মনিদ্র অন্ধকারে

মনিদ্র অন্ধকারে

শিকাগো ট্রিবিউনে কাজ করা আমার এক সাংবাদিক বন্ধু ছিল। তার নিমন্ত্রণে সেখানের বিখ্যাত আর্ট মিউজিয়ামের বিশেষ একটা ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। যে ছবিটি সামনাসামনি দেখব বলে আমি অপেক্ষা করেছি অনেকগুলো বছর। মিউজিয়ামের দেয়ালে টাঙানো শত শত ছবির মধ্যে বিশেষ সেই ছবিটি খুঁজে বের করতে আমার অবশ্য বেশ কষ্ট করতে হলো। ছবিটি দূর থেকে দেখতে বেশ সাদামাটা। মৃদু আলো-ছায়া মেশানো ঘরে একটি পরিবারের পাঁচ সদস্য একসাথে খাচ্ছে রাতের খাবার। একঝলক দেখে কে বিশ্বাস করবে এই ছবিটি নিয়েই বর্তমানে এত তোলপাড় চলছে বড় বড় আর্ট বিশেষজ্ঞদের মাঝে! কে বিশ্বাস করবে এই ছবির প্রকৃত শিল্পী রোমে জেগে থাকা সেইন্ট তেরেসার মতো কোনো দৈব অনুভূতিতে ছুটে গেছে অন্য এক অলৌকিক জগতে! তবে রোম থেকে নয়, বরং বাংলাদেশের এক নির্জন মফস্বল থেকে।

দীর্ঘদিন পর যখন আমার সাংবাদিক বন্ধুর ই-মেইলটা আসে ততদিনে আমার এই আর্টিস্ট বন্ধুটিকে নিয়ে নানারকম কথার প্রচলন শুরু হয়ে গিয়েছে। সেইসব কথা, ধারণা ছড়াতে ছড়াতে হয়ে গেছে আকাশচুম্বী। শেষের দিকে এমন হতো যে ওকে নিয়ে উড়ে আসা বিচ্ছিন্ন কিছু খবর শুনে শুনে আমার নিজেকে প্রবোধ দিতে হতো, আমি যেন নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ না হারাই। কারণ ওকে আমি এককালে চিনতাম নিজের গায়ের ঘ্রাণের মতো করেই সহজভাবে। গম ও আখখেত পেরিয়ে যে নদীর পাশ থেকে আমরা স্কুল থেকে বাড়ি ফিরতাম, সেখানে লেখা হয়ে থাকত আমাদের গল্প আর অদৃশ্য স্মৃতিচারণ। তবে আমি জানতাম, কোনো একদিন এমন সময় আসবে যেদিন সবকিছু আগের মতো করেই থাকবে, শুধু ও থাকবে না। আমার মনে কোথাও না কোথাও এই ধারণাটুকুও ছিল। কারণ ও ছিল একজন ম্যাজিশিয়ান।

যেমন, একদিন দুপুরবেলা আমরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে শর্টকাট নিয়ে যখন নদীর পারে যাচ্ছিলাম, গমখেতের চারপাশ তখন রোদের আলো ও উষ্ণতায় রীতিমতো গলে গলে পড়ছে। একটা সুনসান নীরবতার মাঝে থেকে থেকে বাতাসের মৃদু শব্দ। এমন সময় পথের মধ্যে থেমে হঠাৎ করেই ও বলেছিল,

এ্যাই, আমার চোখের দিকে দেখ।

আমি সাথে সাথেই ওর চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম। আর অবাক বিস্ময়ে দেখতে পেয়েছিলাম ওর চোখের মণিদুটা কোনো এক গভীর কুয়ার মতো কুচকুচে কালো। তবে চোখের ভেতরের ডিমের খোলসের মতো সাদা অংশটুকুতে আকাশের মতো খণ্ড খণ্ড মেঘ ভাসছে। আমি বিস্মিত হয়ে অস্ফুট একটা শব্দ করতেই ও চোখ বন্ধ করে ফেলল আর সাথে সাথেই মিলিয়ে গেল আকাশটা। ও এমনভাবে নদীর দিকে হাঁটতে শুরু করল যেন কিছুই হয়নি।

আরেকবার বৃষ্টি শেষে স্কুল থেকে ফেরার সময় ও বলল,

আমার কাঁধে কচ্ছপটা দেখতে কেমন লাগছে?

আমি ওর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তখন অবিশ্বাসের সুরে বললাম,

কই কচ্ছপ? তোর পিঠে তো স্কুলব্যাগ।

ভালো করে দেখ। কচ্ছপ।

এবার আমি আস্তে করে শুধু একটা শব্দ ছুঁড়ে দিলাম,

চাপা।

ও শব্দটা শুনেই ভীষণ মর্মাহত হতে মুখ কালো করে ফেলল। তারপর রাস্তার মাঝখানেই পিঠের ব্যাগ নামিয়ে, সেখান থেকে সমস্ত বইখাতা বের করে ব্যাগটা ছুঁড়ে দিল সামনের কাদাপানি ভরা সরু রাস্তায়। আমি দেখতে পেলাম ওর শ্যাওলা সবুজ ব্যাগটার দুপাশে গজিয়ে উঠেছে গোলাকৃতির চারটি পা। সেখানে আর কোনো ব্যাগ নেই, আছে নিষ্প্রভ সবুজ রঙের একটা ছোটখাটো প্রাণী। যে ধীরগতিতে একটু একটু করে এগিয়ে চলে যাচ্ছে ঘাসের ভেতর। আর অন্যদিকে আমার বন্ধুটি বইখাতা বুকে ধরে, ঘাড় হেঁট করে গম্ভীরমুখে হাঁটতে শুরু করেছে বাড়ির দিকে।

ওর এই ম্যাজিকগুলোর কথা আমি কাউকে বলতে পারতাম না। কারণ আমি জানতাম, বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। যেমন কেউ বিশ্বাস করতে চায় না যে পাতার বাঁশি বাজালেই দুমুখো সাপ চলে আসে, নেকড়েরাও পোষ মানে, অমাবস্যার রাতে বাঘের দুধ খেলে অমরত্ব পাওয়া যায়, আর ফণীমনসাগাছ মাথার কাছে রাখলে দুঃস্বপ্ন আসে না। আমাদের মফস্বল শহরটা সবকিছুতেই নাকের ফুটার মতো দুটা আলাদা বিতর্ক সৃষ্টি করে উত্তেজনায় ফোঁসফোঁস করতে থাকত। এক দল সব অতিরঞ্জিত করে বিশ্বাস করত আর অন্য দল কিছুই বিশ্বাস করত না। আর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে আমরা হাঁসফাঁস করতাম।

ওর এবং আমার পরিবারের বন্ধুত্ব ছিল বহুবছরের। প্রতিবছর বার্ষিক পরীক্ষার পর আমাদের রেজাল্ট কার্ড নিয়ে পাশাপাশি বসে তুলনা করা হতো কে কত বেশি নম্বর পেয়েছে পরীক্ষায়। বলাবাহুল্য প্রতিবছরই এমন দিনের মুখোমুখি হওয়ার পর ও বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়ত। এরপর চুপচাপ বসে থাকত বাগানের এক কোণের শিউলি গাছের নিচে। ওখানেই ওর বড় ভাইকে কবর দেওয়া হয়েছিল। যার মৃত্যুশোক ভুলতে ওর বাবা-মা নিজেদের মৃত সন্তানের নামেই ওকে ডাকতেন। একদিন বিকেলে ওদের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম ও মস্তবড় একটা সাদা কাগজে একমনে কী যেন করছে। আমাকে বলল, কবিতা লিখছে। কিন্তু সেই সাদা কাগজে কোনো কবিতা লেখা ছিল না। এমন কিছু সাংকেতিক শব্দ, ইঙ্গিত আর আঁচড় ছিল যা কিছুটা দূর দেখে একটা ছবির মতো মনে হচ্ছিল। একটা গাছ, উঁচু ঢিবি, লতাপাতা, ঘাস আর সম্ভবত আকাশের মতো একটা কিছু। পেন্সিলের অদ্ভুত আঁচড়গুলো দেখে মনে হচ্ছিল কেউ কাকের পালক ছিঁড়ে এনে এনে সমস্ত ক্যানভাস জুড়ে ছড়িয়ে রেখেছে আর এখনই পালকগুলো দিগ্বিদিক হারিয়ে তারস্বরে ডাকতে ডাকতে উড়তে শুরু করবে। ও আমাকে কবিতা দেখিয়ে ফেলার পর উন্মুখ হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,

কেমন হয়েছে?

উত্তরে আমি ভ্রু কুঁচকে বলেছিলাম, এটা কবিতা হয়নি। কিছুই পড়া যায় না। হাবিজাবি লাগে।

ও তখন কাগজটা ছিঁড়ে কুচিকুচি করে মাটিতে ফেলে এক ছুটে নিজের বাসায় চলে গিয়েছিল। আর পড়ে থাকা কাগজের টুকরোগুলো পিঁপড়ার মতো ছুটে পালিয়েছিল কয়েক মুহূর্তেই। সেদিনের পর আমাদের মধ্যে কিছুটা দুরত্ব চলে এলো। আমাকে দেখলেই ও এড়িয়ে যেত। তবে আমিও গোপনে, সন্তর্পণে ওকে অনুসরণ করে ঠিকই বের করে ফেলেছিলাম যে ও রোজ বিকেলে বাগানের পেছনে ওর ভাইয়ের কবরের পাশে বসে কবিতা লেখে। কিংবা আঁকে। সে যাই হোক। কয়েক বছর পর ওকে অন্য শহরে পাঠানো হলো পড়ালেখা করার জন্য। যেদিন ও চলে যাচ্ছিল আমি দূর থেকে দেখছিলাম। ওর কাঁধের ব্যাগ, ওর শরীরের দীর্ঘ ছায়া নিঃশব্দে পিছু নিয়ে ওর সাথে সাথে চলে যাচ্ছিল। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমার মনে হচ্ছিল কেউ আমাকে ইলাস্টিকের মতো টেনে দূরে ছুঁড়ে দিচ্ছে আর আমি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছি। অন্য শহরে পড়তে যাওয়ার কিছুদিন পর ও আমাকে প্রথম চিঠি লিখল। আর সেই চিঠির একদম শেষে লেখা ছিল ইতি ভিক্টর। আমি বুঝতে পেরেছিলাম এটাই এখন ওর নাম। তবে ভিক্টর খুব দীর্ঘ সময় অন্য শহরে থাকেনি। এক বছরের মাঝেই আবার ফিরে এসেছিল। আমার ততদিনে কলেজ শেষ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরু। টেনেটুনে পড়ছি। বাড়ি থেকে চাপ দিচ্ছে পাস করামাত্রই চাকরি করতে হবে। ভিক্টর ফিরে এসে আবার কলেজ শুরু করল। তবে অল্প কিছুদিনের মাঝেই এক শিক্ষকের মেয়ের সাথে প্রেমে পড়ে তার লেখাপড়া লাটে উঠল। সে নিয়মিত ক্লাস ফাঁকি দিতে শুরু করল। অল্প কদিনের মাঝেই আশপাশের সবাই এ খবর জেনে গেল এবং ওকে

কলেজ থেকে বরখাস্ত করে দেওয়া হলো। ওর বাবা প্রচণ্ড রেগে ওকে বাসা থেকে বের করে দিলেন। ও আমাদের বাসায় থাকল দুদিন। এরপর এক সকালে গায়েব হয়ে গেল। আমাদের বাসায় থাকার দুইটা দিন আমি নানাকিছু বুঝিয়েছিলাম, অন্তত বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ও কোনো কথাই শোনেনি। একটা পার্মানেন্ট মার্কার দিয়ে শুধু আমার শোবারঘরের দেয়ালে এক নারীর অস্পষ্ট মুখ এঁকে গিয়েছিল দ্রুত গতিতে। আর মাঝপথে জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন হচ্ছে কবিতাটা?

ভিক্টরের পাগলামি দেখে আমার মন দুরুদুরু করছিল। ওর গম্ভীর মুখ আবার পরক্ষণেই দম ফাটানো হাসি কিংবা ছবি আঁকতে আঁকতে অলৌকিক এক আভায় মুখচ্ছবির পরিবর্তন দেখা যেন কোনো সিনেমার দৃশ্যের মতোই রহস্যময় ও মনোরম ছিল। আমাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে ও কোথায় গিয়েছিল আমি জানতে পারিনি। ভিক্টরের তেমন বন্ধু ছিলই না, আমরা যখন মাঠে খেলতাম ও মাটিতে ইটের টুকরা দিয়ে আঁকিবুকি করত। একা বসে থাকত বেশিরভাগ সময়। ভিক্টর গায়েব হয়ে যাওয়ার কয়েকমাস পর আমি হুট করে এক সকালে ওর চিঠি পাই। চিঠির সাথে ছিল ওর আঁকা একটা ছবি। পেন্সিল স্কেচ। অল্প কথায় জানিয়েছিল ও অর্থকষ্টে আছে, চাকরি হারিয়ে শ্রমিকদের সাথে কাজ করছে। খামের গায়ে ওর ঠিকানা দেওয়া ছিল, আমি কী মনে করে জমানো টাকা থেকে অল্প কিছু টাকা পাঠালাম ওকে। ভিক্টরের পরের চিঠি যখন পাই সে তখন আবার প্রেমে পড়েছে। অচেনা সেই নারী কতটা সুন্দর তাই ও লিখেছিল নানান উপমা দিয়ে। যেমন একটা লাইনে ও বলেছিল, সেই নারী ঠিক যেন আরেকটা নতুন দিনের মতো সুন্দর।

আমি তখন পড়ালেখা শেষ করতে মরিয়া হয়ে আছি। শুধু কাগজ কিনি, নোট করি, ফটোকপি করি, পড়ি আর জেগে থাকার জন্য কাপের পর কাপ চা পান করে যাই। বাবা রিটায়ারমেন্টে গেছেন, বাড়িতে গুনে গুনে বাজার আসে। কোনো বাড়তি কিছু নেই, নেই কোনো অপচয়। দিনের পর দিন বৈশিষ্ট্যহীন প্রহর পার করতে থাকি। একটা মেয়ের সাথে অল্প কদিনের পরিচয় হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। সামার প্রজেক্টে খণ্ডকালীন কাজ করতে এসেছিল মেয়েটি। তারই বদান্যতায় হাতে উঠে আসে ফেদেরিকো লোরকা আর ফার্নান্দো পেসোয়া। বাড়ির একঘেয়ে পরিবেশ আর ফ্যাকাসে হয়ে থাকা মুখগুলো থেকে বাঁচতে আমি তখন লাইব্রেরি থেকে কবিতার বই হাতে নিয়ে আমার নতুন সঙ্গিনীর সাথে বটতলায় বসে থাকি। আঁধার নেমে আসলে সঙ্গিনী আশ্চর্য কোনো শিল্পকর্মের মতো বিড়বিড় করে ওঠে–

If I am dying,
leave the balcony open.
The child is eating an orange.
(From my balcony, I see him. )
The reaper is reaping the barley.
(From my balcony, I hear him.)
If I am dying,
leave the balcony open.

এভাবেই লোরকার পরাবাস্তববাদে, পেসোয়ার বুক অব ডিসকোয়ায়েটে আমাদের দিন কেটে যেতে থাকে। আমরা বটতলায় বসে বসে কবিদের হেঁটেরোনিম মুখস্থ করতে থাকি। আর একেক প্রেক্ষাপটে আমি হতে থাকি একেকজন। বাড়িতে একরকম, ক্লাসে একরকম আর সঙ্গিনীর সাথে থাকলে একদম অন্যরকম। এইসব দিনে আমার ভিক্টরকে বলতে গেলে প্রায় মনেই পড়ে না। হয়তো আরও বহুদিন মনে পড়ত না, কিন্তু একদিন পরিচিত এক ছেলের কাছ থেকে খবর পাই ভিক্টরের একবারের প্রেমিকা ছিল এক বিধবা, এক সন্তানের জননী। ওর বাড়িতে এ খবর জানার পর ভিক্টরের বাবা মেয়েটির বাড়ির ঠিকানা খুঁজে বের করে তার বাবা-মায়ের কাছে তীব্র কিছু অভিযোগ এনে বাধ্য করেছেন মেয়েটি ও ভিক্টরের যোগাযোগ বন্ধ করতে। এই কথাগুলো শুনে কেমন যেন লাগে আমার। পুরোনো দুঃসহ স্মৃতি ধেয়ে আসার মতো, শরীরের রক্তমাংস পুড়ে যাওয়ার মতো জ্বলুনি কাজ করতে থাকে সারা দেহে। মনে হয় যেন ভিক্টরের সাথে না, আমার সাথেই হয়েছে এগুলো। একটু একটু করে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি আমি আর পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরে আসি ভিক্টরকে চিঠি লিখব বলে। সেদিনই খুঁজে পাই ভিক্টরের পাঠানো দুইটি চিঠি যা বিগত কিছু মাসে অন্যান্য অযাচিত সব বিজ্ঞাপন ও চিঠির সাথে পড়ে ছিল অবহেলায়। সেই চিঠিগুলো থেকে বের হয়ে আসে ভিক্টরের নিঃসঙ্গ বিবমিষা, অতঃপর বিরক্তি, ওর বাবার প্রতি ক্ষোভ-ঘৃণা আর বিদ্রুপে ভরপুর কথামালা। কয়েকটি চমৎকার ছবিও আসে চিঠির সাথে। ছবিগুলোর পেছনে বড় বড় অক্ষরে লেখা,

কিছু কবিতা…

ছবিতে দেখি, কৃষক পরিবারের রাতের খাবার খাওয়া, ফুলদানিতে উজ্জ্বল ফুল, ভিক্টরের থাকার ঘরের এলোমেলো আসবাবপত্র। আমি দেখতে পাই সাদাকালো স্কেচ ফেলে ভিক্টর এখন ভ্রমরের মতো ঝুঁকে পড়েছে উজ্জ্বল রঙের দিকে এই প্রথম আমি মন খুলে ভিক্টরকে লিখে জানাই ওর আরও অনেক কবিতা লেখা উচিত। অনেক। আমার চিঠিটা বেশ দীর্ঘ হয়। চিঠির সাথে ওকে আবারও অল্প করে টাকা দিয়ে দিই। এই ঘটনার অল্প কিছুদিন পরেই ভিক্টরের বাবা মারা যান। আর বহুদিন পর মুখোমুখি হই আমি ও ভিক্টর। ওর মুখভরা দাড়ি, চোখে এলোমেলো দৃষ্টি। আমরা দুজনে ওদের বাসার পেছনের পরিত্যক্ত বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি অনেকক্ষণ। ধীরে, বড় ধীরে মৃদু বাতাস বয়ে যায়। আমরা দাঁড়িয়ে থাকি, ভিক্টর জানে না আমি তখন কী ভাবছি, আমিও জানি না কী ভাবছে ভিক্টর, তবু আমরা দুজন এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকি যেন নিশ্চল দুটি গাছের মতো আমাদের মাঝে ইশারায়, ইঙ্গিতে, অনুভবে কোনো কথা চলছে। আমি দেখতে পাই ভিক্টরের বড় ভাইয়ের কবরে অনেক আগাছা জমেছে। এমন সময় ভিক্টর অতীতের মতো থেমে থেমে বলে ওঠে–

আমি আকাশের দিকে হাত ঘোরাব আর রঙ বদলাতে শুরু করবে… দেখবি?

আমি মাথা নেড়ে মানা করে দিই। অনেকটা সচল কোনো ঘড়িকে ইচ্ছে করে বন্ধ করে রাখার মতোই স্থির হয়ে থাকে ভিক্টর, তারপর ক্লান্ত পায়ে পথের দিকে হাঁটতে থাকে। আর ইচ্ছে না থাকার পরেও আমি দেখতে পাই আকাশের রঙটা কেমন বদলে যেতে শুরু করেছে একটু একটু করে।

বাবার মৃত্যুর পর আমাদের শহরটার সাথে যেন ভিক্টরের যোগসূত্র একদমই কেটে যায়। আবার দীর্ঘদিনের জন্য গায়েব হয়ে যায় ও। আমার সঙ্গিনী ফিরে যেতে চায় নিজের দেশে। আমি বুঝে উঠতে পারি না ওকে বাধা দেব নাকি যেতে দেব তাই চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে হয়। সঙ্গিনী আমাকে পাবলো নেরুদার নির্বাচিত কবিতার বই ধরিয়ে দিয়ে বিদায় নেয়। আর হঠাৎ কেশে ওঠা অপ্রস্তুত মানুষের মতোই আমি অসহায় হয়ে উঠি। সঙ্গিনী চলে যাওয়ার পর নিজের ছোট্টঘরে শুয়ে থেকে আমার মনে পড়ে, আমি এতদিন প্রেমিক ছিলাম। এখন থেকে আর নই।

পাস করার পর একটা ছোট চাকরি হয়ে যায় আমার। টেবিলের নিচে বাড়িয়ে দেওয়া কাগজের বিনিময়ে চাকরি হয়ে গেছে এই আনন্দেই একটা প্রহর আপ্লুত হয়ে থাকে আমার বাবা-মা। আর কেরানি জীবনে হাঁসফাঁস করতে করতে আমি প্রতিমাসে বেতন পাওয়ার দিন গুনতে থাকি। সপ্তাহে ছয়দিন কাজ করার দিনগুলোতে ক্রীতদাসের মতো বাঁধা পড়তে থাকি। একটা দিন ছুটি পেলে মাতালের মতো ঘুমাই। কবিতা, প্রেম, ভিক্টর কিছুই তখন আর মাথায় থাকে না। জানালার কাঁচে বৃষ্টির পানি পিছলে গড়িয়ে পড়ার মতো গড়িয়ে যায়। ভিক্টরকে মনে পড়ে কখনো-সখনো কিন্তু সবসময়ই কেন যেন এমন হয় যে ওর দিক থেকে যোগাযোগ থাকলে আমার নিজ উদ্যোগে ওকে কিছু জানানো হয় না। অবশ্য জানানোর মতো কিছু ছিলও না আমার। জীবনসংক্রান্ত বিকিকিনিতে সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল। সেবার ডিসেম্বরের দিকে প্রচুর শীত নেমে এলে এক দুপুরে সম্পূর্ণ নতুন এক ঠিকানা থেকে চিঠি এলো। চিঠিতে ভিক্টরের নিয়মিত বিষণ্নতার পাশাপাশি ওর এক নতুন শিল্পবোদ্ধা বন্ধুকে নিয়ে নানাকিছু লেখা ছিল, আর ছিল কয়েকটা ছোট ছোট ছবি। তবে এবারের ছবিগুলো খুবই উজ্জ্বল, রঙিন। যেন কেউ তাকানো মাত্রই জীবন্ত হয়ে উঠবে। আমি ছবিগুলো থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। ভিক্টরের থাকার ঘর থেকে হলুদ দেয়াল ঘেঁষে জেগে ওঠা অন্য এক শহরের ছবিগুলো আমার মতো একজন সাধারণ মানুষকেও মুগ্ধ করে তুলছিল।

নতুন বছর শুরু হওয়ার পর আমার প্রমোশন হলো। কাজের চাপের পাশাপাশি দায়িত্ব বাড়ল। তবে আমি খুশি ছিলাম কারণ আর্থিকভাবে আমি আগের চেয়ে সবল হয়ে উঠেছিলাম। এক সহকর্মীর সাথে ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করা নিয়েই পরিকল্পনা চলল। মাসে মাসে ভিক্টরকে টাকা পাঠানো আমার জন্য আগের চেয়ে কিছুটা সহজ হয়েছিল। আর আমার রোজকার দিনের অংশ হয়ে উঠেছিল ভিক্টরের চিঠিগুলো। প্রায় রাতেই বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি নিজের ঘরে এসে একাকী ভিক্টরের চিঠিগুলো পড়তাম। ভিক্টরের তখন স্বপ্ন হয়েছিল সমস্ত কবি, শিল্পীদের নিয়ে একই কলোনিতে থাকবে। সারাদিন তারা পরস্পরের সাথে নিজেদের সৃষ্টি নিয়ে কথা বলবে। সত্যি বলতে আমার নিজের জীবনে নতুন কোনো স্বপ্ন না থাকায় ভিক্টরের স্বপ্নগুলো পড়তে ভালো লাগত। মনে হতো আমিও সেটার একটা অংশ। আমি মনে মনে ওকে ঈর্ষা করতাম নাকি ভয় পেতাম আমি জানি না। এমন অলীক স্বপ্ন দেখার সাহস আমার ছিল না, আবার এমন স্বপ্নের অংশ না হওয়ার মতো নির্মোহ আমি হতে পারতাম না। স্বপ্নহীন মানুষ মাত্রই মৃত। তাই মৃত হওয়ার চেয়ে ভিক্টরের চোখ দিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারলে আমার নিজেকে জীবিত ও আত্মবিশ্বাসী মনে হতো।

যদি আমাকে ভুবন দাও আমি দেব সমস্ত অমিয় এই একটি লাইন লিখে ভিক্টর একদিন আমাকে চিঠি পাঠাল। আর কেন যেন এটুকু পড়েই আমি ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলাম। কে যেন আমার কানে কানে নিনাদ বাজিয়ে বলে গেল আমি ভিক্টরকে ভালোবাসি। সমস্ত পৃথিবীতে ওকে শুধু আমিই ভালোবাসি। প্রচণ্ড কেঁপে উঠলাম এই অনুভূতি হওয়ার পর। বিমূঢ় হয়ে বসে থাকলাম দীর্ঘসময়। তারপর কোনো এক অদৃশ্য সরলরেখার দিকে এগিয়ে যাওয়ার মতো করেই আমি লিখতে বসলাম চিঠির প্রতিউত্তর। চিঠি লিখে শেষ করার আগেই সে-রাতে ঘুমের ভেতর দুঃস্বপ্ন দেখলাম, ভিক্টর আত্মহত্যা করেছে। নিজেকে নিজেই গুলি করে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে পৃথিবী থেকে। শুধু তাই নয়, গুলি করার আগে নিজের কান কেটে উপহার পাঠিয়েছে আমাকে। ভয়ে, আতংকে, আর বিচ্ছিরি বেদনায় আক্রান্ত হয়ে পরের দিনই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ঘোরগ্রস্ত অবস্থায় রওনা হলাম ভিক্টরের বাড়ির উদ্দেশ্যে। ভিক্টরকে যে আমার নিজের কথাটুকু বলতেই হবে। যে করেই হোক। ট্রেনে করে যাওয়ার পথে পুরোটা সময় আমি শুধু ছটফট করলাম, জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখলাম ঘন মেঘের ভেতর ডাকতে ডাকতে হারিয়ে যাচ্ছে শত পাখির দল। যেন পাখিগুলো ভিক্টরের নাম জপে চলেছে।

দীর্ঘযাত্রার পর গাঢ় হলুদ রঙের দেয়াল ঘেরা যে বাড়িটিতে আমি ভিক্টরের খোঁজে গিয়েছিলাম, সেখানে ওর থাকার ঘরটায় জলজ্যান্ত ভিক্টর বাদে ওর প্রায় সবকিছুই ছিল। আঁকা ছবি, একটা কাঠের চেয়ার-টেবিল, অজস্র তুলি, ক্যানভাস, কাগজ, নানা রঙের প্যালেট-সব ছিল। শুধু ও ছিল না। ওর প্রতিবেশীরাও ওর বিষয়ে কিছু বলতে পারল না। একদিকে ভিক্টরের জন্য আমার অনুভূতি আর অন্যদিকে ওকে খুঁজে না পাওয়াটুকু, কোথায় যেন কাঁটার মতো বিঁধে থাকা বেদনা আমাকে ঝাঁকি দিতে থাকল অনবরত। আর কোনো তথ্য না পেয়ে, কিচ্ছু চিন্তা না করে আমি তাই সেই ঘরের একমাত্র চেয়ারটায় বসে ওর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। রাতদিন, সপ্তাহ-মাস…

ভিক্টরের সাথে আমার ঠিক কত দিন বা কত মাস পর দেখা হয়েছিল আমার ঠিক মনে নেই। ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় আমি যখন দিনের পর দিন সেই ঘরটায় অপেক্ষায় থেকে ভঙ্গুর হয়ে উঠছিলাম, এমন সময় একদিন দেখলাম ভিক্টর এসেছে। সেই ভিক্টর, যে ম্যাজিশিয়ান। যে কবিতা আঁকে, যাকে আমি চিনি নিজের চুলের ঘ্রাণের মতোই আপন করে, যে বিগত বছর ধরে বার বার আমার সামনে এসেছে কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি, আসলে আমার জন্য সে কে? ভিক্টরের উদ্ভ্রান্ত চেহারা, বিবর্ণ পোশাক দেখার পরেও ওকে দেখতে খুব উজ্জ্বল লাগছিল। আমাকে দেখে ও অবাক হয়নি। শুধু একপলক আমার চোখের দিকে তাকিয়েই দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করে দেয়। আমিও সব বুঝে ফেলার মতো, নিঃশব্দে পিছু নিই ওর। ভিক্টর হেঁটে হেঁটে চলে যায় বহুদূর। আমিও ওর পেছনে আগাই ছায়ার মতো। পথ, গাছ, বাড়ি, লোকালয়, দোকানপাট সমস্ত কিছু পেরিয়ে ও চলে যায় সমুদ্রের দিকে। আমিও এক-পা দু-পা করে আগাতে থাকি পিছু পিছু। একটা সময় সমুদ্রের ঢেউ এসে ভিক্টরের দু-পায়ের ওপর ভেঙে পড়ে। সেই ঢেউ ছুঁয়ে ভিক্টর খালি পায়ে ধীরে, অতি ধীরে এগিয়ে যায় সমুদ্রের দিকে। আর আমি দেখতে পাই সন্ধ্যা মিলিয়ে যাওয়া কালচে নীল আকাশের সাথে অজস্র সোনালি নক্ষত্র মিলেমিশে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের পানি রাতের সৌন্দর্যে চকচক করছে। সেই পানিতে আকাশের ছায়া পড়েছে। নক্ষত্র চকমকি পাথরের মতো থেকে থেকে দ্যুতি দিচ্ছে, আর ভিক্টর অল্প অল্প করে সমুদ্রের গভীরে যাওয়ার পথে এগিয়ে যাচ্ছে নিয়তির মতো। আমাকে ফেলে।

শিকাগো ট্রিবিউনে কাজ করা আমার সাংবাদিক বন্ধু আমাকে বেশ কয়েকবারই বলেছিল আমি যেন গ্যালারিতে স্থান করে নেওয়া এই বিশেষ ছবিটার শিল্পীকে নিয়ে কিছু লিখি। যেহেতু এই ছবিটির প্রকৃত শিল্পীকে আমি দীর্ঘদিন কাছ থেকে দেখেছিলাম। যেহেতু এই ছবিটিকে তুলনা করা হচ্ছে ইতিহাসের অন্যতম চিত্রশিল্পীর আঁকা একটি ছবির সাথে। কারণ মূল ছবিটির সাথে এই ছবিটির প্রতিটি আঁচড়, প্রতিটি রঙের এতই নির্ভুল মিল যা গভীরভাবে প্রভাবিত ও বিস্মিত করে তুলছে এ সময়ের সকল শিল্পবোদ্ধাদের। আমি সবকিছু জেনেও অতি বিনয়ের সাথে আমার সেই বন্ধুকে না করে দিয়েছি। তবে আজও আমার চারপাশে আছে ভিক্টরের আঁকা কবিতার প্রতিধ্বনি। আমার কাছে আছে ভিক্টরের লেখা ছয়শ আটান্নটা চিঠি। আজও আমার পুরোনো ঘরের দেয়ালে এক নারীর অস্পষ্ট মুখ। এসব কিছু একান্তই আমার আত্মমগ্নতার অংশ। সেখানে ভিক্টর আছে ও থাকবে, সে আমাকে ছেড়ে কোথাও যায়নি। যেতে পারে না। তাই মৃদু আলো-ছায়া মেশানো ঘরে একটি পরিবারের পাঁচ সদস্যের রাতের খাবার খাওয়ার ছবিটার দিকে শেষবারের মতো আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমি গ্যালারি থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে যাই। ধীর পায়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দেখতে পাই, আকাশের রঙ বদলে যাচ্ছে, পরিচিত কোনো ম্যাজিশিয়ানের পুরোনো কোনো ম্যাজিকের মতো। আমি মৃদু হেসে, দু-চোখে খণ্ড খণ্ড মেঘ নিয়ে, আকাশের দিকে ডান হাতটা তুলে অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ ঘোরাতে থাকি আমার হাতটা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *