মধ্যরাতের মস্কো
ব্যক্তিগত শোকাবহ ঘটনার গল্প দিয়ে দৈনিকের পাতা ভরাতে অভ্যস্ত নই আমরা রাশিয়ানরা। অনেকরকম দুঃখময় দুর্ঘটনা ঘটতে দেখা যায় অনেকের অদৃষ্টে। বহু হতভাগ্য নর-নারী নিছক উচ্চাশা অথবা তীব্র অনুভূতির তাড়নায় হরেকরকম অপরাধও করে ফেলে। ফলাও করে এই সব কাহিনির প্রচার আমরা করি না। এর চাইতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নিয়েই মাথা ঘামাতে হয় আমাদের। শুধু আমাদের জাতভাইদের দিক দিয়েই নয়, পৃথিবীর সব দেশের বাসিন্দাদের পক্ষেই গুরুত্বপূর্ণ এই সব সমস্যা। অনেক সমালোচকদের মতে ব্যষ্টির প্রতি অবহেলা থেকেই নাকি আমাদের এই ধরনের মতবাদ বা দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব হয়েছে। প্রকৃত সত্যটুকু কিন্তু ঠিক তার বিপরীত। আমরা বিশ্বাস করি, সামান্য কয়েকটা চোর-ছ্যাঁচোড়, খুনে-গুন্ডা, জালিয়াত-বদমাশ আর নারীধর্ষণকারীদের তৎপরতা আর তাদের সমুচিত দণ্ডদানের সমস্যাগুলোকে হারিয়ে যেতে দেওয়া উচিত নয়।
সে যাই হোক, সারা দুনিয়ার পুলিশ সহকর্মীর সঙ্গে আমার কর্মজীবনের সবচেয়ে মনে রাখবার মতো কাহিনি বলবার সুযোগ যখন আমাকেও দেওয়া হয়েছে, তখন সে সুযোগের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার আমি করব। শুনুন তবে এই ঘটনার বৃত্তান্ত।
১৯৫৫ সালের আগস্টের শেষাশেষি গ্রীষ্মের সেই রাতটার কথা এখনও ছবির মতোই মনে পড়ে আমার। রাতের তমিস্রা গাঢ় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিনের দাবদাহও কমে এসেছিল অনেকখানি। আমার অধীনস্থ মস্কো মেট্রোর একজন ইন্সপেক্টরের ডিউটি শেষ হওয়ায় বাড়ির দিকে রওনা হয়েছিল। আর্কাডি গুরেলভিচ মানুষটি বড় ভালো। কাজ-কর্মে তার জুড়ি মেলা ভার, কমরেড হিসেবেও চমৎকার। প্রতিবেশী হিসেবে এই রকম মানুষকেই সবাই পেতে চায় যে যার পল্লীতে। একই ফ্ল্যাট-বাড়িতে থাকতাম আমরা। পাঁচতলার আর্কাডি আর দোতলায় আমি সপরিবারে। একই আমোদ-প্রমোদ কেন্দ্রে খেলাধুলো করত আমাদের ছেলেমেয়েরা, একই স্কুলে পড়তে যেত সবাই দল বেঁধে। সভা-সমিতিতে, সিনেমা-থিয়েটারে, পাবলিক স্কুলের সামাজিক অনুষ্ঠানে একই সঙ্গে যেতাম আমরা দুই পরিবার।
বছর পঁয়তাল্লিশ বয়স আর্কাডির। দুনিয়ায় দুটি জিনিস তার দারুণ প্রিয়; একটি কম্যুনিস্ট পার্টি এবং অপরটি ফুটবল খেলা। আগস্টের সেই রাতে সাবওয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে যখন সে বাড়ির পথ ধরল, তখন ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। রাস্তার আলোগুলো অর্ধেক নিভিয়ে ফেলা হয়েছে। আলো অন্ধকার মিশানো জনহীন পথঘাটে প্রাণী বলতে সে তখন একা।
আচম্বিতে রাস্তার মোড় থেকে বাঁক নিয়ে টায়ারের তীব্র আর্তনাদ তুলে পথ ছেড়ে ফুটপাতের ওপর বেগে ধেয়ে গেল ছোট্ট একটা মোটরকার। সামনেই পড়ল আর্কাডি। এমনই প্রচণ্ড বেগে তার ওপর এসে পড়ল গাড়িটা যে আর্কাডির দেহটা ছিটকে গিয়ে আছড়ে পড়ল সামনের উইন্ডস্ক্রিনের ওপর–বলা বাহুল্য সেই প্রচণ্ড সংঘাতে স্ক্রিনের কাঁচও অটুট রইল না।
ধরা পড়ার ভয়ে গাড়ির গতি কমানো দুরে থাকুক, ক্ষিপ্তের মতো গাড়ি হাঁকিয়ে ছুটে চলল ড্রাইভার। সাংঘাতিকভাবে জখম আর্কাডির অচেতন দেহটা কিছু দূর পর্যন্ত গাড়ির সামনেই লেপটে ছিল, তারপর তা ঠিকরে পড়ল রাস্তার ওপর আমাদেরই ফ্ল্যাটবাড়ির প্রায় সামনেই। উল্কার মতো বেগে উত্তরদিকের শহরতলী অঞ্চলে দেখতে দেখতে অদৃশ্য হয়ে গেল বেপরোয়া গাড়িটা।
টায়ারের কর্কশ আর্তনাদের পরেই ধপ করে একটা চাপা শব্দ এবং পরক্ষণেই কাঁচভাঙার ক্ষীণ ঝনঝন্ আওয়াজ শুনেই আশপাশের বাড়ি থেকে জনাছয়েক স্ত্রী-পুরুষ বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। রাস্তার ওপর আহত আর্কাডিকে তারাই পড়ে থাকতে দেখে। একজন তখুনি আমার ফ্ল্যাটে দৌড়ে গিয়ে উত্তেজিতভাবে খবর দিলে যে সিরিয়াস অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে কমরেড গুরেলভিচের। তৎক্ষণাৎ ফোনে অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর নির্দেশ দিলাম। স্থানীয় পুলিশ স্টেশনেও খবর দিতে ভুললাম না।
বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি রাস্তার ওপরেই পড়ে রয়েছে আর্কাডি। একজন একটা ভারী কম্বল দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল তার সর্বাঙ্গ। এমনই নিথর হয়ে শুয়েছিল ও যে প্রথমে ভাবলাম বুঝি বৃথা চেষ্টা, ও দেহে আর প্রাণ নেই। কিন্তু ঝুঁকে পড়তেই লক্ষ্য করলাম খুব ক্ষীণভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস বইছে–তবে চেতনার কোনও লক্ষণ দেখলাম না রক্তাক্ত দেহে। মস্ত বড় একটা ক্ষতচিহ্ন দেখলাম মাথার খুলিতে। গা শিউরে ওঠে সেই বীভৎস চোট দেখলে।
মিনিট কয়েকের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স এবং অনেকগুলো পুলিশের গাড়ি উত্তেজিত এবং উদ্বিগ্ন প্রতিবেশীদের ভিড় ঠেলে পৌঁছে গেল দুর্ঘটনাস্থলে। স্বামীর নেতিয়ে পড়া দেহ স্ট্রেচারে উঠিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় হাউ-মাউ করে কাঁদতে লাগল আর্কাডির বউ।
অশ্রুসিক্ত সে কি কান্না। একজন মহিলা সযত্নে একটা শাল জড়িয়ে দিলে তার গায়ে। যথাসাধ্য সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল সবাই মিলে।
সাক্ষীদের সওয়াল জবাব শুরু করলেন পুলিশ অফিসাররা। কিন্তু আচম্বিতে ধেয়ে আসা গাড়ির গর্জন, টায়ারের তীব্র আর্তনাদ তুলে উধাও হয়ে যাওয়া এবং শীতার্ত রাস্তার ওপর মৃতপ্রায় অবস্থায় আর্কাডিকে পড়ে থাকতে দেখা ছাড়া নতুন কোনও খবরই কেউ শোনাতে পারলে না।
এ কেস সম্পর্কে ব্যক্তিগত এবং পেশাগত দুরকম আগ্রহই সমানভাবে জেগেছিল আমার মনে। তাই ঠিক করলাম পুলিশের গাড়ি নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের পিছু পিছু গোর্কি হসপিটালে যাব। উত্তরমুখো পথে রওনা হলাম আমরা।
দুর্ঘটনাস্থল থেকে প্রায় গোটা তিরিশ বাড়ি পেরিয়ে আসার পর একটা মেরামত এবং সারভিস স্টেশনের সামনে এসে পৌঁছোলাম। নতুন তৈরি হয়েছে স্টেশনটা। দেখেই আমার মাথায় একটা মতলব এল।
কমরেড, থামাও এখুনি।আচমকা হুকুম শুনেই কাঁচ করে ব্রেক টিপে ধরলে পুলিশ ড্রাইভার।
হাতে ফ্লাশলাইট নিয়ে অন্ধকার গলি পেরিয়ে গ্যারাজের পেছনে গাড়ি পার্ক করার জায়গায় পোঁছোলাম আমরা। আলোর সরু রশ্মি গিয়ে পড়ল একটা বেজায় জখম গাড়ির ওপর। টুকরো টুকরো হয়ে গেছিল গাড়িটার উইন্ডস্ক্রিন। আর টোল খেয়ে গেছিল সামনের হুড।
এখনও সে আবিষ্কারের কথা মনে পড়লেই ভাবি বাস্তবিকই সেদিন অদৃষ্ট সুপ্রসন্ন ছিল আমার। তা না হলে নিছক সাধারণ জ্ঞানকে সম্বল করে আততায়ীবিহীন গাড়িটাকে এত তাড়াতাড়ি এভাবে আবিষ্কার করতে পারতাম না আমি।
আরও কয়েক পা এগিয়ে যেতেই নিঃসন্দেহ হলাম আমরা। হ্যাঁ, একটাই সেই ধাক্কা মেরে উধাও হওয়া গাড়িই বটে। র্যাডিয়েটর তখনও গরম রয়েছে। হুডটার ঠিক মাঝখানের পাঁজরে লেগে রয়েছে আর্কাডির ফ্লানেল কোটের একটা ছিন্ন অংশ।
গাড়ির ওপর দিয়ে আলো বুলিয়ে নিতে গিয়ে এমনই একটা জিনিস নজরে পড়ল আমার যে তা দেখা মাত্র বিভীষিকা যেন সাঁড়াশি দিয়ে টিপে ধরল আমার হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনিকে। তারার মতো আকার নিয়ে ভেঙে গিয়েছিল কাঁচটা, আর, তার ঠিক মাঝখানে ভাঙা কাঁচের খাঁজে আটকে ছিল একটুকরো হাড়-মাথায় খুলির দশ সেন্টিমিটার লম্বা হাড়।
খুব সাবধানে হাড়টাকে খাঁজ থেকে উদ্ধার করে রুমালে মুড়তে যখন ব্যস্ত আমার কমরেড ততক্ষণে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিলাম আমাদের আবিষ্কারের বৃত্তান্ত। গাড়িটা পরীক্ষা করার জন্যে পুলিশের গাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থাও করলে সে। এরপর আমি ফোন করলাম হসপিটালে। বললাম, এখুন অপারেশন রুমে আসছি আমরা।
সাইরেনের আর্তনাদে রাত্রির নিস্তব্ধতাকে ফালাফালা করে বাকি পথটা যেন উড়ে এসে গোর্কি হসপিটালে পৌঁছোলাম আমরা। আমার জরুরি ডাকে বিলক্ষণ বিরক্ত হয়েছিলেন ডাক্তাররা। মরণোন্মুখ অপারেশন কেন যে স্থগিত রাখতে বলেছি তা তো তাঁরা জানতেন না।
হসপিটাল পৌঁছেই বললাম আর্কাডি আমার বিশেষ বন্ধু। তাই ভাবলাম ওর জীবনরক্ষার প্রচেষ্টার অপারেশন শুরু করার আগে এই জিনিসটা আপনাদের দেখালে হয়তো সত্যিই ওর কোনও উপকার করতে পারব আমি।
এমনভাবে ডাক্তারা তাকালেন যেন মস্তিষ্ক বিকৃত হয়েছে আমার আর তার পরেই একজন হাড় রুমালের মোড়ক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন–হবে হবে, এইতেই হবে।
হাড়টা তখুনি খুব সন্তর্পণে পরিষ্কার করে ফেললেন ওঁরা। পরে অপারেশন থিয়েটারে গিয়ে আর্কাডি গুরেলভিচের করোটির সঠিক জায়গাটিতে তা বসিয়ে বেমালুম জুড়ে দিলেন। তিন ঘণ্টা পরে অস্ত্রোপচার শেষ হল। তারপর একজন ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। আমি যেখানে ঠায় দাঁড়িয়েছিলাম এতক্ষণ, এসে দাঁড়ালেন সেখানে।
বললেন, কমিশনার, বিপদমুক্ত হয়েছেন আপনার বন্ধু। কিন্তু ওই হাড়টা না পাওয়া গেলে এ সুখবর হয়তো আপনাকে শোনাতে পারতাম না।
মিনিট দশেক পরেই আর একটা পুলিশের গাড়ি এসে পৌঁছোল হসপিটালের প্রাঙ্গণে। গোয়েন্দার কাছে রিপোর্ট পেলাম, গাড়িটার নাম্বার প্লেট থেকে ধাক্কা মেরে উধাও হওয়া ড্রাইভারকে সনাক্ত করতে পেরেছি আমরা। বাড়িতেই ছিলেন ভদ্রলোক। মদের নেশা তখনও তাঁর কাটেনি। পুলিশের কাছে বিনা দ্বিধায় সব স্বীকার করেছেন তিনি। পার্টির উচ্চপদস্থ কর্মচারি তিনি। তা সত্ত্বেও এই গুরুতর অপরাধের জন্য আইনের রক্ত চক্ষুকে তিনি এড়াতে পারেননি। মাথা পেতে নিতে হয়েছিল ধর্মাধিকরণের গুরুদণ্ড।
দ্রুত গোয়েন্দাগিরি এবং তার চাইতেও বেশি কপালজোর–এই দুইয়ের ফলে এ-কেসে রক্ষা পেয়েছিল একজনের জীবন। অন্যান্য দেশে রাশিয়ান পুলিশদের বড় দুর্নাম আছে। তারা নাকি সোভিয়েট ইউনিয়নের যারা শত্রু তাদের গ্রেপ্তার করা এবং হনন করা ছাড়া অন্য কোনও বিষয়েই আগ্রহী নয়। কিন্তু আমি বলব দুনিয়ার যেখানে যত পুলিশ আছে তাদের সঙ্গে আমার এবং আমার সহ-কর্মীদের কোনও প্রভেদই নেই। আমরা সবাই সমান, একই আমাদের দায়িত্ব। কোনও জীবন বিনষ্ট করার চাইতে সে জীবন রক্ষা করার জন্যে হাজার রকম প্রচেষ্টা করতে আমরা দ্বিধা করি না।
* গ্রেগরী আরেকী (রাশিয়া) রচিত কাহিনি অবলম্বনে।