মনের কথা
‘সই লো সই
দুটো মনের কথা কই।’
মন, তুমি কৃষিকাজ জানো না।
শুধু কৃষিকাজই নয় মন অনেক কিছু জানে না। আবার এমন অনেক কিছু জানে যা ভাবা যায় না। তাই তার এত ব্যাকুলতা, এত অস্থিরতা। তাই সে মেঘের সঙ্গী হতে চায়। তাই তার কোথাও হারিয়ে যাওয়ার মানা নেই। সে জন্যেই ‘সই লো সই, দুটো মনের কথা কই’, দুটো মনের কথা শোনার জন্যে মন নিজেই মনের মানুষ খোঁজে।
কিন্তু মনের মন্থরতম, গোপনতম কথা বলার লোক মেলা কঠিন। সব কথা কাকেই বা বলা যায়। তবু মন হু হু করে ওঠে সব কথা বলার জন্যে, স্ত্রী নয়, পুত্র নয়, মা-বাপ, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কেউ নয়, এমন কাউকে সব কথা বলা যিনি নির্বিকারভাবে এসব কথা শুনে যাবেন, যাঁর কাছে মনের ভার উজাড় করা যাবে।
এই মনের ভার উজাড় করার জন্যে সাহেবদের দেশে মনস্তত্ত্ববিদেরা রয়েছেন। আমাদের দেশে মনের চিকিৎসার এখনও তেমন প্রচলন ঘটেনি।
মানুষ মনে মনে নিজেকে কত কী ভাবে। নিজেকে কেউ ভাবে রাজা উজির, কেউ ভাবে উত্তমকুমার। কিন্তু সবাই যে ভালর দিকে ভাবেন তা নয়, এক সাহেব নিজেকে ভাবতেন কুকুর। এক মনোবিজ্ঞানী বহুদিন ধরে তাঁকে দেখলেন, তাঁর চিকিৎসা করলেন, তাঁকে বোঝালেন যে, ‘তুমি কুকুর হতে যাবে কেন, তুমি একটি আস্ত মানুষ।’ সাহেবের ধীরে ধীরে চৈতন্যোদয় হল, তখন একদিন সেই মনোবিজ্ঞানী সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি যে কুকুর নন, সেটা তা হলে এত দিনে বুঝতে পেরেছেন।’ সাহেব বললেন যে, হ্যাঁ স্যার, এখন আর আমার মনে ওসব ধারণা নেই।’
‘মনোবিজ্ঞানী’ তখন বললেন, ‘তা হলে তো আপনি এখন বেশ ভাল আছেন।’ এই কথা শুনে সাহেব বললেন, ‘নিশ্চয় স্যার। আপনি আমার এই নাকের নীচে হাত দিন, দেখুন কেমন সুন্দর ঠান্ডা।’ ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, কুকুরদের শরীর ভাল থাকলে নাকের নীচটা ঠান্ডা থাকে। সুতরাং এক্ষেত্রে সাহেবের কথা শুনে মনোবিজ্ঞানী নিশ্চয়ই খুবই হতাশ হয়েছিলেন, কারণ তিনি সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলেন সাহেবের কুকুরত্ব এখনও যায়নি।
সত্যিই এসব ব্যাপার সহজে যাওয়ার নয়। এক মেমসাহেবের ধারণা ছিল যে তিনি গোরু। বহু চেষ্টা করেও মনোডাক্তার যখন তাঁকে মনুষ্যত্বে ফেরাতে পারলেন না, তিনি জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা মেমসাহেব আপনি কবে থেকে বুঝতে পারলেন যে আপনি গোরু।’ মেমসাহেব নির্বিকারভাবে জবাব দিলেন, ‘সেই যবে বাছুর ছিলাম সেই তখন থেকে।’
এসব মনুষ্যত্ব ফিরে পেয়ে, পুনৰ্মনুষ্য হয়ে সবাই যে খুশি হয় তা নয়। এক ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পরে আক্ষেপ করেছিলেন, ‘গতকাল পর্যন্ত আমি একটা বিশাল গণ্ডার ছিলাম, আর আজ আমি সামান্য একটা মানুষ।’
প্রাতঃস্মরণীয় শিবরাম চক্রবর্তী বলেছিলেন, ‘দুইয়ে দুইয়ে শুধু চার হয় তা নয়, অনেক সময় দুইও হয়।’ যাঁদের মানসিক সমস্যা আছে তাদের ব্যাপার আরও সূক্ষ্ম। তাঁদের কেউ কেউ ভাবেন দুইয়ে দুইয়ে পাঁচ কিংবা তিন হয়। আবার কেউ কেউ ঠিকই জানেন দুইয়ে দুইয়ে চারই হবে কিন্তু তাঁদের চারটা তেমন পছন্দ নয়, তাঁদের বক্তব্য চার না হয়ে অন্য কিছু হলে ভাল হত।
এগুলি জটিল মনস্তত্ত্বের ব্যাপার, এবার সরল ব্যাপারে প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া যাক। এক মানসিক হাসপাতালে পাশাপাশি দুটি ঘর, নয় নম্বর ঘর এবং দশ নম্বর ঘর। নয় নম্বর ঘরে রয়েছেন ভূতনাথ আর দশ নম্বর ঘরে রয়েছেন দেবনাথ। ভূতনাথবাবু এবং দেবনাথবাবু দু’জনারই মনের চিকিৎসা চলছে। দু’জনেরই ব্যাপারটা খুবই জটিল, যদিও বাইরে থেকে দেখে আপাতদৃষ্টিতে বিশেষ কিছুই বোঝা যায় না। তাঁদের মানসিক বৈকল্যের একমাত্র লক্ষণ যে তাঁরা সর্বক্ষণ ‘জপমালা’, ‘জপমালা’ করছেন, জপের মালার মতো সারাদিন এই নাম জপছেন দু’ জনে। একদিন পরিদর্শক এসেছেন হাসপাতালে। তিনি এই দুই ভদ্রলোকের বিচিত্র ব্যাপার দেখে ডাক্তারবাবুর কাছে জানতে চাইলেন, এঁদের মাথা খারাপ হল কী করে আর ওই জপমালাই বা কে? ডাক্তারবাবু যা বললেন তা অতিশয় চমকপ্রদ, ‘ওই যে ভূতনাথবাবু জপমালা নামে এক মহিলার প্রেমে পড়েছিলেন, তারপর প্রেমে ব্যর্থ হয়ে জপমালাদেবীকে বিয়ে করতে না পেরে এই রকম হয়ে গেছেন।’ এই পর্যন্ত শুনে পরিদর্শক মহাশয় সরলভাবে বললেন, ‘এই দেবনাথবাবু উনিও প্রেমে ব্যর্থ হয়ে, ওই একই জপমালা পালকে জীবনে না পেয়ে সারাদিন ‘জপমালা’, ‘জপমালা’ জপে যাচ্ছেন।’ ডাক্তারবাবু মৃদু হেসে বললেন, ‘না। আসল ব্যাপার ঠিক এর উলটো। দেবনাথবাবু প্রেমে সফল হয়ে জপমালাদেবীকে বিয়ে করেছিলেন। ঘটনাবলি দু’জনার ক্ষেত্রে দু’রকম ফল দিয়েছে। ভূতনাথবাবু জপমালাদেবীকে না পেয়ে পাগল হয়ে গেছেন আর দেবনাথবাবু জপমালাদেবীকে পেয়ে পাগল হয়ে গেছেন।’
সুতরাং কী কারণে কার মনে কী হয় কেউ বলতে পারে না। এ বিষয়ে এর আগে আমি অনেক লিখেছি, আমারও আর কিছু বলার নেই। শুধু শুধু চর্বিত চর্বণে, গোরুর মতো জাবর কেটে কী লাভ! সব শেষে সেই ভদ্রলোককে মনে পড়ছে, খেয়াল করতে পারছি না তাঁর কথা এই শেষ মেলেও লিখে ফেলেছি কি না। পাঠক-পাঠিকা আমার অনুরূপ একশো আটটি দোষ ক্ষমা করেছেন নিশ্চয় এর পরেও ক্ষমা করবেন।
খুব ছোট করে বলছি। আমার এক অনতি পরিচিত খ্যাপা প্রতিবেশী জীবনগোপালবাবু সেদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘মিস্টার রায়, আমার নাম যদি জীবনগোপাল না হত, তা হলে কী বিপদ হত? ’ আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, ‘কী বিপদ? ’ তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘আপনারা সবাই আমাকে জীবনগোপাল বলেন, আমার নাম যদি জীবনগোপাল না হত তা হলে কী হত?’
এই জীবনবাবুর মানসিক সমস্যাগুলি অতি বিচিত্র। তিনি খুব আইসক্রিম ভালবাসেন, তাঁর মন চায় আইসক্রিম খেতে।
কিন্তু এদিকে আবার তাঁর অসুখের ভীষণ বাতিক। সব সময়েই ভয় পাচ্ছেন এই বুঝি কোনও মারাত্মক ব্যাধি সংক্রামিত হল। আবার আইসক্রিমের লোভও ত্যাগ করতে পারেন না। অবশেষে তিনি নিজেই এর একটা মধ্যবর্তী সমাধান বার করেছেন। বাজার থেকে আইসক্রিম কিনে এনে আজকাল ফুটিয়ে খাচ্ছেন।
কিন্তু এ তো তবু ভাল। গত রবিবার সকালবেলা বাসায় যখন চা খেতে বসেছি হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে জীবনবাবুর চিৎকারে চায়ের পেয়ালা ফেলে ছুটে গেলাম।
কী ব্যাপার? আজ কিছুদিন হল জীবনবাবুর মাড়ি ফোলা, দাঁতের গোড়া দিয়ে রক্ত পড়ছে, তিনি কাল সন্ধ্যাবেলা দাঁতের ডাক্তার দেখিয়েছেন, ডাক্তারবাবু তাঁকে কয়েকদিন টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজতে বারণ করেছেন, বলেছেন আঙুল দিয়ে দাঁত মাজতে।।
কিন্তু হাতের আঙুলে তো কত রকম জীবাণু, অদৃশ্য ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস থাকতে পারে বিশেষ করে নখের কোণে। সুতরাং মোক্ষম পথ বেছে নিয়েছেন জীবনবাবু, দাঁত মাজায় নিজের ডান হাতের তর্জনীটা জীবাণু মুক্ত করার জন্য টগবগে গরম জলে চুবিয়েছেন এবং তারই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া এই আর্তচিৎকার।
আমি গিয়ে দেখলাম জীবনবাবুর আঙুলে মুহূর্তের মধ্যে বিশাল ফোসকা পড়ে গেছে আর তিনি তর্জনী মাথার ওপরে তুলে লাফাচ্ছেন। জীবনবাবু লাফাতে থাকুন। ততক্ষণে এই নিবন্ধ শেষে আপনাদের একটা উপদেশ দিচ্ছি।
পাগলকে হেলাফেলা করবেন না, বিপদ হতে পারে।
কফিহাউসের দরজায় এক বলবান পাগল কাউকে ঢুকতে কিংবা বেরতে দেখলে দুটো টাকা চাইত একজনের কফি খাওয়ার জন্যে। এক সদয় ভদ্রলোক তাকে দশ টাকার একটা নোট দিয়ে বলেছিলেন ‘এক কাপ কেন, আপনি পাঁচ কাপ কফি খান এই টাকা দিয়ে।’ পরের দিন সেই সদয় ভদ্রলোক যখন আবার কফিহাউসে ঢুকছেন সেই বলবান পাগল এক ঘুষি মেরে তাঁকে চিত করে ফেলে দিল। হতবাক এবং মর্মাহত ভদ্রলোক কিছুই না বুঝতে পেরে সিঁড়ির ওপর থেকে গায়ের ধুলো ঝেড়ে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার? কাল দশটা টাকা দিয়েছিলাম, এই বুঝি তার প্রতিদান ?’
পাগল তখন গজরাচ্ছে, গজরাতে গজরাতে সে বলল, ‘শালা, তোর জন্য পাঁচ কাপ কফি খেয়ে কাল সারারাত আমার ঘুম হয়নি।’
পুনশ্চঃ
এ গল্পটা তো সবাই জানেন তবু আবার বলি। মানসিক চিকিৎসালয়ে এক ভদ্রলোক গিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘আপনাদের এখন থেকে কি আজকালের মধ্যে কোনও পাগল পালিয়েছে ?’
চিকিৎসালয়ের লোকেরা অবাক হয়ে বলেছিল, ‘কই না তো।’ কিন্তু আপনি হঠাৎ আমাদের এখানে এসে এ প্রশ্ন করছেন কেন ?’ এই প্রশ্ন শুনে ভদ্রলোক বললেন, ‘বাসায় গিয়ে শুনলাম আমার স্ত্রী যেন কার সঙ্গে পালিয়েছে। কিন্তু পাগল ছাড়া আর কে আমার বউকে নিয়ে পালাবে, তাই খোঁজ করতে এলাম।’