মনের চিকিৎসা
চিকিৎসার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কোনও রসিকতা করা উচিত নয়। কিন্তু অনেকেই জানেন, বিশেষ করে আমার চিকিৎসকমহোদয়রা জানেন জীবনে কোনও নিষেধই আমি তেমন মানিনি। তা ছাড়া লোকে কি হাসে না, হাসপাতালের ঘরে, ডাক্তারের চেম্বারে, নার্সিংহোমের বারান্দায়? এমনকী শ্মশানের শবযাত্রীরা পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে পরিহাস করে কখনও কখনও হো হো করে হেসে ওঠে। শ্মশানের ধোঁয়া-ভরা আমিষ-গন্ধ বাতাসে সেই হাসি বেমানান হলেও বিরল বা অস্বাভাবিক নয়।
চিকিৎসাসংক্রান্ত হাসির আখ্যানগুলির একটি বড় অংশ মানসিক চিকিৎসক নিয়ে।
এই সূত্রে প্রথম যে গল্পটি মনে পড়ছে সেটি এসেছে সরাসরি উন্মাদ আশ্রমের অভ্যন্তর থেকে। হাসপাতালের সুপারসাহেব একদিন পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে দেখলেন যে তাঁর এক আবাসিক খুব মন দিয়ে কী যেন লিখছেন। তিনি আবাসিককে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী লিখছেন?’ সদ্য-আবাসিক সেই মানসিক রোগী লেখা থেকে বিরত না হয়ে, মাথা না-তুলে সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন, ‘এই একটা চিঠি লিখছি।’
এর পরে কিছু না বললে খারাপ দেখায় তাই নেহাত সৌজন্যবশত সুপারসাহেব প্রশ্ন করলেন, ‘কাকে লিখছেন ?’
এইবার রোগী মুখ তুলে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন, ‘চিঠিটা আমাকেই লিখছি। আমার তো আমি ছাড়া কেউ নেই।’
সুপারসাহেবের মতো পোড়খাওয়া লোক, তিনিও এ রকম দার্শনিক বক্তব্য জীবনে শোনেননি। একটু অবাক হয়ে তিনি বললেন, ‘আপনি নিজেকে নিজে চিঠি লিখছেন ?’
পাগলবাবু অমায়িক হেসে বললেন, ‘ঠিক তাই।’
তখনই সুপারসাহেব বাধ্য হয়ে বললেন, ‘তা হলে আপনি নিজেকে কী লিখলেন।’
এবার হো হো করে হেসে উঠলেন পাগলবাবু, ‘চিঠিটা আগে আমার কাছে আসুক, পড়ে দেখি, তা হলেই তো বলতে পারব চিঠিতে কী লেখা আছে।’
পাগলবাবু চিঠিটা পান, ইতিমধ্যে আমরা অন্য গল্পে ঘুরে আসি। গল্পটি মর্মস্পর্শী।
মনের ডাক্তারবাবুর কাছে এক রোগী এসেছেন, রোগী ভদ্রলোকটি বেশ সম্রান্ত দেখতে, ফিটফাট, ধোপদুরস্ত জামাকাপড়। যথারীতি ডাক্তারবাবু রোগীকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার অসুবিধাটা কী?’ রোগী করুণ কণ্ঠে জানালেন, আর বলবেন না স্যার, আমার কাজকর্ম মাথায় উঠেছে, উপার্জন বন্ধ হতে চলেছে।’
ডাক্তারবাবু বলেন, ‘কেন, কী হয়েছে আপনার?’ রোগী বললেন, ‘আজ কিছু দিন হল কী হয়েছে না লোকজন, ভিড়ভাট্টা দেখলে আমার মাথা রিমঝিম করে, বুক দুরদুর করে, হাত পা অবশ হয়ে আসে।’ ডাক্তারবাবু বললেন, ‘তাতে কী আসে যায়? যাবেন না ভিড়ের মধ্যে। লোকজন হই-হট্টগোল এড়িয়ে চলবেন।’ ডাক্তারবাবুর পরামর্শ শুনে রোগী ডুকরিয়ে উঠলেন, ‘তা হলে যে সর্বনাশ হবে, আমি ধনে-প্রাণে মারা পড়ব। আমার কারবার মাথায় উঠবে।’ রোগীর এই কাতরোক্তি শুনে ডাক্তারবাবু স্তম্ভিত হয়ে বললেন, ‘কিন্তু কী কারবার আপনার তা তো বললেন না। রোগী এবার কবুল করলেন, ‘স্যার, আমি একজন পকেটমার।’
অন্য এক মানসিক রোগী ডাক্তারকে বলেছিলেন, ‘ডাক্তারবাবু, সব সময়ে কেমন অবসন্ন বোধ করি, কেমন যেন ঝিমঝিম ভাব। আমার মনে হয় আমার এমন কিছু দরকার যাতে আমার চনমনে ভাবটা ফিরে আসে। আমার সেই লড়াকু ভাব, যাতে যা কিছু সহ্য হয় না, যা কিছু অপছন্দ করি তা দেখলে রেগে উঠতে পারি, খেপে যেতে পারি। আমাকে এমন একটা ওষুধ দিন যাতে আমি উত্তেজিত হতে পারি।’
ডাক্তারবাবু মৃদু হাসলেন, তারপর বললেন, ‘কিন্তু এর জন্যে আপনার কোনও ওষুধ লাগবে না, চিকিৎসাও নয়।’ এই কথা শুনে রোগী কিছুক্ষণ ধরে ঝিম মেরে বসে থেকে তারপর মিনমিন করে বললেন, ‘তা হলে।’
ডাক্তারবাবু বললেন, ‘আপনার কোনও ওষুধ চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। আপনি যা যা চাইছেন তার জন্যে আমার বিলই যথেষ্ট।’ এই বলে ডাক্তারবাবু ড্রয়ার খুলে বার করে নিজের বিলটার নীচে সই দিয়ে রোগীকে বললেন, ‘আমার বিলটা দেখুন। এই বিলটা দেখলেই আপনার ঝিমঝিম ভাব কেটে যাবে। মাথায় রক্ত উঠে যাবে। সারা শরীর চনমনে হয়ে উঠবে। আপনি রেগে উঠবেন, খেপে যাবেন, উত্তেজিত হবেন। আপনার সেই হারিয়ে যাওয়া লড়াকু ভাবটা ফিরে আসবে।’ তারপর বিলটা রোগীর হাতে তুলে দিয়ে নরমভাবে বললেন, ‘কিন্তু তার আগে অবশ্যই আমার বিলটা মিটিয়ে দেবেন।’
অতঃপর একটি কথোপকথন দিয়ে সাঙ্গ করি। অনিদ্রা বা ইনসোমনিয়ার ওপরে একটি সেমিনার শুনতে গেছেন অনিদ্রার রোগী। বিখ্যাত এক মনোচিকিৎসক ইনসোমনিয়ার বিষয়ে বক্তৃতা করলেন। বক্তৃতান্তে রোগী ও ডাক্তারের মধ্যে এই কথোপকথন:
রোগী: ডাক্তারবাবু আপনার বক্তৃতা শুনে আমার খুব উপকার হল।
ডাক্তারবাবু: আমার বক্তৃতা আপনার ভাল লেগেছে?
রোগী: না, ঠিক তা নয়। আসলে আপনার বক্তৃতা শুনতে শুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। অনেকদিন পরে বেশ ভাল ঘুম হল।