমাবস্যা আর অরণ্য, এই বহু যুগের আদিম অরণ্য- যে অরণ্যকে বেপথু রাত্রি গভীর আশ্লেষে আলিঙ্গন করে আছে। 

আমিও কামপীড়িত হয়ে উঠেছি। আদিম ক্ষুধার নিরন্তর দংশনে আমি অস্থির হয়ে উঠেছি। আমি অন্ধকারের প্রেমে অন্ধ। অমাবস্যা আমার রক্ষিতা। 

.

কলকাতায় এমন রাত্রি আসে না, তিমির-অবগুণ্ঠনে বদন ঢেকে এমন প্রগাঢ়, এমন নিষ্কলুষ অমাবস্যা প্রবেশের পথ পায় না, মূর্খ আলোর কোলাহলে ভয় পেয়ে স্বৈরিণী অন্ধকার মাঝপথে থমকে দাঁড়ায়, ফিরে যায়, এমন প্রবল কাম সেখানে শরীরে ঢল নামাতে পারে না। “কাম প্রেম নয়, বাবা, প্রেমের বসত কামে। কাম যেখানে নেই প্রেম সেখানে বসবে কোথায়?” এক সহজিয়া বৈষ্ণবীর মুখে এ কথা শুনেছিলাম। “মিঠে পেতে হলে এঁটো খেতে হবে, বাবা, অন্য উপায় নেই।” কলকাতায় প্ৰেম আলোর তাড়নায়– দিনেও আলো, রাতেও আলো—উদ্বাস্তু হয়েছে। তাই সুশীলা (সে এখন ডাঃ সুশীলা নাগ) মধ্যপ্রদেশের এই অরণ্যে এসে তার দয়িতকে খুঁজে পেয়েছে। এখানকার রাত্রি নিটোল, এখানে অন্ধকার বড় গাঢ়। হাজার হাজার বছর ধরে এই কামুক অরণ্য অন্ধকারকে লালন করে এসেছে। এখানে কাম এক নিরাপদ গুহা। এখানে প্রেম বড় শক্ত ভিতে স্থাপিত। সে কথা মুংরিকে দেখেই বোঝা যায়। মুংরি মুণ্ডা এই বনের মেয়ে। ধরমকোটে তাকে আমি দেখেছিলাম। সুশীলা বলেছিল, “এই মেয়েটির কাছে আমি যা শিখেছি সেই আমার আসল শিক্ষা।”

মুংরি মুণ্ডা অদ্ভুত মেয়ে। ওর পরিচ্ছন্নতা দেখবার মত। সারা শরীরটা চিকচিক করছে। নিটোল কালো রং যেন পিছলে পিছলে পড়ছে। পরনের কাপড়টা ধবধবে ফর্সা। যে ঝুড়িতে করে পণ্য বেচতে আনে সেটা নতুনের মত। মুংরি আলু আনে, সেগুলোতে পর্যন্ত ময়লা থাকে না। ডিম আনে নির্মল। মুরগি আনে ধোয়াপাখলা। সপ্তাহে দুবার করে ধরমকোটে আসে গ্রাম থেকে। আলু বেচে, ডিম বেচে, মুরগি বেচে, দেহ বেচে, পয়সা নিয়ে ঘরে ফিরে যায়। ঘরে তার স্বামী আছে, সংসার আছে। অটুট সংসার। মুংরির কোনও জিনিস সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করলে খেপে যায়। মারমুখো হয়ে বলে, “চোখ আছে তোর, দেখে নে না। আমার কাছে খারাপ জিনিস কিছু পাবি না, বাবু।”

“আমি নিজে ওদের সংসার দেখেছি, নানাভাবে—আদর্শ সংসার। ওর স্বামী আর ওর মধ্যে গভীর প্রেম। প্রেম বললে কিছুই বলা হয় না, মুংরি আর ওর স্বামী বুধন দুজনে মিলে একটা সত্তা পরিপূর্ণ করেছে। ওরা মনস্তত্ত্ব বোঝে না। দর্শনতত্ত্বের ধার ধারে না। আমি কতদিন ধরে বুঝতে চেষ্টা করেছি, খুঁজতে চেষ্টা করেছি, কী সে মন্ত্র, যার বলে ওরা এমন বলীয়ান।” সুশীলা বলেছিল, “অনেক দিন পরে সে রহস্যের সন্ধান পেয়েছি। জীবনটা ওদের কাছে সবচেয়ে বড়। ওরা ওদের মত করে জীবনটা গড়ে তুলেছে। জীবন আর অগাধ স্বাধীনতা, ওরা যা কিছু মূল্য এ দুটোকেই দেয়। আর সব ওদের কাছে তুচ্ছ।”

“দ্যাখো,” সুশীলা আর একদিন আমাকে বলেছিল, “আমাদের ধারণাগুলো কত অসম্পূর্ণ। যৌন ক্ষুধাও যে জৈব ক্ষুধা, পেটের ক্ষিধের মতই শরীরী প্রক্রিয়া মাত্র, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে এটা প্রমাণসিদ্ধ হলেও আমরা গ্রহণ করতে পারিনি। গ্রহণ করছিনে। একজন পুরুষের অঙ্কশায়িনী হলেই আমি সতী আর এর ব্যত্যয় ঘটলেই আমি অসতী, এ নিয়ম আমরাই যে বর্জন করে দিয়েছি, তাও আমরা জানিনে। বিচ্ছেদের অধিকার, ইচ্ছামত স্বামী নির্বাচনের অধিকার আমাদের সংবিধানে গ্রহণ করেছি। তবু আমরা সেকেলে, বাতিল সংস্কারবশেই চলব। আর সব জিনিস ছেড়ে দিয়ে এখনও আমরা সব নজর একটি মাত্র স্থানে নিবদ্ধ রেখেছি : একই লোক একটি মাত্র পেটিকোটের বাঁধন খুলেছে কি না। এর ফলে জীবনটাই যে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, সেটা বোঝবার ক্ষমতাও আমাদের নেই। 

*

এই সেই সুশীলা, কয়েক বছর আগে যে মেডিক্যাল কলেজে পড়ত, যে ছিল কলকাতার মেয়ে, সমস্ত কলেজ-জীবনটা যে অধ্যাপকের সঙ্গে ক্লাসে ঢুকত, অধ্যাপকের সঙ্গে বেরিয়ে যেত, একদিন রাত্রে এমার্জেন্সির ডিউটিতে এক সহপাঠী (ওরা দুজনেই সেরা ছাত্র ছিল) আবেগভরে জড়িয়ে ধরেছিল, চুমু খেয়েছিল যাকে, তারপর যার লিখিত অভিযোগে ছেলেটি রাসটিকেটেড হয়, পরে পটাসিয়াম সায়ানায়েড খেয়ে আত্মহত্যা করে, লিখে রেখে যায়, যা সবাই লেখে : “আমার মৃত্যুর জন্য কেহ দায়ী নহে।” এ ব্যাপার নিয়ে কলকাতায় খুব হইচই হয়। এতটা সোরগোল পড়ত না, যদি না তিন দিনের মাথায় সুশীলাও আত্মহত্যা করতে যেত। সুশীলা মরেনি, সময়মত হস্তক্ষেপের ফলে সে বেঁচে গিয়েছিল। ওকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন ওরই এক অধ্যাপক। সুস্থ হয়ে ক্লাসে যোগ দেবার দিন সকলের সামনেই ওকে ধমক দিয়েছিলেন, ‘ডোন্ট বি সিলি, সুশীলা! আবেগের এত বশীভূত হলে কি চলে?’ তখন নানা কথা রটনা হয়েছিল সুশীলা সম্পর্কে। কেউ বলেছিল, সুশীলাও ছেলেটিকে ভালবাসত। সুশীলার সম্মতি নিয়েই ছেলেটা অতখানি এগিয়েছিল। তলে তলে আরও অনেক দূর। তবে সেদিন অন্যের চোখে কাণ্ডটা ধরা পড়ে যায়। তাই সুশীলা সাধু সাজতে গিয়ে অধ্যক্ষের কাছে নালিশ করেছিল। আবার কেউ বলেছে, না, ছেলেটি ওকে অপমান করার জন্যই এই কাজ করেছে। সুশীলা ছেলেটির প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটার যে এই রকম মর্মান্তিক পরিণতি হবে সুশীলা তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, সম্ভবত অনুশোচনার তাড়নাতেই সে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। এই শেষোক্ত ভাষ্যটাই সম্ভব বলে আমার মনে হয়েছিল। 

সেই সুশীলা! সেদিন তার মুখে এইরকম জ্ঞানগর্ভ কথা শুনে অকস্মাৎ পুরনো প্রসঙ্গ তুলে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “অনুরূপ ঘটনা বা দুর্ঘটনা আজ যদি তোমার জীবনে ঘটে তবে তুমি কি কর, সুশীলা?”

“নিশ্চয়ই আত্মহত্যা নয়। সে সাফ জবাব দিয়েছিল। পুরনো কৌতূহল নিবৃত্তির আশায় আবার তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, “তুমি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলে কেন? তখন তো অনেক গুজব রটেছিল – কোনটা ঠিক?” সুশীলা জবাব দিয়েছিল, “তোমরা যা শুনেছিলে অর্থাৎ যা যা রটেছিল তার কোনওটাই ঠিক নয়। আসল কারণটা বাইরের কেউই জানে না—জানি আমি, বাবা, মা, কাকা আর পেড্রিয়াট্রিসের অধ্যাপক মশাই।”

“সেই অধ্যাপক যিনি তোমার অত সেবাযত্ন করেছিলেন?”

“হ্যাঁ, পরে একটা দার্শনিক লেকচারও দিয়েছিলেন।”

নিস্পৃহ, নিরুত্তাপ গলায় সুশীলা কাহিনীটা বিবৃত করে গেল : 

“সকালের কাগজে সুবোধের আত্মহত্যার খবরটা পড়েই আমি ভয়ানকভাবে মুষড়ে পড়েছিলাম। যদিও কোনও কাগজে নামটা বের হয়নি, তবু আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এ সুবোধ, সুবোধ ছাড়া আর কেউ নয়। ওকে রাটিকেট করা হবে আমি তা ধারণা করতে পারিনি। সত্যি বলতে কি, ওকে আমি অপছন্দ করতাম না। কিন্তু ওর সেদিনকার অসভ্যতা—সেদিন সেটা অসভ্যতা বলেই আমার মনে হয়েছিল, তখন ও পর্যন্ত মধ্যবিত্ত ট্যাবু-শাসিত সংস্কারের দ্বারা আমি আচ্ছন্ন ছিলাম—আমার আপাদমস্তক আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। তাই নালিশ করেছিলাম অধ্যক্ষের কাছে। তখন যদি আমি জানতাম, এর ফলে ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে তা হলে নিশ্চয়ই আমি নালিশ করতাম না। ওর বহিষ্কারের খবর পাওয়ার পর থেকেই আমার মনটা সাংঘাতিক খারাপ হয়ে ছিল। তারপর এই মর্মান্তিক পরিণতির সংবাদটা আমাকে ধরাশায়ী করে দিল। আশ্চর্য, সেই মুহূর্তে আমার এ কথাই মনে হয়েছিল, আমি যাকে আমার নারীত্বের অপমান বলে মনে করেছিলাম সেটা কিছু না, এমন কিছু না, কিচ্ছু না। দুপুরবেলাতেই পাকা খবর পেলাম, ও সুবোধই। সুবোধ আত্মহত্যা করল আমারই জন্য। আমিই দায়ী, আমিই দায়ী। তারপর থেকে আমার ক্রমাগত বমি হতে লাগল। শুধু বমি। আমার বাবা-মা অস্থির হয়ে উঠলেন, ভয় পেয়ে গেলেন সাংঘাতিক। ডাক্তার ডাকতে চাইলেন, আমি কিছুতেই সম্মতি দিলাম না। খবর পেয়ে কি না জানিনে, সন্ধের সময় অধ্যাপক মশাই এসে হাজির হলেন। বাবা-মা যেন অকূলে কূল পেলেন। তাঁকে নিয়ে আমার ঘরে এসে হাজির হলেন। তখন আমার আর কিছু করবার অবস্থা নেই। মাথা তুলে বসতে পর্যন্ত পারছিনে। আমার নাড়ি টিপে, বুক ঠুকে, তিনি বাবা-মাকে আশ্বস্ত করলেন, স্নায়বিক বিপর্যয়, এমন মারাত্মক কিছু নয়। তবে আমাকে এইভাবে একা একা বসে মনে মনে গুমরোতে দিলে তার ফল খারাপ হতে পারে। উনি প্রস্তাব করলেন, আমাকে নিয়ে বেরোবেন। ওঁর ক্লিনিকে গিয়ে ওষুধ খাইয়ে ময়দানে খানিকটা ঘুরিয়ে দিয়ে যাবেন। তা হলেই আমি সুস্থ হয়ে উঠব। বাবা-মা সানন্দে সম্মতি দিলেন। আমি দুর্বল শরীরে উঠলাম। হাতে পায়ে বল পাচ্ছিলাম না। সব শরীরটাই থরথর করে কাঁপছিল। বাবার বয়সী অধ্যাপকের গাড়িতে গিয়ে বসলাম। ক্লিনিকে যেতে যেতে, উনি আমাকে বোঝালেন, আমার এই অপরাধবোধটি মন থেকে মুছে ফেলতে হবে। সুবোধ যা করেছে তার জন্য আমার কোনও দায়িত্ব নেই। ক্লিনিকে গিয়ে নিজেই একটা মিকশ্চার তৈরি করে খেতে দিলেন। একটু পরেই আমি ধাতস্থ হলাম। উনি খুব খুশি হলেন। তারপর আমরা ময়দানে অনেকক্ষণ হাওয়া খেলাম। সত্যিই আমার খুব উপকার হল। মানসিক অবসাদ দূর হল। আবার উনি আমাকে নিয়ে ক্লিনিকে এলেন। আবার একটা ওষুধ খেতে দিলেন। আমার শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। উনি বললেন, শুয়ে পড়ো, খানিকক্ষণ শুয়ে থাকো। আমি একটা রোগীর খাটে শুয়ে পড়লাম। উনিই যত্ন করে শুইয়ে দিলেন এবং তারপর আমাকে ধর্ষণ করলেন। তারপর… তারপর সেদিন আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া অন্য কোনও ইচ্ছা হয়নি।”

“অবশ্য”, সুশীলা বলল, “সেদিন আত্মহত্যা করলে চরম মূর্খামি হত। অসম্পূর্ণ জ্ঞান, জগতের প্রতি অহেতুক একটা বিদ্বেষ নিয়ে মরতে হত। সার্থকতায় পৌঁছাতে পারতাম না।”

অনেকটা এ ধরনের কথা সে-ও আমাকে বলেছিল। সে ডাঃ সুশীলা নাগের মত এত বিদুষী ছিল না। লেখাপড়া জানত কি না কে জানে! ফার্স্ট ফায়ারম্যানের বউয়ের পক্ষে লেখাপড়া না জানাই তো স্বাভাবিক। প্রথম রাত্রির আকস্মিক সেই অভিজ্ঞতার পর, তার দিকে আর চোখ তুলে চাইতে পারিনি। ভোরবেলায় দরজা খুলে চোরের মত পালিয়ে গিয়েছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, এইমাত্র বুঝি একটা নর্দমা থেকে উঠে এসেছি। মনে পড়ছিল, আমি বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। আমার মরাই ভাল। আমার মরাই ভাল। একুশ বছরের এক বিচারক, একুশ বছরের এক আসামিকে সাজা দিলে—মৃত্যুদণ্ড। আমার মরাই ভাল, আমার মরাই ভাল। ভেবেছিলাম রেল-ইঞ্জিনের তলায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ব। লালমণিরহাটে যুদ্ধের সময় ইঞ্জিনের প্রাচুর্য খুব ছিল। প্ল্যাটফর্মে ইঞ্জিন, ইয়ার্ডে ইঞ্জিন, লোকো শেডে ইঞ্জিন, লাইনে ইঞ্জিন। আমার মরাই ভাল। মরাই ভাল। মরাই ভাল। ইঞ্জিনের চাকায় চাকায় কতবার এই কথা ধ্বনিত হল : মরাই ভাল। মরাই ভাল। কতবার চলন্ত চাকার কাছাকাছি এগিয়ে গেলাম। তবু শেষ পর্যন্ত ঝাঁপ দিতে আর পারলাম না। ভীরু, কাপুরুষ, লম্পট; নিজেকে গালাগাল দিলাম। যাও, ঝাঁপ দাও। অবাধ্য এক মেষকে যেন তার গন্তব্যে ঠেলে দিচ্ছি। যাও, যাও, ঝাঁপ দাও। মনকে তৈরি করে এনেছি। আসাম মেল ছুটে আসছে। দাও, দাও, ঝাঁপ দাও। ‘হেই ইউনিয়নবাবু, হিয়াপর ক্যা করতা! কাট জায়েগা। হঠ যাও, হঠ যাও।’ ওআচ অ্যাণ্ড ওআর্ডের চেনা সেপাই। 

আসাম মেলের ধাবমান ইঞ্জিন তখন প্রায় আমার ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে। ইস্পাতের কঠিন লাইনে প্রচণ্ড শব্দ, প্রচণ্ড কাঁপুনি, সচল পিস্টন, ইঞ্জিনের চোঙা, ধোঁয়া, ড্রাইভারের মুখ, আকাশ, তীব্র হুইল, ‘ইউনিয়নবাবু, হঠ যাও, ওয়াচ অ্যান্ড ওআর্ডের সাস্ত্রির চিৎকার, তার মুখ—সব একসঙ্গে আমার চোখে কানে চেতনায় এসে আঘাত করছে। আমি লাইনের খুব কাছে সরে গিয়েছিলাম, শান্তভাবে দু পা পিছিয়ে এলাম। আসাম মেল সেই মুহূর্ত থেকে আমায় অতিক্রম করতে শুরু করল। প্রথমে ইঞ্জিন ছুটে বেরিয়ে গেল। হাওয়ার ধাক্কায় আমি টলে পড়ে যাচ্ছিলাম? চাকার তলায়? সর্বনাশ! নিদারুণ ভয়ে আমার শরীর কেঁপে উঠল। চাকার দিকে নজর পড়ল। কী প্রচণ্ড বেগে গড়িয়ে ওগুলো ছুটে চলেছে। ওদের অবয়ব অস্পষ্ট অস্বচ্ছ হয়ে এসেছে। ওরা এখন আর কেউ ধাতব গোলাকার চাকা নয়। ওগুলো এখন গতি, প্রচণ্ড ঘূর্ণন। গতির অস্তিত্ব আছে। আকৃতি আছে। চাকাগুলো বিশেষ সংকল্প সিদ্ধির মানসে (গতিপ্রাপ্ত হওয়াই তাদের সংকল্প) ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়েছে, গোলত্ব বিসর্জন দিয়ে লম্বা এক অবিচ্ছেদ্য সত্তায় বিলীন হয়ে গিয়েছে। আমি দেখছিলাম, ট্রেনের হাওয়া আমাকে চাকার নীচে আকর্ষণ করছিল। যদি নিজেকে সামলাতে না পারি, যদি চাকার নীচে চলে যাই, যদি মরে যাই, এই ভয়ে আমি থরথর করে কাঁপছিলাম, আর প্রতি মুহূর্তে আশা করছিলাম, ট্রেনখানা এই বেরিয়ে যাবে, এই বেরিয়ে যাবে। আমার নিশ্বাস আটকে আসছিল, বাতাসের ঝাপটায় আমার জামা-কাপড়ে টান পড়ছিল, থরথর করে কাঁপছিলাম। ট্রেনখানা যেন আমার শিরদাঁড়া মাড়িয়ে চলেছে, অনন্তকাল ধরে চলেছে, চলবে, কখনও তার শেষ অংশের নাগাল পাওয়া যাবে না, এইসব ভাবছিলাম ঘটনাটা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে মনে আছে—আর আমি দেখছিলাম, সেই দ্রুতধাবমান আসাম মেলের চাকাগুলো কোনওটাই গোলাকার নয়, ট্রেনের মতই লম্বা। আমি এই বিপজ্জনক স্থানে কেন এসেছি? এখানে কি কেউ এভাবে দাঁড়ায়? দাঁড়াতে আছে? যে কোনও মুহূর্তেই তো চরম দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে! মরে যেতে পারে মানুষ! আ, এই ট্রেনখানা কি আর শেষ হবে না? 

আসলে ট্রেনখানা অস্বাভাবিক লম্বা ছিল না। আমাকে এ কথা ওয়াচ অ্যান্ড ওআর্ডের চেনা সেপাইটা বলেছিল। আসাম মেল যতটা লম্বা হয়, তেরোটা বগি, একটা ব্রেকভ্যান, ইঞ্জিন বাঙ্কার সমেত। কিন্তু এ কথায় আমার মন ভরেনি। আমি আসাম মেল চিনি না! রোজ দেখছি আসাম মেল। আপ মেল লালমণিরহাট পৌঁছয় আটটা আটান্নয়, ছাড়ে নটা বারোয়। ডাউন মেল পৌঁছয় তেরোটা ষোলোয়, ছাড়ে তেরোটা তিরিশে। আসাম মেল চিনি। আমিনগাঁও থেকে পার্বতীপুর এইটুকু এই মিটারগেন্জি মেলটার দৌড়। সেদিন, আমি যেদিনের কথা বলছি, এই মিটারগেজি মেলগাড়িখানা আসেইনি, এই লাইনে ব্রডগেজি না তার চাইতেও বড় আকারের একখানা গাড়ি ঢুকে পড়েছিল। এক-একখানা কম্পার্টমেন্টের ছাদ আকাশে গিয়ে ঠেকেছিল। দৈর্ঘ্যের বিস্তার ছিল পৃথিবীর শেষ সীমা পর্যন্ত। আসলে ট্রেনখানা আদৌ অস্বাভাবিক লম্বা ছিল না। আসলে ট্রেনখানা অস্বাভাবিক রকম লম্বা ছিল। এই দুটোর কোনটা সত্যি? দুটোই সত্যি, কারণ দুটোই প্রত্যক্ষ। সেপাই দেখেছে, ট্রেনখানা স্বাভাবিক, সাধারণ আসাম মেল। সে ট্রেনের সান্নিধ্যে ছিল না, ট্রেনের ঝাপটা তাকে প্রতি মুহূর্তে চাকার তলায় ফেলে দিতে চায়নি, তার প্রাণসংশয় হয়নি। সে সাধারণ ট্রেনই দেখেছে। সেই সময় সে স্থানকালের যে গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিল তাতে সে এই সত্যই প্রত্যক্ষ করেছে। সেই সময় আমি স্থানকালের যে গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিলাম তাতে আমিও যা প্রত্যক্ষ করেছি, সেটাও সত্য। কলকাতার ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আমরা সরকারি বাসের স্টপে-দাঁড়ানো যে চেহারা দেখি, তাও সত্য—মনুমেন্টের উপর থেকে যে চেহারা দেখি, তাও সত্য। প্রত্যক্ষ সত্যও শাশ্বত নয়, আপেক্ষিক, চতুর্মাত্রিক তত্ত্ব এ যুগে আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়েছে। আমাদের এ যুগের জগৎ আর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতার সাবেকি সংস্কারে আবদ্ধ নেই। তার সঙ্গে কালও যুক্ত হয়েছে। এখন আমাদের চারটে ডাইমেনশন, চতুর্মাত্রা। এ যুগের বিজ্ঞান শুধুমাত্র জড়বিজ্ঞান নয়। চেতন-অচেতনের পার্থক্য ঘুচিয়ে, দুই বিপরীত মেরুতে সেতুবন্ধ রচনা করেছে। 

এই তত্ত্ব যদি জাগতিক, মহাজাগতিক (ব্রহ্মাণ্ডের খবরে কাগুজে প্রতিশব্দ) ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়, তবে ব্যক্তিমানুষের জীবনেই বা প্রযুক্ত হবে না কেন? এক নারী কি একাধিক পুরুষের প্রেমে আসক্ত হয়েও নিষ্ঠাবতী হতে পারে না? নারী বা পুরুষের নিষ্ঠা কার প্রতি? ব্যক্তির প্রতি- না, প্রেমের প্রতি? 

এখন এই গভীর অন্ধকারে মুখোমুখি বসে এইসব কথা ভাবতে পারছি। কেন? না, বেঁচে আছি। সেদিন, আজ থেকে বিশ বছর আগে, চপল এক অনুশোচনা প্ররোচনাবশে ট্রেনের তলায় ঝাঁপ দিইনি—তাই। সন্দেহ নেই সুশীলা অনেক জ্ঞানী হয়েছে। তার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে তার অধ্যাপক তাকে ধর্ষণ করেছিলেন, সেজন্য সে এখন নিজেকে মোটেই অশুচি ভাবছে না। মুংরি সংসার প্রতিপালনের জন্য তার দেহ বিক্রি করছে, সেজন্য সে নিজেকে অশুচি ভাবছে না। দেশ ভাগ হবার পর পাকিস্তানে একদল গুণ্ডা দুর্বৃত্ত কিছু মেয়েকে ধর্ষণ করেছে, সেইসব ধর্ষিতারা কি নিজেদের অশুচি ভেবেছে? একদল মেয়ে কলকাতায়, পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র, সংসার প্রতিপালনের জন্য দেহ বিক্রি করছে। তারা কি নিজেদের অশুচি ভাবছে? সম্ভবত ভাবছে। সম্ভবত কেন, নিশ্চয়ই ভাবছে। সুশীলার স্বচ্ছ দৃষ্টি, মুংরির সতেজ জীবনবোধ তাদের নেই। তারা পাপের কামড়ে ভুগছে। অন্যায় জেনে অন্যায় কাজ করছে। নরকের আগুনে পুড়ছে। হয়তো এমনি পুড়ে পুড়ে তারাও একদিন সত্যে পৌঁছবে, তাদের সত্যে তারা পৌঁছবে, শুচি হয়ে উঠবে। নরকের আগুন আমাকেও তো কম পোড়ায়নি! 

না হলে সেদিন জ্বালা জুড়োতে মরতেই বা যাব কেন? আশ্চর্য, সে কিন্তু আমার আত্মঘাতী বাসনাটাকে ধরে ফেলেছিল। কেরোসিনের কুপির শিসটা—তাতে যত না আলো তার বেশি ধোঁয়া, তখন লাল তেল ছাড়া আর কিছু পাওয়া যেত না- আমার মুখের কাছে অনেকক্ষণ অবধি ধরে রেখেছিল, তীব্র দৃষ্টিতে কী যেন দেখছিল, তারপর কিছু না বলে আমার হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে পিঁড়িতে বসাল। পিড়ি পেতেই রেখেছিল, গ্লাসে জল ভরে, ভাত বেড়ে আমার সামনে ধরে দিল, সামনে এসে বসল। বলল, “সারা দিন কিছু খাওনি তো! পেট ভরে খেয়ে নাও, পাগলামি ছুটে যাবে। উঃ, ভয়ে আমি মরে যাচ্ছিলাম। এই ভূতের বাড়িতে একা একা কেউ থাকতে পারে! আর একটু হলেই আমি ভয়ে মরে যেতাম। জিমিকে কোলের মধ্যে নিয়ে আমি এতক্ষণ জেগে বসে ছিলাম। ও তোমাকে খবর দেয়নি? বলেনি তাড়াতাড়ি আসতে?” 

কাল রাত্রেও ও যে আমার বিছানায় এসেছিল তা কিন্তু যৌন প্রবৃত্তির তাড়নায় নয়। ভয়ের তাড়নায়। অনেকদিন ধরে ভুগে ভুগে পরশুদিন ওর শ্বাশুড়ি মারা গিয়েছে। ওর স্বামী ছুটি পায়নি। একা ঘরে থাকবার সাহস ওর হয়নি। আমি ওদের খুপরি-ঘরের বারান্দায় যেখানে ওরা রান্না করে খাটিয়া পেতে রাত্রে শুতাম। ছ মাস আগে জ্বরের ঘোরে অচৈতন্য অবস্থায় ওর স্বামী আমাকে ইউনিয়ন অফিসের নড়বড়ে তিনখানা বেঞ্চের উপর থেকে—সেইটেই আমার বিছানা—আমাকে ওদের বাড়িতে তুলে এনেছিল। ওর স্বামী, ফার্স্ট ফায়ারম্যান, রথীন সরখেল আমার খুব বন্ধু ছিল। ইউনিয়নের মস্ত বড় খুঁটি। প্রথম দিকে রথীনের বউ কিন্তু আমাকে বিশেষ সুনজরে দেখেনি। স্বামী একটা আপদ এনে জোটালে—ভাবখানা ছিল এইরকম। ওর শ্বাশুড়ি আমাকে যত্ন করে খুব। বুড়ি খুবই স্নেহ করত। এটাও ও ভাল চোখে দেখেনি, সে আমি ওর ভাবভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারতাম। 

ওর শ্বাশুড়ি মরে যাবার পরের রাত্রে, ও একা ঘরে থাকতে বেজায় ভয় পেয়ে গেল। অনেক রাত্রে গোঁ গোঁ আওয়াজ শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে ভাবলাম বুঝি জিমি। গভীর অন্ধকার রাত। চারিদিক নিস্তব্ধ। আমি আবার ঘুমোবার চেষ্টা করলাম। এমন সময় লোকো শেডের কাছে একটা ইঞ্জিন চিৎকার করে সেই স্তব্ধ রাত্রির বুকে তীক্ষ্ণ এক হুইশলের আওয়াজ বিদ্ধ করে দিল। কে যেন ককিয়ে উঠল। অন্ধকার রাত্রি কি? দড়াম করে ওর ঘরের দরজা খুলে গেল। একটা আবছা মূর্তি বেরিয়ে এল। আমার খাটিয়া একটা ভারী দেহের চাপে মচমচ্ করে উঠল। মূর্তিটা কে, ভাল করে তখনও বুঝিনি। ঘটনাটা আকস্মিক। সত্যি বলতে কি, আমিও ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ আমার পা ধরে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিতেই আমি চমকে উঠে বসলাম। পা টেনে সরিয়ে নিতেই ও আমাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরল। “এই শোনো, ঘরে চলো, আমার ভীষণ ভয় করছে, ভয় করছে। (ভয় ভয় ভয়…) ঘরে ভূত আছে।” ম্যালেরিয়া রোগীর মত ও তখন কাঁপছে। আকস্মিকতা কেটে যাবার পর আমি বললাম, “ভয় কী, তুমি ঘরে যাও, আমি জেগে থাকছি।”

“তবে আমিও এখানে থাকি, একা ও ঘরে আমি থাকতে পারব না, মরে গেলেও না।” বলে খাটিয়া থেকে নেমে মেঝেয় বসল। 

“ওখানে বসলে কেন? তবে এই খাটিয়াতেই বোসো।” ও সাড়া দিল না। আমার হাঁটু দুটো ধরে বসে থাকল। ও সঙ্গ চাইছে। বুঝতে পারলাম, মৃত্যুর শীতল আক্রমণের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য ও জীবন্ত মানুষের উষ্ণতার আশ্রয় চাইছে। আমার কেমন করুণা হল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে তার সে কী কান্না! আমার কী মনে হল, আমি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে গেলাম। কোন্ সময় ওর গায়ের কাপড় খসে পড়েছে সেই অন্ধকারে কে জানে! ওর অনাবৃত মসৃণ পিঠে আমার হাত পড়তেই আমার বুকের রক্ত, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, অন্তস্তলের যাবতীয় কিছু প্রচণ্ড বেগে লাফিয়ে উঠল। মুহূর্তে আমার শরীর ধনুকের ছিলার মত টান-টান হয়ে উঠল। তারপর কখন ওকে বুকে টেনে নিয়েছি, কখন ভিতরে গিয়ে বিছানায় শুয়েছি, কখন ওর সব কিছু আমার জানা হয়ে গিয়েছে, সেসব আমার কিছু মনে নেই। অনেকক্ষণ পরে, কতক্ষণ পরে জানি না, মধ্যরাত্রে অথবা রাত ভোরে, জানি না, বাঁকের মুখে ট্রেন আসার শব্দের সঙ্গে সঙ্গে আমার চেতনা ফিরে আসতে লাগল। বাঁকের মুখ থেকে হেডলাইটের তীব্র আলো জানালার ফোকর দিয়ে আমাদের উপর পড়তেই সে ত্রস্তে নিজেকে আবৃত করে ফেলল। আর সেই মুহূর্তে অনুশোচনার তীক্ষ্ণ ছুরি আমার নাবালক বিবেককে ক্ষতবিক্ষত করে দিতে লাগল। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। ঘর ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে। ট্রেনখানা ঘরের পাশ দিয়ে ভারী দেহটা টানতে টানতে বেরিয়ে যাচ্ছে। লাইনে চাকায় সংঘর্ষ হচ্ছে। কিম্ভূত কতকগুলো শব্দ সজোরে আছড়ে পড়ছে আমার বুকে, ঘরের মেঝেয়। ঘরবাড়ি কাঁপছে। আমার দেহটা কাঁপছে, এখন আর অন্তরের আবেগ নয়, আমার বুকের আগুন নিবে গিয়েছে। আমি উঠতে চাইলাম, ও মরিয়া হয়ে আঁকড়ে ধরল। “এখন নয়, এখন নয়, ভোর হোক, আলো হোক” তীব্র হুইলের শব্দে ওর আর্তস্বর ডুবে গেল। আমি তার আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে রইলাম। ট্রেনখানা থেমে গিয়েছে। সিগন্যালের সংকেত পায়নি। পুনঃপুনঃ চিৎকার করে উঠছে অসহিষ্ণু হয়ে। নিথর গাড়িটাকে অবিকল একটা নিটোল কালো সরীসৃপের লাশের মত দেখাচ্ছে জানালার ফোকর দিয়ে ফিকে ফিকে অন্ধকারে। 

*

মার্সিডিজ বেঞ্জের তীব্র হর্নে রাত্রির শরীর চিরে ফালা ফালা হয়ে গেল। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল দুটো জোরালো হেডলাইটের আলো চকিতে লাফ মেরে অন্তহীন অন্ধকারে ডুবে গেল। রঙ্গচারী এখনও ফিরল না। কোথায় জমে গিয়েছে কে জানে! কত দূরে গেল তা-ই বা কে জানে! 

“আসলে তোমাদের সমস্যাটা কী? এই উদ্বাস্তু সমস্যা? এটাকে আলাদা একটা লেবেল মেরে একজিবিট করে রেখেছ কেন তোমরা? আমার হাতে ক্ষমতা থাকলে চব্বিশ ঘণ্টায় সব সমস্যার সমাধান করে দিতাম।”

রঙ্গচারীর মদের মাত্রা বেশি হয়ে গেলে সে আর অফিসের আলোচনা করত না, মেয়েমানুষের আলোচনাও না। এইসব গভীর সমস্যা তার মাথায় তখন কিলবিল করে উঠত। সাদা চোখে যখন থাকত তখন ও যত ঝাল ঝাড়ত ওর চিফ রিপোর্টারের উপর। “তুমি জানো না, ওটা মানুষ নয়, এমন কি পশুও নয়, হি ক্রস্‌ অন হিজ বেলি, ব্যাটা একটা কেন্নো। কর্তাদের তেলিয়ে ব্যাটা চিফ হয়েছে। কিচ্ছু বোঝে না, কিচ্ছু জানে না। জানো, পিকাসোর নাম জানত না ব্যাটা, ওর ধারণা ছিল, পিকাসো হচ্ছে ইতালির একটা শহর, সেই যেখানে হেলানো টাওয়ার আছে। হি মেন্ট পিসা। মায়ের দিব্যি যদি মিছে কথা বলি।” কিংবা দিল্লির যত কেচ্ছা শোনাত। তখন যদি বলতে যেতাম, “রঙ্গচারী, উদ্বাস্তু সমস্যার স্বরূপ যদি বুঝতে চাও—” বাধা দিয়ে বলত, “হু কেয়ারস্ ভাই, সমস্যাগুলো লিডার রাইটারদের জন্য তুলে রাখো, আমরা রিপোর্টার, লেট আস কালেক্‌ট্ ফ্যাক্‌ট্স। শালা, নিজের সমস্যার ঘায়ে পাগল হয়ে যাচ্ছি, তার 

খবর কে করে তার ঠিক নেই, এর উপর আবার উদ্বাস্তু সমস্যা! হুঁ! আই অ্যাম হাংরি ম্যান, আই অ্যাম হাংগরি। হতচ্ছাড়া জায়গা এমন, মেয়েছেলে ছাড়া আর কিছু পাওয়াও যায় না। ইট ইজ অল হিজ ডুইং ইউ নো, অব দ্যাট ভাইল ক্রিচার। আমাকে জব্দ করার জন্যই এখানে পাঠিয়েছে।”

এই রঙ্গচারীই আমাকে বলেছিল, “দ্যাখো, এখানে যত লোক আছে, তার মধ্যে মোস্ট সিসিয়ার ওআকার হচ্ছে ঐ লেডি ডাক্তারটি। কিন্তু জানো, ওর নামে ওপরে রিপোর্ট গিয়েছে—ভেরি সিরিয়াস রিপোর্ট। আই গট ইট ফ্রম অ্যান অথরিটেটিভ সোর্স। ওর গতিবিধি স্ক্যাণ্ডালাস। শি অফ্‌ স্পেন্‌স্‌ নাইট উইথ এ হোটেলওয়ালা। ওর স্ক্যাণ্ডালটা কাগজে তোলার জন্য আমার কাছে অনুরোধ এসেছে। আমি জানি, আমার বস এ স্টোরি লুফে নেবে। দ্যাট ক্রিচার উইল রেলিশ ইট। শালা নিজে সেক্‌স্ স্টার্ড্। এইসবে বড় আনন্দ পায়। বাট আই হ্যাভ এ গ্রেট রিগার্ড ফর হার। মহিলাটিকে আমি কাজের মধ্যে দেখেছি। শি ইজ এ সেলেস সর্ট। বাট হু ইজ দ্যাট হোটেলওয়ালা? আমি শুনেছি ব্যাটা একটা অশিক্ষিত ডিবচ। আবার কেউ কেউ বলছে, ব্যাটা নাকি ভেকধারী কমিউনিস্ট। হু ইজ হি? যাই বলো, এদের অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তবে বলতেই হবে, লোকটা হেঁজিপেঁজি নয়। এরকম একটা অ্যাকম্‌প্লিড্ কালচার্ড লেডি যার-তার বিছানায় রাত কাটিয়ে আসবে, সে কথা যেই বিশ্বাস করুক, আই অ্যাম দি লাস্ট পার্সন টু বিলিভ দ্যাট। এখানকার অফিসারদের সবাই যে ব্রহ্মচারী, তা তো নয়। সব মালকে আমি চিনি। আদিবাসী আর রিফিউজিদের নেক্‌সট জেনারেশানকে উন্নত করার মহান দায়িত্ব এরা কাঁধে তুলে নিয়েছে। আসলে দে আর জেলাস, জেলাস অব দ্যাট ম্যান। বাট হু ইজ হি? লোকটা কে?” 

আমি রঙ্গচারীকে বললাম, “তুমি সুশীলাকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করো না কেন?”

“আরে বাবা, কোনও সোর্স থেকে কনফারমেশন না পেলে তা-ই করতে হবে। এ ব্যাটারাও বিশেষ কিছু জানে না।”

আমিও বিশেষ কিছু জানিনে। এটা জানি, ধরমকোটে এক হোটেলে সুশীলা কয়েক রাত কাটিয়ে এসেছে। সুশীলা আমাকে বলেছিল, কলকাতায় যাকে সে খুঁজে পায়নি, সেই মনের মানুষকে সে পেয়েছে, এই মধ্যপ্রদেশের নিবিড় অরণ্যে। আমি ভেবেছিলাম, এটা বোধ হয় কোনও কিছুর প্রতীক। সে যে আক্ষরিক অর্থেই কথাটা বলেছিল, তা বুঝতে পারিনি। রঙ্গচারীর কথা শুনে মনে হল, ব্যাপারটা বেশ ঘোরালো হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ওর ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি ওর সহকর্মীদের এত আগ্রহ কেন? ওর প্রতি এদের এত বিদ্বেষেরই বা হেতু কী? ওরা কি সুশীলার অভিভাবক? 

“কখনও কখনও আমার কী মনে হয় জানো, আমার যদি ক্ষমতা থাকত, এমন দেশের সন্ধান আমার যদি জানা থাকত, যে দেশে সভ্যতা নেই, সভ্যতা মানে আমাদের এ যুগের সভ্যতা, যে দেশে জন-মনুষ্যের বসতি নেই, শুধু বন আর আরণ্যক বিভীষিকা, তা হলে আমি সমস্ত উদ্বাস্তুদের জাহাজে ভরে সেই দেশে নিয়ে যেতাম, তারপর সেই দেশের উপকূলে গিয়ে লাইফ্-বোটে করে ওদের নামিয়ে দিতাম, তারপর জাহাজটা ডুবিয়ে দিতাম। বলতাম, সেই ডুবে যাওয়া জাহাজের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলতাম, ঐ দ্যাখো, তোমাদের অতীত ডুবে গেল। ঐ দ্যাখো, সামনে তোমাদের ভবিষ্যৎ। যদি মরো, মিটে গেল—যদি বাঁচো, সব তোমাদের।” রঙ্গচারী আবার মদ খেয়েছে। “এখন তোমাদের বাঁচা-মরা তোমাদের হাতে। দেখতে, সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।”

“তাতে কি নিষ্ঠুরতা হত না, রঙ্গচারী?” 

“নিশ্চয়ই হত। বহু লোক রোগে মরত, বহু মরত অনাহারে, অপঘাতে। যারা মরত, তারাও ব্যর্থ হত না। তাদের রক্ত, তাদের দেহ সেই মাটিতে পড়ত, উত্তরপুরুষদের অধিকার জন্মাত সেই মাটিতে। যারা বাঁচত, মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বাঁচত। ক্রমে তারা বংশবৃদ্ধি করত। বীর পুরুষের ঔরসে, বীর মাতার গর্ভে বীর সস্তানেরা জন্ম নিত। ক্রমে তারা নগর পত্তন করত, তাদের মনের মতন নগর, ঘরবাড়ি। সভ্যতার সৃষ্টি করত তারা। মনুষ্যত্বের বাণী প্রচার করার জন্য বিজয়কেতন উড়িয়ে এই নির্বীর্ষ কাপুরুষদের দেশের ঘাটে তাদের জাহাজ ভিড়ত কয়েক শতাব্দী পরে। নিষ্ঠুরতা হত বইকি! কিন্তু এখন দয়া দেখিয়ে কী করছি? ভিক্ষা দিচ্ছি। ভিক্ষালব্ধ অন্নে জীবনধারণ করে পাইকারি হারে ভিক্ষুকদের প্রজননক্রিয়ার সুযোগ করে দিচ্ছি। এরা অধিকাংশই বেঁচে আছে। কিন্তু এ কী ধরনের বাঁচা? আমরা এদের হয়ে নগর পত্তন করে দিচ্ছি, আমাদের নক্‌শামাফিক বানানো ঘরে এদের এনে বসাবার ব্যবস্থা করছি। সে ঘরে ওদের মন বসবে কেন? ভাড়া বাড়িতে বাস করে তোমার মন বসে? অল দিস সিলি ওয়ে। বিল্ডিং মাত্রই হোম নয়, ম্যান। 

“আমাদের কি এদের প্রতি কোনও দায়িত্ব নেই? আমাদের স্বাধীনতার জন্যই কি এরা হাঘরে হয় নি?” 

“স্বাধীনতা কি আমাদেরই এসেছে, ওদের আসেনি? ভূখণ্ডের শাসক পরিবর্তনকে যদি স্বাধীনতাই বলো। স্বাধীনতার জন্য দেশ ভাগ হল, তাতে কী হয়েছে? তা বলে তোমাকে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হবে?” 

“কী করে থাকবে, যদি অত্যাচার হয়, নারীধর্ষণ হয়?” 

“এখানে হচ্ছে না অত্যাচার? ধর্ষণ হচ্ছে না? এখান থেকে লোকে কি পালিয়ে যাচ্ছে? অত্যাচারের জন্য পালিয়ে আসেনি, ধর্ষণের জন্য পালিয়ে আসেনি। পালিয়ে এসেছে ভয়ে। ভয় অত্যাচারের চেয়েও বেশি বিভীষিকাময়। ক্লৈব্য সব থেকে মারাত্মক। ওরা যদি মার খেত, মারত, তবে ভয় ভেঙে যেত। যদি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মারই খেত তবু ভয় ভেঙে যেত। এখানে যারা পালিয়ে এসেছে, তাদের কিছু এসেছে স্বার্থ বাঁচাতে, বেশির ভাগ এসেছে ভয়ে। অল আর ডেড বডিজ। ডোন্ট সে এনিথিং অ্যাবাউট রেপ। আমি জানি, দ্যাট ইজ ফর আওয়ার হেডলাইন্‌স্, দ্যাট ইজ আওয়ার স্টক ইন ট্রেড। আই নো, আই নো। কিন্তু ইতিহাসের দিকে চেয়ে দ্যাখো, আবহমান কাল ধরে রাষ্ট্র পরিবর্তনকালে ধর্ষণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বহু বাস্টার্ডের জন্ম হয়েছে। পৃথিবী কি ভেঙে পড়েছে? সভ্যতা কি পিছিয়ে পড়েছে? এক অর্থে আমরা সবাই জারজ। আমাদের উত্তরাধিকার জারজদের উত্তরাধিকার। এই সভ্যতায় নির্ভেজাল রক্ত কার আছে? ধর্ষণ অন্যায়, পাপ—আই নো, আই নো। কিন্তু কোন্ জাতির জীবনে আতঙ্কগ্রস্ত হবার মত ঘটনা এটা নয়? ডোন্ট সে অল দিস রাবিশ টু মি। ইট ইস লাইফ দ্যাট ম্যাটারস, নাথিং এস্‌। বাঁচো, মানুষের মত বাঁচো। অ্যাণ্ড হোয়ার ইজ লাইফ, ম্যান? কে বেঁচে আছে? নাইদার ইউ নর আই। আমরা মৃতদেহ, আমাদের শহর-গ্রাম কবরখানা, আমাদের ঘরবাড়ি সব কফিন। কে বেঁচে আছি? কেউ না। তুমি আমি কেউ না। আমি তা জানি, তা জানি। সিটি মেন অ্যাট ডেড্‌ম্যান্‌স চেস্ট্। ইয়ো হো হো অ্যাণ্ড এ বট্‌ অব রাম।”

ভয় ভয় ভয়। সন্দেহ নেই, কলকাতার পুরনো ভিতে ভয়ের উইপোকা লেগেছে। আমাদেরই জীবনের মর্মস্থলে উই ধরেছে। ভয় ভয় ভয়। ভয় আমাদের গ্রাস করেছে। লক্ষ লক্ষ জীবন্ত মৃতদেহ ভিড় করে আছে কলকাতা নামক কবরখানায়। সেই লাশগুলো নড়েচড়ে, কথা বলে। আহার নিদ্রা মৈথুনে কাল কাটায়। সিটি মেন অ্যাট ডেডম্যান্‌স্ চেস্ট্, ষাটজন নয়, ষাট লক্ষ, ষাট লক্ষ নয়, প্রায় দু কোটি লোক পশ্চিমবঙ্গ নামক মৃতমানুষের সিন্দুকে বাস করে। ভয়ে ভয়ে থাকে। আর আতঙ্কে চেঁচায়। গেল, গেল, সব গেল। আর ঘুমায়। ওদের দেহ ঘুমায়, ওদের মন ঘুমায়, ওদের মস্তিষ্ক ঘুমায়, ওদের পাকস্থলী ঘুমায়। বুদ্ধি বিচার বিবেচনা ঘুমায়। ঘুমায় আর আতঙ্কে চেঁচায়। গেল, গেল, সব গেল। ওরা মৃত, তাই নিজেরা কিছু করে না, করতে চায় না, ঝুঁকি নেয় না। খালি চেঁচায়, আমরা বঞ্চিত, আমরা বঞ্চিত। ওরা মৃত, ওদের তাই বাঁচার তাগিদ নেই। ওরা মৃত, মরার ঝুঁকিও ওরা নিতে চায় না। 

এই উদ্বাস্তুরা এদেরই বংশধর। অনেক ঢাক ঢোল পিটিয়ে, বন কেটে জমি বানিয়ে কৃত্রিম সারে জমি উর্বরা করে আমরা মৃত বীজ বুনে চলেছি আর সেই জমি থেকে তাজা ফসল চাইছি। এই আমাদের ট্র্যাজেডি অথবা চরম প্রহসন। নপুংসকের কাছে চাইছি বীর্যবান সন্তান! 

দুলু নমশূদ্রকে দেখে এসব কথা আমার মনে পড়ল। কেঁদ গাঁওয়ের ট্রানজিট ক্যাম্পে ওকে দেখে প্রথমে আমি চিনতে পারিনি। অথচ ওর ছবিটা আমার মনে হু বছর ধরে গাঁথা হয়ে আছে। প্রথমে ওকে আমি দেখি বাগজোলার চার নম্বর ক্যাম্পে। তখন দুলু নমশূদ্র সমস্ত প্রশাসনের একটা উৎকট সমস্যা। পাক্কা হু’ ফুট, দিঘল চেহারা, ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল। কী সমর্থ হাতের পায়ের বুকের পেশী! ওর আকাশফাটানো হাসির শব্দে আমার বুক গুরুগুরু করে উঠেছিল, আমার এখনও মনে আছে। আর মনে আছে আর-একটা দৃশ্য : একটা কোঁচ কাঁধে ফেলে, হাতে পাঁচ-সেরি একটা মাই ঝুলিয়ে, আকাশে মাথা ঠেকিয়ে দৃপ্ত তেজে সে বাগজলার খালপাড় দিয়ে হেঁটে আসছে। তার পিছনে জনা পঞ্চাশেক লোক। কারও মুখে কথা নাই। লোকগুলোকে জিজ্ঞাসা করলাম, ব্যাপার কী? ওরা থমকে দাঁড়াল। দুলুকে যতক্ষণ দেখা গেল, কেউ একটি কথাও বললে না। ও চোখের আড়ালে চলে যেতেই সবাই একসঙ্গে ফেউফেউ করে উঠল, “আমাদের ভেড়ি থেকে মাছ মেরেছে। বলেন তো বাবু কী জবরদস্তি!” আমি বললাম, “তোমরা এতগুলো লোক, ঠেকাতে পারলে না?” ওরা বলল, “ও যে ডাকাত, বাবু। সাহস পেলাম না।” তাই ওরা ক্যাম্পে চলেছে নালিশ করতে। সিংহের বিরুদ্ধে ফেরুপাল চলেছে নালিশ জানাতে — এই উপমাই সেদিন মনে পড়েছিল। ঐ নিচু সিঙ্গল-প্লাই তিরপলে ঢাকা খুপরির মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে দুলুর খুব কষ্ট হত। ও ক্যাম্প পরিচালকদের কাছে দরবার করেছিল, “ছার, আমারে একটা বড় তিরপল দ্যান। উঁচা কইরা ঘরখান বানাই। ঐ কেঁচুয়ার মত বুকে হাইটা ঘরে ঢোকতে বড় দিক লাগে, ছার। 

“এক উদ্বাস্তু বলছে, কেঁচোর মত বুকে হেঁটে ঘরে ঢুকতে বিরক্ত লাগে। সে আবদার করছে, সে যাতে মানুষের মত ঘরে ঢুকতে পারে, তার ব্যবস্থা করা হোক। বলাই বাহুল্য, সে আবদার রক্ষিত হয়নি। কারণ, সরকারি রুলে এ ব্যবস্থার মঞ্জুরি নেই। কাজেই দুলু তার ব্যবস্থা নিজেই করে নিয়েছিল। একদিন তিন নম্বর ক্যাম্প থেকে একটা খালি তাঁবু উপড়ে এনে সে নিজের প্রয়োজন নিজেই মিটিয়ে নিলে। সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হল। ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হল। তাঁবু চুরি, ক্যাম্পের শৃঙ্খলাভঙ্গ প্রভৃতি অপরাধে এক সপ্তাহ ডোল বন্ধ করে দেওয়া হল। অবাক হয়ে দুলু মন্তব্য করেছিল, “এ আপনের কেমুন বিচার, ছার?” কী যে অপরাধ করেছে দুলু, সে বুঝতেই পারল না। যে তাঁবুটা সে এনেছে, সেটা তো খালি ছিল। কেউ ব্যবহারও করেনি। আর ওটা তো সরকারি তাঁবু, সরকারের জমিতেই তো সেটা কাজে লাগানো হয়েছে। চুরির অপবাদটা তার বুকে খুব বেজেছিল। আমাকে বলেছিল, “জীবনে অনেক কাইজ্যা দাঙ্গা করছি, ডাকাইতিও করছি, মিছা কথা কমু না ছার, কিন্তুক চুরি কখনও করি নাই।”

বললাম, “চুরি করোনি তো এই মাছটা কোত্থেকে এল?” 

“ধইরা আনছি, ছার। ওরা আছিল তখন।” বলেই সেই ভীরু ফেরু জনতার দিকে চেয়ে হাঁক ছেড়েছিল। “কী রে, তরা দেখস্ নাই আমারে? মিছা কইস্ না, খবরদার।” 

ওর হাঁকের আওয়াজে ক্যাম্পটা যেন থরথর করে কেঁপে উঠল। লোকগুলো হাতজোড় করে বলল, “ছিলাম, হুজুর। সবাই ছিলাম। বারণ করেছিলাম, হুজুর। তা এমন কটমট করে তাকাল—” 

হো হো হাসিতে ফেটে পড়ল দুলু। অ্যাডমিনিস্ট্রেটরকে বলল, “শুনছেন ত ছার, মিছা কই নাই। চুরি আমি জীবনে করি নাই।”

অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ধমকে বললেন, “এটাও চুরি।” 

“বাঃ!” দুলু আকাশ থেকে পড়ল। এ কেমন বিচার? সাক্ষী রেখে কেউ চুরি করে নাকি? “ছার, ওরা সব আছিল তখন—”

“চুপ করো। জানো না, না বলিয়া পরের দ্রব্য লইলে চুরি করা হয়? এটাও চুরি। ওদের মাছ তুমি ধরতেই বা গেলে কেন?” 

“বা! খামু কী? ডোল ত কাইটা দিচ্ছেন। খাইতে লাগব ত। তা ছাড়া অগ ত ক্ষতি কিছু করি নাই। অনেক মাছ আছে, ছার, একটা মাছ মানুষে খাইলে কিছু লোকসান হইব না।”

বিচারে দুলুর সওয়াল টিকল না। রায় হল, দুলুকে মাছ ফেরত দিতে হবে। কিন্তু ফরিয়াদিরা মাছটা ফেরত আর নিল না। খুশি হয়ে বিচারককেই খেতে দিয়ে গেল। 

দুলু শাস্তভাবে বলল, “আপনের বিচার আপনে করছেন, ছার। কিন্তুক মাছ আমি দিমু না। ডোল বন্ধ করছেন, কাজ-কামও করতে দিবেন না। আমি খামু কী? মাছ আমি দিতাছি না।” দুলু হতভম্ব অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের আরদালির হাত থেকে মাছটা কেড়ে নিয়ে ধীর পায়ে নিজের আস্তানায় চলে গেল। রং-চটা বাদামি তাঁবুগুলোর উপর দিয়ে ওর কাঁধ, ওর মাথা, ওর ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল অনেকক্ষণ ধরে ভেসে রইল। সেই দৃশ্যটাই আমার মনে আছে। সেই চেহারাটাই আমার মনে খোদাই করা আছে। 

আর একদিনের নালিশ : দুলু একজনের গাছের কাঁঠাল পেড়ে এনেছে। এ বিষয়ে তার কৈফিয়ত : “গাছের ফল মানুষে খাইবে না!” 

আর একটি গুরুতর অভিযোগ : দুলু দূরের এক উদ্বাস্তু কলোনি থেকে একজনের বউ চুরি করে এনেছে। এ বিষয়ে তার বক্তব্য : “চুরি করি নাই, হুজুর। ও নিজের থিকা আইছে। জিগান না? কী রে মাগি, রা কাড়স্ না ক্যান?” সরস্বতীও সাক্ষী দিয়েছিল, সে নিজের ইচ্ছায় এসেছে। বয়েস বেশি না মেয়েটার। সবে কুড়িতে পা দিয়েছে হয়তো। খুব আঁটসাঁট চেহারা, ভোঁতা ভোঁতা মুখ, পুরু পুরু ঠোঁট। যৌবনের কাঁচা রং উপচে পড়ছে। 

ওর স্বামীটাকেও দেখেছিলাম। বছর চব্বিশেক বয়েস হবে। রোগা হিলহিলে। প্যান্ট পরে, ছক্কাপাঞ্জা হাওয়াই শার্ট। সিনেমার নায়কের মত চুলের কেয়ারি। সিগারেট খায়। কিছুদিন সাইকেলরিকশা টেনেছে, বিড়ি বেঁধেছে ক’দিন। টালিগঞ্জের এক ফিলিম্‌ স্টুডিওয় চায়ের দোকানে বয়গিরিও করত। পেটে বিদ্যে যা আছে তাতে সিনেমা পত্রিকা পড়ে রস পাওয়া যায়। সরস্বতী প্রথমে ওর চটক দেখে মজেছিল। লুকিয়ে লুকিয়ে ছোকরা ওকে নিয়ে সিনেমায় যেত। একদিন শুটিং দেখাতে এনেছিল। সেই থেকে মূলধনহীন এক প্রোডিউসার ছোকরার পিছনে লাগে। তারই পরামর্শে ছোকরা সরস্বতীকে ফুসলিয়ে নিয়ে আসে। কালীঘাটের পুরুত দিয়ে দুজনের বিয়েও হয়। সেই প্রোডিউসার লোভ দেখায় দু’জনকে সিনেমার হিরো হিরোইন করে দেবে। একটা বাসাও সে ভাড়া করে দেয়। তারপর সেই বাসায় একদিন এক মারোয়াড়ি লগ্নিকারক আর জনপ্রিয় নায়ককে নিয়ে সেই প্রোডিউসার হাজির হল। ছোকরা সরস্বতীর সামনেই কুকুরের মত ওদের পা চাটতে থাকে। চাকরের মত ফাইফরমায়েশ খাটে। সেই দিনই সরস্বতীর চোখে ওদের মতলব ধরা পড়ে। 

সরস্বতী বলছিল, “ওরা সব বসে বসে মদ গিলতে লাগল। এমন কাণ্ড আমি আর দেখিনি। মারোয়াড়িটা আমার গা ঘেঁষে বসল। ঢলে ঢলে পড়তে লাগল। আমি সরে গেলাম। আমার গা ঘিনঘিন করছিল। মারোয়াড়িটা বলল, সরে যাচ্ছ কেন তারকাদেবী, এইখানে এসে বোসো। বলে তার কোলটা দেখিয়ে দিলে। রাগে আমার আপাদমস্তক জ্বলে গেল। ওকে দু’ হাতে ঠেলে দিলাম। সে জড়িয়ে জড়িয়ে বলতে লাগল, এসো, এসো দেবীজি, এইখানে এসে বোসো। লজ্জা কেন কোরছ। হিরোইন হোবে তো লজ্জা-ঘৃণা- ভোয় সব তেয়াগ কোরতে হোবে। যার পিছনে এতো টাকা ঢালব তাকে বাজিয়ে তো নিতে হোবে, কী বোলেন দত্তবাবু, কী বোলো ভাই স্বরূপকুমার! এ ভাই নওতুনকুমার, তুমি কী বোলো? তোমার বিবিকে সমঝে দাও তো। আমি ভেবেছিলাম, বুঝি এ কথা শুনে আমার বরটা ঠাস করে ওর গালে একটা চড় মারবে। ও মা! হারামজাদা মিনসে উল্টে দাঁত বার করে হাসতে লাগল। আবার কুত্তার মত কেঁউকেঁউ করে বললে, আমার নাম নতুনকুমার দেবা বুঝি? মারোয়াড়ি হাঁ হাঁ করে উঠল। বললে, বিবিকে তো টেস্ট কোরতে হোবে। হামি টাকা দিবে তো, হামি টেস্ট কোরবো। তারপর প্রোডিউসারবাবু টেস্ট কোরবে, তারপর হিরোবাবু টেস্ট কোরবে, তোবে তো তুমার বিবি তারকা হোবে। সমঝে দেও, সমঝে দেও। মিনসে টলতে টলতে এল। আমার কোমর ধরে টানাটানি করতে লাগল। এমন সময় স্বরূপকুমার উঠে দাঁড়াল, বললে, জন্তিলালবাবু, আপনারা ওকে ভড়কে দেবেন না, ব্যাপারটা ওকে বুঝতে দিন। মারোয়াড়ি বললে, হাঁ, হাঁ, বেয়াপারটা ওকে সমঝে দিন, সমঝে দিন। স্বরূপকুমার বললে, যে ছবিটা আমরা তুলব, যাতে আমি হিরো, আপনি হিরোইন আর আপনার স্বামী নতুনকুমারের প্রথম চিত্রাবতরণ—আজ তার রিহার্সাল হবে। আমরা একটু পরে গাড়ি করে আউটডোরে যাব। আপনার পার্ট হচ্ছে, এই মারোয়াড়িবাবুর সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করা। একটা মক্কেলের কাছ থেকে অভিনয় করে কিছু টাকা আপনাকে হাতাতে হবে। আপনার স্বামী অসুস্থ— তার চিকিৎসার টাকা। বুঝেছেন? ব্যাপারটা আদৌ শক্ত নয়। ও আপনার হাত টিপবে, গা টিপবে, আপনার সুড়সুড়ি লাগবে হয়তো। কিন্তু খবরদার, হেসে ফেলবেন না, সিনেমার হিরোইনরা যেমন নিরীহ নিরীহ মুখ করে থাকে, সেইভাবে বসে থাকবেন, ঠিক পাঁচ মিনিট। কী, পারবেন না? বলে আমার কানে মুখ ঠেকিয়ে চুপিচুপি বললে, ভয় নেই, আমরা কাছেই থাকব। লোকটাকে ভদ্র বলে মনে হল। ওর কথায় ভরসা হল। বললাম, পারব। স্বরূপকুমার বলে উঠল, শাবাশ। প্রথম প্রথম সবাই এ কাজে ভয় পায়, কালে সব সয়ে যায়। গাড়িতে ওঠবার সময় বাপের বয়সী দত্তবাবু আমার হাত দুটো জড়িয়ে ধরলেন, দেখিস দিদি, আমার মুখটা রাখিস, গুবলেট করে ফেলিসনি যেন। একটা বড় চাস্‌ হাতছাড়া হয়ে যাবে তা হলে। আমার তখন সত্যি হাসি পেয়েছিল। কী বিরাট মোটরগাড়ি। দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। পিছনের গদিটা বিছানার মত বড়। ঘুরতে ঘুরতে আমরা বাগজোলার খালধারে এসে পড়লাম। ড্রাইভার গাড়ি রেখে চলে গেল কোথায়। মারোয়াড়িবাবু আর আমি ছাড়া সবাই নেমে গেল। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। আচমকা গদির উপর লুটিয়ে পড়ে হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। আমার মুখে চাপা দেবার অনেক চেষ্টা হল। আমি আঁচড়ে কামড়ে অস্থির করে তুলে খালি চেঁচাতে লাগলাম। এমন সময় প্রচণ্ড এক হাঁক শুনলাম, কে রে, ওখানে কী হইতাছে? আমি ধড়ে প্রাণ ফিরে পেয়ে বাঁচাও বাঁচাও বলে আবার চেঁচিয়ে উঠলাম। এমন সময় অন্ধকার ভেদ করে ও এসে হাজির হল। নিমেষের মধ্যে দরজা খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকের চাপ দূর হল। দেখলাম মারোয়াড়ি শূন্যে ঝুলছে। ঝপ করে একটা শব্দ, ক্যাঁক করে একটা কাতরানি। তারপর মারোয়াড়ির আর্তনাদে চারিদিক সরগরম হয়ে উঠল। আমি নীচে নেমে এলাম। মার ডালা, জান লে লিয়া, দত্তবাবু, স্বরূপভাই, গর্দান তোড় দিয়া, হায় বাপ, ইন্দর সিং মুঝে বাঁচাও, জলদি আও। সব কটাকে এই একটা লোক বেদম ঠ্যাঙালে। কেউ আর উঠতে বসতে পারল না। পুরুষ বটে!” 

সরস্বতীর কথাবার্তায় বাঙাল টান একটুও নেই। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “সরস্বতী, তোমার দেশ ছিল কোথায়?” 

“কে জানে। ছেলেবেলা থেকেই ধুবুলিয়া ক্যাম্পে ছিলাম। বাবা মরে গেল। মা কোথায় চলে গেল। একটু বড় হতেই রানাঘাটের কুপার্স ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিলে। তারপরে পি এল ক্যাম্পে। একদিন একটা লোক এসে বললে, সরস্বতী, আমি তোর কাকা। আমার বাড়ি চল। সেই থেকে টালিগঞ্জে। একদিন দেখলাম, একটা যণ্ডামার্কা লোক ঘোরাঘুরি করছে। শুনলাম, আমাকে বেচে দেবার চেষ্টা করছে কাকা। রাজস্থান না কোথায় যেতে হবে। ততদিনে সেই ছোকরার সঙ্গে আমি পটে গিয়েছি। কেটে পড়লাম। তারপর থেকে এর সঙ্গে। সেই কাকা খবর পেয়ে এসেছিল। মার খাবার ভয়ে পালিয়ে গেছে।”

*

“আমারে চেনতে পারলেন না, ছার? বাগজোলায় আমারে দ্যাখছেন। আমি দুলু।” সম্পূর্ণ একটা অপরিচিত লোকের মুখে খুব পরিচিত লোকের নাম শুনে আমি চমকে উঠেছিলাম। অবাক হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকলাম। কোনও মিল নেই। কোনওখানে সামান্যতম সাদৃশ্যও নেই। “আমি ছার দুলু।”

এ কোন্ দুলু? এ তো স্রেফ বিবর্ণ এক লোল চামড়ায় ঢাকা বাঁকা চোরা তোবড়ানো একটা কঙ্কাল। মাথার চুল ছোট ছোট করে ছাঁটা। হনুর হাড় ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। অনেক দাঁত পড়ে গিয়েছে। গাল তুবড়ে গেছে। চোখে পিচুটি। কোথায় গেল সেই শঙ্খের মত সতেজ আওয়াজ? ও কথা বলল, আমার মনে হল ভিজে একটা ডুগি ঢ্যাব ঢ্যাব্ করে বেজে উঠল। আমার মনে হল অযুত বছরের কবর খুঁড়ে ওকে বুঝি এইমাত্র বের করে আনা হয়েছে। নতুন একটা সিঙ্গল প্লাই ত্রিপলে ঢাকা নিচু তাঁবু থেকে কেঁচোর মত বুকে হেঁটে কেমন অনায়াসে বেরিয়ে এল দুলু। সেই দুলু? “আমি ত আমাতে নাই, ছার, চেনবেন কেমনে?” 

আমি অবাক হয়ে ওকে দেখছিলাম। ওর কাছাকাছি একটা মেয়েলোক বসে ছিল। চাল বাছছিল। যেন ফাঁপা একটা রবারের মেয়েমানুষ। মুখ, চোখ, ওর অন্তরাত্মা একেবারে শূন্য। আশেপাশে গুটি কয়েক বাচ্চাকাচ্চা। আঁতকে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম, “ও-ও কে? সরস্বতী?” 

নিস্পৃহ নিরুত্তাপ কণ্ঠে দুলু বলল, “না, ছার, ও পাঁচি। সরস্বতী নাই। চইলা গেছে গিয়া।”

তিন বছর ওরা একসঙ্গে ছিল। দুলু আর সরস্বতী। আইন আর শৃঙ্খলার পাকে পাকে ইতিমধ্যে দুলুকে বেঁধে ফেলা হয়েছিল। ও ভাল করে খেতে পেত না। ওর স্বাধীনতা নানা সাজার মধ্য দিয়ে ভেঙে চুরমার করে দেওয়া হয়েছিল। দুলুর স্বাধীনতা, অবাধ উদ্দাম প্রাণশক্তি গুঁড়িয়ে যাবার পর ও নিজেও ভেঙে পড়ল। দুলু প্রথম দিকে তা বুঝতে পারে নি। ইতিমধ্যে এক জোয়ান ছোকরা সরস্বতীর কাছেপিঠে ঘুরঘুর করতে লাগল। সে কথা যেদিন টের পেল দুলু, তখন ব্যাপারটা অনেক দূর গড়িয়ে গিয়েছে। ওরা ভেগে পড়ছিল। দুলু গিয়ে মাঠের মধ্যে ওদের ধরে ফেলল। সেই জোয়ান দুলুকে ধরে বেদম মার দিল। দুলু জীবনে এই প্রথম শোচনীয়ভাবে পরাজিত হল। দুলুর সামনেই জোয়ানটা সরস্বতীকে জিজ্ঞাসা করল, “কী রে, কার সঙ্গে যাবি?” সরস্বতী দুলুর দিকে ফিরেও চাইল না। 

কী নিরাসক্তভাবে ঘটনাটা বর্ণনা করেছিল দুলু! “তারপর হাতে হাত ধইরা অরা গেল গিয়া।”

যে মুহূর্তে দুলুর মুখ থেকে এই উত্তাপহীন বর্ণনা বের হতে শুরু হল, সেই মুহূর্তেই আমি ওর সামনে থেকে ভয়াবহ বেগে সরে যেতে লাগলাম। আলোর গতিতে ভর করে। শতাব্দীর পর শতাব্দী হু হু করে ছুটে বেরিয়ে গেল। আলো আর অন্ধকার, আলো আর অন্ধকার সাঁতরে পার হতে হতে আমি গিয়ে পৌঁছলাম পাণ্ডবদের রাজ্যে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। ব্যাধের শরে শ্রীকৃষ্ণ নিহত। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের শেষ অনুরোধ রক্ষা করতে যদুবংশের ষাট হাজার অসহায় অনাথা নারীকে নিয়ে চলেছেন নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিতে। হাতে তাঁর অপরাজেয় গাণ্ডীব, পৃষ্ঠে শরপূর্ণ তৃণীর। মুহূর্তে হিংস্র বাজপাখির মত দস্যুরা ছোঁ মেরে পড়ল সেই নারীর পালে। শুরু হল লুণ্ঠন, ধর্ষণ। রমণীদের আর্তস্বরে সেই প্রান্তর, বনভূমি পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। বহু নারী স্বেচ্ছায় সোল্লাসে দস্যুদের অনুগামিনী হল। বাকিগুলোকে তারা ধরে-বেঁধে বলপূর্বক অপহরণ করল। অসহায়, অথর্ব পুরুষত্বহীন অর্জুন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন। তাঁর গাণ্ডীব পর্বতের মত গুরুভার। তুলতেই পারলেন না। মুহূর্তে আবার ফিরে এলাম ১৯৬১ সালে, মধ্যপ্রদেশে উদ্বাস্তু উপনিবেশে। দেখলাম, অর্জুন সিঙ্গল প্লাই ত্রিপলে ঢাকা নিচু এক তাঁবুতে কেঁচোর মত বুকে হেঁটে অনায়াসে ঢুকছে আর বেরুচ্ছে। আর নিস্পৃহ নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলছে, “তারপর হাতে হাত ধইরা অরা গেল গিয়া।”

কিছুদিন আগে আমার এক কবিবন্ধুর সঙ্গে মহাভারতের এই প্রসঙ্গটি সম্পর্কে আলোচনা হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, আমার মনে হয়, মহাভারতের এই ঘটনাটাই সব থেকে শোচনীয় ঘটনা। আমার বন্ধুটি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “কোন্ অংশটি সব থেকে শোচনীয়?” বলেছিলাম, “বলবীর্যহীন অর্জুন অক্ষম চোখে চেয়ে আছেন আর তার চোখের উপর দিয়ে যদু-রমণীদের দস্যুরা লুঠে নিয়ে যাচ্ছে।” বন্ধুটি বলেছিলেন, “অর্জুন রক্ষা করতে পারবেন না জেনে কিছু রমণী স্বেচ্ছায় তাঁর সামনে দস্যুদের অঙ্কশায়িনী হয়েছিল—এই ঘটনা আরও মর্মান্তিক।” জানি না, অর্জুন এই ঘটনাটা ঠিক কীভাবে যুধিষ্ঠিরের কাছে বর্ণনা করে ছিলেন। “তারপর হাতে হাত ধইরা অরা গেল গিয়া।” সম্ভবত এইরকম অতি স্বাভাবিকভাবেই। 

দুলুর ঘটনা আমাকে এতটা উত্তেজিত করেছিল যে, রঙ্গচারীকে না জানিয়ে পারিনি। ঠিক যেভাবে এখন লিখলাম, অবিকল এই জিনিসই তাকে পরিবেশন করেছিলাম। অর্জুনের কাহিনীটাও বাদ দিইনি। আমার দুর্ভাগ্য, সে তখন সাদা চোখে ছিল; এক ফোঁটা মদও ওর পেটে পড়েনি। 

এক মুহূর্তও দেরি করল না রঙ্গচারী, বলল, “দি গ্রেটেস্ট ট্র্যাজেডি ইজ দিস, সে সময় সংবাদপত্র ছিল না। ষাট হাজার নারীধর্ষণ অ্যাও দেয়ার ওআজ নো নিউজ পেপার! নো ব্যানার হেডলাইন! জাস্ট থিংক অব ইট, ম্যান। আমার চিফ শুনলেই হার্টফেল করে মারা পড়বে। একটা নারী ধর্ষণের খবর পেলেই ইট ক্রিয়েট্স্ স্টার ইন্‌সাইড হিজ অ্যাবডোমেন। রঙ্গচারী, রঙ্গচারী, যাও, বিস্তৃত বিবরণ যোগাড় করে আনো। আই ওআন্ট এভরিথিং, ডু ইউ ফলো। একবার আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, শ্যাল আই ব্রিং দ্যাট রেপড্ গার্ল, বস? হা হা হা। ডু ইউ নো, তার জবাবে দ্যাট করোচ কী বলেছিল, দ্যাট্স নট এ ভেরি ব্যাড আইডিয়া। আই উইশ ইউ লাক।”

একটু থেমে রঙ্গচারী বলল, “সময় সময় আমার কী মনে হয় জানো, সেই যে নাগারাজ্যের গভীর জঙ্গলে হেড-হান্টাররা থাকে, আমরাও জাস্ট লাইক দ্যাট, কতকগুলো হেডলাইন হান্টার মাত্র। এ বিষয়ে খবর কাগজ মাত্রেই এক—লণ্ডন টাইমস্, নিউইয়র্ক টাইম্‌স্‌, টাইম্‌স্‌ অব ইণ্ডিয়া আর পাকিস্তান টাইম্‌স্-এ মূলত কোনও তফাত নেই। সবাই হেডলাইন হান্টারস্; অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ পঞ্জাব গুর্জর মহারাষ্ট্র হিন্দী উর্দু তামিল তেলেগু রুশী চিনা জার্মান জাপানি ফরাসিস—সব এক। একই গোষ্ঠী—ব্রাদারহুড অব হেডলাইন হান্টারস্। ডু ইউ ফলো?” 

*

“আচ্ছা, তুমি কেন দেশ ছেড়ে এসেছিলে, দুলু? ভয়ে?” দুলুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। 

“ক্যান যে আসছিলাম, ছার,” একটা ফাঁকা স্বর জবাব দিয়েছিল, “অখন আর কইতে পারুম না হয়ত, তবে ভয়ের লাইগ্যা আসি নাই নিচ্চয়।”

দুলু মাথাটা ঝুঁকিয়ে ভাবতে লাগল। “আপনে ত আমারে দ্যাখছেন আগে। আমারে লইয়া কত অশান্তি হইছে। দ্যাশে আমার আরও বল আছিল, ছার। ডর-ভয় আমার আছিল না। দাঙ্গা-কাইজ্যা কত করছি। কতবার ধইরা সদরে লইয়া গেছে। ফাটকও খাটছি। ডর-ভয় করি নাই কেউরে। অখন আমি ডরাই। হিন্দুস্তানে আইসা ডরাইতে লাগছি।”

“তোমার উপর কেউ যখন অত্যাচার করেনি” 

“আত্যাচার? আমার উপরে?” দুলু হঠাৎ থেমে গেল। “নমর পোলারে ছার, সহজে কেউ ঘাঁটায় না। আমাগো গায়ে সহজে কেউ হাত দেয় না, দেয়ও নাই। মিয়াগ লগে কাইজ্যা করছি, আবার মিল্যা-মিশ্যা বাসও করছি। কাইজ্যা ত নতুন না, হিন্দুস্তান-পাকিস্তান হইবার আগেও ত দাঙ্গা-কাইজ্যা হইছে ছার, বাপ-দাদারাও কাইজ্যা কইরা গেছে, কেউ ত তখন দেশ-গাঁও ছাইড়া পালায় নাই। 

“তবে এলে কেন?” 

“সেইটা ত ছার কইতে পারি না। নানান কথা শুনছিলাম তখন।”

“কী শুনেছিলে?” 

“শুনছিলাম ত পাকিস্তান হইছে মিয়াগ লাইগ্যা, হিন্দুস্তান হিন্দুগ লাইগ্যা। পাকিস্তানে থাকলে হিন্দুগ জাত-ধরম কিছু থাকব না।”

সে নিজের জন্য আসেনি। একটা আস্ত মানুষ হাঁটুভাঙা 

(দুলু পাকিস্তানে থাকলে নিজেকে বাঁচাতে পারত। জাতকে বাঁচাবার জন্য ভিটেমাটি ছেড়ে উঠে এসেছে। উদ্বাস্তু হয়েছে। আসাম থেকে বাঙালিরা আসছে, নিজেকে বাঁচাতে নয়, নিজেকে বাঁচাতে অনেকেই পারত, এখনও পারে, ওরা আসছে বাংলা ভাষার ইজ্জত বাঁচাতে। এক ব্যাধি সর্বত্র ঢুকেছে। মানুষ ভাবছে না, সে মানুষ। ভাবছে না, তাকে নিয়েই জাতি, তার জন্যই ভাষা। ভাবছে সে জাতির-অস্তিত্বহীন একটা সংজ্ঞার—অংশ। সে বাঙালি, সে অসমিয়া, সে হিন্দু, সে মুসলমান, সে ভারতীয়, সে পাকিস্তানি—কিন্তু সে রক্তমাংসের, চোখ কান নাক মুখ মস্তিষ্ক মেরুদণ্ড হাত পা পাকস্থলী জননেন্দ্ৰিয় বিশিষ্ট একটা ব্যক্তি—একটা দুলু নমশূদ্রই শুধু নয়। দুলু নমশূদ্র যদি দুলু নমশুদ্রই থাকত, তা হলে তাকে জন্মভিটে ছেড়ে চলে আসতে হত না। তার অধিকার বজায় রাখার জন্য সে দাঙ্গা করত, মরত নয় জেল খাটত, কিন্তু আকার-অবয়বহীন আর একটা সংজ্ঞা——উদ্বাস্তু হত না।) 

“এখন তোমার কী আছে, দুলু?” 

“অখন? কিছু না।” সেই সরল নিরুত্তাপ উত্তর। “অখন ত ছার জাতও গেল, প্যাটও ভরল না। বুঝি পরানডাই যায়।”

“এমনই যদি অবস্থা, ফিরে গেলে না কেন?” 

“অনেকবার সে কথা মনে হইছে ছার, কিন্তু বর্ডারের কথা মনে পড়তেই পিছাইয়া গেছি। আমাগো ছার অভিমন্যুর দশা হইছে। ঢোকতে জানি, বাইর হওনের রাস্তা জানি না।”

আমার প্রশ্ন ফুরিয়ে গিয়েছিল। এবার দুলুই আচমকা প্রশ্ন করল, “আচ্ছা ছার, এইখানে যে আমাগোর আনল, কী করব, কইতে পারেন?” 

“তুমি শোনোনি?” আমি সরকারি হ্যান্ড আউট আউড়ে গেলাম, “সাত একর করে জমি পাবে, হালের গোরু, বাড়িঘর, হেল্থ্ সেন্টার, ইস্কুল, সমবায়ী শিল্প, নতুন উপনিবেশ—” 

“আচ্ছা ছার, ডোল পামু ত?” 

“কী বোকা তুমি, দুলু। তোমায় জমি দেবে, তুমি ভিক্ষুকের মত ডোল নেবে কেন?” 

জীর্ণ শীর্ণ হাত দুটো আমার দিকে তুলে ধরল দুলু, শূন্য মুখে আমার দিকে চাইল। “দেখেন ত ছার, এই হাতে ডোল নেওন ছাড়া আর কোন কাম হইতে পারে? ভাল কইরা দেইখ্যা লন।”

*

মানুষের প্রাথমিক আনুগত্য কার প্রতি? আসল আকর্ষণ, অনুরাগ কিসে? দেশের প্রতি? দেশ তো একটা ভৌগোলিক ধারণা। জাতির প্রতি? ধর্মের প্রতি? ওগুলো তো মনস্তাত্ত্বিক সংজ্ঞা। সমাজ, সংসার? এগুলোও তো আরোপিত সংস্কার। সন্দেহ নেই, এসব জিনিস মানুষকে বাড়তে সাহায্য করে, কিন্তু এগুলো মানুষের পক্ষে (মানুষও কী একটা সামষ্টিক ধারণা নয়? বরং ব্যক্তিমানুষ আরও স্পষ্ট।), ব্যক্তির পক্ষে অপরিহার্য নয়। আমি আমি—এ কথা যতটা স্পষ্ট, যতটা সত্য—কারণ আমাকে কখনই তুমিতে পরিণত করা যাবে না—আমি হিন্দু, আমি বাঙালি, এ কথা ততটা সত্য নয়। আমি আজ হিন্দু, কাল মুসলমান হয়ে যেতে পারি। সংসারে পরিবর্তন নিয়ত হচ্ছে। বাঙালি কাকে বলব? যে বাংলা ভাষায় কথা বলে? তা হলে পূর্ব পাকিস্তানের যে অগণিত জনতা বাংলা ভাষায় কথা বলে তারা কী বাঙালি? তারা কি বাঙালি নয়? সীমান্তের পশ্চিম পারে আজ যে ক্রুদ্ধ চিৎকার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে—যার নাম “বাঙালির দাবি” পূর্বপারের সেই একই ভাষাভাষী লোকগুলি কী তারও শরিক? তর্কের খাতিরে কোনও মন্তব্য কোরো না। তোমার মন যা বলে, বুদ্ধি এবং বিবেক যা বলে, সেই উত্তর দাও। (হামজার একখানা চিঠি, আমাকে লেখা)। 

নিজেকেই প্রশ্ন করেছি। উত্তর পাইনি। 

“বাঙালি তুমি কাকে বলবে?” হামজা মদের গ্লাস থেকে মুখ তুলে আমাকে একদিন সরাসরি জিজ্ঞেস করেছিল। “আমি তো বাংলা ভাষা ভাল জানি না। বলতে পারি, লিখতে-পড়তে পারি না। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে আমরা এইখানে আছি। এই কলকাতায়। আমার দেশ তো এইটাই। আমরা কলকাতার আদিমতম অধিবাসী। ওলন্দাজ জাহাজের দাঁড় টেনে আমার পূর্বপুরুষ ভাগীরথী অববাহিকায় প্রবেশ করেছিলেন। আমাকে কী বলবে তুমি?” 

“আমি বাংলা জানি। তোমার মতই জানি। সম্ভবত তোমার থেকে শুদ্ধ করে লিখতেও পারি। আমার বাবা খালি হাতে, তোমরা ঠাট্টা করে যাকে লোটা-কম্বল সম্বল করে আসা বলো, এখানে এসেছিলেন, ষাট বছর আগে।” মাতাদিন পোদ্দার আমার মুখের দিকে চেয়ে একদিন বলেছিল। (ওর মুখখানা আমার মনে পড়ল।) “আমার দাদার নাম বঙ্কিমচন্দ্র, আমার ছেলের নাম সুভাষ, ভাগ্নের নাম চিত্তরঞ্জন, নাতির নাম সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ হবে। আমাকে কী বলবে তুমি?” মাতুর মুখ টলমল করছিল সেদিন। “আমাকে কী বলবে তুমি? আমি সন অব দি সয়েল নই?” 

সুরঞ্জন রায়ের মুখ শুধু গম্ভীর। “লুক হিয়ার। আমি মাত্র সেদিন জেনেছি, আমি বাঙালি নই। আমার বাবা মৃত্যুশয্যায় বলে গিয়েছেন সে কথা। শুধু বলতে পারেননি, তিনি কোথাকার লোক। নিজেও জানতেন না। আভাসে তিনি শুনেছিলেন, উত্তরপ্রদেশের কোনও অঞ্চলে তাঁর বাবা ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। ওঁরা ছিলেন দ্বিবেদী ব্রাহ্মণ। ব্যস্। অনেক চেষ্টা করেও বাবা তাঁর পারিবারিক পরিচয়ের ছিন্ন সূত্র জোড়া লাগাতে পারেননি। এই মূর্খ অন্বেষণে আমিও ক’টা বছর বৃথা নষ্ট করেছি। না, খানদান সম্পর্কে আমার মাথাব্যথা নেই। আমার আগ্রহ ছিল সস্তা গোয়েন্দাগিরির; আমার মা বাঙালি ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে। এমন পরিবার, বাংলা মুলুকের সঙ্গে যাদের সাত-পুরুষের কোনও যোগাযোগ নেই। ইতিহাসের সঙ্গে তাদেরও বরাবরের বিচ্ছেদ। আমার দাদামশায় ছিলেন দরিদ্র, কিন্তু নিষ্ঠাবান পূজারি ব্রাহ্মণ। আমার মা তাঁর একমাত্র মেয়ে এবং তিনিও তাঁর পিতামাতার একমাত্র সন্তান। কাশীতে ওঁরা থাকতেন। ধর্মে আমার বাবারও প্রগাঢ় নিষ্ঠা ছিল। সেই সূত্রেই বাবা-মার বিয়ে হয়ে থাকবে। আমার বাবা ঘটনাচক্রে পূর্ববঙ্গে মানুষ। বাঙালি পরিবারে মানুষ। ছোটবেলায়, বাবা তখন ছ বছরের শিশু, তাঁর বাবা-মার সঙ্গে ট্রেনে করে যাচ্ছিলেন, কলেরায় দুজনেই মারা যান——আমার ঠাকুমা ট্রেনের কামরাতেই, ঠাকুরদাদা জংশনের রেল হাসপাতালে। হাসপাতালের ডাক্তারই, তাঁকেই ঠাকুরদাদা সম্ভবত পরিচয় কিছু বলে গিয়েছিলেন, বাবাকে প্রতিপালন করেন এবং খোট্টার ছেলেটার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও তার দীর্ঘ টিকি ছেঁটে ফেলে, রায় উপাধি দিয়ে, তাকে বাঙালি অভ্যাসের দাস করে তোলবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সেই থেকে আমরা বেমালুম বাঙালি, বাঙালিই শুধু নই, কাঠবাঙালও।”

সোলান নম্বর ওআনের তৃতীয় পেগ উজাড় করে সুরঞ্জন বলল, “বাংলা প্রকৃতই আমার মাতৃভাষা কিন্তু আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি ইংরেজিতে। আমি তবে কী? বাঙালি, না খোট্টা, না ইংরেজ?” 

এইসব সমস্যার তীব্র আবর্তে পড়ে আমি যখন হাবুডুবু খাই, অস্বস্তিতে অস্থির হয়ে উঠি— অস্বস্তি এই কারণে যে, এই আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসার সন্ধান আমার জানা নেই, আমিও অভিমন্যু – অল্পজ্ঞান ভরসা করে জটিল ব্যূহে প্রবেশ করতে পারি, আগম জানি, নির্গম জানি না—তখন আমি মদ খাই, মদ খাই আর অস্থিরতা বাড়ে, অস্থিরতা বাড়ে আর সমস্যাগুলো প্রকট হয়ে ওঠে আর পাকে পাকে জড়িয়ে ধরে, অস্থির, অস্থির, অস্থির করে তোলে। অফিসের কাজে গাফিলতি, পরিবারে অশান্তি ঘনিয়ে ওঠে (“কথা বলো, কথা বলো, ওগো আমার সঙ্গে দুটো কথা বলো না!”), এক আর্তনাদ বহু রাত্রে শুনতে হয়। ব্যবধানের দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর একই শয্যার ভাগী আমাকে আর আমার স্ত্রীকে যোজন যোজন দূরে সরিয়ে দেয়। (“কথা বলো, কথা বলো, ওগো আমার সঙ্গে দুটো কথা বলো না!”) শরীরী সান্নিধ্যে এ ব্যবধান হয়তো সাময়িকভাবে ঘুচত কিন্তু সে অন্তঃসত্ত্বা, অথবা ঋতুমতী, অথবা পীড়িত 

ঋতুমতী, অথবা পীড়িত। আমার তলপেটের আগুনকে পরিশ্রান্ত ইঞ্জিনের বয়লারের জ্বলন্ত কয়লার মত ঝেড়ে ফেলতে হয়। তখন একমাত্র ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর অস্তিত্ব – বাচ্চার পেচ্ছাবের ঝাঁজালো গন্ধ—আমার আত্মা আর বাস্তবে সেতুবন্ধ রচনা করে। তখন মনে হয়, এই গন্ধ সত্য, জগৎ সত্য, আমি এই জগতের জীব—যে জগৎ বর্তুলাকার পৃথিবীর আধারে স্থিত হয়ে এক নির্দিষ্ট দণ্ডে নিয়ত ঘূর্ণমান, এক নির্দিষ্ট কক্ষপথে সতত ধাবিত—সেই আমি, আমার চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক, আমার স্নায়বিক জটিলতা, আমার বুদ্ধি-বিবেচনাও সত্য। যেহেতু পৃথিবী স্থির নয়, জগৎ স্থির নয়, সেই হেতু আমিও অস্থির। অস্থির, অস্থির, অস্থির। এই অস্থিরতা, এইসব জটিল সমস্যাও সত্য। মিথ্যা শুধু সমাধানের ভান, স্লোগানের বাগাড়ম্বর। 

*

হামজা বলেছিল, ‘আমি’, ‘তুমি’, ‘সে’—এই হল বাস্তবের সত্য। ‘আমরা’, ‘তোমরা’, ‘তারা-এ অস্তিত্ব ধারণায়। এ জগতে ‘আমি’ গড়ি, ‘তুমি গড়ো, ‘সে’ গড়ে। এর শক্তি কল্যাণের শক্তি। লক্ষ লক্ষ ‘আমি ‘তুমি’ ‘সে’ সভ্যতার পত্তন করেছি, মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়েছি, শিল্প সাহিত্য সংগীত বিজ্ঞান যন্ত্র সৃষ্টি করেছি। কিন্তু যে মুহূর্তে আমি ‘আমরা’ হয়ে গেলাম, ‘তুমি’ ‘তোমরা’ আর ‘সে’ ‘তারা’, সেই মুহূর্ত থেকেই ধ্বংসের শক্তি জন্ম নিল। জনতার শক্তি দিয়ে শুধু ধ্বংসই সাধন করা যায়, গঠনের কাজে প্রয়োজন ব্যক্তির শক্তি। আমাদের আজকের দুর্ভাগ্য এই, এ সভ্যতার মারাত্মক সংকটের কারণ এই, এ যুগে আমরা জনতার পায়ে আত্মসমর্পণ করে বসে আছি। এই সর্বগ্রাসী মারাত্মক শক্তির হাত থেকে নিস্তার পাওয়া শক্ত। এই হিংস্রতম ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন-সৃষ্ট দানব তার সৃষ্টিকর্তার রক্তেই তর্পণ করবে—এ যুগের সভ্যতার এই নিয়তি। 

সচরাচর আমি এরকম আলোচনায় যোগ দিতে চাই না। ওরা সবাই আলোচনা করে, আমি সেই অবসরে তারিয়ে তারিয়ে গেলাসে চুমুক দিয়ে যাই। ওদের আলোচনা থেকে হঠাৎ হঠাৎ এক একটা সমস্যা, এক একটা প্রশ্ন তীব্রভাবে ছুটে এসে আমার মগজে আঘাত করে, শরীরে অস্থিরতার শিহরন জাগে। কেন জানিনে, সেদিন আমার মুখ থেকে চট করে বেরিয়ে গেল, “এ তোমার চরম মতবাদ, হামজা।” বলেই লজ্জিত হলাম। 

‘কোন্‌টা চরম?” 

আর চারা নেই। বললাম, “তুমি নৈরাজ্যের কল্পনায় বুঁদ হয়ে আছ, হামজা। ব্যক্তির এককত্বে অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ বাড়াবাড়ি নয় কি?”

“ব্যক্তি মাত্রেই একক। ব্যক্তিত্বই এককত্ব।”

“কিন্তু তার সমাজও তো আছে। সেই কঞ্চির গল্পটা জানো তো? একটা একক কঞ্চি মট করে ভেঙে যায়, কিন্তু এক আঁটি কঞ্চিকে ভাঙা যায় না।”

হামজা বলল, “আঁটি বাঁধায় আমার আপত্তি তোমায় কে বললে? আঁটির মধ্যে কঞ্চির কঞ্চিত্ব হারায় না, হারায় কঞ্চি দিয়ে মণ্ড প্রস্তুত করলে। জনতা হচ্ছে ব্যক্তির মণ্ডরূপ। আমার তাতেই আপত্তি।”

ওলিম্পিয়ার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে তখন একসঙ্গে কিছু লোক ঢুকে পড়ল। ওদের পোশাক ঝাড়া দেখে বুঝতে পারলাম, বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। হঠাৎ দেখি- বুলা। সঙ্গে বোধ হয় স্বামী আর বেশ হৃষ্টপুষ্ট এক খোকা।  বুলারই ছেলে। বুলার দেহেও প্রচুর মেদ জমেছে। বুলা আমাকে দেখতে পেল। চিনতে পারল। একটু হাসল। তরতর করে এগিয়ে এল। তারপর ওর মুখটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। কানের কাছে মুখ নামিয়ে, হামজা যাতে না শুনতে পায়, বলল, “উচ্ছন্নে গেছ তা হলে! আবার এসবও ধরেছে!” উত্তরের অপেক্ষা না করেই তরতর করে আবার ফিরে গেল। অনেক দূরের একটা টেবিলে গিয়ে বসল। 

হামজা বলল, “কী, পুরনো ক্ষত?”

দেখলাম, বুলা বারবার আমার দিকে চাইছে। মুখ নামিয়ে ওর স্বামীকে কী বলল। ওর স্বামীও আমার দিকে চেয়ে স্মিত হাসলেন। আমি মাথা ঝুঁকিয়ে জবাব দিলাম। দেখলাম, প্রচুর খাবার এল। বুলা প্রচুর খেল। ও বরাবরই একটু গত্তিলাগা মেয়ে, যদিও এখন তার ডবল হয়েছে। কলেজে পড়ার সময় ও খুব কম খেত। বলত, “বাচ্চা বয়েস থেকে খাইয়ে খাইয়ে মা যা জমিয়ে দিয়েছে শরীরে, এখন তা ঝরাই। এখন বুলার সেই কৃচ্ছ্রসাধনের প্রয়োজন বোধ করি ফুরিয়েছে, তাই মা ছোটবেলায় যে অভ্যাস করিয়ে দিয়েছিলেন, ও এখন প্রাণপণে সেটা ঝালিয়ে নিচ্ছে। 

যাবার সময় ওরা আবার আমার কাছে এল। তখন আমার চোখে রং ধরেছে। এই বুলার শরীর ভেদ করে সেই বুলাকে দেখবার চেষ্টা করলাম। সেই বুলা যেন জলের তলে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিফলনে ওর আকারটার তাই যেন বিকৃতি ঘটেছে। বুলা ওর স্বামীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে। 

বললে, “বাবা মারা গেছেন, জানো? বাবলু মেম বিয়ে করে ফিরেছে। মা’র কষ্টের আর শেষ নেই। একদিন এসো না আমাদের বাড়িতে। কী গো, বলো না!” 

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসবেন বইকি। যে-কোনও রবিবার। এই তো কাছেই বাড়ি। ছ নম্বর বাস। বাঁশদ্রোণী। পোস্টাফিসের কাছেই।” মনে হল স্বামীটি খুবই বশংবদ হবার চেষ্টা করছে। 

বললাম, “রবিবারে আমার তো ছুটি নেই।”

“তাতে কী, তাতে কী! বেশ তো, যে-কোনও দিন আসতে পারেন, যেদিন আপনার খুশি। ও তো সর্বদাই বাড়িতে থাকে। মানে ওর হার্টটা—” 

বুলা বাধা দিয়ে বলল, ‘বেশি বোকো না। তোমার কার্ড একখানা ওকে দিয়ে দাও।”

*

বুলার অনুরোধ আমি রেখেছিলাম। বাঁশদ্রোণীর একখানি শৌখিন বাড়িতে এক বিগত মধ্যাহ্নে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। বুলার বাড়ি, বুলার নিজের বাড়ি। “আর কতদিন ভাড়া বাড়িতে থাকবে! হ্যাঁ গো, ভাড়া তো কম দিতে হচ্ছে না! বাড়ি করার চেষ্টা দ্যাখো না!” আমার স্ত্রীর নিরন্তর তাগিদ। “আসলে তোমার গা নেই। নইলে এত লোক বাড়ি করছে, আর তোমার হয় না?” স্বামী হয়েছে, তারপর বাড়ি, তারপর গাড়ি। “গাড়ি কলকাতা শহরে বাড়ির চেয়েও জরুরি। ট্রাম-বাসের যা অবস্থা—নুইসেন্স। ট্যাক্সির অবস্থা আরও খারাপ।” আমার এক সদ্যঃপ্রতিষ্ঠ বন্ধুর উক্তি। “বাসে-ট্রামে প্রাণ হাতে করে চলতে হয় কলকাতায়। দুর্ঘটনার কথা ছেড়েই দিচ্ছি। চাপা পড়ার কথাও বলছিনে। বাসে উঠে পড়ার পর আর চাপা পড়ার ভয় কী? তখন ভয় পাবলিকের মার খাবার।” আমার এক নিরীহ বন্ধুর—কবি—সকাতর মন্তব্য। “কলকাতার লোক যে কী পরিমাণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে, তা বোঝা যায় বাসে-ট্রামে নিত্য চড়লে। ড্রাইভার ক্ষিপ্ত, কন্ডাক্টার (সরকারি বাসের পরিভাষা পার্টনার) ক্ষিপ্ত, পথচারী ক্ষিপ্ত, বাস-যাত্রী ক্ষিপ্ত। যিনি দাঁড়িয়ে তিনি ক্ষিপ্ত, যিনি বসে আছেন তিনিও ক্ষিপ্ত। যে-কোনও অছিলায় যে-কোনও লোকের প্রাণসংশয় হয়ে যেতে পারে। হয়েছে। আমি নিজে অনেক ঘটনা দেখেছি। একদিন দেখি সিটে বসা একটি লোককে ধরে জনা কয়েক লোক বেদম মার দিলে। তার অপরাধ : সে নাকি তার সামনের সিটে বসা একটি মেয়ের ব্লাউজের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে। লোকটিকে আধমরা করে ফেলার পর তার স্বীকারোক্তি থেকে জানা গেল, সে দোষী নয়, দোষ তার পাশের লোকটির। তারপর তার পাশের লোকটিকে বেধড়ক ঠ্যাঙাবার পর তার গোঙানির পাঠোদ্ধার করে জানা গেল, এ লোক সে লোক নয়; সে লোকটি দুটো স্টপ আগে নেমে যাবার পর এ লোকটি তার জায়গাটি দখল করেছে। তখন পাবলিকের ক্রোধ কমল। আত্মসমালোচনা শুরু হল এবং কালক্রমে সকলেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে, মূল অভিযোগই ভুয়া; কারণ, স্টেট-বাসের সিটগুলো এমনভাবেই তৈরি যে, পিছনের সিটের হাত লোকচক্ষুর অগোচরে কিছুতেই সামনের সিটের ব্লাউজের ভিতর ঢুকতে পারে না। এবং আরও পরে জানা গেল, এই আজগুবি অভিযোগও যেমন কেউ করেনি, তেমনি সে অভিযোগ কারও কানেও যায়নি।”

একটু থেমে তিনি বলেছিলেন, “আমিও একদিন আর একটু হলেই পাবলিকের চাপড় খাচ্ছিলুম আর কি! দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছে, কিছুতেই সরবে না। মহিলাযাত্রীটি নামতে পারছেন না। আমি দু-তিনবার মিনমিন করে অনুরোধ করলাম। ফল হল না। তখন একটু রাগতস্বরে বললাম, কী মশাই, সরতে পারছেন না, মেয়েদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছেন! লোকটা তো সরলই না, অম্লান বদনে বলে বসল, হাম তুমকো জানতা হ্যায়, তুম পাকিটমার হ্যায়! মুহূর্তে দেখলুম পাবলিকের রক্তপিপাসু চোখগুলো আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠল। আর এক মুহূর্ত বিলম্ব হলেই সেদিন আমার দেহ পিষ্ট হয়ে যেত। একটুও বাড়িয়ে বলছি না, একেবারে পিষ্ট হয়ে যেত। বাঘ রক্তের গন্ধ পেয়েছে। ঝাঁপিয়ে পড়তে বাকি। কোনওরকম দ্বিধা করলাম না আমি। আত্মরক্ষার তাগিদে বিবেককে বলি দিয়ে——তার জন্য আমার অনুশোচনার অন্ত নেই—হীনতম অস্ত্র প্রয়োগ করলাম। খবরের কাগজ থেকে বাছা বাছা শব্দ তুলে নিয়ে সজোরে ছুড়ে মারতে লাগলাম, কেয়া, তুমলোগ ভেজাল খিলা খিলাকে বাঙালিকো খুন করতা হ্যায়, কলকাত্তাকো ছিনকে লেতা হ্যায়, সন অব দি সয়েলকো খুন চুষ চুষ কর মহল বানাতা হ্যায় আর উসকা তুম পাকিটমার বলতা হ্যায়, এতনা আস্পদা বাঢ় গিয়া কি প্রকাশ্যে বাঙালিকো বেইজ্জত করতা হ্যায়। প্রার্থিত ফল সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া গেল। তার আর্তনাদ কানে ঢোকবার আগেই একটা স্টপে নেমে গেলাম।”

সুন্দর বাড়িখানা বুলার। কত জায়গা সামনে। ছবির মত লন। বাহারি লতা। ফুলের টবগুলি প্রসাধনে সুন্দর একখানা ছবি হয়ে উঠেছে। আমার চোখ জুড়োল। আমি জানি, এ রুচি বুলার। এ সৃষ্টি বুলার। 

আমাকে দেখে খুশি হল বুলা। আন্তরিক খুশি। বুলার সাহচর্যে আমার অতীতের অনেকগুলো দিন আনন্দে কেটেছে। সপ্তাহে ছটা দিন ওর প্রতীক্ষায় থরথর করে কেঁপেছি। ছুটির দিনে ওর হস্টেলের দরজায়, কখন ও বেরুবে তার অপেক্ষায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছটফট করে পায়চারি করেছি। “আজ আমাকে ক্ষমা করো লক্ষ্মীটি, আমি জানি, এই চিরকুটটা পেয়ে তোমার কী অবস্থা হবে। বিশ্বাস করো, যন্ত্রণায় আমিও ছটফট করছি। ক্ষমা করো লক্ষ্মীটি, আজ আর বেরুবার অবস্থা নেই। কী হয়েছে তোমাকে খুলে বলাও যায় না। ধরে নাও কঠিন ব্যাধি হয়েছে। এ আমার মাসিক ব্যাধি। সত্যিই মাথা তুলতে পারছিনে। বু—” 

“কী হয়েছে বুলার? ইনফ্লুয়েঞ্জা? টাইফয়েড, নিউমোনিয়া, সর্দি-জ্বর? বলুন না, কী হয়েছে?” 

“না, না, ওসব কিছু না।” ওর রুমমেট জবাব দিয়েছে। 

“তবে?” 

“আচ্ছা যন্ত্রণা! সে আপনার শুনে কী হবে? আপনার সঙ্গে আমি বকবক করতে পারিনে। আমি চললুম।” সে ভিতরে চলে গেল। এই ঢং দেখে আমার পিত্তি জ্বলে গেল। 

বু-বু-বুলু বুলা। কী হয়েছে তোমার, কীসের যন্ত্রণা? করপোরেশনের বোবা পুকুরটা বুড়বুড়ি তুলল। আকাশ নি-রং, কলকাতা নীরস, এই অপরাহ্ণ ফাঁকা। 

—লক্ষ্মীটি, তুমি রাগ করবে জানি, কিন্তু কী করব? বাবার হঠাৎ সর্দিজ্বর হয়ে পড়ল। কিছুতেই ছাড়তে চাইলেন না। বিশ্বাস করো, এখানে আমার একদম ভাল লাগছে না। ফিরতে বোধ হয় সপ্তাহখানেক দেরি হবে। বুলা। 

——রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। কিছুতেই ঘুম আসছে না। সুষমাটা পাশের খাটে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমুচ্ছে। কী ঘুমুতেই পারে! বাবাঃ! হঠাৎ মনে হল, তুমি এসে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছ। ছুটে গিয়ে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল। তা বলে, এই খবরদার, কক্ষনো যেন এসব পাগলামি কোরো না। তোমার বুলু। 

…কাল রাত্রে ফিরতে বেশ দেরি হয়েছিল। সুপারিন্টেণ্ডেন্ট মাসিমা খুব রাগ করেছেন। কী পাগলামি করো, বলো তো! বু। 

——মুচকুন্দটা বালিশের নীচে রেখে দিয়েছি। তোমার বু। 

…তোমার পছন্দকে বলিহারি! এই ফটো তুমি ভাল বললে! আমার ভারী বিশ্রী লেগেছে। আমার গাল দুটো কী ব্যাঙের মত? যাঃ! বু। পুঃ আচ্ছা, ফটোখানা তুমি কীভাবে রেখেছ? দেখো, কেউ যেন দেখে না ফেলে। 

“সত্যি বাড়িটা তোমার ভাল লেগেছে? সত্যি বলছ?” 

“সত্যি বলছি। এখন আর তোমাকে মিথ্যে বলে লাভ কী?” 

“তার মানে আগে আমার কাছে খুব মিছে কথা বলেছ বুঝি?” 

“তা বলতে হয়েছে বইকি!” 

“সব মিথ্যে?” ওর চোখ কালো হয়ে এল। “যা বলেছ সব মিথ্যে করে বলেছ? মিথ্যে কথা বলেছ?” 

“সব কিছু মিথ্যে হবে কেন?” 

“যাক বাবা!” বুলার চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। 

“বুলা, আমাকে দেড় শ’টা টাকা দেবে?” 

সত্যি এ টাকাটা আমার ভীষণ দরকার। পরশু রাতে পাল্লায় পড়ে জুয়ো খেলতে বসে দেড়শ’ টাকা হেরে গিয়েছিলাম। 

“কী হবে ‘টাকা?” 

“জুয়ো খেলে হেরে গিয়েছি।” সত্যি কথাই বললাম। “দেনা শোধ দিতে হবে।”

“আচ্ছা, তুমি কী! একেবারে সর্বনাশের পথে নেমে চলেছ! মদ খাও, জুয়া খেলো! আচ্ছা, টাকা যদি না দিই?” 

“কাবুলির দ্বারস্থ হব।”

“থাক, আর বাহাদুরিতে কাজ নেই। তুমি সব পারো। দিচ্ছি টাকা।”

“শোধ দেব না কিন্তু।”

এতক্ষণ পরে বুলা খিলখিল করে হেসে সোফায় গড়িয়ে পড়ল। “কবে শোধ দিয়েছ?” 

*

বুলাকে দেখা মাত্র হামজা কিন্তু ধরে ফেলেছিল। পাকা লোক! জিজ্ঞাসা করেছিল, এ আমার পুরনো ক্ষত কি না। আমি জানি, এমন অনেক ক্ষত হামজার হৃদয়ে আছে। আমি আগে এতটা বুঝতে পারিনি, এখন বুঝলাম এ ক্ষত বহু পুরনো হয়ে গিয়েছে। সম্ভবত দাগও মিলিয়ে গিয়েছে। এখন বুলার সামনে বসতে কোনও যন্ত্রণা নেই। (‘কী যাতনা যতনে, মনে মনে, আমার মনই জানে—নিধুবাবুর টপ্পা)। না, কোনও যন্ত্রণা নেই। বুলা আমাকে টাকা এনে দিল। চর্বি-টানটান মোটা গদা হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আমার গা ছুঁয়ে বলো, আর জুয়ো খেলবে না। মদ খাবে না। (শরৎবাবুর নভেলের হিরোইন।) আমি ওর হাতটা ধরলাম। যন্ত্রণা নেই। আস্তে করে ওর কোলের উপরে হাতটা নামিয়ে দিলাম। (যন্ত্রণা নেই।) 

“এখনও বিয়ে-থা করোনি বুঝি?” 

“না।” মিথ্যে কথা বললাম। (যন্ত্রণা নেই।) 

“সে আমি বুঝেছি।”

“কি করে বুঝলে?” 

“বাঃ, এ কী আর বুঝতে বাকি থাকে! বিয়ে-থা করলে কেউ বুঝি এমন মদ খেয়ে জুয়ো খেলে বাউণ্ডুলে হয়ে ঘুরে বেড়ায়!” 

কথা বললাম না। (যন্ত্রণা নেই।) 

“বিয়ে-থা করোই বা নি কেন?” 

‘তোমার জন্য।” ডাহা মিথ্যে। (যন্ত্রণা নেই।) 

আমার শরীর শান্ত, মন 

“না, না, এ পাগলামি ভাল নয়।” চিকচিক করে উঠল বুলার মুখ। বুলা খুশিই হল। বুলা দুঃখিত হবার চেষ্টা করল। (যন্ত্রণা নেই। নিথর। ক্ষতটা অনেক অনেক পুরনো হয়ে গিয়েছে।) 

বুলা মাঝে মাঝে তার ওখানে যেতে অনুরোধ করল। ওর ভাই মেম বিয়ে করে এনেছে, বুলা সেজন্য পীড়িত। ওর মা মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন, বুলা সেজন্য পীড়িত। ওর বাবা হঠাৎ মারা গেলেন, টাকা-পয়সার বিলিব্যবস্থা কিছুই করে যেতে পারেননি, কোম্পানি অনেক পাওনা মেরে দিয়েছে, বুলা সেজন্য পীড়িত। এই বাড়ি করা নিয়ে ওর শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে বুলার স্বামীর বিচ্ছেদ হয়ে গিয়েছে, বুলা সেজন্য পীড়িত। হার্টের অসুখ বুলাকে ক্রমশ কাবু করে ফেলছে, বুলা সেজন্য পীড়িত। পৃথিবীর হাজারটা সমস্যা বুলাকে পীড়িত করে তুলেছে, তুলছে। সে কথা বলার লোক চায়। নিরাপদ আশ্রয়ে বসে মনের গ্লানি নিষ্কাশন করে ফেলার জন্য সহানুভূতিশীল এক শ্রোতার ওর বড় প্রয়োজন। ওর মনের যা অবস্থা, এই অবস্থায় এই ধরনের মেয়েরা সহজেই সহানুভূতিশীল পরপুরুষকে আঁকড়ে ধরে। আদালতে সূক্ষ্ম মারপ্যাঁচে যা সহজেই ব্যভিচারের মামলা হয়ে দাঁড়ায়। আসলে এদের আসক্তি পুরুষে নয়, সহানুভূতিতে। 

বুলা কাতরভাবে অনুরোধ জানিয়েছিল মাঝে মাঝে ওর কাছে যেতে। “আসবে তো তুমি? আসবে তো?” এ আমন্ত্রণ আমার মনে কোনও যন্ত্রণার জন্ম দিতে পারল না। 

….তোমাকে না জানিয়েই আমি কিন্তু এক কাজ করে বসে আছি। আমার এ বিশ্বাস আছে, আমার জন্য যে ক্ষতিই তোমার হোক না কেন, তুমি হাসিমুখে তা স্বীকার করে নেবে। বাবা লিখেছিলেন যে, তিনি এবার আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনও লোক পাঠাতে পারবেন না। সেই চিঠি পেয়ে আমি তোমার কথা বাবাকে লিখি। বাবা লিখেছেন, তুমি আমাকে পৌঁছে দিলে বাবার কিছুমাত্র আপত্তি নেই। পত্রপাঠ দেখা করো। আমার স্পেশাল পার্মিশান নেওয়া আছে। হস্টেলের গেটে তোমাকে আটকাবে না। সিট রিজার্ভ করতে হবে। ওসব হাঙ্গামা পোয়ানো আমার সাধ্য নয়। বুলু। 

“দেহাতীত প্ৰেম সোনার পাথরবাটি। প্রেম আবার শুধুমাত্র একটা জৈবিক অভ্যাসও নয়। নিছক একটা বাষ্পীয় অথবা সহজাত অন্ধ সংস্কারও নয়। দেহ ও মনের নিবিড় মৈথুনে প্রেমের জন্ম হয়। দেহ যেহেতু পঞ্চভূতের সমষ্টি এবং পঞ্চভূত যেহেতু অনিত্য এবং মন সতত পরিবর্তনশীল, তাই প্রেম কখনও নিত্যকালের হতে পারে না, প্রেমও খণ্ডকালের। প্রেম তাই পরিণতি নয়, প্রেম একটি অবিরাম অন্বেষণ।” এ কথা আমি হামজার মুখে শুনেছি। তাও কখন, যখন তার স্ত্রী বেরিয়ে গিয়েছে অন্য পুরুষের সঙ্গে। “কোনও পুরুষই সম্পূর্ণ নয়, কোনও নারীই সম্পূর্ণ নয়, খামতি তাই থেকেই যায়, তাই আগমার্কা ঘৃতের বিশুদ্ধতা প্রেমের ব্যাপারে সম্ভব হয় না।” 

হামজার চোখে-মুখে এক গভীর বিষণ্ণতা। ওর নেবুবাগানের ফ্ল্যাটের জানলা থেকে দেখা যায়, উজ্জ্বল রোদ পাশের বস্তিটার অপরিসীম নোংরামিকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে ছেড়ে দিয়েছে। ডাস্টবিন উপচে পড়ছে, একটা ষাঁড় তিনটে খেঁকি কুকুর জটলা পাকিয়ে শুয়ে আছে, ঢাকঢোল পিটিয়ে সিনেমার বিজ্ঞাপন একটা ছ্যাকরাগাড়ি করে যাচ্ছে, গোটা আষ্টেক ন্যাংটা ছেলে তার পিছনে ছুটছে। দুটো ফাঁপা মেয়েমানুষ গায়ের কাপড় উদ্‌লা করে অলস অবসরে অবগাহন করছে। হামজার উপরের ফ্ল্যাটে তারস্বরে রক অ্যাণ্ড রোলের রেকর্ড বাজাচ্ছে। শিসের শব্দ, খপ খপ খপ হাততালি, ও বেবি, ও ও ও বে—বি, শিস, হাততালি, খট খট খট নৃত্য। ভূমিকম্প। হামজার শোবার ঘরে বসে মনে হল, উপরে ভূমিকম্প হচ্ছে। ওর ডবল-বেডটা খালি। একটু আগেই আমরা এসে ঢুকেছি। বসবার ঘর খালি, রান্নাঘর খালি, ডবল-বেড খালি। টেবিলের ওপর একখানা চিঠি ছিল, মলির হস্তাক্ষর, সেই চিঠি একটু আগে হামজার হাতে ছিল, হামজার চোখে ছিল, হামজার মগজে ছিল, এখন বিজলি পাখার হাওয়ায় ঘরের মেঝেতে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘুরতে ঘুরতে খাটের পায়ার কাছে বিশ্রাম নিচ্ছে। হামজার ঘরে রোদ নেই, রোদ বাইরে, ভাদ্রের বিকালের জ্বালা ধরা রোদ। ও বেবি—ও ও ও বেবি—খপ খপ খট খট, খেঁকি কুকুরগুলোর আর্ত চিৎকার। হামজার চোখ থেকে, মুখ থেকে, সমগ্র দেহটি থেকে অবসাদ ঝরে ঝরে পড়তে লাগল। টুপটুপ করে ঘাম ঝরছিল। পাখার হাওয়াতেও ভাদ্রের ঘাম মরে না। শুধু ঝরে। 

“ঝগড়া হয়েছিল নাকি?”

“না।”

“তবে কী মান-অভিমান?” 

“আমরা সিনেমার নায়ক-নায়িকা তো নই!” 

“তবে কী হয়েছিল যে, হঠাৎ—” 

“কী হবে? কিছুই না। এখন মনে হচ্ছে, আমার প্রতি ওর ভালবাসা ফুরিয়েছিল।”

“প্রেমে তুমি বিশ্বাস করো, হামজা?” 

“কেন করব না! নিশ্চয়ই করি। 

“তবে তুমি টুকিকে ছেড়েছিলে কেন? টুকিকে তো তুমি ভালবেসেই বিয়ে করেছিলে!” 

“মলি আমাকে ছাড়ল কেন? মলিও তো আমাকে ভালবেসেই বিয়ে করেছিল।”

“আমার মনে হয়, এর মধ্যে প্রেম ছিল না। প্রেম কী এত ঘন ঘন হয়? প্রেম কী একটা শাশ্বত জিনিস নয়?” 

“এ জগতে কিছুই শাশ্বত নয়। মানুষ নিয়ম জন্মায়, নিয়ত মরে। প্রেম তো মানুষেরই। সে আবার শাশ্বত হবে কেমন করে?” 

“বাঃ!” 

এই একটি মাত্র উচ্চারণেই আমার তর্ক স্তব্ধ হয়েছিল। তারপর যা কিছু বলার হামজাই বলেছে। আমি শুনে গেছি, আর দেখেছি, হামজার চোখ-মুখের তীব্রতা বিষাদে কেমন করে ঝাপসা হয়ে উঠেছে। 

অনেকক্ষণ পরে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “তোমার একটুও কষ্ট হচ্ছে না, হামজা?” 

আমার এই ছেলেমানুষি প্রশ্নে হামজার মুখে ম্লান হাসি টলটল করে উঠেছিল। “এ কথার কী কিছু জবাব হয়? এ যে কী ব্যথা, আমি জানি আর আমার মনই জানে।” 

.

…আজ তুমি অবশ্যই আসবে। মা’র জন্য একটা ওষুধ কিনতে হবে। বাবা সঙ্গে করে নিয়ে যেতে লিখেছেন। এদিকের কোনও দোকানে পাওয়া গেল না। চৌরঙ্গি থেকে কিনতে হবে। বুলা 

বুলা, বুলা, বুলা। অসহ্য। বুলা এক অসহ্য অস্তিত্ব। তার চোখ, তার মুখ অভিনব আশ্চর্য সকাল। তার স্মৃতি, তার উপস্থিতি বৈশাখের দুরন্ত ঝটিকা। সে এক আলোর দ্যুতি নক্ষত্রের অযুত অযুত। তার ছোঁয়া সমুদ্র উত্তাল। 

…কাল তুমি ট্যাক্সি নিয়ে ঠিক সময়ে হাজির হোয়ো। বরং একটু আগেই এসো, সময় হাতে থাকাই ভাল। তুমি এলে, তুমি কাছে থাকলে সময় যে কোথা দিয়ে পালায়, একটুও বুঝতে পারিনে। ট্রেন কিন্তু তোমার আমার জন্য একটুও দেরি করবে না; বাবা লিখেছেন গাড়ি নিয়ে শিলিগুড়ি স্টেশনে হাজির থাকবেন। বৃথাই আমরা বেশি পথের টিকিট কিনলাম। বু— 

আমি ভেবেছিলাম, দিন বুঝি আর কাটবে না। ভেবেছিলাম, বুলাকে পৌঁছে দেওয়া, সে বুঝি স্বপ্নই থেকে যাবে। ভেবেছিলাম, এই ব্রহ্মাণ্ড এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণে বিদীর্ণ হয়ে যাবে, কলকাতা ফুৎকারে উড়ে যাবে। পৃথিবী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বাইবেলি মহাপ্লাবনে। অথবা একটিও ট্যাক্সি পাব না সময়মত, ট্রেনখানি বেরিয়ে যাবে। কিন্তু সেসব কিছুই হল না। অনেক আগেই ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। বুলা মালপত্র নিয়ে ট্যাক্সিতে এসে উঠল। ট্যাক্সিখানা থরথর করে কাঁপছিল, শিয়ালদা স্টেশন (মা, দুটো পয়সা দ্যান; মা, দুটো পয়সা দ্যান; বাবু, বাবু, এই বাচ্ছাটা দুই দিন যাবৎ খায় নাই; মা, বাবু, বাবু, বাবু, মা গ) স্টেশনের ঘড়ি কাউন্টার একোয়ারি বইয়ের স্টল প্যাসেঞ্জার মালপত্র ওজনযন্ত্র রাস্তার বাতি সব থরথর করে কাঁপছে। শেষ পর্যন্ত আমরা নাম-লেখা কামরাও খুঁজে পেলাম। ছোট্ট একটা কুপে। এই প্রলয়ংকর পৃথিবীতে দুটি মাত্র আসন—একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। শ্রান্ত ক্লান্ত অবসন্ন আমি কামরায় ঢুকেই নীচের গদি-মোড়া আসনে শরীরটা বিছিয়ে দিলাম। কুলিরা কীভাবে মাল তুলল, সব মাল উঠল কি না, কত পয়সা দাবি করল তারা, কততে ফয়সালা হল, বুলা জানে। বুলা। বুলা, বুলু, বু। তুমি আমাকে স্বস্তিতে থাকতে দাও। আর পারিনে! 

কী আশ্চর্য রাত্রি! কী দ্রুত গতি রাত্রির, গাড়ির, আমার হৃৎস্পন্দনের! ওই দূরে, সহস্ৰ সহস্ৰ কোটি কোটি আলোকবর্ষের দূরতম প্রান্তে নীহারিকাপুঞ্জ, লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের ফাঁকে ফাঁকে স্বপ্নিল ছায়াপথ, ত্রস্ত মৃগের মত দ্রুত ধাবমান তারকারাজি, কত গ্রহ, কত উপগ্রহ। কত দূরে—কত, কত দূরে বুলা। বুলার অস্তিত্ব। হাত বাড়ালেই কী ছোঁয়া যায়? 

“এই, কী?” গায়ে হাত লাগতেই চমকে উঠল বুলা। “রাতটা কিন্তু বেশ লাগছে। এইভাবে যেতে কিন্তু বেশ থ্রিল, না?” বুলা আবার ভাবনার স্বপ্নের মধ্যে তলিয়ে গেল। আমি একা। কত নিঃসঙ্গ। কাল বিকালেও বুলা আমার সঙ্গে ছিল। আজও ট্যাক্সিতে আমার সঙ্গে ছিল। এখন এই একান্ত ট্রেনের কামরায় সে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে, ঐ আকাশে, ঐ সব গ্রহ-নক্ষত্রে, ছায়াপথে, পুঞ্জ পুঞ্জ নীহারিকায়। আমি একা! একেবারে একা! অস্থির, অস্থির। ট্রেনের চাকায় বর্তুল অস্থিরতা, ইস্পাতের রেলে সর্পিল অস্থিরতা, আমাতে দাউদাউ আগুনের অস্থিরতা। অস্থির, অস্থির। একাকিত্বের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে উপশমের আশায় বুলার কাছে ঘন হয়ে সরে বসলাম। সে ছায়াপথে সরে গেল। সেখান থেকে স্বপ্নের ঘোরে হাসল। তার চুল বাতাসে উড়ে উড়ে আমার মুখ-চোখ কোমলভাবে ছুঁয়ে যেতে লাগল। তার চুলের, দেহের ঘ্রাণ আমার নাসায়, আমার মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ল। অস্থির, অস্থির। কোথায় বুলা? ঐ বুলা হাসতে হাসতে শুক্রে মঙ্গলে বুধে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। এই যে তার কুমারী হাতখানা ত্বকের আবরণে মোড়া (হস্ত দ্বারা সৃষ্ট নহে—যেন খুঁজলেই লেবেলটা পাওয়া যাবে) আশ্চর্য, বুলা এখানে নেই। এখানে তার হাতখানা পড়ে আছে। এই ট্রেনের কুপেতে একেবারে অরক্ষিত। শাড়ির তবকে মোড়া ওর আশ্চর্য শরীর এখানে পড়ে আছে। অরক্ষিত। এই হাত, এই শরীর আমার কত কাছে! আমার নাগালের মধ্যে। আমার শরীরে অঢেল জ্বর, অনেক কাতরতা, অনেক অনেক অস্থিরতা। 

“এ কী, এ কী! কী করছ, অসভ্য বাঁদর কোথাকার!” এক ধাক্কায় বুলা আমাকে সরিয়ে দিল। নিজেকে সরিয়ে নিল, লাফিয়ে উঠল বুলা। প্রথমটা হতচকিত, পরে নিদারুণ রাগে, অপরিসীম ঘৃণায় ওর মুখখানা কদাকার হয়ে উঠল। ঠাস করে আমার গালে এক চড় কষিয়ে দিল। সেই চড় খাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার জ্বর দেশ ছেড়ে পালাল। ওর সেই রাগ দ্বেষ ঘৃণা আর অপমানের মিশ্রণে পরিবর্তিত কুৎসিত মুখখানা আমি আর সহ্য করতে না পেরে দু হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লাম। ট্রেন আমাদের ধর্ষিত অস্তিত্বকে কাঁধে তুলে আপন গন্তব্যে উল্কার গতিতে ছুটে চলল। “ফের যদি বাঁদরামো করার চেষ্টা করো, তবে চেন টানব।”

*

ট্রেনখানা শেষ পর্যন্ত বেরিয়েই গেল। প্রথমে ইঞ্জিনের লাইট, সাদা আলো, সাদা চোখ, ধোঁয়া, চোঙ, তারপর বাঙ্কার, তারপর পার্সেল কামরা, প্যাসেঞ্জার বগি, থার্ড ক্লাস, ইন্টার, ফার্স্ট, সেকেণ্ড, থার্ড ক্লাস, থার্ড, থার্ড, তারপর ব্রেকভ্যান, ছোট্ট একটা লাল আলো, গুটোনো ভ্যাকুয়াম পাইপ, বিচিত্র কাপলিং। গোটা ট্রেন কাপলিং-এ কাপলিং-এ জোড়া। পুরনো জোড় খোলে, নতুন জোড় বাঁধে। ভিন্ন ভিন্ন বিচ্ছিন্ন কামরা কাপলিং-এর আকর্ষণে ট্রেন হয়ে উঠে। ট্রেনখানা আমার সামনে দিয়ে অর্বুদ বছর ধরে সমানে চলবার পর অবশেষে তার শেষ দেখা গেল। আমাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। একটা প্রচণ্ড ঝড়, একটা দারুণ ঘূর্ণি, একটা প্রকাণ্ড শূন্যতা। হঠাৎ সব শূন্য হয়ে গেল। সামনে আর ট্রেন নেই। আমার দৃষ্টি হোঁচট খেয়ে শূন্যতার অন্তহীন গহ্বরে পড়ে গেল। শূন্য শূন্য। ফাঁকা ফাঁকা ফাঁকা। ওআচ অ্যাণ্ড ওআর্ডের পাহারাদারটা ফাঁকা লাইনে ঠং ঠং করে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে ভারী ভারী পায়ে এগিয়ে এল। “ইউনিয়নবাবু, এত কাছ থেকে তুমি কী দেখছিলে?” বললাম, “কী বড় গাড়িটা। র্বগুলো যেন আকাশে ঠেকছিল, আর কী লম্বা! কতক্ষণ যে লাগল শেষ হতে। যেন ফুরায়ই না।” ওআচ অ্যাণ্ড ওআর্ড হালস, “কী যে বলো, ইউনিয়নবাবু, পাগলের মত কথা। রোজ যে গাড়ি আসে, আজও সেই গাড়িই এসেছে, একই তার গতি।”

তারপর সে আসল কথা পাড়ল। রেশন নিয়ে বড় গোলমাল হচ্ছে। আটা যা দিয়েছে এবার, একদম গন্ধা। রেশন স্টোরে যারা কাজ করছে, তারা চোর। ওজনে কম দিচ্ছে। বাড়ি এনে সে জিনিসগুলো পাল্লায় ওজন করেছি, চিনি কম, আটা কম, দু দু ছটাক। চাল কম। আর কী কাঁকর! এরকম চলবে তো বাঁচব কী করে? আমাকে এসব অভিযোগ পেশ করতে বলল কোম্পানির কাছে। আমার মনে পড়ল, আজ ইউনিয়ন-অফিস খোলাই হয়নি। চাবি আমার কাছে। সতেরোটা দাবি করেছি আমরা। অনবরত দরবার চলেছে। রেল-শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। দরবারে কিছু হবে না। চাক্কা বন্ধ করতে হবে। আমরা যুদ্ধ সমর্থনের নীতি নিয়েছি। এখন ধর্মঘট করলে যুদ্ধ-প্রচেষ্টা ব্যাহত হবে। আমাদের সংগ্রামের পন্থা দরবার করা। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কমিউনিস্ট ইউনিয়ন। কমিউনিস্টরা যুদ্ধ সমর্থন করছে। প্রথম দিকে করেনি। তখন কমিউনিস্টরা আওয়াজ তুলেছিল : হিটলার ইম্পিরিয়ালিস্টদের শত্রু। আমরা ইম্পিরিয়ালিস্টদের শত্রু। হিটলার রাশিয়ার সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে। কমরেড হিটলার। এ যুদ্ধে এক পাই নয়, এক ভাই নয়। পরে মাত্র দু মাসও কাটে নি, হিটলার পোল্যাণ্ড গ্রাস করে রাশিয়ার মাটিতে ঢুকে পড়ল। কমিউনিস্টরা ধুয়ো বদলাল : এ যুদ্ধ একটা যুদ্ধ নয়, দুটো। হিটলার কমরেড নয়, হিটলার রাক্ষস। আমাদের শত্রু একটা নয়, দুটো—– ইম্পিরিয়ালিস্ট আর ফাসিস্ট। এক ফ্রন্টে ইম্পিরিয়ালিজমকে রোখো, আর এক ফ্রন্টে ফাসিজমকে রোখো। এক যুদ্ধ নয়, দুই যুদ্ধ। তারপর চার্চিল রুজভেল্ট-স্তালিন চুক্তি। কমিউনিস্টরা নতুন ধুয়ো ধরল : ফাসিবাদ সভ্যতার শত্রু। এ যুদ্ধ ফাসিবিরোধী যুদ্ধ। বজ্রকণ্ঠে তোলো আওয়াজ, দেবে না জাপানি উড়োজাহাজ, ভারতে ছুড়ে স্বরাজ। 

কমিউনিস্টরা এ যুদ্ধ সমর্থন করে। আমরাও এ যুদ্ধ সমর্থন করি। আমরা আর কমিউনিস্টরা প্রবলতম প্রতিদ্বন্দ্বী—ঘৃণ্যতম শত্রু। এ যুদ্ধ কাদের? আমরা চেঁচাই আমাদের। এ যুদ্ধ কাদের? কমিউনিস্টরা চেঁচায়- আমাদের। “এ যুদ্ধ আমাদের যুদ্ধ। আমাদের হাতে হাতিয়ার দাও।” এই জিগির আমরা তুলি। এই জিগির কমিউনিস্টরা তোলে। আমরা নীতিগতভাবে যুদ্ধ সমর্থন করছি। কমিউনিস্টদের সমর্থনের পিছনে, আমরা বলি, মতলব আছে। কমিউনিস্টরা নিঃস্বার্থভাবে যুদ্ধ সমর্থন করছে। আমাদের সমর্থন, কমিউনিস্টরা বলে, টাকা-খাওয়া সমর্থন। আমরা নীতিনিষ্ঠ, কমিউনিস্টরা সুবিধাবাদী; আমরা সুবিধাবাদী, কমিউনিস্টরা নীতিনিষ্ঠ। আমরা দালাল, কমিউনিস্টরা দালাল। আমরা সাম্রাজ্যবাদের দালাল, কমিউনিস্টরা রাশিয়ার দালাল। সাম্রাজ্যবাদী চার্চিল, পুঁজিবাদী রুজভেল্ট, সাম্যবাদী গুলিন এ যুদ্ধে দোসর। পরম মিত্র। এদের শক্তি মিত্রশক্তি। আমরা এ শক্তি-জোটের সমর্থক। কমিউনিস্টরা এ শক্তি-জোটের সমর্থক। আমরা আর কমিউনিস্টরা পরস্পরের শত্রু- নিদারুণ শত্রু। অথচ “এ যুদ্ধ আমাদের যুদ্ধ, আমাদের, আমাদের, আমাদের”- উভয়ের সোচ্চার চিৎকার। রেলের চাকা বন্ধ হলে সমর-সম্ভার, সৈন্য পরিবহণ বন্ধ হবে। দাবি-দাওয়া নিয়ে দরবার করো। দরখাস্ত করো। মিটিং-এ গরম বক্তৃতা ঝাড়ো। “আমাদের দাবি মানতে হবে, নইলে চাকা বন্ধ হবে। আমাদের মাঙ পুরা করো।”

যুদ্ধ কোথায়? বিজাটায়, টিউনিসিয়ায়, প্যারিসে, লণ্ডনে, স্মলনকে, স্তালিনগ্রাড়ে, রথিডং-এ, বুথিডং-এ, গুনাবুনায় আর কলকাতার সিনেমা-ঘরের রূপালি পর্দায় প্রতিফলিত নিউজ-রিলে, আর সরকারি প্রচারপত্রে আর আমাদের গলায়। কলকাতায় যুদ্ধ নেই, বাংলায় যুদ্ধ নেই, বিহারে যুদ্ধ নেই; কৈলাস থেকে কন্যাকুমারী, কামরূপ থেকে দ্বারকার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে, সমুজ্জ্বল সুনীল প্রশস্ত আকাশে কোথাও যুদ্ধ নেই। এখানে আছে যুদ্ধের মহড়া—মহড়ার যুদ্ধে রক্ত ঝরে না, বিধ্বংসী বোমায় জনপদের চিহ্ন মুছে যায় না, ট্যাংকের ফিতেয় মানুষের দেহ থ্যাঁতলানো কিমায় পরিণত হয় না, মর্টারের কামানের অব্যর্থলক্ষ্য গোলায় প্রত্যঙ্গ বিচ্ছিন্ন হয় না, টমিগানের নিশ্চিত কার্তুজে কারও খুলি ফুটো হয় না- সীমন্তিনীর সিঁদুর মোছে না, মাতার শোকে আকাশ-বাতাস হাহাকারে আর্ত হয়ে ওঠে না। এখানে যুদ্ধ নেই, যুদ্ধের মহড়া আর যুদ্ধের কন্ট্রাক্ট আর যুদ্ধের ভয় আর “এ যুদ্ধ আমাদের যুদ্ধ”, আর এক নাবালক বায়না—”আমাদের হাতে হাতিয়ার দাও”। 

আর লাল ইউনিয়নের, জঙ্গি রেল-শ্রমিক ইউনিয়নের গোপন সভায় গৃহীত চরম প্রস্তাব : “সামগ্রিকভাবে যুদ্ধ-প্রচেষ্টা সমর্থন এবং আঞ্চলিকভাবে, দাবি আদায়ের চাপ সৃষ্টির জন্য, সাময়িক ধর্মঘট”। আর এর সমর্থনে যুক্তি : এতে (১) শ্রমিক-শক্তির আস্থা কমিউনিস্টদের উপর থাকবে, (২) প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির নাশকতামূলক চক্রান্ত ব্যর্থ হবে, (৩) কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব জনগণের মধ্যে বৃদ্ধি পাবে (এ যুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদ এবং ফাসিবাদ সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হবে, পৃথিবীর বুকে একটিমাত্র পতাকা উড়বে- সর্বহারার বিজয়ধ্বজা, তারকাখচিত লাল নিশান, একটি মাত্র সংগীত— ইন্টারন্যাশনাল—শত কোটি বঞ্চিতের বুকে মুখে অহরহ ধ্বনিত হবে : “ওঠো জাগো অনশনবন্দি”-এ যুগের চাঁদ ভাই কাস্তে। স্তালিন, কমরেড কমরেড কমরেড স্তালিন, মহান স্তালিন সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন ভবিষ্যৎ ভেবেই। তিনি জানেন, তাঁর এই “মৈত্রী”র বলিষ্ঠ হাত আজ যারা আঁকড়ে ধরেছে, এই হাত সেইসব “মিত্রদের” টুটি টিপে মারবে। স্তালিন, মহান স্তালিন, বঞ্চিতদের ত্রাতা স্তালিন, তুমি যখন মুমুর্ষুর শয্যাপার্শ্বে গিয়ে দাঁড়াও তখন মৃতের পুনর্জাগরণ হয়, তোমার স্পর্শে গর্ভিণী সুপ্রসব করে, তুমি যখন শস্যক্ষেত্রের পাশে গিয়ে দাঁড়াও তখন শস্যের কীটসমূহ বিনষ্ট হয়। স্তালিন, স্তালিন, বিরাট স্তালিন, তোমার ছায়া সর্বত্রগামী।), (৪) ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী কমিউনিস্ট পার্টির শক্তির পরিচয় পাবে, এবং (৫) আমাদের সঙ্গে তখন আরও ভাল করে ওদের সমঝোতা হবে। অতএব ধর্মঘট, আঞ্চলিকভাবে সাময়িক ধর্মঘট। 

আর আমাদের পাংশু ইউনিয়নের গোপন বৈঠকে গৃহীত বিবেচনাসম্মত প্রস্তাব : (বিবেচনার উপর আমাদের অগাধ আস্থা ক্রমশ স্থাপিত হচ্ছে। আমাদের নতুন মন্ত্ৰ “মানুষ বিবেচনাশীল”। “ম্যান ইজ র্যাশন্যাল অ্যাও দেয়ারফোর মরাল।” নবদীক্ষিত আমার এক ক্ষীণস্মৃতি বন্ধু—মাত্র ম্যাট্রিক পাস, এক স্থানীয় শাখার নেতা—নতুন রিক্রটদের প্রায়ই মুখস্থ করাতেন : মানুষ ‘বিচরণশীল’—ম্যান ইজ র্যাশন্যাল অ্যাও দেয়ারফোর ‘মর্টাল’) – আমাদের বিবেচনাসম্মত প্রস্তাব : “সামগ্রিকভাবে যুদ্ধ প্রচেষ্টা সমর্থন, কীন্তু আঞ্চলিকভাবে দাবি আদায়ের চাপ সৃষ্টির জন্য ধর্মঘটের ধ্বনি এবং নেহাত অপারগ হলে প্রতীক ধর্মঘটের অনুষ্ঠান।”

আমাদের যুক্তি : এতে (১) রেল-শ্রমিকরা খুশি থাকবে। আমাদের উপর শ্রমিক-শক্তির আস্থা বৃদ্ধি পাবে, (২) কমিউনিস্টদের হীন চক্রান্ত ব্যর্থ হবে, (৩) জনসাধারণের গণতান্ত্রিক চেতনায় আমাদের পার্টি প্রভাব বিস্তার করবে (এ যুগে গণতন্ত্রের জয় নিশ্চিত। টোটালিটারিয়ানিজমের নাভিশ্বাস উঠেছে। ফাসিও-নাৎসি চক্রের পতন ঘটবে মিত্রশক্তির জয়ে। কমিউনিস্ট শক্তি এত প্রচণ্ড ঘা খেয়েছে—আরও খাবে— যে, সে আর মাথা তুলতে পারবে না। পুরনো ক্ষয়-ধরা গণতন্ত্রেরও পরিবর্তন ঘটবে। জন্ম নেবে আমূল গণতন্ত্র — ডিমোক্রেসি ফ্রম দি রুট। যূথবন্ধন থেকে মুক্তি পাবে ব্যক্তিমানুষ। একটি মাত্র সংগীত মানুষের বুকে মুখে ধ্বনিত হবে— “শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।” আমাদের মানবতন্ত্রী নেতা অনেক বিচার-বিবেচনা করেই এসব সমর্থন করেছেন এবং যেহেতু তিনি যুক্তিবাদী অতএব তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী কীছুতেই ব্যর্থ হতে পারে না। মানুষের যুক্তিশীলতায় তাঁর অগাধ বিশ্বাস। ম্যান ইজ র্যাশন্যাল অ্যান্ড দেয়ারফোর মর্যাল 1), (৪) ভারতের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী আমাদের ক্ষমতার পরিচয় পাবে, এবং (৫) ক্ষমতা হস্তান্তরকালে (এইভাবেই ভারত রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করবে, বিপ্লবের পথে নয়— আমাদের নেতার অন্যতম সিদ্ধান্ত।) আমাদের পার্টি সুবিধাজনক অবস্থায় থাকবে। অতএব ধর্মঘটের ধ্বনি, প্রয়োজনে প্রতীক ধর্মঘট।”

“আপনারা তো একই কথা বলেন। আপনারাও যা করতে চাইছেন, লালঝাণ্ডারাও তা করতে চাইছেন। ঝাণ্ডার রঙেও তো তফাত বোঝা যায় না। গ্যাংম্যান বোদাই লস্কর পি ডাব্লিউ আই সাহেবের ট্রলি মুছতে মুছতে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল। (তার মনটা তখন ছিল তার কোআর্টারে।) 

“তফাত অনেক হে, বোদাই। ফাণ্ডামেন্টাল ডিফারেন্স। আমরা গণতন্ত্রী আর ওরা কালেকটিভ ইগোতে বিশ্বাসী। ইতিহাসের ইনেভিটেবিলিটিতে ওরা বিশ্বাস করে। আমরা বিশ্বাস করি ইন্ডিভিজুয়ালের পোটেন্‌সিয়ালিটির আনফোমেন্টে—” 

বোদাইয়ের কোআর্টার থেকে অনেকক্ষণ ধরে চেঁচামেচি, ঝগড়া, গালিগালাজ আসছিল। সে বোঁ করে কোআর্টারে ঢুকে গেল। তারপর খানিক পরে তার বউয়ের চুলের মুঠি ধরে পিটতে পিটতে বের করে আনল। তারপর রেল-লাইনের ওপর তার বউয়ের মাথাটা ঠক-ঠক করে ঠুকতে লাগল। মাথা ফেটে রক্তগঙ্গা। আমি ছুটে গিয়ে বোদাইকে ধরে ফেললাম। “কমরেড কমরেড, করো কী?” বোদাই বোঁ করে ঘুরে দাঁড়াল। তারপর অশ্লীল গালাগালি দিয়ে আমার গালে কষে মারল এক চড়। আমার চোখে সর্ষেফুল। ঘুরে পড়ে গেলাম। লোকজন ছুটে এল। আরও সব গ্যাংম্যান। বোদাইয়ের বউয়ের ভাই, আত্মীয়স্বজন। তুমুল দাঙ্গা। আমি শুয়ে শুয়ে সবই দেখলাম। ভাগ্য ভাল, আমার গায়ে আর হাত পড়েনি। 

“কী মনে হয়, ইউনিয়নবাবু, চাকা বন্ধ হবে?” 

ওঅ্যাচ অ্যাণ্ড ওআর্ডের সেপাই-এর প্রশ্নে ওর দিকে মুখ তুলে চাইলাম। ততক্ষণে ইউনিয়ন-অফিসের কাছে এসে পড়েছি। কাল রাত্রির সেই চরমতম অভিজ্ঞতার পর থেকে এ ঘরে আর ঢুকিনি। জানলা খুলতে খুলতে ওর কথার জবাব দিলাম, “আমার তো মনে হয়, দাবির পিছনে যদি যথেষ্ট জোর থাকে আর দাবিতে যদি যুক্তি থাকে, তা হলে ধর্মঘটের দরকার লাগে না। তবে, আবার এই কথায় নিশ্চিন্ত হয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকাও তো চলে না! আমাদের প্রস্তুতি আমরা করে যাব, দাবি না মিটলে তো ছেড়ে কথা কইব না!” 

আমার ঘুম পাচ্ছিল। ওর সঙ্গে কথা বলে আমার মনের গ্লানি অনেকটা দূর হয়েছিল। এখন আমি বেজায় ক্লান্ত। ক্লান্ত, ক্লাস্ত… যেন আমার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে গিয়েছে। পুস্তিকা, পতাকা, প্রাচীরপত্রের গাদায় ধপ করে শরীরটাকে ফেলে দিলাম। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *