মনখারাপের পার্টি

মনখারাপের পার্টি

সাগরিকার যা কাজ তাই সে করল! একটা অদ্ভুত পরিকল্পনার কথা বলে বসল।

সময় হয়ে গেছে, তবু সন্ধেটা পুরোপুরি হচ্ছে না। কোনও কোনও দিন এরকম হয়। বিকেল চললাম ভাই’ বলে রওনা দেয়, কিন্তু যায় না। আরও কিছুক্ষণ আকাশে দাড়িয়ে থেকে হাসিমুখে হাত নাড়ে। এই সময়ে আকাশে তৈরি হয় আশ্চর্য একটা রং। এই রঙের নাম ‘আবার দেখা হবে’ রং। এই সময়টা বড় ভাল লাগে। মন ভাল হয়ে যায়।

বালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে কয়েক পা গেলেই সাগরিকাদের বাড়ি। আগেকার দিনের বিরাট এই চারতলা বাড়ির ছাদটা খুব মজার। ছাদটা শুধু অনেকটা জায়গা নিয়েই নয়, কোনও এক-একটা দিক হয়তো দু’ধাপ নেমে গেছে, কোনও দিকটা আবার একধাপ উপরে। ছোট ছোট চড়াই উতরাইয়ের মতো! মনে হয়, একটা ছাদের মধ্যেই তিন-চারটে ছাদ লুকিয়ে রয়েছে। এবাড়িতে এলেই মনে হয়, যাই, চট করে একবার ছাদটা ঘুরে আসি। আজও কলকাতার বিকেল যাই যাই করেও দাঁড়িয়ে পড়েছে। আশ্চর্য আলোয় ভরে গেছে চারপাশ। সাগরিকাদের ছাদে যে-ছেলেমেয়েগুলো রয়েছে, নিয়মমতো তাদের মন ভাল থাকার কথা। কিন্তু তা নেই। সকলেরই মুখ গোমড়া।

এমন একটা সময়ে সাগরিকা তার পরিকল্পনার কথা বলল। সব দলেই একটা করে ছটফটে ছেলে থাকে। এই দলে সেই ছেলেটার নাম চন্দ্রভানু। এক জায়গায় সে বেশিক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে পারে না। অথচ চন্দ্রভানু গত আধঘণ্টা ধরে মাদুরের উপর টানটান হয়ে শুয়ে আছে। নড়াচড়া নেই। তার মাথার নীচে ফিজিক্স আর কেমিষ্ট্রি বই। আকাশের দিকে সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বটে, কিন্তু কিছুই দেখছে না। তাকানোর মধ্যে একটা উদাসীন উদাসীন ভাব। সাগরিকার কথা শুনে চন্দ্রভানু পাশ ফিরে বলল, ‘বাঃ, কথাটা তো খারাপ বলিসনি।’

এটাও একটা চিন্তার বিষয়। সাগরিকার পরিকল্পনাগুলো নিয়ে সবথেকে বেশি রসিকতা করে চন্দ্রভানু। কিছুদিন আগেই সে বলেছে, সাগরিকা, আমি ঠিক করেছি, পাচ খণ্ডে তার পরিকল্পনা সমগ্র বের করব।’ সেই চন্দ্রভানু আজ কেন সাগরিকার পরিকল্পনায় উৎসাহ দেখাল? কী এমন কথা বলল মেয়েটা?

চন্দ্রভানুর পাশে বসে আছে অতীশ। তার হাতে খাতা। অতীশ বোকাবোকা মুখ করে সেই খাতার দিকে চেয়ে রয়েছে। ভাবটা এমন, তাকে হিব্রু ভাষায় লেখা কোনও পাণ্ডুলিপি পড়তে দেওয়া হয়েছে। খাতায় আসলে স্ট্যাটিসটিক্সের একটা সহজ অঙ্ক আধখানা করা। অর আধখানা চারবার করে কেটে দেওয়া। কিছুতেই মিলছে না। এই খাতা দেখলে মনে হবে স্ট্যাটিসটিক্সে অতীশ খুব বড় ধরনের একটা গাধা। আসল ঘটনা অবশ্য তা নয়। স্ট্যাটিসটিক্সে অতীশ দুর্দান্ত। এতটাই দুর্দান্ত যে, স্যার একবার ওকে পঞ্চাশ নম্বরের পরীক্ষায় বাহান্ন নম্বর দিয়েছিলেন। প্রথম অতিরিক্ত নম্বরট ছিল ফুল মার্কস পাওয়ার পুরস্কার। পরেরটা ছিল আগামী পরীক্ষায় ফুল মার্কস পাওয়ার জন্য আগাম পুরস্কার। তা হলে অতীশ আজ এই জালের মতো সহজ অঙ্কটা পারছে না কেন? আসলে তার একটা বিচ্ছিরি সমস্যা আছে। মেজাজ খারাপ থাকলে সে কিছুতেই অঙ্ক মেলাতে পারে না। আজও তাই হয়েছে। তার মেজাজ ভাল নেই। সাগরিকার কথা শুনে মুখ তুলল অতীশ। ভুরু কুঁচকে বলল, ‘কী বললি? প্ল্যানটা আর একবার বল তো সাগরিকা, ভাল করে শুনি।’

তন্দ্রা দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে। পাঁচিলে কনুই রেখে। মেয়েটা গাছপালা, নদী, জল, পাখিটাখি নিয়ে ভয়ংকর রকমের বাড়াবাড়ি করতে পারে। বহুবার সে বন্ধুদের বলেছে, প্রকৃতির জন্য সে প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত। কথাটা পুরোপুরি মিথ্যে নয়। এবার বর্ষাতে সে একটা বিচ্ছিরি কাণ্ড করেছিল। কাছ থেকে রামধনু দেখবে বলে তাদের বাড়িতে বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে চিলেকোঠার ছাদে উঠতে গিয়েছিল। কিছুটা ওঠার পর পা পিছলে পড়ে। এতে তাকে প্রাণ দিতে হয়নি ঠিকই, কিন্তু বাঁ পা-টা দিতে হয়েছিল। টানা একমাস বিছানায় কাটাতে হয়েছে তাকে। সেই তন্দ্রা আজ এমন সুন্দর একটা আকাশের দিকে একবারও তাকাচ্ছে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সাগরিকার প্রস্তাব শুনে এই প্রথম মুখ তুলল। বলল, ‘সত্যি হবে? নাকি এটাও তোর অন্যগুলোর মতো পরিকল্পনা স্তরেই থাকবে?’ ছোট্র সিঁড়ির উপর পাশাপাশি বসে চদনা আর বৈশাখী। বেশিরভাগ সময়ই এদের দু’জনকে একসঙ্গে দেখা যায়, কিন্তু এদের স্বভাব একেবারে দু’রকম। বৈশাখীর স্বভাব হল বেশি কথা বলা আর চন্দনা সবসময় চুপচাপ। বন্ধুরা বৈশাখীর নাম দিয়েছে কথা-রানি আর চন্দনাকে ডাকে চুপ-সুন্দরী বলে। সেই কথ-রানি আজ একেবারে স্পিকটি নট! সাগরিকার পরিকল্পনা শুনে সে বিড়বিড় করে কী যেন বলল। কেউ শুনতে পেল না। তবে তার চোখ-মুখ দেখে মনে হচ্ছে, বিষয়টা শুনে সে যথেষ্ট খুশি হয়েছে। এদিকে মন ভাল না থাকায় চন্দনার হয়েছে উলটে এফেক্ট। চুপ-সুন্দরী আজ বেশি কথা বলছে। সাগরিকার দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘তোর পরিকল্পনাটা শুনতে খারাপ লাগছে না। তবে শেষপর্যন্তু হবে না।’

তার বয়েসের ছেলেরা যখন গিটার বা সিন্থেসাইজার কিনছে, কল্যাণ তখন বোকার মতো একটা কাজ করে বসেছে। সে একটা মাউথ অর্গান কিনে ফেলেছে। তাও যদি বাজাতে জানত, একটা কথা ছিল। একেবারেই জানে না। মাউথ অর্গানে ফুঁ দিলেই ঘাস ঘ্যাস জাতীয় একটা আওয়াজ বের হচ্ছে। এই অত্যাচার বন্ধ করতে ক্যান্টিনে ডাকা হয়েছিল জরুরি মিটিং। অম্বরীশ বলল, ‘এটা মাউথ অর্গান বাজানো তো নয়, এ হল মাউথ অর্গানের অপমান। বাদ্যযন্ত্রের কোনওরকম অপমান আমি সহ্য করব না।’

কল্যাণ বলল, ‘ঠিক আছে, আমি বাজানো বন্ধ করছি, কিন্তু তার আগে অম্বরীশকে ছবি আঁকা বন্ধ করতে হবে। ও যখন ছবি আঁকে তখন গভীরভাবে লক্ষ করে দেখেছি, রং, তলি, ক্যানভাস ওর দিকে তাকিয়ে ফিকফিক করে হাসছে। আমি সব সহ্য করতে পারি, কিন্তু বন্ধুর অপমান আমি সহ্য করতে পারি না।’

কল্যাণের কথা শোনা হয়নি। তার উপর কড়া নিয়ম জারি হল। ঠিক হয়েছে, মাউথ অর্গান সে বাজাতে চাইলে বাজাক। কিন্তু সুর বের না হলে ফুঁ পিছু তাকে এক টাকা করে ফাইন দিতে হবে। তবে একটা সুযোগ সে পেয়েছে। ফাইনের টাকা ধার রাখা চলবে। মাত্র ক’দিনে আড়াইশো টাকার মতো ফাইন বাকি পড়ে গেছে কল্যাণের। নিয়মে ধারের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু ধার শোধ করার কথা কিছু বলা হয়নি। ফলে কেউই তাকে চাপ দিতে পারছে না। কল্যাণও সারাক্ষণ জিনসের পকেটে মাউথ অর্গান নিয়ে ঘুরছে এবং যখন তখন ফুঁ দিয়ে সবাইকে চমকে দিচ্ছে। ফাইন ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে সেই আওয়াজ আরও উৎকট হয়েছে। তবে আজ মন ভাল নেই বলে কল্যাণ মাউথ অর্গানটাকে হাতে নিয়েই নাড়াচাড়া করছে, কিন্তু বাজাচ্ছে না। সাগরিকার পরিকল্পনার কথা শুনে সে বলল, ‘দ্যাখ সাগরিকা, তোর প্ল্যান বেশিরভাগ সময়েই শোনার অযোগ্য হয়। তবে এটা যেন একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে।’

সাগরিকাদের ছাদটা একপাশে খানিকটা ঘুরে গেছে। উঁচু দেয়ালের পাশে একটু আড়ালের মতো। মল্লিকা আর প্রবাল সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। মল্লিকাই প্রবালকে এদিকটায় ডেকে এনেছে। সে প্রবালকে একটা জিনিস দিতে চায়। কিন্তু কেন জানি দিয়ে উঠতে পারছে না। এমন সময় সাগরিকা চেঁচিয়ে বলল, ‘তোরা এদিকে আয় তো! অনেক প্রাইভেট টক হয়েছে। এবার থামা।’

এই দলে সবচেয়ে শান্ত ছেলেটির নাম চঞ্চল। চঞ্চল ছাদের এককোণে পাঁচিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে বাইরের দিকে তাকিয়ে নেই, আবার ভিতরের দিকে তাকিয়ে নেই। সে তাকিয়ে আছে তার হাতের মোবাইল ফোনটার দিকে। অসম্ভব বুদ্ধিমান এই ছেলেটি সম্প্রতি একটি বোকার মতো কাজে মন দিয়েছে। কাজটা এরকম— চঞ্চল চাইছে, তার মোবাইলে বিশেষ একজন ফোন করলে সেই রিংটোনটা হবে সকলের চেয়ে আলাদা। এর জন্য অনেক বাছাবাছির পর সে একটা গানের দুটো লাইন পছন্দ করে রেখেছে। ফোনটা এলে প্রথমে সে কিছুক্ষণ গানের সুরটা শুনবে। তারপর কথা বলবে। কাজটা এমন কিছু শক্ত নয়, সুরটা মোবাইলে কম্পোজ করার পর নির্দিষ্ট ফোন নাম্বারের জন্য প্রোগ্রাম করে দিতে হবে। কিন্তু সমস্যাটা হল, যার ফোন বাজলে সে গান শুনতে চায়, তার বাড়িতে ফোন নেই। মোবাইলও নেই। কখনও সখনও সে ফোন করলে রাস্তার বুথ বা অন্য কোনও বাড়ি থেকে করে। সেই সব নাম্বারের কোনও ঠিক নেই। তা হলে? মোবাইল ফোন আলাদা আলাদা করে নাম্বার চিনতে পারে। সেই সফ্‌টওয়্যার তার আছে। কিন্তু মানুষ? বিশেষ মানুষ আলাদা করার মতো সফ্‌টওয়্যার কি মোবাইল ফোনের আছে? চঞ্চল বিষয়টা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারছে না। কারণ সে জানে, কথাটা তুললেই সবাই তাকে জিজ্ঞেস করবে, বিশেষ মানুষটা কে? সেটা সে বলতে পারবে না। এটা একটা গোপন ব্যাপার। চঞ্চলের মনটা অস্থির। এমন সময় সাগরিকার কথা শুনে চঞ্চল বলল, ‘কথাটা খারাপ বলিসনি। সবাই কী বলে দ্যাখ।’ সাগরিকা এবার যেন তেড়েফুঁড়ে উঠল। গলা তুলে বলল, ‘সবাই আর কী বলবে? তোরা তো কথাই বলতে পারছিস না। তোদের কী হয়েছে বল তো, অ্যাঁ? হয়েছেটা কী? পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে আর তোরা সব গাড্ডু খেয়েছিস?’

সবাই জানে, কী হয়েছে। সাগরিকাও জানে। তবু সে ভান করছে যেন কিছুই হয়নি।

গোটা দলটার আজ খুব মনখারাপ। তিনমাস পরে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা। আজ সকালে ফর্ম ফিল আপ হয়ে গেল। দুপুরে স্পেশাল কোচিংও শেষ। এবার যে যার মতো বাড়িতে বসে পড়াশোনা করবে, পরীক্ষা দেবে। তারপর আলাদা আলাদা জায়গায় ছড়িয়ে পড়বার পালা। এক-একজন এক-একটা কলেজে। এর মধ্যে আবার ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, আই আই টি আছে। আছে বাঙ্গালোরে কম্পিউটার, পুনেতে আইন পড়তে যাওয়া। এমনকী কেউ বিদেশেও চলে যেতে পারে। এককথায় ছোট্ট এই দলটা ভেঙে যাচ্ছে। সবাই ছিটকে যাচ্ছে। এই জন্যই আজ তাদের এত মনখারাপ। স্পেশাল ক্লাসের পর সাগরিকাদের বাড়িতে চলে এসেছে সবাই। তারপর সটান ছাদে। সকলেই ভেবেছিল, চমৎকার ছাতটায় কিছুক্ষণ বসলে মন খানিকটা হালকা হয়ে যাবে। উলটে আরও ভারী হয়েছে।

এমন সময় সাগরিকার উদ্ভট প্রস্তাব সবাইকে চনমনে করে দিল। চন্দভানু উঠে বসল। বলল, ‘দ্যাখ সাগরিকা, তুই পার্টি দেওয়ার কথা বলছিস। কিন্তু পার্টি তো হয় আনন্দের সময়। যেমন ধর, জন্মদিনের পার্টি, বিয়ের পার্টি, ভাল রেজাল্টের পার্টি, বিদেশে পড়তে যাওয়ার পার্টি। এরকম একটা বিচ্ছিরি সময়ে পার্টি হলে সেটা কি মানাবে?’

বৈশাখী বলল, ‘আলবাত মানাবে। এটা হবে মনখারাপের পার্টি।’ অম্বরীশ উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, ‘বাঃ কথা-রানি এত ভাল কথা বলেছে! মনখারাপের পার্টি। আমাদের মনখারাপ, তাই আমরা দেব মনখারাপের পার্টি।’

অতীশ হাতের খাতা বন্ধ করে বলল, ‘জমে যাবে। কিন্তু পার্টিটা হবে কোথায়? এই ছাদে? আমাদের প্রকৃতিপ্রেমিকা কী বলছেন? জায়গা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে ওনার মতটা আগে জানা জরুরি।’

অতীশের খোঁচায় তন্দ্রা একটুও রাগল না। প্রকৃতির সঙ্গে তার নাম জড়ালে সে সবসময়ই খুশি হয়। তবে রাগের ভান করে সে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আমার তো মনে হয়, সাগরিকা যে-পরিকল্পনার কথা বলছে, তাতে ছাদে এই পার্টি হতে পারে না। এই পার্টির জন্য একটু জল চাই।’

চন্দনা উৎসাহের সঙ্গে বলল, ‘জল? তার মানে তুই নদীর কথা বলছিস? নদীর ধারে যাব?’

তন্দ্রা আরও গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, ‘না, নদীর কথা বলছি না। তুই চুপ করবি? তোদের এই হল মুশকিল। নেচার আর মানুষের সম্পর্ক নিয়ে তাদের কোনও ধারণা নেই। নদীর ধারের পার্টি হয় আনন্দের। মনখারাপের উৎসব হবে শান্ত নির্জন কোনও দিঘির পাশে। সেই দিঘির জলে মাঝে মাঝে গাছের পাতা পড়বে। আর টুপটুপ করে শব্দ হবে।’ চঞ্চল হাততালি দিয়ে উঠল। বলল, ‘বিউটিফুল। দিঘির ধারে বসে আমরা গলা জড়িয়ে খুব খানিকটা কান্নাকাটি করব। চোখের জলে দিঘির দু’পাড় ভেসে যাবে।’

মল্লিকা বলল, ‘শুধু জল হলেই হবে?’

তন্দ্রা চোখ পাকিয়ে বলল, ‘আবার বোকামি? শুধু জল হলেই হবে কেন? আমরা কি সাঁতার কাটতে যাচ্ছি? আমাদের চাই একটু বাগান, একফালি লন, আর হ্যাঁ, মনখারাপের পার্টিতে গাছের ছায়া মাস্ট। যেখানে যাব, সেখানে বড় বড় কয়েকটা গাছ লাগবে।’

প্রবাল বলল, ‘বাপ রে, এতসব কোথা থেকে পাব রে? তোর লিস্ট তো বিরাট দেখছি। পার্টি মনে হচ্ছে করা যাবে না।’

সাগরিকা বলল, ‘নিশ্চয়ই, আমার ছোটমামার বারাসতের বাগানে করা যাবে। সেখানে দিঘি পাওয়া যাবে না, তবে পুকুর আছে। তিন বছর আগে আমরা গিয়েছিলাম। পুকুরটা কিন্তু বেশ বড়। পুকুরে হবে না তন্দ্রা?’ কল্যাণ লাফিয়ে উঠল। চিৎকার করে বলল, ‘চমংকার, দুর্দান্ত! সাগরিকা, তুই ছোটমামার টেলিফোন নাম্বার বল। চঞ্চল, মোবাইলটা দে তো।’ চুপ-সুন্দরী চন্দনা এবার একটা কাণ্ড করে বসল। তার খাতাবই-ঠাসা ব্যাগ হাতড়ে একটা নীল রঙের মোবাইল ফোন বের করল। তারপর লজ্জালজ্জা মুখ করে বলল, ‘এই নে কল্যাণ। আমিও একটা ফোন নিয়েছি। বাড়িতে ফোন নেই, খুব অসুবিধে হচ্ছে। সাজেশন, নোটস কিছুই জানতে পারছি না।’

সবাই ভারী অবাক হল। যে এমনিতেই কথা বলতে চায় না, সে মোবাইল ফোনে কার সঙ্গে কথা বলবে? সাগরিকা চোখ পাকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁরে, কী ব্যাপার? কার সঙ্গে ফিসফিস হবে?’

চন্দনা কি একটু লজ্জা পেল? মনে হয় পেল। লজ্জা পেলে ওর বাঁ গালে একটা টোল পড়ে।

দশ মিনিটের মধ্যে ছোটমামার বাগানে ব্যবস্থা হয়ে গেল। রবিবার সকালে পৌঁছে গেলেই হবে। সাগরিকা বলল, ‘পুকুরটা আছে তো মামা? নাকি বুজিয়ে দিয়েছ? পুকুর না থাকলে কিন্তু যাব না।’

ছোটমামা বললেন, ‘শুনে হাঁ হবি, না দেখে হাঁ হবি?’

সাগরিকা বলল, ‘না, শুনব না। আমরা দেখেই হাঁ হতে চাই।’

সত্যিই দেখে হাঁ হয়ে গেল সবাই!

রবিবার ঠিক সকাল দশটায় বারাসাত রেল স্টেশন থেকে রওনা দিয়ে ছ’টা সাইকেল রিকশা এসে থামল উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাগানের গেটে। ভিতরে ঢুকতেই বোঝা গেল মনখারাপের পার্টির জন্য জায়গা বাছাই মনের মতো হয়নি। হয়েছে স্বপ্নের মতো। বড় বড় আমগাছে গোটা বাগানটাই ছায়ায় ভরা। আর এত বড় যে, কিছুক্ষণের জন্য দল ছেড়ে হারিয়েও যাওয়া যাবে। বাগানের ঠিক মাঝখানে মস্ত একটা পুকুর। পাতা পড়ার শব্দ না হলেও সেই পুকুরের জলে সরসর করে হাওয়া বয়ে যাওয়ার আওয়াজ হচ্ছে।

যেটা দেখে চন্দ্রভানু আর সাগরিকা হাত ধরাধরি করে নাচতে শুরু করল, সেটা হল একটা ঘাট। পুকুরের একদিকে ঝকঝকে তকতকে এই ঘাটটার কথাই ছোটমামা নিশ্চয়ই বলছিলেন। একেবারে আঁকা ছবির মতো। লাল সিমেন্টে বাঁধানো। চওড়া চওড়া সিঁড়ি নেমে গেছে একদম জল পর্যন্ত।

চঞ্চল ঘোষণা করল, ‘ওয়ান্ডারফুল, এই ঘাটে বসেই আমাদের পার্টি হবে।’

বৈশাখী তার ঝোলা থেকে চাদর বের করে পাততে গেল। তন্দ্রা বলল, ‘খেপেছিস? পুকুরঘাটে কেউ চাদর পেতে বসে? প্র্যাকটিকাল পরীক্ষাগুলোতে সবসময় বেশি নম্বর পাস বলেই তোর প্র্যাকটিকাল সেন্স এত কম। আমাকে দ্যাখ, ঘাটে বসতে হয় এইভাবে পা ছড়িয়ে।’

সাগরিকার এইসব পছন্দ হচ্ছে না। মনখারাপের পার্টি কেমন হবে সে সম্পর্কে সাগরিকা অনেক মাথা ঘামিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করেছিল। সেই পরিকল্পনায় নাচ, গান, ছড়ার মতো সহজ বিষয় কিছুই ছিল না। ছিল সেরা শত্রু বাছাই, দু’বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা, আগামীদিনে কিছুতেই যোগাযোগ না করার শপথবাক্য পাঠ— এইসব কঠিন কঠিন জিনিস। ট্রেনে আসার পথে সেই কাগজ ছিঁড়ে জানলা দিয়ে ফেলে দিয়েছে চন্দ্রভানু। কল্যাণ তাকে সমর্থন করে বলেছে, ‘এটা জন্মদিনের পার্টি নয় যে, প্রথমে মোমবাতি জ্বালাও, তারপর কেক কাটো, তারপর হাততালি দাও, তারপর গান করো। এই পার্টিতে যা খুশি, তাই করা হবে। মনখারাপের পার্টি কোনও পরিকল্পনা মানছে না, মানবে না।’ সকল হইহই করে কল্যাণের সঙ্গে একমত হয়েছে। সাগরিকা চুপ করে গেছে। তার কাছে এখনও লুকোনো একটা পরিকল্পনা রয়েছে। পরিকল্পনা হিসেবে সেটা ভয়ংকর। এরা করুক গে এখন যা খুশি।

সেই ‘যা খুশি’ শুরু হয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল, অতীশ পুকুরঘাটের একেবারে শেষ সিড়িতে গিয়ে বসেছে। জুতো খুলে, জিন্‌স গুটিয়ে সে পা ডুবিয়েছে জলে। তারপর সেই অবস্থাতেই ব্যাগ থেকে খাতা বের করে অঙ্কে মন দিয়েছে। আসলে অতীশের ভাল লাগছে। এত ভাল লাগছে যে, মনে হচ্ছে এ-সময়, কঠিন ক্যালকুলাসগুলো একবার ঝালিয়ে না নেওয়াটা বড় বোকামি হয়ে যাবে।

তন্দ্রার কাণ্ড আরও জমজমাট। গতকাল কাউকে না জানিয়ে তন্দ্রা বার্ড ওয়াচার ক্লাব থেকে একটা দূরবিন জোগাড় করে এনেছে। পড়ার চাপে বহুদিন তার ভাল করে পাখি দেখা হয় না। আগামী কয়েকমাসও হবে না। তাই সে ঠিক করে ফেলেছে, আজ চোখ থেকে দূরবিন নামাবে না। কয়েকমাস আগে ইন্টারনেট ঘাঁটতে গিয়ে সে জেনেছে, দক্ষিণ আমেরিকার বিখ্যাত উইপিং বার্ডের দু’-একটা নাকি সমুদ্র পেরিয়ে এশিয়ার দিকে চলে এসেছে। টুকটুকে লাল মাথার এই ছোট্ট পাখিগুলো গোটা পৃথিবীতেই আছে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা। মজার ব্যাপার, নাম ‘কান্না পাখি’ হলেও এদের ডাক অনেকটা ছোট ছেলেমেয়েদের হাসির মতো! বারাসাতে দক্ষিণ আমেরিকার পাখি দেখতে পাওয়ার আশা খুব বিচ্ছিরি ধরনের পাগলামি। তন্দ্রা আজ সেই বড় পাগলামি করতে চায়। সে চেষ্টা করবে। দূরবিনটা গলায় ঝুলিয়ে তন্দ্রা ফাঁকা জায়গা খুঁজতে লাগল। পাখি দেখার সময় আশেপাশে কেউ থাকলে চলে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে জুতো খুলে, প্যান্ট গুটিয়ে তরতর করে একটা গাছে উঠে বসল।

মল্লিকার আশেপাশে কেউ নেই। তার মুখ ভার। সে চায় আজকের দিনটা প্রবাল তার পাশে পাশে থাকুক। এদিকটায় আসার আগে প্রবালকে গলা নামিয়ে ডেকেছেও। প্রবাল এখনও এল না। কেন এল না? এবার মল্লিকার রাগ হচ্ছে। ছেলেটা নিজেকে ভেবেছে কী? ও আই আই টি-তে চান্স পাবে আর কম্পিউটার নিয়ে পড়বে বলে কি মাথা কিনে ফেলেছে? নাকি পড়াশুনোয় ভাল ছেলেগুলোই এমন গাধা হয়? হায়ার সেকেন্ডারি শেষ হলেই মল্লিকা যে কলকাতায় মাসির বাড়ির পাট চুকিয়ে দুবাইতে বাবা-মা’র কাছে চলে যাচ্ছে, তা কি প্রবাল জানে না? অবশ্যই জানে। তা হলে? থাক, আসতে হবে না। প্রবালকে তো আর এমনি এমনি এই ফাঁকা জায়গায় সে ডাকেনি। কারণ আছে বলেই ডেকেছে। সেদিন যেটা দেবে বলেও দিতে পারেনি, সেটা আজ দেবে বলে ঠিক করেছিল। মুখ কালো করে ফিরে যাওয়ার জন্য রওনা হতেই দেখল প্রবাল মাথা নামিয়ে হেঁটে আসছে। মল্লিকা চট করে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।

সবচেয়ে ‘যা খুশি’ শুরু করেছে কল্যাণ। সে প্রবল উৎসাহে মাউথ অর্গান বাজাতে শুরু করেছে। শুধু বাজাচ্ছে না, নানা ধরনের ভঙ্গিমাও করছে। তার মধ্যে নাচের ভঙ্গিনাই বেশি। সাংঘাতিক ব্যাপার হল, মাউথ অর্গান থেকে এতখানি উৎকট আওয়াজ সে আগে কখনও বের করতে পেরেছে বলে মনে হয় না।

চমকপ্রদ ঘটনাটা ঘটল চঞ্চলের মোবাইল ফোনে। দুপুরে খেতে বসার একটু আগে। চঞ্চল বুঝতে পারছে, ঘটনাটা সত্যি নয়। এরকম কখনও হতে পারে না। তবু হল।

তার মনমেজাজ ভীষণ খারাপ। এখানে আসার পর সে দল থেকে একটু সরে আছে। নিয়মমতো এই সপ্তাহেই তাকে হস্টেল ছেড়ে দিতে হচ্ছে। চলে যেতে হবে আসানসোলে, নিজেদের বাড়িতে। আজ কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। সে ঘাসের উপর চিত হয়ে শুয়ে আছে। মনে হচ্ছে, এইভাবে ঘাসের উপর ঘন্টার পর ঘণ্টা চিত হয়ে শুয়ে থাকে। ইস, এতগুলো বন্ধুর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাচ্ছে। চোখদুটো বুজে আসছে। মন ভাল না থাকলে কি ঘুম পায়? কে জানে। হঠাৎই পাশে ফেলে রাখা মোবাইল ফোন বেজে উঠল। প্রথমবারটা চেনা রিংটোনে, কিন্তু তারপরেই সেই অসম্ভব ঘটনা! বাজছে তার প্রিয় গানের সুর। কী করে হল! রিংটোন বদলানোর ব্যাপারে চঞ্চল তো এখনও কিছুই করতে পারেনি। তবে কি বাজেনি? আধো ঘুমে ভুল শুনল সে? ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে মেয়েলি গলা ফিসফিস করে উঠল। বলল, ‘অ্যাই চঞ্চল, তুই কোনদিকে রে? অনেকক্ষণ ধরে খুঁজে পাচ্ছি না।’ এই মেয়েটা কথা কম বলে। তবু গলা চিনতে চঞ্চলের কোনও অসুবিধে হল না।

দুপুরের খাওয়া শেষের মুখে ঢাউস লাঞ্চ ব্যাগ থেকে একটা বড় আচারের শিশি বের করল বৈশাখী। শিশি-ভরতি চাইনি। বৈশাখীর ব্যাগ থেকে বেরোলেও এটাই সাগরিকার লুকিয়ে রাখা সেই ভয়ংকর পরিকল্পনা।

বৈশাখী বায়োলজিতে যেমন মারাত্মক, রান্নাতেও তেমন মারাত্মক। একটা মারাত্বক হল ভালর জন্য। এর মেডিক্যালে চান্স কেউ আটকাতে পারবে না। অন্য মারাত্মকটা খারাপের জন্য। ডিম সেদ্ধ আর পাউরুটি টোস্ট ছাড়া কোনও রান্নাই তার জানা নেই। তবু সে পরশুদিন ফোন করে সাগরিকার কাছে বায়না ধরল, একটা পদ তাকে রাঁধতে দিতেই হবে। আর তখনই সাগরিকার মাথায় পরিকল্পনা খেলে যায়। সে বলল, ‘পরীক্ষার মধ্যে আর রান্নাবান্নার ঝামেলায় যাচ্ছি না। হাত পুড়ে গেলে আর লিখতে পারব না। তাই লাঞ্চ দোকান থেকে কিনে পাক করে নেওয়া হচ্ছে। তবে তুই যখন এত করে বলছিস, তুই বরং টোম্যাটোর চাটনিটা করে নিয়ে আয়। হ্যাঁরে বৈশাখী, পারবি তো রে?’

বৈশাখী দারুণ উৎসাহে বলল, ‘খুব পারব। তুই শুধু রান্নার সময় টেলিফোনে একটু বলে দিবি।’ সেই একটু বলতে গিয়েই বড় কাজ সেরেছে সাগরিকা। ফাঁক বুঝে গুঁড়ো লঙ্কার মাপটা করে দিয়েছে তিনগুণ। মনখারাপের পার্টি হবে অথচ চোখ দিয়ে একটুও জল বেরোবে না, তা কী করে হয়?

অথচ আজ যে কী হয়েছে, সাগরিকার ঝাল পরিকল্পনা একেবারে মাঠে মারা গেল। অত ঝাল চাটনি খেয়েও সবাই খুশিতে হইচই লাগিয়ে দিল। মায় অম্বরীশ আর কল্যাণ তিনবার পর্যন্ত চেয়ে নিল!

বিকেল শুরু হয়ে গেছে। গোটা জায়গাটা হয়ে উঠেছে আরও ছায়াময়। পার্টির গোড়াতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লেও সময় যত শেষ হয়ে যাচ্ছে, সবাই যেন কেমন কাছাকাছি চলে আসছে। একটা সময় দেখা গেল, পুকুরঘাট গোল হয়ে বসেছে সকালে। অতীশ অঙ্ক খাতার পাতা উলটে বলল, ‘চট করে চাটনির রেসিপিটা বল দেখি বৈশাখী।

চন্দনা বলল, ‘তুই রেসিপি জেনে কী করবি?’

অতীশ বলল, ‘দ্যাখ চন্দনা, স্ট্যাটিসটিক্স বিষয়টা ঠিকমতো জানতে বাইরের কোনও ইউনিভার্সিটিতে আমাকে এবার যেতে হবেই। তখন বিদেশি বন্ধুদের এই চাটনি বানিয়ে খাওয়াব। তারা মুগ্ধ হয়ে যাবে। আমি গর্ব করে বলব, আমার এক রন্ধন পটিয়সী বান্ধবী এটা আবিষ্কার করেছে। তার নাম বৈশাখী। তখন তারা এটার নাম দেবে বৈশাখী পিক্‌ল।’ বৈশাখী খুব লজ্জা পেল, তা দেখে সবাই জোরে হেসে উঠল। এই হাসি আরও বেড়ে গেল, যখন তন্দ্রা জানাল, আজ সকালে পাখি দেখার সময়ে তার দূরবিন পাখি দেখানোর বদলে একটা রোমহর্ষক দৃশ্য দেখিয়েছে। সেই দৃশ্যে সবুজ সালোয়ার কামিজ পরা একটি মেয়ে একজন চুল উসকোখুসকো ছেলের গালে চুমু খাচ্ছিল। তবে ঘটনার বেশিরভাগটাই গাছের আড়ালে ঘটায়, মেয়ে বা ছেলেটিকে চেনা যায়নি। তন্দ্রার গল্প বলার ঢঙে সকলে হেসে গড়িয়ে পড়তে লাগল। অম্বরীশ উঠে দাঁড়াল এবং বলল, ‘বন্ধুগণ, ওরা কারা ছিল সে সম্পর্কে পরে আমাদের বিশদ তদন্ত করে দেখতে হবে। তবে সময় ফুরিয়ে এসেছে। একটু পরেই সন্ধে হয়ে যাবে। আমাদের পার্টি শেষ করতে হবে। তার আগে একটা সামান্য কাজ বাকি আছে। একটা ছোট্ট সংবর্ধনা অনুষ্ঠান, নাম ‘পরিকল্পনা-সংবর্ধনা’। মাননীয়া সাগরিকা দেবীকে আমি একটু উঠে দাঁড়াতে অনুরোধ করছি।’ সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। এবার যা কেউ ভাবতে পারেনি সেই ঘটনা ঘটল। অম্বরীশ সত্যি সত্যি তার ছবি আঁকার ঝোলা থেকে একটা বাঁধানো মানপত্র বের করল। সেখানে ভারী সুন্দর করে সাগরিকার নাম লেখা, পাশে লেখা— পরিকল্পনা বিদুষী! চন্দ্রভানু আর চঞ্চল লাফ দিয়ে উঠে সাগরিকাকে টেনে তুলল। চঞ্চল কলাণকে বলল, ‘এই গাধা, চুপ করে বসে আছিস যে? তোর হতচ্ছাড়া মাউথ অর্গানটা বাজাতে পারছিস না? বাজা, জোরসে বাজা।’

জিনিসপত্র গোছগাছ সারা। এবার উঠতে হবে। কেউ উঠতেই চাইছে না। ছেলেমেয়েগুলো আরও কাছাকাছি চলে এসেছে। কে জানে, হয়তো এরকমই হয়। দূরে যাওয়ার আগে মানুষ কাছে চলে আসে। ছাড়তে হবে জানলে কেউ কাউকে ছাড়তে চায় না। অদ্ভুত ব্যাপার হল, সেদিনের মতো আজও যেন বিকেল খানিকটা থমকে গেছে! সেই ‘আবার দেখা হবে’ রঙের আশ্চর্য আলোয় ভরে গেছে আকাশ। যেন বলছে, আরও একটু বোসো, তোমরা আরও একটু পাশাপাশি বোসো।

সাগরিকা বলল, ‘ওফ! তোরা থামবি এবার? এরকম হাসি শুনলে বাইরের লোকজন কিন্তু ঘাবড়ে যাবে। ভাবৰে দিনের আলোতেই বাগানে কয়েকটা হাসিভূত নেমে পড়েছে। এরপর থেকে ছোটমামার এই বাগানের নাম হয়ে যাবে হাসিভূতের বাগান।’ সবাই আরও জোরে হেসে উঠল।

মনখারাপের পার্টি হবে গম্ভীর মুখে। কিন্তু এরা এত হাসছে কেন? হাসতে হাসতে এদের চোখে জল চলে আসছে, তবু থামছে না। জল মুছে আবার হাসছে। আবার চোখ ভরে যাচ্ছে জলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *