মধ্যযুগের বাঙলায় মুসলিম-রচিত তত্ত্বসাহিত্য
চলমান জীবন প্রতিমুহূর্তে বিচিত্রভাবে নিজেকে প্রকাশ করে চলে। কাজেই কোনো ছকে ফেলে তাকে বিচার করা চলে না। এ-কথা কেবল ব্যক্তি সম্পর্কে নয়, জাতির জীবন সম্বন্ধেও সত্য। সমাজনীতি ধর্ম-বিধি রাষ্ট্রসংস্থা ইতিহাস দর্শন বিজ্ঞান শিল্প স্থাপত্য ভাস্কর্য সাহিত্য সঙ্গীত পোশাক আচার আচরণ প্রভৃতি সাধারণভাবে সমাজের বা জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতির পরিচায়ক ও পরিমাপক বলে স্বীকৃত হয় বটে, তবু বিভিন্ন ক্ষেত্রের সুস্পষ্ট সামগ্রিক ধারণা পাওয়া দুঃসাধ্য। কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে একটা জাতির পূর্ণ পরিচয় যেহেতু নিবদ্ধ নেই, সামগ্রিক স্বরূপে কোনো জাতিকে চিহ্নিত করাও তাই অসম্ভব। তবু মানুষের বোধের ও আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে তার জাতিক চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ের রেওয়াজ চালু আছে। এতে অন্তত আমাদের ব্যবহারিক প্রয়োজন মেটে।
জাতির পরিচয়-ক্ষেত্রে সাহিত্যকে অন্যতম প্রধান উপাদান মনে করা হয়। কেননা জীবন একান্তই স্থান-কাল ভিত্তিক। কাজেই মানুষের দেহমন গড়ে তোলে পরিবেশ। আর মানুষের অন্তরের অকপট অনুভূতি ও উপলব্ধির সুন্দরতম ও নিবিড়তম প্রকাশ ঘটে সাহিত্যে। সাহিত্য মানুষের বোধ-বুদ্ধির অবিকৃত প্রতিরূপ। তাই একে জাতীয় জীবনের মুকুর বলা হয়। যে-কোনো ঐতিহ্য ক্ষেত্রবিশেষে মানুষের প্রেরণার উৎস, কর্মের দিশারী ও মর্মের পরিচায়ক হয়। সাহিত্যে মানুষের মর্মলোকের স্বরূপ বিধৃত থাকে বলে মানুষের অন্তসত্তার পরিচায়করূপে সাহিত্যকেই বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়। আর মানুষের আচরণে ও মননে স্থানিক ও কালিক ছাপ না-থেকেই পারে না। কাজেই প্রাচীন রচনামাত্রেই সমাজ-সংস্কৃতির কিংবা মন-মননের ঐতিহাসিক উপাদান। এতে সাহিত্যগুণ থাকে তো ভালো, না থাকলেও ক্ষতি নেই।
বাঙলা দেশে মুসলমানের প্রায় হাজার বছরের বাস। কালক্রমে তারা দেশে সংখ্যাধিক্যও লাভ করেছে। এবং এ কথাও এখন আর কেউ অস্বীকার করে না যে, শতকরা নব্বই জন মুসলমানই দেশজ। কাজেই মুসলমান সুলতান-সুবাদারের প্রতিপোষকতায় যে বাঙলা ভাষার চর্চা ও সাহিত্য-সৃষ্টি শুরু হল, তাতে মুসলমান সাগ্রহে শরিক হয়নি–এ-কথা ভাবার কোনো সঙ্গত কারণ নেই।
অতএব গত পাঁচশ বছরে মুসলমানের রচনা পরিমাণে অমুসলমান বাঙালির রচনার চাইতে কম হওয়ার কথা নয়। এ পাঁচশ বছরে কোটি কোটি মুসলমান কত বিচিত্রভাবে জগৎ ও জীবনকে প্রত্যক্ষ করেছে তাদের কারো কারো কত জিজ্ঞাসা কত উপলব্ধি, কত বিচিত্র আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনা নানাভাবে অভিব্যক্তি লাভ করেছে রচনার মাধ্যমে। গোটা বাঙলা দেশে ছড়িয়ে ছিল মুসলমানদের এসব রচনা। সগ্রহ ও সংরক্ষণের অভাবে এর এক বিপুল অংশ লোপ পেয়েছে। অবশিষ্টটকুও লোপ পেতে বসেছে। মরহুম আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক, জনাব আলী আহমদ ও বাঙলা একাডেমী পুঁথি সুগ্রহ করেছেন কেবল চট্টগ্রাম বিভাগ থেকেই। কাজেই বাঙলার অন্যান্য অঞ্চলের রচনার খোঁজ আজো বিশেষ নেয়া হয়নি।
তবু একটিমাত্র অঞ্চলে সংগৃহীত রচনারও বিষয় বৈচিত্র্য আমাদের মুগ্ধ করে। প্রণয়োপাখ্যান, চরিতাখ্যান জ্যোতিষ, সঙ্গীত, মরমিয়া, মর্শিয়া, ধর্মশাস্ত্র, অধ্যাত্মতত্ত্ব ইতিহাস প্রভৃতি বাঙলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা সৃষ্ট ও পুষ্ট হয়েছে মুসলমানের দানে।
সব রচনায় অবশ্য সাহিত্য-রস মিলবে না, কিন্তু মানুষের প্রাণের পরশ পাওয়া যাবে এতে। কেননা লেখার পেছনে রয়েছে মানুষ, আর মানুষ প্রাণ-মন বিহীন নয়।
আমাদের তত্ত্বসাহিত্যে জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে মানবমনের চিরন্তন জিজ্ঞাসার মনোময় উত্তর খোঁজা হয়েছে। মানুষের মনে জগৎ ও জীবন সৃষ্টির রহস্য এবং জগৎ ও জীবনের মহিমা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে যে চিরন্তন ও সর্বজনীন প্রশ্ন রয়েছে, তারই জবাব খোঁজার প্রয়াস আছে এতে। কেতাবীদের বিশ্বাস, হযরত মুসা তুর পর্বতে বসে আল্লাহর কাছে প্রশ্ন করে জগৎ ও জীবনের নানা তত্ত্ব জেনে নিতেন। সাইত্রিশ শ বছর আগেকার হযরত মুসার সে তত্ত্বালোচনা আজো প্রাকৃত মনের কৌতূহলাবেগ তৃপ্ত করে। বাস্তবধর্মী শক্তিমানের যে জিজ্ঞাসা মানুষকে বিজ্ঞানী করেছে, ভাববাদী দুর্বলকে তাই করেছে তাত্ত্বিক ও দার্শনিক।
তত্ত্বচিন্তা মানুষকে তিনটে মার্গের সন্ধান দিয়েছে : জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি মার্গ। জ্ঞানবাদ আস্তিক্য, নাস্তিক্য ও সংশয়প্রবণ দর্শনের জন্ম দিয়েছে। কর্মবাদ সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রবিধি গড়ে তুলেছে। আর ভক্তিবাদ হয়েছে নিষ্ঠা ও বৈরাগ্যের উৎস এবং ভক্তিবাদের উপজাত (by product)–কারো কারো মতে পরিণতি হচ্ছে প্রেমবাদ।
বাঙলা ভাষায়ও এই তত্ত্বজিজ্ঞাসা তিন ধারার সাহিত্য সৃষ্টির উৎস হয়েছে : এগুলো ধর্মসাহিত্য, তত্ত্বসাহিত্য ও সাধন সাহিত্য।
ক. ধর্মসাহিত্যে উল্লেখ্য হচ্ছে :
নেয়াজ ও পরাণের (১৭ শতক) কায়দানি কেতাব, খোন্দকার নসরুল্লাহর (১৭ শতক) হেদায়তুল ইসলাম, শরীয়নামা, শেখ মুতালিবের (১৬৩৯ খ্রী.) কিফায়তুল মুসল্লিন, আলাউলের (১৬৬৪ খ্রী.) তোহফা, খোন্দকার আবদুল করিমের (১৮ শতক) হাজার মাসায়েল, আশরাফের (১৭ শতক) কিফায়তুল মুসল্লিন, আবদুল্লাহ (১৮ শতক) নসিয়ত নামা, কাজী বদিউদ্দীনের (১৮ শতক) সিফৎ-ই-ইমান, সৈয়দ নাসির উদ্দিনের (১৮ শতক) সিরাজ ছবিল, মুহম্মদ মুকিমের (১৮ শতক) ফায়দুল মুবদী, বালক ফকীরের (১৮ শতক) ফায়দুল মুবদী, সৈয়দ নুরুদ্দীনের (১৮ শতক) দাকায়েকুল হেকায়েক রাহাতুল কুলুব, মুহাম্মদ আলীর (১৮ শতক) হায়রাতু ফেকাহ, হায়াৎ মাহমুদের (১৮ শতক) হিতজ্ঞানবাণী, আফজল আলীর (১৮ শতক) নসিয়ত নামা প্রভৃতি।
খ. তত্ত্বসাহিত্যে পাই : হাজী মুহম্মদের (১৬ শতক) নূর জামাল, মুহম্মদ আকীলের মুসানামা, খোন্দকার নসরুল্লাহর মুসার সাওয়াল, শেখচাঁদের (১৬ শতক) শাহদৌলাপীর বা তালিবনামা, আবদুল হাকিমের (১৬ শতক) শিহাবুদ্দিন নামা, আলী রজার (১৮ দশক) সিরাজকুলুব, আগম ও জ্ঞানসাগর; শেখসাদীর (১৭ শতক) গদামল্লিকা, সেরবাজ চৌধুরীর ফরনামা বা মল্লিকার সওয়াল, এতিম আলমের (১৮ শতক) আবদুল্লাহর হাজার সওয়াল, সৈয়দ নুরুদ্দীনের মুসার সওয়াল, বুরহানুল আরেফিন, অ-জানা কবির মুসার রায়বার, হোরান জরীপ (সম্ভবত পুরাণ জরীপ) মীর মুহম্মদ শফীর (১৭ শতক) নূর নামা, কাজী মনসুরের (১৮ শতক) সিনামা অজ্ঞাতনামা কবির মুসা পয়গাম্বরের কেচ্ছা, শেখ জেবের আগম, শেখ জাহেদের আদ্য পরিচয়, রমজান আলীর আদ্যক্ত প্রভৃতি। গ. সাধনসাহিত্য : ভক্তিবাদে রয়েছে দ্বৈতরূপ–সাধন ও ভজন। সাধনস্তরে সূফী ও যোগতত্ত্বের মিশ্রণ ঘটেছে। সাধন গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখ্য শেখ ফয়জুল্লহর (১৬ শতক) গোরক্ষ বিজয়, সৈয়দ সুলতানের (১৫৮৪-৬৮ খ্রী.) জ্ঞান প্রদীপ, অজানা কবির যোগকলন্দর, আবদুল হাকিমের চারি মোকাম ভেদ শেখ চান্দের হর গৌরী সম্বাদ, মোহসিন আলীর মোকাম মঞ্জিলের কথা প্রভৃতি। আর ভজন সংগীতরূপে পাচ্ছি : রাধাকৃষ্ণরূপক গীত, বাউল ও মুর্শিদী গান।